৪
দোহার এলাকার মুক্তিযোদ্ধা গাজী আলী হোসেন এসেছিলেন আজাদের মায়ের জানাজায় ৷ সম্পর্কে আজাদের চাচা হন তিনি ৷ ইউনুস চৌধুরীর খালাতো ভাই ৷ আজাদের মা মারা গেছেন শুনে ছুটে এসেছেন ৷ গোরের পাশে যখন তিনি দাঁড়িয়ে, নানা স্মৃতির ভিড়ে তাঁর চোখ ঝাপসা হয়ে আসে ৷ তাঁর মনের ভেতরে বইতে থাকে রোদনধারা ৷ ভাবি আকারে ছিলেন ছোটখাটো, কিন্তু তাঁর হৃদয়টা ছিল অনেক বড় ৷ ইস্কাটনের বাড়িতে আলী হোসেনও থাকতেন ৷ এ রকম আশ্রিত বা অতিথি আরো অনেকেই থাকত বাসায় ৷ আজাদ আর ভাবির সঙ্গে তিনি বহুদিন ক্যারমও খেলেছেন ৷ পরহেজগার মহিলা ছিলেন আজাদের মা ৷ নামাজ-রোজা ঠিকভাবে করতেন ৷ দান-খয়রাত করতেন দু হাতে ৷ বাড়ির সব আত্মীয়স্বজন অনাত্মীয় আশ্রিত প্রতিটা লোকেরই আতিথেয়তা করতেন আন্তরিকতার সঙ্গে ৷
আলী হোসেনের বন্ধুবান্ধবরা খুব একটা এ বাড়িতে আসত না ৷ কিন্তু আলী হোসেনের শখ বন্ধুদের বাড়িটায় আনেন, বাড়িটা বন্ধুরা ঘুরেফিরে দেখুক ৷ এই সুবিশাল আর জাঁকজমকপূর্ণ বাড়িটা তো বাইরের কত লোক শুধু দেখতেই আসে ৷ এই বাড়িতে তিনি থাকেন, সেটা বন্ধুবান্ধবদের একটিবার দেখাতে কি সাধ হয় না! বন্ধুরা বাড়িটাও দেখুক, আর তাঁর ভাবির হাতের রান্না একটু ভালোমন্দ খেয়ে যাক ৷ ওরা তো হলে থাকে, কী খায় না খায় কে জানে!
কথাটা তিনি পাড়েন সাফিয়া বেগমের কাছে, ‘ভাবি, আমার বন্ধুরা তো জানতে চায় আমি কোথায় থাকি, বললাম, ইস্কাটনে ইউনুস চৌধুরীর বাড়িতে, শুনে ওরা বিশ্বাসই করতে চায় না, বলে গুলগাপ্পি বাদ দাও তো ভায়া… কী করি বলেন তো!’
ভাবি বলেন, ‘একদিন নিয়ে আসেন তাদের ৷ কবে আনবেন, আগে থেকে জানাবেন ৷’ আলী হোসেন বন্ধুদের সাঙ্গে আলাপ করে দিনক্ষণ ঠিক করেন ৷ ভাবিকে জানান ৷ ভাবি রান্না করতে পছন্দ করেন খুব ৷ আলীর বন্ধুরা আসবে, এ উপলক্ষ পেয়ে লেগে যান রাঁধতে ৷ কত পদের কত রান্নাই না রাঁধেন ৷ বন্ধুরা আসে ৷ তখন আলী সাফিয়া বেগমকে বলেন, ‘ভাবি, আপনি কি ওদের সামনে একটু আসবেন ?’
সাফিয়া বেগম হেসে বলেন, ‘আমি তো আপনার বন্ধুদের চিনিও না, তাদের সাথে আমার পরিচয়ও হয়নি, কিন্তু আপনি যখন বলছেন, আমি নিশ্চয় তাদের সামনে যাব ৷ আর তা ছাড়া তাদের খাওয়ার তদারকিটাও তো করতে হবে ৷ তুলে না দিলে মেহমানরা কী খাবে না খাবে কে জানে! আমি তাদের তুলে খাওয়াব ৷’
ভাবি সামনে আসেন আলী হোসেনের বন্ধুদের ৷ হেসে হেসে কথা বলেন ৷ বন্ধুরা সহজেই আপন হয়ে যায় তাঁর ৷ তিনি খুব যত্ন করে দেবরের বন্ধুদের পাতে খাবার তুলে তুলে দেন ৷ বন্ধুরা ফিরে যায় মোহিত হয়ে ৷
কিন্তু সবচেয়ে মোহিত হন গাজী আলী হোসেন নিজে, যখন আরেক দিন সাফিয়া বেগম বলেন, ‘বাচ্চু ভাই (আলী হোসেনের ডাকনাম), আপনার বন্ধুদের মাঝে মধ্যে আনবেন ৷ হলে থাকে ৷ বাবা-মার কাছ থেকে কত দূরে ৷ এদের খাওয়াতে পারলে দিলের মধ্যে একটা শান্তি লাগে ৷’
গোরের পাশ থেকে ফিরতে ফিরতে আরো কত কথাই না মনে পড়ে আলী হোসেনের ৷ ইস্কাটনের বাসায় অনেক ফালতু মেহমানও থাকত আশ্রিতের মতো ৷ এদের সবাইকে যে সাফিয়া বেগমের পছন্দ হতে হবে, এমন তো নয় ৷ সবাই পছন্দের ছিলও না হয়তো ৷ আলী হোসেন ছিলেন দেবর, তাঁর ভাবি হিসাবে সাফিয়া বেগম নানা আবদার অত্যাচার সহ্য করতেন ৷ কিন্তু আলী হোসেনের একজন মামা ছিলেন, কাদের, যাঁকে সাফিয়া বেগম ঠিক পছন্দ করতেন না ৷ এটা কাদেরও বুঝতেন, সাফিয়াও যেন বোঝাতে চাইতেন ৷ একদিন আলী হোসেন আর কাদের একসঙ্গে বসেছেন সকালের নাশতা করতে, সাফিয়া বেগম আলী হোসেনের পাতে দুটো ডিমের অমলেট দিলেন, তারপর কাদেরের পাতেও দিলেন দুটো ডিমেরই অমলেট ৷ পরে কাদের বলেন, ‘বুঝলে ভাগ্নে, তোমার ভাবির মনটা অনেক বড় ৷ ছোটলোকি ব্যাপারটাই তার মধ্যে নাই ৷’