৪
মধ্যবয়স্ক এক লোক রান্নাঘর ধোয়ামোছা করছে। মিসির আলি ঘর ঝাঁট দেবার শব্দ পাচ্ছেন, পানি ঢালার শব্দ পাচ্ছেন, ফিনাইলের গন্ধ পাচ্ছেন। তাঁর শোবার ঘরেও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। সব বই সাজিয়ে বুকশেলফে তোলা হয়েছে। বুকশেলফটা নতুন। আগের ভাঙা বেতের বুকশেলফ আপাতত বারান্দায় রাখা হয়েছে। মনে হচ্ছে সেখান থেকে চলে যাবে ডাস্টবিনে।
মিসির আলির খাটের কাছে নতুন একটি সাইডটেবিল দেওয়া হয়েছে। সাইডটেবিলে টেবিলল্যাম্প। টেবিলল্যাম্পের পাশে একটি টেবিলঘড়ি এবং ক্রিস্টালের অ্যাশট্রে।
যে-জায়গায় কয়েকটি কাঠের চেয়ার পেতে বসার ব্যবস্থা ছিল সেখানের পরিবর্তনটা চোখে পড়ার মতো। মেঝেতে কার্পেট বিছানো। দুটা অতি আরামদায়ক গদির চেয়ার। গদির চেয়ার দুটার সামনে একটি দামি রকিং-চেয়ার। এই রকিং-চেয়ারে বর্তমানে দোল খাচ্ছে সায়রা। ঘর ঠিক করার নির্দেশ সে দোল খেতে-খেতেই দিচ্ছে। সায়রার সামনে মিসির আলি বসে আছেন। তিনি বেশ আগ্রহের সঙ্গেই তাঁর ঘরের সংস্কার দেখছেন।
রান্নাঘরের মধ্যবয়স্ক লোকটি ছাড়াও বারো-তেরো বছরের একটি কাজের মেয়েও সায়রা নিয়ে এসেছে। মেয়েটি অতি কর্মঠ। তার নাম নাসরিন। সে মনে হয় কথা বলে না। মিসির আলি এখন পর্যন্ত তার মুখ থেকে একটি শব্দও শোনেন নি।
সায়রা বলল, আপনি কি একদিনের জন্য বাসাটা ছাড়তে পারবেন?
মিসির আলি বললেন, কেন ছাড়তে হবে?
সায়রা বলল, আমি আপনার বাসা ডিসটেম্পার করাব। দরজা-জানালায় নতুন পরদা লাগানো হবে। তার জন্য কিছু কাঠের কাজ করতে হবে।
মিসির আলি বললেন, ও আচ্ছা।
সায়রা বলল, আমি অনেক চিন্তা করে দেখলাম আপনাকে যদি গিফট হিসেবে কোনো অ্যাপার্টমেন্ট দেওয়াও হয় আপনি সেখানে যাবেন না। আপনি থাকবেন আপনার একরুমের ঘরে। কাজেই যেখানে আছেন সেটা ঠিক করে দেওয়া ভালো না?
মিসির আলি বলল, হুঁ ভালো।
আমি নাসরিনকে রেখে যাচ্ছি। সে ঘরদুয়ার পরিষ্কার করে রাখবে। আপনার জন্য রান্না করবে। নাসরিন মেয়েটি কথা বলে না তবে খুব কাজের। তার রান্নাও ভালো। সপ্তাহে আপনি একদিন বাজার করবেন। সেই বাজারও নাসরিন করবে। আপনাকে বাজারে যেতে হবে না। আপনার জন্য বারো সিএফটির একটা ফ্রিজ কেনা হয়েছে। একটা মাইক্রোওয়েভ ওভেন কেনা হয়েছে। ইলেকট্রিশিয়ান এসে কানেকশন ঠিক করে দেবে।
মিসির আলি ‘হুঁ’ বলে মাথা ঝাঁকালেন। এই মাথা ঝাঁকানোর অর্থ সম্ভবত আচ্ছা ঠিক আছে।
সায়রা বলল, আপনার বাসায় ইলেকট্রিক লাইন এইসব গ্যাজেটসের উপযুক্ত বলে মনে হচ্ছে না। ইলেকট্রিশিয়ান মূল লাইনটাও বদলাবে। কারণ আপনার বাসায় দুই টনের একটা এসি বসবে। এসি আপনার জন্য না। আমার জন্য। এসি ছাড়া ঘরে আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারি না। আমি যেহেতু মাঝে মধ্যে আপনার কাছে আসব, আপনার সঙ্গে কিছু সময় কাটাব—আমাকে শান্তিমতো বসতে হবে, তাই না?
মিসির আলি বললেন, সারাক্ষণ এসিতে থাকার এই অভ্যাস তোমার নিশ্চয়ই বিয়ের পর হয়েছে?
সায়রা বলল, হ্যাঁ বিয়ের পর হয়েছে। আমার স্বামী এদেশের অতি ধনবান মানুষদের একজন। তাঁর কী পরিমাণ টাকা আছে তা মনে হয় তিনি নিজেও জানেন না।
তিনি কি বর্তমানে অসুস্থ?
সায়রা একটু চমকাল। চমক সামলে নিয়ে সহজভাবে বলল, তিনি অসুস্থ আপনার এমন ধারণা কেন হল?
এমনি বললাম।
না আপনি এমনি বলেন নি। চিন্তাভাবনা ছাড়া আপনি কথা বলেন না।
তোমার কাজের মেয়েটিকে দেখে আমার ধারণা হয়েছে। এই মেয়ে ঘর ঝাঁট দেবার সময় এমনভাবে ঝাঁট দিচ্ছিল যেন কোনো শব্দ না হয়। পা ফেলছিল অতি সাবধানে। তার চিন্তা-চেতনায় এটা পরিষ্কার যে কোনোরকম শব্দ করা যাবে না। তার মানে হল এই মেয়েটি যেখানে কাজ করে সেখানে একজন অসুস্থ মানুষ আছে যে শব্দ সহ্য করতে পারে না।
সেই অসুস্থ মানুষ আমার স্বামী না হয়ে শাশুড়িও হতে পারতেন।
তা পারতেন।
তা হলে কেন বললেন, তোমার স্বামী কি অসুস্থ? কেন বললেন না, তোমার শাশুড়ি কি অসুস্থ?
মিসির আলি হেসে ফেললেন। সায়রা বলল, না, আপনি হাসবেন না। আপনি আমার প্রশ্নের জবাব দিন। আমি আপনার কাছ থেকে জবাবটা চাচ্ছি।
কেন চাচ্ছ?
আপনি যে-পদ্ধতিতে রহস্যের সমাধান করেন সেই পদ্ধতিটা জানতে চাই। শিখতে চাই।
মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, সায়রা শোন, আমি যা করি তা হল লজিকে ত্রুটি আছে কি না সেটা প্রথমে দেখি। যখন ত্রুটি ধরা পড়ে তখন ত্রুটিটা কেন হল সেটা নিয়ে ভাবি। তারপর লক্ষ করি আচরণগত ত্রুটি।
সেটা কী?
যেমন ধর কোনো একজন মানুষ খুব হাসিখুশি। হঠাৎ-হঠাৎ তার সেই হাসিখুশি ভাবটা নষ্ট হয়। এটাই তার আচরণগত ত্রুটি।
আপনি আর কী দেখেন?
আর দেখি যে কথা বলে সে কতটা সত্য কথা বলে। মানুষ আল আমিন না। একমাত্র আমাদের প্রফেট আল আমিন হতে পেরেছেন, আমরা বাকি সবাই মিথ্যা বলি। এই মিথ্যাও আবার দু রকম।
দুই রকম মিথ্যা মানে?
একটা মিথ্যা হল সরাসরি মিথ্যা। আরেক ধরনের মিথ্যা আছে যে-মিথ্যাকে মিথ্যা বলা যাবে না।
মানে কী?
মানে হচ্ছে, মনে কর তুমি একটা মিথ্যা কথা বলছ, তুমি ভেবে নিচ্ছ এটা সত্যি। এই ধরনের মিথ্যা মানুষ বলে কম, লেখে বেশি।
আপনি আমার লেখা কতটুকু পড়েছেন?
এক চ্যাপ্টার।
পড়তে কেমন লাগছে?
ভালো।
বেশ ভালো না মোটামুটি ভালো?
বেশ ভালো।
বেশ ভালো যদি হয় তা হলে এক চ্যাপ্টার পড়েই পড়া থামিয়ে দিয়েছেন কেন?
আমার কিছু খটকা আছে। খটকা দূর হবার পর দ্বিতীয় চ্যাপ্টার পড়ব বলে ঠিক করেছি।
বলুন কী খটকা?
তুমি লিখেছ HBO-তে সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস দেখেছ। যখনকার কথা বলছ তখন এই ছবি তৈরি হয় নি। তুমি তোমার লেখায় মিথ্যা ঢুকিয়েছ। একটা মিথ্যা যখন ঢুকিয়েছ তখন ধরে নিতে হবে আরো মিথ্যা ঢুকিয়েছ। আমার কাছে এই লেখা উপন্যাস হিসেবে ঠিক আছে। কিন্তু তোমার ব্যক্তিগত লেখা যা পড়ে আমি তোমার সমস্যা ধরতে পারব এবং সমস্যার সমাধান করব সেই লেখা এটা না।
আপনি ভুল ধরলে আমি ঠিক করে দেব।
সব ভুল তো ধরতে পারব না।
ভুল কিন্তু নেই। সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস-এর ব্যাপারটা বলি—সেই রাতে আমরা একটা ভূতের ছবি দেখি। ছবিটা যথেষ্ট ভয়ের ছিল, আমরা দুই বোনই খুব ভয় পেয়েছিলাম। আমি যখন লেখা শুরু করি তখন আর ভূতের ছবির নাম মনে করতে পারছিলাম না। সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস ছবিটা তার কয়েকদিন আগেই দেখেছি সেই নামটা দিয়ে দিয়েছি। এতে কি বড় কোনো সমস্যা হয়েছে?
আমার জন্য সমস্যা। ছোটখাটো বিষয়গুলো আমার জন্য খুব জরুরি। ভালো কথা, তুমি কি প্রায়ই ভূতের ছবি দেখ?
হ্যাঁ।
দুই বোনই ভূতের ছবি দেখতে পছন্দ কর?
হ্যাঁ।
তোমার বাবা যখন বললেন ইবলিশ শয়তান তাঁর সঙ্গে কথা বলেছে সেটা বিশ্বাস করেছ?
হ্যাঁ, কারণ বাবা কখনো মিথ্যা কথা বলেন না। আর কিছু জানতে চান?
তোমার বাবা কি বেঁচে আছেন?
হ্যাঁ বেঁচে আছেন।
আগের মতোই ধর্মকর্ম নিয়ে আছেন?
হ্যাঁ।
উনি তোমার সঙ্গে থাকেন, তাই না?
হ্যাঁ, উনি আমার সঙ্গে থাকেন। এই বয়সে বাবা নিশ্চয়ই একা একা থাকবেন না। আপনার কী করে ধারণা হল উনি আমার সঙ্গে থাকেন?
আন্দাজে বলছি। তাঁর দুই মেয়ে। একজন মারা গেছে আরেকজন বেঁচে আছে। তিনি জীবিত মেয়ের সঙ্গে বাস করবেন এটাই তো স্বাভাবিক।
আপনি একটু আগে বলেছেন আপনি শুধু প্রথম চ্যাপ্টার পড়েছেন। ইথেন যে মারা গেছে এটা আমি শেষের দিকে লিখেছি। তার মানে কিন্তু এই দাঁড়ায় যে আপনি পুরো লেখা পড়েছেন কিন্তু বলছেন প্রথম চ্যাপ্টার পড়েছেন।
মিসির আলি শান্ত গলায় বললেন, আমি প্রথম চ্যাপ্টারই শুধু পড়েছি। প্রথম চ্যাপ্টার পড়লেই কিন্তু বোঝা যায় যে-বোন সম্পর্কে তুমি লিখছ সেই বোন বেঁচে নেই।
আপনার কথা স্বীকার করে নিলাম। আপনি আর কী জানতে চান?
এই মুহূর্তে আমি আর কিছু জানতে চাচ্ছি না। তবে তোমার বাবার সঙ্গে দেখা করতে চাই।
বাবার সঙ্গে আমি আপনাকে দেখা করতে দেব না। কেন দেব না তাও আপনি জানতে চাইবেন না।
মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন—ঠিক আছে।
.
রাত এগারোটা। মিসির আলির সারা শরীরে আরামদায়ক আলস্য। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। খোলা জানালায় হাওয়া আসছে। মিসির আলির গায়ের উপর চাদর। চাদর গলা পর্যন্ত টেনে দিলে আরাম হত, তাতে বই পড়ার অসুবিধা। হাত চলে যাবে চাদরের ভেতর। আজ অবিশ্যি তিনি বই পড়বেন না। সায়রা বানুর লেখা আত্মজীবনীর ২য় অধ্যায় পড়বেন। চোখ যেভাবে ভারী হয়ে এসেছে বেশি দূর পড়তে পারবেন বলেও মনে হচ্ছে না।
দরজা ধরে নাসরিন মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগেই তাকে বলেছেন, মাগো, তুমি শুয়ে পড়। বেশিরভাগ সময়ই নাসরিন নামটা তাঁর মনে আসে না। তখন বলেন ‘মাগো’। কাজের মেয়েকে মাগো বলা সম্ভবত উচিত না। তিনি কিন্তু আন্তরিকভাবেই বলেন। মিসির আলির ধারণা তাঁর নিজের কোনো মেয়ে থাকলে সে তাঁকে যতটা যত্ন করত এই মেয়ে তার চেয়ে অনেক বেশি যত্ন করে। আজ রাতের খাবারের কথাই ধরা যাক। রাতে রান্না হয়েছে গরুর মাংস এবং চালের আটার রুটি। তিনি যাতে গরম-গরম রুটি খেতে পারেন তার জন্য তাঁকে রান্নাঘরে খেতে বসতে হয়েছে। নাসরিন একটা-একটা করে রুটি সেকে তাঁর পাতে দিয়েছে। এ ধরনের আদরযত্নের কোনো মানে হয় না।
মিসির আলি খাতা খুললেন। আর তখনই নাসরিন বলল, খালুজান আর কিছু লাগব? মিসির আলি বললেন, মাগো আর কিছু লাগবে না। তুমি শুয়ে পড়
নাসরিন সঙ্গে সঙ্গে দরজার আড়ালে সরে গেল। এই বুড়ো মানুষটা যতবার তাকে মাগো ডাকে ততবারই নাসরিনের চোখে পানি এসে যায়। সে তার চোখের পানি কাউকে দেখাতে চায় না।
নাসরিন দরজার আড়াল থেকে বের হয়ে এসে বলল, খালুজান সুপারি খাইবেন? সুপারি দেই? পান-সুপারি আইন্যা রাখছি।
মিসির আলি বললেন, পান-সুপারি তো আমি খাই না মা। আচ্ছা ঠিক আছে এনেছ যখন দাও।
নাসরিন পান-সুপারি এনে দিল। মিসির আলি বললেন, আমাকে খালুজান ডাকা তোমার ঠিক না। খালার স্বামী হল খালু। আমি বিয়ে করি নি।
নাসরিন বলল, আমি আপনেরে খালুজানই ডাকব।
মিসির আলি বললেন, ঠিক আছে ডেক। তুমি কি লিখতে-পড়তে জান?
নাসরিন না-সূচক মাথা নাড়ল।
মিসির আলি বললেন, আমি তোমাকে লেখাপড়া শেখাব। তোমার বুদ্ধি আছে, তুমি অতি দ্রুত লেখাপড়া শিখতে পারবে। এখন যাও গো মা শুয়ে পড়। কেউ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে আমি পড়তে পারি না।
নাসরিন সরে গেল কিন্তু ঘুমাতে গেল না। সাবধানে মোড়া টেনে দরজার পাশে বসল। এখান থেকে বুড়ো মানুষটাকে দেখা যায়। এই তো উনি পড়া শুরু করেছেন—
মিসির আলি খাতার পাতা উল্টালেন। শুরুতেই লেখা—
(দ্বিতীয় অধ্যায়)
‘দ্বিতীয় অধ্যায়’ বাক্যটা শুধু বাংলায়। বাকিটা আগের মতোই ইংরেজিতে।
যে ইবলিশ শয়তান নিয়ে বাবার এত সাবধানতা সেই ইবলিশ শয়তানকে আমি একদিন দেখলাম। লম্বা কালো ভয়ংকর রোগা। তার গায়ে নীল রঙের শার্ট। দীর্ঘদিন জ্বরে ভুগলে যেমন হয় তেমন চেহারা। চোখ পশুদের চোখের মতো জ্বলজ্বলে।
ঘটনাটা বলি।
বাড়িতে শুধু আমরা দুই বোন। বাবা বাড়িতে নেই। বৃহস্পতিবার রাতে তিনি বাড়িতে থাকেন না। তিনি তাঁর পীর সাহেবের কাছে যান। পীর সাহেব তাকে নিয়ে সারা রাত জিগির করেন।
আমরা খালি বাড়িতে যেন ভয় না পাই সেজন্য বাবার কলেজের একজন পিয়ন আমাদের সঙ্গে থাকে। পিয়নের নাম ইসমাইল। ইসমাইলের রাতকানা রোগ আছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার দিকে সে বাড়িতে আসে। এসেই বসার ঘরের সোফায় চাদর গায়ে ঘুমিয়ে পড়ে। তার ঘুম ভাঙে পরদিন সকালে। রাতের খাবারের জন্য একবার তার ঘুম ভাঙানো হয়।
আমার লেখা খানিকটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আগেরটা পরে পরেরটা আগে লিখে ফেলছি। ইবলিশ শয়তানকে আমার আগে দেখেছে ইথেন। তার গল্পটা আগে বলা উচিত। আমার অভিজ্ঞতা পরে বলছি। এক বৃহস্পতিবার রাতে ইথেন চিরুনি হাতে আমার সামনে বসতে-বসতে বলল, আপা তোর সাহস কেমন?
আমি বললাম, সাহস ভালো।
ইথেন বলল, তোর ভালো সাহস হওয়া দরকার। সাহস কম হলে তুই বিপদে পড়বি। প্রতি বৃহস্পতিবার বাবা চলে যাবে জিগির করতে। তুই থাকবি একা
আমি বললাম, একা থাকব কেন? তুই তো আছিস।
ইথেন বলল, আমি তো থাকব না। আমি মারা যাব। পেটের বাচ্চা খালাস করতে গিয়ে মারা যাব। কিংবা তারও আগে ইবলিশ শয়তান আমাকে মেরে ফেলবে।
আমি বললাম, উদ্ভট কথা আমাকে বলবি না।
ইথেন বলল, আমি কোনো উদ্ভট কথা বলছি না। ইবলিশ শয়তান যে এ বাড়িতে বাস করে এটা আমি জানি। আমি দেখেছি।
কোথায় দেখেছিস?
একবার দেখেছি ছাদে, আরেকবার দেখেছি রান্নাঘরে। সে চেহারা বদলায়। ছাদে যাকে দেখেছি আর রান্নাঘরে যাকে দেখেছি তারা দেখতে দু রকম। একজন ছিল কুচকুচে কালো আরেকজন ধবল কুষ্ঠ রোগীর মতো সাদা।
আমি বললাম, ইথেন তুই আমাকে ভয় দেখাবি না।
ইথেন বলল, ভয় দেখাচ্ছি না। যেটা ঘটেছে সেটা বলছি। পুরোপুরি বলছি। দাঁড়ি- সেমিকোলনসহ।
দরকার নেই।
দরকার আছে। আগে থেকে জানলে সাবধান থাকতে পারবি। নয়তো হঠাৎ দেখে ভয়ে ভবদা মেরে যাবি। আগে ছাদে কী দেখেছি বলি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যাবেলার কথা। সালোয়ার-কামিজ পরেছি ওড়না খুঁজে পাচ্ছি না। হঠাৎ মনে হল আমি ওড়না ছাদে শুকাতে দিয়েছি। শুধু ওড়না না তার সঙ্গে দুটা ব্লাউজ ছিল। পেটিকোট ছিল। আমি ছাদে গেলাম। ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি ঘরের দরজা সব সময় খোলা থাকে সেদিন দেখলাম বন্ধ। দরজায় কোনো তালা নেই। ধাক্কা দিলে খোলার কথা। ধাক্কা দিয়েও খুলতে পারছি না।
আমি ইথেনকে বললাম, সেদিন আমি কোথায় ছিলাম?
ইথেন বলল, তুই তোর ঘরে। তোর জ্বর এসেছিল। তুই চাদর গায়ে দিয়ে শুয়ে ছিলি। মনে পড়েছে?
না মনে পড়ছে না।
ইথেন বলল, দাঁড়া মনে করিয়ে দিচ্ছি। তোর গায়ে অনেক জ্বর তারপরেও বাবা তোকে ফেলে রেখে জিগির করতে চলে গেল। তুই মন খারাপ করলি, এখন মনে পড়ছে?
হুঁ, মনে পড়েছে।
ইথেন বলল, গল্পের মাঝখানে কথা বলবি না। ফ্লো নষ্ট হয়ে যায়। পুরো গল্পটা একবার বলে নেই তারপর যা প্রশ্ন করার করবি। নো ইন্টারাপশান। আমি যেন কোথায় ছিলাম?
সিঁড়ি ঘরের দরজা খুলতে পারছিলি না।
হ্যাঁ সিঁড়ি ঘরের দরজা খুলতে পারছি না। ধাক্কাধাক্কি করছি। একসময় মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। ফিরে আসার জন্য রওনা হয়েছি। সিঁড়ি দিয়ে দু স্টেপ নেমেছি তখন আপনাআপনি দরজা খুলে গেল। ঘটনাটা যে অস্বাভাবিক এটা আমার মনে হল না। আমি খুশি মনে ছাদে গেলাম। ছাদের মাঝামাঝি জায়গায় ইবলিশ শয়তানটা দাঁড়িয়ে ছিল। মিশমিশে কালো। দেখতে মোটামুটি মানুষের মতো। শুধু তার গলাটা অস্বাভাবিক লম্বা। তবে শুরুতেই তার গলার দিকে চোখ গেল না। শুরুতেই যা দেখে কলিজা নড়ে গেল তা হচ্ছে জিনিসটা নগ্ন। তারপর চোখ পড়ল তার গলার দিকে। লম্বা গলার কারণে মাথাটা শরীর থেকে অনেকখানি ঝুঁকে আছে।
নগ্ন মানুষের মতো দেখতে জন্তুটা আমার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করল। আমি আতঙ্কে জমে গেলাম। আমার চিৎকার দেওয়া উচিত। ছাদ থেকে ছুটে নেমে যাওয়া উচিত এইসব কিছুই মনে এল না। আমি তাকিয়ে আছি তো তাকিয়েই আছি।
ভূতপ্রেতের ছবিতে দেখা যায় এরা যখন হাঁটে দ্রুত হাঁটে। বাতাসের উপর দিয়ে ছুটে যায় কিন্তু এই নগ্ন জিনিসটা পা টিপেটিপে হাঁটছে। ছোট বাচ্চারা হাঁটা শিখলে যেভাবে হাঁটে তার হাঁটার ভঙ্গি সেরকম। টলমল করে হাঁটা। যেন তাকে না ধরলে সে এক্ষুনি ধপাস করে পড়ে যাবে। সে যখন আমার কাছাকাছি চলে এল তখন আমার মনে হল আমি করছি কী? আমি কেন দাঁড়িয়ে আছি? তখনই দৌড় দিলাম। পাগলের মতো সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলাম।
ইথেন বড় নিঃশ্বাস ফেলে থামল। আমি বললাম, ঐ নগ্ন জিনিসটা তোর পিছনে- পিছনে আসে নি?
ইথেন বলল, না।
আমি বললাম, তুই বাবাকে এই বিষয়ে কিছু বলেছিলি?
না।
বলিস নি কেন?
আমার ইচ্ছা হয় নি। দ্বিতীয়বার কী দেখলাম বলি?
আজ থাক আরেকদিন শুনব।
ইথেন বলল, বলতে যখন শুরু করেছি আজই বলব। অন্য আরেকদিন হয়তো আমারই বলতে ইচ্ছা করবে না। সেদিনও ছিল বৃহস্পতিবার। বাবা গেছেন জিগির করতে। ঘরে আমরা দুইজন আর বাবার কলেজের পিয়নটা। আমার পেট ব্যথা করছিল বলে রাতে না খেয়ে শুয়ে পড়েছি। অনেক রাতে খিদের জন্য ঘুম ভেঙে গেছে। ফ্রিজে খাবার আছে একটা কিছু খেয়ে নিলেই হয়। আবার মনে হচ্ছে এখন যদি খেতে যাই ঘুম পুরোপুরি ভেঙে যাবে। এপাশ-ওপাশ করে রাত কাটবে। তারচেয়ে চোখ বন্ধ করে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকি। ঘুমিয়ে পড়লে ক্ষুধা টের পাব না। তখন শুনলাম ডাইনিং হলে খুটখাট শব্দ হচ্ছে। কে যেন চেয়ার নাড়াচ্ছে। বেসিনে পানি ঢালার শব্দও হল। আমি উঠে বসলাম। বাতি জ্বালালাম। ঘর থেকে বের হলাম। ডাইনিং হল অন্ধকার। তবে সেখানে যে কেউ আছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। আবার চেয়ার টানার শব্দ হল। আমি ডাইনিং হলের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে পরদা টানলাম। স্পষ্ট দেখলাম আমার দিকে পিছন ফিরে একজন কেউ বসে আছে। তার সামনে একটা প্লেট, প্লেট থেকে খাবার নিয়ে সে খাচ্ছে। আমি বললাম, কে? সে খাওয়া বন্ধ করে আমার দিকে ফিরল। মানুষের মুখের মতো একটা মুখ। শুধু তার চোখ দুটা পশুদের চোখের মতো। পশুদের চোখ যেমন অন্ধকারে জ্বলে তার চোখও অন্ধকারে জ্বলছে। সে আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আবার খেতে শুরু করল। যেন আমার উপস্থিতিতে তার কিছু যায় আসে না। আমি তোকে ডেকে তুললাম এবং বললাম আজ রাতে তোর সঙ্গে ঘুমাব। তোর মনে আছে না?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
এটা কি মনে আছে সারা রাত তোকে ঘুমাতে দেই নি। হাসাহাসি করেছি। গল্পগুজব করেছি। তারপর দিলাম টিভি ছেড়ে। কী যেন একটা হিন্দি ছবিও দেখলাম।
মনে আছে।
পরদিন ভোরে ডাইনিং হলে গিয়ে দেখেছি প্লেট পড়ে আছে। প্লেটে আধ খাওয়া খাবার!
আমি বললাম, কী খাবার?
ইথেন বলল, সাধারণ ভাত-মাছ। ডাল।
আমি বললাম, জিন-ভূত কি ভাত-মাছ খায়?
ইথেন বলল, আমি তো জানি না জিন-ভূত কী খায়। আমি জিন-ভূত না। আমি বললাম, এমন কি হতে পারে না যে ভাত-মাছ-ডাল তুই নিজেই খেয়েছিস। তারপর ঘুমাতে গিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখেছিস।
ইথেন আমার প্রশ্নের জবাব দিল না। তার মুখ দেখে মনে হল আমার কথা সে একেবারে যে অগ্রাহ্য করছে তা না। জিনের খাদ্য কী এই নিয়ে সব সময় তার মাথাব্যথা ছিল। জিন কী খায়, ভূত কী খায় এই নিয়ে বাবাকে প্রায়ই প্রশ্ন করে। বাবা অসম্ভব বিরক্ত হতেন।
বাবা জিনের খাদ্য কী?
বাবা বললেন, জানি না মা।
তুমি এমন ধর্মকর্ম করা মানুষ। তুমি না জানলে কীভাবে হবে?
বাবা বললেন, আমি ধর্মকর্ম করলেও ধর্মের অনেক কিছু জানি না।
ইথেন বলল, যে জানে তার কাছ থেকে জেনে দাও। তোমার পীর সাহেবকে জিজ্ঞেস কর!
বাবা বললেন, এইসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কারো সঙ্গে আলোচনা করতে ভালো লাগে নারে মা।
তুমি তো কারো সঙ্গে আলোচনা কর নি। তুমি বুঝবে কীভাবে আলোচনা করতে ভালো লাগে কি লাগে না?
মাগো বিরক্ত করিস না।
আমার প্রশ্নের জবাব বের না করে দিলে আমি বিরক্ত করেই যাব।
জিনের খাদ্য কী জেনে তুই কী করবি?
ওদের সব খাদ্য যোগাড় করে রাতের বেলা টেবিলে সাজিয়ে রাখব যাতে ওরা এসে খেতে পারে। জিনের খাদ্য নিয়ে আমি একটা বই লিখব বলেও ঠিক করেছি। বইটার নাম হবে—জিনের সুষম খাদ্য। আরেকটা বই লিখব—জিনের খাদ্য ও পুষ্টি। এটা হবে রান্নার বই। সেখানে সব খাবারের রেসিপি দেওয়া থাকবে।
বাবা হতাশ গলায় বললেন, মারে তোর তো মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
ইথেন গম্ভীর গলায় বলল, মাত্র শুরু আরো হবে।
আরো যে হবে আমরা তার লক্ষণ দেখলাম। সে তার কোনো এক টিচারের কাছ থেকে খবর আনল জিনের পছন্দের খাবার মিষ্টি। মিষ্টির দোকানে তারা গভীর রাতে যায়। সব মিষ্টি খেয়ে দাম দিয়ে চলে যায়। যে কারণে গ্রামের অন্য সব দোকান সন্ধ্যার সময় বন্ধ হয়ে গেলেও মিষ্টির দোকানগুলো গভীর রাত পর্যন্ত খোলা থাকে।
ইথেন প্রতি রাতে ঘুমাতে যাবার আগে তেরোটা সন্দেশ একটা থালায় রাখে। তারের জালির ঢাকনা দিয়ে থালাটাকে ঢেকে রাখে যাতে বিড়াল এসে খেতে না পারে। সারা রাত সন্দেশের থালা থাকে ডাইনিং টেবিলে। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই ইথেন সন্দেশ গোনে। তেরোটা সন্দেশই আছে না জিন এসে খেয়ে কমিয়েছে। তেরোটা সন্দেশের রহস্য হল ইথেনের লাকি নাম্বার তেরো। তার জন্ম তারিখ অক্টোবরের তেরো।
সন্দেশ রাখার চতুর্থ দিন ভোরবেলায় হইচই শুরু হল। দেখা গেল সন্দেশ আছে বারোটা। একটা কম। জিন এসে একটা সন্দেশ খেয়ে গেছে। ইথেন আনন্দ এবং উত্তেজনায় লাফাচ্ছে। আমি তার কাছে গিয়ে বললাম, জিন সন্দেশ খেয়েছে বলে আমার মনে হচ্ছে না।
ইথেন বলল, কেন মনে হচ্ছে না।
আমি বললাম, জিনের যেমন মিষ্টিপ্রীতির কথা শুনেছি তারা একটা সন্দেশ খাবে না। কয়েকটা খাবে। সন্দেশ খাবার পর তারা পানি খাবে না। এই জিন সন্দেশ খাবার পর পানি খেয়েছে। সন্দেশের থালার কাছে আধ খাওয়া পানির গ্লাস।
ইথেন মুখ কালো করে বাবার কাছে গেল। থমথমে গলায় বলল, বাবা রাতে তুমি সন্দেশ খেয়েছ?
বাবা বিব্রত গলায় বললেন, একটা সন্দেশ খেয়েছি মা। হঠাৎ ক্ষুধা লাগল।
ইথেন কাঁদতে শুরু করল। বাবা বললেন, কাঁদার কী হয়েছে? বারোটা সন্দেশ তো তোর জিনের জন্য রাখা ছিল।
ইথেন সারা দিন কিছু খেল না। সেই রাতে দেখা গেল-বারোটা সন্দেশের একটাও নেই। কেউ এসে খেয়ে গিয়েছে।
তার পরের সপ্তাহেই আমি জিন বা শয়তান বা ইবলিশকে দেখলাম। তার সঙ্গে কথা বললাম। এই বিষয়টি আমি বিস্তারিত বর্ণনা করব।
শ্রাবণ মাস। বৃহস্পতিবার রাত। বৃষ্টি শুরু হয়েছে সন্ধ্যা থেকে। শ্রাবণ মাসের টিপটিপ বৃষ্টি না। আষাঢ় মাসের ঝমঝমা বৃষ্টি। ঝমঝমা বৃষ্টি হলেই ইথেনের বৃষ্টিতে ভেজার শখ হয়। তার পাল্লায় পড়ে আমিও বৃষ্টিতে গোসল করেছি। পানি বরফের মতো ঠাণ্ডা। আমার ঠাণ্ডার ধাত। সামান্য ঠাণ্ডা লাগলেই টনসিল ফোলে। জ্বর এসে যায়। আমরা গোসল করছি ছাদে। আমার ইচ্ছা খানিকক্ষণ ভিজেই উঠে পড়ব। ইথেন আমাকে ছাড়ল না। যতবার উঠতে যাই সে আমাকে জাপটে ধরে রাখে। প্রায় এক ঘণ্টা বৃষ্টিতে ভিজলাম। আমার টনসিল ফুলে গেল। জ্বর এসে গেল। রাতে জ্বর বাড়ল। জ্বরের সঙ্গে তীব্র মাথাব্যথা। ইথেনের কাছে মাথাব্যথার ট্যাবলেট আছে। আমি দরজা খুললাম। ইথেনের কাছ থেকে ট্যাবলেট নেব এবং রাতে তার সঙ্গে ঘুমাব। অসুখবিসুখ হলে আমি একা ঘুমাতে পারি না।
বারান্দায় এসে আমি থমকে দাঁড়ালাম। শার্ট-প্যান্ট পরা এক লোক বারান্দার বেতের চেয়ারে বসে আছে। বসে আছে ঠিক না খবরের কাগজ পড়ছে। লোকটার চোখে ভারী চশমা। চুল সুন্দর করে আঁচড়ানো। শান্ত ভদ্র চেহারা। চেহারা দেখে মন হল তাকে আগে কোথায় যেন দেখেছি।
রাত বাজে দুটা। এত রাতে কেউ গম্ভীর ভঙ্গিতে খবরের কাগজ পড়ে না। আমি বললাম, আপনি কে?
লোকটা খবরের কাগজ ভাঁজ করে পাশের চেয়ারে রাখতে রাখতে বলল, আপনি ভালো আছেন? লোকটার গলার স্বর মিষ্টি। কথা বলার ভঙ্গিতে কোনো আড়ষ্টতা নেই। যেন আমি তার পূর্ব-পরিচিত। তাকে দেখাচ্ছিল পূর্ব-পরিচিতের মতোই। আমি আবারো বললাম, আপনি কে?
লোকটি বলল, বসুন তারপর বলছি।
আমি বললাম, আমি কি আপনাকে চিনি? আগে কখনো আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছে?
লোকটি বলল, অবশ্যই দেখা হয়েছে। আমি ইবলিশ শয়তান। বলেই লোকটা হাসল। তখনি বুঝলাম আমি স্বপ্ন দেখছি। ইবলিশ শয়তান সেজেগুজে রাত দুটার সময় আমাদের বাড়ির বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়বে না। শুরুতে যে ভয়টা পেয়েছিলাম সেটা কেটে গেল। আমি বললাম, ইবলিশ শয়তান আপনি ভালো আছেন?
সে বলল, মিথু দাঁড়িয়ে আছ কেন? বোসো।
আমি আবার চমকালাম। আমার নাম মিথেন কিন্তু একজন মানুষ আমাকে মিথু ডাকত। যখন ক্লাস নাইনে পড়তাম তখন আমার একজন প্রাইভেট মাস্টার ছিলেন। আমাকে অঙ্ক করাতেন। তাঁর নাম রকিব। আমি যাকে ইবলিশ শয়তান ভাবছি সে আসলে রকিব স্যার।
মিথু আমাকে চিনতে পারছ? আমরা শয়তানরা নানান রূপ ধরতে পারি। আমি তোমার অতি প্রিয় একজনের রূপ ধরে এসেছি।
আমি বললাম, রকিব স্যার কখনোই আমার অতি প্রিয় একজন ছিলেন না।
অবশ্যই ছিলেন। তোমার মনে নেই একদিন পড়াতে-পড়াতে তিনি হঠাৎ টেবিলের নিচে তোমার পায়ের উপর পা তুলে দিলেন। তুমি কিন্তু আঁতকে উঠে পা সরিয়ে নাও নি। চুপ করেই সারাক্ষণ বসে ছিলে। রকিব স্যার সারাক্ষণ পা দিয়ে পা ঘষেছেন। হা হা হা।
আমি বললাম, আমি পা সরিয়ে নেই নি এটা ঠিক। সরিয়ে নেই নি কারণ আমি তাঁকে লজ্জা দিতে চাই নি। আপনি এত কিছু যখন জানেন তখন আপনার জানা থাকা উচিত যে সেই দিনই ছিল রকিব স্যারের কাছে আমার শেষ পড়া। আমি এরপর তাঁর কাছে আর পড়ি নি।
রেগে যাচ্ছ কেন মিথু?
আমাকে মিথু বলে ডাকবেন না।
আচ্ছা যাও ডাকব না। বসো গল্প করি।
আপনার সঙ্গে আমার গল্প করার কোনো ইচ্ছা নেই।
ইচ্ছা না থাকলেও তোমাকে গল্প শুনতে হবে। এখন আর তোমার আলাদা ইচ্ছা বলে কিছু নেই। আমার ইচ্ছাই তোমার ইচ্ছা। বসতে বলছি বস
আমি বসলাম। লোকটা বলল, কী নিয়ে গল্প করা যায় বলো তো? আমি জবাব দিলাম না। লোকটা আমার দিকে ঝুঁকে এসে বলল, জটিল বিষয় নিয়ে কথা বলার আগে কিছুক্ষণ সাধারণ বিষয় নিয়ে কথা বলি যেমন জিনের খাদ্য। তোমার বোনের ধারণা জিনরা মিষ্টি খায়। ধারণা ঠিক না। তারা মানুষ যে-অর্থে খাদ্য গ্রহণ করে সেই অর্থে খাদ্য গ্রহণ করে না। তোমরা মানুষরা মাছ-মাংস, কার্বোহাইড্রেট, স্নেহ জাতীয় পদার্থ কত কিছু খাও। গাছ খায় শুধু পানি এবং সূর্যের আলো। কিছু কিছু ক্যাকটাস গোত্রের গাছ পানিও খায় না। সূর্যের আলোই তাদের জন্য যথেষ্ট। তোমরা মানুষরা যেমন একটা স্পেসিস, গাছও তেমন একটা স্পেসিস। একই পৃথিবীতে বাস করছ অথচ কী বিরাট পার্থক্য। জিন সম্পূর্ণ আলাদা একটা স্পেসিস। এই ব্যাপারটা তোমার বোনকে বুঝতে হবে। মানুষের মানদণ্ডে তাদের বিচার করা যাবে না।
আমি বললাম, আপনার কথা কি শেষ হয়েছে নাকি আরো কিছু বলবেন?
জ্ঞান বিতরণ অনুষ্ঠান শেষ এখন সন্দেহ বিতরণ অনুষ্ঠান।
তার মানে?
ইবলিশের কাজ কী? ইবলিশের কাজ মানুষের মনে সন্দেহের বীজ ঢুকিয়ে দেওয়া। মানুষের মন সন্দেহের বীজের জন্য অতি আদর্শ জমি। অতি উর্বর। কোনোরকমে একটি সন্দেহের বীজ ঢুকিয়ে দিতে পারলে আর দেখতে হবে না। কিছু দিনের মধ্যেই সেই বীজ থেকে চারা হবে। দেখতে-দেখতে সেই চারা পত্রপল্লবে শোভিত হয়ে বিরাট মহীরুহ।
আপনি সন্দেহের কোন বীজ ঢুকাতে চান?
তোমার মা বিষয়ক সন্দেহ বীজ।
মানে?
মিথু মন দিয়ে শোন—
তোমার মা কি ধর্মকর্ম করতেন? নামাজ-রোজা? বলো, ‘না’। কারণ আমি জানি এর উত্তর, ‘না’।
না।
মৃত্যুর পর তাঁর যে কবর হয়েছে তোমরা দুই বোন সেই কবর জিয়ারত করতে গিয়েছ? বলো—’না’। কারণ এর উত্তর যে না সেটা আমি জানি।
কবর জিয়ারত করতে আমরা যাই নি। কারণ তাঁর কবর হয়েছে বগুড়ার এক গ্রামে। সারিয়াকান্দি। অনেক দূরের ব্যাপার।
তার যে কবর হয়েছে এই বিষয়ে কি তোমরা নিশ্চিত? তোমরা কী তোমার মাকে কবর দিতে দেখেছ?
আমরা দেখি নি। বাবা ডেডবডি নিয়ে একা গেছেন। তখন আমরা দুই বোনই অসুস্থ ছিলাম। ইথেনের ঠাণ্ডা লেগে নিউমোনিয়া হয়েছিল।
তোমাদের মার দিকের কোনো আত্মীয়স্বজন কখনো তোমাদের বাড়িতে এসেছিলেন? বলো—’না’। কারণ এই প্রশ্নের উত্তরও না। আমি জানি।
না।
এখন দুইয়ে দুইয়ে চার মিলালে কেমন হয়? আমি যদি বলি তোমাদের আদর্শ পিতা একটি হিন্দু মেয়েকে ভাগিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। সেই হিন্দু মেয়ে তার ধর্ম ত্যাগ করে নি। কাজেই তাদের বিবাহ হয় নি। অর্থাৎ তোমরা দুই বোন জারজ সন্তান। হা হা হা।
হাসবেন না।
হাসব না কেন? মজার ব্যাপার না? অতি ধার্মিক বাবা দুই জারজ কন্যা নিয়ে ঘুরঘুর করছে। এর মধ্যে একজন আবার সন্তানসম্ভবা। সেই সন্তানও একই জিনিস। জারজে জারজে ধুল পরিমাণ। হা হা হা।
লোকটা হাসছে। হাসির সঙ্গে সঙ্গে তার চেহারা বদলে যাচ্ছে। গায়ের রঙ কালো হয়ে যাচ্ছে। দাঁত বের হয়ে আসছে। চুল হয়ে যাচ্ছে লালচে এবং লোকটার গা থেকে অদ্ভুত এক ধরনের গন্ধ আসতে শুরু করেছে। গন্ধটা পরিচিত তবে আমি ধরতে পারছি না। লোকটা বলল, তুমি কি কোনো গন্ধ পাচ্ছ? নিশ্চয়ই পাচ্ছ। তুমি ভাবছ গন্ধটা আমার শরীর থেকে আসছে। তা না, গন্ধ আসছে তুলসী গাছ থেকে। তুলসীর গন্ধ। তোমার মা টবে তুলসী গাছ লাগিয়েছিলেন। হিন্দু মহিলার বাড়িতে তুলসী গাছ থাকবে না তা কি হয়? আচ্ছা তোমরা তুলসী গাছে ঠিকমতো ‘জল’ দাও। পানি না বলে ‘জল’ বলছি লক্ষ করছ? হা হা হা। মিথু তোমার সঙ্গে কথা বলে বড়ই আরাম পাচ্ছি। বোল হরি হরি বোল। মিথু শোন আমি এখন বিদায় হচ্ছি। আবার আসব। আসতেই থাকব। তোমার শিক্ষকের তোমাকে যেমন পছন্দ হয়েছিল আমারও হয়েছে। পরেরবার আমি তোমার শিক্ষকের মতো পা দিয়ে ঘষাঘষি করব। ঠিক আছে লক্ষ্মী সোনা চাঁদের কণা।
আমি বললাম, আমি যা দেখছি সবই স্বপ্ন। আপনি দূর হন।
তুমি না বললেও দূর হয়ে যাব। দেহধারণ করে বেশিক্ষণ থাকতে পারি না। তবে তুমি যা দেখছ সবই স্বপ্ন এটা কিন্তু ঠিক না। স্বপ্নে মানুষ গন্ধ পায় না। তুমি গন্ধ পেয়েছ। পবিত্র তুলসীর গন্ধ। সবই যদি স্বপ্ন হয় তা হলে গন্ধটা আসে কোত্থেকে! যাবার আগে একটা প্রশ্ন তোমার বোনের পেট খালাসের কী করেছ? দেরি হয়ে যাচ্ছে তো। ব্যবস্থা এখনই নেওয়া দরকার। তুমি বললে আমি নিজেও চেষ্টা নিতে পারি। ছাদ থেকে নিচে ফেলে দিতে পারি। তবে মানুষ মেরে আমি আনন্দ পাই না। মানুষ খেলিয়ে আরাম পাই। মরে যাওয়া মানে শেষ। আর তাকে দিয়ে খেলানো যাবে না। যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিনই সে খেলবে। খেলা দেখব আনন্দ পাব। আনন্দ পাব হাসব। হা হা হা।
.
হাসির শব্দে আমার ঘুম ভাঙল। আমি বুঝলাম এতক্ষণ যা দেখেছি সবই স্বপ্ন। তবে পুরোপুরি স্বপ্নও বোধ হয় না। ঘরে তুলসীর গন্ধ। আমার মা বড় দুটা টবে তুলসী গাছ লাগিয়েছিলেন। গাছ দুটা খুব ভালো হয়েছে। ঝুপড়ির মতো হয়েছে।
এই ঘটনার ঠিক এক সপ্তাহ পরের ঘটনা, সেদিনও বৃহস্পতিবার। বাবা যথারীতি জিগিরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মাগরিবের নামাজ পড়ে চলে যাবেন ফিরবেন পরদিন ফজরের নামাজের পর। সন্ধ্যা হয় হয় করছে। ইথেন দুটা মগ হাতে আমার কাছে এসে বলল, আপা চল তো। আমি বললাম, কোথায়?
ইথেন বলল, ছাদে। সন্ধ্যাবেলা ছাদে বসে চা খেতে আমার ভালো লাগে। একা যেতে ভয়-ভয় লাগে তুইও চল।
আমি বললাম, না।
ইথেন বলল, তোকে যেতেই হবে।
ইথেন কিছু বলবে আর তা করবে না তা কখনো হয় না। তার কাছ থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। আমাকে ছাদে যেতে হল। আমাদের বাড়ির ছাদটা সুন্দর। মা বাগানের শখ ছিল। ছাদে বাগান করেছিলেন। বিশাল সাইজের টবে দেশী ফুল গাছ। কামিনী, গন্ধরাজ, বেলি। কয়েক রকমের বাগান বিলাসও আছে। এর মধ্যে একটার পাতা হালকা নীল রঙের। এই গাছটা নাকি তিনি আসামের শীলচর থেকে আনিয়েছিলেন। ছাদের বাগান খুব সুন্দর লাগছিল। বাগান বিলাসের তিন চার রকম রঙ। বেলি ফুলের সিজন না বলে বেলি ফুল নেই। বেলি ফুল যখন ফুটত’ তখন মা প্রতিদিন সন্ধ্যায় ছাদের বাগানে বসে থাকত।
আমরা দুই বোন বসে চা খাচ্ছি। ইথেনকে হাসিখুশি লাগছে। সে অবিশ্যি এমনিতেই হাসিখুশি তবে সেদিন তাকে অস্বাভাবিক উৎফুল্ল লাগছিল। সে বলল, আপা তোকে মজার একটা খবর দিতে পারি। দেব? আমি বললাম, না। ইথেনের মজার খবর মানেই হল উদ্ভট কিছু যা শুনলে মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে। ইথেন বলল, তোকে আমি ছাদে নিয়ে এসেছি মজার খবরটা দেওয়ার জন্য। খবরটা হল আমাদের মা ছিলেন হিন্দু ব্রাহ্মণ। মার নাম রমা গঙ্গোপাধ্যায়।
আমি বললাম, তোকে কে বলেছে?
ইথেন বলল, আমাকে কেউ কিছু বলে নি। আমি নিজেই মহিলা শার্লক হোমসের মতো বের করেছি। তালা ভেঙে পুরোনো ট্রাঙ্ক ঘাঁটাঘাঁটি করে অনেক কিছু পেয়েছি। বাবার হাতের লেখা দশটা চিঠি। সব চিঠির সম্বোধন—রমা। ইনিয়েবিনিয়ে লেখা ইষ্টিমিষ্টি চিঠি। বাবার লেখা প্রেমপত্র পড়ার মজাই অন্য রকম। আপা তুই পড়বি? আমি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি।
আমি বললাম, না।
ইথেন বলল, পড়লে তোর ভালো লাগবে। একটু কড়া মিষ্টি। তোর বানানো চায়ের মতো বেশি মিষ্টি।
আমি বললাম, ট্রাঙ্ক ঘেঁটে এইসব গোপন চিঠিপত্র বের করা কি ঠিক?
ইথেন বলল, ঠিক না। কিন্তু আমরা তো সব সময় ঠিক কাজটা করি না। মাঝে মধ্যে বেঠিক কাজ করি। তবে আপা তুই আমার দিকে এত কঠিন চোখে তাকাস না। এতক্ষণ তোর সঙ্গে মিথ্যা কথা বলেছি। আমি ট্রাঙ্কের তালা ভেঙে কোনো তথ্য বের করি নি। আমাকে যা বলার বলেছে ইবলিশ শয়তান এবং আমার ধারণা ইবলিশের কথা ঠিক। আমরা এই বাড়িতে মোটামুটি সত্যবাদী একজন ইবলিশ পেয়েছি।
ইবলিশ যে সত্যি কথা বলেছে তার প্রমাণ কী?
প্রমাণ বাবা স্বয়ং। আমি তাকে শক্ত করে ধরেছিলাম। তিনি খকখক করে কাশতে- কাশতে সব বলে দিয়েছেন। বাবা আসলে আমাকে ভয় পায়।
তুই ভয় পাওয়ার মতোই মেয়ে।
অবশ্যই। ইবলিশ নিজেও আমাকে ভয় পায়। আমাকে ডাকে ছোট আপা। হি হি হি।
তোকে ছোট আপা ডাকে?
হুঁ। আমিও তাকে ছোট ভাইয়ের মতো দেখি। গল্পগুজব করি। একটা মজার ব্যাপার জান আপা? শয়তানের সব গল্প কিন্তু শিক্ষামূলক। ঈশপের গল্পের মতো। গল্পের শেষে মোরাল থাকে। শয়তানের একটা গল্প তোমাকে বলব আপা? যদি মজা না পাও তা হলে আমি আমার নিজের নাম বদলে ফরমালডিহাইড রাখব। আপা ফরমালডিহাইডের ফর্মুলা HCHO না?
আমি উঠে দাঁড়ালাম। ইথেন বলল, আপা চলে যাচ্ছিস? সন্ধ্যাটা মিলাক। সন্ধ্যা মিলাবার সময় একটা মজা হবে। মজাটা দেখে যা।
কী মজা হবে?
মা ছাদের যে জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে নিচে লাফ দিয়ে পড়েছিল আমি ঠিক সেই জায়গা থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ব। তোদের সমস্যার সমাধান করে দিয়ে যাব। আমার পেটের বাচ্চা নিয়ে তোদের চিন্তায় অস্থির হতে হবে না। আমি ইবলিশ ভাইজানের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করেছি। ভাইজান বলেছেন—ছোট আপা একটা ভালো বুদ্ধি। হি হি হি।
ইথেনের সঙ্গে এই প্রসঙ্গে কথা বলার অর্থ হয় না। আজান পড়ে গেছে আমি মাগরিবের নামাজ পড়ার জন্য নিচে নামলাম। সবেমাত্র জায়নামাজে দাঁড়িয়েছি— ধুপ করে শব্দ হল। ইথেন ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ল।
যেহেতু অস্বাভাবিক মৃত্যু ইথেনের সুরতহাল হয়েছিল। তার পেটে কোনো সন্তান ছিল না। পেটে সন্তানের পুরো বিষয়টাই ছিল তার বানানো।