রাত্রে বিছানায় শুইয়া যখন ঘটনাটি আগাগোড়া আলোচনা করিয়া দেখিলাম তখন ব্যাপার বড় কৌতুকপ্রদ বলিয়া বোধ হইল না। একজনকে জব্দ করিতে গিয়া ঘটনাচক্রে আমরাই জব্দ হইয়া গেলাম। এখন ঘোর সঙ্কট। সরস্বতী সেই কাল্পনিক প্ৰেম-কবিতা পড়িয়া যদি ঘুনাক্ষরে জানিতে পারে যে ইহা আমার কাজ তাহা হইলে অনর্থ ঘটিবে। দাদা এ কলঙ্ক হইতে উদ্ধার পাইলেও পাইতে পারেন, কিন্তু আমার নিষ্কৃতি নাই। দুশ্চিন্তায় আমার মাথার ভিতরটা আগুন হইয়া উঠিল। কিন্তু আত্মরক্ষার কোন উপায় খুঁজিয়া পাইলাম না। ছিছি, করিয়াছি কি? একটি কুমারী মেয়ের সর্বনাশ করিতে বসিয়াছি? এখন যদি এই কথা কোনক্রমে প্রকাশ হইয়া পড়ে, লোকে কি মনে করিবে? মুখে কিছু বলুক বা না বলুক মনে মনে নিশ্চয় ভাবিবে যে সরস্বতী সত্যই দাদাকে চিঠি লিখিয়াছিল। এখন দুনামের ভয়ে স্বীকার করিতেছে না। অথচ সে বেচারী নিষ্পাপ। আমি এই অপরাধের জন্য নিজেকে ক্ষমা করিতে পারিলাম না। নিজের নিবুদ্ধিতার উপর সহস্ৰ সহস্র অশনিসম্পাত কামনা করিতে করিতে সমস্ত রাত্রি আমার ঘুম হইল না।
পরদিন বেলা প্ৰায় আটটার সময় দাদা যখন পাঠে মনোনিবেশ করিবার জন্য বিবিধ চেষ্টা সত্ত্বেও কৃতকার্য হইতেছিলেন না, তখন আমি গিয়া বলিলাম, দাদা, কাল কোন জায়গাটায় তোমায় ষাঁড়ে তাড়া করেছিল?
দাদা শুষ্কমুখে উত্তর করিলেন, ওই পুব দিকের মোড়ের ওপর।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, পাম্পসুও সেইখানেই হারিয়েছ, না?
উত্তরে দাদা শুধু ঘাড় নাড়িলেন।
তখন আমি কর্দমপরিপুষ্ট জুতার পাটিটা বাহির করিয়া বলিলাম, তাহলে এখান ক্ষিতীনবাবুর বাড়ির পিছনে কি করে গেল?
দাদার মুখ শুকাইয়া গেল। দুবার ঢেকে গিলিয়া বলিলেন, তইতো—কি করে গেল!
জুতাটা এককোণে ফেলিয়া দিয়া আমি তাঁহার সম্মুখে একটা চেয়ারে বসিয়া বলিলাম, মিথ্যে কেন আমার কাছে লুকোচ্ছ দাদা। তার চেয়ে আমার কাছে সব কথা খুলে বল না। আমি যদি কিছু করতে পারি। আমি কাউকে বলব না।
দাদা কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন, তারপর ভগ্নস্বরে বলিলেন, কাউকে বলিস না।
তারপর তিনি যাহা বলিলেন, তাহার মর্ম এই : সরস্বতী তাঁহাকে এসেন্স মাখানো কাগজে কবিতায় চিঠি দিয়াছিল; সেই চিঠির নির্দেশ অনুসারে তিনি কাল রাত্রে সরস্বতীর বাড়ির পিছনে গিয়াছিলেন। সরস্বতীও সেখানে ছিল। কিন্তু চিঠির কথা শুনিয়া সে আকাশ হইতে পড়িল। তারপর চিঠিখানা লইয়া চলিয়া গেল। এমন সময় গাছ হইতে ইত্যাদি।
বিবরণ শেষ হইলে দাদা একটু বিষাদের হাসি হাসিয়া বলিলেন, Frailty, thy name is woman!
যতদূর বিস্মিত হওয়া স্বাভাবিক ততদূর বিস্মিত হইয়া গল্প শুনিতেছিলাম; এখন দাদার দুঃখে৷ বাস্তবিক দুঃখিত হইয়া বলিলাম, কেমন, প্রেমের নেশা ছুটেছে তো?
এইবার দাদা ভয়ঙ্কর উত্তেজিত হইয়া উঠিলেন। সোজা হইয়া বসিয়া প্ৰদীপ্ত কণ্ঠে বলিলেন, তুমি কুল করছি। সন্তোষ! তুমি মনে করছি আমি একটা অন্ধ মোহ বা আর কিছুর বশবর্তী হয়ে তাঁর প্রতি অনুরক্ত হয়েছি। কিন্তু তোমার মত ভুল বোধহয় কেউ কখনো করেনি। তুমি কি মনে কর কাল তিনি আমায় প্রত্যাখ্যান করেছেন বলেই আমার সমস্ত প্ৰেম লুপ্ত হয়ে গেছে? না; বরং তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা শতগুণ বেড়ে গেছে। তাঁর এই শিক্ষা আমি জীবনে ভুলব না। তিনি শিখিয়েছেন যে ভালবেসে প্রতিদান চাইতে নেই। আমরা লেখাপড়া শিখেছি, বড় বড় আইডিয়া মনের মধ্যে ধারণা করতে চেষ্টা করি, কিন্তু একথাটা পূর্বে কখনো ভাবতে পারিনি। তার কারণ কি জান? কারণ-মানুষের মন বড় প্রবল-বড় স্বার্থপর! তাই একগুণ দিয়ে দশগুণ পেতে চায়। আর স্বার্থের মোহে সহজবুদ্ধিটুকুরও গলা টিপে ধরে। বলিতে বলিতে দাদার স্বরা যেন নিভিয়া আসিল।
আমার অত্যন্ত অনুশোচনা হইল। ইচ্ছা হইল সব কথা বলিয়া ফেলি। কিন্তু তাহাতে আরও বিপদ। সরস্বতী চিঠি লেখে নাই জানিতে পারিলে দাদার যন্ত্রণা যে কতদূর বাড়িয়া যাইবে তাহা বলা : একটা মন লইয়া বারবার কৌতুক করিতে ইচ্ছা হইল না। কারণ নিজের মনও খুব suস্থ ছিল না।
ঠিক সেই সময় বৌদিদি প্রবেশ করিয়া একটু যেন হাসি-হাসি সুরে বলিলেন, কি হচ্ছে তোমাদের ঠাকুরপো?
কথাগুল দাদাকেই সম্বোধন করা হইয়াছিল। তিনি কাষ্ঠহাসি হাসিয়া বলিলেন, ও কিছু নয় বৌদি—
বৌদিদি হাস্যচঞ্চল চোখে ভুভঙ্গি করিয়া বলিলেন, তবু শুনিই না।
বৌদিদির ধরন দেখিয়া বোধ হইল হয়তো দাদার উত্তেজিত বক্তৃতা শুনিয়াছেন। কিন্তু সহসা ধরা দেওয়া হইবে না। অথচ মেয়েমানুষের কাছে টিলা হইলেই ধরা পড়িবার ভয়। তাই একটু তীব্ৰকণ্ঠে বলিলাম, বললে কি বুঝতে পারবে বৌদি! এসব ফিলজফির কথা।
বৌদিদি এবার গভীর হইলেন, বলিলেন, তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন বলে আমার ভালবাসা একটুও কমে যায়নি, ভালবেসে প্রতিদান চাইতে নেই,-এইসব বুঝি তোমাদের ফিলজফির কথা।
দাদা বুকে ঘাড় গুঁজিয়া চুপটি করিয়া বসিয়া রহিলেন। আমিও মনে ভারি অস্বচ্ছন্দতা অনুভব করিতে লাগিলাম। কিন্তু তথাপি ছাড়িবার পাত্র নয়। বলিলাম, নিশ্চয়। মনের বৃত্তিগুলিকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করার শাস্ত্ৰই তো—
বৌদিদি মুখ আরও গভীর করিয়া বলিলেন, তবে ঠাকুরপো, তোমাদের ও শাস্ত্র পড়ে কাজ নেই। তোমরা ছেলেমানুষ, শেষে মাথা বিগড়ে যাবে।
আমি হাসিয়া ফেলিলাম। বলিলাম, দেখ, বৌদি, তোমার সবরকম ভণ্ডামি সইতে পারি। কিন্তু ওই গাষ্ঠীর মুখ সইতে পারি না। গাভীর্য তোমার মুখে একটুও মানায় না।
বৌদিদিও হাসিয়া ফেলিলেন, কহিলেন, বেশ মানি। কিন্তু মিথ্যে কথাও তোমাদের মুখে একটুও মানায় না-বলতে গেলেই ধরা পড়ে যাও। মেজ ঠাকুরপো যে জোরে বাগিতা করছিলেন, বাইরের ঘর থেকে বাবাও বোধহয় দুএক কথা শুনে থাকবেন।
দাদা অত্যন্ত শঙ্কিত হইয়া আমার মুখের দিকে চাহিলেন। আমি ইঙ্গিতে তাঁহাকে শান্ত হইতে বলিলাম। কারণ বাবা যে কিছু শুনিতে পান নাই। ইহা নিশ্চিত! একবার মক্কেল-পরিবৃত হইয়া বসিলে বাজনাদিও তাঁহার কানে যাইত না।
বৌদিদি বলিলেন, এখন লক্ষ্মী ছেলের মত বলে ফেল তো ব্যাপারটা কি। আমার যতদূর সন্দেহ হয় কাল রাত্তিরের ঘটনার সঙ্গে এর কোন সংস্রব আছে।
দাদা অত্যন্ত ভীত হইয়া পড়িলেন। কোনক্রমে তাঁহাকে আশ্বস্ত করিয়া বলিলাম, দাদা, মা ভৈঃ, বৌদিকে সব কথা বলে ফেলা যাক। তারপর যা হয় হবে। আর না বলেই বা কঃ পন্থা।
দাদা অগত্যা রাজী হইলেন। তখন আমি বৌদিদিকে টানিয়া আর একটা ঘরে লইয়া গিয়া সমস্ত খুলিয়া বলিলাম। নিজের দুস্কৃতির কথা কিছুমাত্র গোপন করিলাম না। সমস্ত শুনিয়া বৌদিদি গালে হাত দিয়া ভাবিতে বসিলেন।
কিছুক্ষণ ভাবিয়া বলিলেন, ঠাকুরপো, কাজটা ভাল হয়নি। সরস্বতী বড় চালাক মেয়ে, সে এ বিষয় নিয়ে গোলমাল করবে না। কিন্তু এ যে তোমার কাজ তা সে কবিতা দেখেই বুঝবে। সেটা কিন্তু ভাল হবে না ভাই। তার চেয়ে তুমি গিয়ে তার কাছে নিজের সমস্ত দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে এস। তাহলে সে সহজে তোমায় ক্ষমা করতে পারবে। আর তোমার দাদার কথা-সে। আমি আরো ভেবে দেখব।
ভাবিয়া চিন্তিয়া বৌদিদির কথামতই কাজ করা সমীচীন বোধ করিলাম। আরও মনে মনে স্থির করিলাম নিজের জন্য মার্জনা তো চাহিবই, সেই সঙ্গে দাদার মার্জনাটাও স্বীকার করাইয়া লইব।
বৈকালে আন্দাজ পাঁচটার সময় দাদাকে লইয়া বাহির হইলাম। বলিলাম, চল দাদা, একটু বেড়িয়ে আসা যাক।
দাদা উদাসভাবে বলিলেন, কোথায় যাবে?
আমি বলিলাম, চলই না। একটু নিৰ্মল বায়ু সেবন করে আসবে।
দাদা আর আপত্তি করিলেন না। সময় সময় মানুষের মনের এমন অবস্থা হয় যখন কাহারও তুচ্ছ কথাটিরও প্রতিবাদ করিবার প্রবৃত্তি হয় না। অতএব আমরা দুজনে বাহির হইলাম।
যখন ক্ষিতীনবাবুর ফটকের মধ্যে প্রবেশ করিলাম তখন দাদা থমকিয়া দাঁড়াইলেন। আমি বলিলাম, ওকি, দাঁড়ালে কেন, চলে এস না।
দাদার মুখ-চোখ লাল হইয়া উঠিয়াছিল। তিনি বলিলেন, এই বুঝি নির্মল বায়ু সেবনের জায়গা?
আমি কোনরকমে দাদাকে টানিয়া বাগান পার হইয়া বাড়ির সম্মুখে উপস্থিত হইলাম। বাড়িতে ঢুকিতেই বৈঠকখানা সম্মুখে পড়ে। জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম ক্ষিতীনবাবু বাড়িতেই আছেন। পুরাতন বেয়ারা ভোলা একটু হাসিয়া বলিল, ভেতরে চলে যান না বাবু, আপনারি তো বাড়ি।
ছেলেবেলা কতবার বাড়ির ভিতর গিয়াছি। কিন্তু আজ অনেকদিন পরে কেমন লজ্জা করিতে লাগিল। উপরন্তু দাদাকে লইয়া ভিতরে যাওয়া সঙ্গত নয়। অথচ তাঁহাকে বাহিরে একলা বসাইয়া রাখিয়া নিজে ভিতরে যাওয়াটাও কেমন লজােকর বোধ হইতে লাগিল। আমি ইতস্তত করিতেছি। দেখিয়া ভোলা বলিল, বাবু এই পাশের ঘরেই আছেন—আপনার ভেতরে যান।
আমরা ধীরে ধীরে পাশের ঘরে প্রবেশ করিলাম। ঘরটি খুব বড় নয়; তাহাতে সরঞ্জামের মধ্যে একটি খাট, একটি চেয়ার, একটি টেবিল এবং দেয়ালে কতকগুলি বিলাতী ছবি। প্রকৃতপক্ষে ঘরখানি ক্ষিতীনবাবুর দিবানিদ্রার জন্য; তবে অতিথি বন্ধুবান্ধব আসিলে সচরাচর এই ঘরখানি তাঁহাদের নির্দিষ্ট হইয়া থাকে।
আমরা প্রবেশ করিয়া দেখিলাম ক্ষিতীনবাবু বিছানায় চিৎ হইয়া শুইয়া কড়িকাঠের দিকে তাকাইয়া আছেন। মাথার কাছে একটি পকেট ঘড়ি কুণ্ডলিত চেনের মধ্যে থাকিয়া টিক টিক শব্দ করিতেছে। বিছানার উপরেই কতকগুলি ইংরাজী ও সংস্কৃত বই ইতস্তত ছড়ানো। একটি বই খোলা অবস্থায় তাঁহার বুকের উপর পড়িয়া আছে। লক্ষ্য করিয়া দেখিলাম সেটির নাম বেদান্তবারিধিকর্ণধার। ঘরে অন্য কোন জনপ্ৰাণী ছিল না; কেবল একটা মাছি ক্ষিতীনবাবুর উরুর উপর বসিয়া কোন এক অনাগত শত্রুর উদ্দেশ্যে তাল ঠুকিয়া আস্ফালন করিতেছিল।
হঠাৎ তাঁহার বৈদান্তিক অনুশীলনে বাধা দিয়া হঠকারিতা করিলাম। কিনা ভাবিতেছি। এমন সময় ক্ষিতীনবাবু কড়িকাঠ হইতে দৃষ্টি নামাইয়া আমাদের দিকে চাহিলেন। আমাকে দেখিয়া উঠিয়া বসিয়া বলিলেন, সন্তোষ না? এস, এস; ইনি কে?
দাদাকে তিনি পূর্বে অন্তত একশতবার দেখিয়া থাকিবেন। তথাপি এরূপ প্রশ্ন করায় দাদা অত্যন্ত মুষড়িয়া গেলেন। দার্শনিকের স্মৃতির উপর বিশেষ আস্থা না থাকায় ক্ষিতীনবাবু যে আমাকে চিনিতে পারিয়াছেন এজন্য মনে মনে আশ্বস্ত হইলাম।
বলিলাম, ইনি আমার খুড়তুত দাদা-শ্ৰীকেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়। কেন একে তো আপনি অনেকবার দেখেছেন।
ক্ষিতীনবাবু স্বপ্নবিষ্ট্রের ন্যায় চক্ষু দাদার পানে ফিরাইয়া বলিলেন, তা হবে।
তারপর অনেকক্ষণ কোনও কথা হইল না। আমার বোধ হইল ক্ষিতীনবাবু অলক্ষ্যে আবার বেদান্তবারিধিতে ড়ুবিয়া গিয়াছেন। আমরা দুইটি প্রাণী যে তাঁহার সম্মুখে বসিয়া আছি তাহা স্বচ্ছন্দে ভুলিয়া যাইতে একটুও দ্বিধা করেন নাই।
আমি একটু জোরে কাশিয়া ইতস্তত করিয়া বলিলাম, আমি একবার সরস্বতীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।
ক্ষিতীনবাবু বলিলেন, সরস্বতী বাড়ির মধ্যে আছে।
সরস্বতীর বাড়ির মধ্যে থাকা সম্বন্ধে আমারও কোন সন্দেহ ছিল না। আমি ভাবিয়ছিলাম আমার উদ্দেশ্য জানিয়া ক্ষিতীনবাবু আমার ভিতরে যাইবার একটা বন্দোবস্ত করিয়া দিবেন। কিন্তু সেরূপ কোন লক্ষণই না দেখিয়া অগত্যা একাই উঠিলাম। সরস্বতীর সহিত দেখা করিব শুনিয়া দাদা অত্যন্ত আড়ষ্ট হইয়া বসিয়া ছিলেন। তাঁহাকে বলিলাম, একটু বস। আমি এখনি আসছি।
বাড়ির ভিতর পা দিয়াই দেখি সম্মুখে সরস্বতী। সে আমাকে দেখিয়াই থমকিয়া দাঁড়াইয়া হাসিমুখে বলিল, একি সন্তোষদা! কতদিন পরে। ভাল আছ তো?
আমি ঢোক গিলিয়া হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিলাম, তোমাকে দেখতে এলুম।
সরস্বতী পূর্বের মত সুন্দর হাসিয়া বলিল, আর কাউকে নয় তো?
আমি তাড়াতাড়ি বলিলাম, আমাকে তোমার ঘরে নিয়ে চল—কথা আছে।
সরস্বতী চল বলিয়া আমাকে তাহার ঘরে লইয়া গেল। তারপর ঘরের দরজা ভেজাইয়া দিয়া একখানা চেয়ারে বসিয়া বলিল, কি কথা?
আমি অপরাধীর মত তাহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া রহিলাম। অবশেষে বলিলাম, সরস্বতী, আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি।
সরস্বতী পূর্ববৎ রহস্যমুখর কণ্ঠে বলিল, কেন বল তো? আজকাল বড় বেশী কবিতা লিখছ সেই জন্যে। কবিতা লেখার কথা লইয়া আমাদের মধ্যে ঠাট্টা-তামাসা চলিত। কিন্তু আজ আমি তাহার মুখের দিকে তাকাইতে পারিলাম না। নতমুখে বলিলাম, ঠাট্ট নয়। সরস্বতী, আমি সত্যিই ক্ষমা চাইতে এসেছি।
এবার সরস্বতী হাসিল না, শুধু জিজ্ঞাসা করিল, কি জন্যে?
আমি চকিতের জন্য মুখ তুলিয়া আবার তৎক্ষণাৎ নামাইয়া লইয়া বলিলাম, কি জন্যে তুমি জান না? বলিয়া ভয়ে ভয়ে আবার চোখ তুলিয়া দেখি, তাহার মুখের ভাব একেবারে বদলাইয়া গিয়াছে। তাহার চক্ষু হঠাৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে। কপাল উত্তপ্ত লোহার মত রাঙ্গা হইয়া গিয়াছে। সে তীব্র কণ্ঠে বলিল, জানি। কিন্তু তোমরাও জান কি, যে অপমান আমায় করেছ তা মার্জনার কতদূর অযোগ্য?
আমি বাজাহতের মত দাঁড়াইয়া রহিলাম। সরস্বতী তাহার প্রদীপ্ত চক্ষু আমার মুখের উপর স্থাপন করিয়া আবার বলিতে লাগিল। তাহার চক্ষুর ভিতর দিয়া যেন বিদ্যুৎ ছুটাছুটি করিতেছিল। আমি কাঠ হইয়া দাঁড়াইয়া শুনিতে লাগিলাম।
সে বলিল, বুঝি না কি হীন তোমাদের প্রবৃত্তি। যখন কবিতায় চিঠি লিখতে বসেছিলে তখন মনে হয়নি যে একজন কুমারীর ইহকাল নষ্ট করবার পথ পরিষ্কার করছ। এই রকম প্রবৃত্তি নিয়ে তোমরা মনুষ্যত্বের দাবি করতে লজ্জা বোধ করা না। ছিছি, তোমরা মেয়েমানুষ হয়ে জন্মাওনি কেন? এই পর্যন্ত এক নিশ্বাসে বলিয়া গিয়া থামিল। তারপর নিশ্বাস টানিয়া লইয়া আবার আরম্ভ করিল, বাহাদুরী তোমাদের প্রবৃত্তিকে আর বাহাদুরী তোমাদের অনুতাপকে। চিঠি লেখবার সময় এ জ্ঞান হয়নি? তাহলে তো ক্ষমা চাইবার জন্যে এত দূর আসতে হত না। ক্ষমা-ক্ষমা কি মুখের কথা নাকি।
আমার মুখ সাদা হইয়া গিয়াছে দেখিয়া সরস্বতীর বোধহয় দয়া হইল; তাই সে চুপ করিল। আমি অত্যন্ত কাতর হইয়া বলিলাম, সরস্বতী, আমি না বুঝে দোষ করেছি। আমাকে ক্ষমা কর ভাই।
গর্বিতভাবে গ্ৰীবা বাঁকাইয়া সে একটা অত্যন্ত কঠিন উত্তর দিতে যাইতেছিল। তাহার ঠোঁট কাঁপিয়া উঠিয়ছিল। আমি সভয়ে তাহার দিকে তাকাইয়া ছিলাম। ঠিক যেমন আসন্নঅনলবর্ষ। আগ্নেয়গিরির চুড়ার দিকে চলচ্ছক্তিহীন মানুষ ভয়ব্যাকুলচক্ষে তাকাইয়া থাকে—সেইরূপ। কিন্তু হঠাৎ সরস্বতী থামিয়া গেল। তারপর ধীরে ধীরে আমার মুখের উপর হইতে তাহার রূঢ় উদ্ধত দৃষ্টি নামাইয়া লইল।
ঠাণ্ডা হাওয়ার সংস্পর্শে উষ্ণ বাষ্প যেমন গলিয়া জল হইয়া যায়, সরস্বতীর মুখখানা দেখিতে দেখিতে সেইরূপ শান্ত হইয়া গেল। সে নতমুখে বসিয়া রহিল, তাহার কপালে গণ্ডে ছোট ছোট স্বেদবিন্দু ফুটিয়া উঠিল।
কিছুক্ষণ পরে সরস্বতী মুখ তুলিল। মুখখানা ঈষৎ রঞ্জিত হইয়াছিল। সে একটুখানি হাসিয়া বলিল, সন্তোষদা, তুমি এসেছিলে আমার কাছে একটা দৈবাৎকৃত ভুলের জন্যে ক্ষমা চাইতে। আমি কি চমৎকার ব্যবহারই তোমার সঙ্গে করলুম। এখন কে কাকে ক্ষমা করবে বলতো?
আমি সুদীর্ঘ এক নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলাম, কাউকে কারুর কাছে ক্ষমা চেয়ে কাজ নেই সরস্বতী, ওটা কাটাকাটি হয়ে যাক।
সরস্বতী একটু মলিন হাসিয়া বলিল, সেই ভাল।
এমন সময় চাকরানি আসিয়া দ্বারের নিকট হইতে মৃদুস্বরে ডাকিল, দিদিমণি, মা তো এখনো ফিরে আসেননি। উনুনে আগুন দেব কি?
সরস্বতী বলিল, মোক্ষদা, ভেতরে আয় না। মার বোধহয় ফিরতে দেরি হবে-বীণাকে নিয়ে সেই ওপাড়ায় বেড়াতে গেছেন।–তুই এক কাজ কর না মোক্ষদা। উনুন জ্বেলে জল চড়িয়ে দে, তোর দাদাবাবুকে এক পেয়ালা চা তৈরি করে দি।
আমি তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিলাম, না না, অত হাঙ্গামে কাজ নেই–
মোক্ষদা পুরাতন দাসী, সরস্বতী বীণাকে হাতে করিয়া মানুষ করিয়াছে। সে ঘর হইতে বাহির হইয়া যাইতে যাইতে বলিল, হাঙ্গামা কিসের? এই যে এখুনি করে দিচ্ছি। দাদাবাবু। বলিয়া চলিয়া গেল।
আমি বুঝিলাম সরস্বতী বাহ্য কাজের আড়ম্বরে আমাদের ভিতরকার লজ্জাটুকু চাপা দিবার চেষ্টা করিতেছে। আমি একটু ইতস্তত করিয়া বলিলাম, কিন্তু আর একজন নিরীহ প্ৰাণী যে তোমার মার্জনার আশায় বাইরে বসে আছেন।
কথাটা শুনিবা মাত্র সরস্বতী চমকিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। চকিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, কে?
কুণ্ঠিত স্বরে বলিলাম, দাদা।
সরস্বতীর মুখখানা সিঁদুরের মত রাঙ্গা হইয়া উঠিল। তারপর নিজেকে যথাসাধ্য সংযত করিয়া বলিল, যিনি আমাকে এত ছোট মনে করেন। তিনি আবার ক্ষমা চাইতে এসেছেন কেন?
তোমাকে ছোট মনে করেন?
সরস্বতী মাথা নীচু করিয়াই বলিল, তা নাহলে ও চিঠি আমার লেখা বলে মনে করলেন কেন?
আমি চুপ করিয়া রহিলাম। ভাবিলাম বলি-সরস্বতী, তুমি জান না যারা ভালবাসে তাদের মাঝে মাঝে কী প্রলোভনের সম্মুখীন হতে হয়। যদি জানতে এমন কথা বলতে না। কিন্তু কথাটা মনের মধ্যেই রহিল, বলা হইল না।
সরস্বতী হঠাৎ বলিল, যাই দেখিগে, মোক্ষদা কি করলে। বলিয়া যাইতে উদ্যত হইল। আমি বলিলাম, না না। সরস্বতী, আমি এখন চা খাব না। কিন্তু তুমি বল, আমাকে যেমন ক্ষমা করেছি। দাদাকেও তেমনি করলে।
সরস্বতী কোন উত্তর না দিয়া চলিয়া যাইতে লাগিল। আমি নিরুপায় হইয়া বলিলাম, আর চিঠিখানা-সেখানা অন্তত দিয়ে যাও। তাও কি দেবে না?
সরস্বতী চকিতে ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, না, সে চিঠি তোমরা পাবে না। বলিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
বাহিরে আসিয়া দাদার মুখখানা একটু প্ৰফুল্ল দেখিলাম। ফটকের বাহির হইলে তিনি সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলেন, কি হল?
আমি নীরসভাবে বলিলাম, কিসের?
দাদা চুপ করিয়া গেলেন। আমি কিজান্য সরস্বতীর সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছিলাম তাহা তিনি কিছুই জানিতেন না। তবু বোধ করি প্রণয়ীর মনে একটা অনিশ্চিত আশা জাগিয়াছিল।
আমি তখন বলিলাম, নির্মল বায়ু সেবনে তোমার একটু উপকার হয়েছে দেখতে পাচ্ছি।
কি উপকার?
মুখের রং একটু ফরসা হয়েছে মনে হচ্ছে।
দাদা বুঝিতে না পারিয়া আমার মুখের পানে চাহিলেন। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ক্ষিতীনবাবুর সঙ্গে কি কথা হল?
দাদা সজাগ হইয়া বলিলেন, অনেক কথা। ওঁর কথা শুনে মনে হয়। উনি বেদান্ত নিয়ে বেশী নড়াচাড়া করেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন-আপনি বেদান্ত সম্বন্ধে কোন আলোচনা করেছেন? আমি বললুম-কিছুদিন আগে একটু করেছিলুম। কিন্তু বেশী কিছু বুঝতে পারিনি। তিনি উৎসাহিত হয়ে বললেন—একবারেই কি বুঝতে পারা যায়। আর একটু চৰ্চা করে দেখুন সব পরিষ্কার হয়ে বাবে। —তারপরেই আমাদের কথাবার্তা জমে গেল।
আমি বলিলাম, ক্ষিতীনবাবু কেমন লোক বোধ হল?
দাদা বলিলেন, আগে তো কখনো ওঁর সঙ্গে আলাপ করিনি। তবে একবারে যত দূর বোঝা যায় খুব সরল প্রকৃতির লোক। আমার তো খুব চমৎকার লোক বলেই মনে হল।
আমি বলিলাম, তবে দোষের মধ্যে উনি বেদান্তকেই সমস্ত চিন্তার এবং কাজের কেন্দ্র করে। ফেলেছেন।
দাদা। আপত্তি করিয়া বলিলেন, সেটাকে দোষ বলতে পারি না। সকলেরই জীবনের একটা কেন্দ্ৰ থাকা দরকার—তা নাহলে জীবনের বৃত্তটা সম্পূর্ণ হয় না।
আমি বলিলাম, বৃত্তটা খুব বেশী সম্পূর্ণ হলেও একটা বড় অসুবিধা আছে—কেবল বৃত্তপথেই ঘুরে বেড়াতে হয়—তার বাইরে কিছু আছে কিনা দেখবার ফুরসৎ হয় না।
দাদা বলিলেন, বাইরে দেখবার দরকার?
আমি বলিলাম, দেখ, নিরবচ্ছিন্ন সব জিনিসই একঘেয়ে হয়ে দাঁড়ায়। বৈকুণ্ঠে থেকে থেকে ভগবানের জীবন যখন নিতান্ত অসহ্য হয়ে ওঠে তখন তিনিও মত্যে লীলা করতে আসেন।
দাদা বলিলেন, তবে তোমার মতে মানুষের জীবনের একটা কেন্দ্ৰ থাকা উচিত নয়।
আমি তাঁহার প্রশ্ন এড়াইয়া বলিলাম, আচ্ছা, যে মুখে চিরকাল মিষ্টি কথা শুনে এসেছি সে মুখের কড়া কথা মাঝে মাঝে ভাল লাগে নাকি?
বেদান্তর হাওয়া তখনো দাদার মস্তিষ্কের কন্দরে কন্দরে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। তিনি জোর দিয়া বললেন, তা হলেও সত্যের কাছে কিছুই নয়।
আমি বলিলাম, দেখ, এটা তোমার বাড়াবাড়ি। আমি তোমার সঙ্গে আধ্যাত্মিক আলোচনা করছি না। আমি বলছি মনের ছোট ছোট বৃত্তিগুলির কথা—যার হাত থেকে কেউ কখনো নিস্তার পাননি। প্রমাণ চাও? রবিবাবুর রাজা ও রানী পড়। হে ব্ৰাহ্মণ, মিথ্যা করে বল; অতি ক্ষুদ্র সকরুণ দুটি মিথ্যা কথা!
তবু দাদা আমার কথা স্বীকার করিলেন না দেখিয়া আমি তাহার প্রাণের সবচেয়ে নরম স্থানে হাত দিলাম। বলিলাম, আচ্ছা একটা উদাহরণ ধর। মনে কর, একথা যদি সত্যি হয় যে সরস্বতী আদৌ তোমায় চিঠি লেখেনি, আর কেউ ঠাট্টা করে লিখেছে, তাহলে এই সত্যটা তোমার বেশী ভাল লাগে, না, সরস্বতী চিঠি লিখেছে। এই কল্পিত মিথ্যাটা বেশী ভাল লাগে। শুধু মনে করা—আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে বলছি না।
দাদার মুখ শুকাইয়া গেল। স্পষ্ট বুঝিলাম বৈদান্তিক গবেষণায় পরাজিত হইবার ভয়ে মুখ শুকায় নাই। তারপর দারুণ নৈরাশ্যপূর্ণ সুরে বলিলেন, তবে কি ও চিঠি সরস্বতীর নয়?
আমি হাসিয়া বলিলাম, আহাহা-শুধু মনে কর না ছাই। আমি কি তোমায় বিশ্বাস করতে বলছি?
দাদা একটু শান্ত হইয়া চিন্তা করিলেন। চিন্তা করিতে করিতে তাঁহার মুখ উৎফুল্ল হইয়া উঠিল; তিনি অর্ধস্ফুটস্বরে বলিলেন, তা কেমন করে হবে। নিশ্চয় সে লিখেছে। নইলে সে আসবে কেন?
আমি বলিলাম, কেমন, মানলে তো যে মিথ্যা মাঝে মাঝে সত্যের চেয়ে বেশী বাঞ্ছনীয়।
দাদা বলিলেন, কই মানলুম!
আমি বলিলাম, বাঃ, মানলে না? এখনি তো সরস্বতী চিঠি লেখেনি এই মনে-করা সত্যটা মিথ্যা বলে মানবার জন্যে প্ৰাণ আকুলি-বিকুলি করছিল।
দাদা সলজ্জে চুপ করিয়া রহিলেন।