০৪. মোবারক সাহেবের হোটেলের ঘর

মোবারক সাহেবের হোটেলের ঘর

মোবারক সাহেবের হোটেলের ঘর আকাশের কাছাকাছি। একাশিতলার ৮৩৩ নম্বর রুম। জানালা খুললে রুমের ভেতর মেঘ ঢুকে পড়বে। তবে জানালা খোলার ব্যবস্থা নেই। রুমের সঙ্গে বারান্দার মতো আছে-বারান্দাও থাই এলুমিনিয়ামে ঢাকা। এখানে দাঁড়ালে টোকিও শহরের খানিকটা দেখা যায়। সবচে’ ভালো দেখা যায় ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের রানওয়ে। প্রতি মিনিটে একটা করে প্লেন উঠছে–নামছে। প্লেন যে এমন রাজকীয় ভঙ্গিতে আকাশে ওড়ে মোবারক সাহেবের ধারণা ছিল না। বেশ খানিকক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্লেনের উঠানামা দেখে এই সিদ্ধান্তে এলেন যে, উড়ার সময় প্লেনগুলো রাজকীয় ভঙ্গিতে উড়লেও নামার সময় ভয়ে ভয়ে নামে।

হোটেলে বারান্দার এই অংশটির নাম বিজনেস কর্নার। পারসোনাল কম্পিউটার, ফ্যাক্স মেশিন, লেখার চেয়ার-টেবিল সবই আছে। লেখার টেবিলের এক কোণায় কফি পার্কেলেটরে আগুনগরম কফি। মূল লেখার টেবিলের এক কোণে ছোট্ট টিভিতে সিএনএন-এর খবর দেখাচ্ছে।

বারান্দার এই অংশে সিগারেট খাওয়া যাবে। এ রকম একটা নোটিশ ঝুলছে। নো ম্মোকিং সাইন বুললে সিগারেট খাবার ইচ্ছে হয় কিন্তু সিগারেট খাওয়া যায় এ জাতীয় নোটিশ দেখলে সিগারেট খেতে ইচ্ছা করে না।

আজ রোববার। ছুটির দিন। মোবারক সাহেব কাজকর্ম যা নিয়ে এসেছেন তার কিছুই আজ করার নেই। শহরে ঘুরে বোড়ানো বা শপিং করার প্রশ্ন আসে না। একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত এইসব ভালো লাগে–তারপর ভালো লাগে না। তাছাড়া জাপানে তাঁর দেখার নতুন কিছু নেই। তিনি আরো খানিকক্ষণ প্লেনের উড়াউড়ি দেখলেন। আজ সারাদিন কী করবেন তার একটা তালিকা মনে মনে করলেন।

রেহানার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলা। কথা না বললেও হয়–বললে ক্ষতি নেই। জীবনে যতবার দেশের বাইরে এসেছেন ততবারই স্ত্রীর সঙ্গে অন্তত একবার হলেও টেলিফোনে দীর্ঘ আলাপ করেছেন। তিনি অসংখ্যবার দেশের বাইরে গেছেন–রেহানা কখনো তার সঙ্গে আসে নি। রেহানার আকাশভীতি আছে। ছোটবেলায় তার হাত দেখে কে নাকি বলেছিল তার মৃত্যু হবে অ্যাকসিডেন্টে। রেহানার ধারণা সেই অ্যাকসিডেন্ট হবে আকাশে।

রেহানাকে টেলিফোনের পর চিঠি লেখা যেতে পারে। বাইরে এলেই তাঁর চিঠি লিখতে ইচ্ছা করে। কিন্তু চিঠি লিখবে কাকে? তাঁর চিঠি লেখার কেউ নেই।

বই পড়া যায়। ভূতের বইটা সঙ্গে এনেছেন–প্রথম গল্পটা মাঝামাঝি পর্যন্ত পড়া হয়েছে। গল্পের শেষটা কেমন দেখা যেতে পারে। সুন্দর করে শুরু করা গল্পের শেষটা সাধারণত খুব এলোমেলো থাকে।

মোবারক সাহেব কাপে কফি ঢাললেন। চা-কফি এইসব পানীয় নিজে ঢেলে খেতে ভালো লাগে না। অন্য কেউ বানিয়ে হাতে তুলে দিলে ভালো লাগে। টেপী মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে এলে ভালোই হতো। এই মুহুর্তে কফির কাপ হাতে তুলে দিতে পারত। ছুটির দিন ছিল। ছুটির দিনে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতেন। যা দেখত তাতেই বিস্ময়ে অভিভূত হত। সেই বিস্ময় দেখতে ভালো লাগত। নিজের বিস্মিত হবার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেলে অন্যের বিস্মিত চোখ দেখতে ভালো লাগে। মেয়েটিকে অনায়াসে নিয়ে আসা যেত। শেষ মুহুর্তে পরিকল্পনা বাদ দিলেন–তবে মেয়েটি সম্পর্কে খোঁজখবর লোকমানকে পাঠাতে বলেছিলেন। লোকমান ফ্যাক্স গতকাল পাঠিয়েছে। তাঁর পড়ে দেখতে ইচ্ছা করে নি। এখনো করছে না। যখন করবে। তখন পড়ে দেখবেন।

কফি খেতে ভালো হয় নি। কিংবা হয়তো ভালোই হয়েছে। তাঁর নিজের ভালো লাগছে না। ভালো লাগা এবং মন্দ লাগার ব্যাপারটা তাঁর খুব তীব্র। যা ভালো লাগে না, হাজার চেষ্টা করেও তাকে আর ভালো লাগাতে পারেন না। যখন বয়স কম ছিল তখন ভালো লাগাতে চেষ্টা করতেন। এখন তাও করেন না।

রেহানাকে বিয়ের রাতেই তাঁর ভালো লাগে নি। পুতুল পুতুল টাইপের একটা মেয়ে। আয়নায় জবরজং হয়ে খাটের এক কোণায় জড়োসড়ো হয়ে বসে ছিল। ঘরে ঢুকেই তাঁর গোলাপ ফুলের গন্ধে মাথা ঘুরে গেল। দুনিয়ার গোলাপ দিয়ে বাসরঘর সাজিয়েছে। একটা গোলাপের ঘ্রাণ সহ্য করা যায়। কিন্তু এক লক্ষ গোলাপের ঘ্রাণ সহ্য করা যায় না। তাঁকে ঢুকতে দেখেই রেহানা মুখ তুলে তাকাল। সুন্দর মুখ। গোলগাল সুখী সুখী চেহারা, বড় বড় চোখ। তারপরেও মোবারক সাহেবের ভালো লাগল না। তিনি ভালো লাগার প্রাণপণ চেষ্টা করে বললেন, কেমন আছ রেহানা?

নববধু নড়েচড়ে বসল, জবাব দিল না।

কী গরম পড়েছে দেখেছি, গরমে ফুল পচে বিশ্ৰী গন্ধ ছাড়ছে তাই না?

রেহানা বলল, জ্বি।

অথচ বাসরঘর মোটেই গরম ছিল না। শীতকালে বিয়ে হচ্ছে তারপরেও বাসরঘরের এয়ারকুলার চলছে। মাথার উপরে হালকাভাবে ফ্যান ঘুরছে। তিনি নববধূর পাশে বসে হাই তুললেন। বাসরঘরে নববধূর পাশে বসে খুব কম পুরুষই হাই তোলে। তিনি সেই কমসংখ্যক পুরুষদের দলে। রেহানা আশপাশে থাকলে এখনো তার হাই ওঠে। টেলিফোনে যখন তার সঙ্গে কথা বলেন তখনো হাই ওঠে।

মোবারক সাহেব হোটেলের বারান্দা থেকে শোবার ঘরে চলে এলেন। রেহানার সঙ্গে টেলিফোনে খানিকক্ষণ কথা বলবেন। দেশ থেকে আসা ফ্যাক্সগুলো দেখবেন। ভূতের বইটা পড়বেন। না, গোটা বই না, প্রথম গল্পের শেষটা। আজ দিনটা শুয়ে বসে কাটানো। কাল অনেক কাজ। কাজে সাহায্য করার জন্যে তিনি সঙ্গে কাউকে আনেন নি। যা করার তাকে একা করতে হবে। একজন কাউকে নিয়ে এলে হতো। কাজে সাহায্য না হোক কথা বলা যেত। মানুষ একা থাকতে পারে না। মানুষের সবচে’ বড় শাস্তি মৃত্যুদণ্ড না–সলিটারি কনফাইনমেন্ট। নিঃসঙ্গ নির্বাসন।

হ্যালো রেহানা?

ওমা, তুমি!

কেমন আছ রেহানা??

আশ্চৰ্য, তুমি ফাট করে জাপান চলে গেলে। আগে তো কিছুই বল নি। আমি ইদরিসকে টেলিফোন করলাম–ইদরিস বলল, স্যার জাপানে। আমি বললাম–কোথায় আছে টেলিফোন নাম্বার দাও। ও দিল না। বলল, সে জানে না। আমি মিশ্চিত সে জানে, তবু দিল না। তুমি কি ওকে বলেছ। আমাকে টেলিফোন নাম্বার না দিতে?

না।

তাহলে দিল না কেন?

বুঝতে পারছি না কেন দিল না।

তুমি অবশ্যই ওকে কঠিন ধমক দেবে। কী আশ্চৰ্য আমি টেলিফোন নাম্বার চাইলাম, ও দিল না। মিথ্যা কথা বলল…

রেহানা, তুমি কেমন আছ সেটা তো বললে না।

ভালো না। কাল সারারাত এক ফোটা ঘুম হয়নি। রাত এগারটার সময় ঘুমুতে গেছি তখনি মনে হয়েছে ঘুম হবে না। কান্তাকে টেলিফোন করলাম–কান্তা বলল, মাথায় পানি ঢেলে, এক কাপ গরম দুধ খেয়ে শুয়ে থাকতে। মাথায় পানি ঢালিলাম। কিন্তু গরম দুধ আর খুঁজে পাই না। চায়ের জন্যে কনডেন্সড মিস্ক ছাড়া ঘরে দুধ নেই। কল্পনা করতে পার? শেষে ডিপ ফ্রিজে এক প্যাকেট দুধ পাওয়া গেলা–জমে পাথরের মতো হয়ে গেছে। কল্পনা করতে পার? মাইক্রোওয়েভে দুধের পাথর গলাতে দিয়েছি–ওমা সেটাও নষ্ট! ঐ দুধ গরম করে খেতে খেতে রাত বেজেছে দু’টা।

গরম দুধ খাবার পরেও লাভ হয় নি? দেখেছি। শেষ রাতের দিকে চোখের পাতা একটু বন্ধ হয়েছে–তখন শুধু দুঃস্বপ্ন দেখেছি।

তোমার সেই অ্যাকসিডেন্টের দুঃস্বপ্ন?

না। আরো ভয়ংকর। স্বপ্নে দেখলাম আমার যে কাজের মেয়েটা করিমের মা, সে বঁটি দিয়ে আমাকে কোপাচ্ছে।

বল কী?

আমি যতই বলি–এই করিমের মা, এই, ততই সে হাসে আর কোপ দেয়। যাই হোক সকালে ঘুম থেকে উঠেই তিন মাসের অ্যাডভান্স বেতন দিয়ে ওকে বিদায় করেছি। যেতে চায় না–কান্নাকাটি করে–আমি পাত্তা দিই নি। এমনিতেই আমার রাতের ঘুম হয় না, তারপর যদি এরকম দুঃস্বপ্ন দেখার পরেও তাকে রেখে দেই, সেটা কি ঠিক হবে?

ना, छैिक श्रद ना।

তুমি জাপান থেকে আমার জন্যে একটা বই নিয়ে এস।

কী বই?

স্বপ্নের ইন্টারপ্রিটেশনের একটা বই। কোন স্বপ্ন দেখলে কী হয়–এই বই।

খাবনামা জাতীয় বই?

হুঁ।

এইসব বই আমাদের দেশের ফুটপাতে পাওয়া যাবার কথা। জাপানে কি পাওয়া যাবে?

তাই পাওয়া যাবে। স্বল্প নিয়ে সারা পৃথিবীতে রিসার্ট হচ্ছে। স্বপ্ন তো তুচ্ছ করার বিষয় না।

আচ্ছা আমি বই নিয়ে আসব। এখন টেলিফোনটা রাখি। জরুরি কোনো ফ্যাক্স এসেছে বলে মনে হচ্ছে। ফ্যাক্স মেশিনে শব্দ হচ্ছে।

রেহানাকে কথা বলার কোনো সুযোগ না দিয়ে মোবারক সাহেব টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। তিনি স্বস্তিবোধ করছেন–কারণ রেহানা তার কাছে টেলিফোন নাম্বার চায় নি। চাইতে ভুলে গেছে।

টেপীর সম্পর্কে লোকমান খোঁজ যা পাঠিয়েছে তাতে মোবারক সাহেবের বিস্ময়ের সীমা রইল না। মেয়েটির নাম টেপী নয়–মিতু। তার ছবির জগতের একটা নাম আছে–রেশমা। তারা তিন বোন না, দু’বোন এক ভাই। ভাই জেলে আছে। সাত বছরের সাজা হয়েছে। বাবা চা বাগানে চাকরি করতেন। চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসা করতে গিয়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন। মিতু ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় তিনি মারা যান। মেয়েটির আর পড়াশোনা হয় নি।

লোকমানের পাঠানো রিপোর্টটা সম্পূর্ণ না। মেয়েট ছবির লাইনে কী করে এল রিপোর্টে এই তথ্য থাকা উচিত ছিল। মেয়েটির বাবা কীসের ব্যবসা করতেন? ভাইয়ের সাত বছরের সাজা হয়েছে–মামলাটা কীসের? খুনের মামলা? অস্ত্র মামলা?

মেয়েটি অভিনয় ভালোই জানে–শুরুতে তার সামান্য সন্দেহ হচ্ছিল মেয়েটি রসিকতা করছে–শেষে তিনি মেয়েটির কথা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন। তিন বোন–হ্যাঁপী, টেপী, পেপী। এই হাস্যকর ব্যাপারটি যে-মেয়ে বিশ্বাস করিয়ে ফেলতে পারে তার অভিনয় ক্ষমতা তুচ্ছ করার মতো না।

মোবারক সাহেব দুপুরে কিছু খেলেন না। বরফের কুচি দেয়া এক গ্লাস টমেটোর রস খেয়ে শুয়ে পড়লেন। গল্পের বইটি পড়ার চেষ্টা করলেন। যতই এগুচ্ছেন গল্প ততই উদ্ভট হচ্ছে। ভূতের গল্প হিসেবে এইসব ছাইপাশ আজকাল লেখা হচ্ছে। লক্ষ লক্ষ কপি ছেপে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। কোনো মানে হয়?

ভরাপেটে আরাম করে ঘুমানো যায় না। হাঁসফাস লাগে। ক্ষিধে নিয়ে শুয়েছেন বলেই বোধহয় তিনি সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমুলেন। ঘুম ভাঙল টেলিফোনের শব্দে। অফিস থেকে টেলিফোন। তিনি যতদিন বাইরে থাকবেন ততদিনই প্রতি সন্ধ্যায় টেলিফোনে তাঁর খোঁজখবর নেয়া হবে। ঢাকা অফিসের খবর তাঁকে দেয়া হবে।

টেলিফোন করেছে লোকমান। মোবারক সাহেব কোমল গলায় বললেন, কেমন আছ লোকমান?

স্যার ভালো আছি। একটা ফ্যাক্স পাঠিয়েছিলাম স্যার, পেয়েছেন?

হ্যাঁ। ঢাকার খবর কী?

দেয়ার মতো কোনো খবর নেই স্যার। সব ঠিকঠাক আছে।

জুনের আঠার তারিখ মংলা পোর্টে আমাদের যে জাহাজ আসার কথা সেটা ঠিক আছে?

স্যার এখন পর্যন্ত ঠিক আছে। এডেন হয়ে আসবে, এডেনে কোনো সমস্যা না হলে তারিখ মতোই আসবে।

সমস্যা হবার কি কোনো সম্ভাবনা আছে?

জ্বি স্যার আছে।

আচ্ছা ঠিক আছে। ভালো কথা, একটা ছবি বানাতে কী পরিমাণ টাকা লাগে তুমি জান?

স্যার আমি আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।

ছবি বানাতে, টু মেক এ ফুল লেংথ ফিচার ফিল্ম, কী পরিমাণ টাকা লগ্নি করতে হয় তুমি কি জান?

স্যার আমি জানি না, তবে আপনি বললে খোঁজ নিতে পারি।

খোঁজ নিও তো।

আমি স্যার এখনি খোঁজ নেব। খোঁজ নিয়ে ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে আপনাকে জানাব।

তাড়া কিছু নেই–তুমি খোঁজ নিয়ে রাখ, এক সময় আমাকে জানালেই হবে।

জ্বি আচ্ছা স্যার।

লোকমান আমি তাহলে টেলিফোন রাখি?

টেলিফোন রেখে মোবারক সাহেব রাতের কর্মকাণ্ড মনে মনে ঠিক করে ফেলেন। ক্যাব নিয়ে খানিকক্ষণ ঘুরবেন। বইয়ের দোকানে যেতে হবে–স্বপ্নতথ্য বিষয়ক বই কিনতে হবে। তারপর একটা মেক্সিকান রেস্টুরেন্ট খুঁজে বের করতে হবে। ডিনারের সঙ্গে মাৰ্গরিটা খেতে ইচ্ছে করছে। মেক্সিকান রেস্টুরেন্ট ছাড়া এই পানীয় আর কোথাও পাওয়া যায় না। জাপানি ক্যাবি ড্রাইভাররা ইংরেজি জানে না বললেই হয়। হোটেলের রিসিপশনিস্টদের সাহায্য নিতে হবে। বড় হোটেলের রিসিপশনিস্টদের সঙ্গে কথা বলতে তার ভালো লাগে না। এর যন্ত্রের মতো কথা বলে। আজ পর্যন্ত তিনি পাঁচতারা হোটেলে এমন কোনো রিসিপশনিস্ট পান নি যে মানুষের মতো কথা বলছে।

এই হোটেলের রিসিপশনিস্ট মেয়েটি এমন সাজ সেজেছে যেন সে এক্ষুণি বিশ্বসুন্দরী প্ৰতিযোগিতায় অংশ নিতে যাবে। পাতলা ঠোঁটে যে লিপষ্টিক দিয়েছে তাতে মনে হচ্ছে ঠোঁটে আগুন জ্বলছে। জাপানিরা ভালো ইংরেজি বলতে পারে না। কিন্তু মেয়েটি নিখুঁত আমেরিকান একসেন্টের ইংরেজিতে বলল, স্যার আপনার জন্যে আমি কী করতে পারি? মোবারক সাহেব বিরক্তি ও বিতৃষ্ণা নিয়ে মেয়েটিকে দেখছেন। যন্ত্র কথা বলছেমানুষ না। কঠিন কিছু বলে মেয়েটির যন্ত্র ভাবকে নষ্ট করে দিলে সে হয়তো মানুষের মতো কথা বলত।

স্যার কিছু কি করতে পারি? মোবারক সাহেবের ইচ্ছা হলো বলেন–ইয়াং লেডি, আমি খুব একা বোধ করছি। তুমি কি তোমার ডিউটি শেষ হবার পর রাতে ঘণ্টাখানেকের জন্যে আসবে? তোমাকে আমি হ্যাঁন্ডসামলি পে করব।

এ জাতীয় কথা বললে সে একটা ধাক্কা খাবে। তার রোবট ভাব এতে কাটতে পারে। মোবারক সাহেব তেমন কিছু বললেন না, মেক্সিকান রেস্টুরেন্টের ঠিকানা চাইলেন। মেয়েটি দ্রুত ঠিকানা বের করে ফেলল। হাসিমুখে বলল, আমি কি ক্যাব ঠিক করে তাকে ইনসট্রাকশান দিয়ে দেব?

দিলে খুব ভালো হয়। ইউ আর সো কাইন্ড।

প্লিজ ডোন্ট মেনশান।

সব ধরাবাঁধা কথা। সব যন্ত্রের মতো কথা। যেন আগে থেকে প্রোগ্রাম করা।

রেহানাও তো এরকম। সে কোনো পাঁচতারা হোটেলের রিসিপশনিস্ট নয়। কিন্তু সে যখন কথা বলে তখন সেও তো তার ধরাবাধা গৎ-এ চলে আসে। এর বাইরে যেতে পারে না। এর বাইরে কথা বলতে পারে না। আসলে সব মানুষই কি এ রকম নয়? তিনি নিজেও কি একজন রোবট না?

মানুষ রোবট কীভাবে হয়? চট করে হয় না–খুব ধীরে ধীরে হয়। কাজেই এই প্রক্রিয়া বোঝা যায় না–এক ভোরবেলা ঘুম থেকে জেগে দেখে সে রোবট হয়ে গেছে। তখন সে আতংকে অস্থির হয়ে যায়। তিনি নিজে কি এখন আতংকে অস্থির হয়েছেন? হ্যাঁ হয়েছেন। সারাক্ষণ তাঁর একা এক লাগে এবং মানুষের সঙ্গও অসহ্য বোধ হয়। এই অসহ্য বোধ হওয়া ব্যাধি বাড়ছে। ক্রমেই বাড়ছে। এর মধ্যে দু’বার তাঁর মনে হয়েছে বেঁচে থাকার তেমন কোনো অর্থ নেই। সাধারণভাবে মনে হয় নি, তীব্ৰভাবেই মনে হয়েছে।

প্রথমবার মনে হলো তিন বছর আগে। রাতে খাওয়াদাওয়া করে ঘুমুতে গেছেন। রেহানা বলল, আজকের ভেজিটেবল কোপ্তা তোমার কেমন লেগেছে? তিনি বললেন, ভালো।

একটু টক টক লাগছিল না?

হুঁ।

তেঁতুল বেশি হয়ে গিয়েছিল। মাদ্রাজি রান্না তো–সব কিছুতেই তেঁতুল দেয়।

হুঁ।

আমি বাবুর্চিকে বলেছি–তেতুল ছাড়া একবার করতে।

ভালো করেছি।

কাল করতে বলব?

বল।

তিনি কোলবালিশ জড়িয়ে শুয়ে পড়লেন। বাতি নিভিয়ে রেহানা ঘুমুতে এল এবং সে কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল। তাঁর ঘুম আসছিল না। তিনি এপাশ-ওপাশ করলেন না। নড়াচড়া করলে রেহানার ঘুম ভেঙে যাবে। চুপচাপ শুয়ে রইলেন। বাথরুমের ট্যাপ বোধহয় ভালোমতো বন্ধ করা হয় নি। কিছুক্ষণ পর পর ‘টপ’ করে পানির ফোঁটা পড়ার শব্দ আসতে লাগল। এক মিনিট নীরবতা–তারপর ‘টপ’ করে একটা শব্দ। আবার নীরবতা আবার শব্দ। তিনি সাবধানে বিছানা ছেড়ে উঠলেন। বাথরুমের ট্যাপ ভালো করে বন্ধ করলেন। তখন ঘড়ির শব্দ শোনা যেতে লাগল। টক টক করে সেকেন্ডের কাঁটা নড়ছে। তিনি আবার উঠলেন। দেয়াল থেকে চেয়ারে দাঁড়িয়ে ঘড়ি নামানোর কোনো অর্থ হয় না। তিনি খানিকক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলেন। সামনের রাস্তা ফাঁকা। কোনো লোক চলাচল নেই। শীতের রাতে এই সময় লোক চলাচল থাকেও না। সে রাতে শীত খুব তীব্ৰ ছিল। কিন্তু তার শীত লাগিছিল না। তাঁর গায়ে ফ্লানেলের স্লিপিং স্যুট। বারান্দায় খোলা বাতাস দিচ্ছে। শীতে তাঁর জমে যাওয়ার কথা। তিনি রেলিং ধরে দাঁড়ালেন। তার একটু গরম লাগতে লাগল। সেই সঙ্গে ক্ষীণ ইচ্ছা হতে লাগল। লাফ দিয়ে নিচে পড়ে যেতে। তাঁর মনে হলো পড়াটা খুব ইন্টারেস্টিং হবে। তিনতলা থেকে নিচে পড়ার সময় মাথাটা যদি আগে পড়ে তাহলে মাথা থ্যাতলানোর টাস করে একটা শব্দ হবে। সেই শব্দটাও ইন্টারেস্টিং হবার কথা। এই জাতীয় চিন্তা সব মানুষের ভেতর কখনো না কখনো আসে, কিন্তু চিন্তাটা স্থায়ী হয় না। মুহূর্তের মধ্যে আসে আবার মুহুর্তের মধ্যে চলে যায়। তাঁর গেল না। তিনি স্থির সিদ্ধান্তে এলেন যে লাফিয়ে নিচে পড়বেন। পড়ার জন্যে ভালো জায়গা রেব করতে হবে। নরম কোনো জায়গায় পড়লে হবে না। শানবাধানো জায়গায় পড়তে হবে। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি লাফিয়ে নিচে পড়ে যাবেন এই চিন্তাটা তাঁর এত ভালো লাগতে লাগিল যে আনন্দে গায়ে কাটা দিল। তার মনে হলো-অনেক অনেক দিন তিনি এই আনন্দ পাননি। তিনি রেলিঙের ওপর উঠতে যাচ্ছেন তখন শোবার ঘরের থেকে রেহানা বলল, এই তুমি একা একা এখানে কী করছ?

তিনি স্ত্রীর দিকে তাকালেন। এত বিরক্তি এবং এত রাগ নিয়ে তিনি তার নীর এর আগে তাকান নি।

পাতলা একটা জামা গায়ে দিয়ে আছ, তোমার ঠাণ্ডা লাগছে না? আমি তো শীতে মরে যাচ্ছি। ঘুম আসছে না?

না।

ঘুমের ওষুধ খাবে? না খাওয়াই ভালো–একবার খেলে অভ্যাস হয়ে যায়। আমাকে দু’তিনটা সিডাকসিন না খেলে তন্দ্রা পর্যন্ত আসে না। এস, ভেতরে এল। ইস্‌রে কী ঠাণ্ডা!

তিনি ঘরে ঢুকলেন। বিছানায় ঘুমুতে গেলেন এবং বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়লেন। তিনি বোকা নন, তিনি বুদ্ধিমান মানুষ, যা ঘটেছে তা যে আবারো ঘটবে তা তিনি জানেন। তিনি যদি বেঁচে থাকতে চান সেই পথ তাঁকে খুঁজতে হবে। এখানে সাহায্য করার আসলে কেউ নেই।

বিলেতে তিনি এক নামি সাইকিয়াট্রিন্টের কাছে গিয়েছিলেন। এক এক সিটিঙে। এই ভদ্রলোক পঁচাত্তর পাউন্ড করে নেন। রঙচঙে পোশাক পরা এক বুড়ো, যে ফুর্তিবাজের ভূমিকায় অভিনয় করার চেষ্টা করছে। অভিনয় ভালো হচ্ছে না। মোবারক সাহেব চট করে সেই অভিনয় ধরে ফেললেন এবং বুড়োর জন্যে একটু মায়াও লাগল।

বুড়ো বলল, তোমার সমস্যাটা কী?

মোবারক সাহেব বললেন, আমার কোনো সমস্যা নেই।

আমার কাছে এসেছে কেন?

গল্প করতে এসেছি।

বোস। বোস। আরাম করে বোস এবং গল্প কর। গল্প তুমি করবে, না। আমি করব?

মোবারক সাহেব বললেন, দু’জনে মিলেই করব। প্ৰথমে তুমি শুরু করা–দেখি তোমার গল্পটা ইন্টারেস্টিং কিনা। তুমি নিশ্চিত তোমার কোনো সমস্যা নেই?

আমি নিশ্চিত।

তাহলে তো তুমি মানুষ না, তুমি ফার্নিচার গোত্রীয়–টেবিল বা চেয়ার। মানুষ হলে সমস্যা থাকতেই হবে।

তোমাদের বিদ্যা তাই বলে?

হ্যাঁ, তাই বলে। প্রচুর সমস্যা থাকবে–তোমরা আমাদের কাছে আসবে। আমরা খেয়ে পরে বঁচিব, তোমরাও পাউন্ড খরচের একটা জায়গা পাবে–হা-হা-হা।

মোবারক সাহেব লক্ষ করলেন, বুড়ো নকল হাসি হাসছে। এদের কাছে আসা অর্থহীন। তারপরেও কিছু কথাবার্তা হলো। তিনি এক সময় জানতে চাইলেন–মানুষ মরতে চায় কেন?

বুড়ো কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল, অসংখ্য কারণে মানুষ মরতে চায়, তুমি কী জন্যে চাচ্ছ সেটা তুমি জান।

মোবারক সাহেব মনে মনে বুড়োর বুদ্ধির প্রশংসা করলেন। একটা সিটিঙে যে পঁচাত্তর পাউন্ড নেয়। তার কিছু বুদ্ধি তো থাকতেই হবে। বুড়োর সঙ্গে আলাপ করে মোবারক সাহেবের কোনো লাভ হয় নি। তার সমস্যা তিনি জানেন। তিনি বিস্মিত হবার ক্ষমতা নষ্ট করে ফেলেছেন। তাঁকে বেঁচে থাকতে হলে বিস্মিত হবার ক্ষমতা ফিরে পেতে হবে। কিংবা এমন কাউকে পাশে লাগবে যার বিস্মিত হবার ক্ষমতা প্ৰবল।

 

বইয়ের দোকান থেকে তিনি স্বপ্নের উপর দু’টা বই কিনলেন। সেলস গার্ল হাসিমুখে বলল, তুমি বুঝি খুব স্বপ্ন দেখ?

মেয়েটার কথা তাঁর ভালো লাগল। এই মেয়েটি রোবট হয়ে যায় নি। তার বিস্মিত হবার ক্ষমতা আছে। দু’টা স্বপ্নের বই কিনতে দেখে সে বিস্মিত হয়েছে।

তুমি কি আর কোনো বই নেবে?

সুইসাইডের উপর কোনো বই আছে?

হ্যাঁ আছে। Anatomy of Suicide.

পাঁচ শ পৃষ্ঠার বিরাট একটা বই। তিনি ডলার দিচ্ছেন। মেয়েটা কৌতুহলী হয়ে তাকে দেখছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *