মার্চ মাসের মাঝামাঝি রাশেদ একদিন স্বাধীন বাংলার একটা পতাকা নিয়ে এল। গাঢ় সবুজ রংয়ের একটা পতাকা, মাঝখানে লাল গোল, তার মাঝখানে হলুদ রংয়ের কি একটা, দেখে বুঝতে পারলাম না।
ফজলু জিজ্ঞেস করল, মাঝখানে হলুদ এটা কি রে? পাখির মত।
ধুর বোকা— রাশেদ হেসে বলল, পাখি কেন হবে? এটা স্বাধীন বাংলার ম্যাপ।
আমরা আবার ভাল করে তোকালাম, রাশেদ বলে দেয়ার পর এবারে মাঝখানের অংশটা সত্যি ম্যাপের মত দেখাতে লাগল।
রাশেদ বলল, যে ম্যাপটা তৈরি করেছে। সে ভাল করে ম্যাপটা তৈরি করতে পারেনি। আসলে সোনালী রং দিয়ে তৈরি করার কথা ছিল। সোনার বাংলা তো।
আমরা অবাক হয়ে ফ্র্যাগটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। দারুণ হয়েছে ফ্ল্যাগটা। আমাদের হাতে নিয়ে আমাদের এক রকম রোমাঞ্চ হল। আমাদের নিজেদের ফ্ল্যাগ! আমি রাশেদকে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় পেলি এই ফ্ল্যাগ?
রাশেদ উত্তর না দিয়ে রহস্যময় ভঙ্গি করে হেসে বলল, ই ই আমার কাছে সবই আছে!
এটাই হবে আমাদের স্বাধীন বাংলার ফ্ল্যাগ? হ্যাঁ। আমরা অবাক বিস্ময়ে হা করে তাকিয়ে দেখি। বিশ্বাসই হতে চায় না যে আমরা স্বাধীন বাংলা হয়ে যাব। আমাদের নিজেদের আলাদা একটা ফ্ল্যাগ হয়ে যাবে। উর্দু ক্লাসে আর ‘এক কুত্তা মাটি ম্যা ল্যাটা হায়’ সুর করে পড়তে হবে না।
তখন খুব উত্তেজনা চারিদিকে। অসহযোগ আন্দোলন হচ্ছে। সেটা কি জিনিস প্রথমে বুঝতে পারিনি। রাশেদ বুঝিয়ে দিল।
মার্চ মাসের তিন তারিখ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার কথা ছিল। ইয়াহিয়া খান এক তারিখে সেটা বন্ধ করে দিয়েছে। ভুট্রোর সাথে ইয়াহিয়া খানের গলায় গলায় ভাব। সে যেটাই বলছে সেটাই হচ্ছে। জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে দেশের শাসনতন্ত্র তৈরি করার কথা। এখন আর হবে না। শেখ মুজিব এখন অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন, পাকিস্তান সরকারের আর সহযোগিতা করা হবে না, তাই এর নাম অসহযোগ আন্দোলন। দেশ এখন চলছে শেখ মুজিবের কথায়।
উত্তেজনায় আমাদের মুখে কথা সরে না। জিজ্ঞেস করলাম, তাই হচ্ছে সারা দেশে?
হ্যাঁ।
বঙ্গবন্ধু এখন দেখছেন—
বঙ্গবন্ধু? সেটা আবার কে?
রাশেদ আবার এক গাল হেসে বলল, তোরা দেখি কোন খবরই রাখিস না। শেখ মুজিবকে এখন সবাই ডাকে বঙ্গবন্ধু।
আমরা কয়েকবার কথাটা উচ্চারণ করলাম, কথাটা একটু ভারিকটু, কিন্তু বেশ লাগে শুনতে।
বঙ্গবন্ধু কি দেখছেন?
দেখছেন ইয়াহিয়া খান কি করে। যদি দেখেন ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা দেয়ার কোন ইচ্ছা নাই, লাথি মেরে দূর করে দেবেন। আমরা স্বাধীন বাংলা হয়ে যাব সাথে সাথে।
আমি আগে কখনো কাগজ পড়ি নি। আজকাল খুব মন দিয়ে পড়ি। ঢাকা থেকে আমাদের ছোট শহরটাতে খবরের কাগজ আসতে একদিন লেগে যায়, তবুও খবরগুলি গরম থাকে। ঢাকায় মনে হচ্ছে প্রত্যেকদিনই মিছিল হচ্ছে, গোলাগুলীও হচ্ছে। একজন দুজন মানুষ মনে হয় রোজই মারা যাচ্ছে গুলী খেয়ে। আমরা আশা করে আছি— আর কয়েকদিন, তারপরই বঙ্গবন্ধু লাথি মেরে পাকিস্তানীদের বের করে দেবেন, আর আমরা স্বাধীন বাংলা হয়ে যাব।
এর মাঝে রাশেদ একদিন একটা দুঃসংবাদ নিয়ে এল। পাকিস্তানের মিলিটারী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খন বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে এসেছে, সাথে এনেছে জুলফিকার আলী ভুট্রোকে। তারা নাকি বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতা দিয়ে জাতীয় পরিষদের অধিবেশ আবার শুরু করতে পারে, সেটা নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে।
সর্বনাশ! ফজলু মুখ কাল করে বলল, তাহলে স্বাধীন বাংলা হবে না?
স্বাধীন বাংলার এত সুন্দর ফ্ল্যাগটা—
রাশেদ মাথা চুলকে বলল, কিন্তু শালারা খুব হারামির বাচ্চা। মনে নাই নভেম্বর মাসে, ঝড়ের সময় কি করল?
কি করল?
ঝড়ে কয়েক লাখ লোক মারা গেল, আর শালার ব্যাটা ইয়াহিয়া খান একবার দেখতে পর্যন্ত এল না। চীন থেকে ঘুরে এসে নিজের দেশে চলে গেল।
তাই নাকি?
তারপরই তো মাওলানা ভাসানী এক ধমক দিলেন ইয়াহিয়া খানকে। মনে নাই?
আমরা এই ব্যাপারটা জানতাম না, তবু কয়েকবার মাথা নাড়লাম।
রাশেদ গম্ভীর গলায় বলল, মাওলানা ভাসানী ঠিকই বলেছেন।
কি বলেছেন?
বলেছেন কারো ছয় দফা, কারো কারো এগারো দফা। আমার হচ্ছে এক দফা। এই দেশ স্বাধীন বাংলা হবে।
ফজলুর চোখ চকচক করে ওঠে, হাতে কিল দিতে বলল, তাহলে আর স্বাধীনতা কেউ ঠেকাতে পারবে না।
কোন?
জানিস না মাওলানা ভাসানীর পোষা জীন আছে?
জীন?
হ্যাঁ। ফজলু মাথা নেড়ে বলল, তারা সব খবর এনে দেয়।
কিসের খবর?
ভবিষ্যতে কি হবে তার খবর। জীনেরা তো সব জানে আগে থেকে। তারা নিশ্চয়ই মাওলানা ভাসানীকে বলে দিয়েছে— স্বাধীন বাংলা হবে। মাওলানা ভাসানী যেটা বলেন। সেটা কখনো ভুল হয় না—
দিলীপ একটু হকচকিয়ে গেল, বলল, জীনটা কি?
জীন চিনিস না? জীন-ভূত শুনিস নি কখনো?
শুনেছি, কিন্তু জীনটা কি রকম হয়?
বলে।
দিলীপ ভয়ে ভয়ে বলল, ভূতদের হিন্দু-মুসলমান আছে?
মনে হয় আছে।
ওদের রায়ট হয়? কাটাকাটি হয়?
ফজলু মাথা চুলকে বলল, নিশ্চয়ই হয়।
ভূতেরা তখন কি মরে?
ফজলুকে এবারে সত্যিই চিন্তিত দেখাল। অনেকক্ষণ ভেবে বলল, কাটাকাটি হলে কি আর মারে না, কিছু নিশ্চয়ই মরে।
মানুষ মরে হয়। ভূত। ভূত মরে কি হয়?
ফজলু হঠাৎ খুব রেগে—মেগে বলল, তুই চুপ করবি এখন?
দিলীপের মোটেও চুপ করার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু ঠিক তখন আমরা শ্লোগান শুনতে পেলাম। বিরাট বড় একটা মিছিল আসছে। মিছিলের সামনে বড় স্বাধীন বাংলার পতাকা, সবাই শ্লোগান দিচ্ছে— জয় বাংলা। এই শ্লোগানটা নতুন, আগে কখনো শুনিনি। সব শ্লোগানের দুই অংশ থাকে। একজন বলে প্রথম অংশ, অন্য সবাই তখন বলে দ্বিতীয় অংশ। যে রকম ‘ইয়াহিয়ার চামড়া’ ‘তুলে নেব। আমরা’ কিংবা ‘আমার দেশ তোমার দেশ’ ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’। এই শ্লোগানে কিন্তু একটাই অংশ। একজন বলে জয় বাংলা, তখন অন্য সবাই বলে জয় বাংলা। শ্লোগানটা সাংঘাতিক। বলার সময়ই মনে হয় দেশ স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে।
রাশেদের পিছু পিছু আজকে আমরাও মিছিলের সাথে সাথে গেলাম, গলা ফাটিয়ে জয় বাংলা বলে চেচালাম। বাজারের কাছে দিয়ে যখন যাচ্ছি তখন রাশেদ থেমে আঙুল দিয়ে আহসান মঞ্জিলের দিকে দেখােল। দেখলাম, দোতলায় জানালার পর্দা একটু ফাঁক করে কে যেন উঁকি মেরে দেখছে।
কে ওটা?
নিশ্চয় আজরফ আলী।
তুই কেমন করে জানিস?
দেখছিস না। সামনে দাঁড়িয়ে দেখার সাহস নাই। উঁকি মেরে দেখছে।
কেন সাহস নাই?
এত বড় মিছিল, সাহস হবে কেমন করে? আজরফ আলীর তিন বউ জানিস না?
তিন বউ থাকলে কি হয়?
রাশেদ খুবই বিরক্ত হল। বলল, কিছুই দেখি জানিস না। তিন বউ থাকলে কাঠ মোল্লা হয়। যত কাঠ মোল্লা, জামাতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী সব পাকিস্তানের পক্ষে জানিস না?
ও।
আমরা যখন মিছিলের সাথে সাথে খান বাহাদুরের বাসার কাছে দিয়ে যাচ্ছিলাম রাশেদ তখন আবার দাঁড়িয়ে গেল।
আমি বললাম, কি দেখছিস?
খান বাহাদুর নিশ্চয়ই লুকিয়ে দেখছে।
কি দেখছে?
মিছিলটিাকে। পাকিস্তানের মন্ত্রী ছিলো তো স্বাধীন বাংলা একেবারে সহ্য করতে পারে না। তুই যদি কানের কাছে গিয়ে বলিস ‘জয় বাংলা’ দেখবি সব চুল আর দাড়ি দাঁড়িয়ে যাবে রাগে।
আমরা মিছিল থেকে বের হয়ে রাশেদের সাথে র্দাড়িয়ে গেলাম। মিছিলটি যখন চলে গেল তখন দেখলাম, খান বাহাদুর আস্তে আস্তে ভিতর থেকে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। রাশেদ ঠিকই বলেছে, রাগে মুখ থম-থম করছে। মনে হচ্ছে পারলে পুরো মিছিলটিাকে ধরে কঁচা খেয়ে ফেলেন।
ফজলু বলল, একটা ঢেলা মারব নাকি?
ধুর! ঢেলা মারবি কেন?
আমরা আরো খানিকক্ষণ খান বাহাদুরের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে বাসায় ফিরে ५4ठाभ।
পরের কয়দিন খুব দুশ্চিন্তায় কাটল। সত্যি সত্যি যদি ইয়াহিয়া খান আর ভুট্রো মিলে শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের পুরো ক্ষমতা দিয়ে দেয়, তাহলে তো আর স্বাধীন বাংলা হবে না, পাকিস্তানই থেকে যাবে। রাশেদ অবিশ্যি ক্রমাগত বলে যাচ্ছে সেটা
কিছুতেই হতেই পারে না। ইয়াহিয়া খান যত বড় বদমাইশ ভূট্রো নাকি তার থেকে একশগুণ বড় বদমাইশ। পুরোটা নাকি একটা চাল অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে, কিছুতেই বাঙালীদের ক্ষমতা দেবে না। আমরা সেটাই আশা করে আছি, মিটিং ভেঙে যাবে। আর বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়া খান আর ভুট্টোর পাছায় লাথি মেরে বলবেন, দূর হ তোরা। পাকিস্তানে বসে এখন আঙুল চুষ আজ থেকে আমাদের স্বাধীন বাংলা।
আমাদের ছোট শহরটা অবিশ্যি এর মাঝে স্বাধীন বাংলা হয়ে গেছে। সব দোকানে, সব বাসায় একটা করে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ছে। যেখানেই যাই সেখানেই বঙ্গবন্ধুর ছবি। ঘরে ঘরে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম…’ আমরা সবাই আশা করে আছি, এবারে শুধু একটা ঘোষণা, তারপরই পাকাপাকি স্বাধীন হয়ে যাব আমরা। স্কুলে আর উর্দু পড়তে হবে না।
মার্চ মাসের পঁচিশ তারিখে গভীর রাত্রে আমার ঘুম ভেঙে গেল। খুব হৈ-চৈ হচ্ছে চারদিকে, বাসার ভিতরে ছুটাছুটি, বাইরে মাইকে কি যেন বলছে। আমি বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম, অন্ধকারে আব্বা আর আম্মা দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে আব্বা?
আব্বা কোন উত্তর দিলেন না। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে?
আব্বা আস্তে আস্তে বললেন, যুদ্ধ শুরু হয়েছে, বাবা। ঢাকায় মিলিটারীরা আক্রমণ করছে, হাজার হাজার মানুষকে নাকি মেরে ফেলেছে। যুদ্ধ হচ্ছে এখন।
কারা যুদ্ধ করছে বাবা?
বাঙালীরা। পুলিশ। ই. পি. আর. ছাত্র।
মাইকে একজন লোক খুব উত্তেজিত গলায় চিৎকার করে কথা বলতে বলতে রিকশা করে যেতে থাকে। সে বলেছে, ভাইসব! ভাইসব! সারা দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তার সমস্ত শক্তি নিয়ে নিরস্ত্র বাঙালী জনতার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। হাজার হাজার মানুষের মৃতদেহ এখন ঢাকায় পথেঘাটে লুটিয়ে পড়ে আছে। বীর পুলিশ বাহিনী এবং ই. পি. আর তাদের সমস্ত শক্তি নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে। সারা দেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। স্বাধীনতার যুদ্ধ . . .
লোকটার কথা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায়।
ঘুম থেকে উঠে সবাই বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। রাস্তায় ভিড়। আমার বুকের ভিতর কেমন জানি করতে থাকে। ভয়, আতংক, উত্তেজনা আর তার সাথে সাথে কেমন জানি আশ্চর্য একটা আনন্দ।
স্বাধীন বাংলা হবে তাহলে সত্যি!