মাঝে মাঝে খুব ভোরে আমার ঘুম ভাঙ্গে। কোন কারণ ছাড়াই হঠাৎ জেগে উঠে দেখি ঘরের ভেতরের অন্ধকারে নরম একটা ভাব। ঘন অন্ধকারকে কেউ যেন তরল করে দিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে আবার ঘন করে ফেলবে। ধ্বক করে বুকে ধাক্কা লাগে–হচ্ছে কী? ভয়ংকর কিছু কি হচ্ছে? এটাই কি সেই ভয়ংকর মুহুর্ত?
ভয়ংকর মুহূর্তের একটা ইতিহাস আছে। আমি যখন খুব ছোট তখন দাদীজান আমাদের সঙ্গে থাকতেন। মাঝে মাঝে দাদীজানের সঙ্গে আমি রাতে ঘুমুতাম। তার কাছে গল্প শুনতে চাইতে হত না। তিনি নিজের মনেই একের পর এক গল্প বলে যেতেন। তাঁর সব গল্পই ভয়ংকর টাইপের! আজরাইল শিঙ্গা ফুকছে—পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সেই শিঙ্গার কী ভয়ানক আওয়াজ। সেই আওয়াজ কানে যাওয়া মাত্র সমস্ত গর্ভবতী মাদের পেটের সন্তান খালাস হয়ে যাবে। শিঙ্গাটা ফেঁকা হবে— আধো আলো আধো অন্ধকার সময়। তখন দিনও না, রাতও না।
খুব ভোরে যতবার ঘুম ভাঙ্গতো ততবারই মনে হত এই কি সেই শিঙ্গা ফেঁকার সময়? নিজেকে সামলাতে সময় লাগত। আমি এলোমেলো পায়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াতাম। বাড়ির সামনের রাস্তাটা ফাঁকা। একটা মানুষ নেই। মানুষজন যেমন ঘুমুচ্ছে, রাস্তাটাও যেন ঘুমুচ্ছে। কোন একজন জীবন্ত মানুষ রাস্তায় এসে না দাঁড়ানো পর্যন্ত রাস্তার ঘুম ভাঙ্গবে না।
আমি ঠিক করে ফেলি রাস্তার ঘুম না ভাঙ্গা পর্যন্ত আমি বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকব। যে মানুষটা রাস্তার ঘুম ভাঙ্গাবে তাকে দেখে ঘরে ঢুকব। তখন মনে এক ধরনের উত্তেজনা হতে থাকে। কাকে দেখব? কাকে দেখব? কে সেই ঘুম ভাঙ্গানিয়া?
বেশির ভাগ সময়ই নামাজী মানুষদের দেখি। ফজরের নামাজ পড়তে মজিদের দিকে যাচ্ছেন। একবার শুধু বাচ্চা একটা মেয়েকে দেখেছিলাম। তার পরনে লাল ফ্রক,খালি পা, হাতে একটা কঞ্চি। সে নির্বিকার ভঙ্গিতে কঞ্চি দুলাতে দুলাতে যাচ্ছে। আমার মনটা খানিকক্ষণের জন্যে অন্যরকম হয়ে গেল–মেয়েটা এত ভোরে কোথায় যাচ্ছে? তার মনে এত আনন্দইবা কিসের? পৃথিবী কি সত্যই এত আনন্দময়? আমি বারান্দা থেকে ডাকলাম, এই মেয়ে, এই। সে মাথা ঘুরিয়ে আমাকে দেখে ফিক করে হাসল তারপর আগের মতই কঞ্চি দুলাতে দুলাতে এগুতে লাগল। এরপর থেকে ভোরে ঘুম ভাঙ্গলেই মেয়েটার মুখ আমার মনে আসে। কী সুন্দর মায়া মায়া মুখ। কেমন টুক টুক করে হাঁটছিল।
দুর্গাপুর ডাকবাংলোয় আজ আবার আধো অন্ধকার আধো আলোয় ঘুম ভাঙ্গল। আমি পুরানো অভ্যাসমত বারান্দায় চলে এলাম। পাখিদের চিৎকারে কান পাতা যাচ্ছে না। গ্রামের মানুষরা যে খুব ভোরে জেগে ওঠে তার প্রধান কারণ বোধ হয়—পাখিদের হৈ চৈ। পাখিরা বড় বিরক্ত করে।
বারান্দা থেকে উঠোনের দিকে তাকিয়ে চমকে গেলাম। পাপিয়া ম্যাডাম হাঁটছেন। তাঁর হাতে কফির মগ। মাঝে মাঝে কফিতে চুমুক দিচ্ছেন (কফি না হয়ে চা-ও হতে পারে। আমি ধরে নিচ্ছি কফি। তিনি চা খান না)। তিনি নিজের মনে হাঁটছেন। ছবির মত একটা দৃশ্য। তার পরনে শাদা শাড়ি। লাল একটা চাদর মাথার উপর দিয়ে রেখেছেন। তাঁকে জীবন্ত একটা ফুলের মত লাগছে। আমার কাছে মনে হল আমি অনেকদিন এমন সুন্দর দৃশ্য দেখি নি। পাপিয়া ম্যাডাম কোনোদিকে তাকাচ্ছেন না। তিনি আছেন আপন মনে। আমি যদি কখনো ছবি বানাই এমন একটা দৃশ্য অবশ্যই রাখব। ছবির নায়িকা খুব ভোরে বাগানে একা একা হাঁটছে। তার হাতে কফির মগ। মাঝে মাঝে সে মাথা উঁচু করে আকাশ দেখার চেষ্টা করছে। আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ছে। আমার খুব ইচ্ছা করছে উঠোনে নেমে যাই। পাপিয়া ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলি। উনি হয়ত খুব রাগ করবেন। কিছু সময় আছে যখন মানুষ একা থাকতে চায়, অতি প্রিয়জনের সঙ্গও তার অসহ্য বোধ হয়। উনার হয়ত এখন ঐরকম সময় যাচ্ছে। আমি লোভ সামলাতে পারলাম না। নীচে নামলাম। ঠিক করে ফেললাম, উঠোনে এমন ভাবে যাব যাতে মনে হবে উনি যে উঠোনে আছেন আমি জানতাম না। আমি যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে উনাকে দেখেছি উনি তা জানেন না। আমি হঠাৎ উঠোনে উনাকে দেখে চমকে উঠেছি এমন একটা অভিনয়। আমার জন্যে সহজ অভিনয়।
আমি আমার অভিনয়ের অংশটা সুন্দর ভাবে করলাম। উনাকে দেখে চমকে উঠে বললাম, ও আল্লা আপনি! কী আশ্চর্য!
উনি হাসি মুখে বললেন, রুমালী তুমি কেমন আছ?
জ্বি ভাল।
আমাকে দেখে চমকে ওঠার ভান করলে কেন? তুমিতো দোতলার বারান্দা থেকেই আমাকে দেখেছ।
চট করে কোন জবাব আমার মাথায় এল না। আমি অস্বস্তি নিয়ে তাকিয়ে আছি। কাউকে অস্বস্তিতে ফেলতে পারার মধ্যে তীব্র একটা আনন্দ আছে। বেশির ভাগ মানুষ এই আনন্দ অনেকক্ষণ ধরে পেতে চান। উনিও কি তা চাইবেন? না-কি আমার কাছ থেকে কোন জবাবের জন্যে অপেক্ষা করবেন না, অন্য প্রসঙ্গে চলে যাবেন?
পাপিয়া ম্যাডাম অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন–সহজ স্বাভাবিক গলায় বললেন, তুমি কি রোজই এত ভোরে ওঠ?
জ্বি না। আজ হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেছে।
আমি খুব আর্লি রাইজার। যত রাতেই আমি ঘুমুতে যাই না কেন—পাঁচটা সাড়ে পাঁচটার দিকে আমার ঘুম ভাঙ্গবেই। তখন আমি নিজের জন্যে এক মগ কফি বানাই। কফি খেতে খেতে টুকটুক করে হাঁটি।
কিছু বলতে হয় বলেই আমি বললাম, খুব ভাল অভ্যাস।
তিনি বললেন, মোটেই ভাল অভ্যাস না। কারণ সূর্য ওঠার কিছুক্ষণ পরই আমি আবার ঘুমুতে চলে যাই। শুটিং না থাকলে— দশটা এগারোটা পর্যন্ত ঘুমুই।
আজ ঘুমুতে পারবেন না। আজতো শুটিং।
আজো পারব। আজ শুটিং হবে না।
শুটিং হবে না? প্যাক আপ হয়ে গেছে?
না। তবে হবে। আমার সিক্সথ সেন্স বলছে হবে। আমার সিক্সথ সেন্স খুব প্রবল।
আপনি কি সব কিছু আগে ভাগে বলতে পারেন?
আরে না। হঠাৎ কোন একদিন একটা কিছু মনে হয় তারপর দেখি তাই হয়েছে। আজ ঘুম থেকে উঠেই মনে হল শুটিং হবে না। এবং আমি জানি হবে না।
আমি বললাম, এই গ্রামে একটা বৌ আছে। সেও না-কি ভবিষ্যৎ বলতে পারে।
তিনি হালকা গলায় বললেন, ও আচ্ছা জাহেদী। তার কথা শুনেছি। একদিন যাব, দেখে আসব। অবশ্যি পীর-ফকির, ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার খুব আগ্রহ নেই। তুমি ঘুরে বেড়াও আমি যাচ্ছি।
এখন ঘুমুতে যাবেন?
হুঁ।
আপনার মেয়েকে সবুজ বল পয়েন্টে একটা চিঠি লিখবেন বলে ঠিক করেছিলেন, সেই চিঠি লেখা হয়েছে?
পাপিয়া ম্যাডাম হেসে ফেলে বললেন, আমার সবুজ বল পয়েন্টের খবর মনে হয় দিকে দিকে ছড়িয়ে গেছে। হ্যাঁ চিঠি লেখা হয়েছে। এখনো পোস্ট করি নি। আচ্ছা ঠিক আছে চিঠি পোস্ট করার আগে তোমাকে পড়াব। পড়লে তোমার মজা লাগবে।
সকালের নাশতা খাবার সময় সোহরাব চাচা বললেন, মিস রুমাল তুমি মেকাপে বসে যাও। দেরি করবে না। আমি বললাম, চাচা, শুটিং কি হবে? সোহরাব চাচা বিস্মিত হয়ে বললেন, শুটিং হবে না কেন?
এম্নি বললাম।
শুটিং অবশ্যই হবে। স্যার বলে দিয়েছেন— হেয়ার স্টাইল তোমাকে মনে রাখতে। যেদিন যেদিন শাড়ি পরবে, চুল খোলা থাকবে। শাড়ি ছাড়া আর যাই পরবে–দুবেণী করবে।
জি আচ্ছা মনে রাখব। মেকাপ কোথায় দেয়া হবে?
