বিরাটপর্ব
॥ পাণ্ডবপ্রবেশপর্বাধ্যায়॥
১। অজ্ঞাতবাসের মন্ত্রণা
যুধিষ্ঠির বললেন, আমরা রাজ্যত্যাগ করে দ্বাদশ বৎসর প্রবাসে আছি, এখন ত্রয়োদশ বৎসর উপস্থিত হয়েছে। এই শেষ বৎসর কষ্টে কাটাতে হবে। অর্জুন, তুমি এমন দেশের নাম বল যেখানে আমরা অজ্ঞাতভাবে বাস করতে পারব। অর্জুন বললেন, যক্ষরূপী ধর্ম যে বর দিয়েছেন তার প্রভাবেই আমরা অজ্ঞাতভাবে বিচরণ করতে পারব, তথাপি কয়েকটি দেশের নাম বলছি।-কুরুদেশের চারদিকে অনেক রমণীয় দেশ আছে, যেমন পাঞ্চাল চেদি মৎস্য শূরসেন পটচ্চর দশার্ণ মল্ল শাম্ব যুগন্ধর কুন্তিরাষ্ট্র সুরাষ্ট্র অবন্তী। এদের মধ্যে কোনটি আপনার ভাল মনে হয়? যুধিষ্ঠির বললেন, মৎস্যদেশের রাজা বিরাট বলবান ধর্মশীল বদান্য ও বৃদ্ধ, তিনি আমাদের রক্ষা করতে পারবেন, আমরা এক বৎসর বিরাটনগরে তার কর্মচারী হয়ে থাকব।
অর্জুন বললেন, মহারাজ, আপনি মৃদুস্বভাব লজ্জাশীল ধার্মিক, সামান্য লোকের ন্যায় পরগৃহে কি কর্ম করবেন ? যুধিষ্ঠির বললেন, বিরাট রাজা দূতপ্রিয়, আমি কঙ্ক নাম নিয়ে ব্রাহ্মণরূপে তার সভাসদ হব, বৈদূর্য স্বর্ণ বা হস্তিদন্ত নির্মিত পাশক, জ্যোতীরস (১) নির্মিত ফলক এবং কৃষ্ণ ও লোহিত গুটিকা নিয়ে অক্ষক্রীড়া করে রাজা ও তাঁর অমাত্যবর্গের মনোরঞ্জন করব। তিনি জিজ্ঞাসা করলে বলব যে পূর্বে আমি যুধিষ্ঠিরের প্রাণসম সখা ছিলাম। বৃকোদর, বিরাটনগরে তুমি কোন্ কর্ম করবে?
ভীম বললেন, আমি বল্লভ নাম নিয়ে রাজার পাকশালার অধ্যক্ষ হব, পাককার্যে নিপুণতা দেখিয়ে তার সুশিক্ষিত পাচকদের হারিয়ে দেব। তা ছাড়া আমি রাশি রাশি কাঠ বয়ে আনব, প্রয়োজন হলে বলবান হস্তী বা বৃষকে দমন করব। যদি কেউ আমার সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করতে চায় তবে তাদের প্রহার করে ভূপাতিত করব, কিন্তু বধ করব না। কেউ জিজ্ঞাসা করলে
বলব, আমি রাজা যুধিষ্ঠিরের হস্তী ও বৃষ দমন করতাম এবং তার সূপকার ও মল্ল ছিলাম।
যুধিষ্ঠিরের প্রশ্নের উত্তরে অর্জুন বললেন, আমি বৃহন্নলা নাম নিয়ে নপুংসক সেজে যাব, বাহুতে যে জ্যাঘর্ষণের চিহ্ন আছে তা বলয় দিয়ে ঢাকব, কানে উজ্জ্বল কুণ্ডল এবং হাতে শাঁখা পরব, চুলে বেণী বাঁধব, এবং রাজভবনের স্ত্রীদের নৃত্য-গীত-বাদ্য শেখাব। জিজ্ঞাসা করলে বলব, আমি দ্রৌপদীর পরিচারিকা ছিলাম।
নকুল বললেন, আমি অশ্বের রক্ষা ও চিকিৎসায় নিপুণ, গ্রন্থিক নাম নিয়ে আমি বিরাটরাজার অশ্বরক্ষক হব। নিজের পরিচয় এই দেব যে পূর্বে আমি যুধিষ্ঠিরের অশ্বরক্ষক ছিলাম।
সহদেব বললেন, আমি তন্তিপাল নাম নিয়ে বিরাট রাজার গোসমূহের তত্ত্বাবধায়ক হব। আমি গরুর চিকিৎসা দোহনপদ্ধতি ও পরীক্ষা জানি; সুলক্ষণ বৃষও চিনতে পারি।
যুধিষ্ঠির বললেন, আমাদের এই ভার্যা প্রাণাপেক্ষা প্রিয়া, মাতার ন্যায় পালনীয়া, জ্যেষ্ঠা ভগিনীর ন্যায় মাননীয়া। ইনি সেখানে কোন্ কর্ম করবেন? দ্রৌপদী সুকুমারী, অভিমানিনী, জন্মাবধি মাল্য গন্ধ ও বিবিধ বেশভূষায় অভ্যস্ত। দ্রৌপদী বললেন, যে নারী স্বাধীনভাবে পরগৃহে দাসীর কর্ম করে তাকে সৈরিন্ধ্রী বলা হয়। কেশসংস্কারে নিপুণ সৈরিন্ধ্রীর রূপে আমি যাব, বলব যে পূর্বে আমি দ্রৌপদীর পরিচারিকা ছিলাম। রাজমহিষী সুদেষ্ণা আমাকে আশ্রয় দেবেন, তুমি ভেবো না। যুধিষ্ঠির বললেন, কল্যাণী, তোমার সংকল্প ভাল। মহৎ কুলে তোমার জন্ম, তুমি সাধ্বী, পাপকর্ম জান না। এমন ভাবে চলো যাতে পাপাত্মা শত্রুরা সুখী না হয়, তোমাকে কেউ যেন জানতে না পারে।
** (১) মণিবিশেষ, bloodstone
২। ধৌম্যের উপদেশ–অজ্ঞাতবাসের উপক্রম
পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রোপদী নিজ নিজ কর্ম স্থির করার পর যুধিষ্ঠির বললেন, পুরোহিত ধৌম্য দ্রুপদ রাজার ভবনে যান এবং সেখানে অগ্নিহোত্র রক্ষা করুন; তার সঙ্গে সারথি, পাচক আর দ্রৌপদীর পরিচারিকারাও যাক। রথগুলি নিয়ে ইন্দ্রসেন প্রভৃতি দ্বারকায় চ’লে যাক। কেউ প্রশ্ন করলে সকলেই বলবে, পাণ্ডবরা কোথায় গেছেন। তা আমরা জানি না।
ধৌম্য বললেন, পাণ্ডবগণ, তোমরা ব্রাহ্মণ সুহৃদবর্গ যান অস্ত্রাদি এবং অগ্নিরক্ষা সম্বন্ধে ব্যবস্থা করলে। যুধিষ্ঠির ও অর্জুন সর্বদা দ্রৌপদীকে রক্ষা করবেন। এখন তোমাদের এক বৎসর অজ্ঞাতবাস করতে হবে; তোমরা লোকব্যবহার জান, তথাপি রাজভবনে কিরূপ আচরণ করতে হয় তা আমি বলছি।-আমি রাজার প্রিয় এই ” মনে করে রাজার যান পর্যঙ্ক আসন হস্তী বা রথে আরোহণ করা অনুচিত। রাজা জিজ্ঞাসা না করলে তাকে উপদেশ দেবে না। রাজার পত্নী, যারা অন্তঃপুরে থাকে, এবং যারা রাজার অপ্রিয় তাদের সঙ্গে মিত্রতা করবে না। অতি সামান্য কার্যও রাজার জ্ঞাতসারে করবে। মতামত প্রকাশ করবার সময় রাজার যা হিতকর ও প্রিয় তাই বলবে, এবং প্রিয় অপেক্ষা হিতই বলবে। বাকসংযম করে রাজার দক্ষিণ বা বাম পার্শ্বে বসবে, পশ্চাদ্ভাগে অস্ত্রধারী রক্ষীদের স্থান। রাজার সম্মুখে বসা সর্বদাই নিষিদ্ধ। রাজা মিথ্যা কথা বললে তা প্রকাশ করবে না। আমি বীর বা বুদ্ধিমান এই বলে গর্ব করবে না, প্রিয়কার্য করলেই রাজার প্রিয় হওয়া যায়। রাজার সকাশে ওষ্ঠ হস্ত বা জানু সঞ্চালন করবে না, উচ্চবাক্য বলবে না, বায়ু ও নিষ্ঠীবন নিঃশব্দে ত্যাগ করবে। কৌতুকজনক কোনও আলোচনা হলে উন্মত্তের ন্যায় হাসবে না, মৃদুভাবে হাসবে। যিনি লাভে হর্য এবং অপমানে দুঃখ না দেখিয়ে অপ্রমত্ত থাকেন, রাজা কোনও লঘু বা গুরু কার্যের ভার দিলে যিনি বিচলিত হন না, তিনিই রাজভবনে বাস করতে পারেন। রাজা যে যান বস্ত্র ও অলংকারাদি দান করেন তা নিত্য ব্যবহার করলে রাজার প্রিয় হওয়া যায়। বৎস যুধিষ্ঠির, তোমরা এইভাবে এক বৎসর যাপন ক’রো।
যুধিষ্ঠির বললেন, আপনি যে সদুপদেশ দিলেন তা মাতা কুন্তী ও মহামতি বিদুর ভিন্ন আর কেউ দিতে পারেন না। তার পর ধৌম্য পাণ্ডবগণের সমৃদ্ধিকামনায় মন্ত্রপাঠ করে অগ্নিতে আহুতি দিলেন। হোমাগ্নি ও ব্রাহ্মণগণকে প্রদক্ষিণ করে পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদী অজ্ঞাতবাসে যাত্রা করলেন।
তারা যমুনার দক্ষিণ তীরে দিয়ে পদব্রজে চললেন। দুর্গম পর্বত ও বন অতিক্রম করে দশার্ণ দেশের উত্তর, পাঞ্চালের দক্ষিণ, এবং যকৃল্লোম ও শূরসেন দেশের মধ্য দিয়ে পাণ্ডবগণ মৎস্য দেশে উপস্থিত হলেন। তাদের বর্ণ মলিন, মুখ শ্মশ্রুময়, হস্তে ধনু কটিদেশে খড়্গ; কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, আমরা ব্যাধ। বিরাট-রাজধানীর অদূরে এসে দ্রৌপদী অত্যন্ত শ্রান্ত হয়ে পড়লেন, যুধিষ্ঠিরের। আদেশে অর্জুন তাকে স্কন্ধে বহন করে চলতে লাগলেন। রাজধানীতে উপস্থিত হয়ে যুধিষ্ঠির বললেন, আমরা যদি সশস্ত্র হয়ে নগরে প্রবেশ করি তবে লোকে উদবিগ্ন হবে; অর্জুনের গাণ্ডীব ধনু অনেকেই জানে, তা দেখে আমাদের চিনে ফেলবে। অর্জুন বললেন, শ্মশানের কাছে পর্বতশৃঙ্গে ওই যে বৃহৎ শমীবৃক্ষ রয়েছে তাতে আমাদের অস্ত্র রাখলে কেউ নিতে সাহস করবে না। তখন পাণ্ডবগণ তাঁদের ধনু থেকে জ্যা বিযুক্ত করলেন এবং দীর্ঘ উজ্জ্বল খড়্গ, তৃণীর ও ক্ষুরধার বৃহৎ বাণ সকল ধনুর সঙ্গে বাঁধলেন। নকুল শমীবৃক্ষে উঠে একটি দৃঢ় শাখায় অস্ত্রগুলি এমনভাবে রজ্জুবদ্ধ করলেন যাতে বৃষ্টি না লাগে। তার পর তিনি একটি মৃতদেহ সেই বৃক্ষে বেঁধে দিলেন, যাতে পূতিগন্ধ পেয়ে লোকে কাছে না আসে। গোপাল মেষপাল প্রভৃতির প্রশ্নের উত্তরে তারা বললেন, ইনি আমাদের মাতা, বয়স আশি বা এক শ, মৃতদেহ গাছে বেঁধে রাখাই আমাদের কুলধর্ম।
যুধিষ্ঠির নিজেদের এই পাঁচটি গুপ্ত নাম রাখলেন—জয় জয়ন্ত বিজয় জয়সেন দেবল। তার পর সকলে সেই বিশাল নগরে প্রবেশ করলেন।
৩। বিরাটভবনে যুধিষ্ঠিরাদির আগমন
বিরাট রাজার সভায় প্রথমে ব্রাহ্মণবেশী যুধিষ্ঠির উপস্থিত হলেন। তার রূণ মেঘাবৃত সূর্য ও ভস্মাবৃত অগ্নির ন্যায়, তিনি বৈদূর্যখচিত স্বর্ণময় পাশক বস্ত্রাঞ্চলে বেঁধে বাহুমূলে ধারণ করে আছেন। তাঁকে দেখে বিরাট তার সভাসঙ্গণকে বললেন ইনি কে? এঁকে ব্রাহ্মণ মনে হয় না, বোধ হয় ইনি কোনও রাজা; সঙ্গে গজ বালি রথ না থাকলেও এঁকে ইন্দ্রের ন্যায় দেখাচ্ছে। যুধিষ্ঠির নিকটে এসে বললেন মহারাজ, আমি বৈয়াঘ্রপদ্য-গোত্রীয় ব্রাহ্মণ, আমার সর্বস্ব বিনষ্ট হয়েছে, জীবিকা জন্য আপনার কাছে এসেছি। পূর্বে আমি যুধিষ্ঠিরের সখা ছিলাম। আমার নাম কঙ্ক, আমি দ্যূতক্রীড়ায় নিপুণ।
বিরাট বললেন, যা চাও তাই তোমাকে দেব, তুমি রাজা হবার যোগ্য, এ মৎস্যদেশ শাসন কর। দ্যুতকারগণ আমার প্রিয়, আমি তোমার বশবর্তী হয়ে থাক যুধিষ্ঠির বললেন, মৎস্যরাজ, এই বর দিন যেন দ্যূতক্রীড়ায় নীচ লোকের সে আমার বিবাদ না হয়, এবং আমি যাকে পরাজিত করব সে তার ধন আটকে রাখা পারবে না। বিরাট বললেন, কেউ যদি তোমার অপ্রিয় আচরণ করে তবে তা তাকে নিশ্চয় বধ করব, যদি সে ব্রাহ্মণ হয় তবে নির্বাসিত করব। সমাগত প্রজা শোন—যেমন আমি তেমনই কঙ্ক এই রাজ্যের প্রভু। কঙ্ক, তুমি আমার সখা এ আমার সমান, তুমি প্রচুর পানভোজন ও বস্ত্র পাবে, আমার ভবনের সকল তোমার জন্য উদ্ঘাটিত থাকবে, ভিতরে বাইরে সর্বত্র তুমি পরিদর্শন করতে পার কেউ যদি অর্থাভাবের জন্য তোমার কাছে কিছু প্রার্থনা করে তবে আমাকে জানি যা প্রয়োজন তাই আমি দান করব।
তারপর সিংহবিক্রম ভীম এলেন, তাঁর পরিধানে কৃষ্ণ বস্ত্র, হাতে খুন্তি ও কোষমুক্ত কৃষ্ণবর্ণ অসি। বিরাট সভাস্থ লোকদের জিজ্ঞাসা করলেন, সিং ন্যায় উন্নতস্কন্ধ অতি রূপবান কে এই যুবা? ভীম কাছে এসে বিনীতবাক্যে বললেন, মহারাজ, আমি পাচক, আমার নাম বল্লভ, আমি উত্তম ব্যঞ্জন রাঁধতে পারি, রাজা যুধিষ্ঠির আমার প্রস্তুত সূপ প্রভৃতি ভোজন করতেন। আমার তুল্য বলব কেউ নেই, আমি বাহুযুদ্ধে পটু, হস্তী ও সিংহের সঙ্গে যুদ্ধ করে আমি আপনাকে তুষ্ট করব। বিরাট বললেন, তোমাকে আমি পাকশালার কর্মে নিযুক্ত করলাম, সেখানে যেসব পাচক আছে তুমি তাদের অধ্যক্ষ হবে। কিন্তু এই কর্ম তোমার উপযুক্ত নয়, তুমি আসমুদ্র পৃথিবীর রাজা হবার যোগ্য।
অসিতনয়না দ্রৌপদী তাঁর কুঞ্চিত কেশপাশ মস্তকের দক্ষিণ পার্শ্বে তুলে কৃষ্ণবর্ণ পরিধেয় বস্ত্র দিয়ে আবৃত করে বিচরণ করছিলেন। বিরাট রাজার মহিষী কেকয়রাজকন্যা সুদেষ্ণা প্রাসাদের উপর থেকে দেখতে পেয়ে তাকে ডেকে আনালেন এবং জিজ্ঞাস করলেন, ভদ্রে, তুমি কে, কি চাও? দ্রৌপদী উত্তর দিলেন, রাজ্ঞী, আমি সৈরিন্ধ্রী, যিনি আমাকে পোষণ করবেন আমি তাঁর কর্ম করব। সুদেষ্ণা বললেন, ভাবিনী, তুমি নিজেই দাসদাসীকে আদেশ দেবার যোগ্য। তোমার পায়ের গ্রন্থি উচ্চ নয়, দুই উরু ঠেকে আছে, তোমার নাভি কণ্ঠস্বর ও স্বভাব নিম্ন, স্তন নিতম্ব ও নাসিকা উন্নত, পদতল করতল ও ওষ্ঠ রক্তবর্ণ, তুমি হংসগদগদভাষিণী, সুকেশী সুস্তনী। তুমি কাশ্মীরী তুরঙ্গমীর ন্যায় সুদর্শনা। তুমি কে? যক্ষী দেবী গন্ধবী না অপ্সরা?
দ্রৌপদী বললেন, সত্য বলছি আমি সৈরিন্ধ্রী। কেশসংস্কার, চন্দনাদি পেষণ, বিচিত্র মাল্যরচনা প্রভৃতি কর্ম জানি। আমি পূর্বে কৃষ্ণের প্রিয়া ভার্যা সত্যভামা এবং পাণ্ডবমহিষী কৃষ্ণার পরিচর্যা করতাম। তাদের কাছে আমি উত্তম খাদ্য ও প্রয়োজনীয় বসন পেতাম। দেবী সত্যভামা আমার নাম মালিনী রেখেছিলেন। সুদেষ্ণা বললেন, রাজা যদি তোমার প্রতি লুব্ধ না হন তবে আমি তোমাকে মাথায় করে রাখব। এই রাজভবনে যেসকল নারী আছে তারা একদৃষ্টিতে তোমাকে দেখছে, পুরুষরা মোহিত হবে না কেন? এখানকার বৃক্ষগুলিও যেন তোমাকে নমস্কার করছে। সুন্দরী, তোমার অলৌকিক রূপ দেখলে বিরাট রাজা আমাকে ত্যাগ করে সর্বান্তঃকরণে তোমাতেই আসক্ত হবেন। কর্কটকী (স্ত্রী-কাঁকড়া) যেমন নিজের মরণের নিমিত্তই গর্ভধারণ করে, তোমাকে আশ্রয় দেওয়া আমার পক্ষে সেইরূপ। দ্রৌপদী বললেন, বিরাট রাজা বা অন্য কেউ আমাকে পাবেন না, কারণ পাঁচজন মহাবলশালী গন্ধর্ব যুবা আমার স্বামী, তারা সর্বদা আমাকে রক্ষা করেন। আমি এখন ব্রতপালনের জন্যই কষ্ট স্বীকার করছি। যিনি আমাকে উচ্ছিষ্ট দেন না এবং আমাকে দিয়ে পা ধোয়ান না তাঁর উপর আমার গন্ধর্ব পতিরা তুষ্ট হন। যে পুরুষ সামান্য স্ত্রীর ন্যায় আমাকে কামনা করে সে সেই রাত্রিতেই পরলোকে যায়। সুদেষ্ণা বললেন, আনন্দদায়িনী, তুমি যেমন চাও সেই ভাবেই তোমাকে রাখব, কারও চরণ বা উচ্ছিষ্ট তোমাকে স্পর্শ করতে হবে না।
তারপর সহদেব গোপবেশ ধারণ করে বিরাটের সভায় এলেন। রাজা বললেন, বৎস, তুমি কে, কোথা থেকে আসছ, কি চাও? সহদেব গোপভাষায় গম্ভীরস্বরে উত্তর দিলেন, আমি অরিষ্টনেমি নামক বৈশ্য, পূর্বে পাণ্ডবদের গোপরীক্ষক ছিলাম। তারা এখন কোথায় গেছেন জানি না, আমি আপনার কাছে থাকতে চাই। যুধিষ্ঠিরের বহু লক্ষ গাভী ও বহু সহস্র বৃষ ছিল, আমি তাদের পরীক্ষা করতাম। লোকে আমাকে তন্তিপাল বলত। আমি দশযোজনব্যাপী গরুর দলও গণনা করতে এবং তাদের ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান বলতে পারি, যে উপায়ে গোবংশের বৃদ্ধি হয় এবং রোগ না হয় তাও জানি। আমি সুলক্ষণ বৃষ চিনতে পারি যাদের মূত্র আঘ্রাণ করলে বন্ধ্যাও প্রসব করে। বিরাট বললেন, আমার বিভিন্ন জাতীয় এক এক লক্ষ পশু আছে। সেই সমস্ত পশুর ভার তোমার হাতে দিলাম, তাদের পালকগণও তোমার অধীন থাকবে।
তার পর সভাস্থ সকলে দেখলেন, একজন রূপবান বিশালকায় পুরুষ আসছেন, তাঁর কর্ণে দীর্ঘ কুণ্ডল, হস্তে শঙ্খ ও সুবর্ণ নির্মিত বলয়, কেশরাশি উন্মুক্ত। নপুংসকবেশী অর্জুনকে বিরাট বললেন, তুমি হস্তিযূথপতির ন্যায় বলবান সুদর্শন যুবা, অথচ বাহুতে বলয় এবং কর্ণে কুণ্ডল পরে বেণী উন্মুক্ত করে এসেছ। যদি রথে চড়ে যোদ্ধার বেশে কবচ ও ধনুর্বাণ ধারণ করে আসতে তবেই তোমাকে মানাত। তোমার মত লোক ক্লীব হ’তে পারে না এই আমার বিশ্বাস। আমি বৃদ্ধ হয়েছি, রাজ্যভার থেকে মুক্তি চাই, তুমিই এই মৎস্যদেশ শাসন কর।
অর্জুন বললেন, মহারাজ, আমি নৃত্য-গীত-বাদ্যে নিপুণ, আপনার কন্যা উত্তরার শিক্ষার ভার আমাকে দিন। আমার এই ক্লীবরূপ কেন হয়েছে সেই দুঃখময় বৃত্তান্ত আপনাকে পরে বলব। আমার নাম বৃহন্নলা, আমি পিতৃমাতৃহীন, আমাকে আপনার পুত্র বা কন্যা জ্ঞান করবেন। রাজা বললেন, বৃহন্নলা, তোমার অভীষ্ট কর্মের ভার তোমাকে দিলাম, তুমি আমার কন্যা এবং অন্যান্য কুমারীদের নৃত্যাদি শেখাও। অনন্তর বিরাট রাজা অর্জুনের ক্লীবত্ব সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হয়ে তাকে অন্তঃপুরে পাঠিয়ে দিলেন। অর্জুন রাজকন্যা উত্তরা ও তার সহচরীদের নৃত্য-গীত-বাদ্য শিখিয়ে এবং প্রিয়কার্য করে তাঁদের প্রীতিভাজন হলেন।
তার পর আকাশচ্যুত সূর্যের ন্যায় নকুলকে আসতে দেখে মৎস্যরাজ বিরাট বললেন, এই দেবতুল্য পুরুষটি কে? এ সাগ্রহে আমার অশ্বসকল দেখছে, নিশ্চয় এই লোক অশ্বতত্ত্বজ্ঞ। রাজার কাছে এসে নকুল বললেন, মহারাজের জয় হ’ক, সভাস্থ সকলের শুভ হ’ক। আমি যুধিষ্ঠিরের অশ্বদলের তত্ত্বাবধান করতাম, আমার নাম গ্রন্থিক। অশ্বের স্বভাব, শিক্ষাপ্রণালী, চিকিৎসা এবং দুষ্ট অশ্বের সংশোধন আমার জানা আছে। বিরাট বললেন, আমার যত অশ্ব আছে সে সকলের তত্ত্বাবধানের ভার তোমাকে দিলাম, সারথি প্রভৃতিও তোমার অধীন হবে। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন যুধিষ্ঠিরের দর্শন পেয়েছি। ভৃত্যের সাহায্য বিনা তিনি এখন কি করে বনে বাস করছেন?
সাগর পর্যন্ত পৃথিবীর যাঁরা অধিপতি ছিলেন সেই পাণ্ডবগণ এইরূপে কষ্ট স্বীকার করে মৎস্যরাজ্যে অজ্ঞাতবাস করতে লাগলেন।
॥ সময়পালনপর্বাধ্যায়॥
৪। মল্লগণের সহিত ভীমের যুদ্ধ
যুধিষ্ঠির বিরাট রাজা, তাঁর পুত্র এবং সভাসদ্বর্গ সকলেরই প্রিয় হলেন। তিনি অক্ষয়হৃদয়(১) জানতেন, সেজন্য ন্যূতক্রীড়ায় সকলকেই সূত্রবদ্ধ পক্ষীর ন্যায় ইচ্ছানুসারে চালিত করতেন। যুধিষ্ঠির যে ধন জয় করতেন তা বিরাটের অজ্ঞাতসারে ভ্রাতাদের দিতেন। ভীম যে মাংস প্রভৃতি বিবিধ খাদ্য রাজার নিকট লাভ করতেন তা যুধিষ্ঠিরাদিকে বিক্রয় (২) করতেন। অন্তপুরে অর্জুন যে সব জীর্ণ বস্ত্র পেতেন তা বিক্রয়চ্ছলে অন্য ভ্রাতাদের দিতেন। নকুল-সহদেব ধন ও দধিদুগ্ধাদি দিতেন। অন্যের অজ্ঞাতসারে দ্রৌপদীও তার পতিদের দেখতেন।
এইরূপে চার মাস গত হলে মৎস্যরাজধানীতে ব্রহ্মার উদ্দেশে মহাসমারোহে এক জনপ্রিয় উৎসবের আয়োজন হল। এই মহোৎসবে নানা দিক থেকে অসুরতুল্য বলবান বহুবিজয়ী মল্লগণ বিরাট রাজার রঙ্গস্থলে উপস্থিত হল। তাদের মধ্যে জীমূত নামে এক মহামল্ল ছিল, সে অন্যান্য মল্লদের যুদ্ধে আহ্বান করলে, কিন্তু কেউ তার কাছে গেল না। তখন বিরাট ভীমকে যুদ্ধ করতে আদেশ দিলেন। রাজাকে অভিবাদন করে ভীম অনিচ্ছায় রঙ্গে প্রবেশ করলেন এবং কটিদেশ বন্ধন করে জীমূতকে আহ্বান করলেন। মদমত্ত মহাকায় হস্তীর ন্যায় দুজনের ঘোর বাহুযুদ্ধ হ’তে লাগল, তাঁরা হস্ত মুষ্টি করতল নখ, জানু পদ ও মস্তক দিয়ে পরস্পরকে সগর্জনে আঘাত করতে লাগলেন। অবশেষে ভীম জীমূতকে তুলে ধরে শতবার ঘুরিয়ে ভূমিতে ফেললেন এবং পেষণ করে বধ করলেন। কুবেরতুল্য ধনী বিরাট হৃষ্ট হয়ে তখনই ভীমকে প্রচুর অর্থ পুরস্কার দিলেন। তার পর ভীম আরও অনেক মল্লকে বিনষ্ট করলেন এবং অন্য প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় বিরাটের আজ্ঞায় সিংহ ব্যাঘ্র ও হস্তীর সঙ্গে যুদ্ধ করলেন।
অর্জুন নৃত্যগীত করে রাজা ও অন্তঃপুরবাসিনী নারীদের মনোরঞ্জন করতে লাগলেন। নকুল অশ্বদের শিক্ষিত করে রাজাকে তুষ্ট করলেন। সহদেবও বৃষদের বিনীত করে রাজার নিকট অনেক পুরস্কার পেলেন। দ্রৌপদী সুখী হলেন না, মহাবল পাণ্ডবদের কষ্টসাধ্য কর্ম দেখে তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন।
**
(১) মহর্ষি বৃহদশ্বের নিকট লব্ধ। বনপর্ব ১৬-পরিচ্ছেদের পাদটীকা এবং ১৯-পরিচ্ছেদের শেষ ভাগ দ্রষ্টব্য।
(২) যাতে লোকে তাঁদের ভ্রাতৃসম্পর্ক সন্দেহ না করে।
॥ কীচকবধপর্বাধ্যায়॥
৫। কীচক, সুদেষ্ণা ও দ্রৌপদী
পাণ্ডবরা মৎস্য রাজধানীতে দশ মাস অজ্ঞাতবাসে কাটালেন। একদিন বিরাটের সেনাপতি কীচক তার ভগিনী রাজমহিষী সুদেষ্ণার গৃহে পদ্মাননা দ্রৌপদীকে দেখতে পেলেন। তিনি কামাবিষ্ট হয়ে সুদেষ্ণার কাছে গিয়ে যেন হাসতে হাসতে বললেন, বিরাটভবনে এই রমণীকে আমি পূর্বে দেখিনি। মদিরা যেমন গন্ধে উন্মত্ত করে এই রমণীর রূপ সেইপ্রকার আমাকে উন্মত্ত করেছে। এই মনোহারিণী সুন্দরী কে, কোথা থেকে এসেছে? এ আমার চিত্ত মথিত করেছে, এর সঙ্গে মিলন ভিন্ন আমার রোগের অন্য ঔষধ নেই। তোমার এই পরিচারিকা যে কর্ম করছে তা তার যোগ্য নয়, সে আমার গৃহে এসে আমার সমস্ত সম্পত্তির উপর কর্তৃত্ব এবং গৃহ শোভিত করুক।
শৃগাল যেমন মৃগেন্দ্রকন্যার কাছে যায় সেইরূপ কীচক দ্রৌপদীর কাছে গিয়ে বললেন, সুন্দরী, তোমার রূপ ও প্রথম বয়স বৃথা নষ্ট হচ্ছে, পুরুষে যদি ধারণ না করে তবে পুষ্পমালা শোভা পায় না। চারুহাসিনী, আমার পুরাতন স্ত্রীদের আমি ত্যাগ করব, তারা তোমার দাসী হবে, আমি তোমার দাস হব। দ্রৌপদী উত্তর দিলেন, সূতপুত্র, আমি নিম্নবর্ণের সৈরিন্ধ্রী, কেশসংস্কাররূপ হীন কার্য করি, আপনার কামনার যোগ্য নই। আমি পরের পত্নী, বীরগণ আমাকে রক্ষা করেন। যদি আমাকে পাবার চেষ্টা করেন তবে আমার গন্ধর্ব পতিগণ আপনাকে বধ করবেন। অবোধ বালক যেমন নদীর এক তীরে থেকে অন্য তীরে যেতে চায়, রোগার্ত যেমন কালরাত্রির প্রার্থনা করে, মাতৃক্রোড়স্থ শিশু যেমন চন্দ্র চায়, আপনি সেইরূপ আমাকে চাচ্ছেন।
দ্রৌপদী কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে কীচক সুদেষ্ণার কাছে গিয়ে বললেন, সৈরিন্ধ্রী যাতে আমাকে ভজনা করে সেই উপায় কর, তবেই আমার জীবনরক্ষা হবে। সুদেষ্ণা তার ভ্রাতা কীচকের অভিলাষ, নিজের ইষ্ট, এবং দ্রৌপদীর উদবেগ সম্বন্ধে চিন্তা করে বললেন, তুমি কোনও পর্বের উপলক্ষ্যে নিজের ভবনে সুরা ও অন্নাদি প্রস্তুত করাও, আমি সুরা আনবার জন্য সৈরিন্ধ্রীকে তোমার কাছে পাঠাব, তখন তুমি নির্জন স্থানে তাকে চাটুবাক্যে সম্মত করিও।
উত্তম মদ্য, ছাগ শূকর প্রভৃতির মাংস, এবং অন্যান্য খাদ্য ও পানীয় প্রস্তুত করিয়ে কীচক রাজমহিষীকে নিমন্ত্রণ করলেন। সুদেষ্ণা দ্রৌপদীকে বললেন, কল্যাণী, তুমি কীচকের গৃহ থেকে পানীয় নিয়ে এস, আমার বড় পিপাসা হয়েছে। দ্রৌপদী বললেন, রাজ্ঞী, আমি কীচকের কাছে যাব না, তিনি নির্লজ্জ। আমি ব্যভিচারিণী হ’তে পারব না, আপনার কর্মে নিযুক্ত হবার কালে যে সমস্ত (শর্ত) করেছিলাম তা আপনি জানেন। আপনার অনেক দাসী আছে, তাদের কাকেও পাঠান। সুদেষ্ণা বললেন, আমি তোমাকে পাঠালে কীচক তোমার কোনও অনিষ্ট করবেন না। এই বলে তিনি দ্রৌপদীকে একটি ঢাকনিযুক্ত স্বর্ণময় পানপাত্র দিলেন।
দ্রৌপদী শঙ্কিতমনে সরোদনে কীচকের আবাসে গেলেন এবং ক্ষণকাল সূর্যের আরাধনা করলেন। সূর্যের আদেশে এক রাক্ষস অদৃশ্যভাবে দ্রৌপদীকে রক্ষা করতে লাগল।
৬। কীচকের পদাঘাত
দ্রৌপদীকে দেখে কীচক আনন্দে ব্যস্ত হয়ে উঠে বললেন, সুকেশী, আজ আমার সুপ্রভাত, তুমি আমার অধীশ্বরী, তোমাকে সুবর্ণহার শাঁখা কুণ্ডল কেয়ূর মণিরত্ন ও কৌষেয় বস্ত্রাদি দেব। তোমার জন্য দিব্য শয্যা প্রস্তুত আছে, সেখানে চল, আমার সঙ্গে মধুমাধবী (মধুজাত মদ্য) পান কর। দ্রৌপদী বললেন, রাজমহিষী আমাকে সুরা আনবার জন্য পাঠিয়েছেন। কীচক বললেন, দাসীরা তা নিয়ে যাবে। এই বলে তিনি দ্রৌপদীর হাত এবং উত্তরীয় বস্ত্র ধরলেন, দ্রৌপদী ঠেলা দিয়ে তাকে সরিয়ে দিলেন। কীচক সবলে আবার ধরলেন, দ্রৌপদী কম্পিতদেহে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে প্রবল ধাক্কা দিলেন, পাপাত্মা কীচক ভূমিতে পড়ে গেলেন। দ্রৌপদী দ্রুতবেগে বিরাট রাজার সভায় এলেন, কীচক সঙ্গে সঙ্গে এসে রাজার সমক্ষেই দ্রৌপদীর কেশাকর্ষণ করে তাঁকে পদাঘাত করলেন। তখন সেই সূর্যনিযুক্ত রাক্ষস বায়ুবেগে ধাবিত হয়ে কীচককে আঘাত করলে, কীচক ঘুরতে ঘুরতে ছিন্নমূল বৃক্ষের ন্যায় ভূপতিত হলেন।
রাজসভায় যুধিষ্ঠির ও ভীম উপস্থিত ছিলেন। দ্রৌপদীর অপমান দেখে কীচককে বধ করবার ইচ্ছায় ভীম দন্তে দন্ত ঘর্ষণ করতে লাগলেন। পাছে লোকে তাদের জেনে ফেলে এই ভয়ে যুধিষ্ঠির নিজের অঙ্গুষ্ঠ ভীমের অঙ্গুষ্ঠে ঠেকিয়ে তাঁকে নিবারণ করলেন। দ্রৌপদী তাঁদের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে রুদ্রনয়নে বিরাট রাজাকে যেন দগ্ধ করে বললেন, যাঁদের শত্রু বহুদূরদেশে বাস করেও ভয়ে নিদ্রা যায় না, তাঁদেরই আমি মানিনী ভার্যা, সেই আমাকে সূতপুত্র পদাঘাত করেছে! যাঁরা শরণাপন্নকে রক্ষা করেন সেই মহারথগণ আজ কোথায় আছেন? বিরাট যদি কীচককে ক্ষমা করে ধর্ম নষ্ট করেন তবে আমি কি করতে পারি ? রাজা, আপনি কীচকের প্রতি রাজবৎ আচরণ করছেন না, আপনার ধর্ম দস্যুর ধর্ম, তা এই রাজসভায় শোভা পাচ্ছে না। কীচক ধর্মজ্ঞ নয়, মৎস্যরাজও ধর্মজ্ঞ নন, যে সভাসদগণ তার অনুবর্তী তাঁরাও ধর্মজ্ঞ নন।
সাশ্রুনয়না দ্রৌপদীর তিরস্কার শুনে বিরাট বললেন, সৈরিন্ধ্রী, আমার অজ্ঞাতে তোমাদের কি বিবাদ হয়েছে তা আমি জানি না। তথ্য না জেনে আমি কি করে। বিচার করব? সভাসদ্গণ দ্রৌপদীর প্রশংসা এবং কীচকের নিন্দা করতে লাগলেন। তাঁরা বললেন, এই সর্বাঙ্গসুন্দরী যার ভার্যা তিনি মহাভাগ্যবান। এরূপ বরবর্ণিনী মনুষ্যলোকে সুলভ নয়, বোধ হয় ইনি দেবী।
ক্রোধে যুধিষ্ঠিরের ললাট ঘর্মাক্ত হল। তিনি বললেন, সৈরিন্ধ্রী, তুমি এখানে থেকো না, দেবী সুদেষ্ণার গৃহে যাও। আমার মনে হয় তোমার গন্ধর্ব পতিদের বিবেচনায় এই কাল ক্রোধের উপযুক্ত নয়, নতুবা তারা প্রতিশোধের জন্য দ্রুতবেগে উপস্থিত হ’তেন। তুমি আর এখানে নটীর ন্যায় রোদন ক’রো না, তাতে এই রাজসভায় যাঁরা দ্যূতক্রীড়া করছেন তাদের বিঘ্ন হবে। তুমি যাও, গন্ধর্বগণ তোমার দুঃখ দূর করবেন।
দ্রৌপদী বললেন, যাঁদের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দূতাসক্ত সেই অতীব দয়ালুদের জন্যই আমাকে ব্রতচারিণী হ’তে হয়েছে। আমার অপমানকারীদের বধ করাই তাদের উচিত ছিল। দ্রৌপদী অন্তঃপুরে চ’লে গেলেন। তার রোদনের কারণ শুনে সুদেষ্ণা বললেন, সুকেশী, আমার কথাতেই তুমি কীচকের কাছে সুরা আনতে গিয়ে অপমানিত হয়েছ, যদি চাও তবে তাকে প্রাণদণ্ড দেওয়াব। দ্রৌপদী বললেন, কীচক যাঁদের কাছে অপরাধী তাঁরাই তাকে বধ করবেন, সে আজই পরলোকে যাবে।
দ্রৌপদী নিজের বাসগৃহে গিয়ে গাত্র ও বস্ত্র ধুয়ে ফেললেন। তিনি দুঃখে কাতর হয়ে স্থির করলেন, ভীম ভিন্ন আর কেউ তার প্রিয়কার্য করতে পারবেন না। রাত্রিকালে তিনি শয্যা থেকে উঠে ভীমের গৃহে গেলেন, এবং দুর্গম বনে সিংহী যেমন সিংহকে আলিঙ্গন করে সেইরূপ ভীমকে আলিঙ্গন করে বললেন, ভীমসেন, ওঠ ওঠ, মৃতের ন্যায় শুয়ে আছ কেন? যে জীবিত, তার ভার্যাকে স্পর্শ করে কোনও পাপী বাঁচতে পারে না। পাপিষ্ঠ সেনাপতি কীচক আমাকে পদাঘাত করে এখনও বেঁচে আছে, তুমি কি করে নিদ্রা যাচ্ছ?
ভীম জেগে উঠে বললেন, তুমি ব্যস্ত হয়ে কেন এসেছ? সুখ দুঃখ প্রিয় অপ্রিয় যা ঘটেছে সব এল। কৃষ্ণা, তুমি সর্ব কর্মে আমাকে বিশ্বাস ক’রো, আমি তোমাকে সর্বদা বিপদ থেকে মুক্ত করব। তোমার বক্তব্য বলে শীঘ্র নিজ গৃহে চ’লে যাও, যাতে কেউ জানতে না পারে।
৭। ভীমের নিকট দ্রৌপদীর বিলাপ
দ্রৌপদী বললেন, যুধিষ্ঠির যার স্বামী সে শোক পাবেই। তুমি আমার সব দুঃখ জান, তবে আবার জিজ্ঞাসা করছ কেন? দূতসভায় দুঃশাসন সকলের সমক্ষে আমাকে দাসী বলেছিল, সেই স্মৃতি আমাকে দগ্ধ করছে। বনবাসকালে সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ আমার চুল ধরে টেনেছিল, কে তা সইতে পারে? আজ মৎস্যরাজের সমক্ষেই কীচক আমাকে পদাঘাত করেছে, সেই অপমানের পর আমার ন্যায় কোন নারী জীবিত থাকতে পারে? বিরাট রাজার সেনাপতি ও শ্যালক দুর্মতি কীচক সর্বদা আমাকে বলে—তুমি আমার ভার্যা হও। ভীম, তোমার দূতাসক্ত জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার জন্যই আমি অনন্ত দুঃখ ভোগ করছি। তিনি যদি সহস্র স্বর্ণমুদ্রা বা স্বর্ণ রৌপ্য বস্ত্র যান অশ্বাদি পশু পণ রাখতেন তবে বহু বৎসর দিবারাত্র খেললেও নিঃস্ব হ’তেন না। তিনি খেলায় প্রমত্ত হয়ে ঐশ্বর্য হারিয়েছেন, এখন মূঢ়ের ন্যায় নীরব হয়ে আছেন, মৎস্যরাজের পরিচারক হয়ে নরকভোগ করছেন। তুমি পাচক হয়ে বিরাটের সেবা কর দেখলে আমার মন অবসন্ন হয়। সুদেষ্ণার সমক্ষে তুমি সিংহ-ব্যাঘ্র-মহিষের সঙ্গে যুদ্ধ কর, তা দেখলে আমি মোহগ্রস্ত হই। আমার সেই অবস্থা দেখে তিনি তাঁর সঙ্গিনীদের বলেন, এক স্থানে বাস করার ফলে এই সৈরিন্ধ্রী পাচক বল্লবের প্রতি অনুরক্ত হয়েছে, সেজন্য তাকে হিংস্র পশুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে দেখলে শোকার্ত হয়; স্ত্রীলোকের মন দুর্জ্ঞেয়, তবে এরা দুজনেই সুন্দর এবং পরস্পরের যোগ্য। দেব দানব ও নাগগণের বিজেতা অর্জুন এখন নপুংসক সেজে শাঁখা আর কুণ্ডল পরে বেণী ঝুলিয়ে কন্যাদের নৃত্য শেখাচ্ছেন। যাঁকে রত্ন করবার ভার কুন্তী আমাকে দিয়েছিলেন, সেই সৎস্বভাব লজ্জাশীল মিষ্টভাষী সহদেব রক্তবসন পরে গোপগণের অগ্রণী হয়ে বিরাটকে অভিবাদন করছেন এবং রাত্রিকালে গোবৎসের চর্মের উপর শুয়ে নিদ্রা যাচ্ছেন। রূপবান বুদ্ধিমান অস্ত্রবিশারদ নকুল এখন রাজার অশ্বরক্ষক হয়েছেন। দূতাসক্ত যুধিষ্ঠিরের জন্যই আমি সৈরিন্ধ্রী হয়ে সুদেষ্ণার শৌচকার্যের সহায় হয়েছি। পাণ্ডবগণের মহিষী এবং দ্রুপদের দুহিতা হয়েও আমি এই দুর্দশায় পড়েছি। কন্তী ভিন্ন আর কারও জন্য আমি চন্দনাদি পেষণ করিনি, নিজের জন্যও নয়, এখন আমার দুই হাতে কত কড়া পড়েছে দেখ। কুন্তী বা তোমাদের কাকেও আমি ভয় করি নি, এখন কিংকরী হয়ে আমাকে বিরাটের সম্মুখে সভয়ে দাঁড়াতে হয়—আমার প্রস্তুত বিলেপন তিনি ভাল বলবেন কিনা এই সংশয়ে; অন্যের পেষা চন্দন আবার তাঁর রোচে না। ভীম, আমি দেবতাদের অপ্রিয় কোনও কার্য করি নি, আমার মরা উচিত, অভাগিনী বলেই বেঁচে আছি।
শোকবিহুলা দ্রৌপদীর হাত ধরে ভীম সজলনয়নে বললেন, ধিক আমার বাহুবল, ধিক অর্জুনের গাণ্ডীব, তোমার রক্তাভ করযুগলে কড়া পড়েছে তাও দেখতে হল ! আমি সভামধ্যেই বিরাটের নিগ্রহ করতাম, পদাঘাতে কীচকের মস্তক চূর্ণ করতাম, মৎস্যরাজের লোকদেরও শাস্তি দিতাম, কিন্তু ধর্মরাজ কটাক্ষ করে আমাকে নিবারণ করলেন। কল্যাণী, তুমি আর অর্ধমাস কষ্ট সয়ে থাক, তার পর ত্রয়োদশ বর্য পূর্ণ হলে তুমি রাজাদের রাজ্ঞী হবে।
দ্রৌপদী বললেন, আমি দুঃখ সইতে না পেরেই অমোচন করছি, রাজা। যুধিষ্ঠিরকে তিরস্কার করা আমার উদ্দেশ্য নয়। পাছে বিরাট আমার রূপে অভিভূত হন এই আশঙ্কায় সুদেষ্ণা উদবিগ্ন হয়ে আছেন, তা জেনে এবং নিজের দুর্বুদ্ধিবশে দুরাত্মা কীচক আমাকে প্রার্থনা করছে। তোমরা যদি কেবল অজ্ঞাতবাসের প্রতিজ্ঞা পালনেই রত থাক, তবে আমি আর তোমাদের ভার্যা থাকব না। মহাবল ভীমসেন, তুমি জটাসুরের হাত থেকে আমাকে উদ্ধার করেছিলে, জয়দ্রথকে জয় করেছিলে, এখন আমার অপমানকারী পাপিষ্ঠ কীচককে বধ কর, প্রস্তরের উপর মৃকুম্ভের ন্যায় তার মস্তক চূর্ণ কর। সে জীবিত থাকতে যদি সূর্যোদয় হয় তবে আমি বিষ আলোড়ন করে পান করব, তার বশীভূত হব না। এই বলে দ্রৌপদী ভীমের বক্ষে লগ্ন হয়ে কাঁদতে লাগলেন।
৮। কীচকবধ
ভীম বললেন, যাজ্ঞসেনী, তুমি যা চাও তাই হবে, আমি কীচককে সবান্ধবে হত্যা করব। তুমি তাকে বল সে যেন সন্ধ্যার সময় নৃত্যশালায় তোমার প্রতীক্ষা করে। কন্যারা সেখানে দিবসে নৃত্য করে, রাত্রিতে নিজের নিজের গৃহে চ’লে যায়। সেখানে একটি উত্তম পর্যঙ্ক আছে, তার উপরেই আমি কীচককে তার পূর্বপুরুষদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করাব।
পরদিন প্রাতঃকালে কীচক রাজভবনে গিয়ে দ্রৌপদীকে বললেন, আমি রাজসভায় বিরাটের সমক্ষে তোমাকে পদাঘাত করেছিলাম, কেউ তোমাকে রক্ষা করেনি, কারণ আমি পরাক্রান্ত। বিরাট কেবল নামেই মৎস্যদেশের রাজা, বস্তুত সেনাপতি আমিই রাজা। সুশ্রোণী, তুমি আমাকে ভজনা কর, তোমাকে শত স্বর্ণমুদ্রা দিচ্ছি। শত দাসী, শত দাস এবং অশ্বতরীযুক্ত একটি রথও তোমাকে দেব। দ্রৌপদী বললেন, কীচক, এই প্রতিজ্ঞা কর যে তোমার সখা বা ভ্রাতা কেউ আমাদের সংগম জানতে পারবে না; আমি আমার গন্ধর্ব পতিদের ভয় করি। কীচক বললেন, ভীরু, আমি একাকীই তোমার শূন্য গৃহে যাব, গন্ধর্বরা জানতে পারবে না। দ্রৌপদী বললেন, রাত্রিতে নৃত্যশালা শূন্য থাকে, তুমি অন্ধকারে সেখানে যেয়ো।
কীচকের সঙ্গে এইরূপ আলাপের পর সেই দিনের অবশিষ্ট ভাগ দ্রৌপদীর কাছে একমাসের তুল্য দীর্ঘ বোধ হ’তে লাগল। তিনি পাকশালায় ভীমের কাছে গিয়ে সংবাদ দিলেন। ভীম আনন্দিত হয়ে বললেন, আমি সত্য ধর্ম ও ভ্রাতাদের নামে শপথ করে বলছি, আমি গুপ্ত স্থানে বা প্রকাশ্যে কীচককে চূর্ণ করব, মৎস্যদেশের ললাকে যদি যুদ্ধ করতে আসে, তবে তাদেরও সংহার করব, তার পর দুর্যোধনকে বধ করে রাজ্যলাভ করব; যুধিষ্ঠির বিরাটের সেবা করতে থাকুন। দ্রৌপদী বললেন, বীর, তুমি আমার জন্য সত্যভ্রষ্ট হয়ো না, কীচককে গোপনে বধ কর।
সিংহ যেমন মৃগের জন্য প্রতীক্ষায় থাকে সেইরূপ ভীম রাত্রিকালে নৃত্যশালায় গিয়ে কীচকের জন্য প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। সৈরিন্ধীর সঙ্গে মিলনের আশায় কীচক সুসজ্জিত হয়ে সেই অন্ধকারময় বৃহৎ গৃহে এলেন এবং শয্যায় শয়ান ভীমকে স্পর্শ করে আনন্দে অস্থির হয়ে বললেন, তোমার গৃহে আমি বহু ধন, রত্ন, পরিচ্ছদ ও দাসী পাঠিয়ে দিয়েছি; আর দেখ, আমার গৃহের সকল স্ত্রীরাই বলে যে আমার তুল্য সুবেশ ও সুদর্শন পুরুষ আর নেই।
ভীম বললেন, আমার সৌভাগ্য যে তুমি সুদর্শন এবং নিজেই নিজের প্রশংসা করছ; তোমার তুল্য স্পর্শ আমি পূর্বে কখনও পাইনি। তার পর মহাবাহু ভীম সহসা শয্যা থেকে উঠে সহাস্যে বললেন, পাপিষ্ঠ, সিংহ যেমন হস্তীকে করে সেইরূপ আমি তোমাকে ভূতলে ফেলে আকর্ষণ করব, তোমার ভগিনী তা দেখবেন; তুমি নিহত হলে সৈরিন্ধ্রী অবাধে বিচরণ করবেন, তার স্বামীরাও সুখী হবেন। এই বলে ভীম কীচকের কেশ ধরলেন, কীচকও ভীমের দুই বাহু ধরলেন। বালী ও সুগ্রীবের ন্যায় তাঁরা বাহুযুদ্ধে রত হলেন।
প্রচণ্ড বায়ু যেমন বৃক্ষকে ঘূর্ণিত করে সেইরূপ ভীম কীচককে গৃহ মধ্যে সঞ্চালিত করতে লাগলেন। ভীমের হাত থেকে ঈষৎ মুক্ত হয়ে কীচক জানুর আঘাতে ভীমকে ভূতলে ফেললেন। ভীম তখনই উঠে আবার আক্রমণ করলেন। তাঁর প্রহারে কীচক ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়লেন, ভীম তখন দুই বাহু দ্বারা কীচককে ধরে তাঁর কণ্ঠদেশ নিপীড়িত করতে লাগলেন। কীচকের সর্বাঙ্গ ভগ্ন হল। ভীম তাকে ভূতলে ঘূর্ণিত করে বললেন, ভার্যাকে যে পদাঘাত করেছিল সেই শত্রুকে বধ করে আজ আমি ভ্রাতাদের কাছে ঋণমুক্ত হব, সৈরিন্ধ্রীর কণ্টক দূর করব।
কীচকের প্রাণ বহির্গত হল। পুরাকালে মহাদেব যেমন গজাসুরকে করেছিলেন, ক্রুদ্ধ ভীমসেন সেইরূপ কীচকের হাত পা মাথা গলা সমস্তই দেহের মধ্যে প্রবিষ্ট করে দিলেন। তার পর তিনি দ্রৌপদীকে ডেকে সেই মাংসপিণ্ড দেখিয়ে বললেন, পাঞ্চালী, কামুকটাকে কি করেছি দেখ। ভীমের ক্রোধের শান্তি হল তিনি পাকশালায় চ’লে গেলেন। দ্রৌপদী নৃত্যশালার রক্ষকদের কাছে গিয়ে বললেন, পরস্ত্রীলোভী কীচক আমার গন্ধর্ব পতিদের হাতে নিহত হয়ে পড়ে আছে, তোমরা এসে দেখ। রক্ষকরা মশাল নিয়ে সেখানে এল এবং কীচকের রুধিরাক্ত দেহ দেখে তার হাত পা মুণ্ড গলা কোথায় গেল অনুসন্ধান করতে লাগল।
৯। উপকীচকবধ-দ্রৌপদী ও বৃহন্নলা
কীচকের বান্ধবরা মৃতদেহ বেষ্টন করে কাঁদতে লাগল। স্থলে উদ্ধৃত কচ্ছপের ন্যায় একটা পিণ্ড দেখে তারা ভয়ে রোমাঞ্চিত হল। সূতপুত্রগণ (১) যখন অন্ত্যেষ্টির জন্য মতদেহ বাইরে নিয়ে যাচ্ছিল তখন তারা দেখলে অদুরে একটা স্তম্ভ ধরে দ্রৌপদী দাঁড়িয়ে আছেন। উপকীচকরা বললে, ওই অসতীটাকে কীচকের সঙ্গে দগ্ধ কর, ওর জন্যই তিনি হত হয়েছেন। তারা বিরাটের কাছে গিয়ে অনুমতি চাইলে তিনি সম্মত হলেন, কারণ কীচকের বান্ধবরাও পরাক্রান্ত।
উপকীচকগণ দ্রৌপদীকে বেঁধে শ্মশানে নিয়ে চলল। তিনি উচ্চস্বরে বললেন, জয় জয়ন্ত বিজয় জয়সেন জয়দ্বল শোন, মহাবীর গন্ধর্বগণ শোন—সূত-পুত্রগণ আমাকে দাহ করতে নিয়ে যাচ্ছে। ভীম সেই আহ্বান শুনে তখনই শয্যা থেকে উঠে বললেন, সৈরিন্ধ্রী, ভয় নেই। তিনি বেশ পরিবর্তন করে অম্বার দিয়ে নির্গত হয়ে প্রাচীর লঙ্ঘন করে সূতগণের সম্মুখীন হলেন। চিতার নিকটে একটি শুষ্ক বৃহৎ বৃক্ষ দেখে তিনি উৎপাটিত করে স্কন্ধে নিলেন এবং দণ্ডপাণি কৃতান্তের ন্যায় ধাবিত হলেন। তাঁকে দেখে উপকীচকরা ভয় পেয়ে বললে, ক্রুদ্ধ গন্ধর্ব বৃক্ষ নিয়ে আসছে, সৈরিন্ধ্রীকে শীঘ্র মুক্তি দাও। তারা দ্রৌপদীকে ছেড়ে দিয়ে রাজধানীর দিকে পালাতে গেল, সেই একশ পাঁচজন উপকীচককে ভীম যমালয়ে পাঠালেন। তার পর তিনি দ্রৌপদীকে বললেন, কৃষ্ণা, আর ভয় নেই, তুমি রাজভবনে ফিরে যাও আমিও অন্য পথে পাকশালায় যাচ্ছি।
প্রাতঃকালে মৎস্যদেশের নরনারীগণ সেনাপতি কীচক ও তাঁর একশ পাঁচজন বান্ধব নিহত হয়েছে দেখে অত্যন্ত বিস্মিত হল। তারা রাজার কাছে গিয়ে সেই সংবাদ দিয়ে বললে, সৈরিন্ধ্রী আবার আপনার ভবনে এসেছে; সে রূপবতী সেজন্য পুরুষরা তাকে কামনা করবে, গন্ধর্বরাও মহাবল। মহারাজ, সৈরিন্ধ্রীর দোষে যাতে আপনার রাজধানী বিনষ্ট না হয় তার ব্যবস্থা করুন। এ কীচক ও উপকীচকগণের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য আদেশ দিয়ে বিরাট সুদেষ্ণাকে বললেন, তুমি সৈরিন্ধ্রীকে এই কথা বল—সুন্দরী, তুমি এখান থেকে যেখানে ইচ্ছা হয় চ’লে যাও; রাজা গন্ধর্বদের ভয় করেন, তিনি নিজে এ কথা তোমাকে বলতে পারেন না, সেজন্য আমি বলছি।
মুক্তিলাভের পর দ্রৌপদী তাঁর গাত্র ও বস্ত্র ধৌত করে রাজধানীর দিকে চললেন, তাকে দেখে লোকে গন্ধর্বের ভয়ে ত্রস্ত হয়ে পালাতে লাগল। পাকশালার নিকটে এসে ভীমসেনকে দেখে দ্রৌপদী সহাস্যে বললেন, গন্ধর্বরাজকে নমস্কার, যিনি আমাকে মুক্ত করেছেন। ভীম উত্তর দিলেন, এই নগরে যে পুরুষরা আছেন তারা এখন তোমার কথা শুনে ঋণমুক্ত হলেন।
তার পর দ্রৌপদী দেখলেন, নৃত্যশালায় অর্জুন কন্যাদের নৃত্য শেখাচ্ছেন? কন্যারা বললে, সৈরিন্ধ্রী, ভাগ্যক্রমে তুমি মুক্তিলাভ করেছ এবং তোমার অনিষ্টকারী কীচকগণ নিহত হয়েছে। অর্জুন বললেন, তুমি কি করে মুক্ত হলে, সেই পাপীরাই বা কি করে নিহত হল তা সবিস্তারে শুনতে ইচ্ছা করি। দ্রৌপদী বললেন, বৃহন্নলা সৈরিন্ধীর কথায় তোমার কি প্রয়োজন? তুমি তো কন্যাদের মধ্যে সুখে আছ, আমার ন্যায় দুঃখভোগ কর না। অর্জুন বললেন, কল্যাণী, বৃহন্নলাও মহাদুঃখ ভোগ করছে, সে এখন পশুতুল্য হয়ে গেছে তা তুমি বুঝছ না। আমরা এক স্থানেই বাস করি, তুমি কষ্ট পেলে কে না দুঃখিত হয়?
দ্রৌপদী কন্যাদের সঙ্গে সুদেষ্ণার কাছে গেলেন। রাজার আদেশ অনুসারে সুদেষ্ণা বললেন, সৈরিন্ধ্রী, তুমি শীঘ্র যেখানে ইচ্ছা হয় চ’লে যাও। তুমি যুবতী ও রূপে অনুপমা, রাজাও গন্ধর্বদের ভয় করেন। দ্রৌপদী বললেন, আর তের দিনের জন্য আমাকে ক্ষমা করুন, তার পর আমার গন্ধর্ব পতিগণ তাদের কর্ম সমাপ্ত করে। আমাকে নিয়ে যাবেন, আপনাদেরও সকলের মঙ্গল করবেন।
** (১) এরা কীচকের ভ্রাতৃসম্পর্কীয় বা উপকীচক।
॥ গোহরণপর্বাধ্যায়॥
১০। দুর্যোধনাদির মন্ত্রণা
পাণ্ডবরা কোথায় অজ্ঞাতবাস করছেন তা জানবার জন্য দুর্যোধন নানা দেশে চর পাঠিয়েছিলেন। তারা এখন হস্তিনাপুরে ফিরে এসে তাকে বললে, মহারাজ, আমরা দুর্গম বনে ও পর্বতে, জনাকীর্ণ দেশে ও নগরে বহু অন্বেষণ করেও পাণ্ডবদের পাইনি। তাদের সারথিরা দ্বারকায় গেছে, কিন্তু তারা সেখানে নেই। পাণ্ডবগণ নিশ্চয় বিনষ্ট হয়েছেন। একটি প্রিয় সংবাদ এই-মৎস্যরাজ বিরাটের সেনাপতি দুরাত্মা কীচক যিনি ত্রিগর্ত দেশীয় বীরগণকে বার বার পরাজিত করেছিলেন তিনি আর জীবিত। নেই, অদৃশ্য গন্ধর্বগণ রাত্রিযোগে তাকে এবং তার ভ্রাতাদের বধ করেছে।
দুর্যোধন সভাস্থ সকলকে বললেন, পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসের আর অল্পকালই অবশিষ্ট আছে, এই কালও যদি তারা অতিক্রম করে তবে তাদের সত্য রক্ষা হবে এবং তার ফল কৌরবদের পক্ষে দুঃখজনক হবে। এখন এর প্রতিকারের জন্য কি করা উচিত তা আপনারা শীঘ্র স্থির করুন। কর্ণ বললেন, আর একদল অতি ধূর্ত গুপ্তচর পাঠাও, তারা সর্বত্র গিয়ে অন্বেষণ করুক। দুঃশাসন বললেন, আমারও সেই মত; পাণ্ডবরা হয়তো নিগূঢ় হয়ে আছে, বা সমুদ্রের অপর পারে গেছে, বা মহারণ্যে হিংস্র পশুগণ তাদের ভক্ষণ করেছে, অথবা অন্য কোনও বিপদের ফলে তারা চিরকালের জন্য বিনষ্ট হয়েছে।
দ্রোণাচার্য বললেন, পাণ্ডবদের ন্যায় বীর ও বুদ্ধিমান পুরুষরা কখনও বিনষ্ট হন না; আমি মনে করি তারা সাবধানে আসন্নকালের প্রতীক্ষা করছেন। তোমরা বিশেষরূপে চিন্তা করে যা যুক্তিসঙ্গত তাই কর। ভীষ্ম বললেন, দ্রোণাচার্য ঠিক বলেছেন, পাণ্ডবগণ কৃষ্ণের অনুগত, ধর্মবলে ও নিজবীর্যে রক্ষিত, তারা উপযুক্ত কালের প্রতীক্ষা করছেন। তাদের অজ্ঞাতবাস সম্বন্ধে অন্য লোকের যে ধারণা, আমার তা নয়। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির যে দেশেই থাকুন সেই দেশের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল হবে, কোনও গুপ্তচর তার সন্ধান পাবে না। কৃপাচার্য বললেন, পাণ্ডবদের আত্মপ্রকাশের কাল আসন্ন, সময় উত্তীর্ণ হলেই তারা নিজ রাজ্য অধিকারের জন্য উৎসাহী হবেন। দুর্যোধন, তুমি নিজের বল ও কোষ বৃদ্ধি কর, তার পর অবস্থা বুঝে সন্ধি বা বিগ্রহের জন্য প্রস্তুত হয়ো।
ত্রিগর্তদেশের অধিপতি সুশর্মা দুর্যোধনের সভায় উপস্থিত ছিলেন, মৎস্য ও শান্তু দেশীয় যোদ্ধারা তাঁকে বহুবার পরাজিত করেছিল। তিনি দুর্যোধনকে বললেন, মৎস্যরাজ বিরাট আমার রাজ্যে অনেক বার উৎপীড়ন করেছেন, কারণ মহাবীর কীচক তাঁর সেনাপতি ছিলেন। সেই নিষ্ঠুর দুরাত্মা কীচককে গন্ধর্বরা বধ করেছে, তার ফলে বিরাট এখন অসহায় ও নিরুৎসাহ হয়েছেন। আমার মতে এখন বিরাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করা উচিত। আমরা তার ধনরত্ন, গ্রামসমূহ বা রাষ্ট্র অধিকার করব, বহু সহস্র গো হরণ করব। কিংবা তার সঙ্গে সন্ধি করে তার পৌরুষ নষ্ট করব, অথবা তার সমস্ত সৈন্য সংহার করে তাকে বশে আনব; তাতে আপনার বলবৃদ্ধি হবে।
কর্ণ বললেন, সুশর্মা কালোচিত হিতবাক্য বলেছেন। আমাদের সেনাদল একত্র বা বিভক্ত হয়ে যাত্রা করুক। অর্থহীন বলহীন পৌরুষহীন পাণ্ডবদের জন্য আমাদের ভাববার প্রয়োজন কি, তারা অন্তর্হিত হয়েছে অথবা যমালয়ে গেছে। এখন আমরা নিরুবেগে বিরাটরাজ্য আক্রমণ করে. গো এবং বিবিধ ধনরত্ন হরণ করব।
কৃষ্ণপক্ষের সপ্তমীর দিন সুশর্মা সসৈন্যে বিরাটরাজ্যের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে উপস্থিত হলেন। পরদিন কৌরবগণও গেলেন।
১১। দক্ষিণগোহ (১)-সুশর্মার পরাজয়
এ পাণ্ডবগণের নির্বাসনের ত্রয়োদশ বর্ষ যেদিন পূর্ণ হল সেই দিনে সুশর্মা বিরাটের বহু গোধন হরণ করলেন। একজন গোপ বেগে রাজসভায় গিয়ে বিরাটকে বললে, মহারাজ, ত্রিগর্তদেশীয়গণ আমাদের নির্জিত করে শতসহস্র গো হরণ করেছে। বিরাট তখনই তার সেনাদলকে প্রস্তুত হ’তে আজ্ঞা দিলেন। বিরাট, তার ভ্রাতা শতানীক এবং জ্যেষ্ঠ রাজপুত্র শঙ্খ রত্নভূষিত অভেদ্য বর্ম পরে সজ্জিত হলেন। বিরাট বললেন, কঙ্ক বল্লভ তন্তিপাল ও গ্রন্থিক এঁরাও বীর্যবান এবং যুদ্ধ করতে সমর্থ, এঁদেরও অস্ত্রশস্ত্র কবচ আর রথ দাও। রাজার আজ্ঞানুসারে শতানীক যুধিষ্ঠিরাদিকে অস্ত্র রথ ইত্যাদি দিলেন, তারা আনন্দিত হয়ে মৎস্যরাজের বাহিনীর সঙ্গে যাত্রা করলেন। মধ্যাহ্ন অতীত হলে মৎস্যসেনার সঙ্গে ত্রিগর্তসেনার স্পর্শ হল।
দুই সৈন্যদলে তুমুল যুদ্ধ হ’তে লাগল। সুশর্মা ও বিরাট দ্বৈরথ যুদ্ধে নিযুক্ত হলেন। বহুক্ষণ যুদ্ধের পর সুশর্মা বিরাটকে পরাজিত করলেন এবং তাকে বন্দী করে নিজের রথে তুলে নিয়ে দ্রুতবেগে চললেন। মৎস্যসেনা ভয়ে পালাতে লাগল। তখন যুধিষ্ঠির ভীমকে বললেন, মহাবাহু, তুমি বিরাটকে শত্রুর হাত থেকে মুক্ত কর, আমরা তাঁর গৃহে সুখে সসম্মানে বাস করেছি, তার প্রতিদান আমাদের কর্তব্য। ভীম একটি বিশাল বৃক্ষ উৎপাটন করতে যাচ্ছেন দেখে যুধিষ্ঠির বললেন, তুমি বৃক্ষ নিয়ে যুদ্ধ ক’রো না, লোকে তোমাকে চিনে ফেলবে, তুমি ধনু খড়্গ পরশু প্রভৃতি সাধারণ অস্ত্র নাও।
পাণ্ডবগণ রথ নিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন দেখে বিরাটের সৈন্যরাও ফিরে এসে যুদ্ধ করতে লাগল। যুধিষ্ঠির ভীম নকুল সহদেব সকলেই বহুশত যোদ্ধাকে বিনষ্ট করলেন। তার পর যুধিষ্ঠির সুশর্মার প্রতি ধাবিত হলেন। ভীম সুশর্মার অশ্ব সারথি ও পৃষ্ঠরক্ষকদের বধ করলেন। বন্দী বিরাট সুশর্মার রথ থেকে লাফিয়ে নামলেন এবং সুশর্মার গদা কেড়ে নিয়ে তাকে আঘাত করলেন। বিরাট বৃদ্ধ হলেও গদাহস্তে যুবকের ন্যায় বিচরণ করতে লাগলেন। ভীম সুশর্মার কেশাকর্ষণ করে ভূমিতে ফেলে তার মস্তকে পদাঘাত করলেন, সুশৰ্মা মূৰ্ছিত হলেন। ত্রিগর্তসেনা ভয়ে পালাতে লাগল।
সুশর্মাকে বন্দী করে এবং গরু উদ্ধার করে পাণ্ডবরা বিরাটের কাছে গেলেন। ভীম ভাবলেন, এই পাপী সুশর্মা জীবনলাভের যোগ্য নয়, কিন্তু আমি কি করতে পারি, রাজা যুধিষ্ঠির সর্বদাই দয়াশীল। রথের উপরে অচেতনপ্রায় সুশৰ্মা বদ্ধ হয়ে ছটফট করছেন দেখে যুধিষ্ঠির সহাস্যে বললেন, নরাধমকে মুক্তি দাও। ভীম বললেন, মূঢ়, যদি বাঁচতে চাও তবে সর্বত্র বলবে-আমি বিরাট রাজার দাস। যুধিষ্ঠির বললেন, এ তো দাস হয়েছেই, দুরাত্মাকে এখন ছেড়ে দাও। সুশৰ্মা, তুমি অদাস হয়ে চ’লে যাও, এমন কার্য আর ক’রো না। সুশৰ্মা লজ্জায় অধোমুখ হয়ে নমস্কার করে চ’লে গেলেন।
পাণ্ডবগণ যুদ্ধস্থানের নিকটেই সেই রাত্রি যাপন করলেন। পরদিন বিরাট তাদের বললেন, বিজয়িগণ, আপনাদের আমি সালংকারা কন্যা, বহু ধন এবং আর যা চান তা দিচ্ছি, আপনাদের বিক্রমেই আমি মুক্ত হয়ে নিরাপদে আছি, আপনারাই এখন মৎস্যরাজ্যের অধীশ্বর। যুধিষ্ঠিরাদি কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, মহারাজ, আপনার বাক্যে আমরা আনন্দিত হয়েছি, আপনি যে মুক্তিলাভ করেছেন তাতেই আমরা সন্তুষ্ট। বিরাট পুনর্বার যুধিষ্ঠিরকে বললেন, আপনি আসুন, আপনাকে রাজপদে অভিষিক্ত করব। হে বৈয়াঘ্রপদ্য-গোত্রীয় ব্রাহ্মণ, আপনার জন্যই আমার রাজ্য ও প্রাণ রক্ষা পেয়েছে। যুধিষ্ঠির বললেন, মৎস্যরাজ, আপনার মনোজ্ঞ বাক্যে আমি আনন্দিত হয়েছি, আপনি অনিষ্ঠুর হয়ে প্রসন্নমনে প্রজাপালন করুন, আপনার বিজয়সংবাদ ঘোষণার জন্য সত্বর রাজধানীতে দূত পাঠান।
** (১) বিরাট রাজ্যের দক্ষিণে যে সব গরু ছিল তাদের গ্রহণ বা হরণ।
১২। উত্তরগোগ্রহ-উত্তর ও বৃহন্নলা
বিরাট যখন ত্রিগর্তসেনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে যান সেই সময়ে ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ প্রভৃতির সঙ্গে দুর্যোধন মৎস্যদেশে উপস্থিত হলেন এবং গোপালকদের তাড়িয়ে দিয়ে ষাট হাজার গরু হরণ (১) করলেন। গোপগণের অধ্যক্ষ রথে চড়ে দ্রুতবেগে – রাজধানীতে এল এবং বিরাটের পুত্র ভূমিঞ্জয় বা উত্তরকে সংবাদ দিয়ে বললে, রাজপুত্র, আপনি শীঘ্র এসে গোধন উদ্ধার করুন, মহারাজ আপনাকেই এই শূন্য রাজধানীর রক্ষক নিযুক্ত করে গেছেন।
উত্তর বললেন, যদি অশ্বচালনে দক্ষ কোনও সারথি পাই তবে এখনই ধনুর্বাণ নিয়ে যুদ্ধে যেতে পারি। আমার যে সারথি ছিল সে পূর্বে এক মহাযুদ্ধে নিহত হয়েছে। তুমি শীঘ্র একজন সারথি দেখ। উপযুক্ত অশ্বচালক পেলে আমি দুর্যোধন ভীষ্ম কর্ণ কৃপ দ্রোণ প্রভৃতিকে বিনষ্ট করে মুহূর্তমধ্যে গরু উদ্ধার করে আনব। আমি সেখানে ছিলাম না বলেই কৌরবরা গোধন হরণ করেছে। কৌরবরা আজ আমার বিক্রম দেখে ভাববে, স্বয়ং অর্জুন আমাদের আক্রমণ করলেন নাকি?
দ্রৌপদী উত্তরে মুখে বার বার এইরূপ কথা এবং অর্জুনের উল্লেখ সইতে পারলেন না। তিনি ধীরে ধীরে বললেন, রাজপুত্র, বৃহন্নলা পূর্বে অর্জুনের সারথি ও শিষ্য ছিলেন, তিনি অস্ত্রবিদ্যায় অর্জুনের চেয়ে কম নন। আপনার কনিষ্ঠা ভগিনী উত্তরা যদি বলেন তবে বৃহন্নলা নিশ্চয় আপনার সারথি হবেন। ভ্রাতার অনুরোধে উত্তরা তখনই নৃত্যশালায় গিয়ে অর্জুনকে সকল ঘটনা জানিয়ে বললেন, বৃহন্নলা, তুমি আমার ভ্রাতার সারথি হয়ে যাও, তোমার উপর আমার প্রীতি আছে সেজন্য একথা বলছি, যদি না শোন তবে আমি জীবন ত্যাগ করব। অর্জুন উত্তরের কাছে গিয়ে বললেন, যুদ্ধস্থানে সারথ্য করতে পারি এমন কি শক্তি আমার আছে? আমি কেবল নৃত্য-গীত-বাদ্য জানি। উত্তর বললেন, তুমি গায়ক বাদক নর্তক যাই হও, শীঘ্র আমার রথে উঠে অশ্বচালনা কর।
অর্জুন তখন উত্তরার সম্মুখে অনেক প্রকার কৌতুকজনক কর্ম করলেন। তিনি উলটো করে কবচ পরতে গেলেন, তা দেখে কুমারীরা হেসে উঠল। তখন উত্তর স্বয়ং তাঁকে মহামূল্য কবচ পরিয়ে দিলেন। যাত্রাকালে উত্তরা ও তার সখীরা বললেন, বৃহন্নলা, তুমি ভীষ্ম-দ্রোণাদিকে জয় করে আমাদের পুত্তলিকার জন্য বিচিত্র সূক্ষ্ম কোমল বস্ত্র এনো। অর্জুন সহাস্যে বললেন, উত্তর যদি জয়ী হন তবে নিশ্চয় সুন্দর সুন্দর বস্ত্র আনব।
অর্জুন বায়ুবেগে রথ চালালেন। কিছুদূর গিয়ে শ্মশানের নিকটে এসে উত্তর দেখতে পেলেন, বহুবৃক্ষসমন্বিত বনের ন্যায় বিশাল কৌরবসৈন্য ব্যূহ রচনা করে রয়েছে, সাগরগর্জনের ন্যায় তাদের শব্দ হচ্ছে। ভয়ে রোমাঞ্চিত ও উদবিগ্ন হয়ে উত্তর বললেন, আমি কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধ করব না, ওদের মধ্যে অনেক মহাবীর আছেন। যাঁরা দেবগণেরও অজেয়। আমার পিতা সমস্ত সৈন্য নিয়ে গেছেন, আমার সৈন্য নেই, আমি বালক, যুদ্ধে অনভিজ্ঞ। বৃহন্নলা, তুমি ফিরে চল।
অর্জুন বললেন, রাজপুত্র, তুমি যাত্রা করবার সময় স্ত্রী আর পুরুষদের কাছে। অনেক গর্ব করেছিলে, এখন পশ্চাৎপদ হচ্ছ কেন? তুমি যদি অপহৃত গোধন উদ্ধার করে ফিরে যাও তবে সকলেই উপহাস করবে। সৈরিন্ধী আমার সারথ্য কর্মের প্রশংসা করেছেন, আমি কৃতকার্য না হয়ে ফিরব না। উত্তর বললেন, কৌরবরা সংখ্যায় অনেক, তারা আমাদের ধন হরণ করুক, স্ত্রীপুরুষেও আমাকে উপহাস করুক। এই বলে উত্তর রথ লাফিয়ে নামলেন এবং মান দর্প ও ধনুর্বাণ ত্যাগ করে বেগে পালালেন। অর্জুন তাকে ধরবার জন্য পিছনে ছুটলেন।
রক্তবর্ণ বস্ত্র পরে দীর্ঘ বেণী দুলিয়ে অর্জুনকে ছুটতে দেখে কয়েকজন সৈনিক হাসতে লাগল। কৌরবগণ বললেন, ভস্মাচ্ছাদিত অগ্নির ন্যায় এই লোকটি কে? এর রূপ কতকটা পুরুষের কতকটা স্ত্রীর মত। এর মস্তক গ্রীবা বাহু ও গতি অর্জুনের তুল্য। বোধ হয় বিরাটের পুত্র আমাদের দেখে ভয়ে পালাচ্ছে আর অর্জুন তাকে ধরতে যাচ্ছেন।
অর্জুন একশ পা গিয়ে উত্তরের চুল ধরলেন। উত্তর কাতর হয়ে বললেন, কল্যাণী সুমধ্যমা বৃহন্নলা, তুমি কথা শোন, রথ ফেরাও, বেঁচে থাকলেই মানুষের মঙ্গল হয়। আমি তোমাকে শত স্বর্ণমুদ্রা, স্বর্ণে গ্রথিত আটটি বৈদুর্য মণি, স্বর্ণধ্বজযুক্ত অশ্বসমেত একটি রথ এবং দশটি মত্ত মাতঙ্গ দেব, তুমি আমাকে ছেড়ে দাও। অর্জুন সহাস্যে উত্তরকে রথের কাছে টেনে এনে বললেন, তুমি যদি না পার তবে আমিই যুদ্ধ করব, তুমি আমার সারথি হও। ভয়ার্ত উত্তর নিতান্ত অনিচ্ছার রথে উঠলেন এবং অর্জুনের নির্দেশে শমীবৃক্ষের দিকে রথ নিয়ে চললেন।
কৌরবপক্ষীয় বীরগণকে দ্রোণাচার্য বললেন, নানাপ্রকার দুর্লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, বায়ু বালুকাবর্ষণ করছে, আকাশ ভস্মের ন্যায় অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়েছে, অস্ত্রসকল কোষ থেকে স্থলিত হচ্ছে। তোমরা ব্যহিত হয়ে আত্মরক্ষা কর, গোধন রক্ষা কর, মহাধনুর্ধর পার্থই ক্লীববেশে আসছেন তাতে সন্দেহ নেই।
কর্ণ বললেন, আপনি সর্বদা অর্জুনের প্রশংসা আর আমাদের নিন্দা করেন, অর্জুনের শক্তি আমার বা দুর্যোধনের ষোল ভাগের এক ভাগও নয়। দুর্যোধন বললেন, ওই লোক যদি অর্জুন হয় তবে আমাদের কার্য সিদ্ধ হয়েছে, আমরা জানতে পেরেছি। সেজন্য পাণ্ডবদের আবার দ্বাদশ বৎসর বনে যেতে হবে। আর যদি অন্য কেউ হয় তবে তীক্ষ্ম শরে ওকে ভূপাতিত করব।
শমীবৃক্ষের কাছে এসে অর্জুন উত্তরকে বললেন, তুমি শীঘ্র এই বৃক্ষে উঠে পাণ্ডবদের ধনু শর ধ্বজ ও কবচ নামিয়ে আন। তোমার ধনু আমার আকর্ষণ সইতে পারবে না, শত্রুর হস্তী বিনষ্ট করতেও পারবে না। উত্তর বললেন, শুনেছি এই বৃক্ষে একটা মৃতদেহ বাঁধা আছে, আমি রাজপুত্র হয়ে কি করে তা ছোঁব? অর্জুন বললেন, ভয় পেয়ো না, ওখানে মৃতদেহ নেই, যা আছে তা ধনু প্রভৃতি অস্ত্র, তুমি স্পর্শ করলে পবিত্র হবে। তোমাকে দিয়ে আমি নিন্দিত কর্ম করাব কেন? অর্জুনের আজ্ঞানুসারে উত্তর শমীবৃক্ষ থেকে অস্ত্রসমূহ নামিয়ে এনে বন্ধন খুলে ফেললেন এবং সূর্যতুল্য দীপ্তিমান সর্পাকৃতি ধনুসকল দেখে ভয়ে রোমাঞ্চিত হলেন। তার প্রশ্নের উত্তরে অর্জুন বললেন, এই শতস্বর্ণবিন্দুযুক্ত সহস্ৰগোধাচিহ্নিত ধনু অর্জুনের, এরই নাম গাণ্ডীব, খাণ্ডবদাহকালে বরুণের নিকট অর্জুন এই ধনু পেয়েছিলেন। এই ধনু, যার ধারণাস্থান স্বর্ণময়, ভীমের; ইন্দ্রগোপচিহ্নিত এই ধনু যুধিষ্ঠিরের; সুবর্ণসূর্যচিহ্নিত এই ধনু নকুলের; স্বর্ণময় পতঙ্গচিহ্নিত এই ধনু সহদেবের। তাদের বাণ তূণীর খড়্গ প্রভৃতিও এই সঙ্গে আছে।
উত্তর বললেন, মহাত্মা পাণ্ডবগণের অস্ত্রসকল এখানে রয়েছে, কিন্তু তারা কোথায় ? দ্রৌপদীই বা কোথায় ? অর্জুন বললেন, আমি পার্থ, সভাসদ কঙ্কই যুধিষ্ঠির, পাচক বল্লভ ভীম, অশ্বশালা আর গোশালার অধ্যক্ষ নকুল-সহদেব। সৈরিন্ধ্রীই দ্রৌপদী, যার জন্য কীচক মরেছে। উত্তর বললেন, আমি অর্জুনের দশটি নাম শুনেছি, যদি বলতে পারেন তবে আপনার সব কথা বিশ্বাস করব। অর্জুন বললেন, আমার দশ নাম বলছি শোন।
-আমি সর্বদেশ জয় করে ধন আহরণ করি সেজন্য আমি ধনঞ্জয়। যুদ্ধে শত্রুদের জয় না করে ফিরি না সেজন্য আমি বিজয়। আমার রথে রজতশুভ্র অশ্ব থাকে সেজন্য আমি শ্বেতবাহন। হিমালয়পৃষ্ঠে উত্তর ও পূর্ব ফগুনী নক্ষত্রের যোগে আমার জন্ম সেজন্য আমি ফাগুন। দানবদের সঙ্গে যুদ্ধকালে ইন্দ্র আমাকে সূর্যপ্রভ কিরীট দিয়েছিলেন, সেজন্য আমি কিরীটী। যুদ্ধকালে বীভৎস কর্ম করি না সেজন্য আমার বীভৎসু নাম। বাম ও দক্ষিণ উভয় হস্তেই আমি গাণ্ডীব আকর্ষণ করতে পারি সেজন্য সব্যসাচী নাম। আমার শুভ্র (নিষ্কলঙ্ক) যশ চতুঃসমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত, আমার সকল কর্মও শুভ্র, এজন্য অর্জুন (শুভ্র) নাম। আমি শত্রুবিজয়ী এজন্য জিষ্ণু নাম। সুন্দর কৃষ্ণবর্ণ বালক সকলের প্রিয়, এজন্য পিতা আমার কৃষ্ণ নাম রেখেছিলেন।
অর্জুনকে অভিবাদন করে উত্তর বললেন, মহাবাৎ, ভাগ্যক্রমে আপনার দর্শন পেয়েছি, আমি না জেনে যা বলেছি তা ক্ষমা করুন। আমার ভয় দূর হয়েছে, আপনি রথে উঠুন, যেদিকে বলবেন সেদিকে নিয়ে যাব। কোন্ কর্মের ফলে আপনি ক্লীবত্ব পেয়েছেন? অর্জুন বললেন, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার আদেশে আমি এক বৎসর ব্রহ্মচর্য ব্রত পালন করছি, আমি ক্লীব নই। এখন আমার ব্রত সমাপ্ত হয়েছে। অর্জুন তার বাহু থেকে বলয় খুলে ফেলে করতলে স্বর্ণখচিত বর্ম পরলেন এবং শুভ্র বস্ত্রে কেশ বন্ধন করলেন। তার পর তিনি পূর্বমুখ হয়ে সংযতচিত্তে তার অস্ত্রসমূহকে স্মরণ করলেন। তারা কৃতাঞ্জলি হয়ে বললে, ইন্দ্রপুত্র, কিংকরগণ উপস্থিত। অর্জুন তাদের নমস্কার ও স্পর্শ করে বললেন, স্মরণ করলেই তোমরা এস।
গাণ্ডীব ধনুতে গুণ পরিয়ে অর্জুন সবলে আকর্ষণ করলেন। সেই বজ্রনাদতুল্য টংকার শুনে কৌরবগণ বুঝলেন যে, অর্জুনেরই এই জ্যানির্ঘোষ।
**
(১) এই গোহরণ বা গোগ্রহ বিরাট রাজ্যের উত্তরে হয়েছিল।
১৩। দ্রোণ-দুর্যোধনাদির বিতর্কভীষ্মের উপদেশ
উত্তরের রথে যে সিংহধ্বজ ছিল তা নামিয়ে ফেলে অর্জুন বিশ্বকর্মা-নির্মিত দৈবী মায়া ও কাঞ্চনময় ধ্বজ বসালেন, যার উপরে সিংহলাঙ্গুল বানর ছিল। অগ্নিদেবের আদেশে কয়েকজন ভূতও সেই ধ্বজে অধিষ্ঠিত হল। তার পর শমীবৃক্ষ প্রদক্ষিণ করে অর্জুন রথারোহণে উত্তর দিকে অগ্রসর হলেন। তার মহাশঙ্খের শব্দ শুনে রথের অশ্বসকল নতজানু হয়ে বসে পড়ল, উত্তরও সন্ত্রস্ত হলেন। অর্জুন রশ্মি টেনে অশ্বদের ওঠালেন এবং উত্তরকে আলিঙ্গন করে আশ্বস্ত করলেন। এ অর্জুনের রথের শব্দ শুনে এবং নানাপ্রকার দুর্লক্ষণ দেখে দ্রোণ বললেন, দুর্যোধন, আজ তোমার সৈন্যদল অর্জুনের বাণে প্রপ্রীড়িত হবে, তারা যেন এখনই পরাভূত হয়েছে, কেউ যুদ্ধ করতে ইচ্ছা করছে না, বহু যোদ্ধার মুখ বিবর্ণ দেখছি। তুমি গুরুগুলিকে নিজ রাজ্যে পাঠিয়ে দাও, আমরা ব্যূহ রচনা করে যুদ্ধের জন্য অপেক্ষা করি।
দুর্যোধন বললেন, দূতসভায় এই পণ ছিল যে পরাজিত পক্ষ বার বৎসর বনবাস এবং এক বৎসর অজ্ঞাতবাস করবে। এখনও তের বৎসর পূর্ণ হয়নি অথচ অর্জুন উপস্থিত হয়েছে, অতএব পাণ্ডবদের আবার বার বৎসর বনবাস করতে হবে। হয়তো লোভের বশে পাণ্ডবরা তাদের ভ্রম বুঝতে পারেনি। অজ্ঞাতবাসের কিছুদিন এখনও অবশিষ্ট আছে কিনা অথবা পুর্ণকাল অতিক্রান্ত হয়েছে কিনা তা পিতামহ ভীষ্ম বলতে পারেন। ত্রিগর্ত সেনা সপ্তমীর দিন অপরাহ্মে গোধন হরণ করবে এই স্থির ছিল। হয়তো তারা তা করেছে, অথবা পরাজিত হয়ে বিরাটের সঙ্গে সন্ধি করেছে। যে লোক আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে আসছে সে বোধ হয় বিরাটের কোনও যোদ্ধা কিংবা স্বয়ং বিরাট। বিরাট বা অর্জুন যিনিই আসুন, আমরা যুদ্ধ করব। আচার্য দ্রোণ আমাদের সৈন্যের পশ্চাতে থাকুন, ইনি আমাদের ভয় দেখাচ্ছেন আর অর্জুনের প্রশংসা করছেন। আচার্যরা দয়ালু হন, সর্বদাই বিপদের আশঙ্কা করেন। এঁরা রাজভবনে আর যজ্ঞসভাতেই শোভা পান, লোকসভায় বিচিত্র কথা বলতে পারেন; পরের ছিদ্র অন্বেষণে, মানুষের চরিত্র বিচারে এবং খাদ্যের দোষগুণ নির্ণয়ে এঁরা নিপুণ। এই পণ্ডিতদের পশ্চাতে রেখে আপনারা শত্রুবধের উপায় স্থির করুন।
কর্ণ বললেন, মৎস্যরাজ বা অর্জুন যিনিই আসুন আমি শরাঘাতে নিরস্ত করব। জামদগ্ন্য পরশুরামের কাছে যে অস্ত্র পেয়েছি তার দ্বারা এবং নিজের বলে আমি ইন্দ্রের সঙ্গেও যুদ্ধ করতে পারি। অর্জুনের ধ্বজস্থিত বানর আজ আমার ভল্লের আঘাতে নিহত হবে, ভূতগণ আর্তনাদ করে পালাবে। আজ অর্জুনকে রথ থেকে নিপাতিত করে আমি দুর্যোধনের হৃদয়ের শল্য সমূলে উৎপাটিত করব।
কৃপ বললেন, রাধেয়, তুমি নিষ্ঠুরপ্রকৃতি, সর্বদাই যুদ্ধ করতে চাও, তার ফল কি হবে তা ভাব না। শাস্ত্রে অনেক প্রকার নীতির উল্লেখ আছে, তার মধ্যে যুদ্ধকেই প্রাচীন পণ্ডিতগণ সর্বাপেক্ষা পাপজনক বলেছেন। দেশ কাল যদি অনুকূল হয় তবেই বিক্রমপ্রকাশ বিধেয়। অর্জুনের সঙ্গে এখন আমাদের যুদ্ধ করা উচিত নয়। কর্ণ, অর্জুন যেসকল কর্ম করেছেন তার তুল্য তুমি কি করেছ? আমরা প্রতারণা করে তাকে তের বৎসর নির্বাসনে রেখেছি, সেই সিংহ এখন পাশমুক্ত হয়েছে, সে কি আমাদের শেষ করবে না? আমরা সকলে মিলিত হয়ে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত আছি, কিন্তু কর্ণ, তুমি একাকী সাহস ক’রো না।
অশ্বত্থামা বললেন, কর্ণ, আমরা গোহরণ করে এখনও মৎস্যরাজের সীমা পার হইনি, হস্তিনাপুরেও যাইনি, অথচ তুমি গর্বপ্রকাশ করছ। তোমার প্ররোচনায় দুর্যোধন পাণ্ডবদের সম্পত্তি হরণ করেছে, কিন্তু তুমি কি কখনও দ্বৈরথ-যুদ্ধে তাদের একজনকেও জয় করেছ? কোন্ যুদ্ধে তুমি কৃষ্ণাকে জয় করেছ-তোমার প্ররোচনায় যাঁকে একবস্ত্রে রজস্বলা অবস্থায় সভায় আনা হয়েছিল? মানুষ এবং কীট-পিপীলিকাদি পর্যন্ত সকল প্রাণীই যথাশক্তি ক্ষমা করে, কিন্তু দ্রৌপদীকে যে কষ্ট দেওয়া হয়েছে তার ক্ষমা পাণ্ডবগণ কখনই করবেন না। ধর্মজ্ঞরা বলেন, শিষ্য পুত্রের চেয়ে কম নয়, এই কারণেই অর্জুন আমার পিতা দ্রোণের প্রিয়। দুর্যোধন, তোমার জন্যই দ্যূতক্রীড়া হয়েছিল, তুমিই দ্রৌপদীকে সভায় আনিয়েছিলে, ইন্দ্রপ্রস্থরাজ্য তুমিই হরণ করেছ, এখন তুমিই অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ কর। তোমার মাতুল ক্ষত্রধর্মবিশারদ দুষ্টদ্যুতকার এই শকুনিও যুদ্ধ করুন। কিন্তু জেনো, অর্জুনের গাণ্ডীব অক্ষক্ষেপণ করে না, তীক্ষ্ম নিশিত বাণই ক্ষেপণ করে, আর সেইসকল বাণ মধ্যপথে থেমে যায় না। আচার্য (দ্রোণ) যদি ইচ্ছা করেন তো যুদ্ধ করুন, আমি ধনঞ্জয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করব না। যদি মৎস্যরাজ এখানে আসতেন তবে তার সঙ্গে আমি যুদ্ধ করতাম।
ভীষ্ম বললেন, আচার্যপুত্র (অশ্বত্থামা), কর্ণ যা বলেছেন, তার উদ্দেশ্য তোমাকে যুদ্ধে উত্তেজিত করা। তুমি ক্ষমা কর, এ সময়ে নিজেদের মধ্যে ভেদ হওয়া ভাল নয়, আমাদের মিলিত হয়েই যুদ্ধ করতে হবে।
অশ্বত্থামা বললেন, গুরুদেব (দ্রোণ) কারও উপর আক্রোশের বশে অর্জুনের প্রশংসা করেন নি,
শত্রোরপি গুণা বাচ্যা দোষা বাচ্যা গুরোরপি।
সর্বথা সর্বযত্নেন পুত্রে শিষ্যে হিতং বদেৎ
-শত্রুরও গুণ বলা উচিত, গুরুরও দোষ বলা উচিত, সর্বপ্রকারে সর্বপ্রযত্নে পুত্র ও শিষ্যকে হিতবাক্য বলা উচিত।
দুর্যোধন দ্রোণাচার্যের নিকট ক্ষমা চাইলেন। কর্ণ ভীষ্ম ও কৃপের অনুরোধে দ্রোণ প্রসন্ন হয়ে বললেন, অজ্ঞাতবাস শেষ না হলে অর্জুন আমাদের দর্শন দিতেন না। আজ গোধন উদ্ধার না করে তিনি নিবৃত্ত হবেন না। আপনারা এমন মন্ত্রণা দিন যাতে দুর্যোধনের অযশ না হয় কিংবা ইনি পরাজিত না হন।
জ্যোতিষ গণনা করে ভীষ্ম বললেন, তের বৎসর পূর্ণ হয়েছে এবং তা নিশ্চিতভাবে জেনেই অর্জুন এসেছেন। পাণ্ডবগণ ধর্মজ্ঞ, তারা লোভী নন, অন্যায় উপায়ে তারা রাজ্যলাভ করতে চান না। দুর্যোধন, যুদ্ধে একান্তসিদ্ধি হয় এমন আমি কদাপি দেখিনি, এক পক্ষের জীবন বা মৃত্যু, জয় বা পরাজয় অবশ্যই হয়। অর্জুন এসে পড়লেন, এখন যুদ্ধ করবে কিংবা ধর্মসম্মত কার্য করবে তা সত্বর স্থির কর।
দুর্যোধন বললেন, পিতামহ, আমি পাণ্ডবদের রাজ্য ফিরিয়ে দেব না, অতএব যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন। ভীষ্ম বললেন, তা হলে আমি যা ভাল মনে করি তা বলছি শোন।-তুমি সৈন্যের এক-চতুর্থ ভাগ নিয়ে হস্তিনাপুরে যাও, আর এক-চতুর্থাংশ গরু নিয়ে চ’লে যাক। অবশিষ্ট অর্থ ভাগ সৈন্য নিয়ে আমরা অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করব।
দুর্যোধন একদল সৈন্য নিয়ে যাত্রা করলেন, গরু নিয়ে আর একদল সৈন্য গেল। তারপর দ্রোণ অশ্বত্থামা কৃপ কর্ণ ও ভীষ্ম ব্যূহ রচনা করে যথাক্রমে সেনার মধ্যভাগে, বাম পার্শ্বে, দক্ষিণ পার্শ্বে, সম্মুখে ও পশ্চাতে অবস্থান করলেন।
১৪। কৌরবগণের পরাজয়
দ্রোণ বললেন, অর্জুনের ধ্বজাগ্র দূর থেকে দেখা যাচ্ছে, তাঁর শঙ্খধ্বনির সঙ্গে ধ্বজস্থিত বানরও ঘোর গর্জন করছে। অর্জুন তাঁর গাণ্ডীব আকর্ষণ করছেন; এই তার দুই বাণ এসে আমার চরণে পড়ল, এই আর দুই বাণ আমার কর্ণ স্পর্শ করে চ’লে গেল। তিনি দুই বাণ দিয়ে আমাকে প্রণাম করলেন, আর দুই বাণে। আমাকে কুশলপ্রশ্ন করলেন।
অর্জুন দেখলেন, দ্রোণ ভীষ্ম কর্ণ প্রভৃতি রয়েছেন কিন্তু দুর্যোধন নেই। তিনি উত্তরকে বললেন, এই সৈন্যদল এখন থাকুক, আগে দুর্যোধনের সঙ্গে যুদ্ধ করব। নিরামিষ (১) যুদ্ধ হয় না, আমরা দুর্যোধনকে জয় করে গোধন উদ্ধার করে আবার এদিকে আসব।
অর্জুনকে অন্যদিকে যেতে, দেখে দ্রোণ বললেন, উনি দুর্যোধন ভিন্ন অন্য কাকেও চান না, চল, আমরা পশ্চাতে গিয়ে ওঁকে ধরব।
পতঙ্গপালের ন্যায় শরজালে অর্জুন কুরুসৈন্য আচ্ছন্ন করলেন। তার শঙ্খের শব্দে, রথচক্রের ঘর্ঘর রবে, গাণ্ডীবের টংকারে, এবং ধ্বজস্থিত অমানুষ ভূতগণের গর্জনে পৃথিবী কম্পিত হল। অপহৃত গুরুর দল ঊর্ধ্বপুচ্ছ হয়ে হম্বারবে মৎস্যরাজ্যের দক্ষিণ দিকে ফিরতে লাগল। গোধন জয় করে অর্জুন দুর্যোধনের অভিমুখে যাচ্ছিলেন এমন সময় কুরুপক্ষীয় অন্যান্য বীরগণকে দেখে তিনি উত্তরকে বললেন, কর্ণের কাছে রথ নিয়ে চল।
দুর্যোধনের ভ্রাতা বিকর্ণ এবং আরও কয়েকজন যোদ্ধা কর্ণকে রক্ষা করতে এলেন, কিন্তু অর্জুনের শরে বিধ্বস্ত হয়ে পালিয়ে গেলেন। কর্ণের ভ্রাতা সংগ্রামজিৎ নিহত হলেন, কর্ণও অর্জুনের বজ্রতুল্য বাণে নিপীড়িত হয়ে যুদ্ধের সম্মুখ ভাগ থেকে প্রস্থান করলেন।
ইন্দ্রাদি তেত্রিশ দেবতা এবং পিতৃগণ মহর্ষিগণ গন্ধর্বগণ প্রভৃতি বিমানে করে যুদ্ধ দেখতে এলেন। তাদের আগমনে যুদ্ধভূমির ধূলি দূর হল , দিব্যগন্ধ বায়ু বইতে লাগল। অর্জুনের আদেশে উত্তর কৃপাচার্যের কাছে রথ নিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর কৃপাচার্যের রথের চার অশ্ব অর্জুনের শরে বিদ্ধ হয়ে লাফিয়ে উঠল, কৃপ পড়ে গেলেন। তার গৌরব রক্ষার জন্য অর্জুন আর শরাঘাত করলেন না; কিন্তু কৃপ আবার উঠে অর্জুনকে দশ বাণে বিদ্ধ করলেন, অর্জুনও কৃপের কবচ ধনু রথ ও অশ্ব বিনষ্ট করলেন, তখন অন্য যোদ্ধারা কৃপকে নিয়ে বেগে প্রস্থান করলেন।
দ্রোণাচার্যের সম্মুখীন হয়ে অর্জুন অভিবাদন করে স্মিতমুখে সবিনয়ে বললেন,আমরা বনবাস সমাপ্ত করে শত্রুর উপর প্রতিশোধ নিতে এসেছি, আপনি আমাদের উপর ক্রুদ্ধ হ’তে পারেন না। আপনি যদি আগে আমাকে প্রহার করেন তবেই আমি প্রহার করব। দ্রোণ অর্জুনের প্রতি অনেকগুলি বাণ নিক্ষেপ করলেন। তখন দুজনে প্রবল যুদ্ধ হ’তে লাগল, অর্জুনের বাণবর্ষণে দ্রোণ আচ্ছন্ন হলেন। অশ্বত্থামা বাধা দিতে এলেন। তিনি মনে মনে অর্জুনের প্রশংসা করলেন কিন্তু ক্রুদ্ধও হলেন। অর্জুন অশ্বত্থামার দিকে অগ্রসর হয়ে দ্রোণকে সরে যাবার পথ দিলেন, দ্রোণ বিক্ষতদেহে বেগে প্রস্থান করলেন।
অর্জুনের সঙ্গে কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর অশ্বত্থামার বাণ নিঃশেষ হয়ে গেল, তখন অর্জুন কর্ণের দিকে ধাবিত হলেন। দুজনে বহুক্ষণ যুদ্ধের পর অর্জুনের শরে কর্ণের বক্ষ বিদ্ধ হল , তিনি বেদনায় কাতর হয়ে উত্তর দিকে পলায়ন করলেন।
তারপর অর্জুন উত্তরকে বললেন, তুমি ওই হিরন্ময় ধ্বজের নিকট রথ নিয়ে চল, ওখানে পিতামহ ভীষ্ম আমার প্রতীক্ষা করছেন। উত্তর বললেন, আমি বিহ্বল হয়েছি, আপনাদের অস্ত্রক্ষেপণ দেখে আমার বোধ হচ্ছে যেন দশ দিক ঘুরছে, বসা রুধির আর মেদের গন্ধে আমার মূৰ্ছা আসছে, ভয়ে হৃদয় বিদীর্ণ হচ্ছে, আমার আর কশা ও বগা ধরবার শক্তি নেই। অর্জুন বললেন, ভয় পেয়ো না, স্থির হও, তুমিও এই যুদ্ধে অদ্ভুত কর্মকৌশল দেখিয়েছ। ধীর হয়ে অশ্বচালনা কর, ভীষ্মের নিকটে আমাকে নিয়ে চল, আজ তোমাকে আমার বিচিত্র অস্ত্রশিক্ষা দেখাব। উত্তর আশ্বস্ত হয়ে ভীষ্মরক্ষিত সৈন্যের মধ্যে রথ নিয়ে গেলেন।
ভীষ্ম ও অর্জুন পরস্পরের প্রতি প্রজাপত্য ইন্দ্র আগ্নেয় বারুণ বায়ব্য প্রভৃতি দারুণ অস্ত্র নিক্ষেপ করতে লাগলেন। পরিশেষে ভীষ্ম শরাঘাতে অচেতনপ্রায় হলেন, তার সারথি তাঁকে যুদ্ধভূমি থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল। তার পর দুর্যোধন রথারোহণে এসে অর্জুনকে আক্রমণ করলেন। তিনি বহুক্ষণ যুদ্ধের পর বাণবিদ্ধ হয়ে রুধির বমন করতে করতে পলায়ন করলেন। অর্জুন তাঁকে বললেন, কীর্তি ও বিপুল যশ পরিত্যাগ করে চ’লে যাচ্ছ কেন? তোমার দুর্যোধন নাম আজ মিথ্যা হল, তুমি যুদ্ধ ত্যাগ করে পালাচ্ছ।
অর্জুনের তীক্ষ্ম বাক্য শুনে দুর্যোধন ফিরে এলেন। ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ প্রভৃতিও তাঁকে রক্ষা করতে এলেন এবং অর্জুনকে বেষ্টন করে সর্বদিক থেকে শরবণ করতে লাগলেন। তখন অর্জুন ইন্দ্রদত্ত সম্মােহন অস্ত্র প্রয়োগ করলেন, কুরুপক্ষের সকলের সংজ্ঞা লুপ্ত হল। উত্তরার অনুরোধ স্মরণ করে অর্জুন বললেন, উত্তর, তুমি রথ থেকে নেমে দ্রোণ আর কৃপের শুক্ল বস্ত্র, কর্ণের পীত বস্ত্র, এবং অশ্বত্থামা ও দুর্যোধনের নীল বস্ত্র খুলে নিয়ে এস। ভীষ্ম বোধ হয় সংজ্ঞাহীন হননি, রণ তিনি। আমার অস্ত্র প্রতিষেধের উপায় জানেন, তুমি তার নাম বাম দিক দিয়ে যাও। দ্রোণ প্রভৃতির বস্ত্র নিয়ে এসে উত্তর পুনর্বার রথে উঠলেন এবং অর্জুনকে নিয়ে রণভূমি থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন।
অর্জুনকে যেতে দেখে ভীষ্ম তাকে শরাঘাত করলেন, অর্জুন ভীষ্মের অশ্বসকল বধ করে তার পার্শ্বদেশ দশ বাণে বিদ্ধ করলেন। দুর্যোধন সংজ্ঞালাভ করে বললেন, পিতামহ, অর্জুনকে অস্ত্রাঘাত করুন, যেন ও চ’লে যেতে না পারে। ভীষ্ম হেসে বললেন, তোমার বুদ্ধি আর বিক্রম এতক্ষণ কোথায় ছিল? তুমি যখন ধনুর্বাণ ত্যাগ করে নিস্পন্দ হয়ে পড়ে ছিলে তখন অর্জুন কোনও নৃশংস কর্ম করেননি, তিনি ত্রিলোকের রাজ্যের জন্যও স্বধর্ম ত্যাগ করেন না, তাই তোমরা সকলে এই যুদ্ধে নিহত হও নি। এখন তুমি নিজের দেশে ফিরে যাও, অর্জুনও গরু নিয়ে প্রস্থান করুন। দুর্যোধন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে যুদ্ধের ইচ্ছা ত্যাগ করে নীরব হলেন, অন্যান্য সকলেই ভীষ্মের বাক্য অনুমোদন করে দুর্যোধনকে নিয়ে ফিরে যাবার ইচ্ছা করলেন।
কুরুবীরগণ চ’লে যাচ্ছেন দেখে অর্জুন প্রীত হলেন এবং গুরুজনদের মিষ্টবাক্যে সম্মান জানিয়ে কিছুদুর অনুগমন করলেন। তিনি পিতামহ ভীষ্ম ও দ্রোণাচার্যকে আনতমস্তকে প্রণাম জানালেন, অশ্বত্থামা কৃপ ও মান্য কৌরবগণকে বিচিত্র বাণ দিয়ে অভিবাদন করলেন, এবং শরাঘাতে দুর্যোধনের রত্নভূষিত মুকুট ছেদন করলেন। তার পর অর্জুন উত্তরকে বললেন, রথের অশ্ব ঘুরিয়ে নাও, তোমার গোধনের উদ্ধার হয়েছে, এখন আনন্দে রাজধানীতে ফিরে চল।
** (১) যে যুদ্ধে লোভ্য বা আকাঙ্ক্ষিত বস্তু নেই।
১৫। অর্জুন ও উত্তরের প্রত্যাবর্তন-বিরাটের পুত্রগর্ব
যেসকল কৌরবসৈন্য পালিয়ে গিয়ে বনে লুকিয়েছিল তারা ক্ষুধাতৃষ্ণায় কাতর হয়ে কম্পিতদেহে অর্জুনকে প্রণাম করে বললে, পার্থ, আমরা এখন কি করব? অর্জুন তাদের আশ্বাস দিয়ে বললেন, তোমাদের মঙ্গল হ’ক, তোমরা নির্ভয়ে প্রস্থান কর। তারা অর্জুনের আয়ু কীর্তি ও যশ বৃদ্ধির আশীর্বাদ করে চ’লে গেল।
অর্জুন উত্তরকে বললেন, বৎস, তুমি রাজধানীতে গিয়ে তোমার পিতার নিকট এখন আমাদের পরিচয় দিও না, তা হলে তিনি ভয়ে প্রাণত্যাগ করবেন। তুমি নিজেই যুদ্ধ করে কৌরবদের পরাস্ত করেছ এবং গোধন উদ্ধার করেছ এই কথা ! বলো। উত্তর বললেন, সব্যসাচী, আপনি যা করেছেন তা আর কেউ পারে না, আমার তো সে শক্তি নেইই। তথাপি আপনি আদেশ না দিলে আমি পিতাকে প্রকৃত ঘটনা জানাব না।
অর্জুন বিক্ষতদেহে শ্মশানে শমীবৃক্ষের নিকটে এলেন। তখন তার ধ্বজস্থিত মহাকপি ও ভূতগণ আকাশে চ’লে গেল, দৈবী মায়াও অন্তর্হিত হল। উত্তর রথের উপরে পূর্বের ন্যায় সিংহধ্বজ বসিয়ে দিলেন এবং পাণ্ডবগণের অস্ত্রাদি শমীবৃক্ষে রেখে রথ চালালেন। নগরের পথে এসে অর্জুন বললেন, রাজপুত্র, খ, গোপালকগণ তোমাদের সমস্ত গরু ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা এখানে অশ্বদের স্নান করিয়ে জল খাইয়ে বিশ্রামের পর অপরাহ্নে বিরাটনগরে যাব। তুমি কয়েকজন গোপকে বলে দাও তারা শীঘ্র নগরে গিয়ে তোমার জয় ঘোষণা করুক। অর্জুন আবার বৃহন্নলার বেশ ধারণ করলেন এবং অপরাহ্নে বিরাটনগরে যাব। তুমি কয়েকজন গোপকে বলে দাও তারা শীঘ্র নগরে গিয়ে তোমার জয় ঘোষণা করুক। অর্জুন আবার বৃহন্নলার বেশ ধারণ করলেন এবং অপরাহ্নে উত্তরের সারথি হয়ে নগরে যাত্রা করলেন।
ওদিকে বিরাট রাজা ত্রিগর্তদের পরাজিত করে চার জন পাণ্ডবের সঙ্গে রাজধানীতে ফিরে এলেন। তিনি শুনলেন, কৌরবরা রাজ্যের উত্তর দিকে এসে গোধন হরণ করেছে, রাজকুমার উত্তর বৃহন্নলাকে সঙ্গে নিয়ে ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ কর্ণ দুর্যোধন ও অশ্বত্থামার সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেছেন। বিরাট অত্যন্ত উদবিগ্ন হয়ে তাঁর সৈন্যদলকে বললেন, তোমরা শীঘ্র গিয়ে দেখ কুমার জীবিত আছেন কিনা; নপুংসক যার সারথি তার বাঁচা অসম্ভব মনে করি। যুধিষ্ঠির সহাস্যে বললেন, মহারাজ, বৃহন্নলা যদি সারথি হয় তবে শত্রুরা আপনার গোধন নিতে পারবে না, তার সাহায্যে আপনার পুত্র কৌরবগণকে এবং দেবাসুর প্রভৃতিকেও জয় করতে পারবেন।
এমন সময় উত্তরের দূতরা এসে বিজয়সংবাদ দিলে। বিরাট আনন্দে রোমাঞ্চিত : হয়ে মন্ত্রীদের আজ্ঞা দিলেন, রাজমার্গ পতাকা দিয়ে সাজাও, দেবতাদের পূজা দাও, কুমারগণ যোদ্ধৃগণ ও সালংকারা গণিকাগণ বাদ্যসহকারে আমার পুত্রের প্রত্যুদগমন করুক, হস্তীর উপরে ঘণ্টা বাজিয়ে সমস্ত চতুষ্পথে আমার জয় ঘোষণা করা হ’ক, উত্তম বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে বহু কুমারীদের সঙ্গে উত্তরা বৃহন্নলাকে আনতে যাক। তার পর বিরাট বললেন, সৈরিন্ধ্রী, পাশা নিয়ে এস; কঙ্ক, খেলবে এস। যুধিষ্ঠির বললেন, মহারাজ, শুনেছি হৃষ্ট অবস্থায় দ্যূতক্রীড়া অনুচিত। দ্যূতে বহু দোষ, তা বর্জন করাই ভাল। পাণ্ডুপুত্র যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে থাকবেন, তিনি তার বিশাল রাজ্য এবং দেবতুল্য ভ্রাতাদেরও দ্যূতক্রীড়ায় হারিয়েছিলেন। তবে আপনি যদি নিতান্ত ইচ্ছা করেন তবে খেলব।
খেলতে খেলতে বিরাট বললেন, দেখ, আমার পুত্র কৌরববীরগণকেও জয় করেছে। যুধিষ্ঠির বললেন, বৃহন্নলা যার সারথি সে জয়ী হবে না কেন। বিরাট ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, নীচ ব্রাহ্মণ, তুমি আমার পুত্রের সমান জ্ঞান করে একটা নপুংসকের প্রশংসা করছ, কি বলতে হয় তা তুমি জান না, আমার অপমান করছ। নপুংসক কি করে ভীষ্মদ্রোণাদিকে জয় করতে পারে? তুমি আমার বয়স্য সেজন্য অপরাধ ক্ষমা করলাম, যদি বাঁচতে চাও তবে আর এমন কথা বলো না। যুধিষ্ঠির বললেন, মহারাজ, ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ প্রভৃতি মহারথগণের সঙ্গে বৃহন্নলা ভিন্ন আর কে যুদ্ধ করতে পারেন? ইন্দ্রাদি দেবগণও পারেন না। বিরাট বললেন, বহুবার নিষেধ করলেও তুমি বাক্য সংযত করছ না; শাসন না করলে কেউ ধর্মপথে চ’লে না। এই বলে বিরাট অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে যুধিষ্ঠিরের মুখে পাশা দিয়ে আঘাত করলেন। যুধিষ্ঠিরের নাক দিয়ে রক্ত পড়তে লাগল, তিনি হাত দিয়ে তা ধরে দ্রৌপদীর দিকে চাইলেন। দ্রৌপদী তখনই একটি জলপূর্ণ স্বর্ণপাত্র এনে নিঃসৃত রক্ত ধরলেন। এই সময়ে দ্বারপাল এসে সংবাদ দিলে যে রাজপুত্র উত্তর এসেছেন, তিনি বৃহন্নলার সঙ্গে দ্বারে অপেক্ষা করছেন। বিরাট বললেন, তাঁদের শীঘ্র নিয়ে এস।
অর্জুনের এই প্রতিজ্ঞা ছিল যে কোনও লোক যদি যুদ্ধ ভিন্ন অন্য কারণে যুধিষ্ঠিরের রক্তপাত করে তবে সে জীবিত থাকবে না। এই প্রতিজ্ঞা স্মরণ করে যুধিষ্ঠির দ্বারপালকে বললেন, কেবল উত্তরকে নিয়ে এস বৃহন্নলাকে নয়। উত্তর এসে পিতাকে প্রণাম করে দেখলেন, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির এক প্রান্তে ভূমিতে বসে আছেন, তার নাসিকা রক্তাক্ত, দ্রৌপদী তার কাছে রয়েছেন। উত্তর ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, মহারাজ, কে এই পাপকার্য করেছে? বিরাট বললেন আমি এই কুটিলকে প্রহার করেছি, এ আরও শাস্তির যোগ্য; তোমার প্রশংসাকালে এ একটা নপুংসকের প্রশংসা করছিল। উত্তর বললেন, মহারাজ, আপনি অকার্য করেছেন, শীঘ্র এঁকে প্রসন্ন করুন, ইনি যেন ব্রহ্মশাপে আপনাকে সবংশে দগ্ধ না করেন। পুত্রের কথায় বিরাট যুধিষ্ঠিরের নিকট ক্ষমা চাইলেন। যুধিষ্ঠির বললেন, রাজা, আমি পূর্বেই ক্ষমা করেছি, আমার ক্রোধ নেই। যদি আমার রক্ত ভূমিতে পড়ত তবে আপনি রাজ্য সমেত বিনষ্ট হ’তেন।
যুধিষ্ঠিরের রক্তস্রাব থামলে অর্জুন এলেন এবং প্রথমে রাজাকে তার পর যুধিষ্ঠিরকে অভিবাদন করলেন। বৃহন্নলাবেশী অর্জুনকে শুনিয়ে শুনিয়ে বিরাট তাঁর পুত্রকে বললেন, বৎস, তোমার তুল্য পুত্র আমার হয়নি, হবেও না। মহাবীর কর্ণ, কালাগ্নির ন্যায় দুঃসহ ভীষ্ম, ক্ষত্রিয়গণের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য, তাঁর পুত্র অশ্বত্থামা, বিপক্ষের ভয়প্রদ কৃপাচার্য, মহাবল দুর্যোধন—এঁদের সঙ্গে তুমি কি করে যুদ্ধ করলে? এইসকল নরশ্রেষ্ঠকে পরাজিত করে তুমি গোধন উদ্ধার করেছ, যেন শর্দুলের কবল থেকে মাংস কেড়ে এনেছ।
উত্তর বললেন, আমি গোধন উদ্ধার করি নি, শত্ৰুজয়ও করি নি। আমি ভয় পেয়ে পালাচ্ছিলাম, এক দেবপুত্র আমাকে নিবারণ করলেন। তিনিই রথে উঠে ভীষ্মদি ছয় রথীকে পরাস্ত করে গোধন উদ্ধার করেছেন। সিংহের ন্যায় দৃঢ়কায় সেই যুবা কৌরবগণকে উপহাস করে তাদের বসন হরণ করেছেন। বিরাট বললেন, সেই মহাবাহু দেবপুত্র কোথায় ? উত্তর বললেন, পিতা, তিনি অন্তর্হিত হয়েছেন, বোধ হয় কাল পরশু দেখা দেবেন।
বৃহন্নলাবেশী অর্জুন বিরাটের অনুমতি নিয়ে তাঁর কন্যা উত্তরাকে কৌরবগণের মহার্ঘ্য বিচিত্র সূক্ষ্ম বসনগুলি দিলেন। তার পর তিনি নির্জনে উত্তরের সঙ্গে মন্ত্রণা করে যুধিষ্ঠিরাদির আত্মপ্রকাশের উদযোগ করলেন।
॥ বৈবাহিকপর্বাধ্যায়॥
১৬। পাণ্ডবগণের আত্মপ্রকাশ-উত্তরা-অভিমন্যুর বিবাহ
তিন দিন পরে পঞ্চপাণ্ডব স্নান করে শুক্ল বসন পরে রাজযোগ্য আভরণে ভূষিত হলেন এবং যুধিষ্ঠিরকে পুরোবতী করে বিরাট রাজার সভায় গিয়ে রাজাসনে উপবিষ্ট হলেন। বিরাট রাজকার্য করবার জন্য সভায় এসে তাদের দেখে সরোষে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, কঙ্ক, তোমাকে আমি সভাসদ করেছি, তুমি রাজাসনে বসেছ কেন? অর্জুন সহাস্যে বললেন, মহারাজ, ইনি ইন্দ্রের আসনেও বসবার যোগ্য। ইনি মূর্তিমান ধর্ম, ত্রিলোকবিখ্যাত রাজর্ষি, ধৈর্যশীল সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয়। ইনি যখন কুরুদেশে ছিলেন। তখন দশ সহস্র হস্তী এবং কাঞ্চনমালাভূষিত অশ্বযুক্ত ত্রিশ সহস্র রথ এঁর পশ্চাতে যেত। ইনি বৃদ্ধ অনাথ অঙ্গহীন পঙ্গু প্রভৃতিকে পুত্রের ন্যায় পালন করতেন। এঁর ঐশ্বর্য ও প্রতাপ দেখে দুর্যোধন কর্ণ শকুনি প্রভৃতি সন্তপ্ত হ’তেন। সেই পুরুষশ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠির রাজার আসনে বসবেন না কেন?
বিরাট বললেন, ইনি যদি কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠির হন তবে এঁর ভ্রাতা ভীম অর্জুন নকুল সহদেব কারা? যশস্বিনী দ্রৌপদীই বা কে? দূতসভায় পাণ্ডবদের পরাজয়ের পর থেকে তাদের কোনও সংবাদ আমরা জানি না। অর্জুন বললেন, মহারাজ, সন্তান যেমন মাতৃগর্ভে বাস করে আমরা তেমনই আপনার ভবনে সুখে অজ্ঞাতবাস করেছি। এই বলে তিনি নিজেদের পরিচয় দিলেন।
উত্তর পাণ্ডবগণকে একে একে দেখিয়ে বললেন, এই যে শোধিত স্বর্ণের ন্যায় গৌরবর্ণ বিশালকায় পুরুষ দেখছেন, যাঁরা নাসিকা দীর্ঘ, চক্ষু তাম্রবর্ণ, ইনিই কুরুরাজ যুধিষ্ঠির। মত্ত গজেন্দ্রের ন্যায় যার গতি, যিনি তপ্তকাঞ্চনবর্ণ স্থলস্কন্ধ মহাবাহু, ইনিই বৃকোদর, এঁকে দেখুন, দেখুন। এঁর পার্শ্বে যে শ্যামবর্ণ সিংহস্কন্ধ গজেন্দ্রগামী আয়তলোচন যুবা রয়েছেন, ইনিই মহাধনুর্ধর অর্জুন। কুরুরাজ যুধিষ্ঠিরের নিকটে বিষ্ণু ও ইন্দ্রের ন্যায় যে দুজনকে দেখছেন, রূপে বলে ও চরিত্রে যাঁরা অতুলনীয়, এঁরাই নকুল-সহদেব। আর যাঁর কান্তি নীলোৎপলের ন্যায়, মস্তকে স্বর্ণাভরণ, যিনি মুর্তিমতী লক্ষ্মীর ন্যায় পাণ্ডবগণের পার্শ্বে রয়েছেন, ইনিই কৃষ্ণা।
বিরাট তাঁর পুত্রকে বললেন, আমি যুধিষ্ঠিরকে প্রসন্ন করতে ইচ্ছা করি, যদি তোমার মত হয় তবে অর্জুনকে আমার কন্যাদান করব। ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির, আমরা না জেনে যে অপরাধ করেছি তা ক্ষমা করুন। আমার এই রাজ্য এবং যা কিছু আছে সমস্তই আপনাদের। সব্যসাচী ধনঞ্জয় উত্তরাকে গ্রহণ করুন, তিনিই তার যোগ্য ভর্তা।
যুধিষ্ঠির অর্জুনের দিকে চাইলেন। অর্জুন বললেন, মহারাজ, আপনার দুহিতাকে আমি পুত্রবধূ রূপে গ্রহণ করব, এই সম্বন্ধ আমাদের উভয় বংশেরই যোগ্য হবে। বিরাট বললেন, আপনাকে আমার কন্যা দিচ্ছি, আপনিই তাকে ভার্যা রূপে নেবেন না কেন? অর্জুন বললেন, অন্তঃপুরে আমি সর্বদাই আপনার কন্যাকে দেখেছি, সে নির্জনে ও প্রকাশ্যে আমাকে পিতার ন্যায় বিশ্বাস করেছে। নৃত্যগীত শিখিয়ে আমি তার প্রীতি ও সম্মানের পাত্র হয়েছি, সে আমাকে আচার্যতুল্য মনে করে। আমি এক বৎসর আপনার বয়স্থা কন্যার সঙ্গে বাস করেছি, আমি তাকে বিবাহ করলে লোকে অন্যায় সন্দেহ করতে পারে; এই কারণে আপনার কন্যাকে আমি পুত্রবধূ রূপে চাচ্ছি, তাতে লোকে বুঝবে যে আমি শুদ্ধস্বভাব জিতেন্দ্রিয়, আপনার কন্যারও অপবাদ হবে না। পুত্র বা ভ্রাতার সঙ্গে বাস যেমন নির্দোষ, পুত্রবধূ ও দুহিতার সঙ্গে বাসও সেইরূপ। আমার পুত্র মহাবাহু অভিমন্যু কৃষ্ণের ভাগিনেয়, দেববালকের ন্যায় রূপবান, অল্প বয়সেই অস্ত্রবিশারদ, সে আপনার উপযুক্ত জামাতা।
অর্জুনের প্রস্তাবে বিরাট সম্মত হলেন, যুধিষ্ঠিরও অনুমোদন করলেন। তার পর সকলে বিরাটরাজ্যের অন্তর্গত উপপ্লব্য নগরে গেলেন এবং আত্মীয়-স্বজনকে নিমন্ত্রণ করে পাঠালেন। দ্বারকা থেকে কৃষ্ণ বলরাম কৃতবর্মা ও সাত্যকি সুভদ্রা ও অভিমন্যুকে নিয়ে এলেন। ইন্দ্রসেন প্রভৃতি ভৃত্যরাও পাণ্ডবদের রথ নিয়ে এল। এক অক্ষৌহিণী সৈন্য সহ দ্রুপদ রাজা, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র, শিখণ্ডী ও ধৃষ্টদ্যুম্নও এলেন। মহাসমারোহে বিবাহের উৎসব অনুষ্ঠিত হল। শত শত মৃগ ও অন্যান্য পবিত্র পশু নিহত হল , লোকে নানাপ্রকার মদ্য প্রচুর পান করতে লাগল। সর্বাঙ্গসুন্দরী সুভূষিতা নারীগণ বিরাটমহিষী সুদেষ্ণার সঙ্গে বিবাহসভায় এলেন, রূপে যশে ও কান্তিতে দ্রৌপদী সকলকেই পরাস্ত করলেন। জনার্দন কৃষ্ণের সম্মুখে অভিমন্যু-উত্তরার বিবাহ যথাবিধি সম্পন্ন হল। বিরাট অভিমন্যুকে সাত হাজার দ্রুতগামী অশ্ব, দুই শত উত্তম হস্তী, এবং বহু ধন যৌতুক দিলেন। কৃষ্ণ যা উপহার দিলেন যুধিষ্ঠির সেই সকল ধনরত্ন, বহু সহস্র গো, বিবিধ বস্ত্র, ভূষণ যান শয্যা এবং খাদ্য-পানীয় ব্রাহ্মণগণকে দান করলেন।