গ্রাম হইতে বাহির হইলেই বিস্তীর্ণ পঞ্চগ্রামের মাঠ। দৈর্ঘ্যে প্রায় ছয় মাইল প্রস্থে চার মাইল; কঙ্কণা, কুসুমপুর, মহাগ্রাম, শিবকালীপুর ও দেখুড়িয়া এই পাঁচখানা গ্রামের অবস্থিতি; এবং পাঁচখানা গ্রামের সীমানার মাঠ ময়ূরাক্ষী নদীর ধার পর্যন্ত ছড়াইয়া আছে। মাঠখানার দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিমে অর্থাৎ তিন দিকে ময়ূরাক্ষী নদী। ময়ূরাক্ষী নদীর তীরভূমি জুড়িয়া এই মাঠখানার উর্বরতা অদ্ভুত। অংশের নামই হইল অমরকুণ্ডার মাঠ অর্থাৎ মাঠে ফসলের মৃত্যু নাই। শিবপুরের ইহার মধ্যে আবার শিবকালীপুরের সীমানার জমিই নাকি উৎকৃষ্ট। এইটুকু জমির পরিমাণ এদিকে অতি অল্প; শিবপুরের সমস্ত জমি উত্তর দিকে। কালীপুরের চাষের মাঠ অধিকাংশই গ্রামের দক্ষিণ ও পূর্বদিকে অর্থাৎ এই দিকে। শিবকালীপুর নামেমাত্র দুইখানা গ্রাম; শিবপুর ও কালীপুর, দুই গ্রামে বসতির মধ্যে কেবল একটা দিঘির ব্যবধান। কালীপুর গ্রামখানাই বড়, ওই গ্রামেই লোকসংখ্যা বেশি; শ্রীহরি, দেবু প্রভৃতি সকলেরই বাস এখানে।
শিবপুর গ্রামখানি বহু পূর্বে ছিল—ছোট একটি পাড়াবিশেষ; তখন অর্থাৎ বর্তমান কাল হইতে প্রায় আশি-নব্বই বৎসর পূর্বে সেখানে একশ্রেণীর বিচিত্র সম্প্রদায় বাস করিত; তাহারা নিজেদের বলিত দেবল চাষী। তাহারা নিজ হাতে চাষ করিত না, শিবপুরের বুড়া শিবের সেবাপূজার ভার লইয়া তাহারা মাতিয়া থাকিত। এখন এই দেবল সম্প্রদায়ের আর কেহই নাই। অধিকাংশই মরিয়া-হাজিয়া গিয়াছে, অবশিষ্ট কয়েক ঘর এখান হইতে অন্যত্র চলিয়া গিয়াছে। ক্ৰোশ পাঁচেক দূরবর্তী রক্ষেশ্বর গ্রাম এবং ক্রোশ আষ্টেক দূরবর্তী জলেশ্বর গ্রাম-বাবা রক্ষেশ্বর। ও বাবা জলেশ্বর এই নামীয় দুই শিবের আশ্রয় লইয়া পাণ্ডা হিসেবে তাহাদের জ্ঞাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে বাস করিতেছে। শিবভক্ত দেবলদের বাস ছিল বলিয়াই পল্লীটার নাম ছিল শিবপুর। দেবলেরা চলিয়া যাইবার পর কালীপুরের চৌধুরীরা গ্রামের জমিদারি স্বত্ব কিনিয়া শিবপুরে আসিয়া বাস করিয়াছিল। জ্ঞাতি সদ্গোপ চাষীদের প্রত্যক্ষ সংসব এড়াইবার জন্যই তাহারা এই ব্যবস্থা করিয়াছিল। চৌধুরীরাই শিবপুরকে একটি স্বতন্ত্র মৌজায় পরিণত করিয়াছিল। তাহাদের পতনের। সঙ্গে সঙ্গে আবার শিবপুর স্তিমিত হইয়া আসিয়াছে।
উত্তর-পশ্চিমে যে গ্রামের মাঠ, সে গ্রামে নাকি লক্ষ্মী বসতি করেন না, গ্রামের দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে যে গ্রামের চাষের সীমানা—সেখানে নাকি লক্ষ্মীর অপার করুণা। অন্তত প্রবীণেরা তাই বলে। মাঠ উত্তর ও পশ্চিম দিকে হইলে দেখা যায় গ্রাম অপেক্ষা মাঠ উঁচু। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে ক্রমনিম্নতার একটা একটানা প্রবাহ চলিয়া গিয়াছে। বোধহয় গোটা পৃথিবী জুড়িয়া এইটাই এই ক্রমনিম্নতার জন্যই, দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে কৃষিক্ষেত্র হইলে গ্রামের সমস্ত জলই গিয়া মাঠে পড়ে; গ্রাম-ধোঁয়া জলের উর্বরতা প্রচুর। ইহা ছাড়াও গ্রামের পুকুরগুলির জলের সুবিধা ষোল আনা পাওয়া যায়। এই কারণে শিবপুর এবং কালীপুর পাশাপাশি গ্রাম হইলেও দুই গ্রামের জমির গুণ ও মূল্যে অনেক প্রভেদ। এজন্য কালীপুরের লোকের অনেক অহঙ্কার শিবপুরের লোককে সহ্য করিতে হয়। শিবপুরের চৌধুরীরা এককালে তাহাদের জমিদার ছিল, তখন কালীপুরকে শিবপুরের আধিপত্য সহ্য করিতে হইয়াছে, কালীপুরের বর্তমান অহঙ্কারের ঔদ্ধত্য তাহারও একটা প্রতিক্রিয়া বটে।
দ্বারকা চৌধুরী সেই বংশোদ্ভূত। চৌধুরীদের সমৃদ্ধি অনেক দিনের কথা। দ্বারকা চৌধুরীর এক পুরুষ পূর্বে তাহাদের বংশের সম্মান-সমৃদ্ধির ভাণ্ডার নিঃশেষিত হইয়াছে। চৌধুরীরও আভিজাত্যের কোনো ভান নাই; পূর্বকালের কথা সে সম্পূর্ণ ভুলিয়া গিয়াছে। এ অঞ্চলের চাষীদের সঙ্গে সে সমানভাবেই মেলামেশা করে; এক মজলিসে বসিয়া তামাক খায়-সুখদুঃখের গল্প করে। তবু চৌধুরীর কথাবার্তার ধরন ও সুরের মধ্যে একটু স্বাতন্ত্র্য আছে। চৌধুরী কথা বলে খুব কম, যেটুকু বলে—তাহাও অতি ধীর এবং মৃদু স্বরে। কথার প্রতিবাদ করিলে চৌধুরী তাহার আর প্রতিবাদ করে না; কোনো ক্ষেত্রে প্রতিবাদকারীর কথা সংক্ষেপে স্বীকার করিয়া লয়, কোনো ক্ষেত্রে চুপ করিয়া যায়, কোনো ক্ষেত্রে সেদিনকার মত মজলিস হইতে উঠিয়া পড়ে। মোটকথা, চৌধুরী শান্তভাবেই অবস্থান্তরকে মানিয়া লইয়া জীবন অতিবাহিত করিয়া চলিয়াছে।
বৃদ্ধ দ্বারকা চৌধুরী সকালেই ছাতাটা মাথায়—বাঁশের লাঠিটি হাতে লইয়া কালীপুরের দক্ষিণ মাঠে নদীর ধারে রবি-ফসলের চাষের তদ্বিরে চলিয়াছিল। কালীপুরের জমিদারির স্বত্ব চলিয়া গেলেও সেখানে তাদের মোটা জোত এখনও আছে। কালীপুরের দক্ষিণেই অমরকুণ্ডার মাঠ, পূর্বেই বলিয়াছি, এখানকার ফসল কখনও মরে না, এ মাঠে হাজা-সুখা নাই। মাঠটির মাথায় বেশ বিস্তৃত দুইটি ঝরনার, জল আছে; প্রশস্ত একটি অগভীর জলা হইতে নালা বাহিয়া অবিরাম জল বহিয়া চলিয়াছে; জলাটি কানায় কানায় অহরহই পরিপূর্ণ, জল কখনও শুকায় না। এই যুগ-ধারাই অমরকুণ্ডার মাঠের উপর যেন ধরিত্রীমাতার বক্ষক্ষরিত ক্ষীরধারা। নালা বাহিয়া জলাভাবের সময় নালায় বাঁধ দিয়া, যাহার যে দিকে প্রয়োজন জলস্রোতকে ঘুরাইয়া। লইয়া যায়।
অগ্রহায়ণ পড়িতেই হৈমন্তী ধান পাকিতে শুরু করিয়াছে, সবুজ রঙ হলুদ হইতে আরম্ভ করিয়াছে। অমরকুণ্ডার মাঠের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত নদীর বাঁধের কোল পর্যন্ত সুপ্রচুর ধানের সবুজ ও হলুদ রঙের সমন্বয়ে রচিত অপূর্ব এক বর্ণশোভা ঝলমল করিতেছে। ধানের। প্রাচুর্যে মাঠের আল পর্যন্ত কোথাও দেখা যায় না। কেবল ঝরনার দুই পাশের বিসৰ্পিল বাঁধের উপরের তালগাছগুলি অ্যাঁকাবাঁকা সারিতে ঊর্ধ্বলোকে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়া আছে। হেমন্তের পীতাভ রৌদ্রে মাঠখানা ঝলমল করিতেছে। আকাশে আজও শরতের নীলের আমেজ রহিয়াছে; এখনও ধূলা উড়িতে আরম্ভ করে নাই। দূরে আবাদি মাঠের শেষ প্রান্তে নদীর বন্যারোধী বাঁধের উপর ঘন সবুজ শরবন একটা সবুজ রঙের দীর্ঘ প্রাচীরের মত দাঁড়াইয়া আছে। মাথায় চুনকাম করা আলিসার মত চাপ বাঁধিয়া সাদা ফুলের সমৃদ্ধ সমারোহ বাতাসে অল্প অল্প দুলিতেছে।
কালীপুরের পশ্চিম দিকে–সম্ভ্রান্ত ধনীদের গ্রাম কঙ্কণা; গ্রামের চারিপাশের গাছপালার উপর সাদা-লাল-হলুদ রঙের দালানগুলির মাথা দেখা যাইতেছে। একেবারে ফাঁকা প্রান্তরে স্কুল—হাসপাতাল–বাবুদের থিয়েটারের ঘর আগাগোড়া পরিষ্কার দেখা যায়। বাবুরা হালে টাকায় এক পয়সা ঈশ্বরবৃত্তির প্রচলন করিয়াছেন; টাকা দিতে গেলেও দিতে হইবেটাকা লইতে গেলেও দিতে হইবে। ওই টাকায় পার্বণ-উপলক্ষে ধুমধাম যাত্রা-থিয়েটার হয়। চৌধুরী নিশ্বাস ফেলিল-দীর্ঘনিশ্বাস। বৎসরে দেড় টাকা দুই টাকা করিয়া তাহাকে ওই ঈশ্বরবৃত্তি দিতে হয়।
অমরকুণ্ডার ক্ষেতে এখনও জল রহিয়াছে, জলের মধ্যে প্রচুর মাছ জন্মায়; আল কাটিয়া দিয়া মুখে ঝুড়ি পাতিয়া হাড়ি, বাউরি, ডোম ও বায়েনদের মেয়েরা মাছ ধরিতেছে। ক্ষেতের মধ্যেও অনেকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, তাহাদের দেখা যায় না—কেবল ধানগাছগুলি চিরিয়া একটা চলন্ত। রেখা দেখা যায়, যেমন অগভীর জলের ভিতর মাছ চলিয়া গেলে জলের উপর একটা রেখা জাগিয়া ওঠে ঠিক তেমনি। অনেকে ঘাস কাটিতেছে; কাহারও গরু আছে কেহ ঘাস বেচিয়া দুই-চার পয়সা রোজগার করে। এই এখানকার জীবন।
অমরকুণ্ডার মাঠের ঠিক মাঝামাঝি একটি প্রশস্ত আলের উপর দিয়া যাওয়া-আসার পথ। প্রশস্ত অর্থে এক জন বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে চলিতে পারে, দুই জন হইলে গা ঘেঁষাঘেঁষি হয়। এই পথ। ধরিয়া গ্রামের গরুবাছুর নদীর ধারে চরিতে যায়। ধান খাইবে বলিয়া তখন তাদের মুখে একটি করিয়া দড়ির জাল বাঁধিয়া দেওয়া হয়। প্রৌঢ় চৌধুরী একটু হতাশার হাসি হাসিল—গরুগুলির মুখের জাল খুলিবার মত গোচরও আর রহিল না।
বন্যারোধী বাঁধের ওপারে নদীর চর ভাঙিয়া রবি ফসলের চাষের একটা ধুম পড়িয়া গিয়াছে। চাষীদের অবশ্য আর উপায়ও ছিল না। অমরকুণ্ডার মাঠের অর্ধেকের উপর জমি কঙ্কণার বিভিন্ন ভদ্রলোকের মালিকানিতে চলিয়া গিয়াছে। অনেক চাষীর আর জমি বলিতে কিছুই নাই। এই তাহারাই প্রথম নদীর ধারে গো-চর ভাঙিয়া রবি ফসলের চাষ আরম্ভ করিয়াছিল। এখন দেখাদেখি সবাই আরম্ভ করিয়াছে। কারণ চরের জমি খুবই উর্বর। সারা বর্ষাটাই নদীর জলে ড়ুবিয়া থাকিয়া পলিতে পলিতে মাটি যেন সোনা হইয়া থাকে। সেই সোনা, ফসলের কাও বাহিয়া শীষ ভরিয়া দানা হইয়া ফলিয়া ওঠে। গম যব সরিষা প্রচুর হয়; সকলের চেয়ে ভাল হয় ছোলা। ওই চরটার নামই ছোলাকুড়ি বা ছোলাকুণ্ড। এখন অবশ্য আলুর চাষেরই রেওয়াজ বেশি। আলু প্রচুর হয় এবং খুব মোটাও হয়। নদীর ওপারের জংশনে আলুর বাজারও ভাল। কলিকাতা হইতে মহাজনেরা ওখানে আলু কিনিতে আসে; এ কয় মাসের জন্য তাহাদের এক-একজন লোক আড়ত খুলিয়া বসিয়াই আছে–আলু লইয়া গেলেই নগদটাকা। বড় চাষী যাহারা তাহারা বিশ-পঞ্চাশ টাকা দানও পায়।
সকলের টানে চৌধুরীকেও গো-চর ভাঙিয়া আলু-গম-ছোলার চাষ করিতে হইতেছে। চারিপাশে ফসলের মধ্যে তাহার গোচরে গরু চরানো চলে না; অবুঝ অবোলা পশু কখন যে ছুটিয়া গিয়া অন্য লোকের ফসলের উপর পড়িবে—সে কি বলা যায়। তাহার উপর অমরকুণ্ডার মাঠে উৎকৃষ্ট দোয়েম জমিতে রবি ফসলের চাষও অসম্ভব হইয়া উঠিয়াছে। কঙ্কণার ভদ্রলোকের জমি সব পড়িয়া থাকে, তাহারা রবি ফসলের হাঙ্গামা পোহাইতে চায় না, আর খইল-সারেও। টাকা খরচ তাহারা করিবে না। কাজেই তাহাদের জমি ধান কাটার পর পড়িয়াই থাকে। অধিকাংশ জমি চাষ হইলে—সেখানে কতকটা জমি পতিত রাখিয়া গরু চরানো যেমন অসম্ভব, আবার অধিকাংশ জমি পতিত থাকিলে—সেখানে কতকটা জমি চাষ করাও তেমনি অসম্ভব। তবু তো গরু ছাগলকে আগলাইয়া পারা যায়; কিন্তু মানুষ ও বানরকে পারা যায় না। তাহারা খাইয়াই শেষ করিয়া দিবে। কালীপুরের দোয়েম–সোনার দোয়েম!…
এদিকে যুদ্ধ বাঁধিয়া সব যেন উল্টাইয়া গেল (প্রথম মহাযুদ্ধ)। কি কাল যুদ্ধই না ইংরেজরা করিল জার্মানদের সঙ্গে। সমস্ত একেবারে লণ্ডভণ্ড করিয়া দিল। দুঃখ-দুর্দশা সবকালেই আছে, কিন্তু যুদ্ধের পর এই কালটির মত দুর্দশা আর কখনও হয় নাই। কাপড়ের জোড়া ছ-টাকা সাতটাকা, ওষুধ অগ্নিমূল্যমায় পেরেক ও সুচের দাম চারগুণ হইয়া গিয়াছে। ধানচালের দরও প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়াছে; কিন্তু কাপড়চোপড়ের দর বাড়িয়াছে তিনগুণ। জমির দামও ডবল হইয়া গিয়াছে। দর পাইয়া হতগাভা মূর্খের দল জমিগুলা কঙ্কণার বাবুদের পেটে ভরিয়া দিল। ফলে এই অবস্থা, আজ আফসোস করিলে কি হইবে।
মরুক, হতভাগারা মরুক! আঃ, সেই তেরোশো একুশ সালে যুদ্ধ আরম্ভ হইয়াছিল, যুদ্ধ শেষ হইয়া গিয়াছে পঁচিশ সালে; আজ তেরোশো উনত্রিশ সাল-আজও বাজারের আগুন নিবিল না। কঙ্কণার বাবুরা ধুলামুঠা সোনার দরে বেচিয়া কাড়ি কাড়ি টাকা আনিতেছে আর কালীপুরের জমি কিনিতেছে মোটা দামে। ধুলা বৈকি! মাটি কাটিয়া কয়লা ওঠে—সেই কয়লা বেচিয়া তো তাহাদের পয়সা। যে-কয়লার মন ছিল তিন আনা, চোদ্দ পয়সা, আজ সেই কয়লার দর কিনা চোদ্দ আনা। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত এই বাজারে আবার প্রেসিডেন্ট পঞ্চায়েতি ঘুচাইয়া ট্যাক্স বাড়াইয়া বসাইল ইউনিয়ন বোর্ড। বাবুরা সব বোর্ডের মেম্বর সাজিয়া দণ্ডমুণ্ডের মালিক হইয়া বসিল—আর, দাও তোমরা এখন ট্যাক্স! ট্যাক্স আদায়ের ধুম কি! চৌকিদার দফাদার সঙ্গে লইয়া বাঁধানো খাত বগলে বোর্ডের কেরানি দুর্গই মিশ্ৰ যেন একটা লাটসাহেব!
সহসা চৌধুরী চকিত হইয়া থমকাইয়া দাঁড়াইল। কে কোথায় তারস্বরে চিৎকার করিয়া কাঁদিতেছে না? লাঠিটি বগলে পুরিয়া রৌদ্রনিবারণের ভঙ্গিতে জ্বর উপরে হাতের আড়াল দিয়া এপাশ-ওপাশ দেখিয়া চৌধুরী পিছন ফিরিয়া দাঁড়াইল। হ্যাঁ, পিছনেই বটে। ওই গ্রাম হইতে কয়জন লোক আসিতেছে, উহাদের ভিতরেই কেহ কাঁদিতেছে, সে স্ত্রীলোক, তাহাকে দেখা যাইতেছে না, সামনে পুরুষটির আড়ালে সে ঢাকা পড়িয়াছে। আ-হা-হা! পুরুষটা! পুরুষটা কেউটে সাপের মত ফিরিয়া মেয়েটার চুলের মুঠি ধরিয়া দুমদাম করিয়া প্রহার আরম্ভ করিয়া দিল। চৌধুরী এখান হইতেই চিৎকার করিয়া ওঠে—এই, এই; আ-হা-হা! ওই!
তাহারা শুনিতে পাইল কি না কে জানে, কিন্তু স্ত্রীলোকটি চিৎকার বন্ধ করিল, পুরুষটিও তাহাকে ছাড়িয়া দিল। চৌধুরী কিছুক্ষণ সেইদিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া থাকিয়া—আবার রওনা হইল। ছোটলোক কি সাধে বলে। লজ্জা-শরম, রীতকরণ উহাদের কখনও হইবে না। জানে না-স্ত্রীলোকের চুলে হাত দিলে শক্তি ক্ষয় হয়। রাবণ যে রাবণ, যাহার দশটা মুণ্ড, কুড়িটা হাত, এক লক্ষ ছেলে, একশো লক্ষ নাতি, সে যে সে, সীতার চুলের মুঠি ধরিয়া সে একেবারে নির্বংশ হইয়া গেল।
বাঁধের কাছাকাছি চৌধুরী পৌঁছিয়াছে—এমন সময় পিছনে পদশব্দ শুনিয়া চৌধুরী ফিরিয়া চাহিল; দেখিল, পাতু বায়েন হনহন করিয়া বুনো শূকরের মত গোভরে চলিয়া আসিতেছে। পিছনে কিছুদূরে ধুপ ধুপ করিয়া ছুটিতে ছুটিতে আসিতেছে একটি স্ত্রীলোক। বোধহয় পাতুর স্ত্রী। সে এখনও গুনগুন করিয়া কাঁদিতেছে আর মধ্যে মধ্যে চোখ মুছিতেছে। চৌধুরী একটু সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিল। পাতু যে গতিতে আসিতেছে, তাহাতে তাহাকে পথ ছাড়িয়া না দিলে উপায় কি! উহার আগে আগে চলিবার শক্তি চৌধুরীর নাই। পাতু কিন্তু নিজেই পথ করিয়া লইল, সে পাশের জমিতে নামিয়া পড়িয়া ধানের মধ্য দিয়া যাইবার জন্য উদ্যত হইল। সহসা সে থমকিয়া দাঁড়াইয়া চৌধুরীকে একটা প্রণাম করিয়া বলিল দ্যাখেন চৌধুরী মশাই দ্যাখেন।
চৌধুরী পাতুর মুখের দিকে চাহিয়া শিহরিয়া উঠিল। কপালে একটা সদ্য আঘাতচিহ্ন হইতে রক্ত ঝরিয়া মুখখানাকে রক্তাক্ত করিয়া দিয়াছে। সঙ্গে সঙ্গে পাতুর স্ত্রী ডাক ছাড়িয়া কাঁদিয়া উঠিল।
–ওগো, বাবুমশায় গো! খুন করলে গো!
–এ্যাঁও! পাতু গর্জন করিয়া উঠিল। আবার চেঁচাতে লাগিলি মাগী?
সঙ্গে সঙ্গে পাতুর স্ত্রীর কণ্ঠস্বর নামিয়া গেল; সে গুনগুন করিয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিল–গরিবের কি দশা করেছে দেখেন গো, আপনারা বিচার করেন গো!
পাতু পিছন ফিরিয়া দাঁড়াইয়া পিঠ দেখাইয়া বলিল—দেখেন, পিঠ দেখেন।
এবার চৌধুরী দেখিল পাতুর পিঠে লম্বা দড়ির মত নির্মম প্রহার-চিহ্ন রক্তমুখী হইয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে। দাগ একটা-দুইটা নয়—দাগে দাগে পিঠটা একেবারে ক্ষতবিক্ষত। চৌধুরী অকপট মমতা ও সহানুভূতিতে বিচলিত হইয়া উঠিল, আবেগবিগলিত স্বরেই বলিল—আ-হা-হা! কে এমন কল্লে রে পাতু?
–আজ্ঞে, ওই ছিরু পাল। রাগে গগন্ করিতে করিতে প্রশ্ন শেষ হইবার পূর্বেই পাতু উত্তর দিল-–কথা নাই, বার্তা নাই, এসেই এক গাছা দড়ির বাড়িতে দেখেন কি করে দিলে দেখেন। আবার সে পিছন ফিরিয়া ক্ষতবিক্ষত পিঠখানা চৌধুরীর চোখের সামনে ধরিল। তারপর আবার ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল-দড়িখানা চেপে ধরলাম তো একগাছা বখারির ঘায়ে কপালটাকে একেবারে দিল ফাটিয়ে।
ছিরু পাল—শ্ৰীহরি ঘোষ? অবিশ্বাস করিবার কিছু নাই। উঃ, নির্মমভাবে প্রহার করিয়াছে। চৌধুরীর চোখে অকস্মাৎ জল আসিয়া গেল। এক এক সময় অপরের দুঃখ-দুর্দশায় মানুষ এমন বিচলিত হয় যে, তখন নিজের সকল সুখ-দুঃখকে অতিক্ৰম করিয়া নির্যাতিতের দুঃখ যেন আপন দেহমন দিয়া প্ৰত্যক্ষভাবে অনুভব করে। চৌধুরী এমনই একটি অবস্থায় উপনীত হইয়া সজল চক্ষে পাতুর দিকে চাহিয়া রহিল, তাহার দন্তহীন মুখের শিথিল ঠোঁট অত্যন্ত বিশ্রী ভঙ্গিতে থরথর করিয়া কাঁপিতে লাগিল।
পাতু বলিল—মোড়লদের ফিজনার কাছে গেলাম। তা কেউ রা কাড়লে না মশায়। শক্তর সব দুয়োর মুক্ত।
পাতুর বউ অনুচ্চ কান্নার ফাঁকে ফাঁকে বলিতেছিল—সর্বনাশী কালামুখীর লেগে গো—
পাতু একটা ধমক করিয়া বলিল—অ্যাই—অ্যাই, আবার ঘ্যানঘ্যান করে।
চৌধুরী একটু আত্মসংবরণ করিয়া বলিল—কেন অমন করে মারলে? কি এমন দোষ করেছ তুমি যে–
অভিযোগ করিয়া পাতু কহিল—সেদিন চণ্ডীমণ্ডপের মজলিসে বলতে গেলাম–তো আপনি শুনলেন না, চলে গেলেন। গোটা গেরামের লোকের আঙোটজুতি আমাকে সারা বছর যোগাতে হয়, অথচ আমি কিছুই পাই না। তা কর্মকার যখন রব তুললে, তখন আমিও বলেছিলাম যে, আমি আর আঙোটজুতি যোগাতে লারব। কাল সানঝেতে পালের মুনিষ আঙোটজুতি চাইতে এসেছিল—আমি বলেছিলাম-পয়সা আন গিয়ে! তা আমার বলা বটে আজ সকালে উঠে এসেই কথা নাই বাৰ্ত্তা নাই-আথালি-পাথালি দড়ি দিয়ে মার!
চৌধুরী চুপ করিয়া রহিল। পাতুর বউ বার বার ঘাড় নাড়িয়া মৃদু বিলাপের সুরে সেই বলিয়াই চলিল না গো বাবুমশায়—
পাতু তাহার কথা ঢাকিয়া দিয়া বুলিল-আমার পেট চলে কি করেসেটা আপনারা বিচার করবেন না, আর এমনি করে মারবেন?
চৌধুরী কাশিয়া গলা পরিষ্কার করিয়া লইয়া বলিল—শ্ৰীহরি তোমাকে এমন করে মেরেছে—মহা অন্যায় করেছে, অপরাধ করেছে, হাজার বার লক্ষ বার, সে কথা সত্যি; কিন্তু আঙোটজুতির কথাটা তুমি জান না বাবা পাতু! গায়ের ভাগাড় তোমরা যে দখল করতার। জন্যেই তোমাদিগে গায়ের আঙোটজুতি যোগাতে হয়। এই নিয়ম। ভাগাড়ে মড়ি পড়লে তোমরা চামড়া নাও, হাড় বিক্রি কর, তারই দরুন তোমরা ওই আঙোটজুতিমাংস কাটিয়া লইয়া যাওয়ার কথাটা আর চৌধুরী ঘূণাবশে উচ্চারণ করিতে পারিল না।
পাতু অবাক হইয়া গেল; সে বলিলভাগাড়ের দরুন!
–হ্যাঁ। তোমাদের প্রবীণেরা তো কেউ নাই, তারা সব জানত।
—শুধু তাই নয়, মশায়; ওই পোড়ামুখী কলঙ্কিনী গো? এই ফাঁকে পাতুর বউ আবার সুর তুলিল।
পাতু এবার সঙ্গে সঙ্গে বলিল–আজ্ঞে হ্যাঁ। শুধু তো আঙোটজুতিও লয়; আপনারা ভদ্রনোকরা যদি আমাদের ঘরের মেয়েদের পানে তাকান—তবে আমরা যাই কোথা বলুন?
প্রৌঢ় প্রবীণ ধর্মপরায়ণ চৌধুরী বলিয়া উঠিল—রাম! রাম! রাম! রাধাকৃষ্ণ! রাধাকৃষ্ণ!
পাতু বলিল–আজ্ঞে রাম রাম লয়, চৌধুরী মশায়। আমার ভগ্নী দুর্গা একটু বজ্জাত বটে; বিয়ে দেলাম তো পালিয়ে এল শ্বশুরঘর থেকে। সেই তারই সঙ্গে মশায় ছিরু পাল ফষ্টিনষ্টি করবে। যখন তখন পাড়ায় এসে ছুতোনাতা নিয়ে বাড়িতে ঢুকে বসবে। আমার মা হারামজাদীকে তো জানেন? চিরকাল একভাবে গেল; ছিরু পালকে বসতে মোড়া দেবেতার সঙ্গে ফুসফাস করবে। ঘরে মশায়, আমার বউ রয়েছে। তাকে, মাকে আর দুর্গাকে আমি ঘা-কতক করে দিয়েছিলাম। মোড়লকেও বলেছিলাম, ভাল করেই বলেছিলাম চৌধুরী মশাই,–আমাদের জাতজ্ঞেতে নিন্দে করে—আর আপনি আসবেন না মশায়। এ আক্কোশটাও আছে মশাই।
লাঠি ও ছাতায় চৌধুরীর দুই হাত ছিল আবদ্ধ, কানে আঙুল দিবার উপায় ছিল না; সে ঘৃণাভরে থুতু ফেলিয়া মুখ ফিরাইয়া বলিলরাধাকৃষ্ণ হে! থাক পাতু, থাক বাবা-সক্কালবেলা ওসব কথা আমাকে আর শুনিও না। এতে আর আমার কি হাত আছে বল? রাধাকৃষ্ণ!
পাতু কিন্তু ইহাতে তুষ্ট হইল না। সে কোনো কথা না বলিয়া চৌধুরীকে পাশ কাটাইয়া। হনহন করিয়া অগ্রসর হইল। তাহার পিছন পিছন তাহার স্ত্রী আবার ছুটিতে আরম্ভ করিল–স্বামীর নীরবতার সুযোগ পাইয়া সে আবার কান্নার সুরে সুর করিল-হারামজাদী আবার ঢং করে। ভাইয়ের দুঃখে ঘটা করে কানতে বসেছে গো! ওগো আমি কি করব গো!
পাতু বিদ্যুৎগতিতে ফিরিল; সঙ্গে সঙ্গে বউটি আতঙ্কে অস্ফুট চিৎকার করিয়া উঠিল—অ্যাঁ—
পাতু মুখ খিঁচাইয়া বলিল—চেন্নাস না বাপু। তোকে কিছু বলি নাই… তু থাম। ধাক্কা দিয়া স্ত্রীকে সরাইয়া দিয়া সে ফিরিয়া পশ্চাদগামী চৌধুরীর সম্মুখে আসিয়া বলিল-আচ্ছা চৌধুরীমশায়, আলিপুরের রহমৎ শাঁখ যে কঙ্কণার রমন্দ চাটুজ্জের সঙ্গে ভাগাড় দখল করেছে, তার কি করছেন।
আশ্চর্য হইয়া চৌধুরী বলিলেন–সে কি!
–আজ্ঞে হ্যাঁ মশায়। ভাগাড়ের চামড়া দিগে ছাড়া আর কাউকে বেচতে পাব না। আমরা। তারা বলে, ভাগাড় জমিদার আমাদিগে বন্দোবস্ত দিয়েছে। ছাল ছাড়ানোর মজুরি আর নুনের দাম তার ওপর দু-চার আনা ছাড়া আর কিছু দেয় না। অথচ চামড়ার দাম এখন আগুন।
তা হলে?
চৌধুরী পাতুর মুখের দিকে চাহিয়া প্রশ্ন করিল—সত্যি কথা পাতু?
–আজ্ঞে হ্যাঁ। মিছে যদি হয় পঞ্চাশ জুতো খাব, নাকে খৎ দোব।
—তা হলে, চৌধুরী ঘাড় নাড়িয়া বলিলতা হলে হাজার বার তুমি বলতে পার ও-কথা, গায়ের লোক পয়সা দিতে বাধ্য; কিন্তু জমিদারের গোমস্তা নন্দীকে কথাটা জিজ্ঞাসা করেছ?
পাতু বলিল-গোমস্তা নন্দী কেন, জমিদারের কাছেই যাব আমি। ডাক্তার ঘোষ মশায়। বললে, থানায় যা। তা থানা কেন আগে জমিদারের কাছেই যাই, দুটো বিচারই হয়ে যাক। দেখি জমিদার কি বলে!
সে আবার ফিরিল এবং সোজা আলপথটা ছাড়িয়া দক্ষিণ দিকের একটা আল ধরিয়া কঙ্কণার দিকে মুখ করিল। বৃদ্ধ চৌধুরী টুকটুক করিয়া নদীর চরের দিকে অগ্রসর হইল। নদীর ওপারের জংশনের কলগুলার চিমনি এইবার স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। আর চৌধুরী চরের উপর আসিয়া পড়িয়াছে। কিন্তু হতভম্ব হইয়া গিয়াছে বৃদ্ধ চৌধুরী; সব করিয়া সব হইল—শেষে চামড়া বেচিয়া রামেন্দ্র চাটুজ্জে বড়লোক হইবে! ছিঃ ছিঃ, ব্রাহ্মণের ছেলে।