৪
ভদ্রমহিলার নাম মোমেনা খাতুন।
১৮/২ তল্লাবাগে তাঁর ছোট ভাইয়ের সঙ্গে থাকেন। টেলিফোন নাম্বার দেওয়া আছে। মিসির আলি অনেকবার টেলিফোন করলেন। রিং হয় কিন্তু কেউ ধরে না। সেট হয়তো নষ্ট হয়ে আছে। নম্বর খুঁজে বাড়ি বের করার কাজটা তিনি একেবারেই পারেন না। তিনি জানেন তল্লাবাগে উপস্থিত হয়ে যদি বলেন, ১৮/২ বাড়িটা কোথায়, তা হলেও কোনো লাভ হবে না। যাকে জিজ্ঞেস করা হবে সে এমনভাবে তাকাবে যে এই নাম্বার শুনে সে বড়ই চমৎকৃত বোধ করছে। এমন অদ্ভুত নাম্বার কোথেকে এসেছে বুঝতে পারছে না। আরেক দল আছে যারা নাম্বার শুনে বলবে—ও আচ্ছা, আঠার বাই দুই। নাক বরাবর যান, তারপর লেফটে যাবেন। কাউকে জিজ্ঞেস করলেই বলবে। এরা সবজান্তার কাজটা করে কিছু না জেনে। অন্যকে বোকা বানিয়ে আনন্দ পেতে চায়।
এলাকার বাড়িঘরের নম্বর সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো জানে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। যারা থ্রি-ফোরে পড়ে। মানুষের মতো বাড়ির নাম্বার আছে—এই বিষয়টি তাদের হয়তো আলোড়িত করে। তারা মনে রাখার চেষ্টা করে। বাড়ির নাম্বার নিয়ে বিব্রত মানুষকে সত্যিকার অর্থেই এরা সাহায্য করতে চায়।
এদের একজনের সাহায্য নিয়েই মিসির আলি ১৮/২ তল্লাবাগ খুঁজে বের করলেন। সরু রাস্তার উপর বিরাট বাড়ি। বাড়ির বিশেষত্ব হচ্ছে সবই বড় বড়। ড্রয়িংরুমে বিশাল আকৃতির সোফা। দেয়ালে কাবা শরিফের প্রকাণ্ড বাঁধাই ছবি। একটি টিভি আছে—একে কত ইঞ্চি টিভি বলে কে জানে। সিনেমার পর্দার মতো বড় স্ক্রিন। শুধু বাড়ির দরজা- জানালা ছোট ছোট। প্রথম দর্শনেই মিসির আলির মনে হল–সোফা, টিভি এগুলো এ বাড়িতে ঢোকাল কীভাবে?
ড্রয়িংরুমে বেশকিছু লোক। গাদাগাদি করে সোফায় বসে আছে। বাড়িতে কোনো উৎসব হয়তো। সবাই সেজেগুজে আছে। অল্পবয়সী বালিকারাও ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে গালে রোজ মেখে সেজেছে। সবাইকে ভয়ংকর দেখাচ্ছে।
মিসির আলির মনে হল মোমেনা খাতুন নামের এই বৃদ্ধা মহিলার প্রতি কারো কোনো কৌতূহল নেই। আগ্রহও নেই। একজন অপরিচিত ভদ্রলোক তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন শুনেও কেউ কোনো গা করছে না। মধ্যবয়স্ক এক লোক বিরস মুখে বললেন, বসুন দেখছি
বলেই তিনি কর্ডলেস টেলিফোনে কাকে যেন ধমকাতে লাগলেন। লোকটার পরনে হালকা কমলা রঙের স্যুট। গলায় ছোট ছোট ফুল আঁকা টাই—তবে তাঁর প্যান্টের জিপার খোলা। সবাই তা দেখছে, কেউ কিছু বলছে না। মনে হয় বলার সাহস পাচ্ছে না।
মিসির আলি সোফায় বসে রইলেন একা একা। আঠার-উনিশ বছরের একটা মেয়ে ঝড়ের গতিতে বসার ঘরে ঢুকে মিসির আলিকে বলল—আপনি কি কার রেন্টাল থেকে এসেছেন? এত দেরি যে? বলেই জবাবের জন্যে অপেক্ষা না করে ভেতরে চলে গেল। উঁচু গলায় বলল, বাস চলে এসেছে মা।
বোঝা যাচ্ছে এরা দল বেঁধে কোথাও যাচ্ছে। পিকনিক হবার সম্ভাবনা। শীতকালের শুক্রবারে পিকনিক লেগেই থাকে। পিকনিক হলে মোমেনা খাতুনের দলটির সঙ্গে যাবার কথা। ইচ্ছা না থাকলেও বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের পিকনিকে নিয়ে যেতে হয়। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও জীবনের শেষ দিকে এসে পিকনিক জাতীয় ব্যাপারে খুব আগ্রহী হয়ে পড়েন।
টেলিফোন হাতে ভদ্রলোক কথা বলেই যাচ্ছেন, বলেই যাচ্ছেন এবং একটি কথাই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কিছুক্ষণ পরপর বলছেন। একসময় লাইন কেটে গেল কিংবা ওপাশের ভদ্রলোক লাইন ছেড়ে দিলেন। ভদ্রলোক বিরক্ত হয়ে টেলিফোন সেটটার দিকে তাকাচ্ছেন। এই সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। মিসির আলি আবার বললেন, আমি একটু মোমেনা খাতুনের সঙ্গে কথা বলব।
‘আপনাকে অপেক্ষা করতে বললাম না। ব্যস্ততাটা তো দেখতে পাচ্ছেন? নাকি পাচ্ছেন না। সবাই গায়ে-হলুদে যাচ্ছে।’
‘কিছু মনে করবেন না। আপনার প্যান্টের জিপার খোলা।’
ভদ্রলোক এমনভাবে মিসির আলির দিকে তাকালেন যেন মিসির আলি নিজেই জিপার খুলেছেন। মিসির আলি বললেন, উনি আছেন তো?
‘হ্যাঁ, আছেন। কিছুক্ষণ ওয়েট করুন। ভিড় কমুক, তারপর আপনাকে আন্টির কাছে নিয়ে যাব। জাস্ট দেখা দিয়ে চলে যাবেন। বেশিক্ষণ বিরক্ত করবেন না। কথা বলা পুরোপুরি নিষেধ। আন্টির আবার বেশি কথা বলার অভ্যাস। কথা বলে বলে রোগ বাড়াচ্ছেন।’
বোঝা যাচ্ছে ভদ্রমহিলা অসুস্থ। সম্ভবত হাসপাতালে ছিলেন। সম্পতি বাসায় আনা হয়েছে। অনেকেই তাঁকে দেখতে আসছে বলেই মিসির আলিকে এ বাড়ির সবাই স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে।
ঘণ্টাখানেক বসে থাকার পর একজন কাজের মেয়ে এসে বলল, ভিতরে আসেন, জুতা খুইল্যা আসেন।
লম্বা বারান্দা পার হয়ে মিসির আলি ছোট একটা ঘরে ঢুকলেন। ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ। মেঝে মনে হয় ডেটল দিয়ে ধুয়েছে। ঘরময় ডেটলের গন্ধ। ঘরের অর্ধেকটা জুড়ে খাট পাতা। মিসির আলি ভেবেছিলেন বৃদ্ধা এক মহিলাকে শুয়ে থাকতে দেখবেন। তা দেখলেন না। মোমেনা খাতুন একদিকের দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছেন। তাঁর চোখে চশমা। গায়ের রঙ ধবধবে সাদা। গায়ের কাপড়টিও সাদা, মাথার চুল সাদা। যে বিছানা বসেছেন সেই বিছানার চাদরটাও সাদা। সব মিলে সুন্দর একটি ছবি
মিসির আলি বললেন, আপনি কেমন আছেন?
ভদ্রমহিলা স্পষ্ট উচ্চারণে বললেন, জি ভালো।
ভদ্রমহিলার কান ঠিক আছে। কথাও জড়ানো হয়, তবে চোখের দৃষ্টির সম্ভবত কিছু সমস্যা আছে। তিনি তাকিয়ে আছেন অন্যদিকে।
‘আপনি অসুস্থ জানতাম না। অসুস্থ জানলে আসতাম না।’
‘আমি ভালো আছি। বাথরুমে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম। হাসপাতালে নিয়ে গেল। ডাক্তাররা বলল, কিছু হয় নাই।’
‘আমি খানিকক্ষণ আপনার সঙ্গে কথা বলব—যদি আপনার আপত্তি না থাকে। আমার পরিচয় আপনাকে দেওয়া দরকার। আমার নাম মিসির আলি। আমি…’
‘আপনার পরিচয় দিতে হবে না। আমার ছেলে তার ম্যানেজারকে পাঠিয়েছিল, সে বলেছে আপনি আসবেন।’
‘আপনার ছেলে আপনাকে দেখতে আসে নি।
‘না, আসে না। এর আগে একবার জরায়ুর টিউমার অপারেশন হয়েছিল—তিন মাস ছিলাম হাসপাতালে। খবর পেয়েও দেখতে এল না। মরেও যেতে পারতাম। আমি তো তার মা। বলুন আপনি—আমি তার মা না?
‘অবশ্যই আপনি মা? বেশি কথা বলা বোধহয় আপনার নিষেধ। আমি বরং এক কাজ করি—এমনভাবে প্রশ্ন করি যেন হ্যাঁ-না বলে জবাব দেওয়া যায়।’
‘কথা বলা নিষেধ—এটা আপনাকে কে বলল? কোনো নিষেধ না। ডাক্তার এমন কিছু বলে নাই। এইসব কথা এই বাড়ির লোকজন বানিয়েছে—। যেই আসে তাকে বলে—কথা বলা নিষেধ। যাক, বাদ দিন। কী যেন বলছিলাম—’
‘আপনি বলছিলেন—আগে একবার আপনার জরায়ুর টিউমার অপারেশন হয়েছিল—তিন মাস হাসপাতালে ছিলেন। আপনার ছেলে খবর পেয়েও আপনাকে দেখতে আসে নি। আপনি আমার কাছে জানতে চাচ্ছিলেন—আপনি তার মা কিনা।’
মোমেনা খাতুন মিসির আলির কথায় হৃষ্টচিত্তে বললেন, হ্যাঁ, ঠিক কথা। আমি তো তার মা। সন্তান পেটে ধরেছি। সেই আমাকে আমার স্বামী বাড়ি থেকে বের করে দিল। সন্ধ্যারাত্রিতে আমাকে এসে বলল—মোমেনা, বাইরে রিকশা আছে। যাও, রিকশায় ওঠ। তার রাগ বেশি। ভয়ে কিছু জিজ্ঞাস করলাম না। সেই যে রিকশায় উঠলাম—উঠলামই। ঐ বাড়িতে আর ঢুকতে পারলাম না। এখন আমি পড়ে আছি আমার ভাইয়ের বাড়িতে। আমি তো থাকতে পারতাম আমার ছেলের সঙ্গে। পারতাম না?’
‘জি পারতেন।’
‘তার উচিত ছিল না আমাকে তার বাড়িতে রাখা? আমি তার মা। আমি কেন অন্যের বাড়িতে থাকব?’
‘জি তা তো বটেই। তন্ময়ের বাবার মৃত্যুর পর আপনি ঐ বাড়িতে গিয়ে উঠলেন না কেন?’
‘কেমন করে উঠব! তখন আমার ভাইয়া জোর করে আমার বিয়ে দিয়েছে। লোকটা রেলে চাকরি করত। ছোট চাকরি। তবে মানুষ খারাপ ছিল না। সে মারা গেছে কাঁকড়া বিছার কামড়ে। কাঁকড়া বিছার কামড়ে মানুষ মারা যায় এমন কথা আগে কখনো শুনেছেন? শুনেন নাই। এটা হল আমার কপাল। লোকটা রেলের গুদামঘরে ঢুকেছে। টিন না কী যেন সরাচ্ছে—এমন সময় হাতে কামড় দিল। চিৎকার দিয়ে উঠল, সাপ সাপ। সে ভেবেছিল সাপ। লোকজন দৌড়ে এসে দেখে কাঁকড়া বিছা। কেউ কোনো গুরুত্ব দিল না। কামড়ের জায়গায় চুন মাখিয়ে দিল। রাতে লোকটার জ্বর আসল। খুব জ্বর। আমাকে ডেকে তুলে বলল, মোমেনা, বড় পানির পিয়াস লেগেছে। পানি দাও। আমি বাতি জ্বালিয়ে দেখি—হাত ফুলে ঢোল হয়েছে। গা আগুনের মতো গরম। আমি বললাম, ডাক্তার ডাকি। সে বলল, ভোর হোক। এত রাতে ডাক্তার কোথায় পাবে? সেই ভোর আর তার দেখা হল না।’
মিসির আলি ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করছেন। ভদ্রমহিলা কথা বলেই যাচ্ছেন। মৃত্যুর বর্ণনা। মৃত্যুর পরের অবস্থার বর্ণনা। কোনো কিছুই বাদ দিলেন না। একবার কিছুক্ষণের জন্যে থামতেই মিসির আলি বললেন, আপনার ঐ পক্ষের কোনো ছেলেমেয়ে নেই?
‘থাকবে না কেন, আছে। দুই মেয়ে। একজনকে মেট্রিক পাসের সঙ্গে সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলাম। ও এখন আছে কুমিল্লায়। আমার অসুখের খবর পেয়ে দেখতে এসেছিল। একা এসেছিল, জামাই আসতে পারে নি। ছুটি পায় নি। ছোট মেয়ের বিয়ে হয়েছে গত বৎসর। নানান কাণ্ড করে মেয়ে নিজেই বিয়ে করল। ভদ্র সমাজে তা বলা যায় না। বড়ই লজ্জার ব্যাপার। অথচ এই মেয়েটাই ভালো ছিল। খুব নরম স্বভাবের মেয়ে। রাতে একা ঘুমাতে পারত না।…’
ভদ্রমহিলা ছোট মেয়ের ঘটনাও পুরোটা বর্ণনা করলেন। দাঁড়ি কমা কিছুই বাদ দিলেন না। মিসির আলি বললেন, আপনার ছেলে তন্ময় সম্পর্কে বলুন। আপনার কাছে ওর কথাই শুনতে এসেছি।
‘ওর কথা আমি কী বলব? ওকে কি আমি দেখেছি? শুধু পেটেই ধরেছি। ও যখন কথা বলা শিখল তখন তার বাবা আমাকে দূর করে দিল। সন্ধ্যাবেলা আমার ঘরে এসে বলল, মোমেনা, রিকশায় ওঠ—’
‘রিকশায় ওঠার ব্যাপারটা আপনি আগে একবার বলেছেন।’
‘একবার বললে আবারো বলা যায়। দুঃখের কথা বারবার বললে দুঃখ কমে। সুখের কথা বারবার বললে সুখ বাড়ে। এই জন্যে দুঃখের কথা, সুখের কথা দুটাই বারবার বলতে হয়।’
‘আপনার স্বামী আপনাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন কেন?’
‘সেটা আমি আপনাকে বলব না। সেটা লজ্জার ইতিহাস। আপনি অনুমানে বুঝে নেন। লোকটা পাগল ধরনের ছিল। ছেলেও হয়েছে বাপের মতো। বাপ যদি হয় ছয় আনা, ছেলে হয়েছে দশ আনা।’
‘এই কথা কেন বলছেন?’
‘কেন বলব না? একশ বার বলব। আমার ছেলের মুখের উপর বলব। অবস্থা বিবেচনা করেন। অবস্থা বিবেচনা করলে আপনেও বলবেন—তন্ময়ের তখন বাবা মারা গেছে। সে বলতে গেলে দুধের শিশু। আমার বিবাহ হয়েছে। আমি চলে গেছি জামালপুর। এই অবস্থায় তন্ময়কে মানুষ করেছে তাদের ম্যানেজার। নিজের সন্তানের মতো মানুষ করেছে। তার সঙ্গে আমার ছেলে কী ব্যবহারটাই করল! সন্ধ্যাবেলা বাড়ি থেকে বের করে দিল। আমাকে যেমন সন্ধ্যাবেলা বাড়ি থেকে বের করে দিল- তাদেরকেও বের করে দিল। ম্যানেজার, আর তার মেয়ে। মেয়েটা বি.এ. পড়ে। কী সুন্দর পরীর মতো মেয়ে।
‘ঐ মেয়েকে আপনি দেখেছেন?’
‘জিনা দেখি নি। লোকমুখে শোনা। আমার সবই লোকমুখে শোনা।’
‘উনারা কি আপনার ছেলের বাড়িতে থাকতেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘কেন বের করে দিলেন কিছু জানেন?’
‘কিছুই জানি না। ছেলে শুধু বলেছে—সে এখন থেকে একা থাকতে চায়। মানুষ তার ভালো লাগে না। কয়েকটা কুকুর নাকি পুষেছে। কুকুর নিয়ে থাকে।
‘ম্যানেজার সাহেব এখন কোথায় থাকেন?’
‘জানি না কোথায় থাকেন। তবে চাকরি করেন না। চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন।’
‘আপনার ছেলে এখন ঐ বাড়িতে একাই থাকে?’
‘কিছুক্ষণ আগে কী বললাম—কতগুলো কুকুর পালে। আগে দারোয়ান ছিল। কাজের লোক ছিল। একে একে সবাই চলে গেছে। এখন শুনি—একলাই থাকে।’
‘চাকরি ছেড়ে চলে গেছে কেন?’
‘জানি না কেন। সম্ভবত কুকুরের ভয়ে। দৈত্যের মতো একেকটা কুকুর। এখন আপনি বলেন—জীবন বড়, না চাকরি বড়?’
‘আপনার স্বামী কীভাবে মারা গিয়েছিলেন?’
‘একটু আগে তো বলেছি—কাঁকড়া বিছার কামড়ে মারা গেছে। রেলের গুদামে ঢুকেছে…’
‘আপনার প্রথম স্বামীর মৃত্যুর কথা জিজ্ঞেস করছি।’
‘অপঘাতে মৃত্যু। দোতলার সিঁড়ি থেকে পিছলে পড়ে মরে গেল। সিঁড়ি থেকে পড়ে কেউ মরে? আপনি বলেন। হাত-পা ভাঙে—কিন্তু মরবে কেন?’
মিসির আলির মনে হল ইনাকে কিছু জিজ্ঞেস করা অর্থহীন। অসুখবিসুখ, দুঃখকষ্ট এই মহিলাকে পর্যুদস্ত করেছে। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত হতাশার কথাই বলবেন। তাঁর চিন্তা-চেতনা নিজেকে নিয়েই। ইনি কথা বলতে পছন্দ করেন। যারা কথা বলতে পছন্দ করে তারা অধিকাংশ সময়ই অর্থহীন কথা বলে। কথা বলে আরাম পায় বলেই কথা বলা। সেসব কথার অধিকাংশই হয় বানানো। মিসির আলি যা জানতে চান তা ইনি হয়তো বলতে পারবেন না। তবু চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া-
‘আপনার ছেলের অসুখের কথা কি মনে আছে? ছোটবেলায় অসুখ হয়ে গেল?’
‘কেন মনে থাকবে না। মনে আছে। কালাজ্বর হয়েছিল। এখন আপনি বলুন— আপনি কি শুনেছেন কারো কালাজ্বর হয়? শুনেন নি। কারণ কারোর হয় না। এটা হল আমার কপাল—যে জিনিস কারোর হবে না—আমার কপালে সেটা থাকবে। কালাজ্বরে ব্রহ্মচারী ইনজেকশন দিতে হয়। সেই ইনজেকশন পাওয়া যায় না। উল্টাপাল্টা চিকিৎসা। সেই চিকিৎসায় কী হল দেখেন। জিহ্বা কালো হয়ে গেল। দেখলে ভয় লাগে। তন্ময় যে কারো সঙ্গে মেশে না, কারো সঙ্গে কথা বলে না—এই জন্যেই বলে না। একা একা থাকে। আপনাকে বলে রাখলাম, সে বিয়েও করতে পারবে না। কে বিয়ে করবে এই ছেলেকে? একবার হাঁ করলে মেয়ে দৌড়ে পালাবে। আমি হলাম মা। আমিই ভয় পেতাম। মুখের দিকে তাকাতাম না। এই বার তার ম্যানেজারকে আমি বলেছি—তোমার সাহেবকে বল কত নতুন নতুন চিকিৎসা বের হয়েছে, এই রোগের চিকিৎসকও আছে। তোমার সাহেবের তো টাকাপয়সা আছে। বিলাত ও আমেরিকা গিয়ে চিকিৎসা যেন করে।’
‘উনার কি অনেক টাকাপয়সা?’
‘একসময় ছিল। এখন নাই। তার বাবার টাকাপয়সা ছিল। নানান ব্যবসাপাতি ছিল। টঙ্গীতে চামড়ার কারখানা ছিল। নারায়ণগঞ্জে ছিল সুতার মিল। শেষে মতিভ্রমও হল। সব বিক্রি করে দিল। তন্ময়ের কিছুই নাই। কারখানা সব বিক্রি করে দিয়েছে। ওয়ারীতে একটা দোতলা বাড়ি আছে। বাড়িটার ভাড়া পায়। এখন শুনছি সেই বাড়িও বিক্রি করে দেবে।’
‘কোথায় শুনলেন? সে বলেছে?’
‘না, সে বলে নাই। এইসব কথা সে বলে না। লোকমুখে শুনি।’
‘তন্ময় কি আপনাকে হাতখরচের টাকা দেয়?’
‘তা দেয়। মাসের প্রথমে, এক-দুই তারিখে ওর নতুন ম্যানেজার টাকা নিয়ে আসে। ম্যানেজারের নাম রশিদ মোল্লা। আমার হাতে দিয়ে বলে–আম্মা, এই কাগজটায় সই করে টাকা গুনে রাখেন। আমি বলি, বাবা, সই করার দরকার কী? সে বলে দরকার আছে, আম্মা, সই করেন। ম্যানেজার আমাকে খুব সম্মান করে। আম্মা ডাকে।’
‘রশিদ মোল্লার কাছ থেকেই কি শুনেছেন যে ওয়ারীর বাড়ি বিক্রি হচ্ছে?’
‘জি।’
‘উনি কোথায় থাকেন? আপনার ছেলের সঙ্গে?’
‘না না। কী বললাম আপনাকে? তন্ময় তার বাড়িতে কাউকে রাখে না। সে থাকে, দুইটা দারোয়ান থাকে আর বাড়িভর্তি কুকুর। আমি তাকে বললাম, বাবা, এত কুকুর কেন? কুকুর প্রাণীটা ভালো না। তুমি বিড়াল পোষ। বিড়াল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। দেখতেও সুন্দর। আমাদের নবীজীও বিড়াল পছন্দ করতেন। তা সে আমার কথা শুনে না। কেন শুনবে? আমি কে? কুকুরগুলো সারা রাত বাড়ির চারদিকে ছোটাছুটি করে। মাঝে মাঝে একসঙ্গে ডাকে। বড়ই ভয়ংকর।
‘ভয়ংকর কী করে বলছেন? আপনি তো ঐ বাড়িতে যানও নি। কুকুরের ডাকও শুনেন নি।’
‘রশিদের কাছে শুনলাম। প্রতি মাসে আসে। গল্পটল্প করে। যাবার সময় পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। ম্যানেজার বলল, আম্মা, বড় ভয়ংকর অবস্থা। নয়টা কুকুর। সারা রাত বাড়ির চারদিকে ঘুরে। ভয়ংকর স্বরে একসঙ্গে ডাকে। গায়ের রক্ত পানি হয়ে যায়।’
‘রশিদ সাহেব কোথায় থাকেন, আপনি ঠিকানা জানেন?’
‘কাগজে লেখা আছে। টেলিফোন নাম্বার দেওয়া আছে। সে আমাকে বলল, দরকারে-অদরকারে ডাকবেন। আমি চলে আসব। যত রাতই হোক, খবর পেলে চলে আসব। পরের ছেলে এই কথা বলে কিন্তু নিজের ছেলে কিছু বলে না। খোঁজও নেয় না। এই ছেলে দিনের বেলা ঘর থেকে বের হয় না। সে ঘর থেকে বের হয় সন্ধ্যার পর।’
মিসির আলি ম্যানেজারের ঠিকানা নিলেন। উঠবার সময় বললেন, আমি যে আপনাকে এত কথা জিজ্ঞেস করছি—কেন করছি জানতে চান না?
‘না। জেনে কী হবে? তার উপর তন্ময় খবর দিয়েছে—আপনার কাছে একজন ভদ্রলোক আসবেন। তাঁর নাম মিসির আলি। উনি আপনাকে অনেক প্রশ্ন করবেন। সব প্রশ্নের জবাব দেবেন। কোনো কিছুই গোপন করবেন না। যা আপনি জানেন তাই শুধু বলবেন। যা জানেন না তা বলবেন না। নিজে অনুমান করে যদি কিছু বলেন তা হলে সেটাও উনাকে জানাবেন। বলবেন—এটা আমার অনুমান।’
‘আপনাকে ধন্যবাদ। আজ তা হলে উঠি?’
‘আপনি কি আবার আসবেন?’
‘জি না। আর আসব না।’
‘আপনাকে চা পানি কিছুই দিতে পারলাম না। ঘরে অবিশ্যি লোক আছে। থাকলে কী হবে—এদের কিছু বললে বিরক্ত হয়। সেদিন জইতরীর মাকে বললাম- পিয়াস লাগছে, লেবু দিয়ে একগ্লাস শরবত দাও। জইতরীর মা বলল, পারব না। চুলা বন্ধ। দেখেন অবস্থা। শরবত বানাতে চুলা লাগে? আরেকদিন কী হয়েছে শুনেন–-’
‘আজ যাই। আমার একটা কাজ ছিল।’
‘একটু বসেন না। কথা বলার লোক পাই না। কাউকে যে সুখ-দুঃখের একটা কথা বলব সে উপায় নাই। নিজের ভাইয়ের বাসা, এরা এমন ভাব করে যেন আমাকে দয়া করে আশ্রয় দিয়েছে। অথচ নগদ পয়সা দিয়ে থাকি। মাসের প্রথমে গুনে গুনে দুই হাজার টাকা দেই। আমার পিছনে কি দুই হাজার টাকা খরচ হয়—আপনিই বলেন? কী খাই আমি? দুই বেলায় এক পোয়া চালের ভাতও খাই না। মাসে সাত সের চালের ভাতও খাই না। সাত সের চালের দাম কত? ধরেন নব্বুই। মাছ তরকারি ধরেন তিন শ—বেশিই ধরলাম। এত খাই না। রাতে এক কাপ দুধ খাই। দুধের দাম কত ধরবেন? এক শ ধরেন। এখন পনের টাকা লিটার। তা হলে কত হল? চার শ। আচ্ছা পাঁচশই ধরলাম। ঘরটার ভাড়া ধরলাম পাঁচ শ। হল এক হাজার। তারপরেও বাড়তি দেই এক হাজার। দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন।’
মিসির আলি বসলেন। ভদ্রমহিলা গলা নিচু করে বললেন, তন্ময় আমাকে মাসে পাঁচ হাজার দেয়। ওরা সেটা জানে না। জানলে উপায় আছে? ওরা জানে মাসে দুই হাজার পাই—সবটাই ওদের দিয়ে দেই। তবে আমার ভাইয়ের বউ সন্দেহ করে। আমি যখন হাসপাতালে ছিলাম তখন আমার ট্রাংকের তালা খুলে দেখেছে। অতি খারাপ মেয়েছেলে। মুখে মধু। হাসি ছাড়া কথা বলে না।
‘আজ উঠি?’
‘আহা বসেন না। একটু বসেন।’
মিসির আলি আরো এক ঘণ্টা বসলেন। বের হয়ে এলেন প্রচণ্ড মাথার যন্ত্রণা নিয়ে।
ঘর থেকে বেরুবার পর মনে পড়ল একটি জরুরি কথা জিজ্ঞেস করা হয় নি। উনি কি মাস্টার সাহেবকে দিয়ে কোনো চিঠি পাঠিয়েছিলেন? জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে না। কারণ জিজ্ঞেস করে কোনো লাভ নেই। ভদ্রমহিলা বলবেন না। তিনি কিছু গোপন জিনিস জানেন। এগুলো আড়াল করবার জন্যেই এত অপ্রাসঙ্গিক কথা বলছেন। এত দীর্ঘ সময় কথা বলে একটি মাত্র জিনিস জানা গেল-নিজের ছেলে প্রসঙ্গে ভদ্রমহিলার কোনো আগ্রহ নেই।
তার চেয়ে বরং রশিদ মোল্লার কাছে যাওয়া যাক।