মাটির রাজবাড়িতে আমার আদর
বিহানবেলাতেই আবার বাউরি কাহাররা এল। পালকি সাজাতে লাগলে তারা। আমাকে রাজবাড়িতে নিয়ে যাবে। সি আবার কি বেপার! কেউ কিছু বলে না আমাকে। লতুন বউ, শুদুবই ঝ কাকে? শ্যাষে কত্তা এসে ঘরে ঢুকে ঘাড়টো একটু অন্যদিকে ঘুরিয়ে বললে, রাজবাড়ি গাঁয়েই বেশি দূরে নয়। এপাড়া থেকে ওপাড়া। কিন্তু গরুর গাড়িতে সেখানে গেলে মান থাকবে না। পালকিতেই যেতে হবে তোমাকে। গয়না যেখানে যা আছে সব পরো। বিয়ের লাল বেনারসিটা পরে নতুন বউ সেজেগুজে যেতে হবে, বুঝেছ? এরা রাজার আত্মীয়।
কত্তা ঐ বাড়িতে ছেলের মতুন। সেই লেগে নতুন বউ দেখাতে নিয়ে যাওয়া হচে। এই আমি পেথম কত্তাকে কাছ থেকে ভালো করে দেখলম। কেমন পোষ্কার কথা! তেমন করে কথা আমি তো এ জেবনে আর কাউকে বলতে শোনলম না। আমাদের মতুন গেঁয়ো ঘড়ে কথা কুনোদিন তার মুখে শুনি নাই। ইদিকে আবার সহজ মানুষ। হায়, ত্যাকন কি আর জানি, ঐ সহজ মানুষ কি কঠিন মানুষ।
পালকি তুললে কি হিঁদুপাড়ায় এক বাড়ির সিং-দরজায় নামালে। পালকিতে বসেই দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলম দু-তিনটে বড় বড় বাঁধা ঘাটঅয়লা পুকুরের ঘাস-ঢাকা পাড় আর বড় বড় বিরিক্ষের পাশ দিয়ে লহমার মদ্যে পালকি এক বেরাট দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। কত্তা কিন্তুক হেঁটেই একটু আগে সেখানে হাজির। আমি পালকির ভেতর থেকে চোখ তুলে যাকে দেখতে প্যালম, সাথে সাথে বুঝতে পারলম সে-ই হলো ই বাড়ির গিন্নি। খুব ফরশা মোটা মানুষ, বেশি নোম্বা লয়। বয়েস হয়েছে, সেই লেগে কোমর অ্যানেকটো পড়ে গেয়েছে। এই ভেরোলো মুখ, চাইতে ভয় লাগে। মাথায় ছোট ছোট শাদা চুল। মোটা কুঁজো মানুষ আবার বুড়ি! ইনি লিকিনি রাজার ভাগ্নি।
আগে কিছুই জানতম না, অ্যাকন জানলম, এই গাঁ-ই রাজার শ্বশুরবাড়ি। হিঁদুদের মদ্যে রাজা লিকিনি জেতে তেমন উঁচু লয়। নিজের জেতের মদ্যে তেমন মেয়ে পেছিল না যি বিয়ে করে। শ্যাষে ই গাঁয়েই এক গরিব ঘরে নিজের জেতের একটো সুন্দরী কন্যে পেয়েছিল। তাকেই লিকিনি বিয়ে করে। আবার সেই লেগেই নিজের ভাগ্নির ই গাঁয়েই বিয়ে দেয়। তাইলে ই গাঁ হলো রাজার শ্বশুরবাড়ি। সেই লেগে ই গাঁয়ে আছে পাকা শিবতলা, সিখানে তিনটে পাকা মন্দির, আছে পাকা ইশকুল। এমন ইশকুল ইদিকে আর অ্যাকটোও নাই আর সেই ইশকুল চালানোর লেগে আছে বেরাট এক দিঘি আর বিস্তর জমিজোমা। গাঁয়ে আরও এক ঘর রাজার আত্মীয় আছে। বোধায় রাজার ভাই-ভায়াদদের কেউ। তারাই সব জমি-সম্পত্তি ভোগ করে, দেখাশোনা করে, ভাগ্নি তেমন কিছু পায় না। সেই ঘরের সাথে এই ভাগ্নি বাড়ির তেমন পোট নাই।
ইসব কথা পরে শুনেছি। ত্যাকন হাঁ করে তাকিয়ে থাকলম কত্তামার মুখের দিকে। মুখে কি এটুও হাসি আছে? শুদু বললে, এসো। তার সাথের ঝি-বউরা আমাকে পালকি থেকে নামিয়ে নিলে। কত্তামা মুখ ফিরিয়ে থপথপ করে হাঁটতে শুরু করলে আমরাও তার পেছু পেছু বাড়িতে ঢোকলম।
এই বিরাট এনে! এগনে শুদ্ধ গোটা বাড়ি মাটির পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। সব নিখুঁত ছিমছাম। এগনের ভেতরে ইদিকে-উদিকে জাম গাছ, পেয়ারা গাছ, আমড়া গাছ–তা-বাদে গ্যাদা, সন্ধ্যামণি, পাতরকুচি, তুলসী–এইসব গাছ। সারা উঠোনে হেঁয়া। পরিপাটি করে এনে লিকোননা, একটি শুকনো পাতা পড়ে নাই। এগ্নের উত্তর দিক ঘেঁসে দখিন-দুয়োরি মাটির দোতলা বড় কোঠাঘর। তার চাল খ্যাড়ের, কড়িবরগা শাল আর তাল-কড়ির। দেখেশুনে মনে হয় এমন ঘর চেরকাল থাকবে। আরও সব রান্নাঘর, হেঁশেল, বৈঠকখানা—সবই মাটির বটে কিন্তুক মনে হচে সবলতুন, মনে হচে মাটির ঘরে বাস করবে বলেই সব মাটির করেছে, নাইলে পাকা বাড়ি করা এদের লেগে কিছুই লয়।
এগ্নে পেরিয়ে, দোতলা কোঠাঘরের চ্যাওড়া উসারা পেরিয়ে অ্যাকটো ঠান্ডা আঁদার আঁদার ঘরে নিয়ে যেয়ে আমাকে অ্যাকটো কাঠের পিঁড়িতে বসাইলে। কামার পরনে সরু পাড়ের শাদা মিহি ধুতি। বেধবা তো! গায়ে কিন্তুক বেলাউজ নাই। ত্যাকনকার দিনে গাঁয়ের বউ-ঝিরা বেলাউজ পরত না। কত্তামা এত বড় ঘরের বউ। ভেবেছেলম তার গায়ে কি বেলাউজ থাকবে না?
ঘরের কোণে একটো পেল্লায় কঁঠালকাঠের দবজ চেয়ার পাতা ছিল। কত্তামা এসে সেই চেয়ারে বসলে। দেখলম, এনার পা দুটিও খালি। হ্যাঁ, মাহারানীর মতুন লাগছে বটে! ধবধবে শাদা মোটা মানুষ, চেয়ার জুড়ে বসেছে, কোথাও একটু ফাঁক নাই। সেই চেয়ারে বসে একজন মাঝবয়েসি বউকে হাতের ইশারা করলে। বউটোর সিতিতে চ্যাওড়া করে সিঁদুর লেপা। ঘরের এক কোণে রাখা একটো গয়নার বাসো নিয়ে এসে বউটি আমার ছামনে রাখলে। কত্তামা ত্যাকন আমার দিকে চেয়ে আস্তে আস্তে বললে, বউমা, তোমার গায়ের গয়নাগুলি একটি একটি করে খোলো। আমার গয়না দিয়ে তোমাকে সাজিয়ে একবার নয়নভরে দেখি তো মা কেমন লাগে! এই কথার পরে সব ভুলে কত্তামার মুখের দিকে চেয়ে দেখতে দেখতে আমি একটি একটি করে আমার গয়নাগুলিন খুলতে লাগলম। সব খোলা হয়ে গেলে কত্তামা আবার চোখের ইশারা করতে সেই মাঝবয়েসি বউটি কাঠের গয়নার বাসো খুলে একটি একটি গয়না বার করে আমাকে পরিয়ে দিতে লাগল। আঁদার-আঁদার ঘরে ঐসব খাঁটি সোনার ভারী গয়না ঝকমক করতে লাগল। কেরূমে কেরমে কঙ্কণ, বাজু, কানপাশা, ফাঁদি নথ, টায়রা, গোট, ভারী বিছেহার সব আমাকে পরানো হলো। আরও গয়না ছিল, তবে সি আর পরানোর জায়গা নাই। কত্তামা বললে, বউমা, এখন আর এইসব গয়না খুলো না। ঐ বাসোয় আরও গয়না আছে, তোমার গয়নাও এখন ঐ বাসায় থাকুক। যাবার সময় পালকিতে তুলে দেবে।
কত্তামার এই কথার পরে বউটি আবার আমার সব গয়না সেই বাসোয় ভরে বাসোটা বন্ধ করে চাবি আমার ছামনে রেখে দিলে। কি বাহার সেই গয়নার বাক্সোর! তার সারা গায়ে হাতির দাঁতের কাজ, কেমন সব মনোহারী নকশা। আর চন্দনকাঠ দিয়ে তৈরি বলে সেই বাসো হাতে করলেই সুবাস। সেই গন্ধ সেই নকশা আর এই পিথিমিতে নাই। কুথাও কুনোদিন উ আর কেউ পাবে না।
গয়না পরা হয়ে গেলে শাদা পাথরের বড় এক থালায় নানারকম সন্দেশ-মিষ্টি সাজিয়ে আমার ছামনে রেখে দিলে। ইমিষ্টি গাঁ-ঘরে মেলার কুনো কথাই নাই, শহর থেকে আনাতে হয়েছে। তাপর পায়েস, ক্ষীর আরও কতো কি যি এল হিশেব নাই। কামা শুদু বললে, বউমা, খাও।
অত মানুষের ছামনে একা কি কিছু খাওয়া যায়? কুনোমতে এক-আধটু খেয়ে আমি হাত গুটিয়ে বসে থাকলম।
সব শ্যাষে কত্তামা কষ্ট করে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললে, বউমা, মনে রেখো, তুমি আমার বড় ছেলের বউ। তোমার কিন্তু দেওর-ননদ আছে। তারা সব ছোট। তাদের যখন বিয়ে-থা হবে তখন আমি হয়তো থাকব না, তোমাকেই সব দেখেশুনে নিতে হবে।
কত্তামা-ও দেখলম পেঁয়োভাষায় কথা বলে না। আমি পালকিতে ওঠার পরে কত্তাকে নাম ধরে ডেকে বললে, বউমা আমার সোনার পিতিমে, খবরদার তাকে কোনোদিন কষ্ট দিবি না। তাতে তোর ভালো হবে না।
একটো মজার কথা বলি। এত যি কাণ্ড হলো, কত্তামা কিন্তুক একবারও আমার গায়ে হাত দিলে না, ছুঁলে না। জানা কথা, সব মিটে গেলে কত্তামা আর একবার গা ধুয়ে কাপড় বদলে তবে ঘরের কাজ করবে।