ম্যানচেস্টার থেকে নটার দিকে রওয়ানা দিয়েছে ডাঃ ইউনুস ভাইয়ান। স্কটল্যান্ডের বেলশিলে কাজ করে সে, সেখানকার মাতৃসদন হাসপাতালে। একটানা চলে আসতে পারত লন্ডনে গাড়ি চালিয়ে। বহুবার লন্ডনে সে বেড়াতে এসেছে সোজা কোথাও না থেমে। এ যাত্রায় ম্যানচেস্টারে থেমেছিল ডাঃ বারীকে তুলে নেবার জন্যে। তার সঙ্গে শলা হয়েছে, দুজনে দুটো দিন লন্ডনে থাকবে, তারপর ভাইয়ান তাকে নামিয়ে দিয়ে বেলশিলে ফিরে যাবে।
আসলে, এ যাত্রায় মেয়ে দেখতে বেরিয়েছে, বারীকে তা বলে নি ভাইয়ান। বলেছে ছুটি করতে যাচ্ছে, সে আসবে কিনা।
মোটরওয়ে দিয়ে ঘণ্টা দুয়েক একটানা চলবার পর চায়ের তৃষ্ণায় এক সার্ভিস স্টেশনে ঢুকে পড়ে তারা। গাড়ি পার্ক করে রেস্তোরায় গিয়ে কাউন্টার থেকে চা আর স্যান্ডউইচ নিয়ে বসে তারা। মোটর পথের আরও বহু যাত্রী তাদেরই মতো চা কফি খেতে ভিড় করেছে। দুই বন্ধু চা খেতে খেতে তরুণী শ্বেতাঙ্গিনীদের দিকে তাকিয়ে দ্যাখে, কিছুক্ষণ দ্যাখে, দৃষ্টি তৃপ্ত হলে, অথবা, তরুণীটির সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেলে চোখ ফিরিয়ে আবার অন্য কাউকে সন্ধান করে। কাঁধে যাযাবর-পোটলা নিয়ে দুটি তরুণী কাউন্টারে খাবার কিনছে। দুজনের রুখু লাল চুল। পরনে জীনস, অসংখ্য তালিমারা, গায়ে আর্মি সারপ্লাস সোয়েটার ঢল ঢল করছে। একজনের হাতে গিটার। তরুণী দুটি চা গোল রুটি নিয়ে ঠিক ভাইয়ানদের পাশেই বসে।
কাছে এসে বসতেই প্রথম দুই বন্ধুই চোখ ফিরিয়ে নেয় দ্রুত। যেন–না, তোমাদের দেখছিলাম না। তারপর আবার তারা মনযোগ দেয় তরুণী দুটির দিকে। তারা স্তিমিত চোখে তাকিয়ে দ্যাখে পাটলবর্ণ মানুষ দুটিকে। চোখে চোখ পড়বার সংকোচ তাদের নাই। ডাঃ বারী নিজের টাকে হাত রাখে, দ্রুত টাক বুলিয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখটা মুছে নেয়। এই তার এক মুদ্রাদোষ। কেউ তার দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই টাকে হাত চলে যায়।
বারী বলে, ডাক্তার সাহেব, আপনার দিকে তাকিয়ে আছে।
ভাইয়ান সেটা জানে। কিছুটা খুশিও হয়। বলে, দেখতে মন্দ না।
একটিকে তার পছন্দ হয়, যার হাতে গিটার নেই। বয়সটা অপরের তুলনায় কিছু বেশি, মুখটা পুরুষালি, হাতের পাঞ্জা শক্ত সমর্থ। তার সঙ্গিনীটি প্রায় ছেলেমানুষ, মেয়ে-মেয়ে ভাবটা তার অত্যন্ত স্পষ্ট। তাকে আবার ডাঃ বারীর বেশ ভালো লাগে। টাকের কথা ঘনঘন বেয়াড়া রকম মনে পড়ে যাচ্ছে দেখে নিজেই সে বুঝতে পারে, ভেতরে তার প্রতিক্রিয়া হচ্ছে।
বারী আর ভাইয়ান একসঙ্গেই চায়ের কাপে মুখ নামিয়ে আনে। তারপর দুজনেই মুখ তুলে, একে অপরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে।
বারী বলে, কিছু বুঝতে পারলেন?
না।
কিছু না?
হিচহাইক শব্দটা উচ্চারণ করলে তরুণীরা বুঝে ফেলতে পারে, ভাইয়ান তাই বাংলা করে বলে আঙুল দেখিয়ে গাড়ি থামায়, আর কী? গানটান গায়। বেড়াবে বেরিয়েছে। দেবেন নাকি লন্ডন পর্যন্ত একটা লিফট?
লিফট শব্দটা মুখ ফসকে বেরিয়ে যেতেই ভাইয়ান সচকিত হয়ে পড়ে। বুঝে ফেলল না তো?
তো বারী বলে, দুর সাহেব, লিফট দিয়ে লাভ নেই। বুঝতে পারছেন না? এরা সমকামী।
ভাইয়ান কৌতুক চোখে তরুণী দুটিকে দ্রুত দেখে নেয় একবার।
কী যে বলেন?
হাঁ, নির্ঘাত। বড়টি সক্রিয়, ছোটটি নিষ্ক্রিয়। কষ্ট করে বাংলা শব্দ হাতড়ে মনে করে বারী তার অভিমত জ্ঞাপন করে।
পেয়ালা নামিয়ে রাখে ভাইয়ান। বলে, নিন, উঠুন। পথে কেমন ভিড় দেখছে না? পৌঁছুতে দেরি হয়ে যাবে।
বারী উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে, হাঁ, শনিবার তো। কী অপচয়!
শেষ কথাটি ঠিক বুঝতে পারে না ভাইয়ান।
কীসের অপচয়?
মেয়েটির কথা বলছি। সমকামী একটি রমণী অন্তত একটি পুরুষকে বঞ্চিত করিতেছে, দুইটি বঞ্চিত করিতেছে দুই জনকে।
নিরাপদ দুরত্বে এসে গেছে বলে বারী বাক্যটি ইংরেজিতে শেষ করবার সাহস পায়।
বেরুবার আগে কিছু চকোলেট আর চুয়িংগাম কেনে তারা। পথে গাড়ি চালাতে চালাতে খাওয়া যাবে। ভাইয়ান বলে, আপনার কি ফাঁকা যাচ্ছে নাকি?
বারী হাসে। বেরুবার দরোজা খুলে ভাইয়ানকে আগে বেরুতে দেয়। বলে, এখন একটু সাবধান হতে হয়। সেদিন দেখলেন না, ইন্ডিয়ান এক ডাক্তার কীভাবে তার রেজিস্ট্রেশন হারাল?
ভাইয়ানের মনে পড়ে যায় খবরটি। মহিলা এক পেশেন্টকে দেহ পরীক্ষার ছলে নাকি ডাক্তারটি দেহভোগ করেছে। তারপর নালিশ, মামলা। পরিণামে বিলেতে প্র্যাকটিস করা তার বন্ধ।
সার্ভিস স্টেশনের খোলা চত্বর পেরিয়ে গাড়ির দিকে যেতে যেতে ভাইয়ান বলে, আপনি তো আর পেশেন্টের সঙ্গে কিছু করতে যাচ্ছেন না।
তবু বলা যায় কি? এ দেশে আমাদের ওরা চায় না। কখন কে বলে বসবে, আমি পেশেন্ট ছিলাম, আমাকে ইয়ে করেছে, ব্যাস, হয়ে গেল। কিছু না হোক, বিয়ে করতে বাধ্য করতে পারে।
তো করবেন। আপনি তো বিয়ে করেন নি।
বারী বলে, ইংরেজ মেয়েকে বিয়ে? বারোজনের জিনিসকে বিয়ে করে কে সাহেব? করলে তো কবেই করতে পারতাম।
বিয়াল্লিশ বছর বয়স হয়ে গেছে ডাঃ বারীর, এখনো অবিবাহিত। তার বক্তব্য, মনের মতো
মেয়ে এখনো খুঁজে পাওয়া যায় নি। অন্য ডাক্তারেরা বলে, বারীর নিকষ কালো চেহারা, তার ওপরে ছেলেবেলার গুটি বসন্তের দাগ, কোনো মেয়ে পছন্দ করে নি তাকে। বারী যে বছরে একবার নিয়মিত দেশে যায় এক মাসের জন্যে, লোকে বলে, গোপনে সে মেয়ে দেখে বেড়ায়। প্রতিবারই হতাশ হয়ে ফিরে আসে।
গাড়ির কাছে এসে বারী বলে, ডাক্তার সাহেব, এবার আমি চালাই।
ম্যানচেস্টার থেকে চালিয়ে এসেছিল ভাইয়ান, এবারে বারী গিয়ে হাল ধরে।
পথের ওপর আবার গাড়ি উধ্বশ্বাসে ছুটে চলে লন্ডনের দিকে।
বেশ কিছুক্ষণ পেরিয়ে যাবার পর ভাইয়ান ইতস্তত করে বলে, বারী সাহেব, আপনি শুনলে তো আবার রাগ করবেন, আগে বলি নি কেন?
পথের দিকে চোখ রেখে বারী ভ্রু কুঁচকে রাখে।
ভাইয়ান বলে, লন্ডনে একটা বিশেষ উদ্দেশ্য আছে।
নতুন কোনো হাসপাতালে ইন্টারভিউ দিচ্ছেন নাকি? ও আশাও করবেন না। স্কটল্যান্ডের ডাক্তারদের ইংল্যান্ডে সহজে কাজ হয় না। সে ইংরেজই হোক, আর আমরাই হই।
ভেতরের কথাটা বলতে গিয়েও ইতস্তত বোধ করে ভাইয়ান। একটু লজ্জাও করে। তাই সে আপাতত সেটাকে চাপা দিয়ে নগদ প্রসঙ্গেরই জের টেনে বলে, জানি। পাকিস্তানিদের আমরা বলতাম ইস্ট পাকিস্তানকে দাবিয়ে রাখে, এখানেও কম নয়। যতবার লন্ডন থেকে গাড়িতে করে ফিরে গেছি স্কটল্যান্ডে, বোঝাই যায় কখন স্কটল্যান্ডে ঢুকে পড়েছি। রাস্তাগুলো গরীব, সার্ভিস স্টেশনগুলো বাজে, বাড়িঘর সাধারণ। তফাতটা স্পষ্ট বোঝা যায় ইংল্যান্ড থেকে। তাই না?
স্কটল্যান্ড তো এখন স্বাধীন হবার কথা ভাবছে। নর্থ সি-তে তেল বেরিয়ে গেছে, আর ঠেকায় কে?
একটা জিনিসের জন্যে আমার অবাক লাগে, এদের প্রতি শ্রদ্ধা হয়। স্বাধীনতার কথা এরা খোলাখুলি বলতে পারছে, আর আমাদের দেশে বললে ফাঁসি। মিথ্যে একটা মামলাই করে দিল শেখ মুজিবের নামে আইয়ুব খাঁ।
ইংরেজও করে। নিজের দেশে বলে মুখোশটা ঠিক রেখেছে। ব্রিটিশ আমলে আমাদের দেশে কম করেছে সাহেব? আইয়ুব খাঁ তো তাদেরই ট্রেনিং পাওয়া। হঠাৎ মনে পড়ে যায় বারীর। মুহূর্তের জন্যে পথ থেকে চোখ ফিরিয়ে ভাইয়ানকে দেখে নিয়ে, আবার সমুখে চোখ রেখে বলে, কই বললেন না তো, লন্ডনে আপনার উদ্দেশ্যটা? তাহলে নির্জলা ছুটি নয়?
রুহুল কুদ্দুসকে চেনেন তো? সেই যে সেভেন্টি-ফোরে ডাবলিনে পরীক্ষা দিতে গিয়ে দেখা হলো। এক চান্সে এম-আর-সি-ও-জি হয়ে গেল?
খচ করে বুকের ভেতরে লাগল কথাটা। বারী বহু বৎসর ধরে পরীক্ষা দিয়েও পাশ করতে পারে নি। এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে।
হাঁ, মনে আছে।
রুহুল কুদ্দস এক মেয়ের খবর দিয়েছে।
মেয়ে?
বাঙালি মেয়ে। বাবা-মা অনেকদিন এদেশে আছে। বাবার ট্রাভেল এজেন্সি আর দেশে মাল পাঠাবার ব্যবসা।
দ্রুততম তৃতীয় লেন ছেড়ে অপেক্ষাকৃত ধীর গতির প্রথম লেনে গাড়ি সরিয়ে আনে বারী। মেয়ে দেখেছেন?
না, সেই দেখতেই যাচ্ছি। আমিও আপনার মতো ডাক্তার সাহেব, বিয়ে বাঙালি ছাড়া করব
না। রুহুল কুদুস বলল, মেয়েটি নাকি ভালো। বাবা-মা দুজনে বহুদিন এসে থাকলেও এখনো পুরোদস্তুর বাঙালি। তা রুহুল কুদুস আবার থাকতে পারছে না, তার কী কাজ আছে। তাই আপনাকে নিয়ে এলাম। একটা ওপিনিয়ন দিতে পারবেন। অনেকদিন তো আমাকে চেনেন, আমার সবই আপনার জানা। কী রকম বৌ চাই, আপনি ভালো বুঝবেন। বারী আবার ধীরে ধীরে তৃতীয় লেনে গাড়ি নিয়ে যায়। যেতে যতক্ষণ লাগে সে কিছু বলে না। তারপর দ্রুত গতিতে স্থির হয়ে বলে সেই মেয়েটির কী হলো?
অ্যান?
চুপ করে থাকে বারী। অপেক্ষা করে উত্তরের জন্যে।
ভাইয়ান বলে, ডাঃ খলিলের কথা মনে আছে? হার্ট উড হাসপাতালে ছিল, সেখানে নার্স বিয়ে করেছিল, ক্যাথি নাম?
হাঁ।
বিয়ের পর খলিলের অবস্থা দেখে আমার আর ইংরেজ বিয়ে করবার সাধ নেই। দেশে টাকা। পাঠান তো বন্ধই করেছে, দেশেও যায় না আজ তিন বছর। দেখলে আর চিনতে পারবেন না খলিলকে। পাকা ইংরেজ। আমাদের এখন যে সব শুনতে হয়, শুনে মনে হয়, বাংলাদেশে তার জন্ম নয়। অ্যা
নের সঙ্গে তো বেশ ঘুরতেন। একবার বললেন না, ভালোবাসেন?
ভাইয়ান লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে, পা সমুখে ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে বাধা পেয়ে, পা আবার গুটিয়ে বলে, সে একটা মেয়ের সঙ্গে ঘুরলে ও রকম মনে হয় ডাক্তার সাহেব। তাছাড়া দেখুন না, দেশে কোনো ডাক্তার নার্স বিয়ে করলে ছি ছি পড়ে যায়, ডাক্তারেরাই যেন এক ঘরে করে রাখে। এখানে শাদা চামড়া বলেই নার্স উচ্চপদবাচ্য হয়ে গেল? অনেক ভেবে দেখলাম বারী সাহেব, নাহ, বিয়ে করলে বাঙালি। আমার অন্তত ও সব পোষাবে না। বিছানায় নিজের দুদিন ফুর্তির জন্যে সারা জীবন দেশ ছেড়ে, বাপ-মা ভাই-বোন ভুলে বেকড বীনস আর সসজে খেয়ে থাকতে পারব না।
সেই জন্যে বাঙালি মেয়ে খুঁজছেন?
হাঁ, তাই আর কী। রুহুল কুদ্দুসও খুব করে বলল। ভাবলাম দেখেই আসি। দেখতে ক্ষতি কী?
নিজের উদ্দাম আগ্রহ, বারীকে আগে থেকে জানান না দিয়ে টেনে আনবার জন্যে বিবৃতি, এক সঙ্গে সব চাপা দেবার জন্যে ডাঃ ভাইয়ান গলায় তাচ্ছিল্যের সুর আনে। যেন, নেহাত একটা মজা করতে যাচ্ছে, বিয়েটা কোনো কথাই নয়।
ডাঃ বারী হঠাৎ জিগ্যেস করে, আচ্ছা সেই রুহুল কুদ্দুস এখন কী করে?
লন্ডনে কিং এডোয়ার্ড হাসপাতালের কনসালট্যান্ট।
বুকের ভেতরে আবার খোঁচা অনুভব করে বারী। ম্যানচেস্টার থেকে তাকে মেয়ে দেখার জন্যে না বলে নিয়ে আনার দরুণ ভেতরটা হঠাৎ ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে তার। নীরবে সে গাড়ি চালাতে থাকে।