বিকেল বেলায় আমার দপ্তরের পুবদিকের খোলা জানলা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি শেষবর্ষণের আকাশ, মেঘৈমেদুরম্বর। আর কিছুদিন পরেই বর্ষা। বিদায় নেবে, শরৎ-আকাশে দেখা দেবে হালকা মেঘের গুচ্ছ। পূজা সমাস। শহুরে লোকদের মনের আকাশে ছুটির বাঁশি বেজে উঠবে, শহরের একদল বাইরে বেরোবার জল্পনা-কল্পনায় মুখর, সাজসরঞ্জাম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। আর যারা থাকবে শহরে তারা সার্বজনীন উৎসবের আয়োজনে চাদার খাতা নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় হুড়োহুড়ি লাগাবে, পূজার বাজার নরনারীর ভিড়ে ঠাসাঠাসি। আর আমরা, যারা সংবৎসর পত্রিকার পাতা ভরাবার কাজ নিয়ে কাটাই, এ-সময়টা তাদের কাছে রসকষহীন। মহালয়ার আগেই পূজা সংখ্যা বার করতে হবে, তাও যে-সে আকারের নয়, এক-একখানা পুরু টালি। চল্লিশ পঞ্চাশ ফর্মার একখানি পত্রিকা, তাবৎ স্বনামধন্য সাহিত্যিকদের গল্প-উপন্যাস-কবিতা-প্রবন্ধর এক বিরাট সমাবেশ। শারদীয় সাহিত্যের এই ভূরিভোজনে পাঠকরা গরম গরম গল্প-উপন্যাস পেয়ে ছুটির দিনগুলি আনন্দেই কাটান। কিন্তু এই আনন্দের আয়োজনের পশ্চাৎপটে যে ভিয়েন আছে, তারও আছে একটা বিরাট ইতিহাস। সে-ইতিহাস লেখক আর সম্পাদকের মধ্যে টানা পোড়েনের ইতিহাস। রঙ্গমঞ্চে আপনার যখন অভিনয় দেখবার জন্য উৎসুক হয়ে অপেক্ষা করছেন তখন জানতে পারেন না গ্রীনরুমের আড্ডালে প্রধান-অভিনেতা তখনও অনুপস্থিত, মঞ্চপ্রয়োগকর্তা সজোরে কপালে করাঘাত আর দুই হাতে চুল ছিড়ছেন। শারদীয় সাহিত্যের আয়োজন করতে গিয়ে মঞ্চপ্রয়োগকর্তার মত অবস্থা। হয় পত্রিকা-সম্পাদকদেরও। তারই দুটি কৌতুককর কাহিনী আপনাদের কাছে উপস্থিত করছি।
সাহিত্যিকদের কাছ থেকে রচনা সংগ্রহের তিন দফা পদ্ধতি আছে। প্রথমে আদালতের পরোয়ানার মত পূজার তিন মাস আগে প্রত্যেক সাহিত্যিকের দরবারে একটি লিখিত পরোয়ানা যায় এই মর্মে—
সবিনয় নিবেদন,
শারদীয়া পত্রিকার উদ্যোগ-আয়োজন শুরু হইয়াছে। এই কাজে আপনার সক্রিয় সহযোগিতা সর্বদাই আমরা পাইয়াছি, এবারেও তাহা হইতে বঞ্চিত হইব না, ইহাই আমাদের বিশ্বাস। আপনার কাছে আমাদের একান্ত অনুরোধ, একটি রচনা পাঠাঁইয়া শারদীয়া সংখ্যার সমৃদ্ধি বর্ধনে সহায়তা করুন। আশাকরি, আগামী ৭ই আগস্টের মধ্যে আপনার রচনা আমাদের হস্তগত হইবে। আপনার সম্মতিসূচক পত্র পাইলে কৃতজ্ঞ হইব। ইতি।
