যোগমায়ার শোক আজ পুনরায় জেগে উঠেছিলো। পথিকের মুখপানে একবার দৃষ্টিপাত করেই তার বক্ষে তুমুল আলোড়ন উপস্থিত হয়। মানুষে মানুষে কি এমনই সাদৃশ্য থাকে?
সেই থেকে যে কতোবার গোপনে অশ্রু মোচন করেছেন গণনা করা যাবে না। আজ চন্দ্রদাস জীবিত থাকলে কি সংসার তার এমন হতশ্রী হয়? একটি পুত্রবধূ গৃহে আনতেন তিনি। মনোহরদাসের কন্যাটির কথা স্মরণ হলে প্রাণ তার ব্যাকুল হয়ে ওঠে। হায় ভগবান, কি কুক্ষণেই না চন্দ্রদাসকে তিনি মেলায় যাবার অনুমতি দিয়েছিলেন। যাত্রার প্রাক্কালে বারে বারেই সে বলছিলো, মা, চিন্তার কোনো কারণ নেই। দুই পক্ষকাল এমন কিছু দীর্ঘ সময় নয়। আমি বস্ত্রগুলি বিক্রয় করে মাত্র কয়েকদিন অবস্থান করবো, লক্ষ্মণাবতী পর্যন্ত যদি যাই, তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা, পক্ষকালের অধিক বিলম্ব হতে পারে।
কী মায়াময় কথা তার! বলেছিলো, মা তোমার বড় পরিশ্রম হয়–আমি ফিরে এলে তোমরা পুত্রবধূ ঘরে এনো। আহা! ঐ কথা কটি বলবার সময় ঈষৎ লজ্জা হয়েছিলো বাছার। তারপর বলেছিলো,–পিতাকে বলো, চৈত্রের পূর্বেই যেন গৃহ সংস্কারের কার্যাদি সম্পন্ন করে ফেলেন। আর শোনো, কৃষ্ণা গাভীটি বৃদ্ধা হয়ে পড়েছে, যদি সন্ধান পাওয়া যায়, তাহলে ভালো একটি দুগ্ধদা গাভী ক্রয় করো। পিতাকে বলো, তিনি যেন কায়স্থ পল্লীর লোকদের সঙ্গে বিবাদে না যান। পথিমধ্যে আমি মাতুলালয়ে যাবো, মাতুলকে বলবো, তিনি যেন এখানে এসে কিছুদিন অবস্থান করেন।
নানান প্রয়োজন অপ্রয়োজনের কথা বলছিলো সে। বড় দায়িত্ববান পুরুষ হয়ে উঠেছিলো বাছা–অথচ কি বা বয়স তার! তবু দেহটি হয়ে উঠেছিলো বলিষ্ঠ এবং মনটি মায়াময়। গৃহাঙ্গন ত্যাগের মুহূর্তে ভগিনীর অশ্রু ভারাক্রান্ত মুখ দেখে তার বেণীটি মুষ্টিবদ্ধ করে বলেছিলো, অরে বান্দরি, তুইও কাঁদছিস? এ যাত্রা আমার শ্মশান যাত্রা নাকি?
হায়, কে জানতো ঐ যাত্রাই তার শ্মশান যাত্রা হয়ে উঠবে!
প্রতিটি কথা তাঁর স্মরণ হচ্ছিলো। শয্যাগ্রহণের পরও তার চক্ষে ঘুম আসেনি। নীরবে অশ্রু মোচন করছিলেন। মায়াবতী পাশে নিদ্রামগ্না। হতভাগিনীর কথা ভেবেও তার দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো। দীর্ঘদিন জামাতা বসন্তদাস এখানে আসে না, কোথায় যে গেছে, কেউ জানে না। শুধু জানা গেছে যে, সে নাকি বাণিজ্যে গেছে। এ দিকে মায়াবতী যেমন চঞ্চলা, কী হয় বলা যায় না।
অকস্মাৎ তাঁর সম্বিৎ হলো যে শয্যায় মায়াবতী নেই। তাঁর মনে কোথায় যেন শঙ্কা দুলে ওঠে–এতো রাতে মায়াবতী শয্যায় নেই কেন? তিনি উঠলেন। কাউকে না ডেকে কক্ষ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে বাইরে এলেন। অঙ্গন অতিক্রম করে বহির্বাটির দিকে শ্রবণ পাতলেন। এবং যা আশঙ্কা করছিলেন, অস্পষ্টভাবে, তা–ই ঘটেছে বলে তার সন্দেহ হলো। পথিককে দেখে মায়াবতীর চাঞ্চল্য লক্ষ্য করেছিলেন তিনি। এখন বুঝলেন, কেন ঐরূপ চঞ্চল হয়ে উঠেছিলো কন্যাটি। মায়াবতীর স্বামী সন্দর্শন মাত্র একবারই হয়েছে। আজ সপ্তম মাস অতিক্রান্ত হতে যাচ্ছে, কিন্তু বসন্তদাসের কোনো সন্ধান নেই। এদিকে পথিক যুবাপুরুষ, তায় সুন্দরকান্তি। না জানি কী আছে তার মনে। নিজের কন্যাটিকে তো চেনেন–এমন চঞ্চল স্বভাব কেন যে ওর হলো, ভেবে পান না। তার পিতাই অত্যধিক স্নেহ দিয়ে কন্যার মস্তকটি চর্বণ করেছেন। অবশেষে তিনি পুনরায় কান পাতলেন। শুনতে পেলেন সত্যিই বহির্বাটির কক্ষ থেকে মায়াবতীর কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে।
ক্রোধ হলো তাঁর। মায়াবতী আর কিশোরী বালিকাটি নেই। কৈশোরে সে বড় জ্বালাতন করেছে। আহীর পল্লীর তরুণটিকে নিয়ে সে যা আরম্ভ করেছিলো তাতে কলঙ্ক রটতে বিলম্ব হতো না। সৌভাগ্য যে ভ্রাতা দীনদাস ঐ সময়ই বিবাহের সম্বন্ধটি এনেছিলেন। দূরের সম্বন্ধ, কিন্তু তখন আর বিলম্ব করতে সাহস হয়নি। সানন্দেই বিবাহে সম্মতি দান করেছেন।
আর জামাতাটিও যে কী, যোগমায়া বুঝতে পারেন না। নবীন যুবক–এই সময়ে তার স্ত্রী সান্নিধ্যের আকর্ষণটিই প্রধান হওয়া উচিত। কিন্তু দেখো, মূর্খ দেশে দেশে বাণিজ্য করে বেড়াচ্ছে। এদিকে বিবাহের পর মায়াবতীর চাঞ্চল্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, মুখরা হয়েছে আরও অধিক। কিছু বলেন না তিনি। কিন্তু তাই বলে এতো দূর! রাত্রির মধ্যযামে অপরিচিত যুবাপুরুষের কক্ষে প্রবেশ করবে!
যোগমায়া কন্যার আচরণে ক্রুদ্ধা যেমন হলেন, তেমনি আবার ব্যথিতও হলেন।
কিন্তু তৎক্ষণাৎ কিছু করতে গেলেন না। ত্বরিত কিছু করেন না তিনি–সে স্বভাবই তাঁর নয়। বরং অপেক্ষা করলেন। অনতিবিলম্বে লীলাবতীসহ কন্যাকে পথিকের কক্ষ থেকে নিষ্ক্রান্ত হতে দেখলেন। লীলাবতীকে দেখে তাঁর স্বস্তির নিঃশ্বাস নির্গত হলো। যাক, মেয়ে তাহলে অঘটন কিছু ঘটায়নি।
তখনও কিন্তু মৃদুস্বরে উভয় সখীর মধ্যে বাদানুবাদ চলেছে। মায়াবতী বারবার বলছিলো, অন্যায় তো কিছু করিনি। একজনকে একটি সংবাদ নিতে বলার মধ্যে অন্যায়টা কোথায় হলো? মানুষের সংবাদ মানুষের নেওয়া কর্তব্য।
তুই যেভাবে দেখিস, অন্যে তো বিষয়টা সেভাবে না–ও দেখতে পারে। আমি স্বামী পরিত্যক্তা বলে যদি তাঁর করুণা হয়, তাহলে সেটা কি আমার জন্য লজ্জার বিষয় নয়? বল তুই?
রাখ তোর লজ্জা, ওটা শতবার ধৌত করে জলপান কর গিয়ে। যে লোকের সঙ্গে তোর জীবনে দ্বিতীয় বার সাক্ষাতের সম্ভাবনা নেই, তার কাছে আবার লজ্জা কি রে কুকুরি?
না সখী, এ তোর অন্যায় হয়েছে, লীলাবতী বুঝতে চায় না। বলে, আমাকে সঙ্গে নিয়ে ঐকথা তোর বলতে যাওয়া উচিত হয়নি।
ঐকথা না বলতে যাবো তো আর কোন কথা বলতে যাবো? মায়াবতী ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বলে, অরে পামরি, তুই কি ভেবেছিলি আমি তোকে নিয়ে পথিকের সঙ্গে মিলনের জন্য অভিসারে যাবো? আর পথিকের সান্নিধ্যে গেলে প্রণয়লীলা অনুষ্ঠিত হবে?
না, তা নয়, লীলাবতীর স্বর তখনও আহত। বলে, সে কথা ভাবিনি, দূর দেশের পথিক, তার কতো অভিজ্ঞতা, কতো কাহিনী, ঐ সবই কিছু শুনবো বলে আশা করেছিলাম
এই পর্যন্ত উভয়ের কথা হয়েছে, ঐ সময় যোগমায়া ডাকলেন, মায়াবতী, এদিকে আয়।
দুজনই চমকিত হলো, কিঞ্চিৎ ভীতও। কিন্তু যোগমায়া কিছু বললেন না। শুধু আদেশ করলেন, লীলাবতী গৃহে যাও, রাত্রি গম্ভীর হয়েছে।
লীলাবতী চলে গেলে কন্যার কাছে জানতে চাইলেন, পথিক কি অভিমন্যু দাসের পরিচিত?
না, কিন্তু আম্রপট্টলীতে তাঁর মাতুলালয়।
যোগমায়া আরও কিছু বলতেন, কিন্তু কে জানে কেন, ঐ প্রসঙ্গে আর গেলেন না। শুধু বললেন, ঐ কথা বলবার জন্য পথিকের কক্ষে যাওয়া তোমার উচিত হয়নি। তোমার মাতুলকে বললেই পারতে, তিনিই বলতেন।
পরদিবস প্রত্যুষে শ্যামাঙ্গ প্রস্তুত, যাত্রা করবে। জলযোগ ইতোমধ্যে সমাপন হয়েছে। আহার্যাদি প্রস্তুত করেছেন মায়াবতীর মাতা অন্ধকার থাকতেই। গতরাতে সঙ্কোচবশ অতিথির সম্মুখবর্তী হননি, আজ হলেন। বললেন, বৎস, তোমার সমাদর হলো না, দুদিন থেকে গেলে পারতে।
ঐ কথা কটি শ্রবণমাত্র কী যেন ঘটে যায় শ্যামাঙ্গের মনে। মহিলার মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করলে অজানা এক চাঞ্চল্য অনুভব করে সে। কেমন মনে হয়, ঐ চক্ষু দুটি কোথায় যেন সে দেখেছে–ঐ কণ্ঠস্বরটিও তার চেনা, যেন বহুকাল পর সে ঐ স্বর। শুনতে পাচ্ছে। সে কিছু বলতে পারে না। মায়াবতী মায়ের পাশে ছিলো। সেও বললো, দুদিন থেকে গেলে কী এমন ক্ষতি হবে আপনার?
ঐ কথার পরও শ্যামাঙ্গের মুখে বাক্য নিঃসরণ হয় না। সে জানে, তার জানানো উচিত, গৃহে প্রত্যাবর্তন তার অত্যন্ত প্রয়োজনীয়–নতুবা মাতৃস্নেহধারায় অভিষিক্ত হওয়ার এই অমূল্য সুযোগ সে ছাড়তো না, অল্প সময়ে সে যা পেয়েছে তা তার চিরদিন মনে থাকবে। এ পথে সে যতোবার আসবে, ততোবারই ও মাতৃপদে প্রণামের সুযোগ সে গ্রহণ করবে–এই সব বাক্য তার মনে আসছিলো। তবে এও আবার উপলব্ধি হচ্ছিলো যে ঐ প্রকার বাক্য শোনাবে নিতান্তই আনুষ্ঠানিক এবং কৃত্রিম। তাই সে নীরবে কালক্ষেপণ করে। কোন কথাটি যে বলবে, কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না।
একেবারে শেষ মুহূর্তটিতেও তার মুখে কথা আসে না। কেবলই মনে হয়, মায়ের কাছে সন্তানের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কি সাজে? সে আভূমি নত হয়ে যায় এবং যোগমায়ার পদধূলি গ্রহণ করে।
আর ঐ পবিত্র মুহূর্তটিতেই ঈষৎ কম্পিত মাতৃস্নেহের পুণ্য স্পর্শ অনুভব করে সে তার শিরোদেশে। উদ্গত অশ্রুরোধ চেষ্টায় কাতর মায়ের মুখভাবটি দেখবার মতো যথেষ্ট সাহসী সে হতে পারে না। তার কেবলি মনে হতে থাকে যে, আর যদি সে বিলম্ব করে তাহলে সে ভেঙে পড়বে এবং ঐ মাতৃপদকমল দুটি জড়িয়ে ধরে সমস্ত জীবনকালের মাতৃস্নেহের তৃষ্ণা সে মিটিয়ে নেবে। তাই সে অত্যন্ত দ্রুত, প্রায় সজোরে নিজেকে বিচ্ছিন্ন। করার মতই, গৃহদ্বার থেকে ছুটে পথে বেরিয়ে আসে এবং যথাসম্ভব দ্রুত পদচালনা করতে থাকে। না, বড় মায়া পশ্চাতে। পুনর্ভবা তীরের মাতৃময়ী নারীর স্নেহ স্পর্শ তাকে যেন উদ্বাহু হয়ে ডাকছে। বাল্যকালে সে মাকে হারিয়েছে, সেই অবিকল মাকে সে আবার দেখতে পাবে–এ যে কল্পনাও করা যায় না। অনেকখানি পথ অতিক্রম করার পর সে পশ্চাতে মুখ ফেরালো। এবং তখনও দেখতে পেলো, তারই গমন পথে দৃষ্টি প্রসারিত করে অনিমেষ নয়নে দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে দুই নারী। একজন মাতা, অন্যজন ভগিনী। দুজনার স্নেহোদ্বেল চোখে মঙ্গল কামনার উদ্ভাস। শ্যামাঙ্গকে মুহূর্তেক দাঁড়াতে হলো– আর তাতে চিত্রটি তার অন্তরে চিরকালের জন্য মুদ্রিত হয়ে গেলো। দূরযাত্রায় নিষ্ক্রান্ত ভ্রাতা ও পুত্রকে এইভাবেই চিরকাল মাতা ও ভগিনীরা বিদায় জানিয়েছে। তার মনে পড়লো, ঠিক এই চিত্রটিই সে সোমপুর বিহারে প্রাচীর গাত্রের মৃঙ্কলকে উত্তীর্ণ দেখেছে। দ্বারদেশে দুই নারী দাঁড়িয়ে রয়েছে, দৃষ্টি দূরে নিবদ্ধ। সে তখন বোঝেনি, শিল্পী কোন বিষয় ঐ ফলকে উৎকীর্ণ করেছেন–এখন বুঝলো, মনে মনে সেই প্রাচীন শিল্পীকে সে প্রণাম জানালো।
গ্রাম এখনও কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠেনি। সূর্যোদয়ের এখনও কিছু দেরি, বাতাসে ঈষৎ শৈত্যভাব। কোথাও কোথাও গবাদি পশু গোশালা থেকে নিষ্ক্রান্ত হচ্ছে পেছনে কিশোর রক্ষপাল।
পথের দুধারে আম্রবৃক্ষ, নবাম্রভারে কোনো কোনো শাখা আভূমি বিনত। পনসবৃক্ষের কাণ্ডগুলি ফলপিণ্ডে আকীর্ণ। কিছুদূর অগ্রসর হয়ে সে গ্রাম সংলগ্ন কাননে প্রবেশ করলো। মনে হলো, কুসুমিত মধুক বৃক্ষবীথির সুগন্ধ তাকে সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। মধুপ গুঞ্জরণের ধ্বনিও শ্রবণে এলো। একটি কুক্কুরকে ভূমিনত মস্তকে ইতস্তত ভ্রমণ করতে দেখে সে অবাক হয়। কুক্কুরও কি মধুক পুষ্প ভক্ষণ করে? কিন্তু অচিরেই সন্দেহ নিরসন হয়। ওটি কুক্কুর নয়–নিতান্তই শৃগাল। সে ভূমি থেকে লোষ্ট্ৰখণ্ড হাতে নিয়ে শৃগাল লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করে।
আর তখনই একটি হাসির শব্দ তাকে সচকিত করে দেয়। পশ্চাতে দৃষ্টিপাত করতেই দেখে, লীলাবতী অঞ্চল মুখলগ্ন করে দাঁড়িয়ে আছে। সে বিব্রত বোধ করে–লোষ্ট্র নিক্ষেপের ঐ বালসুলভ কাণ্ডটি না করলেও পারতো। লীলাবতী নিশ্চয়ই তাকে বালকের মতো চপল–স্বভাব বলে ধারণা করছে। চোখে চোখ পড়লে তাকে হাসতে হলো। বললো, এতো প্রত্যুষে এখানে আপনি?
আমার মেষ শাবকটির সন্ধানে এসেছি, লীলাবতী জানায়। বলে, আর বলবেন না, এই মাতৃহীন শাবকটি বড় জ্বালাতন করে–তা আপনি কি যাত্রা করলেন?
হ্যাঁ, আজ বহুদিন আমি গৃহত্যাগী, গৃহে প্রয়োজনীয় কর্মাদি রয়েছে।
বিগত রাত্রির কথা স্মরণ হওয়ায় শ্যামাঙ্গ পুনরায় বলে, আপনি চিন্তা করবেন না, আমি আম্রপট্টলীতে নিশ্চয়ই যাবো।
তার ঐ কথায় কী ছিলো ঈশ্বর জানেন, লীলাবতীর হাস্যালোকিত আননে যেন ছায়া পড়ে একটি–কুঞ্চিত হতে দেখা গেলো তার ভ্রূযুগল। মুখের ঐ ভাব গোপন না করেই সে বললো, গত রাত্রির কথা স্মরণ রেখেছেন সে জন্য আমি কৃতজ্ঞ, কিন্তু একটা কথা জানবেন, গত রাতে আপনার সঙ্গে সাক্ষাতের আগ্রহাতিশয্য ছিলো মায়াবতীর, আমার নয়, যা শুনেছেন, ঐসব কথাও আমার নয়।
আপনার নয়? শ্যামাঙ্গ হতচকিত বোধ করে–এ কী কথা শুনছে সে পুনর্ভবা তীরের। প্রোষিতভর্তৃকা এই যুবতীর মুখে?
আমাকে দেখলে কি মনে হয় আমি বিরহ কাতরা?
শ্যামাঙ্গ প্রমাদ গণনা করে, সত্যিই তো, প্রোষিতভর্তৃকা বিরহ কাতরা রমণীর বেশবাস ও আচরণ কি এই প্রকার হয় কখনও?
সে প্রশ্ন না করে পারে না। বলে, আপনার স্বামীকে কিছুই জানাবার নেই আপনার?
না, আমার নিজের কিছুই জানাবার নেই। লীলাবতী বলে, শুধু জানাবেন, আমার পিতা রুগ্ন হয়ে পড়েছেন, তিনি জামাতাকে একবার দেখতে চান।
শ্যামাঙ্গের প্রত্যয় হয় না। লীলাবতীর কথার অর্থ সম্যক বোঝা তার পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সে ভালো করে দেখে, সোমপুরের মঞ্জুশ্রী মন্দিরে দেখা পীবরস্তনী যক্ষিণী মূর্তিটি যেন সে দেখতে পাচ্ছে চোখের সম্মুখে। হ্যাঁ, ঐ প্রস্তর মূর্তিটির মতোই ঋজু শান্ত এবং কঠিন। সে মুখপানে চেয়ে বিভ্রান্ত বোধ করে। কিছু বলতে পারে না। যত্নে আঁকা, সীমান্তের ঐ উজ্জ্বল সিন্দুর রেখাটি তাহলে কেন? যদি সে স্বামীর জন্য উদ্বিগ্না না হবে?
লীলাবতী অপ্রতিভ হয় না। পথিকের ঐ প্রকার বিমূঢ় দৃষ্টি তাকে বিন্দুমাত্রও বিচলিত করে না। সে স্থির দৃষ্টিতে শ্যামাঙ্গের মুখপানে চেয়ে থাকে। শ্যামাঙ্গকে তখন বলতে হয়, আমি পথিক মাত্র, পারিবারিক জটিল বিষয়াদি আমার জানবার কথা নয়। কিন্তু তবু বলছি, কোনো বার্তা থাকলে আপনি অসংকোচে আমাকে বলতে পারেন, আমি যথাস্থানে তা পৌঁছে দেবো।
লীলাবতীর ভাবান্তর হয় না ঐ কথার পরও। তখন শ্যামাঙ্গ আবার বলে, আপনার সংকোচের কোনো কারণ নেই, এ আমার নিজের দায়–যে গ্রামে রাত্রিযাপন করেছি, অন্ন গ্রহণ করেছি, সেই গ্রামের লোকের সামান্যতম উপকারে আসতে পারলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করবো।
শ্যামাঙ্গের কথায় অকৃত্রিমতা ছিলো। আর সেই জন্যই সম্ভবত লীলাবতীর দৃঢ়সংবদ্ধ ওষ্ঠদ্বয়ে হাসির রেখা খেলে গেলো। বললো, অহেতুক এতো কথা বলছেন, এই মূখা গ্রাম্য রমণী আপনার ভাষা কিছুই বুঝছে না, আপনি নির্দ্বিধায় যাত্রা করুন–প্রেরণ করার মতো সত্যিই আমার নিজের কোনো বার্তা নেই।
শ্যামাঙ্গকে সপ্রতিভ হতে হয়। বলে, আপনার রোষ দেখছি গভীর–বোঝা যাচ্ছে, হতভাগ্য অভিমন্যু দাসের জন্য ভবিষ্যতে মহাদুর্বিপাক অপেক্ষা করছে।
কেন, এমন কথা কেন বলছেন?
কুপিতা স্ত্রী ভয়ঙ্কর বস্তু, শ্যামাঙ্গ জানায়।
ও, তাহলে ঐ কারণেই আপনি গৃহে প্রত্যাগমনের জন্য অস্থির? লীলাবতীর স্বরে পুনরায় কৌতুক ধ্বনিত হয়।
আমি কোন ছার, দেবাদিদেব মহাদেব পর্যন্ত তটস্থ থাকেন।
শিব ঠাকুরের ঐ ভয় কিন্তু কপট ভয়, লীলাবতী স্মরণ করিয়ে দেয়।
কপট ভয়? শ্যামাঙ্গ বলে, সম্মার্জনী হস্তে দেবীর চামুণ্ডা মূর্তি কল্পনা করুন তো!
দেবীর মূর্তি যাই হোক, শিব তো জানেন, মানভঞ্জনের কলাকৌশল কীভাবে প্রয়োগ করতে হয়। শিবের পথ অনুসরণ করুন–গৃহলক্ষ্মীর পদসেবা কেমন করে করতে হয়। জানেন তো?
না, তা তো অধমের জানা নেই, মুখে নির্বোধের ভাব আনে শ্যামাঙ্গ।
তাহলে তো দেখছি, আপনার ললাটে সম্মার্জনী প্রায় অবধারিত।
উপায় কি! শ্যামাঙ্গ কপট দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে, অনুশীলনীর জন্যও তো পদযুগল প্রয়োজন–তা কোথায় পাবো?
কেন, গৃহলক্ষ্মী কি গৃহে নেই আপনার? লীলাবতী বিস্ময় মানে।
যে লক্ষ্মী অধিষ্ঠিতাই হলেন না গৃহে, তাঁকে গৃহলক্ষ্মী কেমন করে বলি।
লীলাবতীর কৌতুক অন্তর্হিত হয়। সে ভেবে পায় না, এই সুপুরুষ কান্তিমান যুবক কেন এখনও অবিবাহিত। সে অধিকতর কৌতূহলী হলো। বললো, আত্রেয়ী তীরের গ্রামগুলিতে রমণী যথার্থই কি মহার্ঘ?।
শ্যামাঙ্গ দেখছিলো, সূর্যোদয় হয়েছে তার বিলম্ব হয়ে যাচ্ছে। মনে হলো, এই বাক্য ব্যয় অহেতুক। প্রত্যুষের এই বিজন কানন পথে লীলাবতীর মতো যুবতী রমণী যতোই আকর্ষণীয়া হোক, চৈত্র দ্বিপ্রহরের মার্তণ্ড প্রতাপ তার চেয়েও অধিক সর্বগ্রাসী। সে বললো, ভদ্রে, অনুমতি করুন, যাত্রারম্ভ করি–বিলম্ব হলে পথে কষ্ট হবে, আমি আবার আসবো, তখন কথা হবে।
লীলাবতী গম্ভীর হয়। কিন্তু সরে যায় না। শুধু বলে, বিদায়কালে মিথ্যা ভাষণ করতে নেই।
মিথ্যা ভাষণ? শ্যামাঙ্গের এবার বিলক্ষণ উন্মা হয়। বলে, কোথায় দেখলেন যে আমি মিথ্যা ভাষণ করেছি?
মিথ্যা নয়? বলুন, কোন প্রয়োজনে আবার আপনি এ পথে আসবেন?
লীলাবতীর দুচোখে এবং কণ্ঠস্বরে বিচিত্র একটি ভাব তখন জেগে উঠেছে। দেখে শ্যামাঙ্গের মনে হলো, সম্মুখের এই যুবতী রমণী অহেতুক তার পথরোধ করে দাঁড়িয়ে নেই। যদি আরও বিলম্ব করে, তাহলে অন্য কিছু একটা ঘটে যাবে।
সে বললো, আপনি আমার কথা বিশ্বাস করতে চান না, কিন্তু আমার কথা শুনে রাখুন, যাত্রাকালে আমি মিথ্যা ভাষণ করবো না। আমার গুরু বসুদেব বিল্বমূল গ্রামে রয়েছেন–তাঁর সঙ্গে আমার বাদানুবাদ হলেও তাঁর কাছে আমাকে যেতেই হবে আর দ্বিতীয় কথাটি এই যে, আমি বাল্যকাল থেকে মাতৃহীন, আপনাদের গ্রামে আমার মাকে খুঁজে পেয়েছি, কথাটা মায়াবতী জানে না, তার জননীও জানেন না। ওই মাতমুখ দর্শনের জন্য আপনাদের গ্রামে সত্যিই আমি আবার আসবো।
লীলাবতীর মুখের কুঞ্চিত ভ্রূ সরল হয়, ওষ্ঠের কোণে হাসির রেখাটি দেখা যায়। বলে, চপল স্বভাব বালিকার মতো অনেক কথা বলে ফেলেছি, মনে কিছু নেবেন না–তবে যদি কখনও এ পথে আসেন, তাহলে সেই ভবিষ্যতের জন্য উজুবট গ্রাম পূর্বাহেই আপনাকে স্বাগত জানিয়ে রাখলো, আপনি নিশ্চয়ই আসবেন।
লীলাবতী চলে গেলে, পথ অতিক্রম করতে করতে শ্যামাঙ্গের মনে নানান চিন্তার উদয় হয়। সমস্তই লীলাবতী প্রসঙ্গ। বারবার মনে হলো, ঐ যুবতী দুর্বোধ্য বিস্ময়ের প্রতিমূর্তি। বারবার তার ঐ শ্লোকটির কথা মনে হলো, যাতে বলা হয়েছে যে, দেবতারাও স্ত্রী চরিত্র বিষয়ে অজ্ঞ। তার অনুমান হলো সম্ভবত লীলাবতীর মতো নারীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো বলেই শ্লোককার শ্লোকটি রচনা করেছেন।
লীলাবতী গৃহে প্রত্যাগমনকালে নিজেকেই ধিক্কার দিচ্ছিলো। বলছিলো, ছি ছি দগ্ধমুখি, তোর লজ্জা হলো না, এতো কথা বলতে গেলি কেন? তুই না গতকালের ধারণা নিরসন করতে এসেছিলি? এ যে গতকালের চাইতেও অধিক হয়ে গেলোতোর যে অনেক কিছু জেনে গেলো লোকটা। ছি ছি
তার মেষ শাবকটিকে ঐ সময় সে দেখলো, দূরে একটি গোধুম ক্ষেত্রে বিচরণে ব্যস্ত। তার ইচ্ছে হলো না যে, শাবকটিকে গিয়ে ধরে। বরং তার মনে হলো, পিতা হয়তো এতোক্ষণে জেগে উঠে চিৎকার আরম্ভ করে দিয়েছেন। সে দ্রুতপদে গৃহাভিমুখী হলো। পথিমধ্যে হঠাৎ এক কোকিল চিৎকার করে উঠলে সে গালি দিলো, দগ্ধমুখ, তোর মরণ হয় না! মধুক বৃক্ষ তলে দেখলো, একটি প্রকাণ্ড প্রজাপতি উড়ে এসে তার উচ্চ করবীতে বসতে চাইছে–সে ছি ছি করে উঠলো পুনরায়–ধিক তোকে, আমার কাছে কেন, চক্ষুর মস্তকটি কি ভক্ষণ করে বসে আছিস? অন্ধ কোথাকার, যে লোকটি আত্রেয়ী তীরাভিমুখে চলেছে, তাকে দেখতে পাসনি?
গৃহে উপনীত হয়ে দেখে, পিতা সত্যিই জাগরিত হয়েছেন, তবে চিৎকার করছেন। সে অবাক হলো। কক্ষমধ্যে প্রবেশ করে দেখে, একটি লোক পিতার শয্যাপার্শ্বে বসে আছেন এবং পিতা তাকে নিজ দুর্দশার কথা বলে যাচ্ছেন।
সে বাধা দিলো না, এটা আজকাল অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অপরিচয়–পরিচয় নির্বিশেষে পিতা এই কাজটি আজকাল করেন।
আগন্তুক শ্মশ্রুধারী, প্রৌঢ়। তাঁর হাতের যষ্টিটি বঙ্কিম, সম্ভবত হেমতালের। গ্রীবায় প্রস্তরখণ্ডাবলীর মালা, পরিধেয় অত্যন্ত অপরিষ্কার, কাছে গেলে এক প্রকার দুর্গন্ধ ঘ্রাণে আসে। লীলাবতী ভাবছিলো, লোকটিকে বিদায় করে দেয়। কিন্তু হঠাৎ শুনলো, লোকটি ডাকছে, মা লীলা, এদিকে এসো।
নিকটে গেলে পিতা বললেন, ইনি তোমার মাতুল, যোগব্রত নিয়েছেন–সংসারে থাকেন না, এঁকে প্রণাম করো।
লীলা প্রণাম করলে বললেন, ভ্রাতঃ, একে স্বামীগৃহে পাঠিয়ে দাও–অনেক দিন তো রইলো তোমার কাছে। হরকান্ত পরমকুটুম্বের পরামর্শ শুনে কিছু বললেন না। লীলা গৃহকর্ম দেখবার জন্য বাইরে গেলো।
যোগী সিদ্ধপা এক সময় পুনরায় বললেন, ভ্রাতঃ, দিনকাল ভালো নয়–যুবতী মেয়েরা ক্রমেই অরক্ষণীয়া হয়ে পড়ছে–তোমার সৌভাগ্য যে রাজপুরুষদের দৃষ্টি তোমার কন্যাটির উপর পড়েনি।
আগন্তুক হরকান্তকে পূর্বদেশের, পশ্চিমদেশের, দক্ষিণদেশের নানান কথা জানালেন। যেমন পূর্বদেশে পুনরায় সদ্ধর্মীদের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে–পশ্চিমে রাষ্ট্রবিপ্লব সমুপস্থিত, ভয়ানক যবন জাতি শনৈঃ শনৈঃ পূর্বে অগ্রসর হচ্ছে–কখন কী হয়, বলা যায় না। এমত শোনা যায় যে, এই যবন রাজ মূর্তিমান যম একেবারে। খর্বদেহ, কিন্তু বাহু দুটি যেন ভূমিস্পর্শ করে। শ্মশুকেশ উভয়ই ঘন, চক্ষুদ্বয় রক্তবর্ণ–এবং যখন নিজ ভাষায় ইয়া। আলী বলে হুঙ্কার দেয়, তখন মানুষের হৃৎকম্প উপস্থিত হয়। হাতের অস্ত্র ত্যাগ করে সৈনিক পুরুষেরা ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করে।
যোগী সিদ্ধপা দক্ষিণদেশের কথা বিশেষ বলতে চাইলেন না। শুধু বললেন, ভ্রাতা হরকান্ত–তোমাকে কি বলবো–মাতা বসুমতী পাপের ভার দীর্ঘকাল বহন করতে পারেন না। যা অবশ্যম্ভাবী, তাই হবে। পরম ভট্টারক মহারাজ লক্ষ্মণ সেন দেবের মুষ্টির বাইরে চলে গেছে পরিস্থিতি–কেউ তাকে রক্ষা করতে পারবে না। তার পতন কেবল সময়ের প্রশ্ন।
হরকান্ত যোগী সিদ্ধপাকে দেখছিলেন। শুশ্রুমণ্ডিত মুখাবয়ব হলেও চক্ষু দুটি স্মরণ করতে পারেন। একদা ক্ষেত্রজীবী গৃহস্থ ছিলো এই যোগী পুরুষ। একমাত্র সন্তান পুত্রটিকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। পুত্রটি কায়স্থ পল্লীতে খেলতে যেতো–এবং ঐ সময়ই কায়স্থ পল্লীর বালকেরা তাকে বর্ষায় স্ফীত পুনর্ভবার প্রবল স্রোতে নিক্ষেপ করে।
ঐ ঘটনায় দীননাথ উন্মাদপ্রায় হয়ে যায়, স্ত্রী কমলা উন্মাদিনী হয়ে পুনর্ভবায় ঝাঁপিয়ে পড়ে–নাহ, সেই ঘটনা স্মরণ করতেও প্রাণ শিহরিত হয়। হরকান্তের রুগ্ন দেহে সেই ভয়াবহ ঘটনার স্মৃতি এতোকাল পর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলো। তার অস্থিরতা বৃদ্ধি পেলো। শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট আরম্ভ হলো।
সিদ্ধপা নিজ ভগিনীপতিটির অবস্থা লক্ষ্য করছিলেন। বড় অসহায় অবস্থা এখন হরকান্তের। যদি তার মতো মুক্ত পুরুষ হতে পারতো তাহলে বেঁচে যেতো। কিন্তু তার যে আবার একটি কন্যা রয়েছে। সংসার তাকে ছাড়ে না, সে বেচারার উপায় কি? যদি সমস্ত কিছু ত্যাগ করে একবার বেরিয়ে আসতে পারতো হরকান্ত, তাহলে আর রোগ শোকে সে এমন বিকল হতো না।
সিদ্ধপা এক দিবস অবস্থান করলেন হরকান্তের গৃহে। এখান থেকে তিনি প্রথমে দক্ষিণে তারপর পূর্বে যাবেন। হ্যাঁ, অবশ্যই তিনি আম্রপট্টলী গ্রামে যাবেন এবং জামাতার সন্ধান করবেন–তবে একটা কথা–সিদ্ধপা ভগিনীপতিকে পরামর্শ দেন, যদি সংবাদ পাওয়া যায় যে অভিমন্যু দাস স্বগ্রামেই অবস্থান করছে, তাহলে আর অপেক্ষায় না থেকে লীলাবতীকে সেখানে প্রেরণ করাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত।
লীলা দ্বারান্তরাল থেকে মাতুলের উপদেশ শুনে মন্তব্য করলো, মাতুল বললেই হলো, আসুক দেখি, কে আসছে আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য?
তার সেই অপমান কেমন করে ভুলবে! কুসুম শয্যার রাত্রে লোকটা তার মুখ দুহাতের অঞ্জলিতে নিয়ে কেবলি বলছিলো, আমার বিশ্বাস হয় না–আমার বিশ্বাস হয় না।
অতি মৃদুস্বরে সে জানতে চেয়েছিলো, কি বিশ্বাস হয় না আপনার?
উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে মুখপানে চেয়েছিলো অভিমন্যু–আর বলেছিলো, বিবাহে বিশ্বাস হয় না, নারীতে বিশ্বাস হয় না, তোমাকে বিশ্বাস হয় না।
নববধূ স্বামীর মুখপানে চেয়ে ওষ্ঠদংশন করে মাত্র–অবগুণ্ঠন যেমন ছিলো তেমনি থেকে যায়। তার কিছুই করার থাকে না। ঐ লোকটি, যাকে সে মাত্রই এক দিবসকাল পূর্ব থেকে জেনেছে স্বামী বলে, সে তার মুখপানে কী দেখে ঈশ্বর জানেন। অভিমন্যু কি উন্মাদ? লীলাবতীর সন্দেহ হয়। বাইরে তখনও সম্পর্কিত আত্মীয়া রমণী ও বালিকারা কলহাস্যে মত্ত, আকাশে হেমন্তের জ্যোৎস্না। লীলাবতীর দুই চক্ষু অশ্রুময় হতে আরম্ভ করে। অভিমন্যু যখন তার কঞ্জুলিকার গ্রন্থিমোচন করতে যায় তখন সে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকিত হয়ে বলে–না। যখন অভিমন্যু আলিঙ্গনের জন্য ব্যগ্র দুবাহু প্রসারিত করতে চায়, তখনও সে না বলে। এবং শেষে যখন নীবিবন্ধ স্পর্শ করে অভিমন্যু, তখন লীলাবতী চিৎকার করে ওঠে।
কেন, কেন? বিভ্রান্ত বিহ্বল দৃষ্টি এবং স্খলিত কণ্ঠস্বর অভিমন্যুর। সে তখনও জানতে চায়, তাহলে আমার অনুমান সত্য–বলো? প্রথমে সেই ব্রাহ্মণ কিশোরটি, তাই না? সেই উপবীতধারী তরুণ গৌরোজ্জ্বল ব্রাহ্মণ বালক তাই না? অতঃপর পিতার প্রভুপুত্রটি তাই না? নাকি প্রতিবেশী কেউ?
লীলার আর সন্দেহ থাকে না। বদ্ধ এক উন্মাদের হাতে তুলে দিয়েছেন তাকে তার পিতা। এর চেয়ে যে মরণ ছিলো ভালো। সে স্বামীর প্রলাপ শুনছিলো এবং প্রতি প্রশ্নের উত্তরে বলছিলো–হা, হ্যাঁ, হ্যাঁ। যতোবার প্রশ্ন ততোবার হ্যাঁ। অভিমন্যু দাস হা হতোস্মি, আমার ভাগ্যে এই ছিলো, বলে শয্যায় পতিত হয়। ঐভাবেই তার অতিক্রান্ত হয়ে যায় কুসুম শয্যার রাত্রিটি।
লীলা আবিষ্কার করেছে, পরে। অদ্ভুত এক জটিল মানসিক অবস্থা অভিমন্যু দাসের। তার একটি কিশোরী ভগিনী ছিলো। সেই ভগিনীটি ছিলো এক ব্রাহ্মণ কিশোরের খেলার সঙ্গীতাকে একদিন এক কায়স্থ যুবক অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে সে ফিরে আসে এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনও করে। এক প্রৌঢ়ের তৃতীয়পক্ষের স্ত্রী হয়ে সে ভগিনীটি এখন তিন সন্তানের জননী।
কারও কোনো ক্ষতি হয়নি, শুধু অভিমন্যুর এই মানসিক জটিলতাটুকু ছাড়া।
তুমি গবাক্ষ পাশে কেন দাঁড়িয়েছিলে, বলল, কি দেখছিলে? পুষ্পবতীর স্বামী ভীমনাথকে? তোমার তাকে ভালো লাগে? তার সান্নিধ্যে যেতে চাও? সত্যি করে বলো, তুমি যা চাও, তাই হবে।
লীলাবতী দ্বার রুদ্ধ করে, গবাক্ষ রুদ্ধ করে, নিজেকে অন্ধকারে গোপন রাখে–তবু উন্মাদের সন্দেহ। একেকদিন শরীর নিরাভরণ করে কখনও স্তনে অঙ্গুলি নির্দেশ করতো, এটি কে প্রথম মর্দন করেছে বলো, সেই ব্রাহ্মণ কিশোর, নাকি কোনো কায়স্থ লম্পট, নাকি তোমার প্রতিবেশীদের কেউ? কখনও আবার উরুদেশে হাত রেখে জানতে চাইতো, লীলা, এখানে কেন নখরাঘাতের চিহ্ন নেই? সেই ব্রাহ্মণ কিশোর কি নখর রাখতো না?
অবশেষে লীলাবতী পিতৃগৃহে এলো। এবং সেই যে এলো তারপর বৎসরাধিককাল হতে চললো। অভিমন্যুর কোনো সংবাদ নেই।
লীলাবতী মাতুলের সব কথাই শুনেছে। রাষ্ট্রবিপ্লব সম্পর্কে তার ধারণা নেই, যুদ্ধ কাকে বলে তাও সে কল্পনা করতে পারে না। তবে আসন্ন কোনো বিপদের আশঙ্কা যে তার মাতুল করছে, সেটা সে বুঝতে পারে এবং সে জন্য তার যে স্বামীগৃহে অবস্থান করা উচিত, সেটা বুঝতেও তার অসুবিধা হয় না। কিন্তু এইখানেই তার বিদ্রোহ। প্রলয় যখন হবে তখন কে বাচবে, কে মরবে, তার কোনো স্থিরতা নেই। বাচবো বলে কৌশল অবলম্বন করলেই যে বাঁচা যাবে, তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? সুতরাং ও চেষ্টা কেন? সে স্থির করে, পিতৃগৃহ ত্যাগ করে সে কোথাও যাবে না।