ভাইকাউন্টের চারটে ইঞ্জিন গর্জন করে উঠল। পাখাগুলো বন-বন করে ঘুরতে শুরু করল। তারপর কোনো ফাঁকে প্লেনটা পালামের মাটি ছেড়ে উড়তে শুরু করল। কাবুলের ইন্ডিয়ান এম্বাসীর সেকেন্ড সেক্রেটারি-ডেজিগনেট তরুণ সেনগুপ্তর মনটাও হঠাৎ উড়তে শুরু করল অতীত আকাশের কোলে।…
সেই কোনো সুদূর অতীতে আর্যরা এই পথ দিয়েই এসেছিলেন ভারতবর্ষে। কোথা থেকে এসেছিলেন, কে জানে। কেউ বলেন, পামির থেকে, কেউ বলেন, মধ্য ইউরোপ বা জার্মানী থেকে। মানব সভ্যতার প্রায় আদিমতম সুপ্রভাত আর্যরা আফগানিস্থানে বসেই লিখেছিলেন বেদঋগ্বেদ। কলকাতার রাস্তায় ওই পাগড়ী পরা কাবুলীওয়ালাদের দেখে বিশ্বাস করা কঠিন যে, এঁদের ঘরের দাওয়ায় বসে আমাদের আর ওঁদের পূর্বপুরুষ লিখেছিলেন বেদ। ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে আর্যদের কথা, আমাদের পূর্বপুরুষদের কাহিনি। সভ্য আর্যদের বংশধর বলে গর্ব অনুভব করি আমরা কিন্তু বাইরের জগতে আর্য বলে প্রচার করতে কত কুণ্ঠা আমাদের। আর ওই কাবুলীরা? মুসলমান আফগানরা? সারা দুনিয়ার সামনে বুক ফুলিয়ে বলেন ওরা আর্য। ওদের যেসব বিমান সারা বিশ্বে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার পরিচয়পত্রে বড় বড় হরফে লেখা আছে আরিয়ানা আফগান এয়ারলাইন্স। কাবুলের সব চাইতে প্রাচীন সরকারি হোটেলের নাম, হোটেল আরিয়ানা।….
ভাইকাউন্টের ডিম্বাকৃতি বড় জানলা দিয়ে তরুণ আর একবার নিচের দিকে তাকায়। কত গিরি-পর্বত নদী-নালা মাঠ-ঘাট পেরিয়ে এই পথ দিয়েই এসেছেন ইতিহাসের কত অসংখ্য নায়ক। আলেকজান্ডার, ইবন বতুতা, মহম্মদ ঘোরী, তৈমুর, বাবর ও আরো কত কে। এসেছিলেন কনিষ্ক, এসেছিলেন চীনা পরিব্রাজকের দল। মার্কোপোলো পর্যন্ত লিখে গেছেন এই পথের কথা। হিমালয়ের এই অলিগলি ডিঙিয়েই আফগানিস্থান থেকে ভগবান বুদ্ধের বাণী ছড়িয়েছিল চীনে, জাপানে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আরো কত দেশে।
উল্টো-পাল্টা, ছোট-বড়, সাদা-কালো মেঘের মধ্য দিয়ে ছুটে চলেছে ভাইকাউন্টটা। তরুণের চিন্তার ধারাটাও ওলট-পালট হয়ে যায় মাঝে মাঝে। তাতে কি আসে যায়? তাতে কি ইতিহাসের গুরুত্ব কমে? নাকি কম রোমাঞ্চ লাগে? ইরাণের বিখ্যাত কবি তো বলে গেছেন, মা যি আঘাষ যি আনজাম-ই জাহান বে-খবর-ইম, আওয়াল-ও-আখের ই-ই কুহনা কেতাব উতাদ আস্ত। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের ইতিকথার প্রথম ও শেষ পাতাটাই খোয়া গেছে, তাই তো আদি-অন্তের হিসেব-নিকেশ পাওয়াই দুষ্কর। ভাইকাউন্টের জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে উল্টো-পাল্টা চিন্তা করতে করতে সান্ত্বনা পায় তরুণ।
মিঃ যোগীকে টোকিও থেকে কাবুলে বদলি করা হয়েছিল। বদলির অর্ডার পাবার পর প্রায় মূৰ্ছা যাবার উপক্রম। টোকিও থেকে কাবুল! বোয়িং সেভেন-জিরো-সেভেন চড়ার পর সাইকেল রিকশা। কমপ্যাশনেট গ্রাউন্ডে যোগীসাহেব আপীল করলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে, স্ত্রীর স্বাস্থ্য, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া গোল্লায় যাবে। দোহাই আপনাদের।
শুধু যোগীসাহেব নয়, ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসের অনেকেরই এই মনোভাব। লন্ডন, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, প্যারিস, রোম বা টোকিও ছাড়া সারা দুনিয়াটা যেন মনুষ্য-বাসের অনুপযুক্ত। মস্কো বা ইউরোপের অন্য কোনো রাজধানীতে খুব জোর দু-তিন বছরের একটা টার্ম চললেও চলতে পারে, কিন্তু তাই বলে এশিয়া আফ্রিকায়? কল্পনা করতে পারেন না এঁরা। কিছু কিছু ইন্ডিয়ান আছেন যাঁরা অতীত দিনের প্রভুদের সমাজে মর্যাদা পাবার লোভে অথবা যৌবনের কোনো দুর্বল মুহূর্তে শ্বেতাঙ্গিনীকে জীবন-সঙ্গিনীরূপে গ্রহণ করেছেন। এখন এসব মেমসাহেবের দল মাইশোর সিল্কের শাড়ি পরেন, ইন্ডিপেনডেন্স ডে রিসেপশনের সময় স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে নমসটে করেন সত্য, কিন্তু ইন্ডিয়াতে থাকার কথা ভাবতেও ওদের গাটা শিউরে ওঠে। কি বিশ্রী ফ্লাইজ! মসকুইটো! বেগার! নেকেড সাধুস!
বরিশাল ঝালকাঠির পোলা হয়েও সরকারসাহেব এমনি এক মেমসাহেবের খপ্পরে পড়ে এক নাগাড়ে যোল বছর ইন্ডিয়ার বাইরে বাইরেই কাটিয়ে দিলেন। ইন্ডিয়ার নন-অ্যালাইনমেন্ট ও অ্যাফররা এশিয়ান প্রেমের নীতি রক্ষা করার জন্য একবার দুবছরের জন্য কলম্বো ছিলেন। ব্যস! সরকারসাহেব সাউথ ব্লকে এসে প্রাইম মিনিস্টারের ঘরটা চিনলেও ফরেন সেক্রেটারির ঘরে যেতে হলে বেয়ারা-চাপরাশীদের জিজ্ঞাসা না করে পারবেন না।
সরকারসাহেবের কথা তরুণ জানে। প্রথম প্রথম বিশ্বাস করত না। ফরেন মিনিস্ট্রির মোটা মোটা নিয়ম-কানুনের বইতে ছাপার অক্ষরে লেখা আছে, তিন বছর পর বদলি হতে হবে। একই রিজিয়নে পরপর পোস্টিং হবে না। দুটো টার্মের বেশি একসঙ্গে বিদেশে থাকা চলবে না এবং আরো কত কি। কিছু ডিপ্লোম্যাট ডিপ্লোম্যাসি করেন, কিছু ডিপ্লোম্যাট তৈল মর্দন করেন, কিছু আবার কাশ্মীরে শ্বশুরবাড়ি বলে এসব নিয়মকে এড়িয়ে চলছেন বেশ হাসিমুখে।
কেন মিঃ জোহর? বাইশ বছরই বিদেশে। মাঝে মাঝে তাজমহল দেখার জন্য সরকারি পয়সায় ইন্ডিয়া আসেন কিন্তু ইন্ডিয়াতে পোস্টিং? জোহরসাহেবকে সে কথা বলার সাহসও কারুর নেই, কেউ বলেন, মিসেস জোহরের স্বর্গত পিতা আর ফরেন মিনিস্টারি নাকি বন্ধু ছিলেন। কেউ বলেন, ওসব বাজে কথা। ফরেন সেক্রেটারির ছেলেকে জোহরসাহেব নিজের কাছে ভি-আই-পি সমাদরে রেখে ব্যারিস্টারি পড়িয়েছেন বলেই…। কেউ আবার ফিসফাস করেন, মিসেস জোহর এককালের নামকরা অভিনেত্রী। এখনও বহুজন তার সাহচর্যে দু এক পেগ স্কচ পেলে ধন্য মনে করেন।
নানা মুনির নানা মত। কোনোটা সত্য কোনোটা মিথ্যা তা তরুণ জানে না। জানতে চায়ও। তবে সে বেশ বুঝতে পারে অন্তঃসলিলা ফন্তুর মতো জোহরসাহেবের কিছু আভার গ্রাউন্ড কানেকশন আছে। আমাদের টপ এ-ওয়ান অ্যাম্বাসেডররা পর্যন্ত মিঃ ও মিসেস জোহরকে যেভাবে মর্যাদা দেন, মেলামেশা করেন, তা দেখে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই।
যাকগে সেসব। যোগীর অত হাই কানেকশনস নেই। তবে তৈল মর্দন! জাপানী ট্রানজিস্টার, হংকং-এ ফ্রি পোর্ট তো আছে।
ইন্দুরকার তিন বছরের জন্যে কাবুল গিয়েছিল। ছবছর পরেও বদলি হতে চায়নি সে। ইন্দুরকার তরুণের সমসাময়িক, একই ব্যাচের ছেলে ওরা। দুজনের মধ্যে যথেষ্ট বন্ধুত্ব। দুজনে পৃথিবীর প্রান্তে থাকলেও নিয়মিত চিঠিপত্রের আদান-প্রদান চলে। ছাত্রজীবনে ইতিহাস পড়ে নয়, ইন্দুরকারের চিঠি পড়েই আফগানিস্থান সম্পর্কে তরুণের মনে গভীর আগ্রহ জন্মায়। তাই তো অনেক দিন আগে একবার সুযোগ মতো এক জয়েন্ট সেক্রেটারিকে বলেছিল, স্যার, শুনেছি কাটমা-কাবুলে অনেকেই পোস্টিং চান না। আই উইল বী গ্ল্যাড ইফ আই গেট এ চান্স টু সার্ভ দেয়ার।
জয়েন্ট সেক্রেটারি মনে রেখেছিলেন তরুণের অনুরোধ। তাই তো মিনিস্ট্রির ট্রান্সফার-পোস্টিং কমিটির মিটিং-এ যোগীর আপীলের বিষয় উঠতেই তরুণের নাম উঠল।
যোগীর বদলে কাবুল চলেছে তরুণ সেনগুপ্ত। হিন্দুকুশ দেখবে, বামিয়ানে পৃথিবীর বৃহত্তম বুদ্ধমূর্তি দেখবে, গজনী যাবে, কান্দাহার যাবে। আরো কত কি দেখবে সে। খুব খুশি। তারপর আছে বীণাদি!
মে আই হ্যাভ ইওর অ্যাটেনশন প্লিজ!
ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ভাইকাউন্ট এসে গেল কাবুল।
বিমান থেকে বেরিয়ে আসতেই ফার্স্ট সেক্রেটারি মিঃ মেটাকে দেখে অবাক হয়ে গেল তরুণ। হাজার হোক সিনিয়র অফিসার! কৃতজ্ঞতা জানাল বারবার, সো কাইভ অফ ইউ…
ডোন্ট বী টু ফরম্যাল টরুণ! তুমি আসছ আর আমি এয়ারপোর্টে আসব না?
থার্ড সেক্রেটারি, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ও কমার্শিয়াল অ্যাটাচি এবং আরো তিন-চারজন। এসেছিলেন অভ্যর্থনা জানাতে। আলাপ-পরিচয় হলো সবার সঙ্গে।
যারা দেশ-বিদেশ ঘুরে থাকেন তারা এয়ারপোর্ট দেখেই সেই দেশ সম্পর্কে বেশ একটা ধারণা করে নিতে পারেন। লন্ডন ও নিউইয়র্ক-দুটি এয়ারপোর্টই বিরাট ও অত্যন্ত কর্মচঞ্চল এবং আধুনিকতমও বটে। তবু বেশ বোঝা যায় যে, দুটি দেশের মাঝখানে রয়েছে অ্যাটলান্টিক! ফ্রাঙ্কফুর্ট ও মস্কো এয়ারপোর্টও বিরাট ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক মুহূর্ত দেখলেই দুটি দেশের জনজীবন সম্পর্কে একটা ধারণা করতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হয় না।
মস্কোর তুলনায় কাবুল এয়ারপোর্ট অনেক ছোট হলেও বেশ সুন্দর। রাশিয়ার সাহায্যে তৈরি কাবুল এয়ারপোর্ট বড় প্রাণহীন। তবুও ভালো লাগল তরুণের। দাঁড়িয়েই মনে পড়ল দমদম, পালাম…কোনো তুলনাই হয় না।
এম্বাসি থেকে তরুণের জন্য কোয়ার্টার ঠিক করা হয়েছিল কিন্তু মিঃ সেটা কিছুতেই ছাড়লেন না। বীণা উইল কিল মী, যদি তোমাকে বাড়ি না নিয়ে যাই।
তরুণ এয়ারপোর্ট বিল্ডিং থেকে বেরুবার সময় হাসতে হাসতে বললো, দ্যাট আই নো। তবে কি জানেন, একবার বীণাদির খাতির যত্ন পেতে শুরু করলে কি আর কোনোদিন নিজের কোয়ার্টারে যাব?
অ্যাড অ্যাটাচি ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগ নিয়ে চান্সেরীতে চলে গেলেন। অন্যান্যদের কেউ চান্সেরী, কেউ বাড়ি গেলেন।
পাখতুনিস্থান অ্যাভিনিউ ধরে মিঃ মেটার গাড়িতে যেতে যেতে তরুণের মনে পড়ল অনেক দিন আগেকার কথা।-বীণাদি আর তরুণ একই সঙ্গে নতুন জীবন শুরু করেছিল। বিয়ের পর বীণাদি যেদিন মিঃ মেটার সংসার করা শুরু করেন, তরুণও সেইদিন প্রথম ফরেন পোস্টিং পেয়ে কাজ শুরু করে। একই প্লেনে দুজনে দিল্লি থেকে রোম গিয়েছিল কিন্তু তখন পরিচয় ছিল না। রোম এয়ারপোর্টে মিঃ মেটা একই সঙ্গে দুজনকে অভ্যর্থনা করেন।
ফরেন সার্ভিসের অফিসার বা তাদের পরিবারকে নিয়ে সাধারণ মানুষের বিচিত্র ধারণা। অনেকের ধারণা ওরা বোধ হয় দিনরাত্রি কেবল মদ খান, চরিত্র বলে কোনো পদার্থ ওদের নেই। সমাজ সংসারের বন্ধুহীন এই মেয়েপুরুষরা শুধু ফুর্তি করেই দিন কাটায়। কথাটা যে সর্বৈব মিথ্যা নয়, তা তরুণ বা বীণাদি জানে। কিন্তু তাই বলে কি ওরা মানুষ নয়? ফরেন। সার্ভিসের অফিসার বা তাদের পরিবারের লোকজন তো রক্ত-মাংসের মানুষ। তাদের হৃদপিণ্ড আছে মন আছে; আছে দয়া-মায়া-ভালোবাসা। আর আছে মনুষ্যত্ব।
একে সৌরাষ্ট্রের মানুষ, তারপর ভবনগর রাজ কলেজের ভূতপূর্ব লেকচারার। মিঃ মেটা নিতান্তই একজন শান্তশিষ্ট ভদ্রলোক। কিন্তু রোমের হাওয়া আর ইতালির মাটি কেমন যেন সবাইকে চঞ্চল করে তোলে। তারপর বীণাদির মতো সুন্দরী ও বিদুষী ভার্যা! মিঃ মেটা সত্যিই চঞ্চল হয়ে উঠলেন। মারলোত বা মার্টিনীর বোতল উজাড় না করেও মেটাসাহেব বেশ একটু মদির হয়ে উঠলেন। বীণাদিকে কেন্দ্র করে তার স্বামীর এই রোমান্টিক উন্মাদনা তারও নিশ্চয়ই ভালো লাগতো। হাজার হোক কাকারিয়া লেক-অ্যাপলো বন্দর থেকে ভূমধ্যসাগরের পাড়ে ইউরোপের আনন্দ-উৎসবের অন্যতম প্রাণবিন্দুতে এসে মিঃ মেটার মতো স্বামী পেলে যে কোনো ভারতীয় মেয়ের পক্ষেই অমন হওয়া স্বাভাবিক।
উইক-এন্ডে দুজনে মিলে ঘুরে বেড়ালেন ফ্লোরেন্স, সান মারিনো, ভেনিস, জেনোয়া, মিলান, পাড়ুয়া ও পিসা আরো কত জায়গা। চললেন আল্পসে, ভেসে বেড়ালেন সমুদ্র।
তারপর একদিন বীণাদিই বললেন, চলুন মিঃ সেনগুপ্ত ক্যাপরু বেড়িয়ে আসি।
তরুণ মনে মনে হাসে বীণাদির আকস্মিক পরিবর্তনে। বুদ্ধিমান কূটনীতিবিদ। একটু চিন্তা করেই কারণটা খুঁজে পায়। ইতালির মানুষ জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করতে চায়। আমেরিকানরা অর্থের নেশায় পাগল; ইংরেজরা কর্তৃত্ব বিস্তার করতে মত্ত, জার্মানরা শক্তিসামর্থ্য দেখাতে ব্যস্ত, কিন্তু ইতালির মানুষ জীবনের সমস্ত রস আহরণ করতে চায়। ছেলে-ছোঁকরা। বুড়ো-বুড়ি যেই হোক, সবাই চায় প্রাণভরে হাসতে, কাঁদতে। শুধু হাসতে-কাঁদতে নয়, পৃথিবীর মধ্যে বোধ করি একমাত্র এরাই পারে প্রাণমন দিয়ে ঝগড়া করতে। দর্শক হতে এরা জানে না, প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় প্রতিটি ঘটনায় এরা অংশ গ্রহণ করবে। রোম বা মিলানের রাস্তায় ট্রাফিক অ্যাকসিডেন্ট হলে এরা কলকাতার মানুষের মতো শুধু ভিড় করে না, মতামত দেয়, ঝগড়া করে মারামারি করে। পরে আবার হাসতে হাসতে দল বেঁধে কোর্ট-কাছারিও যাবে। বিচিত্র এই দেশ। বিচিত্রতর এর মানুষজন। এমন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে সমস্ত অন্তর দিয়ে ঘৃণা করতে, হৃদয়-নিংড়ে চোখের জল ফেলতে আর কেউ পারে না।
বীণাদিও কি এই দেশে এসে এদেরই মতো জীবন-উৎসবে মেতে উঠেছে?
তরুণ ড্রাই মার্টিনির গেলাসে চুমুক দিয়ে একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মিঃ মেটাকে কথাটা বলল। মিঃ মেটা একটু লজ্জিত হলেন। কথার মোড় ঘোরাল তরুণ, ক্যাপরী গিয়ে কি হবে? তার চেয়ে চলুন গ্রান্ডসুইপে গিয়ে গল্প করতে করতে বাদাম চিবুই।
বীণাদি বললেন, বাজে কথা বাদে দিন। মোট কথা জেনে রাখুন, সামনের উইক-এন্ডে আপনি আমাদের সঙ্গে ক্যাপরী যাচ্ছেন।
আত্মসমর্পণ করার আগে তরুণ বলল, অমন রোমান্টিক জায়গায় নিয়ে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? আই অ্যাম গিভিং ইউ দি লাস্ট চান্স টু থিংক ইট ওভার।
নেপলস্-এর পাশে ক্যাপরী দ্বীপে গিয়েছিল ওরা তিনজনে। গান আর কাব্যের খ্যাতিসমৃদ্ধ এই ছোট্ট দ্বীপে গিয়ে আনন্দে মেতে উঠেছিল তিনজনেই। ফুল-পাতায় ভরা ব্লু-গ্রোতোতে ছবি তুলেছে, ছবির মতো সুন্দর অ্যানাক্যাপরী গ্রামে ঘুরেছে, মোগানো খেয়েছে, দড়ির জুতো কিনেছে। কিন্তু শেষে মেরিনা পিকোলো বীচ থেকে ফেরার পথে এক অপ্রত্যাশিত মোটর দুর্ঘটনায় নিদারুণভাবে আহত হলেন মিঃ মেটা।
সে ইতিহাস দীর্ঘ। তবে দুর্ঘটনার ফলে মেটা দম্পতির জীবনে একটা পাকাঁপাকি আসন হলো তরুণের। বীণাদির বিশ্বাস, তরুণের জন্যই মেটাসাহেব সে যাত্রায় রক্ষা পেয়েছেন। বীণাদি তাই কৃতজ্ঞ। মেটাসাহেবও ভুলে যাননি তরুণের সেবা-যত্ন তদ্বির-তদারক।
আর তরুণের? তার রুক্ষ জীবন-প্রান্তরে মেটা-দম্পতি এক পরম নিশ্চিন্ত আশ্রয়। বীণাদিকে সে এয়ারপোর্টে আশা করেনি। নিশ্চিত জানত সে খাবার-দাবার তৈরিতে এত ব্যস্ত থাকবে। যে, এয়ারপোর্টে গিয়ে সময় নষ্ট করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
তরুণকে দেখে বীণাদি যেন হাতে স্বর্গ পেল। তুমি এসে বাঁচালে আমাকে।
কেন বীণাদি?
দুদিন থাকলেই বুঝবে কেন। বীণাদি প্রায় দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললেন।
মিঃ মেটা বললেন, এত তুচ্ছ ব্যাপারে আমাদের কলিগরা নিজেদের ব্যস্ত রাখেন যে বীণা তা টলারেট করতে পারে না!
তরুণ আক্ষেপ করে বলল, এইতো আমাদের রোগ।
পরে লাঞ্চ খাবার সময় বীণাদি বলেছিলেন, জান ভাই, আজ প্রায় তিন মাস বাড়ির বাইরে যাই না বললেই হয়।
কেন?
লন্ডন, নিউইয়র্ক, রোম বা কলম্বোর মতো সোসাইটি বলে কোনো পদার্থ তো এখানে নেই। তোমার দাদার কলিগদের বাড়ি গিয়ে সিঙ্গাপুর থেকে ডিউটি-ফ্রি ইমপোর্টের গল্প আর ভালো লাগে না।
সত্যি, বিচিত্র আমাদের দেশ। বিচিত্রতর হচ্ছে ফরেন সার্ভিসের এক শ্রেণীর অফিসার। শুধু ফরেন সার্ভিস কেন? সব সার্ভিসেস-এরই এক অবস্থা। আজ যেসব আই-সি-এস গভর্নর হয়েও মনে শান্তি পান না, তারা যৌবনে স্বপ্ন দেখতেন ডেপুটি সেক্রেটারি হয়ে রিটায়ার করার। দেড়শো বছরের ইংরেজ রাজত্বের মেয়াদ আর একটু বাড়লেই হয়েছিল আর কি! ওয়েলেসলী-সাজাহান মথুরা রোডের বাংলো চোখে দেখতে হতো না, গোল মার্কেটের আশপাশের কোনো অলিগলিতেই এঁদের ভাবলীলা সাঙ্গ হতো। ফরেন সার্ভিসের সিনিয়রদের জীবনকাহিনি আরো চমকপ্রদ যে পুরী সাহেব স্বপ্ন দেখতেন হাথরাশ বা গোরক্ষপুরের ডেপুটি কমিশনার হয়ে রিটায়ার করার পর ড্রইংরুমে বার লাইব্রেরির ফেয়ারওয়েলের গ্রুপ ফটো টাঙাবেন, তিনি আজ লন্ডন-ওয়াশিংটন মস্কো-টোকিও ছাড়া পোস্টিং নেন না। কেন? উনি যে সাতচল্লিশ সালে ময়ূরের পালক পরে ফরেন সার্ভিসে জয়েন করে আজ টপ এক্সপার্ট।
সেই ডামাডোলের বাজারে আরো কত খাল-বিলের জল ঢুকে গেছে। মাদ্রাজ ক্রিশ্চিয়ান কলেজের কেমিস্ট্রির ডিমোনোস্ট্রেটর, লাহোর হেরল্ড-এর জুনিয়র সাব-এডিটর, আরউইন হাসপাতালের অফিস সুপারিন্টেন্ডেন্ট, কনট প্রেসের ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের ম্যানেজার, কেষ্টনগর কলেজের লাইব্রেরিয়ান ও আরো কত বিচিত্র মানুষ ইমার্জেন্সী রিক্রুটমেন্টে ফরেন সার্ভিসের প্রথম বা দ্বিতীয় সারি দখল করল।
বীণাদির কথায় তরুণ অবাক হয় না। এরা সিঙ্গাপুর থেকে ডিউটি-ফ্রি ইমপোর্টের স্বপ্ন দেখবে, নাকি ভারত-আফগান মৈত্রীকে আরো দৃঢ় করবে?
বীণাদি বলতেন, আফগানিস্থানকে ওরা চিনবে? সে বিদ্যাবুদ্ধি বা ইচ্ছা আছে ওদের?
মিঃ মেটা প্রতিবাদ করতেন, যত বুদ্ধি তোমার আছে।
বীণাদি দুবছর কাবুলে আছেন। শুধু হিন্দুকুশের নতুন চ্যানেলই দেখেনি, ইন্ডিয়ান এম্বাসীর অনেক রথী-মহারথীর দুর্বলতার খবরও তিনি জানেন। তাই তো মুহূর্তের মধ্যে স্বামীর কথায় প্রতিবাদ জানান, তোমাদের মতো বিদ্যা-বুদ্ধি না থাকতে পারে, তবে মন আছে, ইচ্ছা আছে…।
বীণাদি পলিটিক্যাল কাউন্সেলরকে কেন ড্রাই ফুট কাউন্সেলার বলে ঠাট্টা করতেন, তা জানতে তরুণের সময় লাগেনি। কোনো জানাশুনা লোক কাবুল থেকে দিল্লি গেলেই হলো, পলিটিক্যাল কাউন্সেলার পাঁচ কিলো কিসমিস, পাঁচ কিলো ক্যাসুনাট জয়েন্ট সেক্রেটারির বড় মেয়ে পলির জন্য পাঠাবেনই। বেশি দিন এমন কোনো প্যাসেঞ্জার না পেলে প্লেনের পাইলট মারফত কিছু কিছু পাঠিয়েই দিল্লিতে একটা মেসেজ পাঠাবেন, পলি…সাজাহান রোড, নিউদিল্পি…প্লিজ কালেক্ট প্যাকেট পাইলট ফ্লাইট…ফ্লাইডে…।
চান্সেরীর ক্লার্করা তো ওকে ডি এফ সি-ড্রাই ফুট কাউন্সেলার বলেই নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে।
চান্সেরীতে শুধু দিনগত পাপক্ষয় করত তরুণ। কাজ করে আনন্দ পায়নি একটুও। যে চালেরীতে চাঞ্চল্য নেই, উত্তেজনা নেই, কোনো রাজনৈতিক রেষারেষি নেই, সেখানে কি কাজ করে কোনো সত্যিকার ডিপ্লোম্যাট খুশি হয়? পাখতুনিস্থান নিয়ে আফগানিস্থান-পাকিস্তানের রাজনৈতিক লড়াই চলছে। সেই সাতচল্লিশ থেকে পুস্তুভাষী আফগানরা সহ্য করতে পারে না পাকিস্তানকে। আর আফগানিস্থানের শতকরা ষাট-সত্তর জনই হচ্ছে পুস্তুভাষী। তবুও পাকিস্তান কেমন টুকটুক করে নিজেদের কাজ গুছিয়ে নিচ্ছে। আর ইন্ডিয়ান এম্বাসী? স্বয়ং অ্যাম্বাসেডরই যদি উদাসীন হন, যদি ডিপ্লোম্যাটিক রিসেপসনে রাজা বা প্রাইম মিনিস্টারের পাশে দাঁড়িয়ে ফটো তোলাই তাঁর স্বপ্ন ও একমাত্র কাজ হয়, তবে এম্বাসী-চালেরীর অন্যেরা কি করবেন। পাকিস্তান এম্বাসীর প্রচার বিভাগ কেমন ধীরে ধীরে ভারতবর্ষের নামে কলঙ্ক রটাচ্ছে। আর ইন্ডিয়ান এম্বাসীর প্রেস অ্যাটাচির কৃপায় প্যারিস থেকে ছাপান ফ্রেন্টি জার্নাল ও তেহেরানে। ছাপা পারসী ভাষার জার্নালের বান্ডিলগুলো স্টোরের মধ্যেই বন্দী হয়ে পড়ে থাকে। কাবুলের। হোটেলে, রেস্তোরাঁয়, এয়ারপোর্টে-সর্বত্র-পাকিস্তানের কত কি নজরে পড়বে। কাবুল ইউনিভার্সিটির রিডিংরুমে পাকিস্তানী প্রচার পুস্তিকার বন্যা বইছে। কিন্তু কোথাও ভারতবর্ষের কোনো কিছুর টিকিটি পর্যন্ত দেখা যাবে না।
কি করবে তরুণ বা মেটা সাহেব? অসহায় হয়ে চাকরি করে গেছে।
চালেরীর বাইরে কিন্তু প্রাণভরে আনন্দ পেয়েছে, উপভোগ করেছে কাবুলবাসের প্রতিটি মুহূর্ত। এমন স্বাধীনতাপ্রিয় জাত ইতিহাসে বিরল বললেই চলে। সব কিছু বরদাস্ত করবে এরা, বরদাস্ত করবে না অন্য জাতের কর্তৃত্ব। শুধু আজ নয়, কোনো দিনই করেনি। প্রায় হাঁটতে হাঁটতেই দেশ দখল করেছেন আলেকজান্ডার, কিন্তু আফগানিস্থানে এসে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন পাঠানশক্তির মারাত্মক স্বাদ! পরবর্তীকালে শিক্ষা পেয়েছিল সাম্রাজ্যলোভী আরবরা। কেন ইংরেজরা? ঝড়ের বেগে এশিয়া-আফ্রিকার ডজন ডজন দেশ দখল করেছে, উড়িয়েছে। ইউনিয়ন জ্যাক। একবার নয়, দুবার নয়, তিনবার বিরাট ইংরেজ বাহিনীর বিপর্যয় হয়েছে এই পাঠান বীরদের হাতে। যখন সামনা-সামনি পারেনি, তখন রাতের অন্ধকারে লোকচক্ষুর আড়ালে চক্রান্ত করে খিড়কির দরজা দিয়ে কাবুলে সংসার পাততে চেয়েছিল বীরের জাত ইংরেজ। তাও পারেনি।
ইদানীংকালে আফগানিস্থান শত শত কোটি সাহায্য নিচ্ছে আমেরিকা-রাশিয়ার কাছ থেকে, কিন্তু তার জন্য মাথা হেঁট করছে না সে; বরং সাহায্য নিয়ে কৃতার্থ করেছে ওদের। কাবুলে ডিপ্লোম্যাটিক পার্টিতে আফগান সরকারের হেড অ্যাসিস্ট্যান্ট-হেড ক্লার্করাও নিমন্ত্রিত হন এবং তারা না এলে হোস্ট অ্যাম্বাসেডররা দুঃখ পান। তরুণ ভাবে নিজের দেশের কথা। একটা ফিল্ম শো দেখার জন্য ভি-আই-পি-দের কি ব্যাকুলতা।
কলকাতা বা দিল্লিতে আফগানদের নিয়ে কতজনকে হাসি-ঠাট্টা করতে শুনেছে তরুণ। শুনেছে ওরা নাকি পিছিয়ে থাকা মধ্যযুগীয়।
কলকাতা-দিল্লি-বোষের মিল্ক বুথের মতো সারা কাবুলে ছড়িয়ে আছে সরকারি নান-এর দোকান। সরকার লরী ভর্তি আটা পৌঁছে দেয় এইসব দোকানে, কর্মচারীরা তৈরি করেন নান। সেই নান খেয়ে বেঁচে থাকেন কাবুলের চার লক্ষ মানুষ। দীনদুঃখী থেকে প্রাইম মিনিস্টারের বাড়ির ডাইনিং টেবিলে পর্যন্ত এই নান পৌঁছে যায়। কোনো নান-এর ওজন এক তোলা কম হবে না।
তরুণ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, একটুও ওজনের হেরফের হয় না?
সহিদুল্লা খাঁ হেসে ওঠে কথা শুনে।-ওজনের হেরফের হবে কেন?
হাসি থামলে খাঁ সাহেব বললেন, একবার ওজন কম দেবার দায়ে দুজনের ফাঁসি হয়। সেই থেকে…
ফাঁসি?
হ্যাঁ, তাই তো শুনেছি।
কবছর আগের কথা?
তা জানি না। তবে বেশ কিছুকাল আগে।
কিংবদন্তীর মতো এসব কাহিনি ঘরে ঘরে শোনা যায়। সঠিক খবর কেউ জানে না, তবে সবাই জানে ওজন কম দেবার সাহস কারুর নেই। আরো অনেক কিছু জানে ওরা। জানে মাঝরাতে কাবুলের নির্জন পথেও নিঃসঙ্গ অর্ধনগ্ন যুবতীর গায়ে হাত দেবার সাহস কোনো আফগানের নেই। কি বললে? চুরি-ডাকাতি? ডাকাতি করলে জোশন গ্রাউন্ডে শুলে চড়ানো হয়। তরুণ বহুজনকে প্রশ্ন করেছে, আপনি দেখেছেন? কেউ দেখেনি। তবে সবাই জানে শূলে চড়ান
কাবুলের রাস্তায় উর্দীপরা পুলিশ ওয়ারলেস গাড়ি নিয়ে ছুটে বেড়ায় না, অ্যান্টি-করাপশন ডিপার্টমেন্টের কৃতিত্ব সরকারি প্রেস নোটে প্রচার করার অবকাশ নেই আফগানিস্থানে। অনেক দেশের সঙ্গেই তুলনা করতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় তরুণ।
মরুভূমি ও চিরতুষারাবৃত পর্বতের সমন্বয়-ভূমি আফগানিস্থান সত্যি বিচিত্র দেশ। অন্য দেশে সৎ মানুষ খেতে পায় না, কিন্তু অসৎ মানুষ জেলখানায় গিয়ে আহার-বিহার-প্রমোদ করে সরকারি খরচায়। আফগানিস্থানে? যে অসৎ, যে ঘৃণিত তাকে জেলখানায় পাঠায় শাস্তি দেবার জন্য। তাই তো সরকারি কোষাগার শূন্য করে কয়েদীদের সেবা-যত্ন আহার-বিহারের ব্যবস্থা নেই আফগানিস্থানে। কয়েদীদের আহার আসে তার আত্মীয়দের কাছ থেকে। যে কয়েদীর আত্মীয়স্বজন নেই, সে হাতে-পায়ে হাতকড়া পরে শুক্রবারে শুক্রবারে ভিক্ষা করবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে এবং সেই ভিক্ষার পয়সায় তার দিন গুজরান হবে। এ ব্যবস্থা ভালো কি মন্দ, তা জানে না তরুণ। তবে জানে এর পেছনে যুক্তি আছে, কারণ আছে।
স্নিগ্ধ-রুক্ষ প্রকৃতির সন্তান আফগানরাও শান্ত, কখনও অশান্ত; কখনও সৌজন্য-ভদ্রতার প্রতীক, কখনও নির্মম পাষাণ। শত্রু নিপাত করে এরা হাসিমুখে। আবার আশ্রয়প্রার্থী চরম শত্রুকেও সন্তান জ্ঞানে সমাদর করে। কিন্তু অপমানের প্রতিশোধ অপমান করেই নেবে, রামধনু গেয়ে নয়।
হঠাৎ ট্রান্সফার অর্ডার পেয়ে কাবুল ছাড়তে যেন তরুণের কষ্টই হচ্ছিল। সে রাত্রে সব কিছু একসঙ্গে মনে পড়ল। বছরের প্রথম তুষারপাতের সময় আফগানদের মতো বরফি খেলার। সময় কি মজাই না হয়েছিল বীণাদির সঙ্গে।
ফেয়ারওয়েল ডিনারের অতিথিরা একে একে সবাই বিদায় নিলেন। অত বড় ড্রইংরুমের তিন কোণায় তিনটি সোফায় তিনজনে চুপচাপ করে বসে রইলেন কতক্ষণ, কেউ জানে না।
অনেকক্ষণ পর বীণাদি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, তোমার সঙ্গে আমাদের এতটা ঘনিষ্ঠতা না হলেই ভালো হতো! যাদের থাকা না থাকার ঠিকঠিকানা নেই, যারা আজ কাবুলে কাল ক্যালিফোর্নিয়ায় বা কোরিয়ায়, তারা যে কেন মানুষকে ভালোবাসে, আপন করে, তা বুঝি না।
মিঃ মেটা একটু সান্ত্বনা দেন, বছর তিনেকের মধ্যেই আবার যাতে আমরা একই মিশনে থাকতে পারি…।
বীণাদি প্রায় গর্জে উঠলেন, বাজে বক করো না তো! তোমার ওই ধাপ্পাবাজি অনেক শুনেছি।
এবার তরুণ কথা বলে, নিত্য নতুন দেশ দেখছি আর তোমাদের ভালোবাসা পাচ্ছি বলেই তো আমি বেঁচে আছি। নয়তো আমি কি করে বাঁচি বল তো?
এতদিন যে প্রশ্ন অনেক কষ্টে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন, এবার বীণাদি সেই প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, ঢাকার কোনো খবর পেলে?
অতি দুঃখেও তরুণ হাসে। বলে, আর কি খবর পাব? শেষ সর্বনাশের কনফারমেশন?
ছি ছি, ওকথা বলছ কেন?-বীণাদি উঠে এসে তরুণের পাশে দাঁড়িয়ে শান্ত কণ্ঠে সান্ত্বনা জানান।
একটু থেমে আবার বলেন, তুমি তো কোনো অন্যায় করনি তরুণ। দেখবে ভগবানও তোমার প্রতি অন্যায় করবেন না। একদিন তুমি ওকে খুঁজে পাবেই।
পরদিন সকালে কাবুল এয়ারপোর্টে ভাইকাউন্টের চারটে ইঞ্জিন আবার গর্জে উঠল, পাখাগুলো বন বন করে ঘুরে উঠল। ঝাঁপসা চোখেও প্লেনের জানালা দিয়ে তরুণ যেন স্পষ্ট দেখে বীণাদিকে। আর প্লেনের গর্জন স্তব্ধ করে বীণাদির শান্ত কণ্ঠ শুনতে পায়, একদিন তুমি। ওকে খুঁজে পাবেই।