ব্রাহ্মণদের পদবী ও গাঞি (?) পরিচয়
উপরোক্ত তথ্য বিশ্লেষণ হইতে দেখা যাইতেছে শর্মণ ও স্বামী পদবী ছাড়া ব্রাহ্মণদের বোধ হয় অন্য পদবী-পরিচয়ও ছিল। যেমন, বৃহচ্চট নামে চট্ট, ভট্ট গোমিদত্ত স্বামী, ভট্ট ব্রহ্মবীর স্বামী, ভট্ট উন্মীলন স্বামী, ভট্ট বামন স্বামী, মহাসেন ভট্ট স্বামী, এবং শ্রীনেত্ৰ ভট (ভট্ট) প্রভৃতি নামে ভট্ট, এবং বন্দ্য জ্ঞানমতি ও বন্দ্য সংঘমিত্র নামে বন্দ্য। বৃহচ্চট্টের চট্ট নামের অংশমাত্র বলিয়া মনে হইতেছে না। ব্রহ্মবীর, উন্মীলন, বামন এবং মহাসেন যে ব্রাহ্মণ তাহা তাহাদের স্বামী পদবীতেই পরিশগকার; কিন্তু তাহার পরেও যখন তাঁহাদের নামের পূর্বে অথবা মধ্যে ভট্ট ব্যবহৃত হইতেছে তখন ভট্ট যেন তাঁহাদের “গাঞি” পরিচয় বলিয়াই মনে হইতেছে। পরবর্তী কালের ভাট অর্থ এই ক্ষেত্রে গ্রহণেযাগ্য বলিয়া মনে হয় না। শ্রীনেত্র ভট স্পষ্টই শ্রীনেত্র ভট্ট এবং এক্ষেত্রে ভট্ট ব্যবহৃত হইয়াছে নামের পরে। বন্দ্য পূজনীয় অর্থে ব্যবহৃত হইয়া থাকিতে পারে, অন্ততঃ আচার্য বন্দ্য সংঘ মিত্রের ক্ষেত্রে; কিন্তু বন্দ্য জ্ঞানমতির ক্ষেত্রেও কি তাহাই? এক্ষেত্রেও বন্দ্য “গাঞি” পরিচয় হওয়া অসম্ভব নয়। চট্ট, ভট্ট এবং বন্দ্য, এই কটিই যে রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের অসংখ্য “গাঞি” পরিচয়ের মধ্যে তিনটি, এ-তথ্য পববর্তী স্মৃতি ও কুলজী গ্রন্থে জানা যায়। ষষ্ঠ-সপ্তম শতকেই এই “গাঞ্চি” পরিচয়ের রীতি প্রচলিত হইয়াছিল, ইহা অসম্ভব এবং অনৈতিহাসিক নাও হইতে পারে।
ব্রাহ্মণদের শর্মণ-শর্মা পদবী-পরিচয় বাংলাদেশে আজও সুপ্রচলিত। কিন্তু স্বামী পদবী-পরিচয় মধ্যযুগের সূচনা হইতেই অপ্রচলিত হইয়া গিয়াছে। নিধনপুর লিপি্র সাক্ষ্য ও শ্ৰীহট্ট অঞ্চলের লোকস্মৃতি হইতে মনে হয়, ঐ লিপির দুই শতাধিক স্বামী পদবীযুক্ত ব্রাহ্মণেরা বৈদিক (পরবর্তী কালে, সাম্প্রদায়িক) ব্রাহ্মণ বলিয়া পরিচিত ছিলেন। অনুমান হয়, ইঁহারা সকলেই বাংলাদেশের বাহির হইতে—পশ্চিম বা দক্ষিণ হইতে—আসিয়াছিলেন। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে তো এখনও ব্রাহ্মণোদের স্বামী পদবী সুপ্রচলিত। প্রাচীন কালেও তাহাই ছিল। উত্তর-ভারতেও যে তাহা ছিল তাহার প্রমাণ গুপ্তযুগের শিলামালায়ই পাওয়া য্যা। পরবর্তী কালের কুলজী-গ্রন্থে বৈদিক ব্রাহ্মণদের দুটি শাখার পরিচয় পাওয়া যায় : পাশ্চাত্য ও দাক্ষিণাত্য। এই সব স্বামী পদবীযুক্ত ব্রাহ্মণেরা পাশ্চাত্য ও দাক্ষিণাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণ হওয়া অসম্ভব নয়। ধনাইদহ পট্টোলির দানগ্রহীতা বরাহস্বামী ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণ, এবং তিনি আসিয়াছিলেন উড়িষ্যান্তর্গত কটক অঞ্চল হইতে। গোপচন্দ্রের একটি পট্টোলির দানগ্রহীতা ব্রাহ্মণটির নাম গোমিদত্ত স্বামী। তিনি কান্বগোত্রীয় এবং লৌহিত্য-তীরবাসী। লৌহিত্য-তীরবর্তী কামরূপের ব্রাহ্মণেরা তো আজও নিজেদের পাশ্চাত্য বৈদিক বলিয়া পরিচয় দিয়া থাকেন। অবশ্য, স্বামী পদবীর উপর নির্ভর করিয়া এসম্বন্ধে নিঃসংশয় সিদ্ধান্ত কিছু করা চলে না। বাহির হইতে ব্রাহ্মণেরা যে বাংলাদেশে আসিতেছেন তাহার প্রত্যক্ষ প্রমাণ অযোধ্যবাসী কুলপুত্ৰক অমৃতদেব স্বয়ং।
এই সব ব্রাহ্মণদের ছাড়া পঞ্চম হইতে অষ্টম শতক পর্যন্ত লিপিগুলিতে রাজকর্মকারচী, গ্রামবাসী গৃহস্থ, প্রধান প্রধান লোক, নগরবাসী, শ্ৰেষ্ঠী, সার্থবাহ এবং অন্যান্য লোকের নাম-পরিচয়ও পাওয়া যাইতেছে। কয়েকটি নামের উল্লেখ করা যাইতে পারে; যথা, চিরাতদত্ত, বেত্রবর্মণ, ধৃতিপাল, বন্ধুমিত্র, ধৃতিমিত্র, শাম্বপাল, রিশিদত্ত (লক্ষণীয় এই যে, নামটির বানান ঋষিদত্ত উচিত ছিল; সংস্কৃত রীতিপদ্ধতি তখনও অভ্যস্ত হয় নাই বলিয়া মনে করা চলে), জয়নন্দি, বিভুদত্ত, গুহনন্দি, দিবাকরনন্দি, ধৃতিবিষ্ণু, বিবোচন, রামদাস, হরিদাস, শশিনন্দী, দেবকীর্তি, ক্ষেমদত্ত, গোষ্ঠক, বর্গপাল, পিঙ্গল, সুংকুক, বিষ্ণুভদ্র, খাসক, রামক, গোপাল, শ্ৰীভদ্র, সোমপাল, রাম, পত্রদাস, স্থায়ণপাল, কপিল, জয়দত্ত, শণ্ডক, রিভূপাল, কুলবৃদ্ধি, ভোয়িল, ভাস্কর, নবনন্দী, জয়নন্দী, ভটনন্দী, শিবনন্দী, দুর্গাদত্ত, হিমদত্ত, অর্কদাস, রুদ্রদত্ত, ভীম, ভামহ, বৎসভোজিক, নরদত্ত, বরদত্ত, বস্পিয়ক, আদিত্যবন্ধু, জোলারি, নগিজোদক, বুদুক, কলক, সূর্য, মহীপাল, খন্দবিদুর্গ, গবিক, মণিভদ্র, যজ্ঞপাত, নাদভদক, গণেশ্বর, জিতসেন, রিভূপাল, স্থাণুদত্ত, মতিদন্ত, বিপ্ৰপাল, স্কন্দপাল, জীবদত্ত, পবিক্রক, দামুক, বংসকুণ্ড, শুচিপালিত, বিহিতঘোষ, শূরদত্ত, প্রিয়দত্ত, জনার্দন, কুণ্ড, কবণিক, নবনাগ, কেশব, ইটিত, কুলচন্দ্র, গরুড়, আলূক, অনাচার, ভাশৈত্য, শুভদেব, ঘোষচন্দ্র, অনমিত্র, গুণচন্দ্র, কলসখ, দুর্লভ, সত্যচন্দ্র, প্রভূচন্দ্র, রুদ্রদাস, অর্জুন-বপ্প (সোজাসুজি অর্জুনের বাপের সংস্কৃত রূপ, এই ধরনের ডাক-নাম আজও বাংলার পাড়াগাঁয়ে প্রচলিত), কুণ্ডলিপ্ত, নাগদেব, নয়সেন, সোমঘোষ, জন্মভূতি, সূর্যসেন, লক্ষ্মীনাথ, শ্রীমিত্রাবলি, বর্ণটিয়োক, শর্বান্তর, শিখর, পুরদাস, শক্ৰক, উপাসক, স্বস্তিমোক, সুলদ্ধ, রাজদাস, দুর্গগট ইত্যাদি। এই নামগুলি বিশ্লেষণ করিলে কয়েকটি তথ্য লক্ষ্যগোচর হয়। প্রথমত, অধিকাংশ নামের রূপ সংস্কৃত; কতকগুলি নামের দেশজ রূপ হইতে সংস্কৃতীকরণ হইয়াছে, যেমন বস্পিযক, খন্দবিদুৰ্গ গরিক, অর্জুন-বপ্প, বর্ণটিয়োক, দুর্গ্ গট ইত্যাদি; আর কতকগুলির নামরূপ দেশজই থাকিয়া গিয়াছে, যেমন, জোলারি, নগিজোদক, কলক, নাদভদক, দামুক, আলূক, কলসখ, ইটিত, সুং’কুক, খাসক ইত্যাদি। ‘অক্’ বা ‘ওক্’ প্রত্যয় জুড়িয়া দিয়া দেশজ বা ভাষা শব্দের নামকে সংস্কৃত ক-কারান্ত পদ রূপে দেখাইবার যে রীতি আমরা পরবর্তী কালে বাংলা দেশে প্রচলিত দেখিতে পাই (যেমন “সদুক্তিকর্ণামৃত” গ্রন্থে গৌড় বঙ্গের কবিদের নাম-পরিচয়ে, এবং অন্যত্র) তাহাও এই যুগেই প্রতিষ্ঠিত হইয়া গিয়াছে, যথা, খাসক, রামক, বম্পিযক, বর্ণটিযোক, নগিজোদক, নাদভদক, স্বস্তিয়োক ইত্যাদি। দ্বিতীযত, ব্যক্তিগত নামে জনসাধারণ সাধারণত কোন ও পদবী ব্যবহার করিত না, শুধু পূর্ব নামেই (forename) পরিচিত হইত (তেমন নামে সংখ্যাই অধিক), যেমন, পিঙ্গল, গোপাল, শ্রীভদ্র, রাম, কপিল, বিরোচন, দেবকীৰ্তি, গোষ্ঠক, শণ্ডক, ভোয়িল, ভাস্কর, ভামহ, বুদ্ধক, সূর্য, পরিক্রক, করণিক, কেশব, গরুড়, অনাচার, ভাশৈত্য, দুর্লভ, শবান্তর, শিখর, শক্রুক, উপাসক, সুলব্ধ, গরুড় ইত্যাদি। তৃতীয়ত, এই নামগুলির মধ্যে কতকগুলি অন্ত্যনামের (৪urname) পবিচয় পাওয়া যাইতেছে যেগুলি এখনও বাংলাদেশে নাম-পদবী হিসাবে ব্যবহৃত হয়, যেমন, দত্ত, পাল, মিত্র, নন্দি-নন্দী, বর্মণ, দাস, ভদ্র, সেন, দেব, ঘোষ, কুণ্ডু, পালিত, নাগ, চন্দ্র, এমন কি দাম (দা), ভূতি, বিষ্ণ, যশ, শিব, রুদ্র ইত্যাদি। অধিংকাংশ ক্ষেত্রেই যে এগুলি অন্ত্যনাম এসম্বন্ধে সন্দেহ করা চলে না, তবে কোন কোন ক্ষেত্রে নামেরই অংশ হিসাবে ব্যবহৃত হইয়াছে, এই অনুমানও হয়তো করা চলে। চতুর্থত, এই সব অন্ত্যনাম আজকাল যেমন বর্ণজ্ঞাপক, পঞ্চম-অষ্টম শতকে তেমন ছিল না, তবে ব্রাহ্মণেতর বর্ণের লোকেরাই এই অন্ত্যনামগুলি ব্যবহার করিতেন; ব্রাহ্মণের শুধু শর্মণ বা স্বামী পদবী এবং ভট, চট্ট, বন্দ্য প্রভৃতি “গাঞি” পরিচয় গ্রহণ করিতেন, এইরূপ অনুমান বোধ হয় করা যায়। বাংলাদেশে ব্রাহ্মণ ভিন্ন অন্য তথাকথিত ‘ভদ্র’ জাতের মধ্যে (বৃহদ্বর্ম পুরাণোক্ত উত্তম সংকর ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণোক্ত সৎশূদ্র জাতের মধ্যে) চন্দ্র, গুপ্ত, নাগ, দাস, আদিত্য, নন্দী, মিত্র, শীল, ধর, কর, দত্ত, রক্ষিত, ভদ্র, দেব, পালিত প্রভৃতি নামাংশ বা পদবীর ব্যবহার এই সময় হইতে আরম্ভ হইয়া হিন্দু আমলের শেষেও যে চলিতেছিল তাহার প্রমাণ পাওয়া যায় “সদুক্তিকর্ণামৃত”-গ্রন্থের গৌড়বঙ্গীয় কবিদের নামের মধ্যে।(১) একথা সত্য বাংলার বাহিরে, বিশেষভাবে গুজরাত-কাথিয়াবাড় অঞ্চলে প্রাচীন কালে এক শ্রেণীর ব্রাহ্মণদের মধ্যে দত্ত, নাগ, মিত্র, ঘোষ, এবং বর্মণ ইত্যাদি অন্তনামের ব্যবহার দেখা যায়। কিন্তু বাংলায় এই লিপিগুলিতে এই সব অন্ত্যনাম যে-সব ক্ষেত্রে ব্যবহার হইতেছে, তাহাদের একজনকেও ব্রাহ্মণ বলিয়া মনে হইতেছে না, ব্রাহ্মণেরা যেন সর্বত্রই শর্মণ বা স্বামী এই অন্ত্যনামে পরিচিত হইতেছেন, অথবা ভট্ট, চট্ট, বন্দ্য প্রভৃতি উপ বা অন্ত্য নামে।
লিপিগুলিতে অনেক ব্যক্তিনামের উল্লেখ যেমন আছে, তেমনই আছে অনেক স্থান নামের উল্লেখ। এই নাম গুলি বিশ্লেষণ করিলেও দেখা যায়, কতকগুলি নামের রূপ পুরাপুরি সংস্কৃত, যেমন, পুণ্ড্রবর্ধন, কোটীবস, পঞ্চনগরী, নব্যাবকাশিকা, সূবর্ণবীথি, ঔদম্বুরিক (বিষয়), চণ্ডগ্রাম, কর্মান্তবাসক, শিলাকুণ্ড, পলাশবৃন্দক, স্বচ্ছন্দ পাটক ইত্যাদি। কতকগুলি নামের দেশজরূপ হইতে সংস্কৃতীকরণ হইয়াছে, যেমন, বারিগ্রাম, পৃষ্ঠম-পোট্টক, গোষাটপুঞ্জক, খাড়(টা)পার, ত্রিবৃতা, ত্রিঘট্টিক, বোল্লবায়িকা ইত্যাদি। আবার, কতকগুলির নাম এখনও দেশজ রূপেই থাকিয়া গিয়াছে, যেমন, কুট্কুট্, নাগিরট্ট, ডোঙ্গা (গ্রাম), কণমোটিকা ইত্যাদি। মনে হয়, ব্যক্তি-নামের ক্ষেত্রে যেমন স্থাননামের ক্ষেত্রেও তেমনই, আর্যীকরণ দ্রুত অগ্রসর হইতেছে।
——————–
(১) সদুক্তিকর্ণামৃত, সংকলয়িতা, শ্রীধরদাস (১২০৬) Ed by Ramavatara Sarma and Haradatta Sarma. Lahore. 1936. শ্রীসুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, “সদুক্তিকর্ণামৃত” বিশ্বভারতী পত্রিকা, কার্তিক-পৌষ, ১৩৫০।
ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় যিনি বিদ্যাসাগর নামে সবাই জানি তিনি শর্মা পদবী লিখতেন _কেন?
অধিকারী পদবী টা কি?
অনেকগুলো অর্থ আছে, যেমন- স্বতৃবান, স্বামী, মালিক, যাত্রাদলের অধ্যক্ষ।