০৪. বৎসর দুই কোথা দিয়া কাটিয়া গেল

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

বৎসর দুই কোথা দিয়া কাটিয়া গেল।

অপু ক্রমেই বড়ো জড়াইয়া পড়িয়াছে, খরচে আয়ে কিছুতেই আর কুলাইতে পারে না। নানাদিকে দেনা কতভাবে হুঁশিয়ার হইয়াও কিছু হয় না। এক পয়সার মুড়ি কিনিয়া দুই বেলা খাইল, নিজে সাবান দিয়া কাপড় কাচিল, লজেঞ্জুস ভুলিয়া গেল।

পরদিনই আবার বোর্ডিং-এর ছেলেদের দল চাঁদা করিয়া হালুয়া খাইবে। অপু হাসিমুখে সমীরকে বলিল-দু-আনা ধাব দিবি সমীর, হালুয়া খাবো?—দু-আনা করে চাঁদা—ওই ওবা ওখানে করছে—কিশমিশ দিয়ে বেশ ভালো করে করচে–

সমীরেব কাছে অপুর দেনা অনেক। সমীর পয়সা দিল না।

প্রতিবার বাড়ি হইতে আসিবার সময় সে মায়ের যৎসামান্য আয হইতে টাকাটা আধুলিটা প্রায়ই চাহিয়া আনে—মা না দিতে চাহিলে রাগ করে, অভিমান করে, সর্বজয়াকে দিতেই হয়।

ইহার মধ্যে আবার পটু মাঝে মাঝে আসিয়া ভাগ বসাইয়া থাকে। সে কিছুই সুবিধা করিতে পারে নাই পড়াশুনার। নানাস্থানে ঘুবিছে, ভগ্নিপতি অর্জুন চক্রবর্তী তত তাহাকে বাড়ি ঢুকিতে দেয় না। বিনিকে এ সব লইয়া কম গঞ্জনা সহ্য করিতে হয় নাই বা কম চোখের জল ফেলিতে হয় নাই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পটু নিরাশ্রয় ও নিরবলম্ব অবস্থায় পথে পথেই ঘোরে, যদিও পড়াশুনাব আশা সে এখনও অবধি ছাড়ে নাই। অপু তাহার জন্য অনেক চেষ্টা করিয়াছে, কিন্তু সুবিধা করিতে পারে নাই। দু-তিন মাস হয়তো দেখা নাই, হঠাৎ একদিন কোথা হইতে পুঁটলি বগলে করিয়া পটু আসিয়া হাজির হয়, অপু তাহাকে যত্ন করিয়া বাখে, তিন-চারদিন ছাড়ে না, সে না চাহিলেও যখন যাহা পাবে হাতে খুঁজিয়া দেয়টাকা পারে না, সিকিটা দুয়ানিটা। পটু নিশ্চিন্দিপুরে আর যায় না–তাহার বাবা সম্প্রতি মারা গিয়াছেন—সত্যা দেশের বাড়িতে তাহার দুই মেয়ে লইয়া থাকেন, সেখানে ভাই বোন কেহই আর যায় না। পটুকে দেখিলে অপুর ভাবি একটা সহানুভূতি হয়, কিন্তু ভালো কবিবার তাহার হাতে আর কি ক্ষমতা আছে?

একদিন রাসবিহারী আসিয়া দু-আনা পয়সা ধার চাহিল। রাসবিহারী গরিবের ছেলে, তাহা ছাড়া পড়াশুনায় ভালো নয় বলিয়া বোর্ডিং-এ খাতিরও পায় না। অপুকে সবাই দলে নেয়, পয়সা দিতে না পারিলেও নেয়। কিন্তু তাহাকে পোঁছেও না। অপু এ সব জানিত বলিয়াই তাহার উপর কেমন একটা করুণা। কিন্তু আজ সে নানা কারণে রাসবিহারীর প্রতি সন্তুষ্ট ছিল না। বলিল, আমি কোথায় পাবো পয়সা?—আমি কি টাকার গাছ?—দিতে পারবো না যাও।রাসবিহারী পীড়াপীড়ি শুরু করিল। কিন্তু অপু একেবারে বাঁকিয়া বসিল। বলিল, কক্ষনো দেবো না তোমায়—যা পারো করো।

রমাপতির কাছে ছেলেদের একখানা মাসিক পত্র আসে, তাহাতে সে একদিন ছায়াপথ সম্বন্ধে একটা প্রবন্ধ পড়িল। ছায়াপথ কাহাকে বলে ইহার আগে জানিত না—এতবড় বিশাল কোন জিনিসের ধারণাও কখনও করে নাই-নক্ষত্রের সম্বন্ধেও কিছু জানা ছিল না। শরতের আকাশ রাত্রে মেঘমুক্ত-বোর্ডিং-এর পিছনে খেলার কম্পাউন্ডে রাত্রে দাঁড়াইয়া ছায়াপথটা প্রথম দেখিয়া সে কী আনন্দ। জুলজুলে সাদা হায়াপথটা কালো আকাশের বুক চিরিয়া কোথা হইতে কোথায় গিয়াছে— শুধু নক্ষত্রে ভরা!…

কাঁঠালতলাটায় দাঁড়াইয়া সে কতক্ষণ মুগ্ধনেত্রে আকাশের পানে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিল–নবজাগ্রত মনের প্রথম বিস্ময়!…

পৌষ মাসের প্রথমে অপুর নিজের একটু সুবিধা ঘটিল। নতুন ডেপুটিবাবুর বাসাতে ছেলেদের জন্য একজন পড়াইবার লোক চাই। হেডপণ্ডিত তাহাকে ঠিক করিয়া দিলেন। দুটি ছেলে পড়ানো, থাকা ও খাওয়া।

দুই-তিনদিনের মধ্যেই বোর্ডিং হইতে বাসা উঠাইয়া অপু সেখানে গেল। বোর্ডিং-এ অনেক বাকি পড়িয়াছে, সুপারিন্টেন্ডেন্ট তলে তলে হেডমাস্টারের কাছে এসব কথা রিপোর্ট করিয়াছেন, যদিও অপু তাহা জানে না।

বাহিরের ঘরে থাকিবার জায়গা স্থির হইল। বিছানাপত্র গুছাইয়া পাতিয়া লইতে সন্ধ্যা হইয়া গেল। সন্ধ্যার পরে খানিকটা বেড়াইয়া আসিয়া রাঁধুনী ঠাকুরের ডাকে বাড়ির মধ্যে খাইতে গেল। দালানে ঘাড় খুঁজিয়া খাইতে খাইতে তাহার মনে হইল—একজন কে পাশের দুয়ারের কাছে দাঁড়াইয়া অনেকক্ষণ হইতে তাহার খাওয়া দেখিতেছেন। একবার মুখ তুলিয়া চাহিয়া দেখিতে তিনি সবিয়া আসিলেন। খুব সুন্দরী মহিলা, তাহার মায়ের অপেক্ষাও ব্যস অনেক-অনেক কম। তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন—তোমার বাড়ি কোথায়?

অপু ঘাড় না তুলিয়া বলিল, মনসাপোতা—অনেক দূর এখেন থেকে–

-বাড়িতে কে কে আছেন?

–শুধু মা আছেন, আর কেউ না।

—তোমার বাবা বুঝি ভাই বোন কটি তোমরা?

—এখন আমি একা। আমার দিদি ছিল—সে সাত-আট বছর হল মারা গিয়েছে।–

কোনোরকমে তাড়াতাড়ি খাওয়া সাবিয়া সে উঠিয়া আসিল। শীতকালেও সে যেন ঘামিয়া উঠিয়াছে।

পরদিন সকালে অপু বাড়ির ভিতর হইতে খাইয়া আসিয়া দেখিল, বছর তেরো বয়সের একটি সুন্দরী মেয়ে ছোট্ট একটি খোকাব হাত ধরিয়া বাহিরের ঘরে দাঁড়াইয়া আছে। অপু বুঝিল—সে কাল রাত্রের পরিচিত মহিলাটির মেয়ে। অপু আপন মনে বই গুছাইয়া স্কুলে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিল, মেয়েটি একদৃষ্টে চাহিয়া দেখিতেছিল। হঠাৎ অপুর ইচ্ছা হইল, এ মেয়েটির সামনে কিছু পৌরুষ দেখাইবে—কেহ তাহাকে বলিয়া দেয় নাই, শিখায় নাই, আপনাআপনি তাহার মনে হইল। হাতের কাছে অন্য কিছু না পাইয়া সে নিজের অঙ্কের ইনস্ট্রমেন্ট বাক্সটা বিনা কারণে খুলিয়া প্রোটেক্টর, সেটুস্কোয়ার, কম্পাসগুলোকে বিছানার উপর ছড়াইয়া ফেলিয়া পুনরায় সেগুলো বাক্সে সাজাইতে লাগিল। কি জানি কেন অপুর মনে হইল, এই ব্যাপারেই তাহার চরম পৌরুষ দেখানো হইবে। মেয়েটি দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিল, কোনো কথা বলিল না, অপুও কোনো কথা বলিল না।

আলাপ হইল সেদিন সন্ধ্যায়। সে স্কুল হইতে আসিয়া সবে দাঁড়াইয়াছে, মেয়েটি আসিয়া লাজুক চোখে বলিল—আপনাকে মা খাবার খেতে ডাকছেন।

আসন পাতা—পরোটা, বেগুন ভাজা, আলুচচ্চড়ি, চিনি। অপু চিনি পছন্দ করে না গুড়ের মতো জিনিস নাই, কেন ইহারা এমন সুন্দর গরম গরম পরোটা চিনি দিয়া খায়?…

মেয়েটি কাছে দাঁড়াইয়া ছিল। বলিল—মাকে বলব আর দিতে?

–না; তোমরা চিনি খাও কেন?…গুড় তো ভালো—

মেয়েটি বিস্মিতমুখে বলিল—কেন, আপনি চিনি খান না?

–ভালোবাসি নেরুগীর খাবার—খেজুর গুড়ের মতো কি আর খেতে ভালো?—মেয়েটির সামনে তাহার আদৌ লজ্জা ছিল না, কিন্তু এই সময়ে মহিলাটি ঘরে ঢোকাতে অপুর লম্বা লম্বা কথা বন্ধ হইয়া গেল। মহিলাটি বলিলেন—ওকে দাদা বলে ডাকবি নির্মলা, কাছে বসে খাওয়াতে হবে রোজ। ও দেখছি যে-রকম লাজুক, এ পর্যন্ত তো আমার সঙ্গে একটা কথাও বললে না-না দেখলে আধপেটা খেয়ে উঠে যাবে।

অপু লজ্জিত হইল। মনে মনে ভাবিল ইহাকে সে মা বলিয়া ডাকিবে। কিন্তু লজ্জায় পারিল, সুযোগ কোথায়? এমনি খামকা মা বলিয়া ডাকা—সে বড়ো—সে তাহা পারিবে না।

মাসখানেক ইহাদের বাড়ি থাকিতে থাকিতে অপুর কতকগুলি নতুন বিষয়ে জ্ঞান হইল। সবাই ভারি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, আটপৌরে পোশাক-পরিচ্ছদও সুদৃশ্য ও সুরুচিসম্মত। মেয়েদের শাড়ি পরিবার ধরনটি বেশ লাগে, একে সবাই দেখিতে সুশ্রী, তাহার উপর সুদৃশ্য শাড়ি-সেমিজে আরও সুন্দর দেখায়। এই জিনিসটা অপু কখনও জানিত না, বড়োলোকের বাড়ি থাকিবার সময়ও নহে, কারণ সেখানে ঐশ্বর্যের আড়ম্বরে তাহার অনভ্যস্ত চক্ষু ধাঁধিয়া গিয়াছিল—সহজ গৃহস্থ জীবনের দৈনন্দিন ব্যাপারের পর্যায়ে তাহাকে সে ফেলিতে পারে নাই।

অপু যে-সমাজ, যে-আবহাওয়ায় মানুষ—সেখানকার কেহ এ ধরনের সহজ সৌন্দর্যময় জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত নয়। নানা জায়গায় বেড়াইয়া নানা ধরনের লোকের সঙ্গে মিশিয়া তাহার আজকাল চোখ ফুটিয়াছে; সে আজকাল বুঝিতে পারে নিশ্চিন্দিপুরে তাহাদের গৃহস্থালি ছিল দরিদ্রের, অতি দরিদ্রের গৃহস্থালি। শিল্প নয়, শ্রী ছাঁদ নয়, সৌন্দর্য নয়, শুধু খাওয়া আর থাকা।

নির্মলা আসিয়া কাছে বসিল। অপু অ্যালজেব্রার শক্ত আঁক কষিতেছিল, নির্মলা নিজের বইখানা খুলিয়া বলিল—আমায় ইংরেজিটা একটু বলে দেবেন দাদা?

অপু বলিল—এসে জুটলে? এখন ওসব হবে না, ভারি মুশকিল, একটা আঁকও সকাল থেকে মিলল না!

নির্মলা নিজে বসিয়া পড়িতে লাগিল। সে বেশ ইংরেজি জানে, তাহার বাবা যত্ন করিয়া শিখাইয়াছেন, বাংলাও খুব ভালো জানে।

একটু পড়িয়াই সে বইখানা বন্ধ করিয়া অপুর আঁক কষা দেখিতে লাগিল। খানিকটা আপন মনে চুপ করিয়ে বসিয়া রহিল। তাহার পর আর একবার ঝুঁকিয়া দেখিয়া অপুর কাঁধে হাত দিয়া ডাকিয়া বলিল—এদিকে ফিরুন দাদা, আচ্ছা এই পদ্যটা মিলিয়ে–

অপু বলিল—যাও! আমি জানি নে, ওই তো তোমার দোষ নির্মলা, আঁক মিলছে না, এখন তোমার পদ্য মেলাবার সময়—আচ্ছা লোক

নির্মলা মৃদু মৃদু হাসিয়া বলিল—এ পদ্যটা আর মেলাতে হয় না আপনার বলুন দিকি—সেই গাছ গাছ নয়, যাতে নেই ফল

অপু আঁক-কষা ছাড়িয়া বলিল—মিলবে না? আচ্ছা দ্যাখোপরে খানিকটা আপন মনে ভাবিয়া বলিল—সেই লোক তোক নয়, যার নেই বল-হল না?

নির্মলা লাইন দুটি আপন মনে আবৃত্তি করিয়া বুঝিয়া দেখিল কোথায়ও কানে বাধিতেছে কি। ঘাড় নাড়িয়া বলিল—আচ্ছা এবার বলুন তো আর একটা

–আমি আর বলব না—তুমি ওরকম দুষ্টুমি করো কেন? আমি আঁকগুলো কষে নিই, তারপর যত ইচ্ছা পদ্য মিলিয়ে দেবো

–আচ্ছা এই একটা-সেই ফুল ফুল নয়, যার—

–মাকে এখুনি উঠে গিয়ে বলে আসবো, নির্মলা—ঠিক বলছি, ওরকম যদি–

নির্মলা রাগ করিয়া উঠিয়া গেল। যাইবার সময় পিছন ফিরিয়া তাহার দিকে চাহিয়া বলিলওবেলা কে খাবার বয়ে আনে বাইরের ঘরে দেখবো–

এরকম প্রায়ই হয়, অপু ইহাতে ভয় পায় না। বেশ লাগে নির্মলাকে।

পূজার পর নির্মলার এক মামা বেড়াইতে আসিলেন। অপু শুনিল, তিনি নাকি বিলাতফেরত নির্মলার ছোট ভাই নস্তুর নিকট কথাটা শুনিল। বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশের বেশি নয়, বোগা শ্যামবর্ণ। এ লোক বিলাতফেরত!

বাল্যে নদীর ধারে ছায়াময় বৈকালে পুরাতন বঙ্গবাসী তে পড়া সেই বিলাতযাত্রীর চিঠির মধ্যে পঠিত আনন্দভরা পুরাতন পথ বাহিয়া মরুভূমির পার্শ্বের সুয়েজ খালের ভিতর দিয়া, নীল ভূমধ্যসাগরমধ্যস্থ দ্রাক্ষাকুঞ্জবেষ্টিত কর্সিকা দুরে ফেলিয়া সেই মধুর স্বপ্নমাখা পথ-যাত্রা।

এই লোকটা সেখানে গিয়াছিল? এই নিতান্ত সাধারণ ধরনের মানুষটা-যে দিব্য নিরীহমুখে রান্নাঘরের দাওয়ায় বসিয়া মোচার ঘণ্ট দিয়া ভাত খাইতেছে!

দু-এক দিনেই নির্মলার মামা অমরবাবুর সহিত তাহার খুব আলাপ হইয়া গেল।

বিলাতের কত কথা সে জানিতে চায়। পথের ধারে সেখানে কি সব গাছপালা? আমাদের দেশের পরিচিত কোন গাছ সেখানে আছে? প্যারিস খুব বড়ো শহর? অমরবাবু নেপোলিয়নের সমাধি দেখিয়াছেন? ডোভারের খড়ির পাহাড়? ব্রিটিশ মিউজিয়ামে নাকি নানা অদ্ভুত জিনিস আছে কি কি? আর ভেনিস?—ইতালির আকাশ নাকি দেখিতে অপূর্ব?

পাড়াগাঁয়ের স্কুলের ছেলে, এত সব কথা জানিবার কৌতূহল হইল কি করিয়া অমরবাবু বুঝিতে পারেন না। এত আগ্রহ করিয়া শুনিবার মতো জিনিস সেখানে কি আর আছে! একঘেয়েধোঁয়া–বৃষ্টি-শীত। তিনি পয়সা খরচ করিয়া সেখানে গিয়াছিলেন সাবান প্রস্তুত প্রণালী শিখিবার জন্য, পথের ধারের গাছপালা দেখিতে যান নাই বা ইতালির আকাশের রং লক্ষ করিয়া দেখিবাব উপযুক্ত সময়ের প্রাচুর্যও তার ছিল না।

নির্মলাকে অপুর ভালো লাগে, কিন্তু সে তাহা দেখাইতে জানে না। পবের বাড়ি বলিয়াই হউক বা একটু লাজুক প্রকৃতির বলিয়াই হউক, সে বাহিরের ঘরে শান্তভাবে বাস করে-কি তাহার অভাব, কোষ্টা তাহার দরকার, সে কথা কাহাকেও জানায় না। অপুর এই উদাসীনতা নির্মলার বড়ো বাজে, তবুও সে না চাহিতেই নির্মলা তাহার মযলা বালিশের ওযাড় সাবান দিয়া নিজে কাচিয়া দিয়া যায়, গামছা পরিষ্কার করিয়া দেয়, ছেঁড়া কাপড় বাড়ির মধ্যে লইয়া গিয়া মাকে দিয়া সেলাইয়েব কলে সেলাই করিয়া আনিয়া দেয়। নির্মলা চায় অপূর্ব-দাদা তাহাকে ফাইফরমাশ করে, তাহার প্রতি হুকুমজারি করে; কিন্তু অপু কাহারও উপর কোনো হুকুম কোনোদিন করিতে জানে না—এক মা ছাড়া। দিদি ও মায়ের সেবায় সে অভ্যস্ত বটে, তাও সে-সেবা অযাচিতভাবে পাওয়া যাইত তাই। নইলে অপু কখনও হুকুম করিয়া সেবা আদায় করিতে শিখে নাই। তা ছাড়া সে সমাজের যে স্তরের মধ্যে মানুষ, ডেপুটিবাবুরা সেখানকার চোখে ব্রহ্মলোকবাসী দেবতার সমকক্ষ জীব। নির্মলা ডেপুটিবাবুর বড় মেয়ে—রূপে, বেশভূষায়, পড়াশুনায়, কথাবার্তায় একমাত্র লীলা ছাড়া সে এ পর্যন্ত যত মেয়ের সংস্পর্শে আসিয়াছে—সকলের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। সে কি করিয়া নির্মলার উপর হুকুমজারি করিবে? নির্মলা তাহা বোঝে না—সে দাদা বলিয়া ডাকে, অপুর প্রতি একটা আন্তরিক টানের পরিচয় তাহার প্রতি কাজে-কেন অপূর্ব-দাদা তাহাকে প্রাণপণে খাটাইয়া লয় না, নিষ্ঠুরভাবে অযথা ফাইফরমাশ করে না? তাহা হইলে সে খুশি হইত।

চৈত্র মাসের শেষে একদিন ফুটবল খেলিতে খেলিতে অপুর হাঁটুটা কি ভাবে মচকাইয়া গিয়া সে মাঠে পড়িয়া গেল। সঙ্গীরা তাহাকে ধরাধরি করিয়া আনিয়া ডেপুটিবাবুর বাসায় দিয়া গেল। নির্মলার মা ব্যস্ত হইয়া বাহিরের ঘরে আসিলেন, কাছে গিয়া বলিলেন–দেখি দেখি, কি হয়েছে? অপুর উজ্জ্বল গৌরবর্ণ সুন্দর মুখ ঘামে ও যন্ত্রণায় রাঙা হইয়া গিয়াছে, ডান পা-খানা সোজা করিতে পারিতেছে না। মনিয়া চাকর নির্মলার মার স্লিপ লইয়া ডাক্তারখানায় ছুটিল। নিলা বাড়ি ছিল না, ভাইবোনদের লইয়া গাড়ি করিয়া মুন্সেফবাবুর বাসায় বেড়াইতে গিয়াছিল। একটু পরে সরকারি ডাক্তার আসিয়া দেখিয়া শুনিয়া ঔষধের ব্যবস্থা করিয়া গেলেন। সন্ধ্যার আগে নির্মলা আসিল। সব শুনিয়া বাহিরের ঘরে আসিয়া বলিলকই দেখি, বেশ হয়েছে দস্যিবৃত্তি করার ফল হবে না? ভারি খুশি হয়েছি আমি–

নির্মলা কিছু না বলিয়া চলিয়া গেল। অপু মনে মনে ক্ষুন্ন হইয়া ভাবিল—যাক না, আর কখনও যদি কথা কই

আধ ঘণ্টা পরেই নির্মলা আসিয়া হাজির। কৌতুকের সুরে বলিল—পায়ের ব্যথা-ট্যথা জানি নে, গরম জল আনতে বলে দিয়ে এলাম, এমন করে সেঁক দেবোলাগে তো লাগবে—দুষ্টুমি করাব বাহাদুরি বেরিয়ে যাবে-কমলালেবু খাবেন একটা?—না, তাও না?

মনিয়া চাকর গরম জল আনিলে নির্মলা অনেকক্ষণ বসিয়া বসিয়া ব্যথার উপর সেঁক দিল, নির্মলার ভাইবোনেরা সব দেখিতে আসিয়া ধরিল-ও দাদা, এইবার একটা গল্প বলুন না।

অপুর মুখে গল্প শুনিতে সবাই ভালোবাসে।

নির্মলা বলিল-হা, দাদা এখন পাশ ফিরে শুতে পারছেন না—এখন গল্প না বললে চলবে কেন?…চুপ করে বসে থাকো সব-নয়তো বাড়ির মধ্যে পাঠিয়ে দেব।

পরদিন সকালটা নির্মলা আসিল না। দুপুরের পর আসিয়া বৈকাল পর্যন্ত বসিয়া নানা গল্প করিল, বই পড়িয়া শুনাইল। বাড়ির ভিতর হইতে থালায় করিয়া আখ ও শাঁখ-আলু কাটিয়া লইয়া আসিল। তাহার পর তাহাদের পদ্যমেলানোর আর অন্ত নাই! নির্মলার পদটি মিলাইয়া দিয়াই অপু তাহাকে আর একটা পদ মিলাইতে বলে–নির্মলাও অল্প কয়েক মিনিটে তাহার জবাব দিয়া অন্য একটা প্রশ্ন করে। …কেহ কাহাকেও ঠকাইতে পারে না।

ডেপুটিবাবুর স্ত্রী একবার বাহিরের ঘরে আসিতে আসিতে শুনিয়া বলিলেন—বেশ হয়েছে, আব ভাবনা নেই—এখন তোমরা দু-ভাইবোনে একটা কবির দল খুলে দেশে দেশে বেড়িয়ে বেড়াও গিয়ে–

অপু লজ্জিত হইয়া চুপ করিয়া রহিল। ডেপুটিবাবুর স্ত্রীর বড়ো সাধ অপু তাহাকে মা বলিয়া ডাকে। সে যে আড়ালে তাহাকে মা বলে, তাহা তিনি জানেন কিন্তু সামনাসামনি অপু কখনও তাহাকে মা বলিয়া ডাকে নাই, এজন্য ডেপুটিবাবুর স্ত্রী খুব দুঃখিত।

অপু যে ইচ্ছা করিয়া করে না তাহা নহে। ডেপুটিবাবুর বাসায় থাকিবার কথা একবার সে বাড়িতে গিয়া মায়ের কাছে গল্প করাতে সর্বজয়া ভারি খুশি হইয়াছিল। ডেপুটিবাবুর বাড়ি! কম কথা নয়!…সেখানে কি করিয়া থাকিতে হইবে, চলিতে হইবে সে বিষয়ে ছেলেকে নানা উপদেশ দিয়া অবশেষে বলিয়াছিল-ডেপুটিবাবুর বউকে মা বলে ডাকবি—আর ডেপুটিবাবুকে বাবা বলে ডাকবি–

অপু লজ্জিত মুখে বলিয়াছিল—হ্যাঁ, আমি ওসব পিরবো না

সর্বজয়া বলিয়াছিল—তাতে দোষ কি?—বলিস, তারা খুশি হবেন—কম একটা বোলোকের আশ্রয় তো নয়!—তাহার কাছে সবাই বড়ো মানুষ।

অপু তখন মায়ের নিকট রাজি হইয়া আসিলেও এখানে তাহা কার্যে পরিণত করিতে পারে নাই। মুখে কেমন বাধে, লজ্জা করে।

 

একদিন—অপু তখন একমাস হইল সারিয়া উঠিয়াছে—নির্মলা বাহিরের ঘরে চেয়ারে বসিয়া কি বই পড়িতেছিল, ঘোর বর্ষা সারা দিনটা, বেলা বেশি নাই-বৃষ্টি একটু কমিয়াছে। অপু বিনা ছাতায় কোথা হইতে ভিজিতে ভিজিতে আসিয়া দৌড়াইয়া ঘরে ঢুকিতেই নির্মলা বই মুড়িয়া বলিয়া উঠিল—এঃ, আপনি যে দাদা ভিজে একেবারে–

অপুর মনে যে জন্যই হউক খুব স্ফূর্তি ছিল–তাহার দিকে চাহিয়া বলিল—চট করে চা আর খাবার—তিন মিনিটে–

নির্মলা বিস্মিত হইল, সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত আনন্দিত হইল। এ রকম তো কখনও হুকুমের সুরে অপূর্বদা বলে না। সে হাসিমুখে মুখ টিপিয়া বলিল-পারব না তিন মিনিটে-ঘোড়ায় জিন দিয়ে এলেন কিনা একেবারে!

অপু হাসিয়া বলিল—আর তো বেশিদিন না—আর তিনটি মাস তোমাদের জ্বালাবো, তারপর চলে যাচ্ছি–

নির্মলার মুখ হইতে হাসি মিলাইয়া গেল। বিস্ময়ের সুরে বলিল—কোথায় যাবেন।

-তিন মাস পরেই এগজামিন দিয়েই চলে যাবো, কলকাতায় পড়বো পাস হলে—

নির্মলা এতদিন সম্ভবত এটা ভাবিয়া দেখে নাই, বলিল–আর এখানে থাকবেন না?

অপু ঘাড় নাড়িল। খানিকটা থামিয়া কৌতুকের সুরে বলিল—তুমি তো বাঁচো, যে খাটুনি তোমার তো ভালো—ওকি? বা রে-কি হলো–শোন নির্মলা–

হঠাৎ নির্মলা উঠিয়া গেল কেন—চোখে কি কথায় তাহার এত জল আসিয়া পড়িল, বুঝিতে পারিয়া সে মনে মনে অনুতপ্ত হইল। আপন মনে বলিল—আর ওকে ক্ষ্যাপাবো না—ভারী পাগল—আহা, ওকে সব সময় খোঁচা দিই—সোজা খেটেছে ও, যখন পা ভেঙে পড়েছিলাম পনেরো দিন ধরে, জানতে দেয় নি যে আমি নিজের বাড়িতে নেই–

ইহার মধ্যে আবার একদিন পটু আসিল। ডেপুটিবাবুর বাসাতে অপু উঠিয়া আসিবার পর সে কখনও আসে নাই। খানিকটা ইতস্তত করিয়া বাসায় ঢুকিল। এক-পা ধুলা, রুক্ষ চুল, হাতে পুটুলি। সে কোন সুবিধা খুঁজিতে আসে নাই, এদিকে আসিলে অপুর সঙ্গে দেখা না করিয়া সে যাইতে পারে না। পটুর মুখে অনেক দিন পর সে রানুদির খবর পাইল। পাড়াগাঁয়ের নিঃসহায় নিরুপায় ছেলেদের অভ্যাসমতো সে গ্রামের যত মেয়েদের শ্বশুরবাড়ি ঘুরিয়া বেড়ানো শুরু করিয়াছে। বাপের বাড়ির লোক, অনেকের হয়তো বা খেলার সঙ্গী, মেয়েরা আগ্রহ করিয়া রাখে, ছাড়িয়া দিতে চাহে না, যে কয়টা দিন থাকে খাওয়া সম্বন্ধে নির্ভাবনা। কোন স্থানে দু-দিন, কোথাও পাঁচদিন–মেয়েরা আবার আসিতে বলে, যাবার সময় খাবার তৈয়ারি করিয়া সঙ্গে দেয়। এ এক ব্যবসা পটু ধরিযাছে মন্দ নয়—ইহার মধ্যে সে তাহাদের পাড়ার সব মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে দু-চার বার ঘুরিয়া আসিয়াছে।

এইভাবেই একদিন রানুদির শববাড়ি সে গিয়াছে–সে গল্প কবিল। রানুদিব শ্বশুরবাড়ি রানাঘাটের কাছে—তাহারা পশ্চিমে কোথায় চাকুরি উপলক্ষে থাকেন-পূজার সময় বাড়ি আসিয়াছিলেন, সপ্তমী পূজার দিন অনাহতভাবে পটু গিযা হাজির। সেখানে আট দিন ছিল। রানুদিব যত্ন কি! তাহার দুরবস্থা শুনিয়া গোপনে তিনটা টাকা দিয়াছিল, আসিবার সময় নতুন ধুতি চাদর, এক পুটুলি বাসি লুচি সন্দেশ।

অপু বলিল—আমার কথা কিছু বললে না?

–শুধুই তোর কথা। যে কয়দিন ছিলাম, সকালে সন্ধ্যাতে তোর কথা। তারা আবার একাদশীর দিনই পশ্চিমে চলে যাবে, আমাকে রানুদি বললে, ভাড়ার টাকা দিচ্ছি, তাকে একবার নিয়ে আয় এখানে—ছবচ্ছব দেখা হয় নিতা আমার আবার জ্বর হল—দিদির বাড়ি এসে দশ-বারোদিন পড়ে রইলাম-তোর ওখানে আর যাওয়া হল না—ওরাও চলে গেল পশ্চিমে

—ভাড়ার টাকা দেয় নি?

পটু লজ্জিত মুখে বলিল—হ্যাঁ, তোর আর আমার যাতায়াতের ভাড়া হিসেব করেসেও খরচ হয়ে গেল, দিদি কোথায় আর পাবে, আমার সেই ভাড়ার টাকা থেকে নেবু ডালিম ওষুধ-সব হল। রানুদির মতন অমন মেয়ে আর দেখি নি অপুদা, তোর কথা বলতে তার চোখে জল পড়ে।

হঠাৎ অপুর গলা যেন কেমন আড়ষ্ট হইয়া উঠিল–সে তাড়াতাড়ি কি দেখিবার ভান করিয়া জানালার বাহিরের দিকে চাহিল।

–শুধু রানুদি না, যত মেয়ের শ্বশুরবাড়ি গেলাম, রানীদি, আশালতা, ওপাড়ার সুনয়নীদিসবাই তোর কথা আগে জিজ্ঞেস করে—

ঘণ্টা দুই থাকিয়া পটু চলিয়া গেল।

দেওয়ানপুর স্কুলেই ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা গৃহীত হয়। খরচ-পত্র করিয়া কোথাও যাইতে হইল। পরীক্ষার পর হেডমাস্টার মিঃ দত্ত অপুকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। বলিলেন-বাড়ি যাবে কবে?

এই কয় বৎসরে হেডমাস্টারের সঙ্গে তাহার কেমন একটা নিবিড় সৌহার্দ্যের সম্বন্ধ গড়িয়া উঠিয়াছে, দু-জনের কেহই এতদিনে জানিতে পারে নাই সে বন্ধন কতটা দৃঢ়।

অপু বলিল—সামনের বুধবার যাব ভাবছি।

–পাশ হলে কি করবে ভাবছো? কলেজে পড়বে তো?

–কলেজে পড়বার খুব ইচ্ছে, স্যর।

–যদি স্কলারশিপ না পাও?

অপু মৃদু হাসিয়া চুপ করিয়া থাকে।

–ভগবানের ওপর নির্ভর করে চলো, সব ঠিক হয়ে যাবে। দাঁড়াও, বাইবেলের একটা জায়গা পড়ে শোনাই তোমাকে

মিঃ দত্ত খ্রিস্টান। ক্লাসে কতদিন বাইবেল খুলিয়া চমৎকার চমৎকার উক্তি তাহাদের পড়িয়া শুনাইয়াছেন, অপুর তরুণ মনে বুদ্ধদেবের পীতবাসধারী সৌম্যমূর্তির পাশে, তাহাদের গ্রামের অধিষ্ঠাত্রী দেবী বিশালাক্ষীর পাশে, বোষ্টমদাদু নবরাত্তম দাসের ঠাকুর শ্রীচৈতন্যের পাশে, দীর্ঘদেহ শান্তনয়ন যীশুর মূর্তি কোন্ কালে অঙ্কিত হইয়া গিয়াছিল—তাহার মন যীশুকে বর্জন করে নাই, কাটার মুকুটপরা, লাঞ্ছিত, অপমানিত এক দেবোন্মাদ যুবককে মনেপ্রাণে বরণ করিতে শিখিয়াছিল।

মিঃ দত্ত বলিলেন—কলকাতাতেই পড়ো—অনেক জিনিস দেখবার শেখবার আছে—কোন কোন পাড়াগাঁয়ের কলেজে খবচ কম পড়ে বটে কিন্তু সেখানে মন বড়ো হয় না, চোখ ফোটে না, আমি কলকাতাকেই ভালো বলি।

অপু অনেকদিন হইতেই ঠিক করিয়া রাখিয়াছে, কলেজে পড়িবে এবং কলিকাতার কলেজেই পড়িবে।

মিঃ দত্ত বলিলেন—স্কুল লাইব্রেরির লে মিজারেবল-খানা তুমি খুব ভালোবাসতে-ওখানা তোমাকে দিয়ে দিচ্ছি, আমি আর একখানা কিনে নেবো।

অপু বেশি কথা বলিতে জানে না—এখনও পারিল না— মুখচোরার মতো খানিকক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া হেডমাস্টারের পায়ের ধুলা লইয়া প্রণাম করিয়া বাহির হইয়া আসিল।

হেডমাস্টারের মনে হইল—তাহার দীর্ঘ ত্রিশ বৎসরের শিক্ষকজীবনে এ রকম আর কোন ছেলের সংস্পর্শে তিনি কখনও আসেন নাই।—ভাবময়, স্বপ্নদর্শী বালক, জগতে সহায়হীন, সম্পদহীন! হয়তো একটু নির্বোধ, একটু অপরিণামদশী-কিন্তু উদার, সরল, নিষ্পাপ, জ্ঞান-পিপাসু ও জিজ্ঞাসু। মনে মনে তিনি বালকটিকে বড়ো ভালোবাসিয়াছিলেন।

তাঁহার জীবনে এই একটি আসিয়াছিল, চলিয়া গেল। ক্লাসে পড়াইবার সময় ইহার কৌতূহলী ডাগর চোখ ও আগ্রহোজ্জল মুখের দিকে চাহিয়া ইংরেজির ঘণ্টায় কত নতুন কথা, কত গল্প, ইতিহাসের কাহিনী বলিয়া যাইতেন–ইহার নীরব, জিজ্ঞাসু চোখ দুটি তাহার নিকট হইতে যেরুপ জোর করিয়া পাঠ আদায় করিয়া লইয়াছে, সেরুপ আর কেহ পারে নাই, সে প্রেরণা সহজলভ্য নয়, তিনি তাহা জানেন।

 

গত চার বৎসরের স্মৃতি-জড়ানো দেওয়ানপুর হইতে বিদায় লইবার সময়ে অপুর মন ভালো ছিল না। দেবব্রত বলিল-তুমি চলে গেলে অপূর্বদা, এবার পড়া ছেড়ে দেবো।

নির্মলার সঙ্গে বাহিরের ঘরে দেখা। ফাখুন মাসের অপূর্ব অদ্ভুত দিনগুলি। বাতাসে কিসের যেন মৃদু মিগ্ধ, অনির্দেশ্য সুগন্ধ। আমের বউলের সুবাস সকালের রৌদ্রকে যেন মাতাল করিয়া তুলিয়াছে। কিন্তু অপুর আনন্দ সে-সব হইতে আসে নাই—গত কয়েকদিন ধরিয়া সে রাইডার হ্যাগার্ডের ক্লিওপেট্রা পড়িতেছিল। তাহার তরুণ কল্পনাকে অদ্ভুতভাবে নাড়া দিয়াছে বইখানা। কোথায় এই হাজার হাজার বৎসরের পুরাতন সমাধি-জ্যোৎস্নাভরা নীলনদ, বিস্মৃত রা দেবের মন্দির!-ঔপন্যাসিক হ্যাগার্ডের স্থান সমালোচকের মতে যেখানেই নির্দিষ্ট হউক তাহাতে আসে যায় না—তাহার নবীন, অবিকৃত মন একদিন যে গভীর আনন্দ পাইয়াছিল বইখানা হইতে—এইটাই বড়ো কথা তাহার কাছে।

নির্মলার সহিত দেখা অপুর মনের সেই অবস্থায়,—অপ্রকৃতিস্থ, মত্ত, রঙিন—সে তখন শুধু একটা সুপ্রাচীন রহস্যময়, অধুনালুপ্ত জাতির দেশে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে! ক্লিওপেট্রা? হউন তিনি সুন্দরী—তাহাকে সে গ্রাহ্য কবে না! পিরামিডের অন্ধকার গর্ভগৃহে বহু হাজার বৎসরের সুপ্তি ভাঙিয়া সম্রাট মেঙ্কাউরা গ্রানাইট পাথরের সমাধি-সিন্দুকে যখন রোষে পার্শ্বপরিবর্তন করেন-মনুষ্য সৃষ্টির পূর্বেকার জনহীন আদিম পৃথিবীর নীরবতার মধ্যে শুধু সিহোর নদী লিবিয়া মরুভূমির বুকের উপর দিয়া বহিয়া যায়—অপূর্ব রহস্যে ভরা মিশর! অদ্ভুত নিয়তির অকাট্য লিপি! তাহার মন সারা দুপুর আর কিছু ভাবিতে চায় না।

গরম বাতাসে দমকা ধুলাবালি উড়াইয়া আনিতেছিল বলিয়া অপু দরজা ভেজাইয়া বসিয়া ছিল, নির্মলা দরজা ঠেলিয়া ঘরে আসিল। অপু বলিল—এসো এসো, আজ সকালে তো তোমাদেব স্কুলে প্রাইজ হল-কে প্রাইজ দিলেন—মুন্সেফবাবুর স্ত্রী, না? ওই মোটামতো যিনি গাড়ি থেকে নামলেন, উনিই তো?

—আপনি বুঝি ওদিকে ছিলেন তখন? মাগো, কি মোটা?—আমি তো কখনও—পাবে হঠাৎ যেন মনে পড়িল এইভাবে বলিল, তারপর আপনি তো যাবেন আজ, না দাদা?

-হ্যাঁ, দুটোর গাড়িতে যাব—রামধারিয়াকে একটু ডেকে নিয়ে এসো তো—জিনিসপত্তরগুলো একটু বেঁধে দেবে।

–রামধারিয়া কি আপনার চিরকাল করে দিয়ে এসেছে নাকি? কই, কি জিনিস আগে বলুন।

দুইজনে মিলিয়া বইয়ের ধুলা ঝাড়িয়া গোছানো, বিছানা বাঁধা চলিল। নির্মলা অপুর ঘোট টিনের তোরঙ্গটা খুলিয়া বলিল—মাগো! কি করে রেখেছেন বাক্সটা! কাপড়ে, কাগজে, বইয়ে হাভুল পাল—আচ্ছা এত বাজে কাগজ কি হবে দাদা? ফেলে দেবো?…

অপু বলিয়া উঠিল—হাঁ হাঁ-না না-ওসব ফেলে না।

সে আজ দুই-তিন বছরের চিঠি, নানা সময়ে নানা কথা লেখা কাগজের টুকরা সব জমাইয়া রাখিয়াছে। অনেক স্মৃতি জড়ানো সেগুলির সঙ্গে, পুরাতন সময়কে আবার ফিরাইয়া আনে-সেগুলি প্রাণ ধরিয়া অপু ফেলিয়া দিতে পারে না। কবে কোন্ কালে তাহার দিদি দুর্গা নিশ্চিন্দিপুরে থাকিতে আদর করিয়া তাহাকে কোন্ বন হইতে একটা পাখির বাসা আনিয়া দিয়াছিল, কতকালের কথা, বাসাটা সে আজও বাক্সে রাখিয়া দিয়াছে—বাবার হাতের লেখা একখানা কাগজ—আর কত কি।

নির্মলা বলিল—এ কি! আপনার মোটে দুখানা কাপড়, আর জামা নেই?

অপু হাসিয়া বলিল-পয়সাই নেই হাতে ৩ জামা! নইলে ইচ্ছা তো আছে সুকুমায়ের মতো একটা জামা করাববা—ওতে আমাকে যা মানায়—ওই রংটাতে

নির্মলা ঘাড় নাড়িয়া বলিল—থাক থাক, আর বাহাদুরি করতে হবে না। এই রইল চাবি, এখুনি হারিয়ে ফেলবেন না যেন আবার। আমি মিশির ঠাকুরকে বলে দিয়েছি, এখুনি লুচি ভেজে আনবে-দাঁড়ান, দেখি গিয়ে আপনার গাড়ির কত দেরি?

এখনও ঘণ্টা দুই। মার সঙ্গে দেখা করে যাবো, আবার হয়তো কতদিন পরে আসব তার ঠিক কি?

—আসবেনই না। আপনাকে আমি বুঝি নি ভাবছেন? এখান থেকে চলে গেলে আপনি আবার এ-মুখো হবেন?—কখনো না।

অপু কি প্রতিবাদ করিতে গেল, নির্মলা বাধা দিয়া বলিল—সে আমি জানি! এই দু-বছর আপনাকে দেখে আসছি দাদা, আমার বুঝতে বাকি নেই, আপনার শরীরে মায়া দয়া কম।

–কম?-বা রে—এ তো তুমি-আমি বুঝি—

–দাঁড়ান, দেখি গিয়ে মিশির ঠাকুর কি করছে—তাড়া না দিলে সে কি আর—

নির্মলার মা যাইবার সময় চোখের জল ফেলিলেন। কিন্তু নির্মলা বাড়ির মধ্যে কি কাজে ব্যস্ত ছিল, মায়ের বহু ডাকাডাকিতেও সে কাজ ফেলিয়া বাহিরে আসিতে পারিল না। অপু স্টেশনের পথে যাইতে যাইতে ভাবিল—নির্মলা আচ্ছা তো! একবার বার হল না—যাবার সময়টা দেখা হত আচ্ছা খামখেয়ালি!

যখন তখন রেলগাড়িতে চড়াটা ঘটে না বলিয়াই রেলে চড়িলেই তাহার একটা অপূর্ব আনন্দ হয়। ছোট্ট তোরঙ্গ ও বিছানাটার মোট লইয়া জানালার ধারে বসিয়া চাহিয়া দেখিতে দেখিতে কত কথা মনে আসিতেছিল। এখন সে কত বড়ো হইয়াছে—একা একা ট্রেনে চড়িয়া বেড়াইতেছে। তারপর এমনি একদিন হয়তো নীল নদের তীরে ক্লিওপেট্রার দেশে—এক জ্যোৎস্না রাতে শত শত প্রাচীন সমাধির বুকের উপর দিয়া অজানা সে যাত্রা।

স্টেশনে নামিয়া বাড়ি যাইবার পথে একটা গাছতলা দিয়া যাইতে যাইতে মাঝে মাঝে কেমন একটা সুগন্ধ-মাটির, ঝরা পাতার, কোন্ ফুলের। ফানের তপ্ত রৌদ্র গাছে গাছে পাতা ঝরাইয়া দিতেছে, মাঠের ধারে অনেক গাছে নতুন পাতা গজাইয়াছে—পলাশের ডালে রাঙা রাঙা নতুন ফোটা ফুল যেন আবতির পঞ্চপ্রদীপের ঊর্ধ্বমুখী শিখার মতো জ্বলিতেছে। অপুর মন যেন আনন্দে শিহরিয়া ওঠে—যদিও সে ট্রেনে আজ সারা পথ শুধু নির্মলা আর দেবব্রতের কথা ভাবিয়াছে…কখনও শুধুই নির্মলা, কখনও শুধুই দেবব্রত—তাহার স্কুলজীবনে এই দুইটি বন্ধু যতটা তাহার প্রাণের কাছাকাছি আসিয়াছিল, অতটা নিকটে অমনভাবে আর কেহ আসিতে পারে নাই, তবুও তাহার মনে হয় আজকার আনন্দের সঙ্গে নির্মলার সম্পর্ক নাই, দেবব্রতের নাই—আছে তার নিশ্চিন্দিপুরের বাল্যজীবনের সিন্ধস্পর্শ, আর বহুদুর-বিসর্পিত, রহস্যময় কোন্ অন্তরের ইঙ্গিত–সে মানে বালক হইলেও এ-কথা বোঝে।

প্রথম যৌবনের শুরু, বয়ঃসন্ধিকালে রূপ ফাটিয়া পড়িতেছে,—এই ছায়া, বকুলের গন্ধ, বনান্তরে অবসন্ন ফায়ূনদিনে পাখির ডাক, ময়ূরকণ্ঠী রং-এর আকাশটা-রক্তে যেন এদের নেশা লাগে—গর্ব, উৎসাহ, নবীন জীবনের আনন্দভরা প্রথম পদক্ষেপে। নির্মলা তুচ্ছ! আর এক দিক হইতে ডাক আসে—অপু আশায় আশায় থাকে।

নিরাবরণ মুক্ত প্রকৃতির এ আহ্বান, রোমান্সের আহ্বান—তার রক্তে মেশানো, এ আসিয়াছে তাহার বাবার নিকট হইতে উত্তরাধিকারসূত্রে-বন্ধন-মুক্ত হইয়া ছুটিয়া বাহির হওয়া, মন কি চায় নাবুঝিয়াই তাহার পিছু পিছু দৌড়ানো, এ তাহার নিরীহ শান্ত প্রকৃতি ব্রাহ্মণপণ্ডিত পিতামহ রামহরি তর্কালঙ্কারের দান নয়–যদিও সে তার নিস্পৃহ জ্ঞানপিপাসা ও অধ্যয়ন-প্রিয়তাকে লাভ করিয়াছে বটে। কে জানে পূর্বপুরুষ ঠ্যাঙাড়ে বীরু রায়ের উচ্ছৃঙ্খল রক্ত কিছু আছে কি-না–

তাই তাহার মনে হয় কি যেন একটা ঘটিবে, তাহারই প্রতীক্ষায় থাকে।

অপূর্ব গন্ধে-ভরা বাতাসে, নবীন বসন্তের শ্যামলীতে, অস্তসূর্যের রক্তআভায় সে রোমান্সের বার্তা যেন লেখা থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *