০৪. মানুষ কি বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন হতে পারে?

মানুষ কি বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন হতে পারে?

আমি নিজেকে একজন বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে ভাবতে অভ্যস্ত এবং আমি চাই সব মানুষই বিচার বুদ্ধির অধিকারী হোক। বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন সকল ব্যক্তিই স্বভাবতঃ এরূপ কামনা করবেন। এ যুগে বিচারবুদ্ধি নানাভাবে মার খেয়েছে বলে এর স্বরূপ জানতে পারলেও মানব-সাধারণ তা আয়ত্ব করতে পারে কিনা? বিচারবুদ্ধির দুটো দিক; ভাগ্যগত এবং বাস্তব। কিন্তু বিচারবুদ্ধিসম্মত মতামত এবং আচরণ বলতে কী বোঝায়? প্রয়োগবাদ (Pragmatisom) মতামতের অযৌক্তিকতার ওপর প্রাধান্য দিয়ে থাকে উভয়দিকের অনেকে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। মতামত এবং আচরণকে একসঙ্গে ধরে রাখার এত আদর্শ বিচারবুদ্ধির কোন মাপকাঠি নেই। ধরুন আমি আর আপনি দুজন যদি দু মতের সমর্থনে ঝগড়া করতে থাকি তাহলে যুক্তি অথবা তৃতীয় ব্যক্তির সালিশীর মাধ্যমে সমাধান করার কথা অর্থহীন, গলাবাজি বিজ্ঞাপন এমনকি আমাদের অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তি অনুসারে শেষপর্যন্ত যুদ্ধের মাধ্যমে নির্ধারণ করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। আমার মতে এ-ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি খুবই ক্ষতিকর এবং শেষপর্যন্ত সভ্যতার পক্ষে মারাত্মক হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং আমি দেখাতে চেষ্টা করব, যে সব ধারণাকে বিচারবুদ্ধিবিরুদ্ধ বলে গণ্য করা হতো, তাও বিচারবুদ্ধিকে খর্ব করতে পারে না, পূর্বের মতো জীবন এবং চিন্তার একমাত্র পথনির্দেশক হিসেবে বিচারবুদ্ধিই থাকে ক্রিয়াশীল।

মতামতের খাতিরে বলতে হলে বিচারবুদ্ধির সজ্ঞায়ন করার ব্যাপারে সত্যে উপনীত হওয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় প্রমাণপঞ্জীর সাহায্য গ্রহণ করা উচিত। যেখানে নিশ্চিত করে কিছু বলা সম্ভব নয়, সেখানে একজন বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ সর্বাধিক সম্ভাব্য মতামতের উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান করেন এবং কম সম্ভাবনাসম্পন্ন মতামতগুলোকে মনে মনে রেখে দেন, উপযুক্ত প্রমাণের সাহায্যে সেগুলোও সম্ভাবনাময় হয়ে উঠতে পারে। বস্তুনিরপেক্ষ পদ্ধতিতে ঘটনার এবং ঘটনার সম্ভাব্যতা নির্ধারণ করা হয়। বস্তুনিরপেক্ষ পদ্ধতি অনুসারে দুজন মানুষ সতর্কভাবে এগুলো একই সিদ্ধান্তে আসতে পারে; কিন্তু অনেক সময় তাতে সন্দেহ পোষণ করা হয়। অনেকের মতে ব্যক্তির আকাঙ্ক্ষা এবং প্রয়োজনের সন্তুষ্টি বিধানই হলো বুদ্ধিবৃত্তির একমাত্র কাজ। ‘দ্যা প্লেবস টেক্সটবুক কমিটি, তাদের দর্শনের সীমারেখা গ্রন্থে বলেনঃ ‘সর্বোপরি বুদ্ধিবৃত্তি হলো একটি পক্ষপাতমূলক অস্ত্রবিশেষ (পৃষ্ঠা ৬৮) এর কর্ম হলো কোন ব্যক্তি অথবা শ্ৰেণীবিশেষের পক্ষে উপকারী কাজগুলোর সম্পাদন এবং অনুপকারী কাজগুলো বর্জন করা।

কিন্তু একই গ্রন্থকার একই গ্রন্থে আবার বলেছেন মার্কসবাদীদের বিশ্বাস ধর্মীয় বিশ্বাসের চেয়ে ভিন্নতর ধর্মীয় বিশ্বাস, কামনা এবং ঐতিহ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। পক্ষান্তরে মার্কসীয় বিশ্বাসে নৈর্ব্যক্তিক বস্তুবাদের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের উপর প্রতিষ্ঠিত। মার্কসীয় মতবাদ গ্রহণে বুদ্ধিবৃত্তি যদি তাদেরকে পরিচালনা না করে থাকে, তা হলে বুদ্ধিবৃত্তিসম্বন্ধে তাদের মতবাদ সামঞ্জস্যহীন। যে ভাবেই হোক, যখন তারা নৈর্ব্যক্তিক বস্তুবাদের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণকে গ্রহণ করেছেন, নৈর্ব্যক্তিক বস্তুবাদের বিচারবুদ্ধিসম্মত মতবাদকেও তারা অবশ্যই গ্রহণ করবেন।

.

প্রয়োগবাদী ও দার্শনিকদের মতো অনেক পণ্ডিত গ্রন্থকারও রয়েছেন যারা বিচারবুদ্ধিবিরুদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গিকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। তাদেরকে চেনাও খুব সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। তারা বলে থাকেন যে, সত্য হলেও আমাদের মতামতের সঙ্গে সঠিকভাবে মিলে যাওয়ার মতো কোন বস্তুবাদী সত্যের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামের অস্ত্র হিসাবে অভিহিত করবেন। এর মধ্যে যেগুলো মানুষকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে সেগুলোকেই বলা হয় সত্য। খ্রিস্টিয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে ধর্ম যখন সর্বপ্রথম জাপানে এসে পৌঁছে তখন জাপানে এই মতবাদ প্রচলিত ছিল। সরকার নতুন ধর্ম গ্রহণের আদেশ দিলেন। তিনি যদি অন্যান্যের চেয়ে অধিকতর উন্নতি করেন তাহলে সর্বজনীনভাবে নতুন ধর্ম গ্রহণ করা হবে। তারা এই মতবাদ অনুসারে (আধুনিক যুগে খাপ খাওয়ার মতো পরিবর্তন সাধন করে। বিভিন্ন ধর্মীয় মতবাদের বিভিন্নতা স্বীকার করে নিয়ে থাকেন কিন্তু তবু তাদের কাউকে অন্যান্য ধর্মের চাইতে দ্রুত উন্নতি বিধান করতে সক্ষম ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করতে আমি এ পর্যন্ত শুনি নি।

প্রয়োগবাদীদের সত্যের সংজ্ঞা যাই হোক না কেন সব সময় তারা নিতান্ত সাধারণ জীবনযাপন করে থাকেন। এমন কি বাস্তবে যতটুকু প্রয়োজন তারও চেয়ে ভয়াবহ দারিদ্রের মধ্যে দিয়ে তারা জীবন অতিবাহিত করে থাকেন। একজন প্রয়োগবাদীকেও যদি জুরিতে বসিয়ে দেয়া হয়, তিনিও অন্যান্যদের মতো প্রমাণের ওপর গুরুত্ব প্রদান করে খুনের মামলার তদন্ত করবেন। কিন্তু তার প্রচারিত মতবাদ অনুসারে বিচার করতে হলে তাকে ভেবে দেখতে হবে। জনসমষ্টির মধ্যে কাকে ফাঁসিতে লটকানো লাভজনক হবে। তার সংজ্ঞা অনুসারে জ্ঞানের আসামীর অপরাধ অন্যান্যের তুলনায় অধিকতর সত্য। এ ধরনের প্রয়োগবাদ মাঝে মাঝে ঘটে থাকে বলে আমার ভয় হয়। আমি রাশিয়া এবং আমেরিকার ফ্রেম আপ’ (frame up) এর বর্ণনা শুনেছি যা এ ধরনের বহু ভয়ের বর্ণনা দিয়েছে। এসব ব্যাপারে গোপন করবার সকল সম্ভাব্য প্রচেষ্টা করা হয় এবং তাতে বিফল হলে বিষময় ফল ফলে। এই জাতীয় গোপন করার পদ্ধতি থেকে প্রমাণিত হয় যে ফৌজদারি মামলা পরিচালনা করার সময় পুলিশও এক জাতীয় বস্তুবাদী সত্য মেনে চলে। বিজ্ঞানে যাকে সেকেলে এবং পায়ে হাঁটা বলে। এটাও সে ধরনের বস্তুবাদী সত্য ধর্মের মধ্যে যা এতদিন সমাধান অনুসন্ধান করে আসছে। তারপর মানুষ, ধর্ম ঝজুভাবে সত্য এ বিশ্বাস পরিত্যাগ করে অন্য কোন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে এর সত্যতা প্রমাণ করতে আত্ননিয়োগ করল। প্রমাণহীন কিছুর প্রতি বিশ্বাস এবং পর্যাপ্ত প্রমাণ যুক্ত কিছুকে অবিশ্বাস করা থেকে বস্তুবাদী সত্যের প্রতি অবিশ্বাসের উৎপত্তি, এটা খুব স্পষ্টভাবে দেখান যায়। নিরপেক্ষ বস্তুবাদে বিশ্বাস সবসময় চাকর নিয়োগ করার এত বিশেষ বিশেষ প্রশ্নের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করে থাকে। যদি ঘটনা অনুসারে আমাদের বিশ্বাস কোথাও সত্য প্রমাণিত হয়, তা হলে অজ্ঞেয়বাদ অনুসারে সর্বত্রই তা পরীক্ষা করা যেতে পারে। 

উপরোক্ত আলোচনা আমাদের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু অনুসারে খুবই অপর্যাপ্ত, তাতে সন্দেহ নেই। নিরপেক্ষ বস্তুবাদকে দার্শনিকেরা খুবই ঘুরালো প্যাঁচালো করে ফেলেছেন। সে জন্য আমি স্থানান্তরে খুবই সহজভাবে বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা করেছি। এক্ষণে আমি ধরে নেব কতকগুলো ঘটনার সম্ভাব্যতা সম্পর্কে ধারণা করা যায়। আমাদের বিশ্বাস অনেক সময় আসল সত্যের বিপরীত, এমনকি যখন আমরা প্রমাণের সাহায্যে কোনকিছুর সম্ভাব্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত ধারনা পোষণ করি, একই প্রমাণে তা অসম্ভবও প্রমাণিত হতে পারে। আমাদের বিশ্বাসসমূহ আমাদের কুসংস্কার, আকাঙ্খ এবং ঐতিহ্যের উপর স্থাপন করা উচিত নয়। কারণ বিশ্বাসসমূহের মধ্যেই বিচার-বুদ্ধির ভাষ্যগত অংশ নিহিত। বিষয়বস্তু অনুসারের একজন বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে হয়ত একজন বিচারক অথবা একজন বৈজ্ঞানিকের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন হতে হবে। 

.

অনেকে চিন্তা করেন, মনঃসমীক্ষা মানুষের মনের বিচিত্র ধারণা এবং উন্মত্ত বিশ্বাসের উৎপত্তির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে আমাদেরকে দেখিয়ে দেয় যে বিশ্বাসের ক্ষোত্রে বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন হওয়া অসম্ভব। মনঃসমীক্ষার প্রতি আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধাবোধ আছে এবং প্রভত উপকার করতে পারে বলেও আমি ধারণা পোষণ করি ফ্রয়েড এবং তার শিষ্যবর্গকে কিসে অনুপ্রাণিত করেছিল সে সম্পর্কে অনেকেই কোন ধারণা রাখে না। উন্মত্ত রোগের এই পদ্ধতি অনেকাংশে চিকিৎসা সম্বন্ধীয় হিস্টিরিয়া এবং অন্যান্য উন্মত্ত রোগের নিরাময়ের জন্য আবিস্কৃত। যুদ্ধকালীন সময়ে মনঃসমীক্ষা যুদ্ধের ভীতিসঞ্জাত নিউরোসিস রোগীদের আরোগ্যের ক্ষেত্রে অনেকগুণে বেশি ফলপ্রসু প্রমাণিত হয়েছে। রিভার্স-এর প্রকৃতি এবং অচেতন (Instinct and unconscious) বহুলাংশে বোমায় আহত রোগীদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ভয়ের ফলে রোগ উৎপত্তির একটা চমৎকার বিশ্লেষণ, যা সোজাসুজিভাবে দেখানো সম্ভবপর নয়। রোগীকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় অবশ ইত্যাদি করে মানসিক চিকিৎসা করা হয়; এজন্য অনেকে বুদ্ধিবৃত্তিসম্মত বলে স্বীকার করেন না। বর্তমান মুহূর্তে সে সবের সঙ্গে আমাদের কোন সংশ্রব নেই, এটা হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক বিচ্যুতি! প্রবৃত্তিগত বাধাই পাগলের মতিভ্রমের কারণ এবং তাতে খাঁটি মানসিক পদ্ধতিতে চিকিৎসা করে আরোগ্যও করে তোলা যায় এবং এই চিকিৎসার দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে পূর্বনির্ধারিত মতে এক জাতীয় আদর্শ সুস্থতার কল্পনাও করা হয়, যে অবস্থা থেকে রোগীর পরিস্থিতি ভিন্ন পথে ধাবিত হয়েছে, তাকে এই পরিবর্তনের সমকালীণ সব ঘটনা সে ভুলে যেতে চায় তাও অবগত করিয়ে পূর্বের সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়। যারা মাঝে মাঝে ভুল করে অথবা সংক্ষিপ্ত করার জন্য নির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি আখ্যা দিয়ে বিচারবুদ্ধিবিরুদ্ধ বিশ্বাসের প্রচলন দেখাবার অলস অভিযোগ করে থাকেন, মনঃসমীক্ষণ ঠিক তার বিপরীত। এর সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত সাদৃশ্যাত্মক পদ্ধতিতে যারা বদ্ধপাগল নয়, তাদেরও চিকিৎসা করা যেতে পারে, যদি তারা তাদের পাগলামির লক্ষণের সঙ্গে পরিচিত নয় এমন চিকিৎসকের কাছে স্বেচ্ছায় আত্মনিয়োগ করে। 

প্রেসিডেন্ট, কেবিনেট মন্ত্রীবৃন্দ এবং বিখ্যাত ব্যক্তিরা কোন চিকিৎসকের কাছে আত্মসমর্পণ করেন না বলে রোগমুক্তও হতে পারেন না। 

.

এতক্ষণ পর্যন্ত আমরা বিচারবুদ্ধি ভাষ্যগত অর্থ নিয়ে পর্যালোচনা করেছি। এর বাস্তব দিকটি অধিকতর কষ্টসাপেক্ষ এবং সে দিকেই আমাদের দৃষ্টি ফেরাতে হবে। বাস্তব ক্ষেত্রে মতের বিভিন্নতা দ্বিতীয়তঃ আকাক্ষার বাস্তবায়নের উপায় পরিকল্পনার বিভিন্নতা। কিন্তু দ্বিতীয় প্রকারে বিভিন্নতা শুধুমাত্র থিয়োরিতে সীমাবদ্ধ এবং বুৎপত্তিগত অর্থে বাস্তব। উদাহরণস্বরূপ কোন কর্তৃপক্ষের মতে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রথম লাইন যুদ্ধ জাহাজ দিয়ে গঠিত হওয়া উচিত। এখানে যে প্রস্তাবিত লক্ষ্য জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে কোনও রকমের মতদ্বৈততা নেই, শুধু উপায় পরিকল্পনার বিভিন্নতার বিবাদ। যে পর্যন্ত বর্তমানে অথবা ভবিষ্যতে নিশ্চিত অথবা সম্ভাব্য ঘটনাবলীর ক্ষতি করার সম্ভাবনা থাকে, সে পর্যন্ত যুক্তিকে পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পরিচালনা করা যায়। এ সমস্ত ক্ষেত্রে বিচারবুদ্ধির সঙ্গে বাস্ত বের সংযোগ থাকা সত্ত্বেও আমি ভাষ্য অথবা থিয়োরিগত অর্থেই বিচারবুদ্ধিকে ব্যবহার করেছি। 

সে যা হোক, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই পরিমণ্ডলে এমন কিছু আসবে যা জটিল কিন্তু ফলিত দিক দিয়ে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। একজন মানুষ যখন নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে কাজ করবার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে, তখন নিজেকে এই বিশ্বাসে অনুপ্রাণিত করে যে, তা করলে তার অভীষ্ট সিদ্ধি হবে, কিন্তু যখন তার কোনও লক্ষ্য থাকে না তখনও সে তার কাজের পেছনে যে বিশ্বাস তার মর্মমূল অনুসন্ধান করে দেখে না। বাস্তবে যা ঘটেছে এবং যা ঘটবার সম্ভাবনা রয়েছে সবকিছুকে সে তার চেয়ে ভিন্ন আকাঙ্খ পোষণকারী একজন যে ভাবে দেখে সে দেখে তার উল্টো। সকলেরই জানা কথা জুয়াড়িরা সবসময় বিচারবুদ্ধিরহিত বিশ্বাসে নির্ভর করে, সব সময় আশা পোষণ করে যে তারা জয়ী হবেই। রাষ্ট্রনীতিতে অংশগ্রহণকারী লোকদের স্থির ধারণা তাদের দলের নেতৃবৃন্দ বিপক্ষদলের নেতাদের এত কখন দুর্নীতি কলা-কৌশল অবলম্বন করে না। শাসকশ্রেনী বিশ্বাস করে জনগণের কল্যাণের জন্য তাদের সঙ্গে ভেড়ার পালের মতো ব্যাবহার করা উচিৎ! ধূমপায়ীরা ধূমপানের স্বপক্ষে যুক্তি প্রদান করে বলে, ধূমপানের ফলে স্নায়ুতে স্নিগ্ধতা আসে। মদ্যপায়ীদের মতে মদ রসবোধক সঞ্জীবিত করে। এ সকল কারণে সৃষ্ট একঘেঁয়েমীর ফলে ঘটনা সম্বন্ধে মানুষের মতামত মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়ে পড়ে, যা এড়িয়ে যাওয়া খুবই কঠিন।

স্নায়ুতন্ত্রের প্রক্রিয়া সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিকদের জ্ঞানগর্ব আলোচনাতেও অনেক অন্তঃস্থ প্রমাণপঞ্জীর অনেককিছু বাদ পড়ে যায়। লেখক মদ্যপায়ী অথবা মদ্য অভ্যাসের যৌক্তিকতা প্রমাণ করবেন। ধর্ম এবং রাজনীতির ক্ষেত্রেও এ জাতীয় মনোভাব অপরিহার্য। রাষ্ট্রনীতিতে যারা অংশ নেন তারা ভাবেন জনগণের কল্যাণের আকাঙ্খই তাদেরকে মতবাদ স্থির করতে অনুপ্রাণিত করেছে। কিন্তু দশবারের মধ্যে নয় বার বলে দেয়া যায় যে একজন মানুষের রাষ্ট্রনীতিতে অংশগ্রহণ তার বাস্তব জীবনধারা থেকে উদ্ভূত। এর ফলে কিছু সংখ্যক মানুষ মনে করে এবং কিছুসংখ্যক মানুষ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে এসব ব্যাপারে বস্তুনিরপেক্ষ হওয়া অসম্ভব এবং পক্ষপাতমূলক শ্রেণীসমূহের মধ্যে টাগ অব ওয়ার ছাড়া এর কোন সমাধান নেই।

.

ঠিক এইরকম ক্ষেত্রে মনঃসমীক্ষণ অত্যাধিকভাবে কার্যকর, কারণ তা মানুষের অচেতন মনে যে পক্ষপাতিত্ব বোধ আছে সে সম্বন্ধে ওয়াকেফহাল করে। অন্যেরা যেমন আমাদেরকে দেখে এই পদ্ধতিতে, ঠিক তেমনি আমরাও নিজদেরকে দেখতে পাই এবং আমাদের মতামতের কারণ বিশ্লেষণ করে জানতে পারি ওসবে যত গুরুত্ব আমরা দিয়ে থাকি আদতে তত গুরুত্বপূর্ণ নয়। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে এই পদ্ধতি ব্যাপকভাবে শিক্ষা দিলে মানুষকে বাস্তবে ঘটনা এবং প্রস্তাবিত কোন কর্মের ক্রিয়াশীলতার প্রতি অধিকতর বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন করা যায়। এসবে মানুষ যদি দ্বিমত পোষণ না করে তাহলে যে ধরনের মতদ্বৈধতার অবকাশ থাকে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে তার মীমংসা সম্ভবপর।

এরপর যে অবশিষ্টাংশটুকু বর্তমানে থেকে যাবে তার সমাধান নিখুঁত বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতিতে সম্ভব নয়। একজন মানুষের আকাঙ্ক্ষা সর্বাংশে অন্য একজন মানুষের সঙ্গে মিল খায় না। স্টক এক্সচেঞ্জের দুজন প্রতিযোগী এ ব্যাপারে সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ এক মত হলেও যতক্ষণ একে অন্যের বদৌলতে ধনী হওয়ার আকাঙ্খ। পরিত্যাগ না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের মধ্যে ঐক্যের প্রতিষ্ঠা হতে পারে না। এরকম বহু বিপত্তি এই বিশেষ স্থানে এড়িয়ে যেতে পারে। ভাবাবেগের তাগিদে মুখের আক্রোশে নাক কেটে ফোল এরকম একজন মানুষকে আমরা বিচারবুদ্ধি রহিত বলে আখ্যা দিতে পারি। সে বিচারবুদ্ধিরহিত, কেননা বর্তমান মুহূর্তের উগ্র আকাঙ্খা চরিতার্থ করার জন্য ভবিষ্যতের প্রয়োজনীয় আকাঙ্ক্ষাকে ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলে। মানুষ যদি বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন হতে পারে তা হলে বর্তমানে যা করে ভবিষ্যতে তার চেয়ে নির্ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। যদি প্রত্যেক মানুষ জ্ঞাতভাবে নিজের স্বার্থের অনুকূলে কাজ করে যায় তা হলে পৃথিবীতে যা আছে তার তুলনায় স্বর্গরাজ্য হয়ে যেত। আমি এও বলতে চাইনি যে মানুষের নিজের স্বার্থের কাজ করার চেয়ে কাজের আর কোনও মহত্ত্বর উদ্দেশ্য নেই। কিন্তু আমি মনে করি অজ্ঞাতভাবে কাজ করার চেয়ে জ্ঞাতভাবে নিজের স্বার্থের অনুকূলে কাজ করা পরার্থপরতার মতো মহত্তর। এ সুশৃঙ্খল সমাজে অন্যের স্বার্থে আপত্তি করার মতো এমন কাজ করবে কদাচিত খুব কম লোককে দেখা যায়। একজন কম বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ, অন্যের পক্ষে যা ক্ষতিকর, তা তারও ক্ষতির কারণ একথা মনে করতে পারেনা, কারণ ঘৃণা এবং প্রতিহিংসা তাকে অন্ধ করে রাখে।

যদিও আমি জ্ঞাতভাবে কাজ করাকে সর্বোচ্চ নৈতিকতা বলার ধৃষ্টতা পোষণ করি না, তবু মানুষ যদি জ্ঞাতভাবে নিজের স্বার্থের অনুকূলে কাজ করে পৃথিবীটা যা আছে তার চেয়ে অনেকগুণে ভালো হয়ে যাবে।

এ মুহূর্তে যেটা তীব্রভাবে অনুভব করছি সেটা নয়, একসঙ্গে সমস্ত প্রয়োজনীয় আকাক্ষার প্রতি দৃষ্টি রাখাকেই ফলিত বিচারবুদ্ধির সংজ্ঞা বলা যেতে পারে। বিচারবুদ্ধি অনেকটা আনুপাতিক মতামতের ওপর নির্ভর করে, এবং তা সম্পূর্ণ আয়ত্ব করা অসম্ভব। তাই বলে যখন কিছু মানুষকে পাগল বলি, তখন এটা পরিস্কার। যে কিছু সংখ্যককে অন্যান্য মানুষের চেয়ে অধিক বিচাররবুদ্ধিসম্পন্ন এ কথা বলে থাকি। আমি বিশ্বাস করি ভাষ্যগত এবং বাস্তব বিচারবুদ্ধির ফলেই পৃথিবীর প্রকৃত উন্নতি হয়েছে। পরার্থপরতার নীতি প্রচার করা আমার কাছে অর্থহীন, কারণ তা একমাত্র তাদের কাছে সক্রিয় যারা পরার্থপরতাকে জীবনের নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু বিচারবুদ্ধি সম্পর্কে প্রচার করার অর্থ ভিন্নতর, কেননা বিচারবুদ্ধির সাহায্যে আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, তা যাই হোক না কেন, বাস্তবে রূপায়ণ করতে সক্ষম হয়ে থাকি। একে অন্যের ক্ষতি করার বিভিন্ন পদ্ধতি যখন বিজ্ঞান আবিস্কার। করেছে তখন আমি বিশ্বাস করি, শিক্ষাব্যবস্থা, সংবাদপত্র, ধর্ম এক কথায় পৃথিবীর প্রধান শক্তিগুলো বিচার বুদ্ধির বিরুদ্ধে। ওসব শক্তিগুলো এমন লোকের কর্তৃত্বাধীনে যা ধর্মরাজ ডেমোগোকেও ভুলিয়ে পথ ভ্রষ্ট করে। বীরত্বের হুংকারে নয়, আত্মীয় প্রতিবেশী এবং পৃথিবীর প্রতি ব্যক্তির সুস্থ এবং নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের মধ্যেই নিহিত এর প্রতিবিধান। একমাত্র ব্যাপক বিস্তৃতিশীল বুদ্ধির কাছেই আমাদের পৃথিবী যে দূর্ভোগে ভুগছে তার নিরসন কামনা করব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *