রমার বিয়ে হয়ে একদিক থেকে ভালোই হলো। ওর বাবাকে আমি দাদা বলি, মাকে বৌদি। কিন্তু ওঁদের চাইতে আমি অনেক ছোট, হাজার হোক আমি জার্নালিস্ট। কাজকর্মে কখনও কখনও বিদেশ যাই। আলাপ হয় বহু ইন্ডিয়ান ডিপ্লোম্যাটের সঙ্গে। ঘনিষ্ঠতাও হয় কয়েকজনের সঙ্গে। সুভাষদাদের সঙ্গেও হয়েছে। কিন্তু তাই বলে তো ওঁকে আমি কাকাবাবু বা মামাবাবু বলতে পারি না। দাদা বলি। মিসেস জয়ন্তী রায়কে বৌদি বলি। এই রকম অজস্র দাদা-বৌদি আমার আছে। পার্লামেন্টের বহু প্রবীণ সদস্যকেও দাদা বলি। সেন্ট্রাল হলে বসে রসের গল্প করি। অথচ ওঁদের অনেকেরই নাতনীদের সঙ্গে নিঃসন্দেহে আমি প্রেম করতে পারি।
সুভাষদাদের সঙ্গে আমার বয়সের পার্থক্য অতটা না হলেও যথেষ্ট। রমা আমার চাইতে কয়েক বছরের ছোট কিন্তু এমন ছোট নয় যে ও আমাকে কাকু বলতে পারে। আমি এমন বড় নই যে ওর বন্ধু হতে পারি না বা আমাদের দুজনের মনের মধ্যে একই সঙ্গে একটা ছোট্ট মিষ্টি স্বপ্ন দানা বাঁধতে পারে না। বিচ্ছিরি না হলেও বেশ অস্বস্তিকর পরিস্থিতি ছিল। ওর বিয়ে হয়ে অন্তত এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে বেঁচেছি। রমাও নিশ্চয়ই স্বস্তি পেয়েছে।
রমার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় বেনারসে। আমেরিকা থেকে ফিরে আসার পরই বৌদি ওকে চিঠি দিয়েছিলেন। মনে হয় আমার সম্পর্কে অনেক ভালো ভালো কথাই লিখেছিলেন। বৌদি আমাকেও জানান যে ওকে চিঠি দিয়েছেন। রমার সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ থাকলেও দ্বিধা ছিল মনে মনে। তার অনেক কারণ ছিল। তবু গিয়েছিলাম। একবার কলকাতা যাবার পথে বেনারস ঘুরে গেলাম। বেশ লেগেছিল। একটি মিষ্টি স্মৃতির প্রলেপ লেগেছিল আমার মনে।
এরপর মাঝে মাঝেই ওর কথা মনে পড়ত। দুএকবার ওকে চিঠি লিখেছি। অতি সাধারণ মামুলি চিঠি। বোধহয় খামে ঠিকানাও টাইপ করেছি কিন্তু ডাক বাসে ফেলিনি। ভেবেছি কি দরকার। যে স্মৃতিটুকু বুকে নিয়ে বেঁচে আছি, সেইটুকুই থাক। অম্লান থাক। ঐ পুঁজিটুকু নিয়েই আমার দিন কেটে যাবে। আমি না লিখলেও নববর্ষে রমার একটা ছোট চিঠি এসেছিল। নিছক শুভ কামনা। খামের মধ্যে ঐ নীল প্যাডের পাতায় তিন চার লাইনের চিঠিতে শুভ কামনার চাইতে কি যেন একটু বেশি ছিল। আমি জবাব দিলাম পোস্টকার্ডে তোমার শুভ কামনার জন্য ধন্যবাদ।
বেনারসের পর রমার সঙ্গে ভালোভাবে আবার আলাপ হলো কায়রোতে। ওদের বাড়িতে মাত্র দুদিন ছিলাম। আমাকে ভালোভাবে খাওয়াবার জন্য বৌদি এমন মেতে উঠলেন যে কিচেন থেকে লিভিংরুম-এ এসে গল্প করার সময় পর্যন্ত ছিল না। আমি কিচেনের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৌদির সঙ্গে গল্প করি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কয়েকটা ট্রাভেলার্স চেক ভাঙিয়ে সামান্য কিছু কেনাকাটার ছিল বলে প্রথমবার বেরুবার সময় বৌদিই বললেন, রমা তুই বরং ওর সঙ্গে যা। রমার সঙ্গেই বেরুলাম। প্রথমেই কাসর এল নীল স্ট্রিটে আমেরিকান একপ্রেসে গিয়ে ট্রাভেলার্স চেকগুলো ভাঙালাম। ব্যাঙ্ক থেকে বেরুবার সময়, রমা জিজ্ঞাসা করল, আপনি কায়রোয় এই প্রথম এলেন?
না, এর আগেও দুবার এসেছি।
তাহলে তো আপনিই আমার গাইড হতে পারেন।
একটু হাসলাম, না, অতটা চিনি না। বড় হোটেলে থেকে ট্যাকসিতে ঘুরলে কোনো কালেই কোনো শহর চেনা যায় না।
তা ঠিক।
তুমি পিরামিড-টিরামিড সব কিছু দেখেছ?
হ্যাঁ। দেখেছি।
কায়রো কেমন লাগছে?
ভালোই। বিশেষ করে নাইলের সাইডটা সত্যি ওয়ান্ডারফুল।
পরের দিন আমি, বৌদি আর রমা সিনেমা দেখলাম। বোধহয় কায়রো প্যালেসে। আমার দিন আসার ফ্লাইট ছিল অনেক রাত্রে। বৌদির অনুরোধে দুপুরবেলায় খাওয়া-দাওয়া করেই খানিকক্ষণ ঘুমুতে হলো। সেই সেদিন বিকেলবেলায় রমার সঙ্গে আবার একটু ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। ঘুরতে ঘুরতে শেষ পর্যন্ত কায়রো-টাওয়ারে গেলাম। কায়রো-টাওয়ারে বসলে মনে হয় মহাশূন্যে ঘুরছি। ভারি ভালো লাগে। মজা লাগে। একটু রোমাঞ্চ উত্তেজনাও। সমস্ত কায়রো শহরটা, নাইল নদী, পিরামিড, আরো কত কি দেখা যায়।
বাবা-মা তো আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
আমি হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলাম, আর তুমি বুঝি আমার নিন্দা করো?
কার কাছে আপনার প্রশংসা বা নিন্দা করব বলুন?
হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, কেন? মনে মনে?
রমা যেন একটু লজ্জা পেল।
ট্যাকসিতে বাড়ি ফেরার পথে ও জিজ্ঞাসা করল, কবে বেনারস আসছেন?
ঠিক নেই।
কলকাতায় তো মাঝে মাঝেই যান?
তা যাই।
তবে?
তবে কি বেনারসে নামব? একটু হাসলাম, তোমার হোস্টেলে গিয়ে দেখা করতে ভীষণ অস্বস্তি লাগে।
কেন?
একটু ভাবলাম, জানি না কে কি ভাবব।
রমাও হাসল। বললো, মনে পাপ না থাকলে অস্বস্তি করার তো কথা নয়।
মুহূর্তের জন্য ভেবে বললাম, মনে মনে কে পাপী নয়? তুমি না?
রমা আর কথা বলেনি অনেকক্ষণ। বাড়ির কাছাকাছি এলে বললো, যাই হোক কলকাতায় যাতায়াতের পথে বেনারস নামবেন।
নামব?
হ্যাঁ, নামবেন।
হোস্টেলে গিয়ে দেখা করতে পারব না।
বেশ। আগের থেকে খবর দেবেন। আমি গিয়ে দেখা করব।
পরে বেনারসে রমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আমি গিয়েছিলাম। যেতে হয়েছিল। ও তখন এম এ পড়ে। সুভাষদারা মস্কোয়। বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে গণ্ডগোলের খবর পেয়েই সুভাষদা আমাকে টেলিগ্রাম পাঠালেন রমাকে দেখে খবর দেবার জন্য। আমি পৌঁছবার আগেই গণ্ডগোল বন্ধ হলেও তখনও পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। ক্যাম্পাসে ঢুকতে, বেরুতে পাস লাগে। রমা আমাকে। দেখে অবাক, আপনি হঠাৎ?
আগে বল তুমি কেমন আছ?
ও হাসতে হাসতে বললো, কেন? দেখে কি মনে হচ্ছে খারাপ আছি?
দেখে তত ভালোই মনে হচ্ছে কিন্তু খবরের কাগজ পড়ে ভেবেছিলাম হয় হাসপাতালে নয়তো পুলিশ লক-আপে তোমাকে দেখতে পাব।
তাহলে তো আপনার আশা ভঙ্গ করলাম।
নিঃসন্দেহে আশাভঙ্গ হলো কিন্তু সেজন্য তোমার বাবা-মা অত্যন্ত সুখী হবেন। একটু থেমে একবার ওর মুখের দিকে তাকিয়ে পকেট থেকে সুভাষদার টেলিগ্রামটা ওকে দিলাম।
টেলিগ্রামটা পড়েই ও চমকে উঠল, সে কি। বাবা আপনাকে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন?
পাঠাবেন না? তোমার যখন ছেলেমেয়ে হবে তখন বুঝবে…
রমা হাসল। আমাকে একবার ভালো করে দেখল। আপনি জার্নালিস্ট বলে বড় পাকা পাকা কথা বলেন।
হাজার হোক আমি তোমার বাবা-মার বন্ধু। এসব কথা বলার অধিকার আমার আছে বৈকি।
হঠাৎ রমা বললো, বাবা-মার বন্ধু হয়েই তো আপনি আমাকে মুশকিলে ফেলেছেন।
তার মানে?
রমা কিছুতেই মনের কথা খুলে বললো না। অনেক অনুরোধ করলাম।না, তবুও না। আজ পর্যন্ত রমা আমাকে সে কথা বলেনি। মনে হয় আর কোনোদিনই বলবে না। কেননা বাছ-বিচার না করেই মানুষের রোগ হয়। ধনী-দরিদ্র, ছেলেবুড়ো, শহুরে বাবু, গ্রামের চাষি। সবার স্বপ্ন দেখার মধ্যেও কোনো বাছবিচার নেই। সবাই দেখতে পারে। কোনো বাধা নেই। রমা কোনো বেহিসেবী স্বপ্ন দেখেনি তো? জানি না। কোনো গুণ না থাকলেও প্রাণ চঞ্চল কাঠবেড়ালীকে সবার ভালো লাগে। রমার ভালো লাগেনি তো? রমা রঞ্জনা হলো। আমি খুব খুশী। নিশ্চিন্ত। নানা কারণে মনে যে স্মৃতির। পলিমাটি পড়ে আছে, তার ওপর অনেক বেদনা-বিধুর স্বপ্ন জন্ম নিয়েছে। কোনো মানুষই তো শুধু দায়িত্ব-কর্তব্য, খাওয়া-পরা নিয়েই বেঁচে থাকে না। আমিও না। মনের মধ্যে কিছু স্বপ্ন সবারই জমা থাকে। আমারও আছে। বাইরে আমার যত দৈন্যই থাক, মনে মনে আমি সম্রাট। কোনো কিছুর বিনিময়েই সে সাম্রাজ্য বিলিয়ে দেওয়া যায় না।
যুক্তি, তর্ক, সামাজিকবোধ দিয়ে নিজেকে অনেক সংযত করলেও একটা বিষণ্ণ করুণ সুর মাঝে মাঝেই নিজের মধ্যে শুনতে পাচ্ছিলাম। সুভাষদাদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হবার আগের মতো। দিনগুলো কাটাচ্ছিলাম। সারাদিন সংবাদ সংগ্রহের তাগিদে ঘুরে বেড়াই, টাইপরাইটার খটখট করি, টেলিপ্রিন্টার-টেলেক্স অপারেটরকে গছিয়ে দিয়েই চলে যাই চাণক্যপুরীর কোনো না কোনো ডিপ্লোম্যাটিক পার্টিতে। রাত নটা-দশটা বা এগারোটা বারোটায় বাড়ি ফিরি। রাধাকিষণের সেবা উপভোগ করে শুয়ে পড়ি। কোনোদিন কোনো কারণে কোনো পার্টিতে না গেলে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরি। চাকফি খেয়ে লরেন্স ডুরেলের ডিপ্লোম্যাটিক জীবনের পটভূমিকায় লেখা স্পিরিট দ্য কোর বা স্টিফ আপার লিপ নিয়ে মজার মজার ঘটনাগুলো আবার পড়ি। কখনও বা শরৎচন্দ্রকেই পড়তে শুরু করি নতুন করে। বেশি ক্লান্ত থাকলে পড়ি না, পড়তে ইচ্ছা করে না। রাধাকিষণের সঙ্গেই গল্প করি।
হ্যাঁরে, একবার তোর বৌ-ছেলেদের দিল্লি দেখাবি না?
দিল তো করে মাগার…
মাগার কি হলো?
অনেক খরচা সাব।
তুই তো শুধু ট্রেন ভাড়া দিয়ে আনবি। থাকা-খাওয়ার তো খরচ লাগবে না।
রাধাকিষণ একটু কাচুমাচু করে বললো, তাছাড়া দিল্লির মতো ইতনা বড় শহরে আসতে বিবির খুব ডর।
আমি হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলাম, ভয় কিসের?
ওরা তো এত ভালো কোঠি, মোটর গাড়ি, টেলিফোন, ফ্রিজ, রেডিও–কিছুই দেখেনি…
তাহলে একবার আমিই তোর দেশে যাব।
গেলে তো সবাই খুব খুশী হবে মাগার আপনি আমাদের বাড়িতে থাকতে পারবেন না।
আমি কি কোটিপতি মহারাজা যে গ্রামে গিয়ে থাকতে পারব না?
রাধাকিষণের কাজ থাকে। বেশিক্ষণ গল্প করতে পারে না। চলে যায়। আমি একা বসে থাকি। নানা কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ রমার কথা মনে হয়। অনেক কথা। বহু ছোটখাট ঘটনা।
প্রথমবার বেনারস গেছি ওর সঙ্গে দেখা করতে। হাজার হোক প্রথম দেখা, প্রথম আলাপ। প্রথমে একটু জড়তা, দ্বিধা থাকবেই। আমারও ছিল, ওরও ছিল। সেই দ্বিধা আর জড়তা যখন চলে গেল, তখন রমা হাসতে হাসতে বললো, আপনি আসার আগে আপনার সম্পর্কে দারুণ দুশ্চিন্তা ছিল।
দুশ্চিন্তা?
হ্যাঁ।
কেন?
মার চিঠি পড়ে আর আপনার ওয়াশিংটনের ছবিগুলো দেখে মনে মনে আপনার সম্পর্কে একটা ধারণা করেছিলাম কিন্তু ভয় ছিল যদি আমার ধারণা ঠিক না হয়? যদি আপনি খুব গম্ভীর প্রকৃতির, খুব সিরিয়াস মানুষ হন?…।
আরো কিছু ভেবেছিলে নাকি? আমি হাসতে হাসতে জানতে চাই।
আমি এখানে একলা একলা থাকি বলে বাবা-মার খুব চিন্তা হয়। অনেক সময়ই, অনেককে আমার খোঁজ-খবর নিতে পাঠান কিন্তু অধিকাংশ লোককেই আমার ভালো লাগে না।
ভাবলাম জিজ্ঞাসা করি, আমাকে ভালো লেগেছে? কিন্তু পারলাম না। জানতে চাইলাম, আমার সঙ্গে আলাপ করে এখন কি মনে হচ্ছে?
আই অ্যাম নট ডিসঅ্যাপয়েন্টেড।
আমার সম্পর্কে ওর কাছ থেকে আরো কিছু শোনার আগ্রহে জিজ্ঞাসা করলাম, তার মানে?
তার মানে আপনি আমাকে হতাশ করেননি।
পরের দিন রমাকে নিয়ে টাঙ্গায় চড়ে সারনাথ গেলাম। ঝাঁকুনি সামলাতে গিয়ে দু একবার ও আমার হাতটা চেপে ধরেছে। শুধু প্রয়োজনে নাকি তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার ইচ্ছাও ছিল, তা বুঝতে পারিনি। তবে ভালো লেগেছে। ভালো লেগেছে সাবলীলভাবে মেশার জন্য। সারনাথে ধর্মরাজিকা স্কুপের পাশে দুজনে পাশাপাশি বসে অনেকক্ষণ অনেক গল্প করলাম। শেষের দিকে হঠাৎ বললো, আপনি আসার জন্য দুটো দিন বেশ কেটে গেল। রোজ কলেজ আর হোস্টেল লাইফ বড় একঘেয়ে লাগে।
কোথাও বেড়াতে যাও না?
কোথায় যাব? দু
চার দিনের ছুটিতে আশে-পাশে কোথাও তোমরা বেড়াতে যাও না?
একে হিন্দু ইউনিভার্সিটি, তার উপর আমরা মেয়ে। অত ঘুরাঘুরির সুযোগ এখানে নেই। একটু থেমে আবার বললো, কাছাকাছি যাদের বাড়ি বা আত্মীয়স্বজন আছে তারা অবশ্য দুচার দিনের ছুটিতেও অনেক সময় ঘুরে আসে কিন্তু কলকাতায় দাদু-দিদা ছাড়া আমার তো কেউ কাছাকাছি থাকে না।
কিন্তু তোমার তো এ সমস্যার সমাধান হওয়া মুশকিল।
আপনি মাঝে মাঝে আসবেন।
মাঝে মাঝেই কি আসা সম্ভব?
আপনি তো বিয়ে করে সংসারে জড়িয়ে পড়েন নি যে দু এক দিনের জন্যও বেরুতে পারবেন!
বিয়ে না করলেই বুঝি ইচ্ছামতো আসা যায়?
নিশ্চয়ই যায়।
আমি মজা করে বললাম, তাহলে তো তুমিও মাঝে মাঝে দিল্লি আসতে পার।
আমি তো মেয়ে। তাছাড়া হোস্টেল থেকে আমাকে ছাড়বে নাকি? এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আমি যখন ছুটিতে বাবা-মার কাছে যাব তখন এসে দেখবেন কত ঘুরতে পারি।
ওর প্রস্তাব শুনে হাসি পায়। বলি, তুমি ছুটিতে কায়রো-লন্ডন-মস্কো-ওয়াশিংটন যেতে পার বলে কি আমিও পারব?
আমি বলছিলাম যদি আসেন…
ঐ ইফস্ অ্যান্ড বাটগুলোই তো লাইফের সব চাইতে বড় সমস্যা।
তারপর রমা বলেছিল, বাবা দিল্লিতে এলে দেখবেন আপনাকে কি বিরক্তি করি।
হঠাৎ একজন মানুষের সঙ্গে আলাপ হতে পারে, ঘনিষ্ঠতা হতে পারে, ভালোবাসা হতে পারে কিন্তু কোনো কারণেই মুহূর্তের মধ্যে সেই পরিচিত, ভালোবাসার পাত্রপাত্রীকে মন থেকে মুছে ফেলা যায় না। আমি অনেকবার অনেক রকমভাবে চেষ্টা করেও রমার ঐ বুদ্ধিদীপ্ত মখখানা ভুলতে পারছিলাম না। পর পর কদিন নাইট শোতে সিনেমা গেলাম। সিনেমা হলে ঢুকলেই নিউজ রীল দেখতে হয়। দেখতে হলো। আরো অনেক কিছুর সঙ্গে বুদ্ধগয়া আর সারনাথে বুদ্ধ জয়ন্তী উৎসবও দেখাল। ভুলতে গিয়ে আবার সবকিছু নতুন করে মনে পড়ল।
আপনি তো জার্নালিস্ট। একদিন না একদিন কোনো না কোনো কারণে আপনাকে সারনাথে আসতেই হবে কিন্তু তখন কি মনে পড়বে আমার সঙ্গে একটা দিন কাটিয়েছিলেন?
ঐ নিউজ রীলের জন্য অর্ধেক সিনেমাটাই মন দিয়ে দেখতে পারলাম না।
বেনারসের মতো দিল্লিতেও যদি গঙ্গা থাকত তাহলে বেশ নৌকা চড়ে বেড়াতে পারতাম, তাই না?
কেন, গাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়াতে তোমার ভালো লাগে না?
লাগে কিন্তু নৌকা যখন মাঝ গঙ্গায় টলমল করে, তখন ভয়ও লাগে, মজাও লাগে।
নৌকা যখন বেশি দুলতে শুরু করত তখনই রমা দুহাত দিয়ে আমার একটা হাত চেপে ধরত। জিজ্ঞাসা করতাম, নৌকা ঘুরিয়ে নিতে বলব?
না, না, ঘুরিয়ে নেবে কেন?
তুমি ভয় পাচ্ছ যে!
একটু একটু ভয় পাচ্ছি ঠিকই কিন্তু আপনি তো আছে।
রাধাকিষণ খেতে ডাক দেয়। চটিটায় পা দিতে গেলেই আবার মনে পড়ে কায়রোতে রমাই পছন্দ করেছিল, এইটাই নিন। খুব সুন্দর মানাবে আপনাকে।
সুন্দর চটি পরলেই কি আমি সুন্দর হবো?
আপনাকে সুন্দর দেখতে বলে এত অহঙ্কার কেন?
তোমার কাছে আমি রূপের অহংকার করব?
মেয়েদের সৌন্দর্যের সঙ্গে পুরুষের সৌন্দর্যের তুলনা করার কোন মানে হয় না।
রমার কথা কেন এত মনে হয় তা জানি না। বুঝতে পারি না। কিন্তু হয়। হবেই। মাঝে মাঝেই হয়। বোধহয় মনের মধ্যে একটা শূন্যতা অনুভব করি। বোধহয় কেন? নিশ্চয়ই একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। মনে মনে বেদনাবোধ করি কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এই ভেবে সান্ত্বনা পাই যে দূরের অপরিচিত ছেলের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়নি।
তার চাইতে বড় কথা দেবব্রত চৌধুরীর সঙ্গে ওর বিয়ে হলো। কোনো না কোনো ভালো ছেলের সঙ্গেই রঞ্জনার বিয়ে হতো কিন্তু ভালোরও তো জাত আছে। দেবব্রত শুধু একটা ভালো ছেলে নয়, একটা স্বপ্ন, একটা সাধনা, একটা বিরাট সম্ভাবনা। ডক্টর চৌধুরীর রিসেপসনে সুভাষদাকে সেই কথাই বললাম।
একটু দাঁড়াও। আমি এক্ষুনি আসছি। সুভাষদা ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলেও একটু পরেই বৌদিকে নিয়ে ফিরে এলেন। বৌদিকে বললেন, শোন শোন ও কি বলছে।
বৌদি আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কি বলছ?
এবার আমি বললাম, সুভাষদাকে বলছিলাম দেবব্রতর মতো ছেলে হয় না।
সঙ্গে সঙ্গে সুভাষদা বললেন, না না, তুমি যে কথাগুলো আমাকে বললে, ঠিক সেই কথাগুলোই ওকে বলল।
বলছিলাম, দেবব্রত ইজ এ পিস অফ ড্রিম, একটা সাধনা, একটা বিরাট সম্ভাবনা।
বৌদি চট করে একবার সুভাষদার দিকে তাকিয়ে আমাকে বললেন, দেবুকে দেখে তো খুবই ভালো মনে হয়।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, গিল্টি সোনার গহনা দেখতেও তো ভালো লাগে কিন্তু দেবু পাকা সোনা।
আনন্দে খুশীতে ওঁরা নীরব হয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন।
সত্যি বলছি বৌদি, এমন ভালো ছেলে আমি খুব কম দেখেছি।
হাজার হোক একটি মাত্র সন্তান। রমাকে ওরা অত্যন্ত বেশি ভালোবাসেন। সারা জীবন ফরেন সার্ভিসে কাটিয়েও সুভাষদা ওকে নিছক সুন্দর একটা বাঙালি মেয়ে তৈরি করেছেন। একমাত্র সন্তানকে ছেড়ে থাকতে অত্যন্ত কষ্ট হলেও বেনারসে রেখে পড়িয়েছে। মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে ওঁরা অত্যন্ত চিন্তিত ছিলেন। আমার কথা শুনে ওঁরা দুজনেই শুধু খুশী নন, নিশ্চিন্ত হলেন।
দেবব্রত পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। আমাদের তিনজনকে দেখে একটু থমকে দাঁড়াল। আমি ওকে বললাম, আপনাকে দেখে আমার ঈর্ষা হচ্ছে।
দেবব্রত জিজ্ঞাসা করল, কেন?
ভালো স্ত্রী অনেকেই পায়, কিন্তু ভালো শ্বশুর-শাশুড়ি পাওয়া সত্যি ভাগ্যের দরকার।
দেবব্রত জবাব দেবার আগেই বৌদি বললেন, না না। তোমার মতো জামাই পেয়েছি বলে আমরাই ভাগ্যবান।
দেবব্রত বললো, না মা, ওকথা বলবেন না।
আমি ঠাট্টা করে বললাম, দু মিনিট আগেই বৌদি বলছিলেন জামাইটা ঠিক মনের মতো হলো না।
সত্যি সত্যি ডান হাতটা তুলে বৌদি বললেন, একটা চড় খাবে।
দেবব্রত হাসল, মা আপনাকেও মারবেন না, আমারও নিন্দা করবেন না।
দেবব্রত আর দাঁড়াল না, চলে গেল।
আচ্ছা বৌদি, আজকালকার কোনো ছেলে এমন সুন্দর করে মা ডাকবে?
সত্যি বলছি ওর মা ডাকটা শুনতে আমার ভীষণ ভালো লাগছে।
সুভাষদা বললেন, ওর মা ডাক শুনেই বোঝা যায় হাউ ইনোসেন্ট হি ইজ।
হাজার হোক ডক্টর দেবতোষ চৌধুরীর ভাইয়ের বিয়ে। প্রেসিডেন্ট বা প্রাইম মিনিস্টার না এলেও অনেক ভি-আই-পি এসেছিলেন। এসেছিলেন অনেক গণ্যমান্য বরেণ্য অতিথি। আস্তে আস্তে সবাই চলে গেলেন। প্যান্ডেল ফাঁকা হলো। মোটর গাড়ির হর্নের আওয়াজ বন্ধ হলো। ভাটা পড়ল ক্যাটারারদের কর্মচাঞ্চল্যে। ডক্টর চৌধুরী, দেবব্রত, সুভাষদা, বৌদির কাছ থেকে ছুটি নিয়ে ভিতরের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, রঞ্জনা, আমি যাচ্ছি।
রমা হাসল, আপনিও রঞ্জনা বলছেন?
রমাই তো রঞ্জিত হয়ে রঞ্জনা হলো।
ও হাসল।
আমি যাচ্ছি।
এক্ষুনি?
হ্যাঁ।
এত তাড়াতাড়ি?
তাড়াতাড়ি কোথায়? নটা বাজে।
তাতে কি হলো?
সাড়ে পাঁচটায় এসেছি। এখনও যাব না?
রিসেপসনের সময় ছিল ছটা থেকে সাড়ে সাতটা। আটটা পর্যন্ত অনেকেই ছিলেন। রঞ্জনা তাই কিছু বলতে পারল না, চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। এমন সময় দেবব্রত এলো। বললাম, টেলিফোন করবেন।
নিশ্চয়ই।
আমি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম। বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্যান্ডেল পার হয়ে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাবার সময়ই দেবব্রত এসে হাজির। আপনি কিছু খেলেন না?
আমি ওঁর কাঁধে একটা হাত রেখে বললাম, খেয়েছি।
আপনাকে তো কিছু খেতে আমি দেখিনি।
আমার যা খাবার আমি ঠিকই খেয়েছি।
না, আপনি আমাদের সঙ্গে খেয়ে যান।
সত্যি বলছি আমি খেয়েছি, এখন আর কিছু খাব না। আমি চলি।
রঞ্জনা বলছিল…
ওকে কথাটা বলতে না দিয়েই আমি বললাম, ওকে আপনি একটু বুঝিয়ে বললেই হবে। গুড নাইট।
গুড নাইট।
আমি গাড়ির দিকে এগুতেই দেবব্রত বাড়ির মধ্যে চলে গেল।
গাড়িতে স্টার্ট দিলাম কিন্তু ক্যাটারারের একটা টেম্পো সামনে থাকায় এগুতে পারছিলাম না। হঠাৎ দেবব্রত এসে হাজির, আপনাকে রঞ্জনা একটু ডাকছে।
আমাকে?
হ্যাঁ।
স্টার্ট বন্ধ করে গাড়ি থেকে নামলাম। প্যান্ডেল পার হয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকলাম। লিভিংরুমে বসে ডক্টর চৌধুরী সুভাষদাদের সঙ্গে গল্প করছিলেন। আমাকে ওঁরা দেখতে পেলেন না। আমি আরো এগিয়ে গেলাম।
কি ব্যাপার? তুমি আমাকে ডেকেছ?
হ্যাঁ।
কেন?
আপনি আমাদের সঙ্গে খাবেন।
কফি-টফি অনেক কিছু খেয়েছি। এখন আর কিছু খাব না।
দেবব্রত আমার পাশেই দাঁড়িয়েছিল কিন্তু প্যান্ডেলের ওদিক থেকে কে যেন ডাকতেই চলে গেল।
খেয়ে যান। আমি খুব খুশী হব।
মনে মনে বললাম, তোমাকে খুশী করার দিন শেষ। কি হবে তোমাকে খুশী করে। আমি তোমার এই ছোট অনুরোধনা রাখলেও খুশীর বন্যায় তুমি ভেসে যাবে। ভীত সন্ত্রস্ত হরিণীর মতো যত সংশয়ই তোমার মধ্যে এখন থাক, সব দূর হয়ে যাবে। আসন্ন কালবৈশাখীতে তৃণখণ্ডের মতো আমাকে খুশী করার প্রবৃত্তি, মন উড়িয়ে নেবে।
কি হলো? কথা বলছেন না যে?
আমি একবার ওর দিকে চাইলাম, কাল ভোর সাড়ে ছটায় আমার ফ্লাইট, তা জান তো?
জানি।
চারটের সময় উঠতে হবে।
হোক। আপনি না খেয়ে যেতে পারবেন না।
পারব না?
না।
আমি হাসলাম।
হাসছেন কেন? বিয়ে হয়ে গেল বলে কি পর হয়ে গেলাম ভাবছেন?
আমি কিছুই ভাবছি না।
বিয়ে হোক আর যাই হোক, আমার কথা আপনাকে শুনতেই হবে।
.
এই পৃথিবীতে মানুষ কত কথা বলে। শৈশব থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত। প্রয়োজনের কথা, ইচ্ছার কথা। কখনও কখনও মনের কথাও মানুষ বলে। কিন্তু কম। খুব কম। মানুষ প্রকাশ্যে অন্যের অবগতির জন্য যত কথা বলে তার চাইতে অনেক অনেক বেশি কথা বলে মনে মনে। আপন মনে। যে বক্তা, সেই শ্রোতা। কেন জানি না, সেদিন রাত্রে আমার মনে হলো, রমা, রঞ্জনা মনে মনে অনেক কথাই বললো আমাকে। আমি শুনতে পেলাম না কিন্তু কেমন করে যেন অনুভব করলাম। মনে মনে, হৃদয় দিয়ে। ওর মুখের ভাষা, চোখের ইঙ্গিত দেখে।
সপ্তাহখানেক পরে সুভাষদা আর বৌদি মস্কো ফিরে গেলেন। ডক্টর চৌধুরী, দেবব্রত, রঞ্জনা ও সুভাষদার কয়েকজন বন্ধুবান্ধব এয়ারপোর্টে এসেছিলেন। আমিও ছিলাম। অনেক কথা, অনেক চোখের জল পড়ল। আমি রঞ্জনাকে বললাম, কাঁদছ কেন? হিন্দু ইউনিভার্সিটি থেকে এমএ পাস করে এবার দিল্লিতে ডক্টরেট পড়তে এসেছ আর রিসার্চ প্রজেক্ট হচ্ছে বাঙ্গালোরে…
কেউ কেউ হাসলেন। রঞ্জনা আমাকে বললো, আপনি চুপ করুন তো।
কিছুক্ষণ পরে সুভাষদার প্লেন ছাড়ল। আমরা সবাই আকাশের দিকে চেয়ে রইলাম কয়েক মিনিট। তারপর আস্তে আস্তে রওনা হলাম বাড়ির দিকে। ডক্টর চৌধুরী আর দেবব্রত দুজনেই ওদের ওখানে যেতে অনুরোধ করলেন। বললাম, সময় পেলেই আসব।
সময় পেয়েছি অনেক দিন অনেক সময়। আমি যাইনি। দেবব্রত লম্বা ছুটি নিয়ে এসেছে। হয়তো ঘুরবে ফিরবে বেড়াবে। দিল্লিতে, দিল্লির বাইরে। হয়তো সিমলা পাহাড়ে বা আরো দুরে ডাল লেকে।
অথবা গুলমার্গের নিশ্চিন্ত প্রশান্ত পরিবেশে। কত নামকরা লোক ডক্টর চৌধুরীর বন্ধু ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত। দেবব্রত আর রঞ্জনাকে নিয়ে তাদের কাছে যাবেন। তারাও আসবেন। এইসব নানা কিছু চিন্তা করে আমি যাইনি। আরো একটা কারণ ছিল। রঞ্জনা এখন শুধু সুভাষদার মেয়ে নয়, ডক্টর চৌধুরীর ভ্রাতৃবধু, দেবব্রতর স্ত্রী। আমি সাংবাদিক। বহু লোকের সঙ্গে আমার আলাপ, ঘনিষ্ঠতা। অনেকে খাতিরও করেন। কেউ কেউ ভালোবাসেন। কিন্তু ওদের মতো সামাজিক মর্যাদা আমার নেই। হবেনা। চাঁদের আলোর মতন সাংবাদিকদেরও নিজস্ব কোনো আলো নেই, পরের, ভি-আই পিদের সূর্য-কিরণেই উদ্ভাসিত। ছোটখাট সুক্ষ্ম আত্মসম্মানবোধ, সামাজিক কারণে আমি যাইনি। মস্কো থেকে বৌদির চিঠি এসেছে। রঞ্জনার খবর নিয়ে জানাতে বলেছেন। আমি রঞ্জনার খবর নিইনি, বৌদির চিঠিরও জবাব দিইনি। ভেবেছি কি দরকার বেশি উৎসাহী হবার। যতটুকু ঘনিষ্ঠতা আছে, সেই যথেষ্ট। আরো ঘনিষ্ঠ হবার প্রয়োজন নেই।
তাছাড়া মানুষের মতো ঘনিষ্ঠতম, হৃদ্যতা ভালোবাসা বা তিক্ততারও একটা নির্দিষ্ট আয়ু আছে। মেয়াদ আছে। এই সংসারে, এই মাটির পৃথিবীতে কোন কিছুই তো চিরস্থায়ী নয়, চিরদিনের নয়। নদীর মতো মানুষের জীবনেও জোয়ার আসে, ভরিয়ে দেয় মন-প্রাণ, দুর করে অনেক দৈন্য কিন্তু তার স্থায়িত্ব কতটুকু? ভাটার টানে আবার সবকিছু চলে যায়। ফিরিয়ে দিতে হয়। তা না হলে হিসাবের খাতায় মিল হবে কি করে? শুধু আসবে, আমদানি হবে, কিছুই ফিরে যাবে না, রফতানি হবে না? তাই কি কখনও হয়?
প্রেসিডেন্টের ট্যুর কভার করতে গিয়ে সুভাষদা, জয়ন্তী বৌদির সঙ্গে একটু বেশি হৃদ্যতা হয়ে গেছে। রমার সঙ্গে একটু অদ্ভুত ধরনের বন্ধুত্ব, ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। সামাজিক অনুশাসন বা নিজেদের কোনো দৈন্য বা অন্য যে কোনো কারণেই হোক বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখেও অনেক কাছে এসেছি দুজনে।
.
ডাইনিং টেবিলে আমার সামনের দিকে বসে রমা জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, আপনি তো অনেকবার বাইরে গিয়েছেন, তাই না? ।
হ্যাঁ গিয়েছি।
আমাদের অনেক ডিপ্লোম্যাটের সঙ্গে নিশ্চয়ই আপনার আলাপ হয়েছে বা আছে?
সে তো খুব স্বাভাবিক।
অনেকের সঙ্গেই কি আপনার ঘনিষ্ঠতা?
অনেকের সঙ্গে কি ঘনিষ্ঠতা হয়?
তাহলে বাবার সঙ্গে এত ভাব হলো কেন?
বোধহয় উই লাইকড ইচ আদার।
আর মার সঙ্গে?
ঐ একই কারণে।
আমার সঙ্গে?
তোমার সঙ্গে আবার ঘনিষ্ঠতা হলো কোথায়?
পারহ্যাপস ইউ আর রাইট। মেলামেশা করলেও ঠিক ঘনিষ্ঠ হতে আপনি চান না, তাই না?
আমি কি চাই, তা তো তুমি বলবে।
রমা হাসতে হাসতে বললো, আপনি শুধু আবির দিয়ে হোলি খেলতে চান, রঙ মাখতে চান না।
শুধু আবির দিয়ে হোলি খেলেছি নাকি রঙও মেখেছি। তা ঠিক বুঝতে পারি না। মাঝে মাঝে মনে হয় রঙও মেখেছি। আবার কখনও কখনও মনে হয় হোলিই খেলিনি। রমা কি হোলি খেলেছিল? রঙ মেখেছিল সর্বাঙ্গে? নাকি শুধু মুখেই একটু আবির মেখেছিল?
এসব প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারব না, নিতেও পারব না। অনুত্তরই থেকে যাবে। তবু মনের মধ্যে এসব প্রশ্ন উঁকি দেয়। বেশিদিন চেপে রাখতে পারি না। একটা অস্বস্তি, জ্বালা বোধ করি মনের মধ্যে। মনে হয় রমাকে একবার কাছে পেলেও বোধহয় একটু ভালো লাগত। শান্তি পেতাম। অনেকবার ভেবেছি যাই, ওদের খোঁজ করি, দেখি ওরা আছে কিনা। থাকলে একটু কথা বলব, গল্প। করব। একটু হাসব। দেখব ওর হাসি, সুন্দর বুদ্ধিদীপ্ত মখখানা…কিন্তু শেষ পর্যন্ত যাইনি, যেতে পারিনি।
.
দিন পনের পর সন্ধ্যার পর অফিস থেকে ফিরে দেখি দেবব্রত আর রঞ্জনা বাড়ির সামনে গাড়িতে বসে আছে। আমাকে দেখেই ওরা গাড়ি থেকে নামল। দুজনকেই একবার দেখে নিয়ে দেবব্রতকে জিজ্ঞাসা করলাম, অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছেন বুঝি?
বেশিক্ষণ নয়, বড় জোর মিনিট দশেক।
বুঝলাম, অনুমান করলাম তারও বেশি সময় অপেক্ষা করছে কিন্তু খেয়াল নেই। নতুন বিয়ের পর সময় যেন হাওয়ায় উড়ে যায়। ঘড়ির কাটা আর মনের কাটা একই গতিতে ঘোরে না।
আই অ্যাম রিয়েলি ভেরী সরি!
দেবব্রত বললো, এর জন্য দুঃখ করার কি আছে?
রঞ্জনা জিজ্ঞাসা করল, আপনার চাকরটা কোথায়?
ছুটিতে।
তিনজনে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। রঞ্জনা জিজ্ঞাসা করল, আপনার খাওয়া-দাওয়ার কি হচ্ছে?
তালা খুলতে খুলতে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, দেখে কি মনে হচ্ছে অনশন করছি?
এই বুঝি আমার প্রশ্নের জবাব হলো?
দরজা খুলে আলোপাখার সুইচ অন করলাম। জানালাগুলো খুলে দিলাম। এক মিনিট।
আমি কিচেনে গিয়ে চায়ের জল চাপিয়ে ফ্রিজ আর কাপবোর্ড খুলে দেখছিলাম ওদের খেতে দেবার কিছু আছে নাকি। একটাও ডিম পেলাম না। পেলাম শুধু কিছু নাটস আর একটা কেকের অর্ধেক। একটা প্লেটে নাটসগুলো ঢালছি এমন সময় পিছন থেকে রঞ্জনার কথা শুনে চমকে উঠলাম, আপনি এসব কি করছেন?
বাপরে বাপ! এমন করে কেউ চমকে দেয়?
আমাদের বসিয়ে আপনি এসব কি করছেন?
বিশেষ কিছুই না, শুধু চা।
কোনো দরকার ছিল না।
তোমাদের দরকার না থাকলেও আমার মর্যাদা আর মানসিক শান্তির জন্য দরকার আছে।
রঞ্জনা এবার বললো, চা চিনি দুধ কই?
আমি কোনো কথা না বলে সব কিছু এগিয়ে দিতেই ও বললো, আপনি যান, আমি নিয়ে আসছি।
আমি দেবব্রতর কাছে এসে বসলাম। কোথাও বেড়াতে গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ, নৈনিতাল গিয়েছিলাম প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটু কৈফিয়ত দিল, যেতে চাইনি কিন্তু দাদা জোর করে পাঠালেন।
ভালোই করেছে। নিজেদের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং হবার জন্য এই সময় একটু বাইরে যাওয়া ভালো।
রঞ্জনা চা, নাটস কেক নিয়ে এলো। আমাদের দিল। ও নিজেও নিল।
একটু লজ্জিত হয়েই বললাম, প্রথম দিন আপনারা এলেন অথচ কিছুই অফার করতে পারলাম না বলে…
দেবব্রত বললো, এখন আবার কি অফার করবেন?
রঞ্জনা জিজ্ঞাসা করল, আপনি হঠাৎ এত ফর্মাল হয়ে গিয়েছেন কেন বলুন তো?
বিয়ের সঙ্গে সঙ্গে তোমার ও দেবব্রতবাবুর একটা নতুন মর্যাদা হয়েছে আমি তার অমর্যাদা। করতে পারি না।
আমার কথায় ওরা দুজনেই হাসল।
চা খেতে খেতে নানা কথা হলো।
রঞ্জনাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার বাবা-মার চিঠি পেয়েছ?
পৌঁছোনোর সংবাদের টেলিগ্রাম ছাড়া মার দুটো বাবার একটা চিঠি এসেছে।
তুমি চিঠি দিয়েছ?
দিয়েছি। আপনি ওঁদের কোনো চিঠি পাননি?
তোমার মার একটা চিঠি পেয়েছি।
জবাব দিয়েছেন?
না, এখনও দিইনি। দু একদিনের মধ্যেই দেব।
এবার দেবব্রতর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, রঞ্জনাকে আপনার দাদার ভালো লাগছে তো?
দাদা তো ওর প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত।
তাই নাকি?
ওরও দাদাকে খুব ভালো লেগেছে।
ভালো। খুব ভালো। অমন দাদাকে ভালো না লাগার তো কোনো কারণ নেই।
এবার রঞ্জনা বললো, সত্যি দাদার মতো মানুষ হয় না। বি-এইচ-ইউতে অনেক পণ্ডিত মানুষ দেখেছি কিন্তু দাদার মধ্যে পাণ্ডিত্য আর হিউম্যান কোয়ালিটিজ সমান।
আমি সমর্থন জানালাম, ঠিক বলেছ। এবার একটা সিগারেট ধরিয়ে দেবব্রতকে জিজ্ঞাসা করলাম, রঞ্জনাকে আপনার ভালো লেগেছে তো?
এক মুহূর্তের জন্য দেবব্রত একটু ভাবল। আমার মনে হয় আমার চাইতে আরো ভালো আরো কোয়ালিফায়েড ছেলের সঙ্গে ওর বিয়ে হওয়া উচিত ছিল।
এবার রঞ্জনার দিকে ফিরে বললাম, কি রঞ্জনা, তোমারও কি ধারণা আরো ভালো মেয়ের সঙ্গে ওঁর বিয়ে হওয়া উচিত ছিল?
রঞ্জনা একবার দেবব্রতর চোখে চোখ রেখেই ঘুরিয়ে নিল। হলে নিশ্চয়ই আরো খুশী হতে আরো সুখী হতো।
আরো কিছুক্ষণ গল্পগুজব করার পর হঠাৎ ও জিজ্ঞাসা করল, রাত্রে আপনার খাওয়া-দাওয়ার কি হবে?
রাত্রে বিশেষ কিছু খাব না।
কেন? চাকর নেই বলে?
ঠিক তা নয়। দুপুরে খুব বেশি খেয়েছি।
রঞ্জনা একটু হাসল। ঘরে চাল-ডাল তরি-তরকারি নেই?
ব্যাচেলার বলে কি সংসার করি না? সব কিছু আছে। বেশ গর্বের সঙ্গেই জানালাম।
কোথায় আছে দেখিয়ে দিন তো। বলেই ও উঠে দাঁড়াল। দেবব্রতর দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি দাদার ওষুধটা কিনে আনো। এর মধ্যে আমার এদিকের কাজ হয়ে যাবে।
দেবব্রতও সঙ্গে সঙ্গে উঠল।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, রঞ্জনা, তুমি কি বিয়ের পর সন্ন্যাসিনী হয়েছ?
ওরা দুজনেই হাসল।রঞ্জনা বললো, আপনার জন্য দুটো ডালভাত রান্না করলেই যদি সন্ন্যাসিনী হওয়া যায় তাহলে আমি রাজি।
আমার উপকার না করে বাড়ি যাও। ডক্টর চৌধুরী নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য চিন্তা করছেন।
দেবব্রত বললল, দাদা এখানে নেই। কাল সকালে ফিরবেন।
আমি আরো কয়েকবার বললাম কিন্তু ফল হলো না। দেবব্রত আমার কথা শুনল না। স্ত্রীর কথা শুনে ওষুধ আনতে গেল। দেবব্রত বেরিয়ে যেতেই বললাম, ঠিক করলে না রঞ্জনা।
কেন?
হাজার হোক আমি ব্যাচেলার। তার উপর বয়সটা খুব বেশি নয়, আমার জন্য তোমার এতটা ব্যগ্রতা না দেখানই ভালো হতো।
রঞ্জনা একটু জোরেই হাসল। হঠাৎ হাসি থামিয়ে বললো, কে আপনাকে ব্যাচেলার থাকতে বলেছে?
আমার কথা ছাড়ো। তবে ভবিষ্যতে এমন উৎসাহ দেখিও না।
কেন?
হয়তো তোমার ক্ষতি হতে পারে।
রঞ্জনা হাসল, আচ্ছা সে দেখা যাবে। এখন কিচেনে চলুন তো।
কি করব? বাধ্য হয়ে ওকে সব কিছু দেখিয়ে দিলাম। সামান্য সাহায্য করলাম। দুটি ওভেনে একসঙ্গে রান্না শুরু হলো।
ফ্রিজ রয়েছে অথচ মাছ, মাংস, ডিম কিছুই রাখেন না কেন?
তুমি আসবে জানলে নিশ্চয়ই রাখতাম।
এবার থেকে রাখবেন।
তুমি এসে রান্না করে দেবে?
রোজ না হলেও মাঝে মাঝে এসে করব বৈকি।
তা না হলে নাটক জমবে কেন?
রঞ্জনা হাসল।
একটু পরে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, দেবব্রতর ছুটি কতদিন আছে?
আর এক সপ্তাহ।
তুমি ওঁর সঙ্গেই ব্যাঙ্গালোর যাচ্ছ?
হ্যাঁ যাচ্ছি তবে মাঝে মাঝেই আমি দিল্লি আসব।
কেন?
দাদার জন্য। তরকারি নামিয়ে একবার আড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসির রেখা ঠোঁটের পাশে লুকিয়ে বললো, তাছাড়া আপনিও তো এখানেই আছেন।
হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, আমি এখানে আছি বলেই তো এতদিন নৈনিতালে কাটিয়ে এলে।
রমার মুখের চেহারাটাই পাল্টে গেল। আমার দিকে তাকাতেই ভয়ে আমি দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। তারপর বললো, আমি বলেই নৈনিতালের লেকের জলে সবকিছু ডুবিয়ে দিতে পারিনি।
তা আমি জানি।
তাহলে এসব কথা আর কোনদিন বলবেন না।
তুমি মাঝে মাঝে আসবে তো?
বোধহয় আপনি না চাইলেও আমাকে আসতে হবে।
রান্না প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। আমি ওর কথার কোনো জবাব না দিয়ে ড্রইংরুমে এসে বসলাম। একটু পরেই দেবব্রত এলো।
ওষুধ পেয়েছেন?
হ্যাঁ পেয়েছি।
কবে ব্যাঙ্গালোর যাচ্ছেন?
এইত শুক্রবারে।
আবার কবে দিল্পি আসছেন?
আমি আর এর মধ্যে আসছি না। ও আসবে।
রঞ্জনা এলো।
আমি দেবব্রতকে বললাম, আপনার স্ত্রীর পরোপকার করার বাতিকটা একটু কন্ট্রোল করবেন।
দেবব্রত বললো, আপনার জন্য সামান্য একটু রান্না করল বলে…
ওর কথার মাঝখানেই রঞ্জনা বললো, খুব অন্যায় করেছি। এর পরদিন মাছ মাংস রান্না করে আজকের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে যাব।
আমি মাছ মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। ওরা দুজনেই হো হো করে হেসে উঠল।