মাঝখানে একটা শীত চলিয়া গেল, পরের শীতের গোড়ার দিকে, শ্যামার নূতন ছেলেটির বয়স যখন প্রায় আট মাস, হঠাৎ একদিন সকালবেলা মামা আসিয়া হাজির।
শ্যামার সেই পলাতক মামা তারাশঙ্কর।
ছোটাখাটো বেঁটে লোকটা, হাত-পা মোটা, প্ৰকাণ্ড চওড়া বুক। একদিন ভয়ঙ্কর বলবান ছিল, এখন মাংসপেশীগুলি শিথিল হইয়া আসিয়াছে! শেষবার শ্যামা যখন তাকে দেখিয়াছিল মাথার চুলে তাহার পাক ধরে নাই, এবার দেখা গেল প্রায় সব চুল পাকিয়া গিয়াছে। সে তো আজকের কথা নয়। শ্যামার বিবাহের কিছুদিন পরে জমিজমা বেচিয়া গ্রামের সবচেয়ে বনেদি ঘরের বিধবা মেয়েটিকে সাথী করিয়া নিরুদ্দেশ হইয়াছিল, শ্যামার বিবাহ হইয়াছে আজ একুশ-বাইশ বছর। বিবাহের সাত বছর পরে তার সেই প্রথম ছেলেটি হইয়া মারা যায়, তার দু বছর পরে বিধানের জন্ম। গত আশ্বিনে বিধানের এগার বছর বয়স পূর্ণ হইয়াছে।
মামার বয়স ষাট হইয়াছে বৈকি! কিন্তু যে লোহার মতো শরীর তাহার ছিল, এতটা বয়সের ছাপ পড়ে নাই, শুধু চুলগুলি পাকিয়া গিয়াছে, দুটো-একটা দাঁত বোধহয় পড়িয়া গিয়াছিল, মামা সোনা দিয়া বাঁধাইয়া লইয়াছে, কথা বলিবার সময় ঝিকমিক করে। এখনো সে আগের মতোই সোজা হইয়া দাঁড়ায়, মেরুদণ্ডটা আজো এতটুকু বাঁকে নাই। চোখ দুটো মনে হয় একটু স্তিমিত হইয়া আসিয়াছে, তা সে চোখের দোষ অথবা মানসিক শ্রান্তি বোঝা যায় না। শ্যামার বিবাহের সময় মামা ছিল সন্ন্যাসী, গেরুয়া পরিত, লম্বা আলখাল্লা ঝুলাইয়া সযত্নে বাবরি আঁচড়াইয়া ক্যাম্বিশের জুতা পায়ে দিয়া যখন গ্রামের পথে বেড়াইতে যাইত, মনে হইত মস্ত সাধু, বড় ভক্তি করিত গ্রামের লোক। এবার মামার পরনে সরু কালোপাড় ধুতি, গায়ে পাঞ্জাবি, পায়ে চকে জুতো–একেবারে বাবুর বাবু!
শীতল চিনিতে পারে নাই। শ্যামা প্ৰণাম করিয়া বলিল, ও মাগো, কোথায় যাব, এ যে মামা! কোথা থেকে এলে মামা তুমি?
মামা হাসিয়া বলিল, এক জায়গা থেকে কি আর এসেছি মা যে নাম করব, চরকি বাজির মতো ঘুরতে ঘুরতে একবার তোক দেখতে এলাম, আপনার জন কেউ তো আর নেই; বুড়ো হয়েছি, কোন দিন চোখ বুজি তার আগে ভাগ্নীটাকে একবার দেখে যাই, এইসব ভাবলাম আর কি—এরা তোর ছেলেমেয়ে না? কটি রে?
শ্যামাকে মামা বড় ভালবাসিত, সে তো জানিত মামা কবে কোন বিদেশে দেহ রাখিয়াছে, এতকাল পরে মামাকে পাইয়া শ্যামার আনন্দের সীমা রহিল না। কি দিয়া সে যে মামার অভ্যর্থনা করিবে! বাইশ বছর পরে যে আত্মীয় ফিরিয়া আসে তাকে কি বলিতে হয়, কি করিতে হয় তার জন্য? মামাকে সে নানারকম খাবার করিয়া দিল, বাজার হইতে ভালো মাছ তরকারি আনিয়া রান্না করিল, বেশি দুধ আনাইয়া তৈরি করিল পায়েস। মামা বড় ভালবাসিত পায়েস। এখনো তেমনি ভালবাসে কিনা কে জানে?
মামার সঙ্গে একটু ভদ্রতা করিয়া শীতল কোথায় পলাইয়াছিল, মামা ইতিমধ্যে শ্যামার ছেলেদের সঙ্গে ভাব জমাইয়া ফেলিয়াছে–ভারি মজার লোক, এমন আর শ্যামার ছেলেরা দেখে নাই। রাঁধিতে রাঁধিতে শ্যামা হাসিমুখে কাছে আসিয়া দাঁড়ায়, বলে আর তোমাকে পালিয়ে যেতে দেব না মামা, এবার থেকে আমার কাছে থাকবে। তোমার জিনিসপত্তর কই?।
মামা বলে, সে এক হোটলে রেখে এসেছি, কে জানত বাবু তোরা আছিস এখানে?
শ্যামা বলে, ওবেলা গিয়ে তবে জিনিসপত্তর সব নিয়ে এস, কলকাতা এসেছ কবে?
মামা বলে, এই তো এলাম কাল না পরশু, পরশু বিকেলে।
বিধান আজ স্কুলে গেল না। মামা আসিয়াছে বলিয়া শুধু নয়, বাড়িতে আজ নানারকম রান্না হইতেছে, মামা কি একাই সব খাইবে? এগারটা পর্যন্ত কোথায় আড্ডা দিয়া আসিয়া তাড়াহুড়া করিয়া স্নানাহার সারিয়া শীতল প্রেসে চলিয়া গেল, মামার সঙ্গে একদণ্ড বসিয়া কথা বলার সময় পাইল না। আজ তাহার এত তাড়াতাড়ি কিসের সে-ই জানে, বাড়িতে একটা মানুষ আসিলে শীতল যেন কি রকম করে, সে যেন চোর, পুলিশ তাহার খোঁজ করিতে আসিয়াছে।
রাঁধিতে রাঁধিতে শ্যামা কত কি যে ভাবিতে লাগিল। সঙ্গিনীটির কি হইয়াছে? হয়তো মরিয়া গিয়াছে, নয়তো মামার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হইয়াছে অনেকদিন আগেই। ও সব সম্পর্ক আর কতকাল টেকে? মরুক, ওসব দিয়া তার কি দরকার? কেলেঙ্কারি ব্যাপার চুকাইয়া দিয়া মামা ফিরিয়া আসিয়াছে, এই তার ঢের। আচ্ছা, এতকাল মামা কি করিতেছিল? টাকা-পয়সা কিছু সঞ্চয় করিয়াছে। নাকি? তা যদি করিয়া থাকে তবে মন্দ হয় না। মামার সম্পত্তি হাতছাড়া হইয়া যাওয়ায় শীতলের মনে বড় লাগিয়াছিল, মামা হয়তো এবার সুদে-আসলে সে পাওনা মিটাইয়া দিবে? পুরুষমানুষের ভাগ্য, বিদেশে ধূলিমুঠা ধরিয়া মামার হয়তো সোনামুঠা হইয়াছে, মামার কাপড়-জামা দেখিলেও তাই মনে হয়। মামার তো আর কেউ নাই, যদি কিছু সঞ্চয় করিয়া থাকে শ্যামাই তাহা পাইবে। এই বয়সে আর একজন সঙ্গিনী জুটাইয়া মামা আর তাহার দেশান্তরী হইতে যাইবে না!
মামাকে সে ঘরবাড়ি দেখায়! পিছনে খিড়কির দিকে খানিকটা খালি জায়গা আছে, কয়েক হাজার ইট কিনিয়া শ্যামা সেখানে জমা করিয়া রাখিয়াছে, রান্নাঘরের পাশে সিঁড়ির নিচে চুন আর সুরকি রাখিয়াছে, আর বছর শ্যামা যে টাকা জমাইয়াছিল এসব কিনিতেই তা খরচ হইয়া গিয়াছিল, এ বছর কিছু টাকা জমিয়াছে, ভগবানের ইচ্ছা থাকিলে আগামী মাঘে দোতলায় শ্যামা একখানা ঘর তুলিবে।
এইটুকু বাড়ি, দুখানা মোটে শোবার ঘর, কেউ এলে কোথায় থাকতে দেব ভেবে পাইনে মামা, দোতলায় ঘরটা তুলতে পারলে বাঁচি, ও আমার অনেকদিনের সাধ। খোকার বিয়ে দিলে ছেলে-বৌকে ওঘরে শুতে দেব। পাস দিতে থোকার আর চার বছর বাকি, পৌষ মাসে কেলাসে উঠলে তিন বছর, নারে খোকা?
মামা গভীর হইয়া বলে, বড় বুদ্ধি তোর ছেলের শ্যামা, মস্ত বিদ্বান হবে বড় হয়ে। তামাকের ব্যবস্থা বুঝি রাখিস না, এ্যাঁ? খায় না, শীতল খায় না তামাক?
আগে খেত, কিন্তু কে অত দেবে মিনিটে মিনিটে তামাক সেজে? যা ঝি আমার, বাসন মাজতেই বেলা কাবার–আর আমার তো দেখছই মামা, নিশ্বাস ফেলবার সময় পাই নে। সারাদিন–খেটে খেটে হাড় কালি হয়ে গেল। এদিকে বাবু তো কম নন, নিজে তামাক সেজে খাবার মুবোদ নেই, এখন বিড়ি-টিড়ি খায়। মরেও তেমনি খুকুর খুকুর কেশে!
দে তবে আমাকে দুটো বিড়ি-টিড়িই আনিয়ে দে বাবু।
শ্যামা উৎসাহিত হইয়া বলে, দেব মামা, হুঁকো তামাক-টামাক সব আনিয়ে দেব? এই তো কাছে বাজার, যাবে আর নিয়ে আসবে। রানী, একবার শোন দিকি মা।
শ্যামার ঝি সত্যভামা শ্যামার ছোট ছেলেটার জন্মের কয়েক ঘণ্টা আগে মরিয়া গিয়াছিল, ছেলে যদি শ্যামার না হইত, হইত মেয়ে কারো তবে আর বুঝিতে বাকি থাকিত না যে বাড়ির ঝি পেটের ঝি হইয়া আসিয়াছে। সত্যভামার মেয়ে রানী এখন শ্যামার বাড়িতে কাজ করে। রানীর বিবাহ হইয়াছে, জামাই ভূষণ থাকে শ্বশুরবাড়িতেই, শীতল তাহাকে কমল প্রেসে একটা চাকরি জুটাইয়া দিয়াছে। রানী বাজার হইতে তামাক খাওয়ার সরঞ্জাম আনিয়া তামাক সাজিয়া ঠুকায় জল ভরিয়া দিল, মামা আরামের সঙ্গে তামাক টানিতে টানিতে বলিল–তোর ঝিটা তো বড় ছেলেমানুষ শ্যামা, কাজকর্ম পারে?
ছাই পারে, আলসের একশেষ, আবার বাবুয়ানির সীমে নেই, ঘুড়ির চলন দেখছ না মামা? ওর মা আমার কাছে অনেকদিন কাজ করেছিল তাই রাখা, নইলে মাইনে দিয়ে অমন ঝি কে রাখে?
খাওয়াদাওয়া শেষ হইতে দুটা বাজিল। শ্যামা সবে পান সাজিয়া মুখে দিয়াছে, শীতল ফিরিয়া আসিল। শ্যামা অবাক হইয়া বলিল, এত শিগগিরি ফিরলে যে?
মামার সঙ্গে একটু কথাবার্তা বলব, প্রেসে কাজকর্মও নেই—
বেশ করেছ। যেমন করে অফিসে চলে গেলে, মামা না জানি কি ভেবেছিল!
শীতল ইতস্তত করে, কি যেন সে বলিবে মনে করিয়াছে। সে একটা পান খায়। শ্যামার মুখের দিকে চাহিয়া মনে মনে কি সব হিসাব করে। হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিল, মামা কদিন থাকবেন। এখন, না?
শ্যামা বলিল, কদিন কেন? বরাবর থাকবেন, আমরা থাকতে বুড়ো বয়সে হোটেলের ভাত খেয়ে মরবেন কি জন্যে?
আমিও তাই বলছিলাম!–পয়সা-কড়ি কিছু করেছেন মনে হয়, এ্যাঁ?
মনে তো হয়, এখন আমাদের অদেষ্ট!
মামা একটা ঘুম দিয়া উঠিলে বিকালে তাহারা চারিদিকে ঘিরিয়া বসিয়া গল্প শুনিতে লাগিল, শহর গ্রাম অরণ্য পর্বতের গল্প, রাজা-মহারাজা সাধু-সন্ন্যাসী চোর-ডাকাতের গল্প, রোমাঞ্চকর বিপদ-আপদের গল্প। মামা কি কম দেশ ঘুরিয়াছে, কম মানুষের সঙ্গে মিশিয়াছে। সুদূর একটা তীর্থের নাম কর, যার নামটি মাত্র শ্যামা ও শীতল শুনিয়াছে, যেমন রামেশ্বর সেতুবন্ধ, নাসিক, বদরীনাথ–মামা সঙ্গে সঙ্গে পথের বর্ণনা দেয়, তীর্থের বর্ণনা দেয়, সব যেন রূপ ধরিয়া চোখের সামনে ফুটিয়া ওঠে। সেই বিধবা সঙ্গিনীটি কতকাল মামার সঙ্গে ছিল, কেহ জিজ্ঞাসা করিতে পারে না, মামার যাযাবর জীবনের ইতিবৃত্ত শুনিয়া কিন্তু মনে হয়, চিরকাল সে দেশে দেশে ঘুরিয়াছে। একা, সাথী যদি কখনো পাওয়া গিয়া থাকে, সে পথের সাথী, পুরুষ। শ্যামা একবার সুকৌশলে জিজ্ঞাসা করে, গ্রাম হইতে বাহির হইয়া প্রথমে মামা কোথায় গিয়াছিল, মামা সোজাসুজি জবাব। দেয়, কাশী–কাশীতে ছিলাম–পাঁচ-ছটা মাস, ভুলে-টুলে গিয়েছি সে সব বাপু, সে কি আজকের কথা!
শ্যামা বলে, একা একা ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগ মামা?
মামা বলে, একা ঘুরেই তো সুখ রে, ভাবনা নেই, চিন্তা নেই, যখন যেখানে খুশি পড়ে থাক, যেখানে খুশি চলে যাও, কারো তোয়াক্কা নেই, জুটল খেলে না জুটল উপোস করলে–চিরকাল ঘরের কোণে কাটালি, সে আনন্দ তোরা কি বুঝব? একবার কি হল–নীলগিরি পাহাড়ের গোড়ায় একটা গ্রামে গিয়েছি এক সাধুর সঙ্গে, গ্রামটার নাম বুঝি তুড়িগগাড়িয়া, পাহাড়ের সার চলে। গিয়েছে গ্রামের ধার দিয়ে। পাহাড়ে উঠে দেখতে ইচ্ছা হল! গা থেকে উড়িয়া মেয়েরা পাহাড়ের বনে কাঠ কাটতে যায়, তাদের সঙ্গে গেলাম। সে কি জঙ্গল রে শ্যামা, এইটুকু সরু পথ, দুপাশে এক পা সরবার যো নাই, যেন গাছপালার দেয়াল গাঁথা। ফিরবার সময় পথে হাতির পাল পড়ল, আর নামবার যো নাই। চারদিন হাতির পাল পথ আটকে রইল, চারদিন আমরা নামতে পারলাম না। কি সাহস মেয়েগুলোর বলিহারি যাই, চারদিন টু শব্দটি করলে না, রাত্রে আমাকে বলত ঘুমোতে, আর নিজেরা কাঠকাটা দা বাগিয়ে ধরে পাহারা দিয়ে জেগে থাকত। আর একদিন–
সেদিন আর মামার জিনিসপত্র আনা হইল না, পরদিন গিয়া লইয়া আসিল।
শ্যামা ভাবিয়াছিল, মামা কত জিনিস না জানি আনিবে, হয়তো আঁটিবেই না ঘরে! মামা কিন্তু আনিল ক্যাম্বিশের একটা ব্যাগ, কম্বলে জড়ানো একটা বিছানা–লেপ, তোশক নয়, দুটো। র্যাগ, খানতিনেক সুতির চাদর আর এই এতটুকু একটা বালিশ।
শ্যামা অবাক হইয়া বলিল, এই নাকি তোমার জিনিস মামা?
মামা একগাল হাসিল, ভবঘুরের কি আর রাশ রাশ জিনিস থাকে মা? ব্যাগটা হাতে করি, বিছানা বগলে নিই, চল এবার কোথায় যাবে দিল্লি না বোম্বাই।–ব্যাগটা হাতে তুলিয়া বিছানা বগলে করিয়া মামা যাওয়ার অভিনয় করিয়া দেখাইল।
তাই হইবে বোধহয়। আজ এখানে কাল সেখানে করিয়া যে বেড়ায়, বাক্স প্যাঁটরার হাঙ্গামা। থাকিলে তাহার চলিবে কেন? কিন্তু এমন ভবঘুরেই যদি মামা হইয়া থাকে, তবে তো টাকাকড়ি। কিছুই সে করিতে পারে নাই? শ্যামা ভাবিতে ভাবিতে কাজ করে। প্রথমে সে যা ভাবিয়াছিল, বিদেশে মামা অর্থোপার্জন করিয়াছে, বেড়াইয়াছে শুধু ছুটিছাটা সুযোগ-সুবিধা মতো, হয়তো তা সত্য নয়। আমার হয়তো কিছুই নাই। দেশে দেশে সম্পদ কুড়াইয়া বেড়ানোর বদলে হয়তো শুধু বাউল সন্ন্যাসীর মতো উদ্দেশ্যহীনভাবেই সে ঘুরিয়া বেড়াইয়াছে। কিন্তু এমন যে দুঃসাহসী, কত রাজ-রাজড়ার সঙ্গে যে খাতির জমাইয়াছে, পার্থিব সম্পদ লাভের সুযোগ কি সে কখনো পায় নাই? পথেঘাটে লোকে তো হীরাও কুড়াইয়া পায়। বিষ্ণুপ্রিয়ার বাবা পশ্চিমে গিয়াছিলেন কপৰ্দকহীন অবস্থায়, কোথাকার রাজার সুনজরে পড়িয়া বিশ বছর দেওয়ানী করিলেন, দেশে ফিরিয়া দশ বছর ধরিয়া পেনশনই পাইতেন বছরে দশ হাজার টাকার। মামার জীবনে ওরকম কিছুই কি ঘটে নাই? কোনো দেশের রাজার ছেলের প্রাণ-টান বাচাইয়া লাখ টাকা দামের পান্না মরকত–একটা কিছু উপহার?
মামা নিঃস্ব অবস্থায় ফিরিয়া আসিয়াছে, শ্যামার ইহা বিশ্বাস করিতে ইচ্ছা হয় না। একবার তাহাদের গ্রামে এক সন্ন্যাসী গাছতলায় মরিয়া পড়িয়া ছিল, সন্ন্যাসীর সঙ্গে ছিল পুরু কাঠের ছোট্ট একটি জলচৌকি, তার ভিতরটা ছিল ফাপা, পুলিশ নাকি ধ্রুর মতো ঘুরাইয়া ছোট ছোট পায়া চারটি খুলিয়া তক্তার ভিতরে একগাদা নোট পাইয়াছিল। মামার ব্যাগের মধ্যে, কোমরের থলিতে হয়তো তেমনি কিছু আছে? নোেট না থোক, দামি কোনো পাথরটাথর?
মামা স্থায়ীভাবে রহিয়া গেল। ভারি আমুদে মিশুকে লোক, কদিনের মধ্যে পাড়ার ছেলেবুড়োর সঙ্গে পর্যন্ত তাহার খাতির জমিয়া গেল, এ বাড়িতে দাবার আড়ায়, ও বাড়িতে তাসের আড্ডায় মামার পসারের অন্ত রহিল না। মামার প্রতি এখন শীতলের ভক্তি অসীম, মামার মুখে দেশ-বিদেশের কথা শুনিতে তাহার আগ্রহ যেন দিন দিন বাড়িয়া চলে, মামাকে সে চুপ করিতে দেয় না। মামা আসিবার পর হইতে সে কেমন অন্যমনস্ক হইয়া পড়িয়াছে, চোখে কেমন উদাস উদাস চাউনি। শ্যামা একটু ভয় পায়। ভাবে এবার আবার মাথায় কি গোলমাল হয় দ্যাখ!
ঠিক শীতলের জন্য যে শ্যামার ভাবনা হয় তা নয়, শীতলের সম্বন্ধে ভাবিবার তাহার সময় নাই। তার গোছানো সংসারে শীতল কবে কি বিপর্যয় আনে, এই তার আশঙ্কা। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটা অদ্ভুত সম্পৰ্ক দাঁড়াইয়াছে তাহাদের। সংসার শ্যামার, ছেলেমেয়ে শ্যামার–ওর মধ্যে। শীতলের স্থান নাই, নিজের গৃহে নিজের সংসারের সঙ্গে শীতলের সম্পর্ক শ্যামার মধ্যস্থতায়, গৃহে শীতল শ্যামার আড়ালে পড়িয়া থাকে, স্বাধীনতাবিহীন স্বাতন্ত্রবিহীন জড় পদার্থের মতো। একদিন শীতল মদ খাইত, শ্যামাকে মারিত, কিন্তু শীতল ছাড়া শ্যামার তখন কেহ ছিল না। আজ শীতলের মদ খাইতে ভালো লাগে না, শ্যামাকে মারা দূরে থাক ধমক দিতেও তাহার ভয় করে। শ্যামা আজ কত উঁচুতে উঠিয়া গিয়াছে। কোনো দিকে কোনো বিষয়ে খুঁত নাই শ্যামার, সেবায়-যত্নে, বুদ্ধি, বিবেচনায়, ত্যাগে-কর্তব্য পালনে সে কলের মতো নিখুঁত–শ্যামার সঙ্গে তুলনা করিয়া সব সময় শীতলের যেন নিজেকে ছোটলোক বলিয়া মনে হয়, এবং সে যে অপদাৰ্থ ছিটগ্রস্ত মানুষ, এ তো জানে সকলেই, অন্তত শ্যামা জানে, শীতলের তাহাতে সন্দেহ নাই। সব সময় শীতলের মনে হয়, শ্যামা মনে মনে তাহার সমালোচনা করিতেছে, তাহাকে ছোট ভাবিতেছে, ঘৃণা করিতেছেকেবল মাস গেলে সে টাকা আনিয়া দেয় বলিয়া মনের ভাব রাখিয়াছে চাপিয়া, বাহিরে প্রকাশ করিতেছে না। বাহিরের জীবনে বিতৃষ্ণা আসিয়া শীতলের মন নীড়ের দিকে ফিরিয়াছিল, চাহিয়াছিল শ্যামাকে কিন্তু সাত বৎসরের বন্ধ্যাজীবন যাপিনী লাঞ্ছিতা পত্নী যখন জননী হয়, তখন কে কবে তাহাকে ফিরিয়া পাইয়াছে? বৌয়ের বয়স যখন কাঁচা থাকে, তখন তাহার সহিত না মিলিলে আর তো মিলন হয় না। মন পাকিবার পর কোনো নারীর হয় না নূতন বন্ধু, নূতন প্রেমিক। দুঃখ মুছিয়া লইবার, আনন্দ দিবার, শান্তি আনিবার ভার শ্যামাকে শীতল কোনোদিন দেয় নাই, শীতলের মনে দুঃখ নিরানন্দ ও অশান্তি আছে কিনা শ্যামা তাহা বুঝিতেও জানে না। শীতল ছিল রুক্ষ উদ্ধত কঠোর, শ্যামাকে সে কবে জানিতে দিয়াছিল যে, তার মধ্যেও এমন কোমল একটা অংশ আছে, যেখানে প্রত্যহ প্রেম ও সহানুভূতির প্রলেপ না পড়িলে যন্ত্রণা হয়? শ্যামা জানে, ওসব প্রয়োজন শীতলের নাই, ওসব শীতল বোঝেও না। তাই ছেলেমেয়েদের লইয়া নিজের জন্য যে জীবন শ্যামা রচনা করিয়াছে, তার মধ্যে শীতল আশ্রয়ের মতো, জীবিকার উপায়ের মতো তুচ্ছ একটা পাৰ্থিব প্রয়োজন মাত্র। আপনার প্রতিভায় সৃজিত সংসারে শ্যামা ড়ুবিয়া গিয়াছে। শীতল সেখানে ঢুকিবার রাস্তা না খুঁজিলেই সে বাঁচে।
মামা বলে, শীতলের ভাব যেন কেমন কেমন দেখি শ্যামা?
শ্যামা বলে, ওমনি মানুষ মামা–ওমনি গা-ছাড়া গা-ছাড়া ভাব। কি এল, কি গেল, কোথায় কি হচ্ছে, কিছু তাকিয়ে দেখে না, খেয়াল নিয়েই আছে নিজের। ভগ্নীপতি চাইলে, দিয়ে দিলে তাকে হাজারখানেক টাকা ধার করে–না একবার জিজ্ঞেস করা, না একটা পরামর্শ চাওয়া! তাও মেনে নিলাম মামা, ভাবলাম, দিয়ে যখন ফেলেছে আর তো উপায় নেই যে মানুষ। ওর ভগ্নীপতি ও টাকা ফিরে পাওয়ার আশা নিমাই!–কি আর হবে? এই সব ভেবে জমানো যে কটা টাকা ছিল, কি কষ্টে যে টাকা কটা জমিয়েছিলাম মামা, ভাবলে গা এলিয়ে আসে–দিলাম একদিন সবগুলি টাকা হাতে তুলে, বললাম, যাও ধার শুধে এস, ঋণী হয়ে থেকে কেন ভেবে ভেবে গায়ের রক্ত জল করা? টাকা নিয়ে সেই যে গেল, ফিরে এল সাদ্দিন পরে। ধারের মনে ধার রইল, টাকাগুলো দিয়ে বাবু সাদ্দিন ফুর্তি করে এলেন। সেই থেকে কেমন যেন দমে গেছি মামা, কোনোদিকে উৎসাহ পাই নে। ভাবি, এই মানুষকে নিয়ে তো সংসার, এত যে করি আমি, কি দাম তার, কেন মিথ্যে মরছি খেটে খেটে–সুখ কোথা অদেষ্টে?
মামা সান্ত্বনা দিয়া বলে, পুরুষমানুষ অমন একটু আধটু করে শ্যামা–নিজেই আবার সব ঠিক করে আনে। আনছে তো বাবু রোজগার করে, বসে তো নেই।
শ্যামা বলে, আমি আছি বলে, আর কেউ হলে এ সংসার কবে ভেসে যেত মামা।
মামা একদিন কোথা হইতে শ্যামাকে কুড়িটি টাকা আনিয়া দেয়। শ্যামা বলে, একি মামা?
মামা বলে, রাখ না, রাখ–খরচ করিস। টাকাটা পেলাম, আমি আর কি করব ও দিয়ে?
সত্যই তো, টাকা দিয়া মামা কি করিবে? শ্যামা সুখী হইল। মামা যদি মাঝে মাঝে এরকম দশ-বিশটা আনিয়া দেয়, তবে মন্দ হয় না। মামাকে শ্যামা ভক্তি করে, কাছে রাখিয়া শেষ বয়সে তাহার সেবাযত্ন করার ইচ্ছাটাও আন্তরিক। তবে, তাহার কিনা টানাটানির সংসার, ইট-সুরকি কিনিয়া রাখিয়া টাকার অভাবে সে কিনা দোতলায় ঘর তোলা আরম্ভ করিতে পারে নাই, মেয়ে কিনা তাহার বড় হইতেছে, টাকার কথাটা সে তাই আগে ভাবে। কি করিবে সে? তার তো জমিদারি নাই। মামা থাক, হাজার দশ হাজার যদি নাই পাওয়া যায়, মামার জন্য যে বাড়তি খরচ হইবে, অন্তত সেটা আসুক, শ্যামা আর কিছু চায় না।
দিন পনের পরে মামা একদিন বর্ধমানে গেল, সেখানে তার পরিচিত কোন সাধুর আশ্রম আছে, তার সঙ্গে দেখা করিবে। বলিয়া গেল, দিন তিনেক পরে ফিরিয়া আসিবে। শ্যামা ভাবিল, মামা বোধহয় আর ফিরিয়া আসিবে না, এমনিভাবে ফাঁকি দিয়া বিদায় লইয়াছে। শীতল ক্ষুণ্ণ হইল সবচেয়ে বেশি। বন্ধনহীন নির্বান্ধব ভ্ৰাম্যমাণ লোকটির প্রতি সে প্রবল একটা আকর্ষণ অনুভব করিতেছিল। মামা যখন যায়, শীতল বাড়ি ছিল না। মামা চলিয়া গিয়াছে শুনিয়া সে বার বার বলিতে লাগিল, কেন যেতে দিলে? তোমার ঘটে একফোঁটা বুদ্ধি নেই, মামার স্বভাব জান ভালো করে, আটকাতে পারলে না? বোকা হাঁদারাম তুমি–মুখ্যুর একশেষ!
কচি খোকা নাকি ধরে রাখব?
ধরে আবার রাখতে হয় নাকি মানুষকে? কি বলেছ কি করেছ তুমিই জান, যা ছোট মন। তোমার, আত্মীয়স্বজন দুদিন এসে থাকলে খরচের ভয়ে মাথায় তোমার টনক নড়ে যায়–ছেলেমেয়ে ছাড়া জগতে যেন পোষ্য থাকে না মানুষের। ছেলে–তোমার কি করে দেখ, তোমার কাছেই তো সব শিখছে, তোমার কপালে ঢের দুঃখ আছে।
পাগল হলে নাকি তুমি? কি বকছ?
শীতল যেন কেমন করিয়া শ্যামার দিকে তাকায়। খুব রাগিলে আগে যেমন করিয়া তাকাইত সে রকম নয়। পাগল আমি হই নি শ্যামা, হয়েছ তুমি। ছেলে ছেলে করে তুমি এমন হয়ে গেছ, তোমার সঙ্গে মানুষে বাস করতে পারে না–ছেলে না কচু, সব তোমার টাকার খাকতি, কি করে বড়লোক হবে, দিনরাত শুধু তাই ভাবছ, কারো দিকে তাকাবার তোমার সময় নেই। জন্তুর মতো হয়েছ তুমি, তোমার সঙ্গে একদণ্ড কথা কইলে মানুষের ঘেন্না জন্মে যায় এমনি বিশ্রী স্বভাব হয়েছে। তোমার, লোকে মরুক, বাঁচুক, তোমার কি? সময়ে মানুষ টাকা-পয়সার কথা ভাবে আবার সময়ে দশজনের দিকে তাকায়, তোমার তা নেই, আমি বুঝি নে কিছু টাকার কথা ছাড়া এক মিনিট আমার সঙ্গে অন্য কথা কইতে তোমার গায়ে জ্বর আসে, মন খুলে স্বামীর সঙ্গে মেশার স্বভাব পর্যন্ত তোমার ঘুচে গেছে, বসে বসে খালি মতলব আঁটছ কি করে টাকা জমাবে, বাড়ি তুলবে, টাকার গদিতে শুয়ে থাকবে : বাজারের বেশ্যা মাগীগুলো তোমার চেয়ে ভালো, তারা হাসিখুশি, ফুর্তি করতে জানে : রক্তমাংসের মানুষ তুমি নও, লোভ করার যন্তর!
বাস্ রে! শীতল এমন করিয়া বলতে পারে? সমালোচনা করার পাগলামি এবার তাহার আসিয়াছে নাকি? এসব সে বলিতেছে কি? শ্যামার সঙ্গে মানুষ বাস করিতে পারে না? মানুষের সঙ্গে অনুভূতির আদান-প্রদান সে ভুলিয়া গিয়াছে একেবারে তুলিয়া গিয়াছে?
সে জন্তু, যন্ত্র, বেশ্যার চেয়ে অধম? কেন, টাকা-পয়সা বাড়িঘর সে নিজের জন্য চায় নাকি! শীতল দেখিতে পায় না নিজে সে কত কষ্ট করিয়া থাকে, ভালো কাপড়টি পরে না, ভালো জিনিসটি খায় না? শ্যামা শীতলকে এই সব বলে, বুঝাইয়া বলে।
শীতল বলে, ভালো ভাবে পরবে কি, মানুষ ভালো খায় ভালো পরে–ভালো মানুষ। তুমি। তো টাকা জমানো ফন্তর!
ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হয়।–শ্যামা বলে।
শীতল বলে, তাই তো বলছি, টাকা আর ভবিষ্যৎ হয়েছে তোমার সব, ভবিষ্যৎ করে করে জন্ম কেটে গেল, অত ভবিষ্যৎ কারো সয় না। ভবিষ্যতের ভাবনা মানুষের থাকে, অল্পবিস্তর থাকে, তোমার ও ছাড়া কিছু নেই, ওই তোমার সর্বস্ব, বড় বেখাপ্পা মানুষ তুমি, মহাপাপী!
শোন একবার শীতলের কথা! কিসে মহাপাপী শ্যামা? কোন দিন চোখ খুলিয়া পুরুষের দিকে চাহিয়াছে? অসৎ চিন্তা করিয়াছে? দেবদ্বিজে ভক্তি রাখে নাই? শ্যামা আহত, উত্তেজিত ও বিস্মিত হইয়া থাকে। শীতল তাহাকে বকে? যার সংসার সে মাথায় করিয়া রাখিয়াছে? যার ছেলেমেয়ের সেবা করিয়া তাহার হাতে কড়া পড়িয়া গেল, মেরুদণ্ড বাকিয়া গেল ভারবহা বাঁকের মতো? ধন্য সংসার! ধন্য মানুষের কৃতজ্ঞতা!
মামা কিন্তু ফিরিয়া আসিল, সাতদিন পরে।
সাতদিন পরে মামা ফিরিয়া আসিল, আরো দিনদশেক পরে শ্যামা দোতলায় ঘর তোলা আরম্ভ করিল, বলিল, জান মামা, উনি বলেন, আমি নাকি কেপ্লনের একশেষ, নিজে তো ডাইনে-বায়ে টাকা ছড়ায়, আমি মরে বেঁচে কটা টাকা রেখেছি বলে না ঘরখানা উঠেছে? সংসারে ওনার মন নেই, উড়ু উড়ু কচ্ছেন। আমিও যদি তেমনি হই সব ভেসে যাবে না, ছারখার হয়ে যাবে না? টাকা রাখব আমি, ইট-সুরকি কিনব আমি, মিস্ত্রি ডাকব আমি, তারপর ঘর হলে শোবেন কে? উনি তো? আমি তাই জন্তু জানোয়ার, যন্তর? কথা কই সাধে? কইতে ঘেন্না হয়।
মামা বলিল, সেকি মা, কথা বলিসনে কি?।
শ্যামা বলিল, বলি, দরকার মতো বলি। পঁয়ত্রিশ বছর বয়স হল আজেবাজে কথা আর মুখে আসে না, দোষ বল দোষ, গুণ বল গুণ, যা পারি নি তা পারিই নে।
ঘর তুলিবার হিড়িকে শ্যামা, আমাদের ছেলে-পাগলা শ্যামা, ছেলেমেয়েদের যেন ভুলিয়া গিয়াছে। কত আর পারে মানুষ? সংসারে উদয়াস্ত খাটিয়া আগেই তাহার অবসর থাকিত না, এখন মিস্ত্রির কাজ দেখিতে হয়, এটা-ওটা আনাইয়া দিতে হয়, ঘর তোলার হাঙ্গামা কি কম! শ্যামা পারেও বটে! এক হাতে ছোট ছেলেটাকে বুকের কাছে ধরিয়া রাখে, সে ঝুলিতে ঝুলিতে প্রাণপণে স্তন চোষে, শ্যামা সেই অবস্থাতে চরকির মতো ঘুরিয়া বেড়ায়, ভাতের হাঁড়ি নামায়, তরকারি চড়ায়, ছাদে গিয়া মিস্ত্রির দেয়াল গাঁথা দেখিয়া আসে, ভাঙা কড়াইয়ে করিয়া চুন নেওয়ার সময় উঠানে এক খাবলা ফেলিয়া দেওয়ার জন্য কুলিকে বকে, শীতলকে আপিসের ও বিধানকে স্কুলের ভাত দেয়, মাসকাবারি কয়লা আসিলে আড়তদারের বিলে নাম সই করে, খরচের হিসাব দেখে, ছোট খোকার কথা কাচে (রানী এ কাজটা করে না, তার বয়স অল্প এবং সে একটু শৌখিন), আবার মামার সঙ্গে, প্রতিবেশী নতুবাবুর স্ত্রীর সঙ্গে গল্পও করে। চোখের দিকে তাকাও, বাৎসল্য নাই, স্নেহ-মমতা নাই, শ্ৰান্তি নাই কিছুই নাই! শ্যামা সত্যই যন্ত্র নাকি?
মামা বলে, খেটে খেটে মরবি নাকি শ্যামা? যা যা তুই যা, মিস্ত্রির কাজ আমি দেখবখন।।
শ্যামা বলে, না মামা, তুমি বুড়ো মানুষ, তোমার কেন এসব ঝঞাট পোষাবে? যা সব বজ্জাত মিস্ত্ৰি, বজ্ঞাতি করে মালমসলা নষ্ট করবে, তুমি ওদের সঙ্গে পারবে কেন? তাছাড়া নিজের চোখে না দেখে আমার স্বস্তি নেই কাজ কতদূর এগুল, ঘর তোলার সাধ কি আমার আজকের! তুমি ঘরে গিয়ে বোসসা মামা, পিঠে কোথায় ব্যথা বলছিলে না? রানী বরং একটু তেল মালিশ করে দিক।
শীতল কোনোদিকে নজর দেয় না, কেবল সে যে পুরুষমানুষ এবং বাড়ির কর্তা, এটুকু দেখাইবার জন্য বলা নাই কওয়া নাই মাঝে মাঝে কর্তৃত্ব ফলাইতে যায়। গম্ভীর মুখে বলে, এখানে জানালা হবে বুঝি, দেয়ালের যেখানে ফাঁক রাখছ?
মিস্ত্রিরা মুখ টিপিয়া হাসে। শ্যামা বলে, জানালা হবে না তো কি দেয়ালে ফাঁক থাকবে?
তাই বলছি শীতল বলে–জানালা হবে কটা? তিনটে মোটে? না না, তিনটে জানালায় আলো বাতাস খেলবে না ভালো–ওহে মিস্ত্রি এইখানে আরেকটা জানালা ফুটিয়ে দাও–এদিকে একটাও জানালা কর নি দেখছি।
শ্যামা বলে, ওদিকে জানালা হবে না, ওদিকে নকুবাবুর বাড়ি দেখছ না? আর বছর ওরাও দোতলায় ঘর তুলবে, আমাদের ঘেঁষে ওদের দেয়াল উঠবে, জানালা দিয়ে তখন করবে কি? জান না, বোঝ না, ফোপরদালালি কোরো না বাবু তুমি।
শীতল অপমান বোধ করে, কিন্তু যেন অপমান বোেধ করে নাই এমনিভাবে বলে, তা কে জানে ওরা আবার ঘর তুলবে!–হাঁ হাঁ, ওখানে আস্ত ইট দিও না মিস্ত্রি–দেখছ না বসছে না, কতখানি ফাঁক রয়ে গেল ভেতরে? দুখানা আদ্ধেক ইট দাও, মাঝখানে একটা সিকি ইট দাও।
মিস্ত্রিরা কথা বলে না, মাঝখানের ফাঁকটাতে কয়েকটা ইটের কুচি দিয়া মসলা ঢলিয়া দেয়, শীতল আড়চোখে চাহিয়া দেখে শ্যামা স্তুর চোখে চাহিয়া আছে! শীতল এদিক-ওদিক তাকায়, হঠাৎ শ্যামার দিকে চাহিয়া একটু হাসে, পরক্ষণে গম্ভীর হইয়া নিচে নামিয়া আসে। দাঁড়াইয়া বিধানের একটু পড়া দেখে, পড়িবার জন্য ছেলেকে শ্যামা গত বৈশাখ মাসে নূতন টেবিল চেয়ার কিনিয়া দিয়াছে, পড়া দেখিতে দেখিতে শীতল টের পায় শ্যামা ঘরে আসিয়াছে। তখন সে বিধানের বইয়ের পাতায় একস্থানে আঙুল দিয়া বলে: এখানটা ভালো করে বুঝে পড়িস খোকা, পরীক্ষায় মাঝে মাঝে দেয়। তারপর বিধান জিজ্ঞাসা করে, Circumlocutory মানে কি বাবা? শীতল বলে, দেখ না দেখ মানে বই দেখ। বিধান তখন খিলখিল করিয়া হাসে। শ্যামা বলে: পড়ার সময় কেন ওকে বিরক্ত করছ বল তো?
শীতল বলে, হাসলি যে খোকা?–শীতলের মুখ মেঘের মতো অন্ধকার হইয়া আসে–বাপের সঙ্গে ইয়ার্কি হচ্ছে? হারামজাদা ছেলে কোথাকার! বলিয়া ছেলেকে সে আথালিপাথালি মারিতে আরম্ভ করে। বিধান চেঁচায়, বুকু চেঁচায়, বাড়িতে একেবারে হৈচৈ বাধিয়া যায়। শ্যামা দুই হাতে বিধানকে বুকের মধ্যে আড়াল করে, শীতল গায়ের ঝাল ঝাড়িতেই শ্যামার গায়ে দুচারটা মার বসাইয়া দেয় অথবা সেগুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হইয়া শ্যামার গায়ে লাগে বুঝিবার উপায় থাকে না। শ্যামা তো আজ গৃহিণী, মোটাসোটা রাজরানীর মতো তাহার চেহারা, শীতল কি এখন তাহাকে ইচ্ছা করিয়া মারিবে?
এমনিভাবে দিন যায়, ঠাণ্ডায় শীতের দিনগুলি হ্রস্ব হইয়া আসে। মামা সেই যে একবার শ্যামাকে কুড়িটি টাকা দিয়াছিল আজ পর্যন্ত সে আর একটি পয়সাও আনিয়া দেয় নাই, শ্যামা তবু শীতলের চেয়ে মামাকেই খাতির করে বেশি : মামার সঙ্গে শ্যামার বনে, শ্যামার ছেলেদের মামা। বড় ভালবাসে, শীতলের চেয়েও বুঝি বেশি। নিজের বাড়িতে শীতল কেমন পরের মতো থাকে, যে সব খাপছাড়া তাঁহার কাণ্ড, কে তাহার সঙ্গে আত্মীয়তা করিবে? শীতলকে ভালবাসে শুধু বকুল। মেয়েটার মন বড় বিচিত্র, যা কিছু খাপছাড়া, যা কিছু অসাধারণ তাই সে ভালবাসে! শীতলও বোধহয় খোড়া কুকুর, নোম-ওঠা ঘা-ওলা বিড়াল, ভাঙা পুতুল এই সবের পর্যায়ে পড়ে, বকুল তাই শ্যামার ভাষায় বাবা বলিতে অজ্ঞান। ছেলেবেলা হইতে বকুলের স্বাস্থ্যটি বড় ভালো, চলাফেরা হাসি খেলা স্বাভাবিক নিয়মে সবই তার সুন্দর, কত প্ৰাণ, কত ভঙ্গি। সকলে তাকে ভালবাসে, তার সঙ্গে কথা বলিতে সকলেই উৎসুক, সে কিন্তু যাকে তাকে ধরা দেয় না, নির্মমভাবে উপেক্ষা করিয়া চলে। খেলনা ও খাবার দিয়া, তোষামোদের কথা বলিয়া তাহাকে জয় করা যায় না। মামা কত চেষ্টা করিয়াছে, পারে নাই। শ্যামার তিন ছেলেই মামার ভক্ত, বকুল কিন্তু তাহার ধারেকাছেও ঘেঁষে না। শ্যামার সঙ্গেও বকুলের তেমন ভাব নাই, শ্যামাকে সে স্পষ্টই অবহেলা করে। বাড়িতে সে ভালবাসে শুধু বাবাকে, শীতল যতক্ষণ বাড়ি থাকে, পায়ে পায়ে ঘুরিয়া বেড়ায়, শীতলের চুল তোলে, ঘামাচি মারে, মুখে বিড়ি দিয়া দেশলাই ধরাইয়া দেয়, আর অনর্গল কথা বলে। শীতল বাড়ি না থাকিলে, ছাদে গিয়া তাহার গোসাঘরে পুতুল খেলে, মিস্ত্রিদের কাজ দেখে, আর শ্যামার ফরমাশ খাটে। শীতল না থাকিলে মেয়েটার মুখের কথা যেন ফুরাইয়া যায়।
একদিন শ্যামা নূতন গুড়ের পায়েস করিয়াছে, সকলে পরিতোষ করিয়া খাইল, বকুল কিছুতে খাইবে না, কেবলি বলিতে লাগিল, দাঁড়াও, বাবা আসুক, বাবাকে দাও?
শ্যামা বলিল, সে তো আসবে রাত্তিরে, ওই দ্যাখ বড় জামবাটিতে তার জন্যে তুলে রেখেছি, এসে খাবে। তোরটা তুই খা!
বকুল বলিল, বাবা পায়েস খেতে আসবে দুটোর সময়।
শ্যামা বলিল, কি করে জানলি তুই আসবে?
বকুল বলিল, আমি বললাম যে আসতে? বাবা বললে দুটোর সময় ঠিক আসবে, আমি বাবার সঙ্গে খাব।
শ্যামা বলিল, দেখলে মামা মেয়ের আব্দার? বুড়ো ভেঁকি মেয়ে বাবাকে পায়েস খাবার নেমন্তন্ন করেছেন, আপিস থেকে তিনি পায়েস খেতে বাড়ি আসবেন।…খা বুকু খেয়ে বাটি খালি করে দে। তিনি যখন আসবেন খাবেন তখন, তুই বরং আদর করে খাইয়ে দিস, এখন নিজে খেয়ে আমায় রেহাই দে তো।
বকুল কিছুতে খাইবে না, শ্যামারও জিদ চাপিয়া গেল, সেও খাওয়াবেই। পিঠে জোরে দুটো চড় মারিয়া কোনো ফল হইল না, বকুল একটু কাঁদিল না পর্যন্ত। আরো জোরে মারিলে কি হইত বলা যায় না, কিন্তু যতই হোক শ্যামার তো মায়ের মন, কতবার কত জোরে আর মায়ের মন লইয়া মেয়েকে মারা যায়? এক খাব পায়েস তুলিয়া শ্যামা মেয়ের মুখে গুঁজিয়া দিতে গেল, বকুল দাঁত কামড়াইয়া রহিল, তার মুখ শুধু মাখা হইয়া গেল পায়েসে।
হার মানিয়া শ্যামা অভিমানাহত কণ্ঠে বলিল, উঃ, কি জিদ মেয়ের। কিছুতে পারলাম না। খাওয়াতে?
দুটোর আগে শীতল সত্য সত্যই ফিরিয়া আসিল। শ্যামা আসন পাতিয়া গেলাসে জল ভরিয়া দিল। ভাবিল শীতল খাইতে বসিলে সবিস্তারে বকুলের জিদের গল্প করিবে। কিন্তু ঘরের মধ্যে বাপ-বেটিতে কি পরামর্শই যে দুজনে তাহারা করিল, খানিক পরে মেয়ের হাত ধরিয়া শীতল বাড়ির বাহির হইয়া গেল। যাওয়ার আগে শ্যামার সঙ্গে তাহাদের যে কথা হইল, তাহা এই—
শ্যামা বলিল, কোথায় যাচ্ছ শুনি?
শীতল বলিল, চুলোয়।
শ্যামা বলিল, পায়েস খেয়ে যাও।
বকুল বলিল, তোমার পায়েস আমরা খাই নে।
শ্যামা বলিল, দ্যাখ ভালো করছ না কিন্তু তুমি। আদর দিয়ে দিয়ে তোমার মেয়ের তো মাথা খেলে।
এর জবাবে শীতল বা বকুল কেহই কিছু বলিল না। পা দিয়া পায়েসের বাটি উঠানে ছুড়িয়া দিয়া শ্যামা ফেলিল কাঁদিয়া।
রাত প্রায় নটার সময় দুজনে ফিরিয়া আসিল। বকুলের গায়ে নতুন জামা পরনে নতুন কাপড়, দুহাত বোঝই খেলনা, আনন্দে বকুল প্রায় পাগল। আজ কিছুক্ষণের জন্য সকলের সঙ্গেই সে ভাব। করিল, শ্যামার অপরাধও মনে রাখিল না, মহোৎসাহে সকলকে সে তাহার সম্পত্তি দেখাইল, বাবার সঙ্গে কোথায় কোথায় গিয়াছিল গল গল করিয়া বলিয়া গেল!
শীতল উৎসাহ দিয়া বলিল, কি খেয়েছিস বললি না বুকু?
পরদিন রাত্রে প্রেস হইতে ফিরিয়া বকুলকে শীতল দেখিতে পাইল না। শ্যামা বলিল, মামার সঙ্গে সে বনগাঁয়ে পিসির কাছে বেড়াইতে গিয়াছে।
আমায় না বলে পাঠালে কেন?
বললে কি আর তুমি যেতে দিতে? যাবার জন্য কাঁদাকাটা করতে লাগল, তাই পাঠিয়ে দিলাম।
হঠাৎ বনগাঁ যাবার জন্য ও কাঁদাকাটা করল কেন?
কাল-পরশু ফিরে আসবে।
ঝোঁকের মাথায় কাজটা করিয়া ফেলিয়া শ্যামার বড় ভয় আর অনুতাপ হইতেছিল, সে আবার বলিল, পাঠিয়ে অন্যায় করেছি। আর করব না।
শীতলের কাছে ত্রুটি স্বীকার করিতে আজকাল শ্যামার এমন বাঁধ বাঁধ ঠেকে। নিজে চারিদিকে সব ব্যবস্থা করিয়া করিয়া স্বভাবটা কেমন বিগড়াইয়া গিয়াছে, কোনো বিষয়ে কারো কাছে যেন আর নত হওয়া যায় না। আর বকুলকে এমনভাবে হঠাৎ বনগাঁয়ে পাঠাইয়াও দিয়াছে। তো এই কারণে, মেয়ের উপর অধিকার জাহির করিতে। কাজটা যে বাড়াবাড়ি হইয়া গিয়াছে, ওরা রওনা হইয়া যাওয়ার পরেই শ্যামার তাহা খেয়াল হইয়াছে।
শীতল কিন্তু আজ চেঁচামেচি গালাগালি করিল না, করিলে ভালো হইত, ছড়ি দিয়া শ্যামাকে অমন করিয়া হয়তো সে তাহা হইলে মারিত না। মাথায় ছিটওলা মানুষ, যখন যা করে একেবারে চরম করিয়া ছাড়ে। শ্যামার গায়ে ছড়ির দাগ কাটিয়া কাটিয়া বসিয়া গেল।
মারিয়া শীতল বলিল, বজ্জাত মাগী, তোকে আমি কী শাস্তি দিই দেখ্। এই গেল এক নম্বর। দুনম্বর শাস্তি তুই জন্মে ভুলবি না।
শাস্তি? আবার কি শাস্তি শীতল তাহাকে দিবে? তাহার স্বামী।
বিবাহের পরেই শ্যামা টের পাইয়াছিল শীতলের মাথায় ছিট আছে। পাগলের কাণ্ডকারখানা কিছু বুঝিবার উপায় নাই। পরদিন দশটার সময় নিয়মিতভাবে স্নানাহার শেষ করিয়া শীতল আপিসে গেল। বারটা-একটার সময় ফিরিয়া আসিল।
শ্যামাকে আড়ালে ডাকিয়া তাহার হাতে দিল একতাড়া নোট। শ্যামা শুনিয়া দেখিল, এক হাজার টাকা। এ কেমন শাস্তি? শীতল কি করিয়াছে, কি করিতে চায়?
এ কিসের টাকা? শ্যামা রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞাসা করিল।
শীতল বলিল, বাবু বোনাস দিয়েছেন। পরশু লাভের হিসাব হল কিনা, ঢের টাকা লাভ হয়েছে এ বছর, আমার জন্যেই তো সব? তাই আমাকে এটা বোনাস দিয়েছেন।
এত টাকা। হাজার। আনন্দে শ্যামার নাচিতে ইচ্ছা হইতেছিল। সে বলিল, বাবু তো লোক বড় ভালো?–হ্যাঁগো কাল বড় রেগেছিলে না? বড় মেরেছিলে বাবু কাল পাষাণের মতো। ভাগ্যে কেউ টের পায় নি, নইলে কি ভাবত? আপিস যাবে নাকি আবার?
যাই, কাজ পড়ে আছে। সাবধানে রেখ টাকা।
এই বলিয়া সেই যে শীতল গেল, আর আসিল না। কিছুদিন পরে মামা বনগাঁ হইতে একা ফিরিয়া আসিল।
বুকু কই মামা?– শ্যামা জিজ্ঞাসা করিল।
মামা বলিল, কেন, শীতলের সঙ্গে আসে নি? শীতল যে তাকে নিয়ে এল?
তখন সমস্ত বুঝিতে পারিয়া শ্যামা কপাল চাপড়াইয়া বলিল, আমার সর্বনাশ হয়েছে মামা।
কে জানিত পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে চারটি সন্তানের জননী শ্যামার জীবনে এমন নাটকীয় ব্যাপার ঘটিবে?