ছ’টার একটু আগে মহিমবাবু বিজয়কৃষ্ণকে ডেকে তুললেন। বিজয়বাবু চোখ মেলে খনিকক্ষণ বিহ্বলদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন – তাঁর মনে হচ্ছিল, যন প্রতিদিনের মতো নিজের বাড়িতেই শুয়ে আছেন, এর মধ্যে এ লোকটা এলো কোত্থেকে? একটু পরে তাঁর সব কথা মনে পড়ে গেল, দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি উঠে বসলেন।
বাইরে গাড়ির মধ্যে কুণ্ডলী পাকিয়ে কাঞ্চা ঘুমুচ্ছিল, অনেক ডাকাডাকি করে তাকে জাগানো হল। বিজয়কৃষ্ণ করুণ স্বরে বললেন, “আপনিও চলুন না আমার সঙ্গে, মহিমবাবু।”
বাড়িতে পুলিশ আসবে, এ কথা ভাবতেই বিজয়কৃষ্ণের হাত পা কালিয়ে আসছিল। অত্যন্ত সুখে ও অতি নিশ্চিন্ত আরামে তাঁর এই হয়েছে যে, সামান্য কোনো হাঙ্গামা হলেও তাঁর হৃৎকম্প উপস্থিত হয়। আর এ তো পুলিশ! মহিমবাবু সঙ্গে থাকলে তবু খানিকটা ভরসা পাওয়া যাবে।
মহিমবাবু বললেন, “তুমি না বললেও আমি যেতুম। একটু চা খেয়ে নেওয়া যাক।”
কিন্তু এবারে বিজয়কৃষ্ণকে কিছুতেই খাওয়ানো গেল না। তাঁর মাথা ধরেছে, তাঁর গা বমি বমি করছে, কিছু খাবার কথা তিনি ভাবতেই পারেন না। এক রাত্রের একটু অনিয়মেই তাঁর শরের যেন ভেঙে আসছে! অগত্যা মহিবাবু একাই চা খেয়ে নিলেন, তারপর বেরিয়ে পড়লেন বিজয়কৃষ্ণকে নিয়ে।
রাস্তার মোড়ে মোড়ে ‘কলকাতা হরকরা’র ফেরিওয়ালা জাঁকিয়ে চেঁচাচ্ছে – “হরকরা – হরকরা – পরীক্ষিৎবাবুর অন্তর্ধান – বিখ্যাত ঔপন্যাসিক পরীক্ষিৎবাবুর অন্তর্ধান – জয়ন্তী ভণ্ডুল!” মহিমবাবু গাড়ি থামিয়ে একখানা ‘হরকরা’ কিনলেন। কোলের উপর কাগজটা মেলে ধরে বললেন – “কী একটা কাণ্ডই হল!”
বিজয়কৃষ্ণ শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
কাগজে চোখ বুলোতে বুলোতে মহিমবাবু বলে উঠলেন, “আরে আরে, আর একটা খবর দেখেছ! কাল বিকেলের মধ্যে পরীক্ষিৎকে কেউ যদি উদ্ধার করতে পরে, তাকে দশ হাজার তাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।”
“কে দেবে?” স্তিমিতস্বরে জিজ্যেস করলেন বিজয়কৃষ্ণ।”
“সেটাই তো আরও আশ্চর্য – দেবে লালবিহারী মালাকার। হঠাৎ তাঁর এত উৎসাহ!”
“তা, আপনার কি মনে হয় দাদাকে পাওয়া যাবে?”
“দেখা যাক, পুলিশ কী করতে পারে!”
সারা রাস্তা আর কোনো কথা হল না।
বাড়িতে চাকররা ছাড়া কেউ নেই, বিজয়কৃষ্ণের স্ত্রী ছেলেপুলে নিয়ে কিছুদিনের জন্য বাপের বাড়ি গেছেন। তাঁরা গাড়ি থেকে নামতেই নিমাই ছুটে এল, সে ভেবেছিল, গাড়ি থেকে তার বাবুও বুঝি নামবেন। ছোটবাবুর চেহারা দেখেই সে ব্যাপারটা আঁচ করে নিলে, তারপর ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে কাঁদতে লাগল।
মহিমবাবু তকে ধমক দিয়ে বললেন, “চুপ কর, নিমাই বোকার মতো কেঁদো না।”
বিজয়বাবু উপরে আর গেলেন না, বাইরের ঘরে বসে দু জনে অপেক্ষা করতে লাগলেন। সাতটার একটু পরে পুলিশ এল – ইন্স্পেক্টর রনজিৎ সামন্ত, সঙ্গে দু জন কনেস্টবল। কনেস্টবলদের বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে রণজিৎবাবু ড্রয়িংরুমে এসে ডঃুকলেন। বয়সে চল্লিশের কাছাকাছি, ছিপছিপে সুন্দর চেহারা, ইউনিফর্ম পরা না থাকলে পুলিশ ইন্সপেক্টরের বলে মনে হয় না, বরং কবি টবি বলেই মনে হয়। মহিমবাবু তাঁকে অভ্যর্থনা করে বললেন, “আসুন রণজিৎবাবু।”
“আরে, মহিমবাবু যে!” রণজিৎবাবু হাত তুলে নমস্কার করলেন। “কেমন আছেন?”
নানা ব্যাপারে, নানারকমের কাজের উপলক্ষে মহিমবাবুর সঙ্গে বিস্তর লোকের পরিচয়। তাঁর ‘চ্যাটার্জি ব্যাঙ্ক’ যখন ফেল পড়ে, তখন যে লোক তিন লাখ টাকা ঠকিয়ে তাঁর সর্বনাশ করে, তাকে ধরবার চেষ্টা পুলিশ কিছু কম করে নি, আজও সে লোকটার নামে ওয়ার্যান্ট আছে, কিন্তু আজও সে অজ্ঞাত। রণজিৎ সামন্ত সে সময়ে কেসটা নিয়ে খুব খেটেছিলেন; কিন্তু যে করতে পারেন নি, সেটা তাঁর দোষ নয়। সে কথা রণজিৎবাবুর মনে আছে, মহিমবাবুও ভোলেন নি।
মহিমবাবু বললেন, “বিজয়ভায়া তো এর মধ্যেই একেবারে নেতিয়ে পড়েছে, আমি তাই এলুম যদি কোনো কাজে লাগি।”
“বেশ করেছেন। ইনি?”
“ইনিই বিজয়কৃষ্ণ মজুমদার, পরীক্ষিতের ছোট ভাই।”
“ও! আচ্ছা, এবার ব্যাপারটা শোনা যাক।”
বিজয়বাবু মোটামুটি সমস্ত ঘটনার একটা বিবরণ দিলেন। মহিমবাবুর উপস্থিত থাকার খুবই দরকার ছিল, কারণ তাঁর সাহায্য ছাড়া বিজয়কৃষ্ণ কোনো কথাই ভালো করে বলতে পারতেন না। তিনি আরম্ভ করেন, মহিমবাবু শেষ করেন, তিনি একটু বলতেই মহিমবাবু বিস্তারিত বর্ণনা দেন – এইভাবে সমস্ত কথা ইন্স্পেক্টরের কর্ণগোচর করা হল। ইন্সপেক্টর খাতায় অনেক সব নোট নিলেন, তারপর বললেন, “চলুন বাড়িটা একবার দেখে আসি।”
বাড়ির অন্যান্য ঘরগুলো ইন্সপেক্টর চোখ বুলিয়েই সারলেন, দোতলার পরীক্ষিৎবাবুর শোবার ঘরে এসে কিছু দেরি করলেন। দক্ষিণ পূবে খোলা মস্ত সুন্দর ঘর। খাটে নিভাঁজ বিছানা পাতা, সূক্ষ্ম নেটের মশারি ঝুলছে। কাল সন্ধের পরে নিমাই বিছানা পেতে রেখে গেছে, তারপর এ পর্যন্ত কেউ ডঃোকে নি। রণজিৎবাবু বিছানা উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখলেন, ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার একটু ঘাঁটলেন, কোনোই হদিশ মিলল না। তারপর গেলেন পাশের ঘরে, সেটি পরীক্ষিৎবাবুর লেখাপড়ার ঘর। সাত আট আলমারি বই, প্রকাণ্ড টেবিল, তার উপর কত কাগজপত্র, চিঠি প্রুফ তার অন্ত নেই। রণজিৎবাবু হেসে বললেন, “উনি মানুষটা ভারি আগোছালো তো।”
বিজয়বাবু বললেন, “উনি ওঁর লেখার টেবিলে কাউকেই হাত দিতে দেন না – নিমাইকেও না।”
“তাঁর অনুমতি না নিয়েই আমাকে টেবিলটায় হাত দিতে হচ্ছে,” বলে রণজিৎবাবু কাগজপত্রগুলি নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলেন। “ইস, কত কিছু একসঙ্গে ছড়ানো! দরকারের সময় ঠিক জিনিসটি খুঁজে পান কেমন করে?”
“তাই কি পান নাকি? একদিন একটা হাজার টাকার চেক বাজে কাগজ মনে করে ছিঁড়ে ফেললেন, কি কোনো লেখার পাণ্ডুলিপি ফেলে দিলেন বাজে কাগজের ঝুড়িতে। দরকারি চিঠিপত্র প্রায়ই হারিয়ে যায়, তখন যে কী মুশকিল হয়!”
“তবে সুখের কথা এই যে, আমাদের দরকারি কাগজটি আমরা ঠিক পেয়ে গেছি,” বলে রণজিৎবাবু একতাড়া প্রুফের তলা থেকে একটি কাগজ টেনে বার করলেন।
বিজয়বাবু আর মহিমবাবু একসঙ্গে বলে উথলেন, “কী? কী ওটা?”
রণজিৎবাবু নিঃশব্দে কাগজটা বিজয়বাবুর হাতে দিলেন। বিজয়বাবু একবার চোখ বুলিয়ে হতাশস্বরে বললেন, “ও, এই!”
বিজয়বাবুর কাঁধের উপর দিয়ে মহিমবাবুও কাগজটা পড়ে নিয়েছিলেন। পরীক্ষিৎবাবু মনোগ্রাম করা পুরু সাদা কাগজে একখানা অসমাপ্ত চিঠি, মহিমবাবুকেই লেখা। চিঠিটা এইরকম, “প্রিয় মহিম, তোমার উৎসাহে রাজি হয়েছিলুম, কিন্তু যতই ভাবছি, ততই এই জয়ন্তী ব্যাপারটা আমার খারাপ লাগছে। মন কিছুতেই সায় দিতে চাচ্ছে না। ইচ্ছে হচ্ছে কলকাতা থেকে অনেক দূরে কোথাও পালিয়ে যাই, অভিনন্দন মালাচন্দনের নাগালের বাইরে। তোমার সঙ্গে দেখা হলে…”
এইটুকুই। কোনো তারিখ নেই; চিঠি আরম্ভ করে শেষ করেননি, ফেলে দিতেও ভুলে গেছেন।
রনজিৎবাবু জিজ্যেস করলেন, “এ আপনার দাদার হাতের লেখা তো?”
“সে বিষয়ে কোনো সন্দেহই নে!”
মহিমবাবু বললেন, “কিন্তু এতে কিছুই প্রমাণ হয় না। এরকম চিঠি আমাকে অন্তত দশখানা লিখেছে, আমার বাড়িতে আসেন তো দেখাতে পারি। জয়ন্তীতে ওর একেবারেই মত ছিল না, আমরা জোর করেই এটা করাচ্ছিলাম।”
রণজিৎবাবু বললেন, “চিঠিটা খুব হালের লেখা বলেই মনে হয়। কালকের লেখাও হতে পরে। দেখি বলে, বিজযবাবুর হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে রণজিৎবাবু আলোর দিকে তুলে ধরে দেখলেন, তারপর ভাঁজ করে পকেটে ভরে রাখলেন।
মহিমবাবু বললেন, “হলই বা কালকের লেখা। তাতে কী রহস্যের কোনো সমাধান হয়?”
রনজিৎবাবু বললেন, “তা হতে পরে বই কি! চিঠিটা যে শেষ করেননি তার মানে কী? লিখতে লিখতে হঠাৎ মনে করলেন লিখে লাভ কী, কাজেই করা যাক!”
“তার মনে আপনি বলতে চান, পরীক্ষিৎ নিজে ইচ্ছে করে পালিয়ে গেছে? অভিনন্দন মালাচন্দন এড়াবার জন্যে?”
“তা অসম্ভব কী! কাল রাত ন’টায় প্রিন্সেপ ঘাট থেকে জাপানগামী একখানা জাহাজ ছেড়েছে।”
মহিমবাবু হেসে উঠলেন, “মাপ করবে, আপনার কথা শুনে না হেসে পারলুম না। ছেলেবেলা থেকে আমি পরীক্ষিতের বন্ধু, ওর স্বভাব আমি ভালোই জানি। এ রকম পাগলে মতো কোনো কাজ ও কখনোই করবে না। আর অমন অসংখ্য ছিঠি ও আরভ করে শেষ করে না, তাতে কী হয়েছে? এদিকে প্রিন্সেপ ঘাটে গভীর রত্রে উপেন ধরের ঘোরাঘুরি, বৃন্দাবন গুপ্তের ভিজিটিং কার্ড – এগুলোর মনে কী?”
মহিমবাবু কথা শুনে রণজিৎবাবু একটু যেন লজ্জিত হলেন। “ আচ্ছা, এনকোয়ারি আরম্ভ করা যাক তো? দেখি, ঐ কার্ডটা!”
বিজয়বাবু তাঁর পকেট থেকে কার্ডটা বার করে দিলেন। ইন্সপেক্টর সেটি নিজের পকেটে ভরে বললেন, “চলুন, নীচে যাওয়া যাক!”
নীচে গিয়ে ইন্সপেক্টর চাকরদের সঙ্গে, বিশেষত, নিমাই আর কাঞ্চার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বললেন।
“আচ্ছা বিজয়বাবু, এখন চলি। যা হয়, আপনাদের জানাব। আর হ্যাঁ, মহিমবাবু, আপনার সব এডিটর চঞ্চল নাগের সঙ্গে কথা বলতে চাই।”
“বেশ তো, আমার আপিসে একবার পযের ধুলো দেবেন। একটার সময় সে আপিসে আসে।”
“আমি একটার একটু পরেই যাব।”
“আশা করি, সুখবর নিয়েই যাবেন।”
“এক ঘণ্টার মধ্যেই যে, এ রহস্য ভেদ করে ফেলত পারব, এমন দুরাশা করি নে।”
বিজয়বাবু কাতরস্বরে বললেন, “কালকের মধ্যে তাকে না পাওয়া গেলে তো জয়ন্তীই ভণ্ডুল হবে। উঃ, এতদিনের এত আয়োজন, সব কি ব্যর্থ হবে?”
ইন্সপেক্টর কপাল কুঁচকে বললেন, “তাই তো মনে হচ্ছে।”
রণজিৎবাবু চলে যাওয়ার পর বিজয়বাবু বললেন, “কোনো আশাই তো দেখা যচ্ছে না।”
মহিমবাবু বললেন, “বলে কিনা জাপান পালিয়েছে। ঐরকম বুদ্ধি নিয়ে ঢোকে পুলিশের কাজে? ছোঃ!”
“পুলিশই যদি কিছু না করতে পরে, তবে আর কেউ কি পারবে?”
“তা নিয়ে এমন দুশ্চিন্তা করে লাভ নেই বিজয়! তুমি স্নান করে কিছু খেয়েটেয়ে নাও। ঘাবড়ে যেও না, মনে সাহস রেখ। আমি এখন চলি, কাজ আছে; আবার অসব”খন বিকেলের দিকে।”