ডাকে চিঠি ছেড়ে দিয়ে উত্তরের অপেক্ষায় দিন দশ কাটবে। কেউ কেউ উত্তর দিলেন, অধিকাংশই নীরব। দশ দিন অপেক্ষার পর শুরু হবে সাহিত্যিকদের আস্তানা পরিক্রমার পালা। এক-একদিন এক-একজনের বাড়ি সকাল বেলা গিয়ে অনুরোধ-উপরোধ তাগাদা এমনকি মান-অভিমানের পালাও হবে। একটা উদাহরণ দিই। বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্রর কথাই ধরুন। ভদ্রলোক লেখেন কম, তাই সম্পাদকের বাজারে তার লেখার চাহিদা সর্বাধিক। পূজার মাস-দুই আগে থেকেই প্রতিদিন তার বাড়ির একতলার বৈঠকখানায় দেখবেন এক বিরাট দল বসে আছে। তারা সবাই খ্যাত-অখ্যাত নানা পত্রিকার সম্পাদক। সকলের এক লক্ষ্য, প্রেমেনদার একটা লেখা আদায় করা। মিষ্টভাষী প্রেমেনদা কোন সম্পাদককেই নিরাশ করেন না। কাপের পর কাপ চা খাওয়াচ্ছেন, গল্প করছেন। এমন বিষয় নেই যা নিয়ে তার বৈঠকে আলোচনা হচ্ছে না এবং সরস আলাপে তো তার জুড়ি নেই। কিন্তু পত্রিকার সম্পাদকদের দিনের পর দিন আশা দিয়ে নিরাশ করতেও ওঁর মত দ্বিতীয় কোন সাহিত্যিক আজও আমি দেখি নি। প্রত্যেককেই উনি বলবেন
নিশ্চয় লেখা দেব। যদি মুড আসে তাহলে কবিতাই পাবে। তা না হলে গল্প। এ কথা শোনার পর কোন সম্পাদক না উল্লসিত হবেন। কিন্তু প্রত্যেককেই শেষ পর্যন্ত নিরাশ হতে হয়। আর লেখা লিখতে না পারার এমন যুক্তি উপস্থিত করেন যে দ্বিতীয়বার অনুরোধ করতে সম্পাদকেরই লজ্জা করবে।
একবার তো আমাকে প্রচণ্ড ধমক খেতে হয়েছিল।
সে ঘটনা বলি। পাশের বাড়ির সঙ্গে প্রেমেনদার জানলা নিয়ে মামলা চলছে। তুমুল মামলা। পুবদিকের জানলাটির সামনে এক দেওয়াল তুলে দেওয়ায় এই গণ্ডগোল। এখন, আদালতে প্রমাণ দিতে হবে জানলা আগে না দেওয়াল আগে। মামলার পরিণতি যখন একটা চরম নাটকীয় মুহূর্তে উঠেছে, অর্থাৎ কে-জেতে কে-হারে অবস্থা, যথারীতি লেখার তাগাদায় আমি সকালে প্রেমেনদার বাড়ি হাজির। যাওয়া মাত্রই প্রেমেনদা বলে উঠলেন—
তুমি কত বছর ধরে আমার বাড়ি নিয়মিত আসছ?
এ আবার কী প্রশ্ন? তবু মনে মনে হিসেব করে দেখলাম, বারো বছর হয়ে গেল পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। তাই বললাম—
তা, বারো বছর ধরে পূজা সংখ্যায় লেখা আদায়ের জন্য আপনার বাড়ি নিত্য আসা-যাওয়া করছি।
ভেরি গুড। তাহলে বরাবর তুমি পুবদিকের জানলাটা লক্ষ করে এসেছ?
এসেছি। তবে খোলা অবস্থায় দেখি নি কোনদিন।
সোৎসাহে প্রেমেনদা বললেন, যাক নিশ্চিন্ত হলাম। তোমাকে কিন্তু মামলায় সাক্ষি দিতে হবে। আদালতে গিয়ে শুধু বলতে হবে বারো বছর ধরে পুবদিকের জানলাটা ওইখানে ওই অবস্থায় তুমি দেখেছ।
সাক্ষি দিতে তৎক্ষণাৎ রাজী হয়ে গেলাম। মনে মনে জানি পূজা সংখ্যার লেখা পেতে এবার আর বেগ পেতে হবে না। তাই উৎসাহের সঙ্গে প্রেমেনদাকে যেই-না লেখার কথা বলা আর যাবে কোথায়। চোখ পাকিয়ে প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বললেন–
লজ্জা করে না লেখা চাইতে? দেখছ মামলা-মোকদ্দমায় ডুবে আছি। উকিলবাড়ি আর আদালত-ঘর ছুটোছুটি করে মরছি, তার ওপর আবার লেখা?
যেন লেখা চাওয়াটা মস্ত অপরাধ।
আরেকদিন সকালে শারদীয়ার লেখা আদায়ের আশায় তাঁর বাড়ি বসে আছি, আমার মতন আরও চার-পাঁচ জন আছেন। এমন সময় বিখ্যাত একটি মাসিক পত্রিকার সম্পাদক এসেই প্রেমেনদাকে বললেন—
ছয় বছর ধরে আপনি আমাকে লেখা দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিরাশ করেছেন। এবছর আর ছাড়ছি না। লেখা দিতেই হবে।
উত্তরে প্রেমেনদা বললেন, প্রত্যেক বছরই তোমাকে লেখা দেব বলে ভাবি। কিন্তু এবার বোধ হয় ভাবতেও পারব না।
শারদীয়া পত্রিকার রসদ সংগ্রহের দ্বিতীয় দফা পদ্ধতির উদাহরণ একজন সাহিত্যিককে নিয়েই দিলাম। এরকম ঘটনা অন্যান্যদের নিয়ে যে কত আছে তা আর বলে শেষ করা যাবে না। এর পর হচ্ছে তৃতীয় বা চরম পদ্ধতি। ভোরবেলায় লেখকের বাড়ি গিয়ে অনশন ধর্মঘট করে পড়ে থাকা। কয়েক শিপ লেখা না নিয়ে নড়ছি না। কুঁড়ে লেখকদের কাছে এই পদ্ধতিতেই ফল পাওয়া যায়। একবার লেখায় বসাতে পারলেই হল। তৃতীয় পদ্ধতিতে অবশ্য লেখকদের গৃহিণীরা সম্পাদকের প্রধান সহায় হয়ে থাকেন—এ কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে এখানে উল্লেখ না করলে অপরাধী হতে হবে। ভোর থেকে একটা লোক কুটোটি মুখে না তুলে হত্যে দিয়ে পড়ে আছে, তাতে যে গৃহস্থবাড়ির অকল্যাণ। তাছাড়া কর্তাকে দিয়ে পূজার সময় লেখানো মানেই ইত্যাদি ইত্যাদি। কাজেই সম্পাদকদের প্রতি সাহিত্যিকের গৃহিণীদের সহানুভূতি চিরকালই থাকে।
প্রেমেন্দ্র মিত্রর কাহিনী তো শুনলেন, এবার শুনুন বাংলা-সাহিত্যের আরেক দিকপাল তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনী, শারদীয়া সংখ্যার রচনা সংগ্রহ উপলক্ষ্যে।
শারদীয়া পত্রিকার জন্য লেখা চেয়ে প্রথম দফা পদ্ধতির চিঠি ছাড়ার সাত দিন পরে তারাশঙ্করবাবুর চিঠি এসে হাজির। তিনি লিখেছেন—
পরমকল্যাণবরেষু
সাগরময়, শারদীয়া সংখ্যায় লেখা দেবার জন্য তোমার আমন্ত্রণলিপি পেলাম। তোমাদের সঙ্গে দীর্ঘকাল দেখাসাক্ষাৎ নাই। আগামী বুধবার নয়টার মধ্যে যদি আমার বাড়ি আসতে পার তাহলে সাক্ষাতে কথা হবে। আমার এখান থেকেই তুমি অফিসে চলে যেয়ো। তোমার সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ কামনা করি। ইতি–
চিঠি পেয়েই উত্তরে জানিয়ে দিলাম বুধবার যথাসময়েই আমি তার বাড়ি উপস্থিত হচ্ছি।
আমি থাকি টালিগঞ্জে আর তারাশঙ্করবাবু তখন থাকতেন টালা নয়, বাগবাজারে আনন্দ চ্যাটার্জি লেন-এ, অমৃতবাজার পত্রিকা অফিসের সন্নিকটে। এখন সমস্যা সকাল নটার মধ্যে তার বাড়ি হাজির হতে হলে আমাকে বেরোতে হয় সকাল আটটায়। সুতরাং খেয়ে দেয়ে বেরোনোর প্রশ্নই ওঠে না।
আমার গৃহিণীকে তারাশঙ্করবাবুর চিঠিটা দেখিয়ে প্রশ্ন করলাম তোমার কি মনে হয়? না খেয়েই বেরোব?
গৃহিণী বললেন–খেয়েদেয়ে বেরোনর মত কোন যুক্তি তো চিঠিতে পাচ্ছিনা। অত সকালে ভাত খেয়ে যাবেই বা কি করে।
আমি বললাম,—কেন? এই যে লিখেছেন—আমার এখান থেকেই তুমি অফিসে চলে যেয়ো—এই কথাটার মধ্যে প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতটা ধরতে পারছ না?
অবাক হয়ে গৃহিণী বললেন–এর মধ্যে আবার ইঙ্গিত তুমি পেলে কোথায়।
মেয়েরা গল্প-উপন্যাসের একনিষ্ঠ পাঠিকা হতে পারেন কিন্তু তারা যে আভাস-ইঙ্গিত বোঝেন না বা বুঝতে চান না এ ধারণা আমার অনেককালের এবং তা বদ্ধমূল। তাই গৃহিণীকে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ঠাট্টা করে বললাম–স্ত্রীবুদ্ধি কি শাস্ত্রে বলে সাধে। ইংরেজীতে একটা কথা আছে—টু রীড বিটুইন দি লাইনস। সে-ভাবে যদি পড়তে জানতে তাহলে তোমার চোখে ও-দুটি লাইনের মাঝে চারটি ডাল-ভাত খেয়ে কথাটা জ্বলজ্বল করে ফুটে উঠত।
গৃহিণী আর কথা বাড়ালেন না। বদ্ধি নিয়ে ইঙ্গিত করলে তিনি নীরব থাকাই পছন্দ করেন।
বুধবার সকালে তাড়াহুড়ো করে স্নান সেরে বেরোতে যাচ্ছি, গৃহিণী একথালা লুচি আর বেগুনভাজা এনে বললেন–পেট ভরেই খেয়ে যাও, সাহিত্যিকদের কথায় আমার বেশি ভরসা নেই।
স্ত্রীবুদ্ধি সম্বন্ধে আরেকবার নিঃসন্দেহ হয়ে গোটা-দুই লুচি মুখে পুরে রওয়ানা হলাম বাগবাজার অভিমুখে।
আনন্দ চ্যাটার্জি লেন-এ তারাশঙ্করবাবুর বাড়িতে যখন উপস্থিত হয়েছি তখন প্রায় নটা বাজে। কড়া নাড়তেই দরজা খুলে দাঁড়ালেন স্বয়ং তারাশঙ্করবাবু। অনাবৃত দেহে শ্বেতশুভ্র উপবীত যেন ঘনকৃষ্ণ মেঘের গায়ে বিদ্দুল্লতা।
প্রণাম করতেই বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন–তোমার জন্যই অপেক্ষা করছি, এস, এস, বস।
আমাকে চেয়ারে বসিয়েই ভিতরের ঘরের দরজার কাছে গিয়ে চেঁচিয়ে বললেন, সনৎ, শীগগির প্লেট নিয়ে আয়, সাগর এসেছে।
তাহলে ডাল-ভাত নয়, জলযোগের ভূরি আয়োজনই হয়েছে অনুমান করলাম। কিন্তু বসতে না বসতেই খেতে হবে? পূজা সংখ্যার লেখা সম্পর্কে কোন কথাই হল না। অথচ আসা মাত্রই খাওয়া? আর, এ খাওয়ানোর উপলক্ষ্যটাই বা কি। প্লেট-এর বন্দোবস্ত যখন, তখন উপলক্ষ্য একটা কিছু আছেই। সেক্ষেত্রে অন্যান্য আমন্ত্রিতরাই বা কোথায়? তারা কি আগেই খাওয়া-দাওয়া সেরে চলে গেল? গৃহিণীর উপর রাগ হতে লাগল। এসেই যদি খেতে বসতে হবে তাহলে বাড়ি থেকে বেরোবার সময় লুচিই বা গিলতে গেলাম কেন? সাত-সতেরো প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরছে, তারাশঙ্করবাবু তখনও দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পরিত্রাহি চেঁচিয়ে বলছেন—
সনৎ, দেরি করছিস কেন? প্লেট-টা তাড়াতাড়ি নিয়ে আয়। কতক্ষণ সাগরকে বসিয়ে রাখব।
খুবই অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম আমাকে খাওয়াবার জন্যে ওঁর ব্যস্ততা দেখে। মৃদুস্বরে বললাম
আপনি ব্যস্ত হচ্ছেন কেন। আসুন গল্পগুজব করি। ওটা পরেই হবে। আমার তো তেমন কিছু তাড়া নেই।
আরও ব্যস্ত হয়ে উনি বলে উঠলেন– না না, সে কি করে হয়। যে-জন্যে তোমাকে ডেকে পাঠালাম আগে সেটা সেরে নাও, পরে গল্প করা যাবে।
কথা শেষ হতে না হতেই তারাশঙ্করবাবুর জ্যেষ্ঠ পুত্র সৌম্যদর্শন সনৎ হন্তদন্ত হয়ে ঘরে এসে উপস্থিত, হাতে বৃহদাকারের একটা কালো খাম।
খাম দেখে আমি তো উল্লসিত। যেন হাতে স্বর্গ পেয়ে গেছি। পূজা সংখ্যার গল্প তাহলে লেখা হয়ে গেছে? মধুর বিস্ময়ে আমার দুই বিস্ফারিত চোখ খামের অভ্যন্তরে গল্পের পাণ্ডুলিপি দেখবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। পুত্রের হাত থেকে খামটা নিয়েই তারাশঙ্কর বাবু চলে গেলেন পুবদিকের খোলা জানলাটার কাছে। আমাকে বললেন–
জানলার কাছে সরে এস, আলো না হলে দেখতে অসুবিধা হবে।
ওঁর পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই তারাশঙ্করবাবু খামের ভিতর হাত ঢুকিয়ে ফস করে টেনে বার করলেন একটা প্লেট। সেই বিখ্যাত প্লেট যার গল্প বহুবার আমাকে অনেক বৈঠকে বলতে হয়েছে, তা আপনাদের আজ শোনাতে বসেছি। খামের ভিতর থেকে একটি এক্স-রে প্লেট বার করে তারাশঙ্করবাবু সেটা চোখের উপর সূর্যকে আড়াল করে মেলে ধরলেন। একটি শীর্ণকায় মানুষের নাড়ীভুড়ি সমেত জট-পাকানো জঠরের ছবি চোখের উপর ভেসে উঠল। মানচিত্রের উপর ছড়ি বুলিয়ে মাস্টারমশাই যেমন ভূগোল পড়ান, প্রায় তেমনি ভাবেই তারাশঙ্করবাবু আঙুল বুলিয়ে আমাকে উদরের ভূগোল শেখাতে লাগলেন। গলার কাছে আঙুল ধরে বলে চললেন—
কণ্ঠনালী দেখতে পাচ্ছ? এই হচ্ছে কণ্ঠনালী। আমরা যখন আহার করি তখন তা এই কণ্ঠনালী দিয়ে পাকস্থলীতে এইভাবে ঘুরে আসছে। ছবির একেবারে তলায় ওটা হচ্ছে পায়ু। পাকস্থলী থেকে খাদ্যবস্তু এখান দিয়ে নিঃসারিত হয়। স্বাভাবিক লোকের পাকস্থলী থেকে পায়ুদ্বারে খাদ্যবস্তু এসে পৌঁছুতে লাগে ছয় ঘণ্টা, আমার লাগছে চার ঘণ্টা। নিজের চোখেই তো দেখলে আমার শরীরের অবস্থা। এক্স-রে করিয়েছি, চিকিৎসাও চলছে, এখন ডাক্তারের কথাতেই দিন-সাতেকের মধ্যে চেঞ্জে যাচ্ছি দাজিলিং-এ। এই অবস্থায় পূজা সংখ্যায় এবার তো লিখতে পারব না ভাই। এমনি বললে তো আর বিশ্বাস করতে না, ভাবতে, আমি ফাঁকি দিচ্ছি। তাই ডেকে পাঠিয়েছিলাম।
জট পাকানো নাড়ী-ভুড়ির ছবি দেখে আমার নাড়ী-ভুড়ি উল্টোবার অবস্থা। অফিসের জরুরী কাজের অছিলায় তখন বেরোবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে বিদায় চাইলাম।
বিস্মিত হয়ে তারাশঙ্করবাবু বললেন—এর মধ্যেই উঠবে কি, এক কাপ চা অন্তত খেয়ে যাও।
আমি প্রবল আপত্তি জানিয়ে বললাম-না চা আর এখন খেতে পারব। একটু আগেই বাড়ি থেকে পেট ভরে খেয়েদেয়ে বেরিয়েছি।
বাগবাজারের মোড়ের লড়াইয়ে চপের দোকানের সামনে এসে ঢুকব কি না ভাবছি, চোখের উপর ভেসে উঠল সেই এক্স-রে প্লেট। আর কালক্ষেপ না করে বাসেই চেপে বসলাম।
আপনাদের কাছে কবুল করতে লজ্জা নেই, স্ত্রীবুদ্ধি সম্বন্ধে আমার সেই বহুকালের ধারণাটা সেদিনের ঘটনার পর বাধ্য হয়েই বদলাতে হয়েছে।