চতুর্থ পরিচ্ছেদ
ব্যবসা, শিল্প বাণিজ্য
এক ওয়াচ-মেকারের দোকানে দেখতে পেয়েছিলাম, তার ছেলে চমৎকার যন্ত্র তৈরী করেছে। এরূপ জিনিস যে আমাদের দেশে সম্ভব তা আগে জানতাম না।
ঢাকা জেলার পশ্চিম বানানির একটা লোক স্টিমারের ভিতর হাতের তৈরী কতকগুলি ঝিনুকের গহনা আমাকে দেখায়। আমি সেই সব জিনিস দেখে অবাক হয়েছিলাম।
অনেক জায়গায় সামান্য অশিক্ষিত মুচি চমৎকার চমৎকার জুতো প্ৰস্তুত করে। ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে বহু মানুষ সুন্দর আশ্চর্য জিনিস প্রস্তুত করে। বিজ্ঞানের শক্তির সম্মুখে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে না বলেই তাদের আদর হয় না।
বিলাতের লোকের মধ্যে নানা প্রকার সাংসারিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের উপকরণ প্ৰস্তুত করার ঝোঁক চিরকালই বেশী। কোন চিন্তা বা ফল নিয়ে তারা বসে থাকে না। উন্নতির পর উন্নতি করতে চেষ্টা করে। আমাদের দেশের লোক তা করে। না। করা দরকার বিবেচনা করে না। বর্ধমান জেলায় চিকনের কাজ, শান্তিপুরের ফুল তোলার কাজ দেশের লোক শ্রদ্ধার চােখে দেখে না।
ব্যবসার মধ্যে জাতির বেঁচে থাকবার উপকার অনেক বেশী। লেখাপড়া শিক্ষা করা বা জ্ঞানানুশীলন চাকরির জন্য কিছুতেই নয়। জ্ঞানের সাহায্য নিয়ে সকল দিকে উন্নতি করা তুমি ভাল চাষা, কামার, দরজি, মিস্ত্রী এবং কারিগরী হও। বিশ্বাস কর চাকরির জন্য জ্ঞান নয়। তোমাদের যেমন হাত-পা আছে, জ্ঞানও তেমনি তোমাতে থাক। চাকরির জন্য জ্ঞানার্জন করো না।
শিল্পী বা ব্যবসায়ী হলে তোমাকে ছোট থাকতে হবে তা নয়। সব জায়গাতেই অধ্যবসায়ী ও পরিশ্রমী হতে হবে। কতকগুলো লোকের কথা বলবো যাদের জীবন কাহিনী শুনে তুমি বুঝতে পারবে-হীন অবস্থা হতে অধ্যবসায়, বুদ্ধি ও পরিশ্রম দ্বারা কেমন করে শিল্প-বাণিজ্যে উন্নতি করে নিজের, দেশের ও মানুষের কল্যাণ সাধন করেছেন। সাধনাপথে বাধা এসেছিল—তারা সে সব গ্রাহ্য করেন নি। শিল্প-বাণিজ্যের প্রতি অশ্রদ্ধার কঠিন শাস্তি মানুষকে চিরকালই ভোগ করতে হয়!
লেখাপড়া জান না, যদি অধ্যবসায়ী, চিন্তাশীল এবং দৃষ্টিসম্পন্ন হও—তুমি মানুষের উপকার করতে পারবে, তোমার উদ্ভাবনা শক্তি, প্রতিভা ও আবিষ্কারের দ্বারা তুমি বিশ্বের নর-নারীকে চিরকালের জন্য উপকার করে যেতে পার।
সাধুতাকে অবলম্বন করে তুমি ব্যবসা কর-পরিশ্রম করে জীবিকা অর্জন কর—তোমার আসন নীচে হবে না। প্রতারণা ও মিথ্যায় ভরা ভদ্ৰ(?)জীবন ত্যাগ করে তুমি সামান্য ব্যবসা অবলম্বন কর। অসার জীবনকে ঘূণা করতে শেখ, সত্য জীবনকে শ্রদ্ধা করতে শেখ। এখানেই তোমার মনুষ্যত্ব। ব্যবসায়ী ঘরের বহু প্ৰাতঃস্মরণীয় মানুষ জগতের কত উপকার করে গিয়েছেন। দেশীয় বা জাতীয় শ্ৰীবৃদ্ধির মূল কারণ ব্যবসায়ীর পরিশ্রম ও বুদ্ধি কৌশল। মিস্ত্রীর ছেলে ওয়াটের আবিষ্কারের ফলে জগতের কত উপকার হয়েছে। পৃথিবীর সভ্যতা তার কাছে কতখানি ঋণী। জ্বাল দিলে জল থেকে যে বাম্প ওঠে। সে বাম্পের যে কত শক্তি আছে তা কে জানত? হাজার ঘোড়ার শক্তিতে যা না হয়, বাম্পের কল্যাণে তা হয়। ওয়াট যদি মানুষকে এই কথা বলে না দিতেন, তা হলে পৃথিবীর সভ্যতা এত হতো না। রেলগাড়ির গতি, ছাপাখানা, যুদ্ধ সবই বাষ্পের শক্তিতে পরিচালিত হচ্ছে।
ওয়াটের আবিষ্কারের ফলে আর্করাইট সুতা প্রস্তুত করবার উন্নত ধরনের কল প্ৰস্তুত করতে সক্ষম হন। আর্করাইট কোন বড় ঘরের ছেলে নন। প্রেসটন শহরে ১৭৩২ খ্ৰীষ্টাব্দে তার জন্ম হয়। বাবার অবস্থা খুব শোচনীয় ছিল। তের ছেলের মধ্যে আর্করাইট ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। কোন কালে তার স্কুলে যাবার ভাগ্য হয়নি। নিজে নিজে যা একটু পড়েছিলেন।
প্ৰথমে বাপ তাঁকে এক নাপিতের কারখানায় পাঠান। কাজ শেখা হলে আর্করাইট নিজে একটা দোকান খোলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে পরচুলা লাগাবার ব্যবসাও আরম্ভ করলেন। শহরে শহরে মেলায় মেলায় ঘুরে তিনি চুল কিনে বেড়াতেন। এই ব্যবসা টেকসই হয় নাই। বিপন্ন হয়ে আর্করাইট ভাবলেন, একটা সুতা তৈরী করবার উন্নত ও ভাল রকমের যন্ত্র আবিষ্কার করলেই হয়। তারপর রাতদিন কেবল ভাবতে লাগলেন। রোজগার বন্ধ হয়ে গেল। অবস্থা যারপরনাই শোচনীয় হয়ে পড়লো। এর আগেই তিনি বিয়ে করেছিলেন। স্ত্রী স্বামীর এই মাথাপাগলামী সহ্য করতে না পেরে একদিন যত যন্ত্রপাতি ছিল, সব ভেঙ্গেচুরে বাইরে ফেলে দিলেন। আর্করাইট এতে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন—ফলে, স্বামী-স্ত্রীতে চিরবিচ্ছেদ সংঘটিত হয়। গায়ে জামা নাই—পরনে জুতা নাই—ছিড়ে গিয়েছে— কিন্তু সেদিকে তাঁর ক্ৰক্ষেপ নাই। এক মনে তিনি ভাবতে লাগলেন কি করে উন্নত প্ৰণালীতে বাষ্পীয় শক্তির সাহায্যে সুতা তৈরী করবার যন্ত্র আবিষ্কার করা যায়।
ঐকান্তিক সাধনার সম্মুখে কিছু বেধে থাকে না। আর্করাইটের সাধনা ব্যর্থ হলো না। জগৎ সভ্যতার প্রধান ভিত্তি তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন।
আর্করাইটের চরিত্র বল অসীম ছিল। পরিশ্রম করবার শক্তিও তার ছিল অসাধারণ। এই আবিষ্কারের পর তিনি বড় বড় কারখানা স্থাপন করলেন। এইসব কারখানার কাজে তাকে প্ৰাতঃকাল হতে রাত্রি ন’টা পর্যন্ত অনবরত খাটতে হতো।
যখন তার বয়স পঞ্চাশ, তখন তিনি ইংরেজী ব্যাকরণ পড়া আরম্ভ করেন। কারণ, শুদ্ধ করে তখনও তাঁর দুই লাইন লিখবার ক্ষমতা ছিল না।
সম্পদ ও গৌরব তার লাভ হলো। মানুষের কল্যাণ তিনি করলেন। তাঁর মহৎ জীবনকে সম্মান করবার জন্য সম্রাট তাঁকে উপাধি দিলেন।
বিলাতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরুষসিংহ স্যার রবার্ট পিলের নাম তোমরা শুনেছ। তিনি সম্রাট চতুর্থ জর্জের মন্ত্রী ছিলেন। তাঁর বাপ ছিলেন সামান্য কৃষক। বৃহৎ পরিবারের গ্রাসাচ্ছাদন চালান কঠিন হয়ে পড়াতে পিলের বাবা কাপড় বোনা আরম্ভ করলেন। তখনও কাপড়ের কারখানা বিলাতে স্থাপিত হয় নাই। লোক তখন বাড়ী বাড়ী কাপড় বুনতো। পিলের পিতা সাধু প্ৰকৃতির ও পরিশ্রমী লোক ছিলেন। এই ব্যবসা করতে করতে কাপড়ে ছাপ লাগানোর পন্থা আবিষ্কার করতে ইচ্ছে করলেন। আর্করাইটের ন্যায় বহু চিন্তা, পরিশ্রম এবং ব্যর্থতার পর তিনি সাধনায় জয়ী হলেন। মানুষের চেষ্টা, অধ্যবসায় ও চিন্তার সম্মুখে কিছু অসম্ভব নয়।
স্যার রবার্ট পিল তাঁর পিতা সম্বন্ধে বলেছেন—পিতা বুদ্ধিমান এবং দৃষ্টিসম্পন্ন লোক ছিলেন। তাঁর দ্বারাই আমাদের বংশের শ্ৰীবৃদ্ধির সূচনা হয়। জাতির উন্নতি ব্যবসার উপর নির্ভর করে। দেশের সকল মানুষের শ্ৰীবৃদ্ধির প্রাণ ব্যবসা। এখানে-ওখানে দুই একজনের একটু আধটু উন্নত অবস্থার কোন মূল্য নাই।
বিশ বছর বয়সে পিল কয়েকখানা ভাঙ্গা ঘর আর মাত্র কয়েক শত টাকা নিয়ে ব্যবসা আরম্ভ করেন।
সাধু, পরিশ্রমী এবং মিতব্যয়ী পিল ক্ৰমে উন্নতি করে নানা জায়গায় নতুন নতুন কারখানা খুললেন।
সম্পদ, সম্মান, কোটি কোটি টাকার মালিক পিল প্রথম বয়সে মজুর ছিলেন। সাধুতা, পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের দ্বারা তিনি দেশমান্য পুরুষ হতে পেরেছিলেন।