তাওতো জানি না—আচ্ছা দাঁড়াও জেনে এসে বলছি। এই ফাঁকে দ্রুত চা শেষ করে ফেল। তুমি টুকটুক করে চা খাও কেন? এক চুমুক পাঁচ মিনিট অপেক্ষা, আবার আরেক চুমুক।
চা শেষ করার আগেই সোহরাব চাচা ফিরে এসে বিরক্ত মুখে বললেন, আজ শুটিং প্যাক আপ হয়েছে।
ছবির জগতে প্যাক আপ বাক্যটি আনন্দময়। স্কুলে উপস্থিত হবার পর হেড স্যার যদি এসেম্বলীতে বলেন, তোমাদের জন্যে দুঃখের খবর আছে— ক্লাস এইটের একজন ছাত্রী মায়া হালদার যে দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিল, আজ খবর এসেছে সে মারা গেছে। আজ তাঁর আত্মার মাগফেরাতের জন্যে দোয়া করা হবে। এবং আজ আর কোন ক্লাস হবে না। তখন ছাত্রীরা খুব চেষ্টা করে চোখে মুখে মনখারাপ ভাব ফুটিয়ে রাখতে। শেষ পর্যন্ত পারে না। মৃত্যুর শোকের চেয়ে ক্লাস হবে না এই আনন্দই বড় হয়ে ওঠে। প্যাক আপেও তাই হয়— সবাই ভাব করে— আহা একটা দিন মাটি হল, কিন্তু সবাই খুশি। সবচে খুশি আমার মা। তিনি আনন্দ ঝলমল গলায় বললেন, বকু! আমার সঙ্গে চল এক জায়গা থেকে ঘুরে আসি। আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, চল।
কোথায় যাচ্ছি না জেনেই বললি—চল।
তুমি যেখানেই নিয়ে যাবে সেখানেই যাব। তুমি যদি লাযাতে নিয়ে যাও, সেখানেও যাব।
লাযাটা কোথায়?
লা হচ্ছে একটা দোজখের নাম। সাতটা দোজখের একটার নাম লাযা।
আমি তোকে লাযাতে নিয়ে যাব কেন? এটা কি ধরনের কথা। পাগলামী ছাগলামী কথা আমার সাথে বলবি না। আমার কাছে জ্ঞান ফলাবি না। আমি তোর পেটে জন্মাইনি, তুই আমার পেটে জন্মেছিস।
মা রাগে গরগর করতে লাগলেন, আমি মিষ্টি মিষ্টি হাসি হাসছি। এই হাসিতে মার রাগ আরো বাড়বে। তবে রাগটা কনট্রোলের ভেতর থাকবে। লাগামছাড়া হবে না। এই হাসি উনুনে অল্প অল্প তুষ ছড়িয়ে দেয়া হাসি। আমার আরেকটা হাসি আছে পেট্রল ঢেলে দেয়া টাইপ। ধুম করে আগুন।
বকু!
জ্বি মা।
কাপড় বদলা, ভাল কিছু পর।
তুমি যা বলবে তাই পরব। তুমি আগে সেজে গুজে আস। তারপর আমি। আমার চেয়ে তোমার সাজটা বেশি দরকার।
তার মানে?
না সাজলেও আমাকে সুন্দর দেখাবে মা। বয়সের সৌন্দর্য। তোমার সেই সৌন্দর্যতা নেই। সাজগোজ করে সেটা কাভার দিতে হবে। তবে মা শোন, আল্লাহর দোহাই লাগে তুমি ঠোঁটে এত কড়া করে লিপস্টিক দিও না।
আমি আবারো মিষ্টি মিষ্টি করে হাসলাম। মা রাগে কাপতে কাপতেই দোতলায় উঠে গেলেন। সেজে গুজে তাঁর নীচে নামতে এক ঘন্টার মত সময় লাগবে। এই এক ঘন্টা আমি নিজের মনে ঘুরতে পারি। হাফিজ আলির বাড়ি যদি আশে পাশে হয় তাহলে চট করে তার বৌকেও দেখে আসা যায়। তার কাছ থেকে ভবিষ্যৎটা জেনে আসা যায়। যিনি ভবিষ্যৎ বলতে পারেন তার অতীতও বলতে পারার কথা। আমি তাঁর কাছ থেকে ভবিষ্যৎ জানতে চাইব না। আমি জানতে চাইব অতীত। আমার প্রশ্নগুলি হবে এ রকম—
বলুনতো ছোটবেলায় আমি কার সঙ্গে ঘুমুতাম? মার সঙ্গে না বাবার সঙ্গে?–কি দুজনের সঙ্গেই–মাঝখানে আমি, এক পাশে বাবা আর এক পাশে মা।
উত্তরটা হল আমি দুজনের কারোর সঙ্গেই ঘুমুতাম না। আমি ঘুমুতাম আমার দাদীজানের সঙ্গে।
আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে— বলুনতো আমি এই পর্যন্ত কবার পানিতে ডুবেছি?
উত্তর হচ্ছে তিনবার। প্রতিবারই মরতে মরতে বেঁচে উঠেছি। প্রথমবার পানিতে ডুবি আমাদের দেশের বাড়ি নেত্রকোনায়। পানি থেকে যখন আমাকে তোলা হয় তখন না-কি আমার সমস্ত শরীর নীল হয়ে গিয়েছিল। চোখের মণি উলটে গিয়েছিল। চোখের মণি উলটে যাওয়ার মানে কী আমি জানি না। নিশ্চয়ই কোন ভয়াবহ ব্যাপার। মৃত্যুর আগে আগে কিংবা মৃত্যুর সময় চোখের এই ঘটনাটা হয়ত ঘটে। যাই হোক আমাকে উঠোনে শুইয়ে রেখে সবাই যখন মরাকান্না শুরু করে তখন হঠাৎ করে আমি সামান্য নড়ে উঠে, ছোট্ট করে শ্বাস ফেলি। আমাকে নিয়ে ছোটাছুটি পড়ে যায়। এবং গ্রামের এক কবিরাজ আমাকে বাঁচিয়ে তোলেন। এই ঘটোনার পর আমার পানি-ভীতি হবার কথা। তা হয় নি, উল্টোটা হয়েছে। পানি দেখলেই ছুটে কাছে যেতে ইচ্ছা করে। পানি হাত দিয়ে ছুঁয়ে থাকতে ইচ্ছা করে।
এই কারণে আরো দুবার আমাকে পানিতে ডুবতে হল, প্রতিবারই জীবন সংশয়ের মত অবস্থা। আমাকে সাঁতার সেখানোর জন্যে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমি সাঁতার শিখলাম না। কারণ আমার মনে হল–সাঁতার শিখে ফেললেই আমার আর পানি ভাল লাগবে না। শান্ত সুন্দর কোন দিঘি দেখলে তার কাছে যেতে ইচ্ছা করবে না। কেন এই আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করব? আমার চারপাশে আনন্দময় ব্যাপারতো খুব কম। আচ্ছা দিলু যেমন দিঘির নীল জলে ডুবে মারা গেছে আমার বেলাতেও কি তাই হবে? শুটিং এর শেষ পর্যায়ে হঠাৎ একদিন দেখা যাবে আমি সাঁতার না জেনেও দিঘিতে ভাসছি। দিঘির চারপাশের গাছের অসংখ্য পাখি অবাক হয়ে আমাকে দেখছে আর ভাবছে— ব্যাপারটা কী? একটা হলুদ রঙের পাখি হয়ত আমার ভাসন্ত শরীরটার উপর দিয়ে কয়েকবার উড়ে উড়ে যাবে। তার চোখে থাকবে বিস্ময়।
কেমন আছেন?
আমি তাকালাম। সেলিম ভাই। উনিও কি আমার মায়ের মত নিঃশব্দে হাঁটা প্র্যাকটিস করছেন? কখন এসে পাশে দাঁড়িয়েছেন বুঝতেই পারি নি। সেলিম ভাইকে দেখে চমকে ওঠার কোন মানে হয় না। কাজেই চমকালাম না। হাসি হাসি মুখে বললাম,
আপনার খবর কী সেলিম ভাই?
জ্বি ভাল।
চোখ লাল হয়ে আছে কেন? রাতে ঘুম হয় নি?
জ্বি না। টেনশনে ঘুম হয় নি। আজ শুটিং, স্যার কী করতে বলবেন আর কী করব এই টেনশনে,.।
শুটিং যে প্যাক আপ হয়েছে সেই খবর নিশ্চয়ই পেয়েছেন।
জ্বি পেয়েছি।
তাহলেতো টেনশন কমে যাবার কথা।
জ্বি না, টেনশন কমে নি আরো বেড়েছে আজ সকালে নাশতা খেতে পারি নি। আমি ঠিক করে রেখেছিলাম ঘুম থেকে উঠেই কাউকে কিছু না বলে ঢাকা চলে যাব।
সেটা করলেন না কেন? যেটা ভাববেন সেটা করবেন। শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে পড়বেন না। ঢাকায় পালিয়ে যাবার ব্যাপারটা কি এখনো আপনার মাথায় আছে?
জি আছে।
তাহলে এক কাজ করুন আগামীকাল ভোরে ঢাকায় চলে যান। আজ খোজ নিয়ে আসুন ঢাকার দিকের প্রথম বাস কখন ছাড়ে। বাস ভাড়া কত আপনার কাছে কি ঢাকায় ফিরে যাবার মত টাকা আছে?
জ্বি না।
আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবেন।
জ্বি আচ্ছা।
এখন আমার সঙ্গে একটু চলুন।
কোথায়?
তেমন কোথাও না, একটু হাঁটাহাঁটি করব। একটু পরেই মা দোতলা থেকে নামবেন। নেমে শুনবে আমি আপনার সঙ্গে কোথাও গেছি। মার ব্রেইন ডিফেক্টের মত হয়ে যাবে। তিনি ভাব দেখাবেন যে খুব নরম্যাল আছেন। আসলে থাকবেন খুব এবনরম্যাল অবস্থায়। খুব মজা হবে।
মজা হবে কেন?
আপনি বুঝবেন না। চলুনতো যাই। কথা বলে শুধু শুধু সময় নষ্ট করছি। মা যদি এখন হুট করে নেমে যায় তাহলে পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে।
দাঁড়ান একটা ছাতা নিয়ে আসি–খুব রোদ।
আপনাকে ছাতা আনতে হবে না। চলুনতো।
আমি গেটের দিকে এগুচ্ছি–সেলিম ভাই আসছেন আমার পেছনে পেছনে। খুব যে উৎসাহের সঙ্গে আসছেন তা মনে হচ্ছে না। মানুষ অনুরোধে চেঁকি গেলে, উনাকে দেখে মনে হচ্ছে উনি অনুরোধে রাইস-মিল গিলে ফেলেছেন। বেচারার মন থেকে অস্বস্তি ভাবটা কাটানো দরকার। কী করে কাটাব বুঝতে পারছি না। হালকা ধরনের গল্প টল্প করা যেতে পারে।
সেলিম ভাই!
জ্বি।
বলুনতো দেখি চন্ডিগড় গ্রামটার বিশেষত্ব কী?
কোন বিশেষত্ব নেই। বাংলাদেশের সব গ্রাম একরকম।
হয় নি। এই গ্রামের একটা আলাদা বিশেষত্ব আছে। দেখবেন এই গ্রামে একটু পর পর শিমুল গাছ। গাছে ভর্তি কড়া লাল রঙের ফুল। মনে হয় যে পুরো গ্রামটায় আগুন ধরে গেছে। ধিক ধিক করে আগুন জ্বলছে।
জ্বি।
চন্ডিগড় গ্রামটা দেখে আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। আপনি শুনে দেখুনতো আইডিয়াটা কেমন? আইডিয়াটা হচ্ছে বাংলাদেশের গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে যদি একটা করে শিমুল গাছ লাগিয়ে দি তাহলে কেমন হয়? যখন ফুল ফুটবে তখন মনে হবে পুরো বাংলাদেশে আগুনের ফুল ফুটেছে। কোন বিদেশি বাংলাদেশে এলে হতভম্ব হয়ে বলবে— একী? কোন দেশে এলাম? আমার আইডিয়া কেমন?
অদ্ভুত আইডিয়া।
খুব কি অদ্ভুত?
না খুব অদ্ভুত না, তবে শিমুল গাছ না, লাগাতে হবে কৃষ্ণচূড়া গাছ আর রাধা চূড়া গাছ।
এমন কোন গাছ আছে যার ফুল নীল।
জারুল গাছ। থোকা থোকা নীল ফুল ফোটে।
তাহলে আসুন আমরা একটা কাজ করি–বাংলাদেশের গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে একটা করে কৃষ্ণচূড়া গাছ আর একটা করে জারুল গাছ লাগিয়ে দি। পাঁচ ছ বছর পর গাছগুলি যখন বড় হবে তখন একটা ভয়ংকর কান্ড ঘটে যাবে।
সেলিম ভাই কিছু বলছেন না। অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছেন। মনে মনে হয়ত ভাবছেন–আচ্ছা এক পাগলী মেয়ের হাতে পড়লাম।
বৈজ্ঞানিকরা কত অদ্ভুত অদ্ভুত আবিষ্কার করেন, এমন একটা আবিষ্কার করতে পারেন না যাতে অন্যের মনের কথা পরিষ্কার শোনা যাবে। ক্যালকুলেটারের মত ছোট্ট যন্ত্র। পকেটে লুকানো থাকবে। যন্ত্রের বোতাম টিপে দিলেই পাশের মানুষটার মনের কথা শোনা যাবে।
সেলিম ভাই।
জ্বি।
কথা বলুন। এত চুপচাপ কেন? না-কি আমার সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগে না।
সেলিম ভাই কিছু বললেন না। মাথা আরো নীচু করে ফেললেন। মনে হচ্ছে লজ্জা পাচ্ছেন।
কাল ভোরে ঢাকা চলে যাবার প্রোগ্রামটা কি আপনার ঠিক আছে?
জ্বি ঠিক আছে।
ঢাকা গিয়ে কী করবেন কিছু ঠিক করেছেন?
জ্বি-না। প্রাইভেট টিউশনি করব।
প্রাইভেট টিউশনিই ভাল। স্বাধীন ব্যবসা। চেষ্টা করবেন বড়লোক কোন মেয়ের প্রাইভেট টিউটার হতে। মেয়েটার বয়স চৌদ্দ পনেরো হলে ভাল হয়। এই বয়সের মেয়েরা দ্রুত প্রেমে পড়ে। কোন রকমে বরশি দিয়ে একটা প্রেম গেঁথে ফেলতে পারলে আপনার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। আপনি আমার কথায় বিরক্ত হচ্ছেন নাতো?
জ্বি-না।
আপনি কেমন কাজের মানুষ এইবার দেখি––হাফিজ আলির বাড়িটা খুঁজে বের করুন।
কোন হাফিজ আলি? যার স্ত্রী ভবিষ্যৎ বলতে পারে? জাহেদা?
আপনি তাহলে জানেন?
জি। ইউনিটের সবাই জানে!
আপনি কি তার কাছ থেকে আপনার ভবিষ্যৎ জেনে এসেছেন?
উনি পুরুষদের সঙ্গে কথা বলেন না।
তাহলে ভবিষ্যৎ জানতে পারেন নি?
জ্বি না।
এই সব কি বিশ্বাস করেন?
জ্বি করি। আমাদের গ্রামেও এ রকম একটা ছেলে আছে। যা বলে লেগে যায়। তার নাম মতিন। কানা মতিন। কঞ্চির খোঁচা লেগে তার একটা চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
এ রকম মানুষ সব গ্রামেই থাকে। বাংলাদেশের যে গ্রামেই যাবেন সে গ্রামেই একজন পাগল থাকবে, একজন জ্বীনে ধরা মানুষ থাকবে, একজন নজর খারাপ মানুষ থাকবে, নজর খারাপ মানুষের শুধু নজর লাগবে। সবই ভুয়া। ভুয়া পাগল, ভুয়া জ্বীন, ভুয়া নজর। পৃথিবীটা চলছেই ভুয়ার উপরে। জাহেদা মেয়েটাও বিরাট ভুয়া। ভুয়া ভাব মেয়েদের মধ্যে কম থাকে। হাফিজ আলির স্ত্রীর মধ্যে কী ভাবে চলে এল সেটাই আমার দেখার ইচ্ছা। সেলিম ভাই আপনি কি জানেন জাহেদা কী কী ভবিষ্যৎ বাণী করেছে? আমি সব কটা লিখে রাখব। পরে মিলিয়ে দেখব।
উনি বলেছেন—চন্ডিগড়ে ছবির শুটিং কোনদিন হবে না। বিরাট গন্ডগোল লাগবে। পানিতে ডুবে একটা মানুষ মারা যাবে।
এই কথা বলেছে?
জ্বি। খুব জোর দিয়ে বলছে।
আপনি কি এই ভয়েই পালিয়ে যাচ্ছেন? শুটিং করতে এসে পানিতে ডুবে মরার চেয়ে ঢাকায় প্রাইভেট টিউশনি করা ভাল। তাই না? প্রাইভেট টিউশনি এম্নিতে খুব বোরিং ব্যাপার কিন্তু কোন মতে পড়া পড়া খেলার সঙ্গে যদি প্রেম ঢুকিয়ে দিতে পারেন তাহলে পুরো ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং হয়ে যাবে।
সেলিম ভাই মাথা নীচু করে হাঁটছেন, মাঝে মধ্যে চিন্তিত মুখে আমার দিকে তাকাচ্ছেন। পৃথিবীর সব মেয়েদের ভেতর অলৌকিক একটা ক্ষমতা থাকে। কোন পুরুষ তার প্রেমে পড়লে মেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তা বুঝতে পারে। এই ক্ষমতা পুরুষদের নেই। পুরুষদের কানের কাছে মুখ নিয়ে কোন মেয়ে যদি বলে–শোন আমার প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। আমি মরে যাচ্ছি। তারপরেও পুরুষ মানুষ বোঝে না। সে ভাবে মেয়েটা বোধ হয় এ্যাপেনডিসাইটিসের ব্যথায় মরে যাচ্ছে। সেলিম ভাইকে দেখে এখন মনে হচ্ছে তার খবর হয়ে গেছে। কাল ভোরে তিনি কিছুতেই ঢাকা যেতে পারবেন না। তাঁকে থেকে যেতে হবে— শুধু মাত্র আমার আশে পাশে থাকার আনন্দের জন্যে।
হাফিজ আলির বাড়ির সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি। মাটির দুটা ঘর। জরাজীর্ণ অবস্থা। বাইরের উঠোন খুবই নোংরা। ঝোপ ঝাড়ে একাকার। কেউ কোনদিন উঠোন ঝাঁট দেয় নি। একটা মুরগী মরে পড়ে আছে। তার উপর রাজ্যের মাছি। বাড়ির সামনে খুঁটিতে একটা ছাগল বাঁধা আছে। সেই ছাগলটাও মনে হচ্ছে অসুস্থ। হাফিজ আলি উঠোনে বসে আছে। সে যে হাফিজ আলি তা বুঝলাম কারণ সেলিম ভাই বললেন, হাফিজ ভাল আছ? হাফিজ আলি তার জবাব দিল না। ছাগলটার মত হাফিজ আলি ও মনে হল অসুস্থ। চোখ টকটকে লাল। খুঁটিতে হেলান দিয়ে সে বসে আছে—পাথরের মূর্তির মত স্থির হয়ে আছে। তার দৃষ্টি মরা মুরগীটার দিকে। এই মুরগীটা বোধ হয় তার প্রিয় ছিল। কিংবা পচাগলা মুরগীর উপর মাছি ওড়ার দৃশ্যে সে মুগ্ধ। বিকট গন্ধে আমার নাড়ি ভুড়ি উল্টে আসার মত হচ্ছে।
সেলিম ভাই বললেন, হাফিজ আলি তোমার কি শরীর খারাপ?
না।
ইনি এসেছেন তোমার স্ত্রীর সঙ্গে দুটা কথা বলার জন্যে।
যান কথা বলেন! আপনে এইখানে থাকেন। পুরুষ মানুষের অন্দরে যাওয়া নিষেধ। পর্দা পুষিদার বিষয় আছে।
আমি যাব না। আমি এইখানেই থাকব।
সেলিম ভাই দাঁড়িয়ে রইলেন, আমি ভেতরে চলে গেলাম। বাড়ির ভেতরটা বাইরের মত নয়। ঝকঝক তকতক করছে। মনে হচ্ছে এই কিছুক্ষণ আগে ঝট দেয়া হয়েছে। সবচে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে উঠোনে গম্ভীর মুখে একটা বক হাঁটাহাঁটি করছে। বক খালে বিলে ধানের ক্ষেতে থাকে। মানুষ দেখলে উড়ে যায়। এ দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশ দিয়ে হাঁস চলে গেল। মুরগী তার বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে চলে গেল সে ঘাড় ঘুরিয়ে শুধু দেখল। আমি মুগ্ধ হয়ে বকের কাণ্ডকারখানা দেখছি তখনই হাফিজ আলির স্ত্রী জাহেদার গলা শুনলাম–ভইনডি পালা বক পাখি।
আমি পোষা বক পাখি দেখে যেমন বিস্মিত হলাম, জাহেদাকে দেখেও তেমনি বিস্মিত হলাম। নিতান্তই কিশোরী একটা মেয়ে। গায়ের রঙ কাল। কালো রঙ যে কত মিষ্টি হতে পারে মেয়েটাকে না দেখলে আমার জানা হত না। কী মায়াকাড়া মুখ। মনে হচ্ছে শাড়ি পরাও ঠিকমত শেখে নি। শাড়ি গা থেকে নেমে নেমে যাচ্ছে। পান খেয়ে সে ঠোঁট লাল করেছে। পায়ে আলতা।
আমি বললাম, বক পোষ মানে?
জে ভইনডি মানে। খুব ছোটবেলায় বকের বাসা থাইক্যা ধইরা আনতে হয়। চউখ ফুটনের আগেই ধইরা আনতে হয়। চউখ ফুইট্যা হে দেখে মানুষ। তহন হে মানুষরেই জানে তার বাপ-মা।
এই বক কে ধরে এনেছে, আপনি?
জ্বে না। মায়ের বুক খালি কইরা বকের বাচ্চা আনা মেয়েছেলের কাম না। ভইনডি।
বক যে পোষ মানে মানুষের সঙ্গে থাকে এই প্রথম দেখলাম।
ভইনডি মানুষ পারে না এমন কাম নাই। মানুষ সব পারে।
এই বকটার কি কোন নাম আছে?
এর নাম ধলা মিয়া। ধলা মিয়া কইয়া ডাক দেন অফনের বগলে আসব।
আমি ধলামিয়া বলে ডাক দিলাম। আশ্চর্য কান্ড–বকটা গম্ভীর মুখে হেঁটে হেঁটে আমার কাছে আসছে। আমি চমকে দুপা পেছনে গেলাম। জাহেদা কিশোরীর মতই খিলখিল করে হেসে উঠল। এই মেয়ে ভবিষ্যৎ বলবে কী নিতান্তই সহজ সরল গ্রাম্য বধু।
ভইনডি পান খাইবেন?
হ্যাঁ খাব। আর আপনার সঙ্গে অনেক গল্প করব।
আমি কোন গল্প জানি নাগো ভইনডি।
আপনি না জানলেও আমি জানি। আমি গল্প বলব আপনি শুনবেন।
মেয়েটা আমার এই কথাতেও খিল খিল করে হেসে উঠল। তার হাসির মধ্যে সামান্য অস্বাভাবিকতা আছে। গ্রামের মেয়ে এত শব্দ করে হাসে না। আমি তার হাসির মাঝখানেই বললাম, আপনি নাকি ভবিষ্যৎ বলতে পারেন?
গেরামের মানুষ এইগুলোন বানাইছে। আমি কিছু বলতে পারি না।
আপনি না-কি বলেছেন— এখানে শুটিং হবে না। একটা মানুষ মারা যাবে।
জ্বে বলেছি।
কেন বলেছেন?
জাহেদা আবারো শব্দ করে হাসছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে মেয়েটা কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ। অপ্রকৃতিস্থ একজন মানুষ বানিয়ে বানিয়ে অনেক কিছু বলতে পারে। মেয়েটার হাসির শব্দে বক উড়ে গেল দুটা চক্কর দিয়ে বসল জাহেদার মাথায়। জাহেদা খুব স্বাভাবিক। এই ব্যাপারটায় সে যেন অভ্যস্ত। আমি অবাক হয়ে দেখছি, একটা মেয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে তার মাথায় গম্ভীর মুখে একটা বক বসে আছে।
ঢাকায় ফিরে গিয়ে যদি এই গল্প বলি— কেউ বিশ্বাস করবে না। এটা কোন কথা হল— একটা তরুণী মেয়ে ঘরের কাজ কর্ম করছে তার মাথায় গম্ভীর মুখে একটা বক বসে আছে! বকটার নাম ধলা মিয়া।
জাহেদা আমাকে পাটি এনে দিল। পান সুপারি এনে দিল। আমি পা ছড়িয়ে এমন ভাবে বসলাম যেন কত দিনের পরিচিত এই বাড়ি। জাহেদা আমার পাশে বৃক্ল না। সে ঘরের কাজ কর্ম করে যাচ্ছে এবং আমার কাছে তা খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। অতিথি এসে অতিথির মত আরাম করে বসে থাকবে। গৃহকত্রী তার কাজ করতে থাকবে ফাঁকে ফাঁকে দুএকটা কথা বলবে।
ভইনডি আমার পুরুষ মানুষটারে দেখছেন?
হাফিজ আলির কথা বলছেন? যে বাইরে বসে আছে?
হ। গাঞ্জা খাইয়া শরীরটা কী বানাইছে। বেশি দিন বাঁচব না। তার মৃত্যু ঘনাইছে।
গাজা খায়?
নিশার জিনিস সব খায়। চরস খায়, ভাঙ্গের সরবত খায়। যখন খাওনের কিছু পায় না তহন কেরোসিন খায়। তয় গাঞ্জাটা খায় বেশি।
জাহেদা আবারো হাসছে। আমি বললাম, স্বামী নেশা করে বেড়াচ্ছে এটাতো কোন মজার কথা না। আপনি এ রকম করে হাসছেন কেন?
ভইনডি আমার হাসি রোগ আছে। আমার যখন দশ বছর বয়স তখন আমার পিতা মারা গেল। সন্ন্যাস রোগে ধড়ফড় কইরা মৃত্যু! হে উঠানে ধড়ফড় করে আর আমি হাসি। হাসি থামে না। কত মাইর যে হাসির কারণে খাইছি। এখন আর কেউ মারে না, কিছু কয়ও না। স্বামী গাঞ্জাখোর— তার সামনে হাসলেও যা কানলেও তা।
আপনার ধারণা এই গ্রামে শুটিং হবে না?
এম্নে এম্নে বলছি। এইটা নিয়া চিন্তা কইরেন না। আল্লাহপাক মানুষরে অধিক চিন্তা করতে নিষেধ করছেন। অবশ্য মানুষ অধিক চিন্তা করেও না–ভাব দেখায় হে অধিক চিন্তা করে। হি হি হি।
আমি মুগ্ধ হয়ে জাহেদার হাসি দেখছি। তার মাথার উপর বসে থাকা বকটা উড়ে গাছের দিকে চলে গেছে। হাসতে হাসতে জাহেদার চোখে পানি এসে গেছে। সে চোখের পানি শাড়ির আঁচলে মুছছে। বকটা গাছে গিয়ে বসল না। জাহেদার মাথার উপর চক্কর খেতে লাগল। আচ্ছা এরা এই বকটার নাম ধলা মিয়া রাখল কেন? বকটা কি পুরুষ?
আমাকে অনেকক্ষণ দেখতে না পেয়ে মায়ের কী অবস্থা হবে তা আন্দাজ করেছিলাম। আন্দাজের চেয়েও বেশি হয়ে গেল। মাকে দেখলাম বিছানায় এলিয়ে পড়ে আছেন। তাঁর মুখ নীল। বুকে নিশ্চয়ই ব্যথা হচ্ছে, বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছেন। হার্ট অ্যাটাকের প্রাথমিক লক্ষণ সবই দেখা যাচ্ছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আমি সহজ ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকলাম। মার দিকে না তাকিয়ে বাথরুমে ঢুকে— চোখে-মুখে পানি দিলাম। আমি জানি ব্যস্ত হবার কিছু নেই। মা আমাকে দেখতে পেয়েছেন এখন দুত তার শারীরিক সমস্যা কেটে যেতে শুরু করবে। তিনি বিছানায় উঠে বসে রণরঙ্গিনী মূর্তি ধারণ করবেন। কঠিন কঠিন সব কথা হাউইয়ের মত মার মুখ থেকে বের হয়ে আমার দিকে ছুটে আসবে। যুদ্ধ প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই আমি চোখে মুখে পানি দিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে রাখছি।
কোথায় গিয়েছিলি?
কাছেই একটা বাড়িতে।
আমিতো পুরো এলাকা চষে ফেলেছি–তোকেতো দেখি নি।
ভাল মত চষ নি। চষলে পেতে।
তোর সঙ্গে ঐ হারামজাদাটা ছিল–সেলিম?
হ্যাঁ এই হারামজাদাটা অবশ্যি ছিল।
তুই কি জানিস ইউনিটে তোকে নিয়ে ছিঃ ছিঃ পড়ে গেছে।
ছিঃ ছিঃ পড়ার কী আছে? আমি একজনকে নিয়ে বেড়াতে বের হতে পারব না?
যার তার সঙ্গে বের হয়ে যাবি? একটা জোয়ান ছেলের সঙ্গে তোর বয়সী একটা মেয়ে যদি বের হয় তাহলে সবাই কী ভেবে নেয় তুই জানিস?
কী ভেবে নেয়?
যা ভাবার তাই ভাবে?
সেই তাইটা কী?
মা দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বললেন, সবাই ভাবে ছেলেটা তোকে নিয়ে গেছে পাট ক্ষেতে।
পাট ক্ষেত দেখতে নিয়ে যাওয়াটা কি মা খুব দোষনীয় কিছু?
ন্যাকা সাজবি না। আমার সঙ্গে ন্যাকা সেজে পার পাবি না। বদ মেয়ে কোথাকার।
এত জোরে চিৎকার করো না মা ভোকাল কর্ড নষ্ট হয়ে যাবে। বাকি জীবন হাঁসের মত ফ্যাস ফ্যাস করতে হবে।
তুই এতক্ষণ ধরে মুখ ধুচ্ছিস কেন?
আমি হাসলাম। বেসিনের উপরে পারা নষ্ট হয়ে যাওয়া আয়না বসানো। সেই আয়নায় সব কিছুই ঢেউ খেলানো দেখায়। আমি আয়নায় দেখলাম একটা মেয়ে ঢেউ খেলানো হাসি হাসছে। আয়নাতেই দেখা যাচ্ছে মা নেমে আসছেন। তিনি ধাক্কা দিয়ে আয়নায় আমার মাথা ঠুকে দেবেন। ঝনঝন শব্দে আয়না ভাঙ্গবে। ভাঙ্গা কাচ ঢুকে যাবে কপালে। অভিনয় করতে হবে কপালে কাটা দাগ নিয়ে। না-কি তিনি বাথরুমের দরজা বন্ধ করে শাস্তির ব্যবস্থা করবেন। ফাঁসির আসামীকে ছোট্ট ঘরে আটকে রাখলে তার কী হয় আমি জানি। আমার যদি কখনো ফাঁসি হয়—তাহলে সলিটারী কনফাইনমেন্টে থাকার সময়টা আমার খুব খারাপ কাটবে না।
মা ঈগলের মত ছুটে আমার কাধ ধরে ফেললেন আর তখনি ঘরে ঢুকলেন পাপিয়া ম্যাডাম। মার মুখ সঙ্গে সঙ্গে হাসি হাসি হয়ে গেল। তাকে দেখে এখন মনে হবে তিনি তার অতি আদরের কন্যার সঙ্গে বাথরুমে কিছু অন্তরঙ্গ আলাপ করছেন। মা বললেন, কেমন আছেন?
পাপিয়া ম্যাডাম বললেন, ভাল।
মা বললেন, মেয়ের মাথার চুল ঠিক করে দিচ্ছিলাম। এমন পাগলী মেয়ে, সারা সকাল কোথায় কোথায় ঘুরেছে— দেখেন না চুলের অবস্থা। একা একাই রওনা হয়েছিল, আমি বললাম, একা যাবি না। সেলিমকে সঙ্গে করে নিয়ে যা।
আমি মার স্ট্র্যাটিজি দেখে হাসলাম। তিনি সবাইকে বলে বেড়াবেন সেলিমকে আমার সঙ্গে পাহারাদার হিসেবে তিনিই পাঠিয়েছেন। আমি নিয়ে যাই নি।
পাপিয়া ম্যাডাম বললেন, বকুল একটু বারান্দায় এসো। আমি বারান্দায় চলে এলাম।
মেয়েকে লেখা চিঠি তোমাকে পড়াব বলেছিলাম— নাও পড়ে দেখ।
বড় বড় অক্ষরে লেখা চিঠি।
মা,
ও আমার মা। আমার সোনা মা, ময়না মা, গয়না মা। কত দিন তোমাকে দেখি না। রাতে যখন ঘুমুতে যাই, আমার পাশে তোমার বালিশটা রেখে দি। বালিশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ঘুমুতে যাই। আমার মনে হয় বালিশে মাথা রেখে তুমি ঘুমুচ্ছ। মা তোমাকে না দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে। আবার আমি তোমাকে কবে দেখব?
তোমার
মা
চিঠি পড়তে পড়তে কেন জানি আমার চোখে পানি এসে গেল। আমি তাকিয়ে দেখি পাপিয়া ম্যাডাম আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন।