বেশি দূর যাবার দরকার নেই। আমাদের আশেপাশে ছড়িয়ে আছে। ভালো-মন্দ, হাসি-কান্না, অতীত বর্তমানের সব কিছু মাল-মশলাই পাওয়া যাবে। দৃষ্টিটা একটু চারপাশে ঘোরালেই হয়। কিন্তু এই দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে নেবার অবকাশ থাকলেও ইচ্ছা থাকে না সবার। আগ্রহও নেই বহুজনের। তাছাড়া চোখ থাকলেই দৃষ্টি শক্তি কি থাকে সবার? কান থাকলেই কি শুনতে পায় সবাই?
না। চোখ, কান থাকলেই দৃষ্টি শক্তি বা শ্রবণ শক্তি থাকে না। হৃদপিণ্ড তো সবারই আছে; মন, সংবেদনশীল মন কি সবার হয়?
না।
শুধু দুমুঠো অন্নের জন্য যাঁরা ডালহৌসীর রণাঙ্গনে নিত্য সংগ্রামে মত্ত, তাদের কথা আলাদা। মার্চেন্ট অফিসের হৃদয়হীন ছোট কর্তাদের ভজনায় যাদের সারা জীবন কেটে যায়, তারা আশপাশে দেখবেন কখন?
সবাই তো ওই দলের নয়। লক্ষ লক্ষ মানুষের অফুরন্ত অবকাশ রয়েছে সংসারের চারপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে নেবার। কিন্তু অপরের মুখের হাসি, চোখের জল দেখার প্রয়োজন কি? আশপাশের মানুষগুলো বাঁচল কি মরল, হাসল কি কাদল, তাতে ওই সার্থক স্বার্থপরদের কি আসে যায়?
কিছু না। বিন্দু মাত্র না। সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের খবর না নেওয়াই তো বড় হবার লক্ষণ!
অফিসারের দল বেয়ারা-চাপরাশী-কেরানীদের সেলাম নেন কিন্তু তাদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ? নেভার? অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, প্রেস্টিজ সব গোল্লায় যাবে যে!
রাজভবনের বেয়ারা-চাপরাশীদের বেশি দূরে সরিয়ে রাখা অসম্ভব। তবে খুব বেশি কাছে টানতেও অফিসারের দল নারাজ।
সেকেন্ড পাঞ্জাব ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টের ব্যারাক থেকে ক্যাপ্টেন রায় যখন প্রথম রাজভবনে এলেন, তখন তিনিও শুধু সেলাম নিতেন। আমজাদ আলি, রমজান, হরকিষণ, মনোহরলালদের রোজ দেখতেন, সেবা নিজেন কিন্তু ঠিক চিনতে চাইতেন না। ওর পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও ক্যাপ্টেন রায়ের দৃষ্টিটা উদাস হয়ে শূন্য আকাশের দিকে চলে যেত।
আমজাদ আলি, রমজানের দল এজন্য কিছু মনে করত না। ওইটাই তো নিয়ম।
ব্যাচিলার এ-ডি-সি ক্যাপ্টেন রায়কে রাজভবনের সামনের ওই স্যান্ডস্টোনের স্পর্শ-ধন্য কোয়ার্টারে আশ্রয় নিতে হয়নি। ওই গুটিকতক কোয়ার্টার নিয়ে মারামারি যেসব সরকারি অফিসারের দল সরকারি পয়সায় বার কয়েক দার্জিলিং ঘুরে পাহাড়ের প্রেমে হাবুডুবু খান, ওই কোয়ার্টারগুলির প্রতি তাদের বড় মোহ, বড় আকর্ষণ। লাটসাহেবের ঘোড়ার আস্তাবল ও মোটরের গ্যারেজের পাশে বা উপরে থাকার ইজ্জত কি বাগবাজার বা ভবানীপুরে সম্ভব? লাটসাহেবের সেক্রেটারি, ডেপুটি সেক্রেটারি ছাড়াও আরও দুজন একজন অফিসের আস্তাবল-গ্যারেজের পাশে অফিসার্স কোয়ার্টাসে আস্তানা পান। ভাগ্যক্রমে ম্যারেড এ-ডি-সি-ও পেতে পারেন ওর একটি সুইট।
অফিসারের দল সাজিয়ে গুছিয়ে নিজের নিজের ফ্ল্যাটকে মিনিয়েচার রাজভবন করে রাখেন। ছমাস-এক বছর কাশ্মীরি কার্পেট প্রিন্স অফ ওয়েলস বা ডাফরিন সুইটে রাখার পর সেগুলো চলে যায় ওই আস্তাবলের পাশের অফিসারদের ফ্ল্যাটে। আরো অনেক কিছু চলে যায় ওইসব অফিসার্স ফ্ল্যাটে। থ্রোন রুমের চেয়ার, কাউন্সিল চেম্বারের পর্দা, লাটসাহেবের ড্রইংরুমের সোফা থেকে শুরু করে আরো অনেক কিছু নজরে পড়বে ওইসব মিনিয়েচার রাজভবনগুলিতে।
বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই না? রমজান বা আমজাদ আলিকে জিজ্ঞাসা করার দরকার নেই। ওরা তো সিনিয়র কর্মচারী। নতুন ছোঁকরা বেয়ারা-চাপরাশীদের জিজ্ঞাসা করুন। ওরাই সব বলে দেবে। বলে দেবে যে কিছু কিছু অফিসারের বিছানার গদি, চাঁদর, বেডকভার, বাথরুমের তোয়ালে, গায়ে মাখা সাবান পর্যন্ত আসে ওই বড় রাজভবনের স্টোর থেকে।
রাজভবনের অধিকাংশ অফিসারই এইসব উপরি পাওনা নিয়েই মত্ত। রমজান বা আমজাদের সঙ্গে পুরনো দিনের গল্প করার মেজাজ বা প্রবৃত্তি কোথায়?
ক্যান্টেন রায় খাস রাজভবনের অন্দরমহলে আস্তানা পেয়েছিলেন স্বয়ং হিজ একসেলেন্সির অর্ডারে। তাই রমজান বা আমজাদকে বেশি দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি।
প্রথম প্রথম ডিউটির পর চলে যেতেন অফিসারদের কোয়ার্টারে প্লেট ভর্তি কাজু আর ঘণ্টায় ঘণ্টায় কফি খেতে খেতে আড্ডা দিতে বেশ লাগত। সকালে, দুপুরে কাজ না থাকলে চলে যেতেন এ-ডি-সি স্কোয়াড্রন লিডার নরেন্দ্রপ্রসাদ সিং-এর কোয়ার্টারে। বিকানীরের মরুভূমির লোক হলেও মনটা বড় সরল, সহৃদয়।
ক্যাপ্টেন রায়ের আজও মনে পড়ে সেদিনের কথা। এ-ডি-সি ইন ওয়েটিং ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার সিং। তিনিই ক্যাপ্টেনকে নিয়ে গিয়েছিলেন গভর্নরের কাছে। তারপর পরিচয় করিয়েছিলেন অন্যান্য অফিসার ও কর্মীদের সঙ্গে। অতগুলো লোকের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করতে করতেই অনেক বেলা হয়ে গেল।
রাজভবনের দক্ষিণের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে স্কোয়াড্রন লিডার সিং একবার ঘড়িটা দেখে বললেন, কাম অন, লেট আস রাস ফর লাঞ্চ।
ক্যাপ্টেন রায় জানতে চইলেন, কোথায় খেতে যাবেন?
কোথায় আবার? আমার কোয়ার্টারে।
আবার আমার জন্য…
সিং মুখে কিছু জবাব দেয়নি, শুধু একটু হেসেছিল। প্রায় ডবল মার্চ করার মতো লম্বা পা ফেলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই হাজির হল কোয়ার্টারে।
পর্দা সরিয়ে সামনে ড্রইংরুমে ঢুকতেই যিনি অভ্যর্থনা করলেন, তিনি মিসেস পূর্ণিমা সিং।
ক্যাপ্টেন মীট মাই ওয়াইফ পূর্ণিমা। পূর্ণিমা সিং হাত জোড় করে একটা নমস্কারও করলেন না। আর মীট মাই ওয়াইফ করতে হবে না, চল খেতে চল।
ক্যাপ্টেন রায় অতি পরিষ্কার স্পষ্ট বাংলা কথা শুনে অবাক বিস্ময়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। এক ঝলক দুজনের দিকে তাকিয়ে মিসেস সিং-এর উদ্দেশ্যে বললেন, চমৎকার বাংলা শিখেছেন তো!
পূর্ণিমা মুচকি হেসে পর্দা সরিয়ে ভিতরে চলে গেল!
স্কোয়াড্রন লিডার সিং একটু চাপা গলায় বললেন, ক্যাপ্টেন বিয়ের আগে সী ওয়াজ মিস পূর্ণিমা মুখার্জী।
আই সি!
পূর্ণিমা বাঙালি হলেও মোধপুরের মেয়ে। জন্ম, মামাবাড়ি পাটনাতে হলেও মোধপুরে কাটিয়েছে শৈশব, কৈশোর, যৌবন। পূর্ণিমার বাবা যোধপুরের সর্বজনপ্রিয় বাঙালি ডাক্তার! সারাদিন ডাক্তারি করে সন্ধ্যার পর তাস-পাশা-চা-সিগারেট। রবিবারে তানপুরা, হারমোনিয়াম তবলা। নিজে গাইতেন আয়েনা বালম, স্ত্রী গাইতেন একটি নমস্কারে প্রভু, মেয়ে পূর্ণিমা গাইত তবু মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে।
সন্ধ্যাবেলার সে আড্ডায় কে না থাকতেন? হিজ হাইনেসের প্রাইভেট সেক্রেটারি, ডেপুটি কমিশনারের স্ত্রী, মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে যোধপুর এয়ারফোর্স স্টেশনের ছোট বড় অফিসারের দল। আসতেন ফ্লাইট লেফটন্যান্ট নরেন্দ্রপ্রসাদ সিং।
সে এক ইতিহাস! কলকাতার রাজভবনের অফিসার্স ফ্ল্যাটে এসেও পূর্ণিমা ভুলতে পারে না পুরনো দিনের সন্ধ্যাবেলার মজলিশ। কলকাতায় ঠিক আত্মীয়-বন্ধু কেউ নেই। আর রাজভবনের অফিসাররা সন্ধ্যাবেলায় তানপুরা হাতে নিয়ে বসবার কথা কল্পনাও করতে পারে না।
স্কোয়াড্রন লিডার সিং যখন বাংলাদেশের গভর্নরের এ-ডি-সি মনোনীত হলেন, তখন আনন্দে, খুশিতে ফেটে পড়েছিল পূর্ণিমা। এ তোমাদের বিকানীর বা চণ্ডীগড় নয়। দেখো কি মজা করেই দিন কাটবে।
এখন সন্ধ্যা যেন কাটতে চায় না। কত সিনেমা-থিয়েটার দেখা যায়? তাছাড়া পূর্ণিমা তো বাইরের আনন্দের চাইতে ঘরের আনন্দই বেশি চায়। সিং-এর যেদিন ইভনিং ডিউটি থাকে, সেদিন পূর্ণিমা সীতার বনবাসের শুন্যতা অনুভব করে মনে মনে।
তাই তো ক্যাপ্টেন রায়কে বড় সমাদর করে গ্রহণ করলেন ওঁরা দুজনে।
স্কোয়াড্রন লিডার সিং খেতে বসে বললেন, প্লিজ ডোন্ট মিসটেক। পূর্ণিমা বাঙালি হলেও এ প্রোডাক্ট অফ আওয়ার রাজস্থান।
বাজে বকো না! তোমাদের দেশে ডাক্তার ছিল না বলেই তো আমার বাবাকে যেতে হয়েছিল।
এবার ক্যাপ্টেন রায়ের দিকে ফিরে পূর্ণিমা বলল, জানেন দাদা, আমার বাবাই যোধপুরের প্রথম অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তার।
স্কোয়াড্রন লিডার একটু সংশোধন করে দেন, না, না, একটু ভুল হয়ে গেল। শুধু যোধপুরের নয়, সারা রাজস্থানের মধ্যে উনিই প্রথম ডাক্তার।
ওদের দুজনের মধ্যে এমনি টুকটাক ঠোকাঠুকি বেশ লাগত ক্যাপ্টেনের। বলত, আমাদের আর্মির ভাষায় তোমাদের এই বর্ডার স্কারমিশ বেশ এন্টারটেনিং!
স্বামী-স্ত্রী দুজনেই হাসত।
যাই হোক প্রথম কিছুকাল বেশ কেটেছে ওদের নিয়ে। সকালে ব্রেকফাস্টের জন্য আর যেতো না, তবে দুপুরে-রাত্রে খেতেই হতো।
ক্যাপ্টেন রায় বলেছিল, সিং, দিস কান্ট বি দি রেগুলার ফিচার। তোমাকে এর বিনিময়ে…
স্কোয়াড্রন লিডার জিভ কেটে বলেছিল, মাই গড! আমি মাড়বারের লোক হতে পারি কিন্তু ঠিক এতটা ব্যবসাদার নই। তাছাড়া ডক্টর মুখার্জীর মেয়ে ঠিক দুজনের সংসার চালাতে শেখেনি।
ওরা যতদিন ছিল রমজান বা আমজাদের সঙ্গে ঠিক মিশতে পারেননি ক্যাপ্টেন। প্রয়োজন হয়নি। তাগিদ বোধ করেননি ওদের কাছে টেনে নেবার। রমজানের কাছে অ্যান্ডারসন সাহেবের ছোঁকরীর কাহিনি শোনার চাইতে পূর্ণিমার সঙ্গে খোসগল্প করার টান ছিল অনেক বেশি।
আচ্ছা দাদা, একদিন ডায়মন্ডহারবার বেড়াতে যাবেন?
তুমি ডায়মন্ডহারবার যাওনি?
চোখ দুটো ঈষৎ ঘুরিয়ে সিং-কে একটু আড় চোখে দেখে পূর্ণিমা বলে, ওই মরুভূমির লোকটার কোনো রসবোধ আছে?
স্কোয়াড্রন লিডার সঙ্গে সঙ্গে টিপ্পনী কাটে, ইউ আর পারফেক্টলি জাস্টিফায়েড পূর্ণিমা। আমার রসজ্ঞান নেই বলেই আহা, তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা, প্রিয় আমার ওগো প্রিয় গান শুনে তোমার কাছে সারেন্ডার করেছিলাম।
ক্যাপ্টেন রায় হাসতে হাসতে বলেন, সিং এয়ার ফোর্সে অফিসার হয়ে এসব সিক্রেট ডিসক্লোজ করা অন্যায়।
স্কোয়াড্রন লিডার সিং হঠাৎ বদলি হয়ে চলে গেল আম্বালা। এতদিন পরে ক্যাপ্টেন রায় আবিষ্কার করলেন, এই পাথরে গাঁথা রাজভবনে মনের আনন্দ, প্রাণের রসের বড় অভাব। অনুভব করলেন তিনি বড় নিঃসঙ্গ।
চুপচাপ নিজের ঘরের মধ্যে শুয়েছিলেন তিনি। দরজাটায় নক করে আমজাদ এল ভিতরে। একমুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বলল, ক্যাপ্টেন সাব, মন খারাপ করবেন না। যান একটু ঘুরে আসুন।
মুখে কিছু বললেন না ক্যাপ্টেন রায়। তবে সেই প্রথম উপলব্ধি করলেন, যাদের এতদিন দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন, যাদের দেখেও দেখেননি, যাদের মানুষ বলে স্বীকার করতে চাননি, তাদেরও প্রাণ আছে, আছে হৃদয়, আছে সহানুভূতি।
ডিউটির পর এখন আর চুপচাপ বসে থাকতে চান না ক্যাপ্টেন। ডেকে নেন রমজান, আমজাদ আলিকে। গল্প বলেন, গল্প শোনেন। শোনেন অ্যান্ডারসন সাহেবের মেয়েদের কীর্তি। স্কোয়াড্রন লিডার সিং চলে যাবার পর আর কোনো অফিসারের সঙ্গে ক্যাপ্টেন রায় বিশেষ হৃদ্যতা গড়ে তুলতে চাননি। আশা করেছিলেন সেক্রেটারি বা ডেপুটি সেক্রেটারির সংসারে ছোট ভাইয়ের মর্যাদা পাবেন। ওদের সংসারের পাঁচ জনের একজন হয়ে কাটিয়ে দেবেন। কলকাতায় কটা বছর। বাংলাদেশের বাঙালি তো মিশুক হয় বলেই ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছেন। কলকাতায় আত্মীয়স্বজন না থাকলেও বন্ধুহীন হয়ে নিশ্চয়ই কাটাতে হবে না।
এসব কথা মনে হলে ক্যাপ্টেন রায়ের হাসি পায়। তাইতো আমজাদ-রমজানের দল এগিয়ে। আসতে তাদের ফিরিয়ে দেননি, নিজেও এগিয়ে গেছেন ওদের কাছে। ভালোই হয়েছে। রমজান-আমজাদের কাছে কত কি জানতে পেরেছেন, শিখতে পেরেছেন! এই রাজভবনে তো কোনো অফিসার নেই, যিনি অ্যান্ডারসন সাহেবের কাহিনি বলতে পারেন। কে জানে ওর মেয়েদের বেলেল্লাপনার কাহিনি?
দু-একজন বুড়ো কেরানি হয়তো জানে কিন্তু তারা কিছুতেই ইংরেজ লাটের নিন্দা করবে। ইংরেজদের কাছে অহর্নিশি অপমান সহ্য করে চাকরি করতে হয়েছে এদের। তবু এরা। আজ ইংরেজ বলতে বিভোর হয়।
আমজাদ বেশি কথা বলে না। তবুও সেই আমজাদের মুখেই ক্যাপ্টেন রায় শুনেছিলেন, আজকাল লম্বা-চওড়া কথা বলেন কিন্তু আমরা তো সরকার বাবুকে ইংরেজ আমলেও দেখেছি।
কেন ইংরেজ আমলে উনি কি করতেন?
শুনলে বিশ্বাস করবেন?
কেন করব না?
তবে শুনে রাখুন এইসব বাবুদের কীর্তি।…
সারা বাংলাদেশের পি-ডবলিউ-ডি ডিপার্টমেন্টের যত ওভারশিয়ার ছিল, তাদের মধ্যে সব চাইতে ইংরেজভক্ত খুঁজে বার করতে চীফ ইঞ্জিনিয়ার মাস ছয়েক সময় নিলেন। সেকালে বাঙালি ছোঁকরাদের সরকার বাহাদুর বিশ্বাস করতেন না বলেই এই সামান্য কাজের ভার স্বয়ং চীফ ইঞ্জিনিয়ারকে দেওয়া হয়েছিল। চীফ ইঞ্জিনিয়ার নিজেই সিলেক্ট করতে পারতেন তবে কে কোথা থেকে কি করে বসে–এই ভয়ে দুজনের নাম সুপারিশ করে পাঠিয়েছিলেন ডেপুটি মিলিটারি সেক্রেটারির কাছে।
অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর শেষ পর্যন্ত রাজভক্তির সিংহদ্বার পার হলেন শ্রীনিশিকান্ত সরকার। আমাদের সরকার মশাই।
জানেন এ-ডি-সি সাব, সরকারবাবুর কি কাজ ছিল?
পি-ডবলিউ-ডি-র ওভারশিয়ার যখন, তখন নিশ্চয়ই বিলডিং-এর…
আমজাদ মাঝ পথেই আটকে দেয়, তাহলে আর কি দুঃখ ছিল। সরকারবাবু শুধু বাথরুম দেখাশুনা করতেন।
স্যানিটারি ফিটিংস দেখাশুনা করতেন।
আমরা ওকে বলতাম বাথরুম বাবু। আর মিলিটারি সেক্রেটারি অফিসের বাবুরা ওকে বলতেন টাট্টি বাবু!
আমজাদ একটু হাসে! শুধু বাথরুম দেখাশুনা করে ওর ইংরেজ ভক্তি আরো বেড়ে গেল। উনি বলতেন, সাহেবরা জানে কি ভাবে বাথরুম ইয়ুজ করতে হয়। যদি কখনও কোনো ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্ট হাউসে এসে দু-একদিন থেকে গেলেন, তাহলে আর কথা নেই! উনি চলে যাবার পর শুরু হতো সরকারবাবুর বকবকানি, ইন্ডিয়ানরা বাথটব ইয়ুজ করতে জানে না অথচ করবেই।…
সরকারবাবুর বস ছিলেন ডেপুটি মিলিটারি সেক্রেটারি। একটা ছোঁকরা মেজর। ছোঁকরাটা ইন্ডিয়ানদের রাস্তার কুকুরের মতো মনে করত। কথায় কথায় স্কাউড্রেল বিচ, ব্লাডি, বাগারের মতো সাধারণ বিশেষণে উনি খুশি হতে পারতেন না। আর তার সঙ্গে বুটের ছোট্ট লাথি। কোনো কর্মচারী একবার এক্সকিউজ মি স্যার, বললেই হল! সঙ্গে সঙ্গে ছোঁকরা মেজর বুটের এক লাথি দিয়ে বলত, তোর মাথায় কি ঘিলু নেই? তুই কি কুকুরের পেটে জন্মেছিস?
কেউ সহ্য করতে পারত না ওই ছোঁকরাটাকে। ধরাধরি করে অন্য সবাই বদলি হয়েছিল অন্যান্য ডিপার্টমেন্টে। শুধু সরকারবাবু কোনোদিন প্রতিবাদ করেননি, কোনোদিন বদলি হতে চাননি। আরে বাপু, ওসব কি গায়ে মাখলে চলে? কাজ শিখতে হলে এইসব কড়া সাহেবদের কাছে শেখা যায়।
আমজাদ বলল, এই ছোঁকরাটা ব্ৰেবোর্ন সাহেবের সময়েই গভর্নমেন্ট হাউসে এল। পরে শুনেছিলাম ও ব্যাটা মেদিনীপুরে অনেক অত্যাচার করেছিল, অনেক মেয়ের সর্বনাশ করেছিল। তাই প্রমোশন দিয়ে ওকে গভর্নমেন্ট হাউসে আনা হয়।
সেই সরকারবাবু আজ রাজভবনের মস্ত অফিসার!
একদিন সুবিধে মতন ক্যাপ্টেন রায় পাকড়াও করলেন, সরকারবাবু অনেকদিন কাটালেন এই গভর্নমেন্ট হাউসে তাই না।
একটু গাম্ভীর্য এনে উনি বললেন, হ্যাঁ, তা হল অনেক দিন।
আপনি তো পুরনো জমানাও দেখেছেন।
একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল সরকারবাবুর। দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে দেখে নিলেন পুরনো লাট সাহেবের দুটো একটা পেন্টিং। ক্যাপ্টেন, দ্যাট ওয়াজ গুপ্ত পিরিয়ড অফ মাই লাইফ।
তা তো বটেই!
শেরওয়ানির পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছে মাথার গান্ধী ক্যাপটা ঠিক করে নিলেন সরকারবাবু।
…কি বলব সে-সব দিনের কথা! তখন সবকিছুরই একটা স্ট্যান্ডার্ড ছিল। আর আজকাল? হা, ভগবান! এই গভর্নমেন্ট হাউস! আমরা কি এসব প্যালেসে থাকার উপযুক্ত? এখন গভর্নমেন্ট হাউসের লনে আলু-পটলের চাষ হয়, মাৰ্বল হলে খোল-করতাল বাজিয়ে কেত্তন হয়! আরে বাপু, আলু-পটলের চাষ করতে হয় তো দত্তপুকুর-গোবরডাঙা যাও, কেত্তন শুনতে হয় তো নবদ্বীপ যাও, এই গভর্নমেন্ট হাউসে কেন?
এতক্ষণ প্রায় স্বগতোক্তি করছিলেন সরকারবাবু। এবার ক্যাপ্টেনের দিকে ফিরে বললেন, আজকাল লাটসাহেবকে ডেপুটি সেক্রেটারির সঙ্গেও হাসি-ঠাট্টা করতে দেখা যাবে। আর আগে? লাটসাহেবকে দেখলে ডেপুটি সেক্রেটারির আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়ে যেত। অ্যাড়মিনিস্ট্রেশন কি এমনি গোল্লায় যেতে বসেছে?
এ-ডি-সি সাহেব ছোট্ট সায় দেন, তা যা বলেছেন আপনি!
আপনি তো সেদিন এলেন। কি আর বলব আপনাকে। এমন লাটসাহেবও দেখলাম যিনি সেক্সন অফিসারকে হিসেব নিকেশ পাল্টাতে বলেন।
কেন?
কেন আবার? নিজের সুনাম রাখার আগ্রহে।
কথাগুলো যে একেবারে মিথ্যে, তা নয়। দেশে যখন খাদ্য সমস্যা চরমে উঠল, যখন দেশের লিডাররা বন্দেমাতরম ভুলে গ্রো মোর ফুড শ্লোগান দিতে শুরু করলেন, তখন লাটসাহেব ঠিক করলেন, রাজভবনেও চাষ করতে হবে। সরকারি ফার্ম থেকে সব চাইতে ভালো বীজ আনানো হল, বিখ্যাত কেমিক্যাল কোম্পানি থেকে ফাটিলাইজার আনা হল। জাপানীজ এম্বাসেডরের উপহার দেওয়া হোট হ্যাঁন্ড ট্রাক্টর চালিয়ে ধান চাষের উদ্বোধন করলেন স্বয়ং লাটসাহেব। তারপর ডাইরেক্টর অফ এগ্রিকালচার, ডেপুটি ডাইরেক্টর অফ সীড ডেভলপমেন্ট অফিসার, ফার্টিলাইজার কোম্পানি রোজ কয়েক ঘণ্টা কাটাতেন রাজভবনে ওই হোট জমির তদারকিতে। কয়েকমাস অজস্র অর্থ ব্যয়ে একদিন সত্যি সত্যি ধানের শিষ বেরুল। পাবলিসিটি ডিপার্টমেন্ট থেকে সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরাম্যান তলব করে ডজন ডজন ছবি নেওয়া হল। এমনি করে একদিন বাইশ হাজার টাকার বিনিময়ে দুমণ ধান হল রাজভবনের উর্বর জমিতে।
হর্টিকালচারাল ডিপার্টমেন্টের শঙ্করলাল বলে, অত কাণ্ড করেও শেষ পর্যন্ত এক মণ ধানও হয়নি। ডাইরেক্টর অফ এগ্রিকালচার নিজের প্রেস্টিজ বাঁচাবার জন্য একদিন গাড়ি করে এক বস্তা ধান এনে মিশিয়ে দিলেন এই ধানের সঙ্গে।
সরকারবাবু পরে বলেছিলেন, স্বয়ং লাটসাহেবের নির্দেশে গ্রো মোর ফুড ক্যাম্পেনের খরচা কম দেখান হল। লড ব্রেবোর্ন বা স্যার জন হার্বাট হলে গভর্নমেন্ট হাউসে চাষ করতে দিতেন
আর চাষ করলেও খরচ দেখবার জন্য সেন অফিসারকে অনুরোধ করতেন না। কথাটা যে বেঠিক, তা নয়। লর্ড ব্রেবোর্ন বা স্যার জন হার্বাট হয়তো অনেক কিছুই করতেন, হয়তো তারা মহানুভব ছিলেন, কিন্তু ডেপুটি মিলিটারি-ওই ছোঁকরা মেজরটা যে কুট্টাকা বাচ্চা না বলে সরকারবাবুকে আদর করতে পারতেন না? তবুও সেটাই ছিল ওর জীবনের গুড পিরিয়ড, স্বর্ণ যুগ।
চমৎকার। এই লোকগুলোকে দেখলেও ক্যাপ্টেন রায়ের ঘেন্না করে। তাইতো আমজাদ-রমজানকে অনেক বেশি ভালো লাগে তার।