০৪. ভয়

চতুর্থ অধ্যায় ভয়

পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে দুই হইতে ছয় বৎসর বয়স্ক শিশুর নৈতিক শিক্ষার বিষয় আলোচনা করিব। শিশুর বয়স ছয় বৎসর হইতেই তাহার নৈতিক শিক্ষা প্রায় শেষ হওয়া উচিত; অর্থাৎ পরবর্তীকালে বালক-বালিকার নিকট হইতে যে গুণের বিকাশ আশা করা হইবে এই সময়ের মধ্যে ভালো অভ্যাস গঠনের ফলে এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা জাগরিত হওয়ায় তাহার সূত্রপাত হওয়া চাই। যেখানে নৈতিক শিক্ষা উপেক্ষিত হয় কিংবা খারাপভাবে দেওয়া হয় কেবল সেখানেই পরে এ শিক্ষা দেওয়া আবশ্যক হইয়া পড়ে।

ধরিয়া লইলাম যে, পূর্ব অধ্যায়ে চারিত্রিক শৃঙ্খরা বিধানের জন্য যে প্রণালী আলোচিত হইয়াছে তাহা অবলম্বিত হওয়ায় শিশু সুখি ও স্বাস্থ্যবান হইয়া এক বৎসর বয়সের হইয়াছে। অবশ্য পিতামাতার সর্বপ্রকার যত্ন সত্ত্বেও অল্পসংখ্যক শিশুর স্বাস্থ্য খারাপ থাকিবেই। কিন্তু আশা করা যায় যে, কালক্রমে এ সংখ্যাও হ্রাস পাইবে। বর্তমান যুগের জ্ঞান যথাযথভাবে প্রয়োগ করিলে অন্য দিক দিয়া রুগ্ন শিশুর সংখ্যা খুবই তুচ্ছ হইত। যে সব শিশুর শৈশবের শিক্ষা ভালো হয় নাই তাহাদের জন্য কি করা উচিত তাহা আমার আলোচ্য বিষয় নয়; এ সমস্যা শিক্ষকের, পিতামাতার নয়। এ-বই বিশেষ করিয়া সন্তানের পিতামাতার উদ্দেশ্যেই লিখিত।

শিশুর দ্বিতীয় বৎসর খুবই আনন্দময়। সে হাঁটিতে এবং কথা বলিতে শিখিয়াছে; ইহার ভিতর সে স্বাধীনতা ও নূতন শক্তির সন্ধান পাইয়াছে। শিশু দিন দিন বাড়িতে থাকে। (১) তাহার পক্ষে স্বাধীনভাবে খেলা করা সম্ভব হয়, এবং বিশ্বের সব জিনিস দেখিবার বাসনা তাহার এত বেশি হয় যে, একজন ভূপর্যটকের তত হয় না। পাখি, ফুল, নদী, সমুদ্র, মোটরগাড়ি, রেলগাড়ি, স্টিমার প্রভৃতি তাহার অপরিসীম আনন্দ ও কৌতূহলের উদ্রেক করে। এই সময় তাহার কৌতূহলের শেষ নাই, প্রায়ই তাহার মুখে শোনা যাইবে দেখতে চাই। নিজের শোওয়ার খাট কিংবা ঠেলাগাড়ি হইতে মুক্ত হইয়া শিশু বাগানের ভিতর, মাঠে অথবা সাগরতীরে ছোটাছুটি করিয়া মুক্তির আনন্দে উচ্ছ্বসিত হইয়া ওঠে। প্রথম বৎসর অপেক্ষা এখন হজম শক্তি বেশি হইয়াছে, খাদ্যেও বৈচিত্র্য আসিয়াছে; চিবানো এখন একটি নূতন আনন্দ। এইসব কারণে শিশুর যদি উপযুক্ত যত্ন লওয়া হয় এবং যদি তাহার স্বাস্থ্য ভালো থাকে তবে এই বয়সে শিশুর জীবন তাহার কাছে আনন্দময় এবং রোমাঞ্চকর মনে হয়।

হাঁটা ও দৌড়ানোর মধ্যে শিশু যে নূতন স্বাধীনতার সন্ধান পায় তাহার সঙ্গে একটি নূতন ভয়ও তাহার মনে আসে। শিশুকে সহজেই ভয় দেখানো যায়; ডক্টর এবং শ্রীমতী ওয়াটসন দেখিয়াছেন যে, শিশু উচ্চ শব্দ এবং পড়িয়া যাওয়ার আশঙ্কা হইতে সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। শিশুকে এমনভাবে যত্নের সঙ্গে রাখা হয় যে, ইহার বাস্তব ভয়ের কোনো কারণই থাকিতে পারে না; সত্যিকারের কোনো বিপদ হইলেও শিশু সেখানে অসহায়, কাজেই ভয় শিশুর কোনো কাজেই আসিবে na। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বৎসরে শিশুর মনে নূতন ভয় আসে। তর্কের বিষয় হইল এই যে, এই ভয় কি শিশুর প্রবৃত্তিগত অর্থাৎ আপনা-আপনি বিকশিত হয়, না অন্যের নিকট হইতে শিশু ইহা ছোঁয়াচে রোগের মতো পায়? শিশুর প্রথম বৎসরে ভয় থাকে না, কিন্তু তাই বলিয়া ইহা যে প্রবৃত্তি হইতে জ্ঞাত নয় এমন প্রমাণ করা চলে না; কেননা যে-কোনো বয়সে একটি প্রবৃত্তি পরিপূর্ণতা লাভ করিতে পারে। উগ্র ফ্রয়েডবাদীও বলিবেন না যে, জন্মের সময়ই শিশুর যৌন প্রবৃত্তি পরিপূর্ণ মাত্রায় রহিয়াছে। স্পষ্টতই দেখা যায় যে শিশু হাঁটিতে পারে না তাহার চেয়ে যে চলাফেরা করিতে পারে তাহারই ভয়ের প্রয়োজন বেশি; কাজেই যখন প্রয়োজন তখন যদি ভয় প্রকাশ পাইতে থাকে তবে বিস্ময়ের কিছু নাই। এ প্রশ্নটির শিক্ষাসম্বন্ধীয় গুরুত্ব অনেক। ভয় যদি অন্যের নিকট হইতে সংক্রামিত হয় তবে সহজ উপায়েই ইহা নিবারণ করা যায়–যেমন শিশুর সম্মুখে ভয় বা বিরক্তি প্রকাশ না করিয়া পক্ষান্তরে যদি কতক ভয় প্রবৃত্তি হইতে উদ্ভূত হয় তবে ইহা নিবারণের জন্য আরও ব্যাপক কোনো পন্থা গ্রহণ করিতে হইবে।

ডক্টর চার্মাস মিচেল তাহার The Childhood of Animals (জীবজন্তুর শৈশব) পুস্তকে পরীক্ষার সাহায্যে প্রমাণ করিয়াছেন যে, সাধারণত জীবজন্তুর শাবকদের মধ্যে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ভয় থাকে না। বানর এবং কয়েক প্রকার পাখি ছাড়া অন্য কোনো জীবের শাবক তাহাদের প্রজাতির চিরশত্রু। যেমন সাপ প্রভৃতিকেও মোটেই ভয় করে না, যদি না তাহাদের জনক-জননী তাহাদিগকে ভয় করিতে শিখাইয়া না দেয়। এক বছরের কম বয়সের শিশু কোনো প্রাণীকেই ভয় করে না। এইরূপ একটি শিশুকে ডক্টর ওয়াটসন ইঁদুরকে ভয় করিতে শিখাইয়াছিলেন; যখনই ইঁদুরটি ইহার সামনে আসিত তখনই শিশুটির পিছনে খুব জোরে ঘণ্টার আওয়াজ করিতেন; আওয়াজ শুনিয়া সে ভয় পাইত; ক্রমে ইঁদুরের সঙ্গে এই ভয়েই সংযোগ সাধিত হইল অর্থাৎ পরে শব্দ না হইলেও ইঁদুর দেখিলেই সে ভীত হইত। কিন্তু প্রাণী শাবকদের প্রথম কয়েক মাসে কোনো প্রবৃত্তি-জাত ভয় থাকে না। অন্ধকারে ভয়ের কারণ আছে বলিয়া যাহাদিগকে শিখানো হয় নাই এমন ছেলেমেয়েদের অন্ধকার ভীতিপ্রদ নয়। এরূপ ধারণার যথেষ্ট কারণ আছে যে, বেশিরভাগ ভয় যাহা আমরা এতদিন প্রবৃত্তিজাত মনে করিতাম অপরের নিকট হইতে সঞ্চারিত হয়; বয়স্ক ব্যক্তিরা সৃষ্টি না করিলে এরূপ ভয় মোটেই দেখা দিত না।

এই বিষয়ে নূতন তথ্য পাইবার আশায় আমি আমার ছেলেমেয়েদিগকে সযত্নে পর্যবেক্ষণ করিয়াছি। কিন্তু ধাত্রী এবং পরিচারিকারা কখন তাহাদিগকে কি বলিয়াছে তাহা সর্বদা জানিতে পারি নাই। এইজন্য ঘটনার বিশ্লেষণও কখনও সন্দেহজনক হইয়াছে। যতদূর বিচার করিতে পারিয়াছি তাহাতে মনে হয় শিশুর প্রথম বছরে ভয় সম্বন্ধে ডক্টর ওয়াটসন যাহা বলিয়াছেন তাহাই ঠিক; আমার ছেলেমেয়েদের বেলায় ইহা পরীক্ষা করিয়া দেখা গিয়াছে। দ্বিতীয় বৎসরে তাহারা কোনো প্রাণী দেখিয়া ভয় পাইত না, কেবল একজন কিছুকাল ঘোড়া দেখিলেই ভীত হইত। ইহার কারণ বোধহয় যে, একদিন একটি খুব জোরে শব্দ করিয়া তাহার পাশ দিয়া ছুটিয়া গিয়াছিল। এই মেয়েটির বয়স এখন দুই বৎসর; ইহার পরবর্তী বয়সে ভয়ের প্রকাশ কেমন তাহা লক্ষ করিবার জন্য ছেলেকে পর্যবেক্ষণ করিতে হইয়াছে। দুই বৎসর পূর্ণ হওয়ার কাছাকাছি এ ছেলেটির জন্য একজন নূতন ধাত্রী নিযুক্ত করা হয়। এ ধাত্রীটি ছিল ভিতু প্রকৃতির, বিশেষ করিয়া অন্ধকারকে অত্যন্ত ভয় করিত। ছেলেটির মধ্যে অল্পদিনেই এ ভয় সংক্রামিত হইল (প্রথম অবশ্য আমরা কিছুই জানিতে পারি নাই); সে কুকুর বিড়াল দেখিলে ছুটিয়া পলাইত, কালো কাবোর্ড দেখিলে ভয়ে জড়সড় হইত। অন্ধকার ঘরের প্রত্যেক অংশে আলো চাহিত, এমনকি প্রথমবার তাহার ছোট বোনটিকে দেখিয়া রীতিমতো ভয় পাইয়াছিল; হয়তো সে ইহাকে কোনো অজানা অদ্ভুত প্রাণী মনে করিয়াছিল। [প্রথম কলের পুতুল দেখিলে যেরূপ ভয় হয় এমনও হইতে পারে। সে যখন প্রথম দেখে তখন মেয়েটি ঘুমাইতেছিল; সে ইহাকে কলের পুতুল মনে করিয়াছিল; মেয়েটি যখন নড়িয়াছিল অমনি সে চমকিয়া উঠিয়াছিল।

ছেলেটি হয়তো এই ভয় ভিতু ধাত্রীর নিকট হইতে লাভ করিয়াছিল; বস্তুত ধাত্রী চলিয়া যাওয়ার পর ভয়ও ধীরে ধীরে লোপ পাইয়াছিল। কিন্তু অন্য ধরনের ভয়ও ছিল। এরূপ ভয় ধাত্রী আসিবার পূর্বে প্রকাশ পাইয়াছিল; তাহা ছাড়া কোনো বয়স্ক ব্যক্তি এরূপ ভয় বোধ করিবে না। কাজেই অন্যের নিকট হইতে সঞ্চারিত হওয়ার সম্ভাবনাও নাই। এরূপ ভয়ের মধ্যে প্রধান হইল যাহা কিছু অদ্ভুতভাবে চলে তাহার প্রতি ভয়, যেমন ছায়া ও খেলনা কলের পুতুল। ইহা পর্যবেক্ষণ করিয়া আমি বুঝিলাম যে, এই ধরনের ভয় শিশুর পক্ষে স্বাভাবিক এবং এগুলি প্রবৃত্তি হইতে উদ্ভূত মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। উইলিয়াম স্টার্ন তাহার Psychology of Early Childhood (শৈশবের মনস্তত্ত্ব) পুস্তকে রহস্যজনক বস্তুর প্রতি ভয় [Fear of the mysterious] শীর্ষক নিবন্ধে এ বিষয়ে আলোচনা করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন :

পূর্ববর্তী শিশু-মনোবিজ্ঞানবিদগণ এই ধরনের ভয়ের কথা, বিশেষ করিয়া অতি শৈশবে এরূপ ভয়ের স্বরূপ কি তাহা আলোচনা করেন নাই। পরে গ্রুস এবং তাঁহার সঙ্গে আমরা ইহার স্বরূপ জানিতে পারিয়াছি। জানা বিপদের ভয় অপেক্ষা অপরিচিত বিষয়ের ভয়ই বেশি স্বভাবগত বলিয়া মনে হয়। শিশু যদি এমন কোনো জিনিস দেখিতে পায় যাহা তাহার পরিচিত ধারণার সঙ্গে মেলে না তবে তিন প্রকার প্রতিক্রিয়া হইতে পারে। যথা–(১) নূতন জিনিসটি এত অপরিচিত মনে হইবে যে, ইহার প্রতি সে মোটেই আকৃষ্ট হইবে না। (২) কিংবা দৃষ্টি আকর্ষণ করিলেও তাহার মনে বিপর্যয় সৃষ্টি করিতে পারিবে না। তখন ইহার মনে জাগ্রত হইবে বিস্ময়, জানিবার বাসনা, নানা চিন্তা, বিচার এবং অনুসন্ধানের মনোভাব। (৩) অথবা নূতন জিনিস তাহার পূর্বের ধারণাকে সম্পূর্ণ উলটাইয়া দিয়া তাহার মনে গভীর অসন্তোষ ও অজানার প্রতি ভয়ের ভাব সৃষ্টি করিবে। গ্রুস বিশেষ অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় দিয়া বলিয়াছেন যে, এই অজানার প্রতি ভীতি প্রবৃত্তিজাত ভয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত, জীবকুলের আত্মরক্ষার পক্ষে প্রয়োজনীয় বলিয়াই ইহা এক প্রজাতি [Grneration] হইতে অন্য প্রজাতিতে সঞ্চারিত হয়।

স্টার্ন ভয়ের অনেক উদাহরণ দিয়াছেন; তাহার মধ্যে ছাতা খুলিলে ভয় পাওয়া এবং কলের পুতুল দেখিয়া ভয় পাওয়ার কথাও আছে। প্রথমোক্তটি গরু ঘোড়ার মধ্যেই বেশি; আমি পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছি গরু বা ঘোড়ার দলকে একটি ছাতার সাহায্যে ঊধ্বশ্বাসে ধাবিত করা যায়। স্টার্ন যেমন বর্ননা করিয়াছেন আমার নিজের ছেলের ভয়ও তেমনি ছিল। অস্পষ্ট দ্রুত চলমান ছায়া দেখিলে (যেমন রাস্তায় চলমান গাড়ির ছায়া যদি ঘরের দেওয়ালে পড়িত) ভয় পাইত। আমি মেঝেতে এবং দেওয়ালে আঙুল দিয়া ছায়া ফেলিতাম এবং তাহাকে দিয়া অনুরূপ করাইতাম; এইভাবে তাহার ছায়া-ভীতি দূর হইয়াছিল। শীঘই সে বুঝিয়াছিল ছায়া জিনিসটি কি এবং ইহাতে সে আনন্দ অনুভব করিত। কলের পুতুল সম্বন্ধেও এই নীতিই প্রযোজ্য। পুতুলের ভিতরকার কলকবজাটুকু দেখা হইলে সে আর ভয় পাইত না। কলকজা যদি দেখা না যাইত তবে ভয় দূর হইতে কিছু সময় লাগিত। কেহ তাহাকে একটি ছোট বসিবার আসন দিয়াছিল; চাপ দিলেই ইহা হইতে এক রকম করুণ একটানা শব্দ বাহির হইত। অনেকদিন পর্যন্ত সে এটা দেখিয়া ভয় পাইয়াছে। কিন্তু আমরা এই ভয়ের জিনিসটাকে কিছুতেই সরাইয়া ফেলি নাই। প্রথমে এটি কিছুটা দূরে রাখা হইয়াছিল যাহাতে সে বেশি ভয় না পায়। পরে অল্প অল্প করিয়া এটি ছেলের কাছে পরিচিত করাইয়া লইলাম এবং তাহার ভয় সম্পূর্ণ দূর না হওয়া পর্যন্ত থামি নাই। আসনের যে রহস্যময় ভাবের জন্য এটি ভীতিপ্রদ হইয়াছিল। খোকার ভয় কাটিয়া যাওয়ার পর ইহাই তাহাদের আনন্দ দিয়াছে। আমার মনে হয় অবাস্তব ভয় চাপিয়া রাখা ঠিক উচিত নয়; ক্রমে ক্রমে পরিচয় জন্মাইয়া ইহা সম্পূর্ণ দূর করাই সঙ্গত।

দুইটি ক্ষেত্রে বাস্তব ভয় সম্বন্ধে আমরা ঠিক ইহার বিপরীত প্রণালী অবলম্বন করিয়াছিলাম। হয়তো ইহা ভুলই হইয়াছিল। তখন প্রত্যক্ষ ভয়ের কারণ বিদ্যমান ছিল না। বৎসরের অর্ধেকটা আমি কোনো পাহাড়ময় সাগরতীরে কাটাই। ছেলেটির উচ্চতা সম্বন্ধে কোনোরূপ ভীতি ছিল না এবং না ঠেকাইলে সে খাড়া পাহাড়ের চূড়ায় উঠিয়া যাইত। একদিন আমরা একটি খাড়া পাহাড়ের উপর বসিয়াছিলাম; সমুদ্রের জল হইতে ইহা প্রায় একশত ফুট উচ্চে। ছেলেকে শান্তভাবে এই বৈজ্ঞানিক তথ্য বলিলাম : যদি পাহাড়ের ধারে যাও নিচে পড়ে যাবে; পড়ে গেলে প্লেটের মতো ভেঙে যাবে। (সে কয়েকদিন আগে একখানা প্লেট মেঝেতে পড়িয়া ভাঙিয়া যাইতে দেখিয়াছিল) কিছুক্ষণ স্থির হইয়া বসিয়া থাকিয়া সে নিজে নিজে উচ্চারণ করিল পড়ে যাবে, ভেঙে যাবে। তাহার পর সে সেইখান হইতে তাহাকে সরাইয়া আনিতে বলে। এ ঘটনা ঘটে তখন তাহার বয়স প্রায় আড়াই বৎসর। ইহার পর হইতে আমরা লক্ষ রাখিলে সে খুব উঁচুতে উঠিত না। কিন্তু কাছে কেহ না থাকিলে বিপদ সম্বন্ধে তাহার কোনো হুঁশ থাকিত na। তাহার বয়স যখন তিন বৎসর নয় মাস তখনই নিঃসঙ্কোচে ছয় ফুট উচ্চ হইতে লাফাইত। বারণ না করিলে কুড়ি ফুট উচ্চ স্থান হইতে লাফ দিতেও সে প্রস্তুত ছিল। কাজেই দেখা যাইতেছে যে, ভয় সম্বন্ধে শিক্ষাদান বিশেষ কার্যকরি হয় নাই। ইহার কারণ আমার নিকট এই মনে হয় যে, উচ্চস্থান হইতে পতনের ভয় সম্বন্ধে শুধু শিক্ষাদান করা হইয়াছিল, ভয় সঞ্চার করা হয় নাই। যখন উপদেশ দেওয়া হইতেছিল, তখন আমাদের দুইজনের মধ্যে কেহই ভয় অনুভব করি নাই। শিক্ষা ব্যাপারে ইহার গুরুত্ব খুব বেশি। বাস্তব বিপদ সম্পর্কে আশঙ্কা থাকা দরকার; ভয় থাকার কোনো প্রয়োজন নাই। কিছুমাত্রায় ভয়ের সঙ্গে মিশ্রিত না থাকিলে শিশু বিপদের আশঙ্কা অনুভব করিতে পারে না; কিন্তু উপদেষ্টা বা শিক্ষকের মধ্যে এই ভয়ের সামান্য প্রকাশ না থাকিলে শিশুর মনে ইহা কোনো রেখাপাত করে না। শিশুর তত্ত্বাবধানকারী বয়স্ক ব্যক্তিদের কখনোই ভীত হওয়া উচিত নয়, এই কারণেই পুরুষের মধ্যে যেমন স্ত্রীলোকদের মধ্যেও তেমনই সাহস বাড়ানো প্রয়োজন।

দ্বিতীয় উদাহরণটি ততটা ইচ্ছাকৃত নয়। খোকার বয়স যখন তিন বৎসর চার মাস একদিন তাহাকে সঙ্গে লইয়া বেড়াইতে গিয়া পথে একটি বিষধর সাপ দেখিতে পাই। খোকা পূর্বে সাপের ছবি দেখিয়াছিল কিন্তু আসল সাপ দেখে নাই। সাপ যে কামড়ায় তাহা সে জানিত না। সাপ দেখিয়া সে খুশি হইয়া উঠিল। এবং সেটি চলিয়া গেলে তাহার পিছে পিছে দৌড়াইতে লাগিল। আমি জানিতাম যে সে সাপের কাছে দৌড়াইয়া পৌঁছিতে পারিবে না; কাজেই তাহাকে বারণ করি নাই এবং সাপ যে বিপজ্জনক তাহাও বলি নাই। এই ঘটনার পর হইতে তাহার পরিচারিকা লম্বা ঘাসের মধ্যে সাপ থাকিতে পারে এই ভয়ে তাহাকে দৌড়াদৌড়ি করিতে দিত না। ইহার ফলে খোকার মনে সামান্য ভয়ের সঞ্চার হইয়াছিল, কিন্তু তাহা খুব বেশি নয়।

সমুদ্রের ভয় দূর করাই ছিল সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার। খোকার যখন আড়াই বৎসর বয়স তখন তাহাকে প্রথমবার সমুদ্রের জলে নামাইতে চেষ্টা করিয়াছিলাম। প্রথমে ইহা একেবারেই অসম্ভব ছিল। ঠাণ্ডা জল সে মোটেই পছন্দ করিত না, ঢেউ-এর গর্জন শুনিয়া সে ভয়ে জড়সড় হইয়াছিল; তাহার মনে হইতেছিল সমুদ্র কেবলই আসিতেছে, ফিরিয়া যাইতেছে না। ঢেউ বড় থাকিলে সে সমুদ্রের কাছে যাইতেই চাহিত না। এটা ছিল সাধারণভাবে ভয় পাওয়ার কাল। জীবজন্তু, উচ্চ বিকট শব্দ এবং বিভিন্ন জিনিস তাহার ভয় উৎপাদন করিত। সমুদ্রের ভয় আবার অল্প অল্প করিয়া দূর করিয়াছিলাম। প্রথমে শিশুকে সমুদ্র হইতে কিছুটা দূরে অগভীর ডোবার মধ্যে বসাইয়া রাখা হইত ও ঠাণ্ডার ভয় এইভাবে কাটিয়া গিয়াছিল। গরম চার মাসের শেষ দিকে সে এই ডোবার মধ্যে হাঁটিয়া আনন্দ পাইত কিন্তু কোমর পর্যন্ত জলে নামাইলে চিৎকার করিতে থাকিত। সমুদ্রের গর্জন শোনা যায় অথচ ঢেউ দেখা যায় না এমন স্থানে প্রত্যহ এক ঘণ্টা করিয়া তাহাকে খেলিতে দেওয়া হইত। ভাইবোনদিগকে সমুদ্রে স্নান করিতে দেখিত। ইহার পর আমরা তাহাকে এমন জায়গায় লইয়া যাইতাম যে স্থান হইতে সাগর দেখা যাইত, তাহাকে দেখানো হইত যে, ঢেউ আসিয়া আবার চলিয়া যাইতেছে। এইভাবে তাহার সাগর গর্জন ভীতি দূর করা হইল। ইহা ছাড়া সে তাহার পিতামাতা ও অন্যান্য ভাইবোনকে সমুদ্রে স্নান করিতে দেখিত।

এ সবের ফলে এইমাত্র হইল যে খোকা নির্ভয়ে ঢেউ-এর নিকটে যাইত মাত্র। এ ক্ষেত্রে ইহা নিশ্চিত যে ভয় প্রবৃত্তি হইতে সঞ্জাত; অন্যের নিকট হইত সঞ্চারিত হইবার কোনো কারণ ছিল না। পরের বছর গ্রীষ্মকালে আবার সমুদ্র স্নান শুরু হইল। তখন তাহার বয়স সাড়ে তিন বৎসর। তখনও ঢেউ-এর মধ্যে যাইতে তাহার রীতিমত ভয় ছিল। মিষ্টি কথায় যখন কোনো ফল হইল না, অন্য সকলের স্নান করা দেখিয়াও যখন খোকার জলে নামিতে সাহস হইল না, তখন আমরা। পুরনো প্রণালী গ্রহণ করিলাম। তাহাকে বুঝিতে দিলাম যে তাহার ভীরুতা দেখিয়া আমরা লজ্জা বোধ করি এবং তাহার সাহস দেখিলে প্রশংসা করি। প্রায় এক পক্ষকাল ধরিয়া প্রত্যেক দিন তাহার ধস্তাধস্তি এবং চিৎকার সত্ত্বেও তাহাকে গলা পর্যন্ত জলে ডুবাইয়া রাখা হইত। দিন দিন চিৎকার এবং হাত পা-ছোঁড়া কমিয়া আসিতে লাগিল। ভয় সম্পূর্ণ অন্তর্হিত হওয়ার আগেই সে জলে নামিতে চাহিত। এক পক্ষ শেষে বাঞ্চিত ফল পাওয়া গিয়াছিল–সে আর সমুদ্র দেখিয়া ভয় পাইত না। সেই সময় হইতে আমরা তাহাকে সম্পূর্ণভাবে ছাড়িয়া দিয়াছিলাম; আবহাওয়া ভালো থাকিলে নিজের খুশিমতো সে অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে স্নান করিত। প্রথমে ভয় সম্পূর্ণভাবে লোপ পায় নাই; গর্ব ইহাকে আংশিকভাবে চাপিয়া রাখিয়াছিল। পরিচয়ের ফলে ভয় কমিতে কমিতে অবশেষে সম্পূর্ণ লোপ পায়। তাহার কুড়ি মাস বয়স্ক ছোট বোন সমুদ্রকে মোটেই ভয় করে না এবং নিঃসঙ্কোচে দৌড়াইয়া জলে নামিয়া পড়ে।

এই ব্যাপারে এই রকম বয়সে আমার উপর যে প্রণালী প্রয়োগ করা হইয়াছিল তাহা অদ্ভুত। গোড়ালি ধরিয়া উঁচু করিয়া আমার মাথা জলের মধ্যে ডুবাইয়া দেওয়া হইত, আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ইহার ফলে সমুদ্রের জল আমি ভালোবাসিতে আরম্ভ করি। তথাপি এ প্রক্রিয়া আমি অন্যের জন্য অনুমোদন করি না।

এ কিছুটা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হইল, কারণ যে বর্তমান শিক্ষাপ্রণালী সম্বন্ধে আমার বিশেষ আস্থা আছে ইহা কতকাংশে তাহার বিরুদ্ধে গিয়াছে। শিক্ষাক্ষেত্রে জোর প্রয়োগ না করাই ভালো। কিন্তু আমার মনে হয় ভয় জয় করিতে কিছুটা জোর জবরদস্তি সুফল দেয়। কোনো অবাস্তব ভয় যদি প্রবল হয় শিশুর নিজের উপর ছাড়িয়া দিলে সে কখনোই পরীক্ষা করিয়া দেখিবে না বাস্তবিক সে-ভয়ের কোনো প্রকৃত হেতু আছে কি না। যাহা পূর্বে বিপজ্জনক মনে হইয়াছিল এরূপ ঘটনা যদি বারে বারে অনুষ্ঠিত হয় অথচ কোনো বিপদ না ঘটে তবে ইহার সঙ্গে শিশুর পরিচয় ঘটে। এই পরিচয়ই ভয় নাশ করে। এই ভীতিনাশক অভিজ্ঞতা কেবল একবার দিলেই চলিবে না; বারংবার ঘটাইতে হইবে যেন ইহার সম্বন্ধে কোনো ভয়ই আর না থাকে। কোনো প্রকার জোর না করিয়া যদি এরূপ অভিজ্ঞতা দেওয়া যায় তবে ভালোই, তাহা যদি সম্ভব না হয় তবে অপরাজিত ভয় পোষণ করা অপেক্ষা জোর করিয়া দূর করাই শ্রেয়।

আরও একটি বিষয় আছে। আমার ছেলের ক্ষেত্রে এবং মনে হয় অন্য সকলের ক্ষেত্রেই দেখা গিয়াছে যে ভয়কে জয় করার আনন্দ অপরিসীম। বালকের গর্ববোধ জাগানো সহজ; সাহস দেখানোর জন্য প্রশংসা পাইলে সারাদিন সে আনন্দে উৎফুল্ল থাকে। পরবর্তী বয়সে ভীরু ছেলেরা অন্য সকলের ঘৃণার পাত্র হইয়া মানসিক কষ্ট বোধ করে কিন্তু তখন তাহাদের পক্ষে নূতন অভ্যাস গঠন করাও কঠিন। এইজন্য আমার মনে হয় অল্প বয়স হইতেই ভয় দমন করার ব্যাপারে আত্মসংযম অভ্যাস এবং দৈহিক পটুতা [Enterprise] শিক্ষা দেওয়া উচিত। এ জন্য যদি কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে হয় তাহাও বরং বাঞ্ছনীয়।

পিতামাতা তাহাদের ভুল হইতে শিক্ষালাভ করেন। ছেলেমেয়েরা যখন বড় হইয়া উঠে তখনই তাঁহারা নিজেদের ভুল বুঝিতে পারেন এবং কিভাবে শিক্ষা দেওয়া উচিত ছিল তাহাও উপলব্ধি করিতে পারেন। ছেলেকে অতিরিক্ত আদর দিলে কি কুফল ফলে তাহার একটি উদাহরণ উল্লেখ করিব। আমার ছেলের বয়স যখন আড়াই বৎসর তখন তাহাকে একটি কুঠুরিতে একা একা শুইবার ব্যবস্থা করা হইয়াছিল। পরিচারিকার তত্ত্বাবধানে শিশুর শয়ন-ঘর হইতে অন্যত্র শুইতে পাওয়ায় পদোন্নতির গর্বে সে খুবই আনন্দিত হইয়াছিল এবং প্রথম প্রথম সারারাত্রি নির্বিঘ্নে ঘুমাইয়া কাটাইত। এক রাত্রিতে খুব জোরে ঝড় বহিতেছিল, ভীষণ শব্দ করিয়া জানালার একটি খিল খুলিয়া গিয়াছিল। ভয়ে জাগিয়া উঠিয়া সে চিৎকার করিয়া উঠিয়াছিল। আমি তৎক্ষণাৎ তাহার কক্ষে গিয়াছিলাম সে হয়তো দুঃস্বপ্ন দেখিয়া জাগিয়াছিল; সে আমার কণ্ঠলগ্ন হইয়া শুইয়া রহিল; দ্রুততালে তাহার হৃৎস্পন্দন হইতেছিল। অল্পক্ষণের মধ্যেই তাহার ভয় দূর হইল কিন্তু আলো না থাকায় অনুযোগ করিতে লাগিল। অথচ ওই সময় সে সারারাত্রি অন্ধকার ঘরে ঘুমাইত। তাহাকে রাখিয়া আসার পর আবার সে ভয়ের কথা বলে। কাজেই তাহাকে একটি আলো দেওয়া হইল। ইহার পর সে প্রায় প্রতি রাত্রিতেই চিৎকার করিয়া উঠিত, পরে বোঝা গেল ইহার উদ্দেশ্য শুধু এই যে, বয়স্ক ব্যক্তিরা আসিয়া তাহাকে লইয়া কিছুটা হইচই করুক। কাজেই আমরা তাহাকে শান্তভাবে বুঝাইয়া বলিলাম যে, অন্ধকারে ভয়ের কিছুই নাই এবং ঘুম ভাঙিয়া গেলে সে যেন পাশ ফিরিয়া আবার ঘুমাইয়া পড়ে। কোনো গুরুতর কিছু না ঘটিলে যে আমরা তাহার কাছে রাত্রিতে আর যাইব নাতাহাও জানাইয়া দিলাম। সে মনোযোগ দিয়া শুনিল এবং তারপর হইতে বিশেষ কারণ ছাড়া আর রাত্রিতে কাঁদিয়া ওঠে নাই। রাত্রিতে ঘরে আলো রাখা অবশ্য বন্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। আমরা যদি আরও বেশি আদর দেখাইতাম তবে হয়তো কিছুকাল, শুধু কিছুকাল কেন হয়তো বরাবরই তাহার ঘুমের ব্যাঘাত করিতাম।

এই গেল ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা। আমরা এখন ভয় দূর করার সাধারণ প্রণালী সম্বন্ধে আলোচনা করিব।

প্রথম কয়েক বৎসরের দৈহিক সাহস শিক্ষা দেওয়ার উপযুক্ত শিক্ষক হইল অন্য শিশুরা। যদি শিশুর বড় ভাইবোন থাকে তাহারাই উদাহরণ দেখাইয়া বা উপদেশ দিয়া উহাকে উৎসাহিত করিবে; তাহারা যাহা করিতে পারে শিশুও তাহা অনুকরণ করিবে। স্কুলে দৈহিক ভীরুতাকে সকলেই অবজ্ঞা করে; বয়স্ক শিশুদের এ বিষয়ে আর জোর দেওয়ার প্রয়োজন নাই। বালকদের মধ্যে অন্তত এই ভাবই প্রচলিত। মেয়েদের মধ্যেও এইরূপ হওয়া উচিত, তাহাদেরও ছেলেদের মতো সাহস থাকা বাঞ্ছনীয়। সৌভাগ্যক্রমে বালিকাদিগকে এখন আর মেয়েলি শিক্ষা দেওয়া হয় না এবং তাহাদের দৈহিক শক্তি বিকাশের পূর্ণ সুযোগ তাহারা পায়। তথাপি বালক ও বালিকাদের মধ্যে এ বিষয়ে কিঞ্চিৎ পার্থক্য রহিয়াছে। আমার বিশ্বাস এই যে, এইরূপ পার্থক্য থাকা উচিত নয়। আমি যখন সাহস বাঞ্ছনীয় মনে করিয়াছি তখন সাহসের আচরণমূলক ব্যাখ্যাই আমার মনে আসিয়াছে। অন্যেরা যে কাজ ভয়ে করিতে পারে না সে কাজ যে করে তাহাকে সাহসী বলা যায়। সে যদি মোটেই ভয় না করে তাহা হইলে সবচেয়ে ভালো; শুধু ভয়কে দমন করাকেই আমি সত্যিকারের সাহস কিংবা শ্রেষ্ঠ সাহস বলি না। বর্তমান নৈতিক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হইল–যাহাতে বালক-বালিকা বাঞ্ছনীয় আচরণ করে সে জন্য তাহাদের সদভ্যাস গঠন। ইহাই পূর্বে আত্ম-সংযম এবং ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে করানো হইত। ইচ্ছা শক্তির দ্বারা যে সাহস প্রদর্শিত হয় তাহা স্নায়বিক বিকলতা সৃষ্টি করে। যুদ্ধক্ষেত্রে কামানের গোলা-ভীতি [Shell Shock] দ্বারা সৃষ্ট মনোবিকলতার বহু দৃষ্টান্ত আছে। যে-ভয় দমিত হইয়াছিল তাহাই পরে এমন নৃতনরূপে আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল যে, মনঃসমীক্ষণ দ্বারা তাহা নির্ণয় করা সম্ভবপর হয় নাই। আমি এ কথা বলিতে চাহি না যে, আত্ম-সংযমের কোনো প্রয়োজন নাই; বরং এ কথা ঠিক যে, আত্ম-সংযম ব্যতীত পূর্বাপর সামঞ্জস্য রাখিযা জীবনধারণ করাই অসম্ভব। আমার বক্তব্য এই যে, এরূপ অবস্থার সম্মুখিন হইবার জন্য পূর্ব হইতে শিক্ষা দেওয়া হয় নাই। শুধু সেইরূপ অভাবিত বা অদৃষ্টপূর্ব অবস্থায় উপযুক্ত আচরণের জন্য আত্ম-সংযমের ব্যবহার প্রয়োজন। সকলকে সবরকম বিপদের সম্মুখিন হইবার মতো শিক্ষা দেওয়াও সম্ভবপর নয়। রাজ্যের সকল অধিবাসীকে যুদ্ধের সময় কিরূপ সাহস প্রদর্শন করিতে হইবে তাহা শিখাইতে যাওয়া মূর্খতারই শামিল। যুদ্ধের ন্যায় সর্বাত্মক বিপদ স্বল্পকাল স্থায়ী এবং কদাচিৎ ঘটিতে থাকে; কাজেই যুবকদিগকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিক্ষার মধ্যে কিরূপ আচরণ করিতে হইবে তাহা অভ্যাস করাইতে গেলে অন্য সকল রকম শিক্ষা খর্ব করিতে হয়।

যে ধরনের ভয়ের সহিত আমি পরিচিত, স্বর্গত ডক্টর রিভার্স তাঁহার প্রকৃতি ও নির্জন মন [Instinct and the Onconscious] পুস্তকে চমৎকার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ দিয়াছেন। তিনি বলেন, কোনো বিপজ্জনক অবস্থার সম্মুখিন হইবার একটি উপায় হইল দৈহিক পটুতা এবং যাহারা ইহা উপযুক্তভাবে প্রয়োগ করিতে পারে তাহারা অন্তত সজ্ঞানে ভয় অনুভব করে না। এইরূপ অভিজ্ঞতার যথেষ্ট মূল্য আছে; ইহা আত্মমর্যাদাবোধ বৃদ্ধি করে এবং ভয়কে জয় করিবার কৌশল আয়ত্ত করিতে উৎসাহ দেয়। সাইকেল চালানো শিখিবার মতো সহজ কৌশলও বালকের মনে এইরূপ অভিজ্ঞতা সঞ্চার করে। বর্তমান জগতে যন্ত্রবিজ্ঞানের প্রসারের জন্য এই ধরনের কৌশল আয়ত্ত করার প্রয়োজন দিন দিন বাড়িতেছে।

আমার অভিমত এই যে, অন্য লোকের সহিত দৈহিক কসরতের ভিতর দিয়া সাহস অর্জন অপেক্ষা নানা কলকজা আয়ত্ত করার মতো দৈহিক পটুতা শিক্ষা করানো বেশি প্রয়োজনীয়। পর্বত আরোহণে, উড়োজাহাজ চালনায় কিংবা ঝড়ের মধ্যে ছোট একটি জাহাজ চালাইতে যে প্রকার সাহস দরকার তাহা আমার নিকট যুদ্ধ করিতে যেরূপ সাহস দরকার তাহা অপেক্ষা বেশি প্রশংসার যোগ্য মনে হয়। কাজেই আমি স্কুলের ছাত্রদিগকে ফুটবল খেলার দিকে ঝোঁক দিতে না দিয়া কমবেশি রকমের বিপজ্জনক বিষয়ে নিপুণতা শিক্ষা দেওয়ার পক্ষপাতী। যদি কোনো শত্রুকেই অভিভূত করিতে হয়, এই শত্ৰু মানুষ না হইয়া কোনো বস্তু হোক, ইহাই বাঞ্ছনীয়। এ নীতি শুধু কাগজ-কলমে পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনায় সীমাবদ্ধ রাখিলেই চলিবে না, শরীরচর্চা ও ক্রীড়া কৌশলের ক্ষেত্রে ইহার গুরুত্ব বৃদ্ধি করিতে হইবে।

দৈহিক সাহস দেখানোর আরও নিষ্ক্রিয় (Passive] উপায়ও আছে। কোনো রকম হইচই আহা-উঁহু না করিয়া আঘাত সহ্য করা ইহার একটি দৃষ্টান্ত। ছোটখাটো আঘাত পাইলে শিশুদের প্রতি যদি সমবেদনা না দেখানো হয়, তবে এই ধরনের সাহস গড়িয়া তোলা যায়। পরবর্তীকালে অত্যধিক সমবেদনা পাওয়ার বাসনা হইতে নানা উত্তেজনাময় বায়ুরোগের কারণ ঘটিতে পারে। লোকে একটু আদর আপ্যায়ন, একটু আঁচড় লাগিলে বা কাটিয়া গেলেই শিশুদিগকে কাঁদিতে উৎসাহ না দিলে এইরূপ মনোভাব প্রতিরোধ করা যায়। এই ব্যাপারে বালকদের প্রতি যেমন অতি মৃদু ও কোমল ব্যবহার সঙ্গত নয়, বালিকাদের প্রতিও তেমনই। স্ত্রীলোকেরা যদি পুরুষের সমকক্ষ হইতে চায় তবে চরিত্রের দৃঢ় গুণগুলির বিষয়েই বা তাহারা পুরুষ অপেক্ষা হীন হইবে কেন?

যে সাহস কেবল দৈহিক নয় এখন সেই ধরনের সাহসের আলোচনা করা যাক। এই প্রকার সাহসই বিশেষ প্রয়োজনীয় কিন্তু কোনো প্রাথমিক ধরনের সাহসকে ভিত্তি না করিয়া ইহা গড়িয়া তোলা কঠিন। অবাস্তব ভয়ের আলোচনা প্রসঙ্গে রহস্যজনক জিনিসের প্রতি ভয়ের কথা উল্লেখ করা হইয়াছে। আমার বিশ্বাস এই যে, ভয় প্রবৃত্তি হইতে সমুৎপন্ন এবং ইহার ঐতিহাসিক গুরুত্ব খুব বেশি। ইহাই অধিকাংশ কুসংস্কারের কারণ। চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ, ভূমিকম্প, প্লেগ এবং অনুরূপ ঘটনা অশিক্ষিত লোকের মধ্যে রীতিমত ভয় উদ্রেক করে। ব্যক্তিগতভাবে এবং সামাজিকভাবে এ ভীতি বড়ই বিপজ্জনক, কাজেই প্রথম জীবনেই ইহা সমূলে উৎপাটন করা বাঞ্ছনীয়। এ ভীতির প্রধান ঔষধ হইল বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। প্রথম দৃষ্টিতে যাহা রহস্যজনক তাহারই যে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে হইবে এমন কোনো কথা নাই। কতকগুলি ব্যাখ্যা দিলে শিশু অনুমান করিবে যে অন্য ঘটনারও অনুরূপ কারণ আছে এবং ইহা বলা সম্ভবপর হইবে যে, এখনও ব্যাখ্যা দেওয়া যাইতেছে না। কোনো কিছুর রহস্য যে অজ্ঞতা হইতেই উদ্ভূত এবং ধৈর্য ও মানসিক চেষ্টা দ্বারা যে এই অজ্ঞতা দূর করা যায় এই ধারণা যত শীঘ্র জন্মান যায় ততই মঙ্গল। ইহা বিশেষ উল্লেখযোগ্য যে, যে-রহস্য প্রথমে শিশুর ভীতি উৎপাদন করে তাহার কারণ জানা হইয়া গেলে তাহাই আবার শিশুকে আনন্দ দেয়। এইভাবে দেখা যায়, যখনই রহস্য আর কুসংস্কার বৃদ্ধি করে না তখন হইতেই ইহা শিশুর পাঠের অনুপ্রেরণা জোগায়। আমার সাড়ে তিন বছরের ছেলে একাকী তন্ময় হইয়া বহু ঘণ্টা ধরিয়া বাগানের পিচকারিটি পরীক্ষা করিয়াছে। অবশেষে সে বুঝিতে পারে কিভাবে জল ভিতরে আসে এবং বাতাস বাহির হইয়া যায় এবং কীভাবে ইহার বিপরীত অবস্থা ঘটে অর্থাৎ জল বাহির হইয়া গেলে বাতাস প্রবেশ করে। ছোট ছেলেমেয়েরাও যাহাতে বুঝিতে পারে এমনভাবে চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণ বুঝাইয়া বলা যায়। শিশুরা যাহা দেখিয়া ভয় পায় বা আনন্দ পায় তাহা সম্ভবপর হইলে ব্যাখ্যা করিয়া বুঝাইয়া দেওয়া উচিত।

এই সংক্রান্ত কতকগুলি সমস্যা বেশ কঠিন। ইহাদের ব্যাখ্যা করিয়া শিশুদিগকে বুঝাইয়া দিতে রীতিমত কৌশলের প্রয়োজন। ইহাদের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন হইল মৃত্যু রহস্য। শিশু দেখে যে, গাছপালা এবং জীবজন্তু মরিয়া যায়। তাহার ছয় বৎসর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই হয়তো তাহার পরিচিত ব্যক্তির মৃত্যু হইতে পারে। তাহার মন যদি সক্রিয় হয় তবে তাহার মনে হইতে পারে যে তাহার পিতামাতারও একদিন মৃত্যু হইবে। এমনকি সে নিজেও মরিবে। (নিজের মৃত্যুর সম্ভাবনা চিন্তা করা কঠিন)। এই চিন্তাগুলি তাহার মনে বহু প্রশ্ন তুলিবে; এগুলির উত্তর দেওয়া আবশ্যক। যিনি পরলোক বিশ্বাস করেন তাঁহার পক্ষে এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কিথঞ্চিৎ সহজ। কিন্তু যিনি বিশ্বাস করেন না তিনিও যেন নিজের বিশ্বাসের বিপরীত কোনো অভিমত না দেন। পিতামাতার পক্ষে শিশুর নিকট মিথ্যা বলিবার কোনো সঙ্গত কারণ নাই। ইহা বলাই সবচেয়ে ভালো যে, মৃত্যু হইল মহান্দ্রিা; মৃত্যুঘুমে ঘুমাইয়া পড়িলে কেহ আর জাগিয়া ওঠে না। কোনোরূপ গাম্ভীর্যের অবতারণা না করিয়া এমনভাবে বলুন যে, মৃত্যু একটি সাধারণ ঘটনা। শিশু যদি নিজের মৃত্যু সম্বন্ধে চিন্তাকুল হয় তাহাকে বলুন যে, অনেকদিন পর্যন্ত তাহার পক্ষে মৃত্যুর কোনো সম্ভাবনা নাই। দুঃখপূর্ণ হইলেও মৃত্যু অনিবার্য এবং ইহার কষ্ট সহ্য করিতেই হইবে। মৃত্যু সম্বন্ধে এই ধরনের ভাব বাল্যকালে শিশুর মনে সঞ্চার করার চেষ্টা বৃথা। আপনি নিজে এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করিবেন না কিন্তু শিশু জানিতে চাহিলে প্রশ্ন এড়াইয়া যাইবেন না।

শিশুকে বুঝাইয়া দিন যে, ইহার মধ্যে কোনো রহস্য নাই। শিশু যদি স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন হয় এবং স্বাস্থ্যবান হয় তবে সে ইহা লইয়া দুশ্চিন্তা করিয়া মাথা ঘামাইবে না। এ প্রসঙ্গে কথা উঠিলে খোলাখুলিভাবে আপনি যাহা বিশ্বাস করেন তাহা সরলভাবে বলিবেন এবং শিশুর মনে এই ধারণা সৃষ্টি করিতে চেষ্টা করিবেন যে, বিষয়টি খুব আনন্দপ্রদ নয়। কি শিশু কি বৃদ্ধ কাহারও পক্ষেই মৃত্যুচিন্তায় সময় কাটানো মঙ্গলজনক নয়।

কোনো কিছু সম্বন্ধে বিশেষ ভয় ছাড়াও শিশুর একটা সাধারণ উত্তষ্ঠা বোধ করিতে পারে। বয়স্ক ব্যক্তিদের অত্যধিক শাসনই মোটামুটিভাবে এ জন্য দায়ী। কিন্তু বর্তমানে ইহা অনেকটা কমিয়া আসিয়াছে।

পদে পদে দোষ ত্রুটি ধরা, গোলমাল করিতে নিষেধ করা, সর্বদা ভদ্র আচরণ সম্বন্ধে উপদেশ দেওয়া প্রভৃতি শিশুর জীবন দুঃখময় করিয়া তুলিত। আমার মনে আছে, পাঁচ বৎসর বয়সে আমি শুনিয়াছিলাম যে শৈশবকাল জীবনের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সুখের কাল (সে যুগে ইহা ছিল নিছক মিথ্যা কথা)। আমি কাঁদিয়া আকুল হইতাম, মনে করিতাম মরিলেই বাঁচি, অবসাদময় বছরগুলি কিভাবে কাটাইব তাহা ভাবিতেই পরিতাম না। কেহ যে শিশুকে এরূপ বলিতে পারেন বর্তমান যুগে তাহা অচিন্ত্যনীয়।

শিশুরা স্বভাবতই আশাবাদী; তাহাদের মন আগামী দিনের স্বপ্ন দেখে, ভবিষ্যতের আশায় উৎসাহিত হয়। ইহা শিশুকে কাজে অনুপ্রেরণা দেয়। শিশুর দৃষ্টি যদি পিছন দিকে ফিরাইয়া দেওয়া যায়, বলা হয় যে ভবিষ্যৎ অতীতের চেয়ে বেশি দুঃখপূর্ণ তবে তাহার জীবনের উৎসকেই নির্জীব ও দুর্বল করিয়া ফেলা হয়। অথচ বাল্যকাল সুখের সময় এই ধরনের কথা বলিয়া হৃদয়হীন ভাবপ্রবণ ব্যক্তিরা শিশুদের জীবন বিষাদময় করিয়া তুলিতেন। সৌভাগ্যক্রমে তাঁহাদের কথা শিশুদের জীবনে বেশিদিন স্থায়ী হয় নাই। প্রায় সময়েই আমার মনে হইত বয়স্ক ব্যক্তিদের পড়াশুনার চাপ নাই, তাহারা যাহা ইচ্ছা তাহাই খাইতে পারেন, তাঁহারা নিশ্চয়ই খুব সুখি। আমার এই বিশ্বাস ছিল স্বাস্থ্যপ্রদ এবং প্রেরণার উৎসস্বরূপ।

.

লাজুকতা : লাজুকতা বড়ই বিব্রতকর ধরনের ভীরুতা। ইহা ইংল্যান্ড ও চীনদেশে ব্যাপকভাবে দেখা যায়, অন্যত্র খুব কম। ইহার উৎপত্তির আংশিক কারণ হয় অপরিচিত লোকের সংস্পর্শে না আসা এবং আংশিক কারণ সামাজিক আদাব কায়দার উপর জোর দেওয়া। সুবিধা হইলেই শিশুদিগকে প্রথম বৎসরের পর হইতেই অপরিচিত লোক দেখিতে এবং তাহাদের সান্নিধ্যে আসিতে দেওয়া উচিত। আদব-কায়দা সম্বন্ধে বলা চলে, নিম্নতম যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু শিখানো দরকার, প্রথম অবস্থায় শিশু অন্যের নিকট অসহনীয়রূপে বিরক্তিকর না হইলেই হইল। শিশুদিগকে অপরিচিত আগন্তুকের সম্মুখে ঘরের মধ্যে শান্তভাবে বসাইয়া না রাখিয়া বরং কিছুক্ষণ নিজের ইচ্ছামতো থাকিতে দিয়া পরে অন্যত্র লইয়া যাওয়া উচিত। প্রথম দুই বৎসর শিশুর ছবি, কাদামাটি, যন্ত্রপাতি অথবা অন্য কোনো খেলার সরঞ্জাম লইয়া দিনের মধ্যে কিছু সময় নিজের ইচ্ছামতো কাটাইতে অভ্যাস করানো ভালো। শিশুকে শান্ত হইয়া থাকিতে বলিলে তাহার এমন কারণ থাকা চাই যাহা সে বুঝিতে পারে। খেলার মতো প্রীতিকর অভ্যাসের ভিতর দিয়াই ভদ্র আচরণ শিখানো উচিত; নীরস উপদেশ বা তত্ত্বহিসাবে প্রয়োগ করিলে ইহাতে বিশেষ সুফল পাওয়া যাইবে না। যখনই শিশুর বুঝিবার ক্ষমতা হইবে, সে অনুভব করিবে যে তাহার পিতামাতারও অধিকার আছে; সে অন্যকে কাজে স্বাধীনতা দিবে, নিজেও যথাসাধ্য ভোগ করিতে চেষ্টা করিবে। শিশুরা সহজেই ন্যায় বিচার উপলব্ধি করে; অন্যের নিকট হইতে তাহারা যেরূপ আচরণ পাইবে অন্যের প্রতিও তাহারা দ্রুপ করিতে প্রস্তুত থাকিবে। ইহাই ভদ্র আচরণের মূল।

ভয় নিবারণের উপায় :

সর্বোপরি, আপনি যদি আপনার সন্তানদের ভীতি দূর করিতে ইচ্ছা করেন, আপনি নিজে নির্ভীক হউন। আপনি যদি মেঘগর্জনে ভয় পান, তবে প্রথমবার যখন আপনার শিশু আপনার সম্মুখে থাকিয়া মেঘ গর্জন শুনিবে, তখনই তাহার মধ্যে ভয় সঞ্চারিত হইবে। আপনি যদি সামাজিক বিপ্লব সম্পর্কে ভীতি প্রকাশ করেন, আপনি কি বিষয়ে বলিতেছেন তাহা বুঝিতে না পারায় আপনার সন্তান আরও বেশি ভীত হইবে। আপনি যদি রোগ সম্বন্ধে শঙ্কিত হন আপনার সন্তান আরও বেশি শঙ্কিত হইবে। জীবন বিঘ্ন-সংকুল কিন্তু বিজ্ঞ ব্যক্তি অবশ্যম্ভাবী বিপদকে উপেক্ষা করেন এবং যেগুলি প্রতিরোধ করা সম্ভব সেগুলি সম্বন্ধে বুদ্ধি প্রয়োগ করিয়া অবিচলিতভাবে কাজ করেন। আপনি মৃত্যুর হাত এড়াইতে পারেন না কিন্তু বিনা উইলে মৃত্যুর হাত এড়াইতে পারেন। কাজেই আপনার উইল (দানপত্র) করিয়া ফেলুন তারপর মনে ভুলিয়া যান যে আপনি মরণশীল। বাস্তব দুর্ভাগ্য বা দৈব-দুর্বিপাকের বিরুদ্ধে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করা ভয় হইতে সম্পূর্ণ পৃথক জিনিস; ইহা বিজ্ঞতার পরিচায়ক, কিন্তু ভীতি আত্ম অমর্যাদাকর। আপনি যদি নিজের ভয় দমন করিতে না পারেন তবে চেষ্টা করিবেন যাহাতে আপনার সন্তান ইহা সন্দেহ করিতে না পারে। সর্বোপরি তাহাকে এমন উদার দৃষ্টিভঙ্গি দিবেন এবং তাহার মনে বহুবিচিত্র বিষয়ে এমন জীবন্ত উৎসাহ সঞ্চার করুন যেন সে পরবর্তী জীবনে নিজের ব্যক্তিগত বিপদের আশঙ্কা সম্বন্ধে চিন্তা না করে। কেবল এই উপায়েই আপনি তাহাকে বিশ্বের একজন মুক্ত নাগরিকরূপে গড়িয়া তুলিতে পারেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *