মানুষের প্রাণের সঙ্গে প্রদীপের তুলনা কোনওদিন পুরনো হয় না।
কয়েকদিন যাবৎ মনে হচ্ছিল বেলা বুঝি সত্যি ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ আরোগ্যের পথে যাচ্ছে। হঠাৎ তার অবস্থার আবার খুবই অবনতি হয়েছে দু’দিন আগে।
।কবি সাধারণত দুপুরবেলা নিরিবিলিতে দেখতে যান মেয়েকে। কাল বিকেল পর্যন্ত ছিলেন। আজ সকাল থেকেই তাঁর মন উতলা হয়ে আছে। লেখালেখি কিংবা বিষয় কর্মে মন বসছে না কিছুতেই। একসময় তিনি বেরিয়ে পড়লেন।
বেলার বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নেমে, কয়েক পা এগিয়েই থমকে গেলেন কবি।
সদর দরজা হাট করে খোলা। বৈঠকখানায় ও বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ কিছু মানুষ, সকলেই কথা বলছে খুব নিম্ন স্বরে। কবিকে দেখে সকলেই স্তব্ধ হয়ে গেল।
কবির পা মাটিতে গেঁথে গেল, স্থির মূর্তিবৎ তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন একটুক্ষণ। তিনি বুঝে গেছেন, বেলা আর নেই।
শোকের বাড়ির কোনও চিহ্ন লাগে না, বাতাসে গন্ধ পাওয়া যায়। হয়তো ফুলের গন্ধ, তবু সে গন্ধ অন্যরকম। অন্যদিনও হয়তো এ সময় দরজা খোলা থাকে, আজকের দরজা বড় বেশি ভোলা। হয়তো অন্যদিনও এই মানুষেরা আসে, কিন্তু আজ তারা অন্য মানুষ।
কবি আর ওপরে উঠলেন না। মৃত কন্যার মুখ দেখতে চান না তিনি। এ বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল। বেলা চলে গেছে, এখন এ পরিবারের লোকেরা কবিকে হয়তো আরও অপ্রিয় কথা শোনাতে দ্বিধা করবে না।।
হাতে করে ফুল এনেছিলেন, বেলার প্রিয় চাঁপা ফুল, সেই ফুলের গুচ্ছ দোরের কাছে রেখে ফিরে গেলেন দ্রুতপদে।
তাঁর চোখে এক বিন্দু অশ্রু নেই। বুকের মধ্যে কিছু যেন চাপ বেঁধে আছে, তিনি মনকে নির্দেশ দিলেন শান্ত হতে। মৃত্যুর কাছে তিনি কিছুতেই পরাভূত হবেন না। মৃত্যু তো অনন্ত জীবন প্রবাহেরই অঙ্গ।
বেলাকে যে আর বেশি দিন ধরে রাখা যাবে না, সে জন্য তিনি নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন আগে থেকেই। তাঁর অন্য মেয়ে রাণু আর রাণুর মায়ের ওপরেও মৃত্যুর ছায়া পড়েছিল ধীরে ধীরে। শুধু তাঁর আদরের ছেলে শমী, সবাই বলত শমী যেন তার বাবারই ক্ষুদ্র প্রতিচ্ছবি, সেই শমী চলে গেল আচম্বিতে, সেই আঘাত সামলানো সহজ ছিল না।
জোড়াসাঁকোয় এসে তিনি উদ্বিগ্ন রথী আর প্রতিমাদের খবরটি জানালেন অতি সংক্ষিপ্ত ভাবে। ঠিক কখন, কী ভাবে এসেছে বেলার শেষ মুহূর্ত কিংবা কী ভাবে সম্পন্ন হবে শেষকৃত্য, তা নিয়ে একটি কথাও বললেন না, উঠে গেলেন তিনতলার ঘরে।
রথী জানে তার বাবার মনের গড়ন। নিজে তো শোকের কোনও চিহ্ন দেখাবেনই না, অন্য কেউ তাঁর সামনে শোকের উচ্ছ্বাস দেখালে বিরক্ত হবেন। মৃত্যুকে অগ্রাহ্য করার একমাত্র উপায় সম্পূর্ণ স্বাভাবিক থাকা। বাবা এখন অন্যদিনেরই মতো লেখাপড়া নিয়ে বসবেন। এমনকী অন্য কেউ সাক্ষাৎ করতে এলে এমনই স্বাভাবিক ভাবে কথা বলবেন, অন্যরা বুঝতেই পারবে না আজ কী ঘটে গেছে।
বিকেল পর্যন্ত কবি রইলেন নিজের ঘরে।
তারপর হঠাৎ একসময় ব্যস্তসমস্ত ভাবে বাইরে বেরোবার পোশাকে সজ্জিত হয়ে নামতে লাগলেন সিঁড়ি দিয়ে।
রথী সর্বক্ষণ আড়াল থেকে নজর রাখছিল। সে প্রথমে ভাবল, তবে কি নীচে কোনও দর্শনার্থী এসেছে? না, কেউ এলে আগে তো তাকেই জানাবার নির্দেশ সে দিয়েছে ভৃত্যদের।
সে জিজ্ঞেস করল, বাবা, আপনি কোথাও বেরোচ্ছেন?
বাবা বললেন, হ্যাঁ, একটু ঘুরে আসি।
রথী আবার বলল, আমি যাব আপনার সঙ্গে?
বাবা বললেন, তার দরকার নেই, সন্ধের আগেই ফিরে আসব।
রথী বারান্দা থেকে দেখল, বাবামশাই বাড়ির গাড়ি নিলেন না, হেঁটেই যাচ্ছেন।
হয়তো যাচ্ছেন গঙ্গার ধারে। খানিকক্ষণের জন্য নদীর টাটকা বাতাস গায়ে মেখে এলে ভালই হবে। জ্যৈষ্ঠ মাসের দারুণ গুমোট গরমের দিন। বাইরে কিছু ভাব দেখাবেন না, কিন্তু বাবামশাই যে কী কঠিন সংযমের পরীক্ষা দিচ্ছেন, তা কি রথী বোঝে না? মাধুরীলতা আর নেই! রথী নিজে সারা দুপুর নিঃশব্দে কেঁদেছে।
কবি খানিকটা হেঁটে চিৎপুরের রাস্তায় এসে একটা ভাড়ার ঘোড়ার গাড়ি ডাকলেন। তাতে উঠে বসে নির্দেশ দিলেন ভবানীপুরের দিকে যেতে।
সেখানে পৌঁছে তিনি ল্যান্সডাউন রোডে একটি নম্বর খুঁজতে লাগলেন। একটু পরে থামলেন একটা বাড়ির সামনে। এই তো পঁয়ত্রিশ নম্বর।
সদর দরজা বন্ধ। তিনি মুখ তুলে জোরে জোরে ডাকলেন, রাণু! রাণু!
ওপরের জানলা দিয়ে কে যেন মুখ বাড়াল।
কবি ঘোরলাগা মানুষের মতো বললেন, রাণু কোথায়? আমি রাণুকে দেখতে এসেছি।
ঘটাং করে দরজা খুলে গেল। প্রথম দৃষ্টিপাতে কবির মনে হল, তিনি কোনও অলৌকিক দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছেন।
সামনে কে দাঁড়িয়ে আছে, একটি পরী, না অপ্সরা? নাকি তাঁর দৃষ্টি বিভ্রম?
আপাতত মনে হয়, একটি দশ-এগারো বছরের বালিকা, দুধেআলতা গায়ের রং, সরল হরিণী চোখ, মাথায় কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, তার অঙ্গে একটি সুতোও নেই, সে সম্পূর্ণ নগ্নিকা।
এই বয়েসের মেয়েরা নগ্ন থাকে না। কবি যে সমাজে বিচরণ করেন, সেখানে দু’তিন বছরের বালিকারাও পোশাক না পরে বাইরের লোকের কাছে আসে না, কবি সেরকম দেখতেই অভ্যস্ত। তাই তাঁর মনে হল, অবশ্যই পরী কিংবা অপ্সরা, তাদের পোশাকের প্রশ্ন নেই। প্রির্যাফেলাইট চিত্রকলায় যে সব উড়ন্ত পরীদের দেখা যায়, তারা তো এই রকমই।
কবির মনে হল, এ বালিকা টাকা-পয়সা গুনতে শেখেনি, ঘড়ি দেখতে জানে না, কারণ স্বর্গে টাকাপয়সা কিংবা ঘড়ি নেই।
এ বালিকা জন্ম মৃত্যুর অতীত, কালের চিহ্ন ওকে স্পর্শ করে না।
আজকের দিনটিতেই এ বালিকা সরাসরি স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে তাঁর হৃদয় জুড়িয়ে দিতে।
রাণু তার আয়ত চক্ষুদুটি মেলে তাকিয়ে রইল কবির দিকে।
কবির দীর্ঘকায় সুঠাম শরীরে এখনও বয়েসের স্পর্শ লাগেনি। মাথার চুলে সদ্য পাক ধরেছে, দাড়িও সাদায়কালোয় মেশামেশি, কিন্তু চক্ষুদুটি যৌবনবন্ত।
তাঁর বিষণ্ণতা এখন ঢেকে দিয়েছে বিস্ময়।
রাণু প্রথম দেখেই চিনেছে।
কিন্তু সে কোনও কথা বলে একটা হাত ধরল কবির।
কয়েক মুহূর্ত মাত্র। তারপরই দুদ্দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন রাণুর মা, এক পিসি, এক মামা।
মামাটি বিস্মিতভাবে বলে উঠলেন, আরেঃ, রবিবাবু।
কবি এক দৃষ্টিতে নগ্নিকা বালিকাটির দিকে চেয়ে বললেন, তুমিই রাণু?
রাণু বলল, আপনি রবিবাবু, কথা রেখেছেন তাহলে। এসেছেন!
রাণুর মা বললেন, ছি ছি ছি, রাণু, তুই এই ভাবে … যা, শিগগির যা!
রাণু কিছুই বুঝতে না পেরে বলল, কেন, কী হয়েছে? উনি তো আমার সঙ্গেই দেখা করতে এসেছেন।
মা বললেন, হতচ্ছাড়ি, যা ইজের পরে আয়। জামা পরে আয়!
রাণু বলল, বড্ড গরম, ঘেমে যাচ্ছি যে!
কবি বাস্তবে ফিরে এসে ঈষৎ লজ্জাবোধ করলেন।
গত আট নমাস ধরে রাণু তাঁকে কত না চিঠি লিখেছে, তিনিও উত্তর দিয়েছেন সমানে। এতদিন চোখের দেখা হয়নি। শেষ চিঠিতে রাণু মাথার দিব্যি দিয়েছিল, সে কলকাতায় আসছে, এবার দেখা করতেই হবে। ঠিকানা দিয়েছিল এ বাড়ির।
কিন্তু কবি তো রাণুর বাবা-মায়ের সঙ্গেও পরিচিত। মামাটিকেও চেনেন। তবু বয়স্ক ব্যক্তিদের আগে সম্বোধন না করে, ঝোঁকের মাথায় শুধু রাণুর নাম ধরেই ডেকেছেন।
কবিকে এনে বসানো হল দোতলার প্রশস্ত বসবার ঘরের আরামকেদারায়।
সবাই ঢিপ ঢিপ করে প্রণাম করল কবির পায়ের কাছে মাথা ঠেকিয়ে, শুধু রাণু ছাড়া।
সে এর মধ্যে একটা গোলাপি রঙের শাড়ি আলুথালু ভাবে গায়ে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে, মিটিমিটি হাসছে।
লাঠিতে ভর দিয়ে এলেন শীর্ণকায় ফণিভূষণ অধিকারী।
তিনি একটানা রোগে ভুগছেন, কাশিটা কিছুতেই সারছে না, তাই হাওয়া বদল ও চিকিৎসার জন্য সপরিবারে এসেছেন কলকাতায়।
এখন বয়স্কদের সঙ্গেই কবি কথা বলতে লাগলেন। বাইরে থেকে একজন অতিথি এসে শুধু বাড়ির একটি বালিকার সঙ্গেই কথা বলবেন, এ তো শোভা পায় না। যদিও কবি এসেছেন রাণুরই টানে।
তিনি মাঝে মাঝেই দেখছেন রাণুকে।
সে যেন ঠিক এই বয়েসের মাধুরীলতা। রাণুর শরীর বেলার তুলনায় খানিকটা বড়সড়, তবু তাকে যতবার দেখছেন, বেলার সঙ্গেই মিল খুঁজে পাচ্ছেন।
বেলা তার বাবার দিকে যে ভাবে তাকাত, তার চেয়ে রাণুর চাহনি ভিন্ন।
খানিকটা যেন রাগ রাগ ভাব। যেন, কবি কেন তাকে ছেড়ে অন্যদের সঙ্গে কথা বলছেন, সেটা তার পছন্দ হচ্ছে না।
রাণুর মামা কালীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় বেশ বাক্যবাগীশ মানুষ। একএকটা গল্প শুরু করলে থামতে চান না। কথা বলেন বাংলা-হিন্দি মিশিয়ে, শুনতে বেশ লাগে। একবার তিনি শান্তিনিকেতনের ছাত্রদের কাছে একটা বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তার শিরোনামটি ছিল চমকপ্রদ। ‘কো বাং চো চাং’! অর্থাৎ ‘কোমর বাঁধো, চোখ চাও!’ সে উপদেশাত্মক বক্তৃতা শুনে ছাত্ররা শিক্ষা গ্রহণের বদলে হেসে গড়াগড়ি দিয়েছিল।
কবি এবার উঠে পড়বেন। সবাই অনুরোধ করল, আরও কিছুক্ষণ থাকার জন্য। কবি কি একটা-দুটো নতুন কবিতা শোনাবেন না? কিংবা গান?
যারা অনুরোধ করছে, তারা জানে না যে আজ সকালেই কবির কন্যা-বিয়োগ হয়েছে। তবে রাণুকে যতবার দেখছেন, ততবার যে তাঁর বুকের ব্যথা একটু একটু করে কমে যাচ্ছে, সে কথাও ঠিক।
উঠে দাঁড়িয়ে তিনি ফণিভূষণকে বললেন, অধিকারী মশাই, আপনি স্বাস্থ্যোদ্ধার করতে চান, সবাই মিলে শান্তিনিকেতনে চলে আসুন। শান্তিনিকেতনের জল-হাওয়া খুব ভাল, অনেকে তো বলে, ওখানকার জলে পাথর পর্যন্ত হজম হয়ে যায়। অবশ্য আপনাদের পাথর খেতে দেব না। আপনাদের কোনও অসুবিধে হবে না, সব ভার আমার ওপর!