০৪. রাত্তিরের ঘটনাটা

রাত্তিরের ঘটনাটা আর নবকুমারবাবুকে বলল না ফেলুদা। চায়ের টেবিলে শুধু জিগ্যেস করল, ‘স্টুডিওটা চাবি দেওয়া থাকে না?’

‘এমনিতে সবসময়ই থাকে,’ বললেন নবকুমারবাবু, ‘তবে ইদানীং রবীনবাবু প্রায়ই গিয়ে কাজ করেন। রুদ্রশেখরবাবুও যান, তাই ওটা খোলাই থাকে। চাবি থাকে বাবার কাছে।’

চা খাওয়ার পর আমরা চন্দ্রশেখরের স্টুডিওটা দেখতে গেলাম।

তিনতলায় ছাত। তারই একপাশে উত্তর দিকটায় স্টুডিও। সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডান দিকে ঘুরে স্টুডিওতে ঢোকার দরজা।

উত্তরের আলো নাকি ছবি আঁকার পক্ষে সবচেয়ে ভালো, তাই স্টুডিওর উত্তরের দেয়ালটা পুরোটাই কাঁচ। বেশ বড় ঘরের চারদিকে ছড়ানো রয়েছে ডাঁই করা ছবি, নানান সাইজের কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো সাদা ক্যানভাস, দুটো বেশ বড় টেবিলের উপর রং তুলি প্যালেট ইত্যাদি নানারকম ছবি আঁকার সরঞ্জাম, জানালার পাশে দাঁড় করানো একটা ইজেল। সব দেখেটেখে মনে হয় আর্টিস্ট যেন কিছুক্ষণের জন্য স্টুডিও ছেড়ে বেরিয়েছেন, আবার এক্ষুনি ফিরে এসে কাজ শুরু করবেন।

‘জিনিসপত্তর সবই বিলিতি’, চারিদিক দেখে ফেলুদা মন্তব্য করল। ‘এমন কি লিনসীড অয়েলের শিশিটা পর্যন্ত। রংগুলো ত দেখে মনে হয় এখনো ব্যবহার করা চলে।’

ফেলুদা দু’একটা টিউব তুলে টিপে টিপে পরীক্ষা করে দেখল।

‘হুঁ, ভালো কন্ডিশনে রয়েছে জিনিসগুলো। রুদ্রশেখর এগুলো বিক্ৰী করেও ভালো টাকা পেতে পারেন। আজকালকার যে কোনো আর্টিস্ট এসব জিনিস পেলে লুফে নেবে।’

ঘরের দক্ষিণ দিকের বড় দেয়ালে আট-দশটা ছবি টাঙানো রয়েছে। তার একটার দিকে নবকুমারবাবু আঙুল দেখালেন।

‘ওটা দাদুর নিজের আঁকা নিজের ছবি।’

আর্টিস্টরা অনেক সময় আয়নার সামনে বসে সেলফপোর্ট্রেট আঁকতেন সেটা আমি জানি। চন্দ্রশেখর নিজেকে এঁকেছেন বিলিতি পোষাকে। চমৎকার শার্প, সুপুরুষ চেহারা। কাঁধ অবধি ঢেউখেলানো কুচকুচে কালো চুল, দাড়ি আর গোঁফও খুব হিসেব করে আঁচড়ানো বলে মনে হয়।

চন্দ্রশেখর নিজেকে এঁকেছেন বিলিতি পোষাকে

‘এই ছবিটাই ওই প্রবন্ধের সঙ্গে বেরিয়েছে’, বলল ফেলুদা।

‘তা হবে’, বললেন নবকুমারবাবু ‘বাবার কাছে শুনেছিলাম ভূদেব সিং-এর এক ছেলে এখানে এসেছিল একদিনের জন্য। বাপের আর্টিকলের জন্য বেশ কিছু ছবি তুলে নিয়ে যায়।’

‘ভদ্রলোকের রঙ ত তেমন ফর্সা ছিল বলে মনে হচ্ছে না।’

‘না’, বললেন নবকুমারবাবু। ‘উনি আমার প্রপিতামহ অনন্তনাথের রং পেয়েছিলেন। মাঝারি।’

‘সেই বিখ্যাত ছবিটা কোথায়?’ এবার ফেলুদা প্রশ্ন করল।

‘এদিকে আসুন, দেখাচ্ছি।’

নবকুমারবাবু আমাদের নিয়ে গেলেন দক্ষিণের দেয়ালের একেবারে কোণের দিকে।

গিল্টিকরা ফ্রেমে বাঁধানো রয়েছে যীশুখৃষ্টের ছবিটা।

মাথায় কাঁটার মুকুট, চোখে উদাস চাহনি, ডান হাতটা বুকের উপর আলতো করে রাখা। মাথার পিছনে একটা জ্যোতি, তারও পিছনে গাছপালা—পাহাড়—নদী—বিদ্যুত-ভরা মেঘ মিলিয়ে একটা নাটকীয় প্রাকৃতিক দৃশ্য।

আমরা মিনিটখানেক ধরে অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম ছবিটার দিকে। কিছুই জানি না, অথচ মনে হল হাজার ঐশ্বর্য, হাজার রহস্য লুকিয়ে রয়েছে ওই ছবির মধ্যে।

ফেলুদার হাবভাবে বেশ বুঝতে পারছিলাম যে বৈকুণ্ঠপুরের নিয়োগীদের সঙ্গে সম্পর্ক এইখানেই শেষ নয়। নিচে এসেই ফেলুদা একটা অনুরোধ করল নবকুমারবাবুকে।

‘আপনাদের একটা বংশলতিকা পাওয়া যাবে কি? অনন্তনাথ থেকে শুরু করে আপনারা পর্যন্ত। জন্ম মৃত্যু ইত্যাদির তারিখ সমেত হলে ভালো হয়, আর আলাদা করে চন্দ্রশেখরের জীবনের জরুরী তারিখগুলো। অবিশ্যি যেসব তারিখ আপনাদের জানা আছে।’

‘আমি বঙ্কিমবাবুকে বলছি। উনি খুব এফিশিয়েন্ট লোক। দশ মিনিটের মধ্যে তৈরী করে দেবেন আপনাকে।’

‘আর, ইয়ে—যে ভদ্রলোক ছবি কিনতে এসেছিলেন তাঁর ঠিকানাটা। যদি বঙ্কিমবাবুর কাছে থাকে।’

বঙ্কিমবাবুর বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। বেশ চালাক চেহারা। হাসলেই গোঁফের নিচে ধবধবে সাদা দাঁতের পাটি বেরিয়ে পড়ে। বললেন, বংশলতিকা একটা রবীনবাবুর জন্য করেছিলেন, তার কার্বন রয়েছে। সেটা পেতে দশ মিনিটের জায়গায় লাগল দু মিনিট।

যিনি ছবি কিনতে এসেছিলেন তাঁর একটা কার্ড বঙ্কিমবাবুর কাছে ছিল, উনি সেটা এনে দিলেন ফেলুদাকে। দেখলাম নাম হচ্ছে হীরালাল সোমানি, ঠিকানা ফ্ল্যাট নং ২৩, লোটাস টাওয়ারস, আমীর আলি অ্যাভিনিউ।

কার্ডটা দেবার পর ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে রয়েছেন, মুখে একটা কিন্তু কিন্তু ভাব। ফেলুদা বলল, ‘কিছু বলবেন কি?’

‘আপনার নাম শুনেছি,’ বললেন ভদ্রলোক, ‘আপনি ডিটেকটিভ ত?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘আপনি কি আবার আসবেন?’

‘প্রয়োজন হলে নিশ্চয়ই আসব। কেন বলুন ত?’

‘ঠিক আছে’, ভদ্রলোকের এখনো সেই ইতস্তত ভাব।—‘মানে, একটু ইয়ে ছিল। তা সে পরেই হবে।’

আমার কাছে ব্যাপারটা কেমন যেন রহস্যময় মনে হল, যদিও পরে ফেলুদাকে বলতে ও বলল, ‘বোধহয় অটোগ্রাফ নেবার ইচ্ছে ছিল, বলতে সাহস পেলেন না।’

গাড়িতে যখন উঠছি তখন ফেলুদা নবকুমারবাবুকে বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ, মিষ্টার নিয়োগী। আপনাদের এখানে এসে সত্যিই ভালো লাগল। যা দেখলাম আর শুনলাম, তা খুবই ইন্টারেস্টিং। আমি যদি একটু এদিক ওদিক খোঁজ-খবর করি তাতে আপনার আপত্তি হবে না ত?’

‘মোটেই না।’

‘একবার ভগওয়ানগড়ে ভূদেব সিং-এর কাছে যাবার ইচ্ছে আছে। ওই যীশুর বাজার দরটা কী হতে পারে সেটা একবার ওঁর কাছ থেকে জানা দরকার।’

‘বেশ ত, চলে যান ভগওয়ানগড়। আমার আপত্তির কোনো প্রশ্নই ওঠে না।’

‘আর আপনার বাবা কিন্তু ঠিকই বলেছেন; আপনাদের ফক্স-টেরিয়ার খুনের ব্যাপারটাকে কিন্তু আপনি মোটেই হালকা করে দেখবেন না। আমি ওটার মধ্যে একটা গূঢ় রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি।’

‘তা তো বটেই। আমার কাছে ব্যাপারটা অত্যন্ত নৃশংস বলে মনে হয়েছিল।’

ফেলুদা আর নবকুমারবাবুর মধ্যে কার্ড বিনিময় হল। ভদ্রলোক বললেন, ‘আপনি প্রয়োজনে টেলিফোন করবেন, তেমন বুঝলে সোজা চলে আসবেন। আর ভগওয়ানগড়ে কী হল সেটা দয়া করে জানিয়ে দেবেন।’

*

‘ভগওয়ানগড় বলে যে একটা জায়গা আছে সেটাই জানা ছিল না মশাই,’ ফেরার পথে বললেন লালমোহনবাবু।

‘জায়গাটা বোধহয় মধ্যপ্রদেশে,’ বলল ফেলুদা। ‘তবে আই অ্যাম নট শিওর। গিয়েই পুষ্পক ট্র্যাভেলসের সুদর্শন চক্রবর্তীর শরণাপন্ন হতে হবে।’

‘এম পি-টা দেখা হয়নি,’ আপন মনে বললেন জটায়ু।

‘অবিশ্যি এ যাত্রায় যে বিশেষ দেখা হবে সেটা মনে করবেন না। স্রেফ কতগুলো তথ্য জেনে নিয়ে ফিরে আসা। বৈকুণ্ঠপুরকে বেশিদিন নেগলেকট করা চলবে না।’

‘এটা কেন বলছেন?’

‘রুদ্রশেখরের পায়ের দিকে লক্ষ করেছেন?’

‘কই, না ত।’

‘রবীন চৌধুরীর খাওয়াটা লক্ষ করেছেন?’

‘কই, না ত।’

‘তাছাড়া ভদ্রলোক রাত দুটোর সময় স্টুডিওতে কী করেন, বঙ্কিমবাবু কী বলতে গিয়ে বললেন না, একটা কুকুরকে কী কী কারণে খুন করা যেতে পারে—এসব অনেক প্রশ্ন আছে।’

আমি বললাম, ‘কোনো বাড়ির কুকুর যদি ভালো ওয়াচডগ হয়, তাহলে একজন চোর সে-বাড়ি থেকে কিছু সরাবার মতলব করে থাকলে আগে কুকুরকে সরাতে পারে।’

‘ভেরি গুড। কিন্তু কুকুরকে মারা হয়েছে মঙ্গলবার আঠাশে সেপ্টেম্বর, আর আজ হল ৫ই অক্টোবর। কই, এখনো ত কিছু চুরি হয়েছে বলে জানা যায়নি। আর, এগারো বছরের বুড়ো ফক্স-টেরিয়ার কতই বা ভালো ওয়াচডগ হবে?’

‘আমার কী আপশোস হচ্ছে জানেন ত?’ বললেন লালমোহনবাবু।

‘কী?’

‘যে আর্টের বিষয় এতো কম জানি।’

‘বর্তমান ক্ষেত্রে শুধু এইটুকু জানলেই চলবে যে একজন প্রাচীন যুগের প্রখ্যাত শিল্পীর ছবি যদি বাজারে আসে, তাহলে তার দাম লাখ দু’ লাখ টাকা হলেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই।’

‘অ্যাঁ!’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘তার মানে বলতে চান একটি লাখ টাকার ছবি আজ চল্লিশ বছর ধরে টাঙানো রয়েছে বৈকুণ্ঠপুরের ওই স্টুডিওর দেয়ালে, অথচ সেটা সম্বন্ধে কেউ কিচ্ছু জানে না?’

‘ঠিক তাই। এবং সেইটে জানার জন্যেই ভগওয়ানগড় যাওয়া।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *