০৪. ভয়াল-ছয় বাহিনীর তিনজন সদস্য

ভয়াল-ছয় বাহিনীর তিনজন সদস্যকে স্কুল গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। তিনজনই অত্যন্ত বিমর্ষ। টুনু একটা ঘাসের ডাটা চিবুচ্ছে। সাজ্জাদ রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে। দলের বাকি সদস্যদেরও এসে পড়ার কথা। কেউ আসছে না। সময় সকাল দশটা। রোদ উঠেছে কড়া। বেশ গরম লাগছে। টুনু বলল, চল ছায়াতে দাড়াই। কেউ জবাব দিল না। ওইদিন টুন কাপুরুষের মতো পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে কেউ তার সঙ্গে কথা বলছে না।

এক জায়গায় এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। তারা পাচিলে উঠে পা ঝুলিয়ে বসল। পাঁচিলে ওঠা নিষেধ। হেড স্যার খুব রাগ করেন। কিন্তু আজ শুক্রবার, স্কুল বন্ধ। হেড স্যারের এদিকে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। যতক্ষণ ইচ্ছা পা ঝুলিয়ে বসে থাকা যাবে। বল্টু হঠাৎ ফিসফিস করে বলল, মুনির আসছে। তিনজনেই তাকাল তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে। মুনির হনহন করে আসছে। তার হাতে কী একটা বই। গল্পের বই নিশ্চয়ই। ওদের দেখতে পেয়েই সে বই শার্টের নিচে লুকিয়ে ফেলল। মুনিরের সঙ্গে ওদের তেমন ভাব নেই। যে ছেলে প্রতি পরীক্ষায় ফার্স্ট হয় তার সঙ্গে কারও ভাব থাকে না। ক্লাস টিচার সোলায়মান স্যারের ধারণা, মুনিরের মতো ভালো ছাত্র এই স্কুলে এর আগে আর ভর্তি হয়নি। পরে হবে না। গত বত্সর স্কুল ম্যাগাজিনে তার একটা ইংরেজি গল্প ছাপা হয়েছে। গল্পের নাম–দি বেগার বয়। হেড স্যার সেই গল্প আবার স্কুল অ্যাসেম্বলীতে পড়ে শুনিয়েছেন এবং বলেছেন, ক্লাস সেভেনের ছেলের ইংরেজি দেখলে? বিএ এমএ পাসরাও এমন লিখতে পারবে না। এর গল্পের মরালটা লক্ষ করবে–যে ছেলে ভিক্ষা করে তার মধ্যেও মনুষ্যত্ব আছে।

মুনির স্কুল গেটের কাছে এসে থমকে দাঁড়াল। সন্দেহভরা গলায় বলল, অ্যাই, তোরা কী করছিস?

কিছু অছি না।

ওয়ালের উপর বসে আছিস কেন? হেড স্যার নিষেধ করেছেন না?

আমরা কারও নিষেধ মানি না।

ও, তোরা তো আবার ভয়াল-ছয়।

ভয়াল-ছয়টা মুনির এমনভাবে বলল যেন খুব একটা হাস্যকর ব্যাপার। সাজ্জাদ চুপ করে বুইল। দলের কথাটা এরকম জানাজানি হলে কী করে কে জানে। মুনির নিষেধ না মানার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই।

না থাকলে নাই। আমরা নিষেধ মানি না।

কোনো নিষেধ মানি না?

না। তোর শার্টের নিচে এটা কী বই?

রাতের আতঙ্ক। এটা আমি কাউকে দিতে পারব না। এখনো পড়া হয়নি।

তোর বই আমরা চাই না।

তারা চুপ করে গেল। মুনির চলে যাচ্ছে না। দাঁড়িয়েই আছে। বল্টু বলল, তুই চলে যা। দাঁড়িয়ে আছিস কেন?

তুই কী করছিস?

আমি যা-ই করি তাতে তোর কী?

মুনির ইতস্তত করে বলল, আমাকে দলে নিলে এই বইটা পড়তে দেব।

সে শার্টের ভেতর থেকে বই বের করল। মোটা একটা বই। মলাটে মুখখাশপরা একটা মানুষের ছবি। তার হাতে পিস্তল। অন্য হাতে লম্বা একটি বর্শা।

কি, নিবি আমাকে দলে?

ভালো ছাত্রদের আমরা দলে নিই না।

কেন? ভালো ছাত্ররা কী দোষ করল?

ভালো ছাত্ররা পড়াশোনা করবে। আমরা পড়াশোনা করব না।

কী করবি তাহলে?

দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াব।

আমিও ঘুরব তোদের সাথে।

মুনিরকেও দেখা গেল দেয়ালের ওপর উঠে বসেছে। ভয় পাওয়া গলায় বলল, পড়ে যাব না তো?

কেউ উত্তর দিল না।

আমাকে দলে নিয়েছিস?

ভেবে দেখি। দলের অন্যরা যদি রাজি হয়।

অন্যরা কখন আসবে?

আসবে এক্ষুনি।

কিন্তু দলের অন্যদের আসার আগেই স্কুলের দপ্তরি কালিপদ এসে বলল, হেড স্যার আপনাদের ডাকে। টুনুর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সাজ্জাদ বিড়বিড় করে বলল, হেড স্যার কোত্থেকে এলেন? কালিপদ তার জবাব দিল না। হাত ইশারা করে দেখাল। হেড স্যার হোস্টেলের বারান্দায় লুঙ্গি পরে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর মুখের ভাব অস্বাভাবিক গম্ভীর।

হেড স্যার প্রথম কিছু সময় কোনো কথাই বললেন না। তারা যে এসে দাঁড়িয়েছে সেটাও যেন চোখে পড়েনি। বেশ কিছুক্ষণ পর মেঘ গর্জন করলেন।

ওয়ালের উপর বসে ছিলি কেন?

কোনো জবাব নেই।

তোর হাতে ওটা কী বই?

রাতের আতঙ্ক।

এসব আজেবাজে বই পড়তে নিষেধ করেছি, মনে নাই?

সবাই চুপচাপ।

তোদের বলি নাই–এখন চারদিকে ঝামেলা হচ্ছে এখন ঘরে বসে থাকবি? পাঠ্যবই পড়বি। ট্রান্সলেশন করবি।

জি স্যার, বলেছেন।

দু বছর পর এসএসসি পরীক্ষা। খেয়াল আছে? শাহজাহান বল তো, রাইনোসেরাস মানে কী?

গণ্ডার স্যার।

রাইনোসেরাস বানান কর।

শাহজাহান টেনে টেনে বলল, আর ওয়াই…। বলেই থেমে গেল। হেড স্যার আরও গম্ভীর হয়ে গেলেন। মুনির ফিসফিস করে বলল, স্যার আমি বলব?

না, তোমার বলতে হবে না। যাও, এখন ঘরে যাও। খবরদার কোনো মিছিলে টিছিলে যাবে না।

জি আচ্ছ, স্যার।

আর এই বইটা রেখে যাও আমার কাছে। ম্যাট্রিক পাস করার আগে কোনো আউট বই পড়বে না। যেসব বই পড়ে কিছু শেখা যায় না সেসব বই পড়ার কী মানে? বলো কোনো মানে আছে?

নাই, স্যার।

যাও, বাড়ি যাও। আর এই তুমি, ঘাস চিবাচ্ছ কেন? ঘাস খায় ছাগলে। তুমি কি ছাগল?  বলো, তুমি ছাগল?

টুনু মুখ কালো করে বলল, জি-না স্যার।

ঘাস-লতাপাতা এসব যেন আর খেতে না দেখি। যাও, বাড়ি যাও।

বড় রাস্তার মোড়ে এসে টুনু বলল, সে বাড়ি চলে যাবে। সাজ্জাদ বলল, যেতে চাইলে যা, তোকে আমরা বেঁধে রেখেছি?

এটা রাগের কথা। এরপর যাওয়া যায় না। এই সময় একটা বেশ বড়সড় মিছিল আসতে দেখা গেল। সমুদ্রগর্জনের মতো গর্জন, জেগেছে জেগেছে বীর জনতা জেগেছে, জাগো জাগো জাগো, বীর জনতা জাগো। সাজ্জাদ বলল, যাবি নাকি মিছিলে?

কেউ কিছু বলল না। শুধু মুনির বলল, না, স্যার নিষেধ করেছেন।

ওরা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। মিছিলটাও প্রকাণ্ড। শেষই হতে চায় না। পেছনে চার-পাঁচটা পুলিশের ট্রাক। দেখলেই কেমন ভয় লাগে। মুনির ফিসফিস করে বলল, খুব গণ্ডগোল হবে। চল বাড়ি যাই।

তোর ভয় লাগে, তুই যা।

কত পুলিশ, দেখেছিস?

পুলিশকে ভয় পেলে তুই চলে যা। তোকে ধরে রেখেছি নাকি?

মুনির ইতস্তত করে বলল, হেড স্যার দেখলে খুব রাগ করবেন। তাছাড়া বাসায় আজ বড় খালামণির আসার কথা। বড় খালামণি আমাকে না দেখলে খুব রাগ করেন।

সাজ্জাদ বলল, তোর আসলে ভয় লাগছে। ভীতুর ডিম কোথাকার!

মুনির মুখ কালো করে ফেলল। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকল না। গলির ভেতর ঢুকে পড়ল। মুনিরের সাথে টুনুও চলে গেল। তার নাকি পেট ব্যথা করছে। সাজ্জাদ বলল, বল্টু, তুইও যাবি নাকি?

নাহ।

কী করবি তাহলে? মিছিলের সাথে যাবি?

হুঁ। কিন্তু কিছু হয় যদি?

দূর, কী হবে?

ভয়াল-ছয়ের দুই সদস্য মিছিলে ঢুকে পড়ল। অদ্ভুত একটা উত্তেজনা। গর্জনে চারদিক কেঁপে কেঁপে উঠছে। একেকটা ঘামে ভেজা মুখ কী ভয়ঙ্কর রাগী। মিছিল যতই এগোচ্ছে মানুষের সংখ্যা ততই বাড়ছে। যেদিকে তাকানো যায় শুধু মানুষ আর মানুষ। মিছিল কোনদিকে যাচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

সাজ্জাদ আর বল্টু হাত ধরাধরি করে হাঁটছিল। হঠাৎ কে একজন পেছন থেকে বল্টুর শার্টের কলার চেপে ধরল। বল্টু ঘাড় ফিরিয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেল। জামিল স্যার! অঙ্ক করান, দারুণ রাগী। স্যারের এক হাতে একটা লাল নিশান।

তোরা এখানে কী করছিস? যা, এক্ষুনি বাড়ি যা। এটা হাওয়া খাওয়ার জায়গা। আর কে কে আছে তোদের সাথে?

আর কেউ নেই, স্যার।

ঠিক করে বল।

না স্যার, আমরা দুজনই।

এক্ষুনি বাড়ি যা, খুব গণ্ডগোল হবে। ওই গলি দিয়ে বেরিয়ে পড়। এক্ষুনি। এক্ষুনি। খুব গণ্ডগোল হবে। দৌড়া। দৌড়া।

স্যারের কথা শেষ হওয়ার আগেই কোথাও কিছু একটা হলো। দারুণ ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেল চারদিকে। ঢেউয়ের মতো মানুষের স্রোত আসতে লাগল। দুম দুম শব্দ হলো সামনে। গুলির শব্দ না টিয়ার গ্যাস? কয়েকজন প্রাণপণে চিৎকার করছে, আগুন আগুন! কোনোদিকে নড়ার রাস্তা নেই তবু এর মধ্যেই সাজ্জাদ প্রাণপণে ছুটছে। বল্টু তার হাত শক্ত করে চেপে ধরে আছে। কালো কোট গায়ে দেওয়া একটা লোক বলল, এই খোকারা, মাটিতে শুয়ে পড়ো। দেখছ কী? গুলি হচ্ছে। ওরা কী করছে নিজেরা বুঝতে পারছে না। একজন বুড়ো মানুষ বললেন, কোনো ভোলা বাড়ি দেখে ঢুকে পড়ো। কোনো বাড়ির দরজা খোলা নেই। সাজ্জাদের মনে হলো সে আর দৌড়াতে পারছে না। ডান পায়ের নখ উঠে গেছে বা কিছু হয়েছে। এবার পেছন থেকে দ্রিম দ্রিম শব্দ আসছে।

একতলা একটি বাড়ির গেটে বুড়ো মানুষ একজন কে যেন দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি হাত বাড়িয়ে ওদের ধরে ভেতরে ঢুকিয়ে ফেললেন।

সেদিন ছিল পহেলা মার্চ। ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করেছে সকাল এগারোটায়। বারোটা নাগাদ বাঙালিরা বেরিয়ে পড়েছিল রাস্তায়। সেই জনসমুদ্র দেখে স্তজিত সরকার দুপুর একটায় ঘোষণা করল, বিকেল পাঁচটা থেকে কার্ফু। কেউ ঘর থেকে বেরুবে না। সেই ঘোষণা বাতিল করে নতুন ঘোষণা দেওয়া হলো, কার্ফু বেলা তিনটা থেকে। যে যেখানে আছে সেখানেই থাকবে। রাস্তায় দেখামাত্র তাদের গুলি করা হবে।

সাজ্জাদ এবং বল্টু আটকা পড়ে গেল একটা অচেনা বাড়িতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *