০৪. মীনা তার মেয়েকে গোসল দিচ্ছে

মীনা তার মেয়েকে গোসল দিচ্ছে। যথেষ্ট আয়োজনের গোসল। প্লাস্টিকের বেবি বাথটাব কেনা হয়েছে। বাথটাব ভর্তি ফেনা। টুনটুনি বাথটাবে বসে আছে। বাথটাবটা আট হয়ে তার গায়ে বসে গেছে।

জহির এসে পাশে বসতে বসতে বলল, ভোম্বা মেয়েকে এমন পিচকি গামলায় ঢুকিয়ে দিলি। বের করবি কীভাবে?

মীনা মুখ কালো করে বলল, এরচে বড় সাইজ বাথটাব নেই। আমি কী করব?

বাথরুমে নিয়ে গোসল করাবি।

এইবারে মীনার চোখে পানি এসে গেল। সে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল, বাথটাব কিনে তোমার টাকা নষ্ট করেছি তো, এই টাকা আমি দিয়ে দিব।

জহির বিরক্ত হয়ে বলল, ঠিক আছে দিবি। এখন কান্না বন্ধ কর। দিনের মধ্যে দশবার চোখের পানি। অসহ্য!

মীনা বলল, আমার সব কিছুই তো অসহ্য। আমাকে অসহ্য। আমার মেয়েকেও অসহ্য। কত সহজে বলে ফেললে ভোম্বা মেয়ে। একদিন দেখলাম না কোলে নিয়ে আদর করতে। গালে একটা চুমু খেতে।

জহির উঠে পড়ল। তার খুবই বিরক্ত লাগছে। বিরক্তির প্রধান কারণ ড্রয়ারে বাজার খরচ হিসেবে রাখা পনেরশো টাকা নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ঐ টাকা দিয়ে টিয়া এক কার্টুন সিগারেট আরো কি কি যেন কিনেছে। তার নাকি ডেইলি এক থেকে দেড় প্যাকেট সিগারেট লাগে।

ড্রয়ারের পনেরশো টাকা ছিল জহিরের শেষ সম্বল। আবার তাকে টাকার সন্ধানে বের হতে হবে। টাকা পাওয়া যাবে কি না কে জানে। একটা পত্রিকার অফিসে ইলাসট্রেটর হিসেবে যোগ দেবার কথা ছিল। পত্রিকার মালিক জানিয়েছেন আপাতত তারা নতুন কাউকে নিচ্ছেন না। পরে যোগাযোগ করতে।

অনেক ছবির দোকানে ছবি দেয়া আছে। কোথাও কিছু বিক্রি হয় নি। শ্রাবণী গ্যালারির মালিক কুদ্দুস সাহেব গলাটা খাটো করে বলেছেন, কামরুল হাসানের তুলির টান রপ্ত করেন। তারপর উনার ঢংয়ে কয়েকটা ছবি একে নিয়ে আসেন। আমাদের লোক আছে অবিকল কামরুল হাসানের নকল করে সিগনেচার করে দেবে। পার পিস আপনাকে দেব পাঁচ হাজার। রাজি থাকলে ছবি আঁকেন। এস এম সুলতান কপি করতে পারলে পার পিস পনেরো করে দেব। জয়নুল নকল করতে পারলে পার পিস কুড়ি পাবেন। আপনার প্রতিভা আছে আপনি পারবেন। আমি খোলা মানে আপনাকে আমার অফার দিলাম। বাকিটা আপনার ইচ্ছা। না খেয়ে মরবেন, না নকল ছবি আঁকবেন সেটা আপনার বিবেচনা।

জহির সকাল থেকে কামরুল হাসানের তুলির টান দিচ্ছে। দুটি দাঁড়িয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। দুটাই বকের ছবি। একটাতে বক মাছ খাচ্ছে। তার ঠোঁটে মাছ। অন্যটাতে উড়ার প্রস্তুতি হিসেবে পাখা মেলেছে। জুহিরের ধারণা কামরুল হাসান এই ছবি দুটি দেখলে নিজেও খুশি হতেন।

মীনা টুনটুনিকে টাওয়েল দিয়ে মুছতে মুছাতে ভাইয়ের সামনে এসে দাড়াল। কঠিন মুখে বলল, ভাইজান আমি ঠিক করেছি আজ চলে যাব।

জহিল বলল, আচ্ছা।

রাতে বাস যায়। রাতের বাসে যাব।

ঠিক আছে।

খালি হাতে আমি শ্বশুরবাড়িতে উঠতে পারব না। তুমি টুনটুনিকে সোনার কিছু দিবে বলেছিল। আমাকে টাকা দাও। আমি কিনে আনব।

এখন আমার হাতে কোনো টাকাপয়সা নাই। তোরা চলে যা, আমি টাকা মানিঅর্ডার করে পাঠাব।

মীনা কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি তোমার বোন না পথের ফেলনা। ঠিক করে বল তো ভাইয়া। দশ দিন ধরে আছি। তুমি টুনটুনির বাবার সঙ্গে একটা কথা বল না। বেচারা একা বারান্দায় বসে থাকে। সামান্য কয়েক পেকেট সিগারেট কিনেছে, এই নিয়েও তুমি কথা শুনিয়েছ।

জহির বলল, কথা শুনাইনি তো। বলেছি অন্যের পয়সায় এত দামি সিগারেট খাওয়ার দরকার কী? আমি নিজে তো দেশীটা খাই।

দু দিনের জন্যে বেড়াতে এসে দামি সিগারেট যদি খায় তাতে অসুবিধা কী?

জহির হতাশ গলায় বলল, কোনো অসুবিধা নাই। বেশি করে খেতে বল। এখন সামনে থেকে যা।

মীনা কাঁদতে কাঁদতেই সামনে থেকে বের হয়ে গেল। এখন টুনটুনির কান্নাও শোনা যাচ্ছে। মীনা রাগ ঝাড়তে গিয়ে মেয়ের গালেও চড়থাপ্পড় লাগিয়েছে। সে কখনও একা কেঁদে শান্তি পায় না।

জহির ছবি হাতে উঠে পড়ল। কান্নাকাটির মধ্যে বসে থাকার কোনো মানে হয় না।

 

কুদ্দুস সাহেব স্কেচ দুটি ভুরু কুঁচকে অনেকক্ষণ দেখলেন। কিছুই না বলে ড্রয়ার থেকে দশ হাজার টাকার একটা ব্যান্ডেল দিয়ে বললেন চা খাবেন?

জহির বলল, খাব।

কুদ্দুস বলল, জয়নুলের নকল করেন। উনি নিজেই নিজের ছবি প্রচুর নকল করেছেন। উনার ভালো ভালো ছবির চার পাঁচটা জেনুইন ভার্সান আছে। আপনার হাত ভালো। আপনি যদি করেন কোনো শালা ধরতে পারবে না। আপনাকে আমরা ঠকাব না।

জহির বলল, ঠিক আছে।

কবে দিবেন বলেন। আমার কাছে পার্টি আছে।

তাড়াতাড়িই দিব।

উনার দুর্ভিক্ষের কাক কিন্তু আঁকবেন। ডাস্টবিনের ময়লার পাশে শিশু, কাক এইসব। বিদেশীরা লুফে নিবে।

ঠিক আছে বক আর আঁকব না। এখন থেকে কাক।

আপনার ঐ বন্ধু কোথায়? ফজলু সাহেব। উনার হাতও ভালো।

জহির সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, শুধু হাত ভালো হলে হয় না, কপালও ভালো থাকতে হয়। তার কপাল মন্দ। সে হাসপাতালে। এখন মরে মরে অবস্থা।

বলেন কি! কোন হাসপাতাল? কত নম্বর কি বলুন তো একবার দেখতে

জহির উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, খামাখা হাসপাতালের নাম দিয়ে কী করবেন? আপনি যে দেখতে যাবেন না সেটা আপনিও জানেন আমিও জানি।

 

জহির বাসায় ফিরে বোনের হাতে টাকার বান্ডেলটা দিয়ে বলল, যা টুনটুনির জন্যে কিছু নিয়ে আয়।

মীনা গম্ভীর গলায় বলল, এখানে কত আছে?

দশ আছে।

এতে তো এক ভরিরও কিছু হবে না। সোনার ভরি এখন তেরো হাজার।

যা হয় তাই কিনবি এবং রাতের বাসে বিদায় হয়ে যাবি। আমি পথের ফকির। এই জিনিসটা যেদিন বুঝবি সেই দিন আবার বেড়াতে আসিস।

মীনা বলল, আমি আর কোনো দিনও আসব না। আমি যদি বাবা-মায়ের সন্তান হয়ে থাকি তাহলে তুমি আর কোনো দিন আমার মুখ দেখবে না।

আচ্ছা ঠিক আছে। চিৎকার বন্ধ।

এই রইল তোমার টাকা। তোমার এই টাকা যদি আমি নেই তাহলে যেন আমার হাতে কুষ্ঠ হয়।

মীনা কাঁদছে। মীমার মেয়ে কাঁদছে। জহিরের বিরক্তির সীমা রইল না। বিকালের দিকে মীনা স্বাভাবিক। এক কাপ চা জহিরের সামনে রাখতে রাখতে বলল, ভাইয়া আমি ঠিক করেছি দশ আনার মধ্যে একটা চেইন কিনব। তোমার অবস্থাও তো দেখতে হবে। তোমার যে এমন খারাপ অবস্থা এটাও তো জানি না।

জহির বলল, তোরা কি রাতে যাচ্ছিস?

টিয়াকে পাঠিয়েছি টিকেট কাটতে। টিকিট পেলে অবশ্যই চলে যাব।

ঠিক আছে যা। এতদিন ঢাকায় পড়ে থাকারও কোনো মানে নেই।

ভাইয়া তুমি বলেছিলে টুনটুনির ছবি এঁকে দিবে।

জহির বলল, তুই মেয়ে কোলে নিয়ে সামনে বোস। একে দিচ্ছি।

শাড়ি বদলে চুল বেঁধে আসি?

কিছুই করতে হবে না। আমি তো ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলছি না।

মীনা মেয়ে কোলে নিয়ে বসল। জহির বলল, কথা বলবি না। চুপচাপ বসে থাকবি।

মীনা বলল, কতক্ষণ লাগবে?

জহির বলল, দশ মিনিটও লাগতে পারে আবার দশ ঘণ্টাও লাগতে পারে।

দশ মিনিটের বেশি হলে কিন্তু আমি পারব না। আচ্ছা ভাইজান তুমি টিয়ার সঙ্গে কথা বল না কেন? আজ চলে যাবে তো। ওকে ডেকে ওর সঙ্গে একটু কথাটথা বল।

আচ্ছা বলব। তোর বরের আসল নাম কী?

মীনা হতভম্ব হয়ে বলল, তুমি ওর নাম জান না?

ভুলে গেছি। মানুষ ভুলে যায় না।

মীনা থমথমে গলায় বলল, ওর নাম সবুজ। থাক তোমাকে আর ছবি আঁকতে হবে না।

মীনা মেয়ে কোলে নিয়ে উঠে গেল।

পাশের ঘর থেকে মীনার ফুপিয়ে কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। একটু পরেই মেয়ে কাঁদতে শুরু করবে। শুরু হবে কোরাস। জহির ছবির দিকে তাকিয়ে আছে। টুনটুনির চেহারা চলে এসেছে মীনার খানিকটা এসেছে। ছবিটা ভালো লাগছে দেখতে। মনে হচ্ছে এই ছবিতে আর কাজ না করলেও হবে। সামান্য শেড অবশ্যি দেয়া যায়। না দিলেও তেমন ক্ষতি হবে না। টুনটুনিকে সুন্দর লাগছে ছবিতে। বাচ্চাটার চেহারায় অন্য রকম মায়া আছে। ছবি আঁকার আগে ব্যাপারটা জহির লক্ষ করেনি। জহির আগ্রহের সঙ্গে ছবিতে নিজের নাম সই করল।*

 

সবুজ বাসের টিকেট কাটতে গিয়েছিল বিকাল চারটায়। মীনা পাঁচটার সময় কাদো কাঁদো মুখে বলল, ভাইয়া ও টিকিট কাটতে গেছে এক ঘণ্টা হয়ে গেছে এখনো তো ফিরছে না।

জহির বলল, যেতে-আসতে সময় লাগবে না। তুই অল্পতেই এত অস্থির হয়ে যাস কী জন্যে?

মীনা বলল, ও দশ হাজার টাকার বান্ডেলটা নিয়ে গেছে।

তাতে সমস্যা কী? টিকিট কেটে বাকি টাকা ফেরত আনবে।

ড্রয়ারে পাঁচ প্যাকেট সিগারেট ছিল। সিগারেটও নিয়ে গেছে।

মীনা ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে শুরু করল।

জহির ধমক দিয়ে কান্না থামালো। টুনটুনি তার মাকে ভালো কপি করা শিখেছে। মা কাঁদতে শুরু করলে সে কাঁদতে শুরু করে। মা থামলে সেও থামে।

মীনা বলল, ভাইয়া আমার খারাপ একটা সন্দেহ হচ্ছে। ও মনে হয় চলে গেছে।

জহির বলল, চলে গেছে মানে। কোথায় চলে গেছে।

মীনা বলল, আমি কিভাবে জানি কোথায় গেছে। চলে যে গেছে এটা জানি। ব্যাগে করে নিজের কাপড়-জামাও নিয়ে গেছে। ভাইয়া এখন কী হবে?

জহির সার্ট গায়ে দিচ্ছে। ঘর এখন অসহ্য লাগছে। বাইরে কোথাও যেতে হবে। হাসপাতালে যাওয়া খুবই দরকার, ফজলুর খোঁজ নিতে হবে। গত তিন দিন যাওয়া হয় নি।

মীনা বলল, ভাইয়া কোথায় যাও?

কাজে যাই। জরুরি কাজ আছে।

আমাকে পথে ফেলে চলে যাচ্ছ?

তুই পথে নী। তুই আমার বাসায় আছিস এবং ভালো আছিস।

তুমি ফিরবে কখন?

জানি না কখন ফিরব।

রাত হবে?

হতেও পারে।

মীনা বলল, এর মধ্যে যদি টিয়া বাসের টিকিট নিয়ে ফিরে আসে।

যদি ফিরে আসে তোরা চলে যাবি। বাসায় তালা দিয়ে চাবি বাড়িওয়ালার কাছে রেখে চলে যাবি।

তুমি এ রকম কঠিন গলায় আমার সঙ্গে কথা বলছ কেন?

মীনা আবার ফোস ফোস শুরু করল। টুনটুনিও দেরি করল না।

আর এক মুহূর্ত দেরি করা ঠিক হবে না। জহির উঠে দাঁড়াল।

 

ফজলু মুখের সামনে তিন দিনের একটা বাসি পত্রিকা ধরে শুয়ে আছে। জহিরকে দেখে সে পত্রিকা নামিয়ে বলল, আমাকে ধরাধরি করে একটু বসিয়ে দে। শুয়ে শুয়ে কথা বলতে ভালো লাগে না। প্রকৃতি চায় না আমরা শুয়ে শুয়ে কথা বলি।

জহির ফজলুকে বিছানায় বসাতে বসাতে বলল, তোর নতুন থিওরি?

ফজলু বলল, থিওরি না হাইপোথিসিস। আমরা কখন শুই? ঘুমানোর জন্য শুই, কাজেই…

শরীরের অবস্থা কী?

ভালো না? ডাক্তাররা বলছে খারাপ ধরনের জন্ডিস। হেপাটাইটিস বি, সি, ডি এর কোনো একটা। ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, মৃত্যুর প্রস্তুতি কি নিতে শুরু করব?

ডাক্তার এমনভাবে তাকালো যেন পাগলা গারদের কোনো পেশেন্ট।

তোকে সে-রকমই দেখাচ্ছে।

ফজলু আগ্রহের সঙ্গে বলল, মৃত্যুর প্রস্তুতি কিন্তু আমি নিতে শুরু করেছি।

জহির বলল, সেটা কী রকম?

মনকে বুঝাচ্ছি আমাদের পৃথিবীর যে জগৎ সে জগতের চেয়ে মৃত্যুর পরের জগৎ অনেক ইন্টারস্টিং।

জহির বলল, মন বুঝেছে?

ফজলু বলল, না। এখনও না। তবে বার বার একই কথা বললে মন কন্ডিশন্ড হয়ে যাবে। তখন বুঝ মানবে।

জহির বলল, বুঝ মানলে তো ভালোই। এখন কি খাওয়া-দাওয়া করতে পারছিস, না-কি স্যালাইন চলছে?

স্যালাইন চলছে। মাঝখানে একবার জাউ ভাত দিয়েছিল। মুখে দিয়েই বমি করে দিয়েছি। ভালো করেছি না?

জহির জবাব দিল না। ফজলুর মুখ হাসি হাসি। যেন অতি মজাদার কোনো কথা বলেছে। জহির বলল, যে ডাক্তার তোকে দেখছেন তার নাম কী?

ফজলু বলল, তার নাম দিয়ে দরকার কী?

কথা বলতাম। তোর অসুখ কী? চিকিৎসা কী হচ্ছে?

কথা বলার কোনো দরকার নেই। তাদেরকে তাদের কাজ করতে দে। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের কাজ করবে। একজন অন্যজনের কাজে ইন্টারফেয়ার করবে না। ডাক্তার করবে ডাক্তারের কাজ, আমি করব আমার কাজ।

এখন তোর কাজটা কী?

ফজলু আগ্রহের সঙ্গে বলল, আমার বর্তমান কাজ অদ্রুত অদ্ভুত হাইপোথিসিস দাঁড় করানো। আমার আরেকটা হাইপোথিসিস শোন—

জহির বলল, হাইপোথিসিস শুনতে ইচ্ছা করছে না।

আহা শোন না, মজা পাবি। এই হাইপোথিসিসে মৃত্যুর পর আমরা আরেকটা গ্রহে চলে যাব। সেই গ্রহ পৃথিবীর চেয়ে অনেক সুন্দর। পৃথিবীতে যেমন রোগ-ব্যাধি আছে সেই গ্রহে নেই। সেই গ্রহ ব্যাধিমুক্ত গ্রহ। তবে সেখানে অভাব, অনটন আছে। মানসিক কষ্ট আছে। পৃথিবীর সব মানুষ যে সেই গ্রহে যেতে পারবে তা-না। অনেকের মডেল নষ্ট করে ফেলা হবে।

দ্বিতীয় যে গ্ৰহটাতে আমরা যাব সেখানেও মৃত্যু আছে। মৃত্যুর পর আমাদের স্থান হবে তৃতীয় গ্রহে। দ্বিতীয় গ্রহ থেকে তৃতীয় গ্রহে যাবার সময়ও একদল মানুষ বাদ পড়ে যাব।

তৃতীয় গ্রহ হবে দ্বিতীয়টার চেয়ে বেটার। সেখানে ব্যাধি যেমন নেই, অভাব নেই। একটি ব্যাধি এবং অভাব মুক্ত জগৎ। তবে মানসিক কষ্ট আছে।

সেই জগৎ থেকে আমরা যাব চতুর্থ জগতে। সেই অপূর্ব জগতে কোনো কষ্টও নেই। সেখান থেকে যাত্রা হবে পঞ্চম জগতে।

জহির বলল, এর শেষ কোথায়?

ফজলু বলল, সর্বশেষ জগতটা হলো নবম জগৎ। সেখানে অল্প কিছু মানুষই বাস করবেন। তারা সবাই মুক্ত পুরুষ। মহান সাধু-সন্ত। তারা সর্ব বিষয়েই মুক্ত এমন কি সময়ের বন্ধন থেকেও মুক্ত। তারা তাদের ইচ্ছা মতো যে কোনো জগতে যেতে পারবেন। কেউ কেউ ইচ্ছা করেই যাবেন। এই যে আমরা হঠাৎ হঠাৎ মহাপুরুষদের মত সাধু-সন্তের দেখা পাই তারা আসলে নবম জগতের মানুষ। স্ব-ইচ্ছায় আমাদের জগতে বাস করতে এসেছেন।

জহির বলল, এমন কোনো সাধু-সন্তের দেখা পেয়েছিস?

ফজলু বলল, একজনের দেখা তো অবশ্যই পেয়েছি। আমি নিজে, ঠাট্টা করছি না, এখন আমি মোটামুটি নিশ্চিত।

জহির বলল, আজ উঠি। ফজলু বলল, কাল আসবি?

না। কাল, পরশু, তর এই তিনদিন আসব না। সাভারের এক খামার বাড়িতে যাব। টাকার কুমির এক বুড়োর পোট্রেট আঁকব।

বুড়োর গায়ের রঙ কি ফর্সা?

হুঁ।

তাহলে এক কাজ করিস ইয়েলো ওকার ব্যবহার করিস। ইয়োলো ওকারের সাথে সামান্য লাল রঙ দিবি। টাইটেরিয়াম হোয়াইট কিংবা জিংক অক্সাইড একেবারেই ব্যবহার করবি না। এক্সপেরিমেন্ট করে দেখ।

আচ্ছা।

জহির পকেট থেকে পাঁচশ টাকার একটা নোট বের করে ফজলুর বালিশের নিচে রাখতে গেল। ফজলু বলল, টাকা রাখিস না। চুরি হয়ে যাবে। গতকালই বালিশের নিচ থেকে একশ টাকা চুরি হয়েছে।

খালি হাতে থাকবি?

হুঁ। আসছি নেংটা, থাকব নেংটা, যাব নেংটা।

জহির বাসায় ফিরল রাত দশটায়। মীনা তার মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে বারান্দায় একা বসে আছে। জহিরকে দেখে উঠে দাঁড়াল।

ভাইয়া ও ফিরে নাই।

জহির কিছু না বলে ঘরে ঢুকে গেল। মীনা তার পেছনে ঢুকল।

ভাইয়া এখন আমি কী করব?

কি আর করবি কান্না শুরু কর। মেয়েকে ঘুম থেকে তোল। সে কাঁদুক।

ভাইয়া তুমি পাষাণের চেয়েও খারাপ। সিমারের চেয়েও খারাপ। মীর জাফরের চেয়েও খারাপ।

জহির বলল, ভাত দে। আয় ভাত খাই।

মীনা ভাত বাড়ল। জহিরকে অবাক করে দিয়ে খেতেও বসল। জহির ভেবেছিল মীনা খাবে না। রাগ করে ভাত না খাওয়া তার ছোটবেলার অভ্যাস।

মীনা। জি ভাইয়া।

তোর টিয়া টাকা-পয়সা, সিগারেট, কাপড়-চোপড় তোকে না জানিয়ে নিয়ে চলে গেছে এটা ঠিক না, তোকে জানিয়েই গেছে। তুই তাকে দশ হাজার টাকার একটা বান্ডেল দিয়ে দিবি টিকিট কেনার জন্যে এটা কখনও হবে না। ঘটনা কি বলতে চাইলে বল। বলতে না চাইলে বলতে হবে না।

মীনা মাথা নিচু করে বলল, ও ইন্ডিয়া যাবে। পাসপোর্ট নাই তো। বর্ডার ক্রস করে যাবে। যে বর্ডার পার করাবে তাকে পাঁচ হাজার টাকা দিতে হবে।

জহির বলল, ইন্ডিয়া যাবে কেন?

মীনা বলল, পালিয়ে থাকার জন্য যাবে। দেশে সে একটা ঝামেলায় পড়েছে।

কী ঝামেলা?

মীনা ক্ষীণ গলায় বলল, ওদের কারখানার কেন্টিনে একটা বাজে টাইপের মেয়ে কাজ করতো। এই মেয়েটাকে নিয়ে কি সব হয়েছে। শত্রুতা করে টিয়ার নাম ঢুকিয়ে দিয়েছে। মূল আসামী তিনজন। টিয়া ঘটনার বিন্দু-বিসর্গও জানে না। সারারাত সে ছিল আমার সাথে। আমার জ্বর। বেচারা সারারাত আমার মাথায় জলপট্টি দিয়েছে।

জহির বলল, রেপ কেইস না-কি?

মীনা হ্যাঁ না কিছুই বলল না।

জহির বলল, মেয়েটা মারা গেছে না বেঁচে আছে।

মীনা বলল, মারা গেছে।

আসামী চারজনের মধ্যে কয়জন ধরা পড়েছে।

তিনজনই ধরা পড়েছে। টিয়াকে শুধু ধরতে পারে নি। কীভাবে ধরবে? আল্লাহ আছে না আমাদের দিকে?

কিছু না বলে জহির খাওয়া শেষ করে উঠল। মীনা বলল, ভাইয়া পানি খাও তোমার জন্য পান আনিয়ে রেখেছি।

জহির পান খেল। একটা সিগারেট ধরাল। মীনা তার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। জহির বলল, তুই কি আরো কিছু বলবি?

মীনা বলল, তুমি কি আমাকে তোমার এখানে থাকতে দিবে?

জহির বলল, অবশ্যই। এখন যা, ঘুমাতে যা।

মীনা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ভাইয়া আমার মেয়েটা তোমাকে খুব ভয় পায়। তুমি ওর ভয়টা ভাঙ্গায়ে দিও। তোমার সঙ্গেই তো সে থাকবে। এত ভয় পেলে চলবে?

———————
* চেকোশ্লোভাকিয়ার প্রাগে অনুষ্ঠিত বিশ্ব পেনসিল স্কেচ প্রতিযোগিতায় Unfinished শিরোনামে এই ছবিটি যৌথভাবে জাপানের ইতিমশোর আঁকা Lovely bamboo tree ছবির সঙ্গে স্বর্ণপদক পায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *