৪. যখন তিতু একটা অসাধারণ আইডিয়া নিয়ে এসেছে যেটা করা রীতিমতো অসম্ভব
চার তলার ছাদে অর্ধসমাপ্ত ঘরটিতে আজকে আবার মিটিং বসেছে। এই মিটিংয়ে তিতু সবাইকে বলবে রাহেলা খাতুনের জন্য সবচেয়ে ভালো জন্মদিনের উপহার কী হতে পারে। শোনার জন্য সবাই আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে, এমন কী টিয়া পর্যন্ত তার বই পড়া বন্ধ করে তিতুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
তিতু সবার দিকে তাকিয়ে একটু লাজুক মুখে বলল, আমি চিন্তা করে বের করেছি মাকে- মানে নানিকে জন্মদিনে কী গিফট দিলে নানি সবচেয়ে বেশি খুশি হবে।
রিতু বলল, বলে ফেল, আমরা শুনি।
গিফটটা একটু কঠিন কিন্তু আমরা নানির জন্যে একটু কঠিন কাজ তো করতেই পারি। পারি না?
টিটল বলল, হ্যাঁ পারি। এখন বল সেটা কী জিনিস।
এটা কোনো জিনিস না, এটা একটা কাজ।
টিয়া বলল, কী কাজ। বল তিতু ভাইয়া।
বলছি। তিতু একটা বড় শ্বাস নিয়ে বলল, আমরা তো সবাই নানির সাথে কথা বলেছি। বল দেখি নানি সবচেয়ে বেশি কী চায়?
রিতু বলল, তুই যেহেতু চিন্তা করে বের করেছিস তুইই বল।
নানি সবচেয়ে বেশি কার কথা বলে?
মিঠুন বলল, মানে হয় আমার কথা।
তিতু মাথা নাড়ল, বলল, উঁহু। তোর কথা না। অন্য আরেক জনের কথা।
সবাই একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকালো। টিটন একটু অধৈর্য হয়ে বলল, এতো ধানাই পানাই না করে তুই সোজাসুজি বলে ফেল দেখি।
তিতু বলল, নানি সবচেয়ে বেশি বলে নানার কথা। বলে কী না? সবাই একটু থতমত খেয়ে যায়। কেউ ভাবেনি তিতু আসাদ রহমানের কথা বলবে। তিতু এখন কী বলবে কেউ অনুমান করতে পারে না কিন্তু সবাই একটু ইতস্তত করে মাথা নাড়ল।
তিতু বলল, নানি সব সময় বলে, ইশরে মানুষটা মাটি পেল কী না সেইটাই জানলাম না। যদি কোথায় মাটি দিয়েছে জানতাম তাহলে সেইখানে মাথার কাছে বসে কোরান শরীফটা খতম দিতাম। বলে কী না?
সবাই মাথা নাড়ল, এমন কী মিঠুন পর্যন্ত গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল।
তিতু বলল, সেইজন্যে আমি মনে করি নানির জন্মদিনের জন্যে আমরা নানার কবরটা কোথায় সেটা খুঁজে বের করি। তারপর নানিকে সেইখানে নিয়ে যাই।
সবাই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। তারপর সবাই অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। প্রথম কথা বলল রিতু, কিন্তু, কিন্তু আমরা তো কিছুই জানি না। ত্রিশ-বত্রিশ বছর আগে কোথায় নানা যুদ্ধ করেছে- কোথায় মারা গেছে।
তিতু বলল, সেইটা ঠিক।
তাহলে আমরা কীভাবে তার কবর খুঁজে বের করব?
তিতু মাথা নাড়ল, সেইটা আমি জানি না।
তাহলে?
তাহলে কী?
তাহলে মানে- তাহলে আমরা কীভাবে খুঁজে বের করব?
তিতু বলল, সেইটা চিন্তা করে ঠিক কর।
মিঠুন হঠাৎ করে হাসি হাসি মুখে বলল, একটা খুব সোজা উপায় আছে।
সবাই অবাক হয়ে মিঠুনের দিকে তাকালো, সোজা উপায়?
হ্যাঁ। আমরা এমনি এমনি একটা জায়গায় নিয়ে দাদিরে বলব, এইটা দাদার কবর-দাদি কোনোদিন টের পাবে না!
টিটন যথেষ্ট জোরে মিঠুনের মাথায় একটা চাটি মেরে বলল, চুপ কর ছাগল কোথাকার।
মিঠুন মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, আমি কী ভুল কিছু বলেছি? দাদি কেমন করে বুঝবে এইটা আসল না ভূয়া?
টিটন আরেকবার চাটি মেরে বলল, চুপ কর গাধা কোথাকার।
মাথায় চাটি মেরে একটা একটা করে প্রাণীর নাম বলতে থাকলে অনেকক্ষণ ধরে বলা যাবে। মিঠুন মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে চুপ করে গেল।
কিছুক্ষণ অন্য সবাইও চুপ করে রইল। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে টিয়া বলল, আসলে তিতু ভাইয়া ঠিকই বলেছে আমরা যদি দাদিকে দাদার কবরের কাছে নিতে পারি সেটা আসলেই খুবই ভালো জন্মদিনের গিফট হবে। কিন্তু আমরা তো জানি পর্যন্ত না দাদা কোথায় যুদ্ধ করেছে, কীভাবে মারা গেছে।
টিটন বলল, আচ্ছা, এটা কী কখনো কেউ খোঁজ নিয়েছে?
তিতু বলল, একটু একটু নিয়েছে।
রিতু জিজ্ঞেস করল,তুই কেমন করে জানিস?
নানিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, নানি বলেছে। যুদ্ধের পর নানি খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছিল কিন্তু বেশি খোঁজ নিতে পারে নাই। দেশের অবস্থা খুব খারাপ ছিল, নানিও অনেক ঝামেলার মাঝে ছিল।
সবাই মাথা নাড়ল, তারা সবাই তাদের আব্ব আম্মুর কাছ থেকে গল্প শুনেছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা খুব কষ্টের মাঝে ছিল। তখন দুই বেলা খাওয়া জোগাড় করতেই রাহেলা খাতুনের জান বের হয়ে যেত। কাজেই তখন রাহেলা খাতুন ভালো করে তার স্বামীর খোঁজ নিতে পারেন নাই।
টিয়া জিজ্ঞেস করল, যখন আমাদের আব্ব চাছু ফুপুরা বড় হয়েছে। তখন তারা খোঁজ নেয় নাই?
তিতু বলল, নিতে চেষ্টা করেছে লাভ হয় নাই।
তুমি কেমন করে জান?
নানি বলেছে। সবাই জানে তিতুর সাথে রাহেলা খাতুনের একটা অন্যরকম সম্পর্ক, অনেক সময় সে নানির পায়ের কাছে বসে তার গল্প শুনে। এতো বড় হয়েছে এখনো মাঝে মাঝে নানির গলা জড়িয়ে ধরে বসে থাকে।
সবাই আরো কিছুক্ষণ বসে থাকে, তারপর রিতু সোজা হয়ে বসে বলল, ঠিক আছে। আজকের মিটিং তাহলে এখন শেষ। তিতু যেটা বলেছে সেটা ঠিক, আমরা যদি আসলেই নানার কবরটা খুঁজে বের করতে পারি সেটা হবে অসাধারণ। শেষ পর্যন্ত পারি আর নাই পারি একটু চেষ্টা করে দেখব। ঠিক আছে?
সবাই মাথা নাড়ল, এমন কী মিঠুনও। রিতু একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, শুধু বুঝতে পারছি না কোথা থেকে শুরু করব। এখন দেশের গভমেন্টটাও রাজাকারের গভমেন্ট!
কেউ কোনো কথা বলল না, শুধু মিঠুন হাত তুলে চিৎকার, করল, রাজাকারের চামড়া, তুলে নিব আমরা।
মিঠুনের সাথে চিৎকারে আর কেউ যোগ দিল না কিন্তু সবাই মনে মনে ভাবল কাজটা করতে পারলে আসলে খারাপ হতো না।
.
বাচ্চা কাচ্চারা প্রথমে তাদের আব্ব আম্মুর সাথে কথা বলল। তাদের কাছ থেকে তারা বিশেষ কিছুই জানতে পারল না। বাসায় আসাদ রহমানের সেরকম কোনো ছবি পর্যন্ত নেই। বিয়ের পর রাহেলা খাতুনের সাথে স্টুডিওতে তোলা একটা ছবি আছে সেটাই একমাত্র ছবি। কীভাবে তারা আসাদ রহমান নিয়ে খোঁজ-খবর শুরু করবে সেটাই যখন তারা বুঝতে পারছিল না তখন হঠাৎ করে রিতু শুরু করায় একটা পথ খুঁজে পেলো। পথটা দেখালেন এমন একজন যার কথা রিতু কখনো কল্পনা করেনি। মানুষটা হচ্ছে তাদের প্রিন্সিপাল ম্যাডাম।
স্কুলে টিফিনের ছুটিতে সবাই দৌড়াদৌড়ি করে খেলছে। প্রত্যেক দিন রিতুও খেলে আজকে তার শরীরটা ভালো লাগছে না বলে বারান্দায় পা ঝুলিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে বসেছিল। আজকাল রিতু যখনই একা একা বসে সে তার নানার কথা চিন্তা করে, একটা মানুষ এভাবে পুরোপুরি পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে সেটা কেমন করে হতে পারে?
রিতু খেয়াল করেনি যে তাদের প্রিন্সিপাল ম্যাডাম সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন এবং রিতুকে বসে থাকতে দেখে দাঁড়িয়ে গেছেন। স্কুলে শত শত ছেলে মেয়ে, প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আলাদাভাবে তাদের মনে রাখতে পারেন না কিন্তু এই তেজী মেয়েটার কথা তার মনে আছে। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম খুব বেশি হাসেন না কিন্তু আজকে হাসি হাসি মুখে বললেন, কী হলো? তুমি একা একা বসে আছ কেন?
রিতু প্রিন্সিপাল ম্যাডামের গলার স্বর শুনে লাফ দিয়ে ওঠার চেষ্টা করল এবং নিজের পায়ের সাথে নিজের পা বেঁধে একেবারে হুড়মুড় করে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের ওপর পড়ে গেল, প্রিন্সিপাল ম্যাডাম তাকে খপ করে ধরে ফেললেন, বললেন, আরে! কী হলো! কী হলো!
রিতু লজ্জায় প্রায় মরে যাচ্ছিল, কোনোমতে বলল, সরি ম্যাডাম! সরি সরি সরি!
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, আমি সরি, তোমাকে এভাবে চমকে দেওয়ার জন্য! এতো মনোযোগ দিয়ে কী ভাবছিলে?
কিছু না ম্যাডাম কিছু না বলে হঠাৎ করে সে থেমে গিয়ে বলল, আসলে আমার নানার কথা ভাবছিলাম। আমার মুক্তিযোদ্ধা নানা।
প্রিন্সিপাল ম্যাডামের মুখটা এবারে একটু গম্ভীর হলো, শান্ত গলায় বললেন, ও।
জী ম্যাডাম।
এরপর একেবারে কিছু না বললে কেমন দেখায়? তাই প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, কী ভাবছিলে?
আসলে আমার নানা কখনো ফিরে আসেন নাই। নানা কোথায় যুদ্ধ করেছেন কোথায় মারা গেছেন কেউ জানে না।
সত্যি?
জী ম্যাডাম। এই জন্যে কয়েকদিন থেকে ভাবছিলাম কেমন করে আমার নানার খোঁজ পাওয়া যায়। কোনো উপায় আছে কিনা।
কিছু ঠিক করেছ?
নানার অনেক পুরানো একটা ছবি আছে, তার বিয়ের পর নানির সাথে তোলা ছবি। তাই ভাবছিলাম সেটা দিয়ে পত্রিকায় কোনো বিজ্ঞাপন দেয়া যায় কিনা, কেউ যদি কিছু জানে সেটা জানানোর জন্য। আপনার কী মনে হয় এটা কাজ করবে?
গুড আইডিয়া। ম্যাডাম কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলেন, তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, সময়টা খারাপ, বুঝেছ। মুক্তিযযাদ্ধারা কথা বলতে চায় না। ওদের ভিতরে এক ধরনের অভিমান।
রিতু কী বলবে বুঝতে পারল না তাই কয়েকবার মাথা নেড়ে দাঁড়িয়ে রইল। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম মাথা ঘুরিয়ে রিতুর দিকে তাকালেন তারপর বললেন, আমার পরিচিত একজন আছেন, উনি হচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের গবেষক। ওনার কাজই হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করা। যে মুক্তিযোদ্ধারা খুব খারাপ অবস্থায় আছে তাদের বের করে সাহায্য করা। তুমি তার সাথে দেখা করে দেখতে পার, তোমাকে হয়তো সাহায্য করতে পারেন।
সত্যি ম্যাডাম? সত্যি?
হ্যাঁ, আমার অফিসে একবার এসো দেখি তার ঠিকানা ফোন নম্বর খুঁজে পাই কিনা।
কী নাম উনার?
মুশতাক। মুশতাক আহমেদ।
থ্যাংক ইউ ম্যাডাম থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম মাথা নাড়লেন তারপর অন্যমনস্ক ভাবে হেঁটে হেঁটে চলে গেলেন।
.
দুইদিন পর বিকাল বেলা দেখা গেল পাঁচ ভাই বোন জামা কাপড় পরে বাইরে যাওয়ার জন্যে রেডি হয়েছে। আশেপাশের বাসা থেকে যে বাচ্চা কাচ্চারা ফুটবল খেলতে এসেছে তারা একটু মন খারাপ করে অন্য কিছু খেলার কথা চিন্তা করলে লাগল। পাঁচজনের দলটি তাদের বড় চাচার (কিংবা বড় মামার) সাথে দেখা করল। বড় চাচা মাসুদ ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ ঠাণ্ডা গলায় বললেন, কী চাই? পঞ্চ তাণ্ডব কোথায় রওনা দিয়েছে?
টিটন বলল, আব্ব, আমরা মোটেও পঞ্চ তাণ্ডব না। আর কোথায় যাচ্ছি সেটা বলা যাবে না। সেইটা সিক্রেট।
বেআইনী কোনো কাজে না তো?
রিতু বলল, না বড় চাচ্চু।
ভেরি গুড। বলে মাসুদ তার বইয়ে ফিরে গেলেন, কিন্তু পাঁচজন চলে না গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল দেখে বললেন, কী ব্যাপার?
টিয়া বলল, রিকশা ভাড়া শর্ট পড়েছে?
কত রিকশা ভাড়া?
জানি না।
তাহলে?
মিঠুন বলল, বেশি করে দিয়ে দাও। যদি বেঁচে যায় আমরা ফুচকা খেয়ে নিব।
আর যদি কম পড়ে?
এমনভাবে দিবে যেন কম না পড়ে।
মাসুদ মিঠুনের বাস্তব বুদ্ধি দেখে চমৎকৃত হলেন। তিনি সত্যি সত্যি মানি ব্যাগ বের করে একটু বেশি করে কিছু টাকা দিয়ে বললেন, ফুচকা খাওয়ার পর পেট খারাপ হলে খাওয়ার জন্য খাবার স্যালাইনের টাকাও দিয়ে দিচ্ছি।
মিঠুন বলল, খাবার স্যালাইন কিনে টাকা নষ্ট করা ঠিক হবে না। দরকার হলে বাসায় খাবার স্যালাইন বানিয়ে নিব। এক চিমটি লবণ এক মুঠ গুড় যায় এক গ্লাস পানি।
মাসুদ মিঠুনের বাস্তব বুদ্ধি দেখে দ্বিতীয় বার চমৎকৃত হলেন।
.
মুক্তিযুদ্ধ গবেষকের বাসার গেটে দারোয়ান তাদের আটকে দিল, কোথায় যাচ্ছ?
রিতু বলল, মুশতাক আহমেদের বাসায়।
উনি জানেন?
মিঠুন বলল, এখন জানবেন।
দারোয়ান ভুরু কুঁচকে মিঠুনের দিকে তাকাল, তারপর বলল, দাঁড়াও।
পাঁচ ভাই বোন দাঁড়িয়ে রইল এবং দারোয়ানটা একটু পরে ফিরে এসে বলল, যাও উপরে। দুই তালা বাম দিকে।
পাঁচজন সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেল। দরজায় শব্দ করার আগে রিতু মিঠুনের দিকে তাকিয়ে বলল, খবরদার কোনো উল্টা পাল্টা কথা বলবি না।
টিয়া বলল, তার চাইতে বল, খবরদার কোনো কথা বলবি না। মিঠুন কথা বললেই সেটা হবে উল্টা পাল্টা কথা।
মিঠুন মুখ শক্ত করে বলল, কোনও দিন না।
রিতু বেল টিপল এবং সাথে সাথে বিশ একুশ বছর বয়সের একজন। ছেলে দরজা খুলে দিয়ে বলল, আস, ভিতরে আস।
ঘরের এক পাশে একটা বড় টেবিল, টেবিলের পিছনে একজন একটা চেয়ারে বসে আছেন। মানুষটার উশখু খুশকু চুল এবং উশখু খুশকু দাড়ি। নাকের ডগায় চশমা। চশমার ওপর দিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ও! তোমরা তাহলে সেই আন্ডাবাচ্চার দল। দারোয়ান ভুল বলে নাই।
বিশ বছরের যে ছেলেটা দরজা খুলে দিয়েছে সে বলল, না স্যার ভুল বলে নাই।
উশখু খুশকু চুল দাড়ির মানুষটা, যিনি নিশ্চয়ই মুশতাক আহমেদ হবেন। গবেষক বললে ঠিক এরকম একজন মানুষের চেহারা চোখে ভেসে ওঠে। মুশতাক আহমেদ বললেন, তা, তোমরা কী মনে করে? বেড়াতে নাকি কোনো কাজে।
রিতু বলল, কাজে।
অন্য সবাই রিতুর কথাটা সমর্থন করে জোরে জোরে মাথা নাড়ল।
মুশতাক আহমেদ বললেন, কী কাজ? শুনি।
রিতু বলল, আমাদের প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আমাকে আপনার ঠিকানা দিয়েছেন। বলেছেন আপনি মুক্তিযুদ্ধের গবেষক।
ইন্টারেস্টিং।
ম্যাডাম বলেছেন আপনি নাকী মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করেন।
চেষ্টা করি। আজকাল মুক্তিযোদ্ধাদের পাওয়া কঠিন, কেউ নিজেদের পরিচয় দিতে চায় না। সব রাজাকার লাফিয়ে লাফিয়ে সামনে চলে আসে।
রিতু বলল, আমার নানা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
মিঠুন রিতুকে থামিয়ে বলল, আপুর নানা কিন্তু আমার দাদা। ব্যাপারটা যথেষ্ট পরিষ্কার হয়েছে কী না সেটা নিশ্চিত করার জন্য বলল, আমাদের তিনজনের দাদা আর দুইজনের নানা। আপন দাদা আর নানা। এক্কেবাওে পুরাপুরি আপন।
মুশতাক আহমেদ মিঠুনের কথা শুনে মুচকি হাসলেন, যদিও তার দাড়ি গোঁফের কারণে সেটা বোঝা গেল না। মুখে বললেন, বুঝতে পেরেছি।
রিতু চোখ পাকিয়ে মিঠুনের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাকে একটু কথা বলতে দিবি?
মিঠুন বলল, বল আপু। বল।
আমাদের নানা কিংবা দাদা যেটাই বলেন, যুদ্ধে গিয়ে আর ফিরে আসেন নাই।
মুশতাক আহমেদ তার দাড়ির মাঝে হাত ঢুকিয়ে বললেন, ভেরি ফেমিলিয়ার স্টোরি।
আমরা আপনার কাছে এসেছি একটা জিনিস জানার জন্য- রিতু কথার মাঝখানে থেমে গেল।
মুশতাক আহমেদ একটু ঝুঁকে বললেন, কী জিনিস?
আপনি কী, আপনি কী-বলতে পারবেন নানার কী হয়েছিল? নানা কোথায় কী ভাবে মারা গেছেন কিংবা তার কবরটা কোথায়?
মুশতাক আহমেদ তাদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, বস। তোমরা বস।
ঘরে অনেকগুলো চেয়ার কিন্তু বেশির ভাগ চেয়ারের ওপরেই কিছু না কিছু আছে, বই, খাতা কিংবা কাগজপত্র। তারা কেমন করে বসবে বুঝতে পারল না। তখন মুশতাক আহমেদ চেয়ারগুলো খালি করার জন্যে চেয়ারটা ধাক্কা দিয়ে যখন একটু সামনে এলেন তখন সবাই বুঝতে পারল, মুশতাক আহমেদ আসলে চেয়ারে নয় একটা হুইল চেয়ারে বসে আছেন এবং তার হাঁটুর ওপর থেকে দুটি পা নেই।
মিঠুন প্রায় আর্তনাদ করে বলল, হায় হায়! আপনার পা নাই!
সাথে সাথে সবাই একসাথে মিঠুনের ঘাড় ধরে ঝাঁকিয়ে বলল, চুপ করবি তুই? চুপ করবি ছাগল কোথাকার?
মুশতাক আহমেদ বললেন, ওকে ছেড়ে দাও, ও তো ভুল বলে নাই। আমার তো আসলেই পা নাই।
মুশতাক আহমেদের কথা শুনে মিঠুন একটু সাহস পেলো। জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছিল আপনার পায়ের?
সবাই আবার মিঠুনের ঘাড় চেপে ধরল। রিতু চাপা গলার হিস হিস করে বলল, তুই আরেকবার যদি মুখ খুলিস তোর গলা টিপে ধরব।
মুশতাক আহমেদ রিতুর কথাটা না শোনার ভান করে মিঠুনকে বললেন, যুদ্ধের সময় একটা শেল পড়েছিল, পা উড়ে গেছে। আমি জানে বেঁচে গেছি, আমার প্রাণের বন্ধু বাঁচে নাই। খুব মিস করি ওকে।
বিশ একুশ বছরের ছেলেটাও এগিয়ে এল, মুশতাক আহমেদ আর ছেলেটা মিলে কয়েকটা চেয়ার খালি করে দিল। সবাই তখন চেয়ার গুলোতে ভাগাভাগি করে বসল। টিটন মিঠুনকে নিজের চেয়ারে বসাল, আবার মুখ খুললে সময় মতো তার মুখ টিপে ধরার জন্য।
সবাই বসার পর মুশতাক আহমেদ সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা কী খাবে? চা না কফি?
রিতু বলতে যাচ্ছিল কিছুই লাগবে না, তার আগেই মিঠুন বলল, কফি। বেশি করে দুধ আর চিনি।
টিটন ফিস ফিস করে বলল, বাসায় কোনদিন তোকে কফি খেতে দেয় তুই যে এখানে কফি খেতে চাচ্ছিস?
মিঠুন ফিস ফিস করে বলল, সেই জন্যেই তো দেখতে চাই খেতে কী রকম।
রিতু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনল, বলল, আমাদের কিছু লাগবে না স্যার। আমরা এখনো চা কফি খাওয়া শিখি নাই।
ঠিক আছে যদি না শিখে থাকো তাহলে আমি শিখাতে চাই না।
মিঠুন একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলল এবং সবাই সেটা না শোনার ভান করল।
মুশতাক আহমেদ কিছুক্ষণ তার আঙুলগুলো পরীক্ষা করলেন, তারপর সেই আঙুল দিয়ে টেবিলে কিছুক্ষণ টুক টুক করে শব্দ করলেন, তারপর বললেন, আমি ঠিক কী ভাবে তোমাদের বলব বুঝতে পারছি না, তোমরা এত ছোট। আমাদের মুক্তিযুদ্ধটাই হচ্ছে একটা খুব দুঃখের ইতিহাস। এত মানুষ এত আপনজনকে হারিয়েছে যে সেটা বলে বোঝানো যাবে না। তোমার নানার মতো মানুষের কিন্তু শেষ নেই। কত মুক্তিযোদ্ধা যে দেশের জন্যে যুদ্ধ করে প্রাণ দিয়ে একেবারে সবার অজান্তে হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে মানে হারিয়েই গেছে।
তোমার নানা-
মিঠুন মনে করিয়ে দিল, এবং দাদা।
মুশতাক আহমেদ হাসলেন, বললেন, হ্যাঁ নানা এবং দাদা তবুও তো তোমাদের স্মৃতিতে বেঁচে আছেন। তোমরা তাকে খুঁজে বের করতে চাইছ, দেখে আমার খুব ভালো লাগছে। আমি চেষ্টা করব তাকে খুঁজে বের করতে। কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন, কার সাথে যুদ্ধ করেছেন, কী হয়েছে আমি বের করার চেষ্টা করব। কিন্তু-
বলে মুশতাক আহমেদ থেমে গেলেন। বাচ্চারা কোনো কথা না বলে ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করে। মুশতাক আহমেদ একটু পরে আবার শুরু করলেন। বললেন, কিন্তু আমি তোমাদের জোর দিয়ে বলতে পারছি না যে। আমরা তাকে খুঁজে পাবই পাব। এতোদিন আগের ব্যাপার, কতো তথ্য হারিয়ে গেছে। তাছাড়া সময়টা খুব খারাপ, গভমেন্ট হচ্ছে রাজাকারের গভমেন্ট, মাঝে মাঝে গভমেন্ট এমন ভাব করে যেন মুক্তিযুদ্ধ করাটাই যেন অপরাধ। রাজাকারে রাজাকারে দেশ ভরে গেছে।
মিঠুন গলা নামিয়ে বলল, রাজাকারের চামড়া তুলে নেব আমরা।
মুশতাক আহমেদ ঠিক শুনতে পেলেন না, জিজ্ঞেস করলেন, কী বললে?
মিঠুন বলল, রাজাকারের চামড়া, তুলে নেব আমরা।
মিঠুনের কথা শুনে মুশতাক আহমেদ হা হা করে হাসলেন। বললেন, ভালোই বলেছ। ঠিকই বলেছ, রাজাকারের চামড়া তুলেই নেওয়াই দরকার। যাই হোক, আমরা যদি তোমার নানা কিংবা দাদাকে খুঁজে বের করতে চাই তাহলে সবার আগে কিছু তথ্য দরকার। তোমার নানা সম্পর্কে যা কিছু জান সব বলতে হবে। আমরা একটা ফর্ম তৈরি করে রেখেছি সেটা সবার আগে ফিলআপ করতে হবে। ইচ্ছে করলে এখন ফিলআপ করতে পার, ইচ্ছা করলে বাসায় নিয়ে যেতে পার, ফিলআপ করে পাঠিয়ে দিতে পার। তোমাদের ইচ্ছা।
রিতু বলল, আমরা আসলে কাগজে সব লিখে এনেছি এখনই ফর্মটা ফিলআপ করে যেতে পারব।
ভেরি গুড। তাহলে এখনই সব লিখে দাও। যত বেশি তথ্য দিতে পারবে তত ভালো। তোমাদের কাছে যেটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হবে না সেটাও লিখবে। বুঝেছ?
সবাই মাথা নাড়ল, বলল, বুঝেছি।
রিতু তার ব্যাগ থেকে কাগজ বের করল, আর টিয়া বসে বসে লিখতে শুরু করল। সবাই তাকে ঘিরে দাঁড়ালো, দেখতে লাগল যেন কোনো কিছু লিখতে গিয়ে ভুলে না হয়ে যায়।
আসাদ রহমানের সবকিছু লিখে দেবার পর রাহেলা খাতুনের সাথে বিয়ের সময় ভোলা ছবিটি ফর্মের এক কোনায় লাগিয়ে দিল। মুশতাক আহমেদ তখন ফর্মটা হাতে নিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন, তারপর সন্তুষ্টির মতো শব্দ করে বললেন, ভেরি গুড। আমরা যদি পজিটিভ কোনো খবর পাই তোমাদের আল্লু আম্মু কারো কাছে ফোন করে জানাব-
সবাই এক সাথে চিৎকার করে উঠল, না, না, না-
মুশতাক আহমেদ অবাক হয়ে বললেন, না? না কেন?
তিতু লাজুক মুখে বলল, আসলে এটা গোপন। আমরা যদি আসলেই নানার কবরটা পেয়ে যাই, তাহলে আমাদের নানিকে সেখানে নিয়ে অবাক করে দেব।
টিটন বলল, আমার নানির ষাট নম্বর জন্মদিন তো-এটা হবে আমাদের জন্মদিনের গিফট।
রিতু বলল, সেইজন্যে এইটা আমরা এখন বাসার কাউকে জানাতে চাই না।
মুশতাক আহমেদ বললেন, কিন্তু যদি তোমাদের খবর দিতে হয় কেমন করে দিব?
সবাই একজন আরেকজনের দিকে তাকালো, টিটন বলল, আপনি একটা এস.এম.এস করে বলবেন, আর্ট ক্লাশ ক্যান্সেল আমরা তাহলে বুঝে নিব।
সবাই মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ, তাহলেই আমরা বুঝে যাব।
রিতু বলল, তখন আমরা আপনার সাথে যোগাযোগ করব।
মুশতাক আহমেদ বললেন, ঠিক আছে। তারপর বিশ একুশ বছরের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললেন, রঞ্জু তুমি মনে রেখো। যদি পজিটিভ কোনো খবর পাই তাহলে একটা এস.এম.এস পাঠাতে হবে, আর্ট ক্লাস ক্যানসেলড!
সবাই যখন বিদায় নিয়ে বের হয়ে আসছে তখন টিয়া হঠাৎ করে মুশতাক আহমেদের কাছে গিয়ে বলল, স্যার। একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
কর।
যুদ্ধের শুরু যুদ্ধের শেষ বইটা কী আপনি লিখেছেন?
মুশতাক আহমেদ একটু অবাক হয়ে টিয়ার দিকে তাকালেন, তারপর বললেন, হ্যাঁ। আমি লিখেছি। তুমি কেমন করে বুঝলে?
আমি বইটা পড়েছি। পড়ে আমি-আমি-
তুমি কী?
আমি অনেক কেঁদেছি। খুব কষ্টের বই।
মুশতাক আহমেদ তার হুইল চেয়ারটা চালিয়ে টিয়ার কাছে এলেন। এসে টিয়ার মাথায় হাত রেখে বললেন, তুমি এত ছোট মেয়ে এত মোটা বই পড়ে ফেলেছ?
তিতু বলল, আমাদের টিয়া অনেক বই পড়ে।
টিয়া বলল, কিন্তু এই বইটা বেশি কষ্টের।
মুশতাক আহমেদ বললেন, বইটা লিখতেও আমার অনেক কষ্ট হয়েছে। লিখার সময় আমিও কেঁদেছি।
টিয়া বলল, এর পরের বার আমি বইটা নিয়ে আসব, আপনি একটা অটোগ্রাফ দিয়ে দিবেন?
অবশ্যই। অবশ্যই দিব। বাসায় ফিরে আসার সময় কারোরই ফুচকা খাওয়ার কথা মনে পড়ল না।