০৪. বিরহিণী পত্ৰলেখা

০৪. বিরহিণী পত্ৰলেখা

তেতলায় নতুন কয়েকটি ঘর তোলা হয়েছে। সেখানেই জ্ঞানদা তার নিজস্ব ঘরটিকে সুন্দর করে সাজিয়েছেন। মেঝেতে পেতেছেন ফুল-তোলা মাদুর। এককোণে ছোট্ট জলচৌকির ওপর কাঁসার ঘটিতে একগুচ্ছ লাল গোলাপ। দেওয়ালে জ্যোতিরিন্দ্রের আঁকা জ্ঞানদার একটি পোর্ট্রেট। সেদিকে তাকিয়ে আপনমনে বসে ছিলেন ছবির মানবীটি। হাতে সত্যেনের পাঠানো একগোছা চিঠি।

বিনি দাসী রুপোর রেকাবে একরাশ কাটা ফল নিয়ে হাজির করে, খেয়ে নাও গো বোঠান, তোমার শরীরে এখন গত্তি দরকার।

জ্ঞানদা আলস্যে শুয়ে থাকেন, দুর বিনি, আর সারাদিন ফল খেতে পারি না। যা-না একটু তেঁতুলের আচার নিয়ে আয়। সেজদিদির কাছে চুপিচুপি চেয়ে আনবি।

বিনি মুচকি হেসে বলে, এ সময়ে টক খেতে মন চায়, আমারও এরকম হত। মেজোবোঠান, তুমি সঁতে করে একটু ফল কাটো দিকিনি, পেটের বাবুসোনার পুষ্টি হবে। আমি এই ছুটে আচার নে আসছি। আহা এসময় বাপের বাড়ি গেলে কত ভাল লাগত, সে তো কত্তাবাড়ির রেয়াজ নেই।

বিনি চলে যেতে-না-যেতেই উত্তেজিত হয়ে একটি খাতা হাতে করে জ্যোতিরিন্দ্র ঘরে ঢোকেন কালবৈশাখী ঝড়ের মতো। মেজোবউঠান, শুনবে একটু আমার নতুন লেখাটা?

জ্ঞানদা উজ্জ্বল মুখে প্রিয় দেওরের দিকে তাকালেন, এতদিনে তোমার আসার সময় হল নতুনঠাকুরপো, আমি তো ভাবলাম নতুন বউ পেয়ে পুরনো বোঠানকে ভুলেই গেছ!

তুমি কোনওদিন পুরনো হবে না মেজোবউঠান, জ্যোতি জ্ঞানদার হাতদুটি ধরে আবেগের সঙ্গে বলে ওঠেন, তবে কাদম্বরীকেও একটু সময় দিতে হবে তো! সে বেচারা তো আমার ভরসাতেই এই প্রাসাদে ঢুকেছে।

নববিবাহের রক্তিমাভায় জ্যোতিকে আগুনের মতো রূপবান মনে হয়। জ্ঞানদার হৃদয় এক মুহূর্তের জন্য ঈর্ষায় উথালপাতাল হয়ে ভাবে, কে এক কাদম্বরী কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে এই তরুণের হৃদয়ে! পরক্ষণেই নিজেকে শাসন করেন ধীমতী এই নারী, ছিঃ, এরকম করে ভাবছেন কেন তিনি! দেবরটিকে তো তিনি আঁচলে বেঁধে রাখতে পারেন না চিরদিন।

মাঝে মাঝেই জ্ঞানদার ঘরের পালঙ্কে জমিয়ে আড্ডা বসান জ্যোতি ও স্বর্ণকুমারী। কিশোরী কাদম্বরী কোনও কোনও দিন একপাশে এসে বসে থাকেন। জ্ঞানদার সাহিত্যপ্রীতি ও সুচারু সাজসজ্জায় মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন, কিন্তু মেজোবউঠানের দিক থেকে নতুনবউ বিশেষ সাড়াশব্দ পান না। তাদের জমাটি আসরে নিজেকে বড় বেমানান লাগে কাদম্বরীর, কিন্তু তিনি ঠিক করেন শিগগিরই শিখে নেবেন স্বামীর ভাললাগা বিষয়গুলি।

রাতের শয্যায় লাজুকনতুন বউ স্বামীর কাছে জানতে চান, মেজোবউঠানকে তুমি খুব ভালবাসো তাই না?

জ্যোতি বউকে জড়িয়ে ধরে বলেন, হ্যাঁ ভালবাসি কিন্তু তোমাকে তার চেয়ে অনেক বেশি ভালবাসি, শতগুণ বেশি।

তিনি কত কী জানেন, আমি মুখ কিছুই জানি না। তোমাদের মতো করে কথা বলতে বড় ইচ্ছে করে, জ্যোতির বুকে মুখ রেখে কাদম্বরী বলেন।

জ্যোতিও তো তাই চান, নিজের মনের মতো করে গড়ে নিতে চান বউকে। বধূকে চুম্বন করে তিনি বলেন, তুমি এখন নরম মাটির মতো, আমি তোমাকে গড়েপিটে মনের মতো পুতুল বানাব। সবুর করো কদিন, তখন সবাই অবাক হয়ে তোমাকে দেখবে।

.

জ্ঞানদা নিজের ঘরে বসে সত্যেনের চিঠি পড়তে থাকেন। প্রতিদিনের প্রাত্যহিক কথাও চিঠিতে কেমন অসামান্য হয়ে ওঠে। অতিপরিচিত স্বামীটিও যেন নতুন হয়ে ধরা দিচ্ছেন নিত্য নতুন চিঠিতে। সত্যেন প্রায় প্রতিদিন চিঠি লেখেন জ্ঞানদাকে

‘তুমি এখন কেমন আছ? এই দুই তিন দিনে অবশ্য বুঝিতে পারিয়াছ অবশিষ্ট কাল কিরূপে থাকিতে হইবে। তোমার সঙ্গে সর্বদা কে কে থাকেন। স্বর্ণ ও জানকী কি তেতলায় শোন? খাওয়া তোমার একলা হয় কি কেহ ভাগী থাকে? তুমি যেমন চাও তাহা পাইতেছ কি না? সকল বিশেষ করিয়া লিখিবে। নূতনকে আমার স্নেহ জানাইবে ও বলিবে যেন মধ্যে মধ্যে লেখেন—

শ্রীসত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর

 নীলকমল ও চারুর Photo তোমার album-এর জন্য পাঠাইলাম।
শ্রীস’

‘ভাই জ্ঞেনু

আলাহাবাদ বাগানে একজন অন্ধ ব্রাহ্মের সহিত সাক্ষাৎ হইল। তিনি জন্মান্ধ, তবুও বুদ্ধিমান ও বিবেকী বোধ হইল। কয়েকটি ব্রহ্মসঙ্গীত গান করিলেন মন্দ নহে– অর্থাৎ রাগরাগিনী শুদ্ধ না হোক কিন্তু সুর মন্দ নহে। তিনি অন্যের মুখে শুনিয়া উপনিষদ ও ব্রাহ্মধৰ্ম্মের পুস্তক সকলের মর্ম বুঝিয়াছেন। এমন কি অনেক শ্লোক তাহার কণ্ঠস্থ। তুমি সর্বাপেক্ষা চক্ষু হারাইবার ভয় কর, কিন্তু দেখ চক্ষু না থাকিলেও কত করা যায়। আলাহাবাদ ২৬এ প্রাতে পরিত্যাগ করিয়া সেই দিন সন্ধ্যার সময় জব্বলপুর পৌঁছিলাম। ভাগ্যে চারুর কাছ থেকে একখানা Novel সংগ্রহ করিতে পারিয়াছিলাম, তাহাই পথের একপ্রকার সম্বল হইয়াছে। এখন সেই গ্রন্থ পাঠ করিতেছি– তাহার নাম Oswald Cray- গ্রন্থকর্তা অথবা গ্রন্থকত্রীর নাম Mrs. Henry Wood৷ গ্ৰন্থখানি মন্দ নহে, তুমি আনাইয়া পড়িলে বুঝিতে পারিবে। ইংরাজ সমাজের দোষগুণ– ভাল দিক মন্দ দিক– তাহার অন্তরের ভাব অনেক লক্ষিত হইবে। এক এক স্থলে বর্ণনা বেশ আছে।’

জ্ঞানদা জানতে চান সত্যেনের নিজের কথা। এত পথচলায় কষ্ট হচ্ছে কি? পায়ের ব্যথা কেমন আছে? মনের মতো কথা বলার সঙ্গী কি পেয়েছেন সত্যেন?

সত্যেন জানান,

দেখ এক সপ্তাহের মধ্যে বোম্বাই আসিয়া পৌঁছিয়াছি। এখন যে হোটেলে রহিয়াছি তাহা Adelphi অপেক্ষা অনেক গুণে ভাল। হোটেল হইতে পৃথক একটা বাঙ্গলা পাইয়াছি– গোবিন্দ একটা পার্শ্ববর্তী বাঙ্গলায় রহিয়াছে– আমরা দুইজন একত্রে আহার করি। গোবিন্দ সারাদিনই তোমাকে ইংলণ্ডে পাঠাইবার পরামর্শ দেয়– তাহা এখন আর কি প্রকারে হয়– পরে দেখা যাইবে– কি বল জ্ঞেনু? আজ আমার ছুটির বিষয়ে অনুসন্ধান করিলাম– তাহার কোন গোল হয় নাই–১৫ই মার্চ হইতে তিন মাসের ছুটি পাইয়াছি– কল্য আমার অবশিষ্ট বেতন আদায় করিয়া লইব। আহমদনগরই এখন আমার কর্মস্থল। কিন্তু আবার আসিষ্টান্ট জজের পদ পাইবার চেষ্টা দেখিতেছি, শুনিলাম পুণায় একটা খালি আছে।

জ্ঞানদা পালটা চিঠিতে জানতে চান, তুমি কী খাও, কেমন স্বাদের খাবার খাও জানাবে? যাতায়াতে পথে খাওয়াদাওয়ার কোনও কষ্ট হয়নি তো? তোমার সঙ্গে এই বিচ্ছেদ আর ভাল লাগে না। এমন করে কতদিন যে তোমাকে ছেড়ে থাকতে হবে!

সত্যেন জবাব দিলেন,

পথিমধ্যে বিশেষ কোন কষ্ট হয় নাই। কল্য দাসপুরে সন্ধ্যার একটু পূৰ্ব্বে পৌঁছিয়া সুপ মাংস পীচ প্রভৃতি বিলক্ষণ ফলার করিয়া লইলাম। সঙ্গে যে আহার সামগ্রী ছিল, তাহা প্রায় খুলিতে হয় নাই। রৌদ্রের উত্তাপও বিশেষ কিছুই বোধ হইল না। আমি যে গাড়িতে ছিলাম, তাহা আর কেহ অধিকার করে নাই, সমস্ত পথটা একাকীই চলিয়াছি। সঙ্গীর মধ্যে এক হৈমবতী পুস্তক, তাহাকে লইয়া আর কতক্ষণ থাকিতে পারি। তবে বসিয়া শুইয়া ভাবিয়া ত একপ্রকার কালক্ষেপ করিলাম। কল্য সন্ধ্যার সময় নব ইন্দুকলা দেখিয়া তোমাকে মনে পড়িতে লাগিল– দেখিতে দেখিতে তাহা অস্ত গেল– আমিও শয়ন করিলাম।

তোমাতে আমাতে এবার এক বৎসরের জন্য বিচ্ছেদ হইবে কাহার মনে ছিল কিন্তু তাহাই ঘটিল। বোধহয় কোন দেবতা আমার প্রতি রুষ্ট হইয়া আমাকে, যক্ষের অনুরূপ বর্ষভোগ্য কান্তা বিরহ গুরু শাপ দিয়া থাকিবেন। এক্ষণে আর কি করা যায়। ঈশ্বরের প্রতি লক্ষ্য করিয়া ও কর্তব্য সাধন মনে করিয়া এক বৎসর কাল কোন মতে ধৈৰ্য্য ধরিয়া থাক; তোমার যখন যাহা প্রয়োজন হয় তাহা জানকীকে বলিলে তাহা আনিয়া দিবে। আর যদি কিছু না পাও ও তোমার কোনরূপ কষ্ট হয়, আমাকে লিখিলেই আমি তাহার উপায় করিয়া দিবার চেষ্টা দেখিব। তোমার যে কোন অসুখ হয়, একজন কাহাকেও সব খুলিয়া বলা অত্যন্ত আবশ্যক গোপন করিলে অনেক অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা। রাজেন্দ্রবাবু তোমাকে যত্ন করিয়া দেখিবেন তাহাতে আমার কোন সন্দেহ নাই। তোমার যখনি আবশ্যক হয় তাহাকে ডাকিয়া পাঠাইবে।

.

কত নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে আলাপ হয় সত্যেনের, তাদের বর্ণনা পড়তে জ্ঞানদার ভারী মজা লাগে। সত্যেনের চিঠিতে ছবির মতন ভেসে ওঠে কত মানুষ, এক ভোজসভায় আলাপ হল এক কালাসাহেবের সঙ্গে।

.

কৃষ্ণবর্ণ পুরুষ– প্রথমেই কেমন নিতান্ত ফিরিঙ্গি ফিরিঙ্গি বোধ হইল। তাহার এ দেশের কিছুই আর ভাল লাগেনা। Roast Beef ও Beer ভিন্ন দেশীয় সামগ্রী। সকল তাহার মুখরোচক নহে। ভিক্টোরিয়া রাণীর নিতান্ত অনুগত ভক্ত দাস। তাহার পিতা হইতে স্বতন্ত্র বাস করিতেছে। ইংলণ্ডের জলবায়ু লণ্ডনের কর্দম-ধূম কোওসা- মেঘ বাষ্প প্রভৃতি তাহার পক্ষে অতীব তৃপ্তিকর। আর এ দেশের জলবায়ু সূৰ্যকিরণ অসহনীয়। তাহার কথাবার্তা শুনিয়া আমাদের অত্যন্ত বিরক্তি বোধ হইল। আমরা যত পারি ইংলণ্ডের নিন্দা করিলাম ও সে দেশের জনসমাজের যে সকল কুপ্রথা তাহা বলিতে লাগিলাম। তাহা শুনিয়া যেন সে কিছু অপ্রস্তুত হইল।

.

পশ্চিমে থাকতে জ্ঞানদার সঙ্গে বেশ ভাব হয়েছিল মিসেস অলিফ্যান্ট-এর। জ্ঞানদা সত্যেনের কাছে জানতে চাইলেন তার কথা, সত্যেন স্ত্রীর বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে এসে লিখলেন,

.

এখানে কাল Oliphant-দের সহিত Tiffin করিলাম। Mrs. Oliphant তোমার কথা অনেক জিজ্ঞাসা করিলেন– যথা তুমি ঘোড়ায় চড়িতে শিখিয়াছ কি না–কলিকাতা থাকিতে ভালবাস কিনা ইত্যাদি। আমি Mrs.0-কে বলিলাম, যদি তুমি আহমদাবাদে তাহাকে ঘোড়ায় চড়িতে শিখাইতে তবে শিখিতে পারিতেন, কিন্তু এখন আর তাহার যো নাই। আর বলিলাম, কলিকাতার আর সকল ভাল লাগে, কেবল যদি মনের মত থাকিতে পার। আমাদের সকল পরিবারেরা কেমন একত্রে মিলিয়া একগৃহে বাস করে, তাহা বলিলাম। তুমি বোধ করি Mrs. Oliphant-কে সৌদামিনীর কথা বলিয়া থাকিবে, তাই জিজ্ঞাসা করিতেছিল তাহার সহিত সেখানে সাক্ষাৎ হয় কিনা?

.

জোড়াসাঁকোর আনন্দের আসরে একটু মনমরা হয়ে থাকেন জ্ঞানদা। এমনিতে তিনি এখন অন্তঃসত্ত্বা, কোনও দুশ্চিন্তা করা উচিত নয়। তবু মাঝে মাঝে উদ্বিগ্ন হন। নতুন বউ এসে তার গুরুত্ব কি একটু কমে যাচ্ছে এ-বাড়িতে? ওই একফোঁটা নিরক্ষর বালিকার প্রতি এত মনোযোগ দিচ্ছে কেন নতুনঠাকুরপো? এমনকী পুঁচকে বালক রবিও তার থেকে মাত্র কয়েক বছরের বড় নতুন বউয়ের পেছন পেছন ঘুরছে। বোধহয় তার চেলি ও গয়নার ঝকমকানিতে আকৃষ্ট হয়েছে সে। এই বালিকা কী করে উজ্জ্বল জ্যোতির সহধর্মিণী হবে? পরিশীলনে পরিমার্জনায় জ্যোতির মন যে উচ্চ তারে বাঁধা হয়ে গেছে, বালিকা কী করে তার নাগাল পাবে? হাসি পায় জ্ঞানদার, দুঃখও হয়।

জোড়াসাঁকোর মেয়েমহলে প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে জ্ঞানদার। বিবির কাছে ইংরেজি শেখেন, বাচ্চার জামা সেলাই করাও শিখছেন। বাংলা, ইংরেজি উপন্যাস পড়ে, চিঠি পড়ে তার দিন কাটে আলস্যে। জ্যোতি কাদম্বরীরা অনেকেই বোলপুরে হাওয়া বদলাতে গিয়েছেন। জ্ঞানদা সত্যেনের কাছে আবদার করেন জোড়াসাঁকোর বাইরে আলাদা বাড়িতে তার থাকার ব্যবস্থা করে দিতে। সত্যেন দুশ্চিন্তায় পড়েন। ঠাকুরবাড়ির চার-দেওয়ালে আটকে পড়া জ্ঞানদাকে কী করে মুক্তি দেবেন? অথচ তাকে তো একলা অন্য বাড়িতে রাখা যায় না!

.

প্রিয়তমা জ্ঞানদা,

এখন ত তোমার অনেক কষ্টে দিন যাইতেছে। কাল বাবামহাশয়ের ছবিশুদ্ধ তোমার পত্র পাইয়া তবুও কতকটা সুস্থির হইলাম। তোমার গঙ্গার ধারে থাকিবার ইচ্ছা হয় ত নিকটে কি কোন বাড়ী পাইতে পার না? তোমার সঙ্গে বাড়ীর কাহাকেও পাও আর ডাক্তারদের হইতে দূর না হয়, তবে ক্ষতি নাই, কিন্তু এখন বড়ই সাবধানে থাকা প্রয়োজন।

..তোমার অন্য বাড়ীতে থাকার বিষয়ে কিছু স্থির করিতে পারিতেছি না– বাবামহাশয় ইহার মধ্যে ত বাড়ী আসিবেন, না জানি তাঁহার কি মত? আর তুমি ত পাঁচিধোবানির গলিতে কোন বাড়ী লইয়া থাকিতে পারিবে না– একটা ভাল স্থানে বাঙালীটোলায় বাড়ী পাওয়া সহজ নহে। তবে যদি কোন বাগানে গিয়া থাকিতে ইচ্ছা কর। সে এক কথা।

.

..কি বল জ্ঞেনু?– কৈ তোমার ও নতুন বৌয়ের ছবি পাঠাইলে না?

.

সত্যেন বারবারই নতুন বউয়ের ছবি দেখতে চান। জ্ঞানদা বারবারই তা পাঠাতে ভুলে যান। ফোটোগ্রাফার ডেকে ছবি তোলানো কিছু কঠিন নয়, আজকাল ঠাকুরবাড়ির অন্দরেও তারা ছবি তুলতে আসে। কিন্তু নতুনবউ এসে তার বাল্য সহচর জ্যোতিকে ছিনিয়ে নিয়েছে জ্ঞানদার কাছ থেকে। খুব একা লাগে, মনখারাপ হয়। ছবি পাঠানো আর হয়ে ওঠে না।

ইতিমধ্যে সত্যেন টাঙ্গাগাড়ি কিনেছেন, কুকুর পুষেছেন। বাংলোবাড়িতে আস্তানা গেড়ে স্ত্রীকে লেখেন,

‘আমি এক নতুন খবর তোমাকে লিখিতে ভুলিয়াছি। আমি এক গরু কিনিয়াছি ও কাল তাহার এক বৎস হইয়াছে। শুনিতেছি ৫ সের দুধ দেয় ও ৫০ টাকা দাম। দুধ দেখিয়া দাম দিব। তার নাম কি রাখিব? তোমাদের বাড়ীতে লক্ষ্মী বলিয়া এক গরু ছিল, তাহাকে তুমি ভালবাসিতে– এর নামও লক্ষ্মী রাখি– কি বল? তোমার চিঠি দুই দিন পাই নাই, তোমার শরীর কেমন, কিছু কি ভাল হইয়াছে?’

দুজায়গায় সংসার চালাতে টাকার জোগাড় করতে সকলে দুশ্চিন্তায় পড়েন মাঝে মাঝেই। জ্ঞানদা জোড়াসাঁকোয় থাকলেও তার জন্য মেমসাহেব শিক্ষিকা রাখার খরচ বা বিশেষ বিশেষ বইপত্রের টাকা সত্যেনকেই পাঠাতে হয়। রোজগেরে পুত্রের হাতখরচ দেওয়ার ব্যাপারে দেবেন ঠাকুরের কিছু আপত্তি আছে। অথচ ওই ১০০ টাকা পেলে জ্ঞানদার কাজে লাগে। সত্যেন বাবামশায়কে চিঠিতে টাকা বন্ধ না করার আবেদন জানান। রোজগার করলেই কি পুত্র তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন? জ্ঞানদাকে লেখেন,

‘–আগামী মাসে তোমাকে টাকা পাঠাইতে পারিব কিনা সন্দেহ, কারণ গাড়ীঘোড়া জিনিষপত্র কিনিতে অনেক খরচ হইয়াছে। বোধ করি আগষ্ট মাসে একেবারে ২, ৩ শত টাকা পাঠাইতে পারিব। তুমি যদুর কাছ থেকে ত মাসে মাসে কতক পাইবে আর বাবামশায় যদি ১০০ টাকা এখনো দিবার অনুমতি করেন তাহা তোমার হস্তে দিবার জন্য জানকীকে লিখিয়াছি। যদি এখানে Assistant জজের কৰ্ম্ম পাই তবে বেশ হয়। তাহার অনেক সম্ভাবনা আছে। হয়ত এবারকার গ্যাজেটে তাহার কিছু থাকিতে পারে। আমার প্রেম ও রাশি রাশি চুম্বন।‘

.

অন্যদিকে জ্ঞানদার মনে হয় সত্যেন ওখানে সুখেই আছেন, কত বন্ধুবান্ধব, কত ভোজসভা, কত নতুন জায়গায় ভ্রমণ। এ-সবেই তার সঙ্গী হওয়ার কথা অথচ গর্ভিণী বলে আটকে থাকতে হচ্ছে এই সেকেলে শ্বশুরবাড়িতে।

সত্যেন ৬৫০ টাকা মাইনের অ্যাসিস্টান্ট জজ হয়েছেন আহমেদনগরে। প্রায় সন্ধেবেলাই কোনও না কোনও সাহেবের বাড়িতে গিয়ে সৌজন্যসাক্ষাৎ করতে হয়, এটাই নিয়ম। কয়েকদিনের মধ্যে এত মেমসাহেবের সঙ্গে আলাপ হয়েছে যে মুখ মনে রাখতে পারছেন না। তাঁর মতে,

এখানে অনেক গুলি বিবি আছে– একবার দেখা করিয়া সকলকে চিনিয়া উঠা কঠিন– এক দঙ্গল মেষপালের মধ্যে যেমন এক মেষকে অন্য হইতে চেনা দুষ্কর। নিতান্ত কুৎসিত কি নিতান্ত সুন্দরী যে, তাকেই একবার দেখিয়া জানা যায়। এখানে কৰ্ম্মের বড় অধিক জঞ্জাল নাই, পড়িবার অনেক সময়।

জ্ঞানদা রোজ চিঠি পান,

‘আমচী জ্ঞেনুমণি,

এখন অনেক সময় একলা থাকিতে হয় বলিয়া এক একবার বড় বিরক্ত বোধ হয়। ১০টার পর নাস্তা করিয়া তারপর দুই প্রহরের সময় কাঁচারিতে যাই, সেখানে দুই তিন ঘণ্টা থাকিয়া আবার আসিয়া চা খাই ও কিঞ্চিৎ পরে সন্ধ্যার সময় একবার বেড়াইতে যাই। কাল চলিয়া দেখিলাম কত পথ চলিতে পারি। প্রায় আধ ক্রোশ চলিয়াও বিশেষ কষ্ট বোধ হইল না, ক্রমে চলা অভ্যাস করিতে হইবে। রাত্রে এখন মন্দ ঘুম হইতেছে না, মশা নাই এক বড় সুবিধা, মশারিও দিতে হয় না। তোমার আসিবার আর কত বিলম্ব হইবে বোধ কর?’

‘… কতদিন হইল আমরা বিচ্ছিন্ন হইয়াছি। বোধ হইতেছে যেন অনেক দিন– অনেক মাস–…

…আমার এখন কেমন কিছুই ভাল লাগে না– আমি আপনার প্রতি বিরক্ত –এখানকার লোকজনের উপর বিরক্ত কাহারও সঙ্গে মিশিতে ইচ্ছা হয় না। ইংরাজদের সঙ্গে মিলিবার স্থান Gymkhana, Band Stand প্রভৃতি আছে কিন্তু সেখানে যদি যাই, অনিচ্ছার সহিত যাই। আর বিবিদের সেই একরকম কৃত্রিমতা আমার ভাল লাগে না। আমার এখন ক্রমশই প্রতীতি জন্মিতেছে যেন ইংরাজদের সঙ্গে আমাদের যে জাতীয় প্রভেদ তাহা ভাঙ্গিবার নহে। যাহা কিছু মিল হয় মৌখিকমাত্র। ইংলণ্ডে আমার মত একরকম ছিল। এখানে উলটিয়া যাইতেছে’।

.

আশ্বিনের এক রাতে জ্ঞানদার ব্যথা উঠল। সারদা খবর পেয়ে দাইকে ডেকে পাঠালেন। রাতে আসার জন্য দাই একটু টাকা বেশি চাইলেও শেষে আট টাকায় রাজি করানো গেল। আতুড়ঘর উঠোনের এককোণে। নাড়ি কেটে দাই আতুড়ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল শিশুটিকে কোলে নিয়ে, পুত্রসন্তান দেখে মেয়েরা শঙ্খ বাজিয়ে উলুধ্বনি করে নবজাতককে স্বাগত জানালেন। নাতির মুখ দেখে খুশি হয়ে সারদা একটি নতুন ধনেখালি শাড়ি ও প্রচুর মিষ্টি দিয়ে দাই-বিদায় করলেন।

পরদিন ভোরেই দুধমা ও ধাইমা ডেকে আনা হল। ঠাকুরবাড়িতে প্রায়ই শিশু জন্মায় বলে বেশ কয়েকজন বাঁধা দুধমা ও ধাইমা আছে, তারাই পালা করে সামলে দেয়। কিন্তু এবার একটা গণ্ডগোল হল। নবজাতক দুধমায়ের স্তন্যপান করতে করতে তীব্র স্বরে কেঁদে উঠল।

জ্ঞানদা অস্থির হয়ে পড়েন, বাচ্চা কাঁদে কেন? পেটব্যথা নাকি অন্য কিছু? তিনি ধাইয়ের কোল থেকে নিজের কোলে নিয়ে বাচ্চাকে থামাতে চেষ্টা করলেও শিশুর কান্না থামে না। সাহেব ডাক্তারের ওষুধ পড়ল, তাও বাচ্চা নেতিয়ে পড়ছে কেন? দুদিন কান্নার পর কেউ কিছু বোঝার আগেই শিশুটি মারা গেল। প্রথম সন্তানের মৃতদেহ কোলে নিয়ে সারারাত বসে রইলেন জ্ঞানদা। তার চোখের জল যেন শুকিয়ে পাথর হয়ে গেছে।

কয়েকদিন পর সত্যেনের চিঠি এল,

‘প্রিয়তমা জ্ঞানদা,

১১ই অক্টোবর জানকীর পত্রে দেখিলাম তোমার একটি পুত্রসন্তান জন্মিয়াছে– আজ তোমার তেরই-এর পত্রে তাহার মৃত্যুসংবাদ পাইলাম। ইহাতে আর কাহার দোষও-তোমারই কি দোষ, ডাক্তারদেরই কি দোষ। জন্মমৃত্যুর উপর আমাদের ত হাত নাই– আমরা নিয়মমত থাকিবার চেষ্টা করিতে পারি, তাহাই কৰ্ত্তব্য। এক্ষণে তোমার শরীরে বল পাইলেই আসিতে পার– দুই এক মাস না গেলে হয়ত বল পাইবে না। তুমি যেমন যেমন থাক আমাকে লিখিবে ও তুমি বেশ ভাল হইলে তোমার আসিবার কোনরূপ ব্যবস্থা করা যাইবে।

শোকার্ত জ্ঞানদাকে কিছুদিনের জন্য পেনেটির বাগানবাড়িতে নিয়ে আসা হল। জ্যোতি, সারদাপ্রসাদ, হেমেন, সৌদামিনীরা তার সঙ্গী হয়েছেন। গঙ্গার সংস্পর্শে তার মন যদি কিছুটা আরাম পায়। মৃত সন্তানের জন্য তার প্রথম অশ্রুপাত ঘটল এখানেই।

এই শোকের সময় জ্যোতি তাঁকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন। মেজোবউঠানকে সঙ্গ দেবেন বলে কাদম্বরীকেও সঙ্গে আনেননি এবার।

গঙ্গার ঘাটে বসে বসে ওঁদের বেশি সময় কাটে। ওপারে কোন্নগরের বাগানে ঘাঁটি গেড়েছেন ও-বাড়ির গুণেন্দ্ররা। বাড়ি ভাগাভাগির পরেও গুনো আর জ্যোতির খুব ভাব। তারা একসঙ্গে বৌবাজার আর্ট স্কুলের প্রথম বছরের। ছাত্র ছিলেন। মাঝে মাঝেই বিকেলবেলা ওপারের পানসি এপারে আসে। এপারের পানসি ওপারে যায়।

বন্দুকের আওয়াজে তারা একে অপরকে সিগনাল পাঠান। এপারের থেকে গুলি ছোড়েন গুণেন্দ্র। ওপার থেকে জ্যোতির বন্দুক জবাব দেয়।

গুণেন্দ্র ভারী শৌখিন পুরুষ। নানারকম মহার্ঘ শিল্পবস্তু সংগ্রহ করেন তিনি। স্ত্রীর আয়নার সামনে সাজিয়ে দিয়েছেন অসামান্য একটি স্ফটিকের টিউলিপ দেওয়া ফুলদানি। যতবার আয়নায় তার মুখের ছায়া পড়ে, ততবারই মুখের পাশে ভেসে ওঠে টিউলিপগুচ্ছ।

কোন্নগরের বাগানে আবার অন্যরকম মজা। কতরকম লোক আসে। এক নাপিত কাঠবেড়ালির ছানা এনে দেয়। বাবুইপাখির বাসা জোগাড় করে আনে। বহুরূপী এসে নাচ দেখায়।

বারান্দার বাইরে ছোট চালাঘরে মেয়েরা রান্নার তদারকি করছেন। কাঁঠালতলায় চৌকি পেতে আসর জমিয়েছেন গুণেন্দ্র, জ্যোতি, যদুনাথেরা।

কোন্নগরের রাস্তা থেকে এক বালক গায়ককে ধরে এনেছেন গুণেন, ছেলেটি ভারী মজার। ব্ল্যাকওয়ার নামে এক সাহেব রোজ ঘোড়ায় চড়ে ভ্রমণের পর গয়লাপাড়ায় গিয়ে গয়লানির কাছে এক পো দুধ খেত। পাড়ার লোকে তাই নিয়ে গান বেঁধেছে। গুণেনের নির্দেশে অর্গান বাজিয়ে সেই গানটি শোনায়।

হায় রে সাহেব বেলাকর ।
আমি গাই দেব, তুই বাছুর ধর
 ওটি শিষ্ট বাছুর গুঁতোয় নাকো
কান দুটো ওর মুচড়ে ধর।
 হায়রে সাহেব বেলাকর।

গান শুনে হা হা করে হেসে ওঠেন জ্যোতি ও গুণেন।

 গঙ্গাতীরে বাঁধানো ঘাটের সিঁড়িতে বসে জ্যোতি একদিন তার শকুন্তলা অনুবাদ শোনাচ্ছিলেন জ্ঞানদাকে। জ্যোতির কাব্যের অপূর্ব ভাষায় ছন্দে জ্ঞানদার মনে আনন্দ ফিরে আসছিল। একে একে হেমেন, যদুনাথ ও সারদাপ্রসাদ এসে জড়ো হলেন।

কিছুক্ষণ কাব্যপাঠের পর জ্যোতিরিন্দ্র একটু থামতেই যদুনাথ জানতে চান, ভায়া তোমার কাব্য তো অতি সুন্দর। কিন্তু এই রচনার নেপথ্য প্রেরণা কোন সুন্দরী?

জ্ঞানদা জানেন, তিনি এই রচনার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছেন, তার বিদগ্ধ সান্নিধ্যেই জ্যোতির উদ্ভাস। কিন্তু সে-কথা প্রকাশ্যে বলার নয়।

যদুনাথের হাসিঠাট্টায় উত্ত্যক্ত হয়ে সারদাপ্রসাদ বলেন, কেন জ্বালাচ্ছ ভায়রা, তুমি কি জানো না, সদ্যবিবাহিত তরুণ কবির মনে যে শকুন্তলার ছবি ফুটে উঠছে সে আমাদের কাদম্বরী।

লাজুকমুখে জ্যোতি জানালেন এরকম বেরসিকদের সামনে তিনি কাব্যপাঠ করতে চান না। ভাইকে লজ্জারুণ দেখে রাশভারী হেমেন উঠে যান। যদু তখন হাত ঘুরিয়ে নেচে নেচে জ্যোতিকে কাদম্বরীর নাম ধরে খ্যাপাতে থাকেন। জ্ঞানদা ভীষণ বিরক্ত বোধ করেন, মনে হয় কাদম্বরী এ যাত্রায় ওঁদের সঙ্গী না হলেও তিনিই যেন আসরের মধ্যমণি।

জ্ঞানদা যেখানে যান সেখানে সাধারণত তিনিই রানিমৌমাছি। তাকে ঘিরে দিশি বিদেশি পুরুষেরা বিস্মিত হন, স্তুতি করেন। সত্যেনের বন্ধু ম্যাকগ্রেগর সাহেব কতবার বোম্বাই ও আমেদাবাদের পার্টিতে সমবেত বহু মহিলার মধ্য থেকে তাঁকেই বেছে নিয়ে মুগ্ধতা জানিয়েছেন। নাচের আসরে তাঁকে ছাড়া আর কারও সঙ্গেই ডান্স করতে চান না ম্যাকগ্রেগর। সত্যেন স্বয়ং তাকে নিয়ে কত গর্ব করেন। জ্যোতিও তাকে মাথায় করে রাখে। কিন্তু এখন, এই গঙ্গাতীরের বাগানবাড়িতে হঠাৎ মনে হয়, এখানে তিনি প্রধান আকর্ষণ নন, অন্য কেউ। প্রিয়জনেরা সবাই তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য ঘিরে আছেন, জ্যোতিও সেজন্যই এখানে একা এসেছেন, নতুনবউকে আনেননি। কিন্তু নতুনঠাকুরপোর মন পড়ে আছে কাদম্বরীর আঁচলেই।

জ্ঞানদা এ-সবের অনেক ঊর্ধ্বে। তাকে অনেক দূর যেতে হবে। এসব কথাবার্তা তার অসহ্য লাগে, এই বিচ্ছিরি আসর ছেড়ে তিনি ঘাটের অবারিত সৌন্দর্যের দিকে পা বাড়ান।

জ্যোতি দেখলেন গোধূলি আলোয় রহস্যময়ী নারীর মতো ধীরে ধীরে নদীর জলে পা ভেজাতে নেমে যাচ্ছেন জ্ঞানদানন্দিনী। মুহূর্তের জন্য তার ভ্রম হয়, এ নারী কে, মেজোবউঠান না তার নাটকের শকুন্তলা! জলে নেমে এইবার বোধহয় তাঁর আংটি খোয়া যাবে।

কিছুক্ষণ পর জ্যোতিও জলের ধারে নেমে গেলেন। মেজোবউঠানের পিঠে হাত রেখে বললেন, চলো ঘরে বসে গান-বাজনা করা যাক। এখানে ঠান্ডা বাতাস লেগে যাবে।

জ্ঞানদা জ্যোতির হাত ধরে বললেন, চলো নতুন, এখানে আর ভাল লাগছে না, জোড়াসাঁকো ফিরে যাই চলো।

জ্যোতিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। এখন যে ঘরেই তার পিছুটান।

এর অল্পদিন পরেই স্টিমারে বোম্বাই ফিরে গেলেন সদ্য সন্তানহারা জ্ঞানদা। বাড়ির দুই জামাই সারদাপ্রসাদ ও জানকীনাথ সে-যাত্রায় তার সঙ্গী হলেন।

.

পশ্চিমে বসেও জোড়াসাঁকোর সব খবর পান জ্ঞানদা। জ্যোতি বেনামে কিঞ্চিৎ জলযোগ নামে একটি প্রহসন লিখেছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার এই নাটকে ব্রাহ্মিকাদের স্ত্রীস্বাধীনতাকে কটাক্ষ করা হয়েছে এবং কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকায় তা নিয়ে যথেষ্ট বাদানুবাদ শুরু হয়ে গেছে।

ক্ষুব্ধ সত্যেন এসে জ্ঞানদাকে ধর্মতত্ত্ব পত্রিকার রিভিউ পড়ে শোনান, আমরা শুনিয়া যারপরনাই দুঃখিত হইলাম যে কিঞ্চিৎ জলযোগ” নামক একখানি নাটক সম্প্রতি প্রকাশিত হইয়াছে। এই পুস্তকে ভারতাশ্রম, ব্ৰহ্মমন্দির, প্রচারকগণকে বিলক্ষণ গালি দেওয়া হইয়াছে, ব্রাহ্মিকাদিগকেও ইহার মধ্যে আনিয়া গ্রন্থকর্তা যথোচিত আপনার নীচতা ও বিকৃত স্বভাবের পরিচয় দিয়াছেন। আমরা এ কথা শুনিয়া অবাক হইলাম যে উক্ত গ্রন্থকর্তা কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজের ভক্তিভাজন প্রধান আচার্যের পুত্র।

জ্ঞানদাও খুব বিরক্ত হন, আমাদের নতুনঠাকুরপো কী করে এরকম নারীবিরোধী নাটক লিখতে পারেন, মেয়েপুরুষ একসঙ্গে প্রার্থনাসভায় বসছে বলে ব্যঙ্গ করতে পারেন, আমি ভেবে পাচ্ছি না। শ্যাম গাঙ্গুলির মেয়েকে বিয়ে করে এত অধঃপতন! ছি ছি!

আবার বঙ্কিমচন্দ্র কেমন তাতে ধুনো দিয়েছেন দেখো, সত্যেন বলেন, বঙ্গদর্শনে কত প্রশংসা বেরিয়েছে। রাজা রাধাকান্ত দেব ডেকে নিয়ে তার নাটমন্দিরে মঞ্চস্থ করিয়েছেন। মধুসূদনের একেই কি বলে সভ্যতা আর কিঞ্চিৎ জলযোগ একসঙ্গে অভিনীত হয়েছে শনিবার।

জ্যোতি কেন রক্ষণশীলদের দলে গিয়ে ভিড়ল বলো তো? জ্ঞানদা অবাক হন, আমার তো মনে হয় নতুনবউ ওর মাথাটা খাচ্ছে। এইজন্যই শিক্ষিত মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। বাবামশায় আপত্তি করলেন, এখন বুঝুন তিনি, জ্যোতি তো তার বিরুদ্ধেই কলম ধরেছে।

জ্যোতিটা একটু ওরকমই, সত্যেন বললেন, জ্ঞেনু তোমার মনে নেই আমরা মেয়েপুরুষ মিলে গাড়ি করে ময়দানে হাওয়া খেতে বেরলে জ্যোতির কেমন অস্বস্তি হত, তোমাকে গাড়ির পরদা তুলতে দিত না। তারপর অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে পরদা তোলা গেল তো মেয়েদের জন্য ঢাকা গাড়ির বায়না। তুমি এখানে এমন ভোলা গাড়িতে ঘুরছ দেখলে জ্যোতির বোধহয় লজ্জায় মাথা কাটা যাবে। আর নিজের বউকে বোধহয় ঘরবন্দি করে রাখবে মা দিদিমার যুগের মতো।

তুমি ওকে এখানে ডেকে পাঠাও। আমাদের সঙ্গে থাকলে ওর মনের ধোঁয়াশা কেটে যাবে। আমরা মেয়েরা কত সাহস করে এগিয়ে যাচ্ছি আর ওর মতো প্রতিভাবান ছেলে এমন পিছিয়ে থাকবে কেন?

এখন কি আর ওকে একলা পাবে, এখন ওকে ডাকলে নতুনবউকেও বলতে হবে। সেটা তোমার ভাল লাগবে কি বউ? জ্ঞানদা কাদম্বরীকে কতখানি অপছন্দ করেন সত্যেন সেটা বিলক্ষণ জানেন।

হায়, রাহুগ্রস্ত চাঁদকে কে বাঁচাবে! অনালোকিত কাদম্বরীর গ্রাস থেকে প্রিয় দেওরটিকে কী করে রক্ষা করবেন? চাদে যে গ্রহণ লেগেছে। গভীর বিষাদে মৌন হয়ে যান জ্ঞানদা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *