বাড়িতে পৌঁছতে পৌঁছতে এগারোটা গড়িয়ে গেল। তাদের পুরনো ইট-বেরকরা দেওয়ালের দিকে তাকাল সে কিছুক্ষণ। মালবিকা নামে মেয়েটির বাড়ি থেকে খুব বেশি কিছু আলাদা? না। ক্ষয়িষ্ণুতার দৌড়ে পিছিয়ে নেই দেওয়াল। তবে কজাগুলো আজও শক্তিমান। এখনও আলগা করেনি বাঁধন। জানালাদের ঝুলে পড়তে দেয়নি।
কত দিন রং হয় না বাড়িটায়। ছাদ থেকে, দেওয়াল থেকে মেঝে অবধি মেরামতির প্রয়োজনীয়তা প্রকাশিত। বর্ষাকালে ঝর্নার মতো জল গড়ায় ছাদ থেকে। নোনা ধরে গেছে দেওয়ালে। দরজা-জানালা বিবর্ণ। মেঝের মসৃণতা হারিয়ে গিয়েছে পায়ে পায়ে। এক রিক্ততার হাড়-জিরজিরে অস্তিত্ব।
মেরামতি আর হবে না। কেমন করে হবে। সব অর্থ বাবা আর বোনের ওষুধে, ডাক্তারে এবং দৈনন্দিন জীবনযাপনে ফুরিয়ে যায়। এতটুকুও উদ্বৃত্ত নেই। বরং প্রতি মাসে টান পড়ে। প্রতি মাসে বিজ্ঞাপমেয় সংগ্রহ থেকে সরাতে হয়। আবার পরের মাসের মাইনে থেকে পুষিয়েও দিতে হয়। অভাবের চক্র তাই মাসে মাসে আবর্তনই করে।
তার মনে হয়, তারা প্রত্যেকেই এই বাড়িটারই মতো নোনাধরা, ফেটে যাওয়া, পলেস্তারা খসা মানুষ। তাদের বেঁচে থাকাটা নিতান্তই অর্থহীন। প্রাণ যেন ঝুলে রয়েছে গলায়। আরও কিছু বিপর্যয় এলেই দেহত্যাগ কবে।
দরজায় শব্দ করে সে, আর দরজা খুলে যায়। মা। বিরক্ত, অপ্রসন্ন মুখে ঝুলকালির মতো লেগে আছে প্রশ্নটা। লেগে আছে, কিন্তু উচ্চারিত হচ্ছে না। হবে না শুভদীপ জানে। রোজগার করে বলেই এই সংসার তাকে দেয় কিছু বাড়তি সুবিধা, সম্রম। কিছু বাড়তি গুরুত্বও, যা তার বাবা পেয়ে আসত আগে। কবে থেকে সে এই পদে অভিষিক্ত হল জানতেও পারেনি। সংসার প্রচলিত নিয়মে তাকে একটি পদমর্যাদা দিয়েছে। সে নিজে এই পদ বা মর্যাদা চায় কি চায় না সেটা কোনও কথাই নয়। পৃথিবীর সর্বত্র মানুষের হাতে পায়ে অজস্র শিকল। ক খ-এর চেয়ে স্বাধীন। খ গ-এর চেয়ে। কিন্তু ক খ গ কেউ সীমাহীন স্বাধীনতা লাভ করে না। সম্পূর্ণ স্বাধীনতা নেই কোথাও, ছিল না কখনও। হবে কি না একমাত্র বলতে পারে মহাকাল। কিল মহাকালের সঙ্গে কথােপকথন করবে কোন শক্তিমান?
অতএব পৃথিবীর সর্বত্র মানুষের হাতে-পায়ে অদৃশ্য শেকল। চলনেবলনে অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ। কে কী চায়, কী পথ, কোন জীবন, কী পেশা, কোন সংগীত–সেই সব আর্ত চিৎকার বাতাসে বাতাসে বাজে। তার অদৃশ্য হাত মানুষকে ঠেলে দেয় ছোট্ট বলের মতো। গড়িয়ে দেয় যে-দিকে তার খুশি আর গড়ান নিয়ন্ত্রণ করে না। এমনকী লোফালুফি করে যখন যেমন ইচ্ছে।
এই যে সে, শুভদীপ, সে নিজের ইচ্ছেয় জন্মায়নি, নিজের ইচ্ছেয় শুভদীপ ভট্টাচার্য হয়নি। নিজের ইচ্ছেয় বনে যায়নি নিম্নবিত্ত সংসারের মুকুটহীন অধিপতি। অসংখ্য ভারী, অনপনেয় দায়বদ্ধতা তার ওপর আরোপ করা হয়েছে। কিছু পূর্বনির্ধারিত রীতি অনুসারে, কিছু বর্তমানের তাগিদে। তার জন্য তাকে দেওয়া হয়নি কোনও সতর্কবার্ত। কোনও প্রস্তুতির সময়। যেন এই দায়বদ্ধ করা–এক অধিকার। আর অধিকারের অন্য পিঠে সেই কঠিন বন্ধন। কিন্তু এই অধিকার, এই বন্ধনও নিত্য নয়। চিরস্থায়ী নয়। বাঁধন ওঠে, ছেড়ে, ছিঁড়ে দেয়। অধিকঞ্জবোধ জাগে, পরিণত হয় এবং টুটে যায় একদিন।
সুবল, টিয়ার, জাত, খাঁচায় বসে ঘুমোচ্ছিল। শুভদীপের সাড়া পেয়ে ঘুমন্ত চোখ খুলল। শব্দ করল একবার। আবার ঘুমিয়ে পড়ল। ঘরে এল সে। প্রতিদিনের থেকে এতটুকু আলাদা নয়। যেন একটি দিন আরেক দিনকে নকল করছে মাত্র। যত ক্ষয়, যত বদল, যত গড়ে ওঠা–এতখানি বিন্দু বিন্দু পর্বে-নজরে আসে না। অনেকখানি বড় হয়ে গেলে মনে হয়, প্রস্তুতির সময় কঠিন বন্ধন। কিও দেয়। অধিক এ কী! এ কেমন করে হল! কবে হল!
নিভু নিভু আলো জ্বলছে। বাবার জন্য। খেয়ে-দেয়ে ঠিক দশটায় ঘুমিয়ে পড়ে বাবা। আর মা জেগে থাকে। ঘুমোয় এবং ঘুমের মধ্যেও জেগে থাকে। গত দশ বছর ধরেই এমন। এখন মা আয়ত্ত করেছে নিজস্ব ঘড়ি। কোনও যন্ত্র ছাড়াই ঠিক সময়ে ঘুম ভেঙে যায় মার। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়া মায়ের সঙ্গে স্নাতক ও কারিগরি বিদ্যায় পারদর্শী বাবার বিয়ে হয়েছিল। সমস্ত জ্ঞান এবং পারদর্শিতা নিয়ে বাবা শুয়ে আছে বছরের পর বছর। আর মা বেঁচে থাকার যন্ত্র ও কৌশল আবিষ্কার করছে প্রতিদিন।
বাবার এতটুকু কষ্ট যাতে না হয় তার জন্য আলো নিবিয়ে দেয় মা। দুজনের বয়সের পার্থক্য প্রায় পনেরো বছর। কিন্তু এখন মাকে বাবার সমবয়সী লাগে। বিছানায় শুয়ে পড়ার পর বাবা ধীরে ধীরে মরছে। মা দ্রুত।
কয়েক বছর আগেও তাদের তিন ভাইবোনের কারও না কারও পড়ার প্রয়োজন থাকত। তখন তারা পাশের ঘরে চলে যেত। শরিকি বাড়ি ভাগবাঁটোয়ারার পর এই ঘরখানা তারা পেয়েছে রসুই হিসেবে। ছোট নিচু স্যাঁতসেতে ঘর। একটি মাত্র জানালা। দেওয়ালের একদিকে তাক। তাতে মায়ের রান্নার সরঞ্জাম। জানালা বরাবর গ্যাসের উনুন রাখার টেবিল। বাড়তি একফালি জায়গায় একটা খাট। তারা দু’ভাই তাতে গা ঘেঁষাঘের্ষি শুয়ে থাকে সারা রাত। একজন চিৎ হলে অন্যজনকে পাশ ফিরতে হয়।
খাটের পা-গুলি ইটের ওপর ইট সাজিয়ে উঁচু করা। নীচে জলের পাত্র, চালের ভাঁড়ার, হাঁড়িকড়াই, আনাজ, ছাতা, বঁটি, ময়লা ফেলার পাত্র। বর্ষায় উঠোনের জমা জল হুড়মুড় ঢুকে পড়ে। এই বিছানার ওপর তখন সব তুলে দেওয়া হয়। তারা দু’ভাই পা-ডােবা জলে দাঁড়িয়ে মগ দিয়ে জল ঘেঁচে। আর রাত্রে তখন পাঁচজন এক বিছানায় শোয়। বড় ঘরের বড় বিছানায় পাথালি দিয়ে শোয়। মশারিতে পালৈগে যায় বাবার এবং দু’ভাইয়ের। তারা পা গুটিয়ে শোয়। সারা রাতটান করতে পারে না।
আর এইসব জলহেঁচার কাজে, জিনিসপত্র টানাটানির কাজে দীপান্বিতা ভট্টাচার্যকে তারা নেয় না কখনও। দীপান্বিতা তখন শুচু হয়ে বড় ঘরের খাটের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে থাকে চুপচাপ। কারণ, জল ঘাঁটাঘাটি করলেই ওর জ্বর এসে যায়। সারতে চায় না। তাই শুচুকে ভারী কাজ করতে দেওয়া হয় না। রান্নাও করতে দেওয়া হয় না। মার হাতে হাতে টুকটাক করে। সুবলকে খেতে দেয়। সুবলের খাঁচা পরিষ্কার করে। সুবল একমাত্র ওকেই কামড়ে দেয় না তখন। ওর হাতে মাথা ঘষে অস্ফুট শব্দ করে। শুচু তখন মহীনের ঘোড়াগুলির গান শোনায় সুবলকে …সেই বাড়ির নেই ঠিকানা। শুধু অজানা লাল সুরকির পথ শূন্যে দেয় পাড়ি। আকাশে ছড়ানো মেঘের কাছাকাছি… সুবল তার থেকে বেছে নেয় কিছু পছন্দমতো শব্দ। আর আওড়ায় সারাদিন।
কোনও ভারী কাজ করার শক্তিই নেই শুচুর। ওর মধ্যে একটি স্বাভাবিক শীর্ণতা আছে। স্বাভাবিক দৌর্বল্য। Congenital Cynotic Heart Diesease। হৃদযন্ত্রের জন্মকালীন অসুখ।
শীর্ণতার সঙ্গে, নিয়মিত অসুস্থতার সঙ্গে, তারা দেখেছিল, ওর জিভ ক্রমশ নীলচে হয়ে যাচ্ছে। চোখ নীলচে। এমনকী গায়ের রঙেও কালচে নীল ছোপ। যেন বিষ ভরে গেছে শরীরে। চিকিৎসকেরা জানালেন, ওর অলিন্দ ভুলে ভরা, নিলয় ত্রুটিযুক্ত। ওর বিশুদ্ধ রক্তে ঢুকে পড়ছে অশুদ্ধ রক্ত। অস্ত্রোপচার করলে ভাল হতে পারত। কিন্তু তার জন্য চাই এক সমুদ্র টাকা। দুর্ভাগ্য শুচুর। তার বাবার সমুদ্র ছিল না। পুকুরও না। শুধু বালতি একখানা। মাসে মাসে ভরত। আবার খালি হত। এখন ভাইয়ের ঘটিও পূর্ণ হয় না। তার অস্ত্রোপচার কেমন করে হবে! তাই ওষুধ আর ওষুধ আর ওষুধ। মাঝে মাঝে রক্ত দেওয়া। গায়ে চাকা চাকা হয় মাঝে মাঝে। মাথা ঘোরে। জ্ঞান হারায়। মরে যেতে পারে যে কোনও দিন। আধার বেঁচেও থাকতে পারে। বেঁচে আছে যেমন। নীল অপরাজিতার মতো অসম্পূর্ণতায়। কিন্তু ও বেঁচে আছে বলেই, ও যে মূরে যেতে পারে, যেকোনও দিন, সেই সম্ভাবনা মনে রাখে না কেউ। শুচুকে আগলে রাখা অভ্যাস রাখে। যেমন দিনের পর দিন শুধু আলুসেদ্ধ আর ভাত খাওয়া অভ্যাস-খায়। আর সেইসব দিন শুধু বর্ষার জন্য একটু দুধের ব্যবস্থা রাখা। সে-ও অভ্যাসবশে রাখা থাকে অনায়াসে। আর শুচুও এই অসুস্থতা, ওষুধ আর মৃত্যুর সম্ভাবনার ভিতর অভ্যস্ত হয়ে যায় জীবনে। হাঁটা-পথের দূরত্ব ইস্কুলে পড়েছিল সে আর নিকটবর্তী কলেজে নাম লিখিয়েছিল। ডাক্তারের আদেশনামা অনুসারে পরীক্ষা দিয়ে আসত শুধু। আর দেখতে দেখতে তারা স্নাতক হয়ে যায়। তারা তিন ভাই-বোন। বাবার অসুস্থতাজনিত অক্ষমতায় দারিদ্রের দণ্ড তাদের পাঠ ইত্যাদি সম্পর্কে বিরাগ জন্মাতে পারেনি।
এর মধ্যে শুচুকেই বলা যায় বৃহত্তম বিস্ময়। কারণ কলেজে না গিয়ে, কারও সাহায্য না নিয়ে সে একা একা পাশ দিয়েছিল। এমনই, মৃত্যুকে সঙ্গী করে। শীর্ণতার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়েছিল আর গান ভালবেসেছিল। বেশ কিছু ক্যাসেট তাদের সঞ্চয়। বিশ্বদীপ দুটি ছাত্র পড়িয়ে যা পায়, তার থেকে কেনে। হয়তো শুচুর কথা ভেবেই। আর নতুন গান বাজলেই মা টের পায়। কিছুক্ষণ অভিযোগ করে। গান সংসারের তেমন কোনও কাজে লাগে না, যেমন লাগে চাল, ডাল, চালকুমড়ো। শুচু শোনে। বিশ্বদীপও শোনে। কিন্তু চালিয়ে যায় আগের মতো। ক্যাসেটের সংগ্রহ বাড়ে। আর শুচু ঘুরে-ফিরে, সুবলকে খাওয়াতে খাওয়াতে গায় মহীনের ঘোড়াগুলি। শোনে অনেক গান আর খায় শুধু মহীনের ঘোড়াগুলি। হয়তো পঙক্তিগুলি যথাযথ থাকে না। ক্রম বদলে যায়। শব্দও দু-একটা। কিন্তু ও প্রাণ দিয়ে গায়। মোটামুটি স্বরে মোটামুটি করে গায়। আর ওর গান শুনতে শুনতে তাদের সবার মুখস্থ হয়ে যায় গানগুলি। যেমন প্রায়ই সন্ধ্যায় বাবা আর মা টিভি দেখতে থাকলে ও গায় বোেকা বাক্সের গান। মা তখন বিরক্ত হয়। দারিদ্রের দুঃখ অপনোদনের এই এক মাধ্যমের কাছে বসে মা বড় নিবিষ্ট হয়ে যায়। আর শুচু উঠোনে ঘুরে ঘুরে, সুবলের খাঁচার কাছে দাঁড়িয়ে, কলপারের কাছে গজানো সন্ধ্যামণি ফুলের দিকে তাকিয়ে গাইতে থাকে।
পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে
স্যাটেলাইট আর কেবলের হাতে
ড্রয়িংরুমে রাখা বোকা বাক্সতে বন্দি
আ-হা-হা-আ–হা
ঘরে বসে সারা দুনিয়ার সাথে
যোগাযোগ আজ হাতের মুঠোতে
ঘুচে গেছে দেশকাল-সীমানার গণ্ডি
আ-হা-হা-আ–হা
ভেবে দেখেছ কি তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে
তারও দুরে তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে
শুচুর অসুখ ধরা পড়ার পর দশ বছর সুস্থ ছিল বাবা। তারপর তার স্নায়ু বৈকল্য হয়। মনস্তাত্ত্বিক জটিলতাও থাকতে পারে। কারণ সংসারের শ্রীমুখে কালির প্রলেপ লাগছিল শুচুর অসুখ ধরা পড়ার পরই। হতে পারে তার জন্য কিংবা কোনও অজ্ঞাত কারণে নিজেকে গুটিয়ে গুটিয়ে এতটুকু করে বাবা পুরোপুরি ঘরের মধ্যে সেঁধিয়ে গেছে। তার আগে পর্যন্ত শুচুর সমস্ত তত্ত্বাবধান সেই করত। বাবার হাত থেকে অতঃপর শুচুর দায়িত্ব চলে আসে শুভদীপের হাতে। শুচুর দায়িত্ব এবং শুচুর সঙ্গে সঙ্গে গোটা সংসারেরও ভার। এ যেন সেই জ্বলন্ত মশাল দৌড়। মশাল নিভবে না। দৌড় থামবে না। শুধু বাহকরা বদলে বদলে যাবে। শুভদীপ জানে, সে যদি মরে যায়, এই ভার নেবে বিশ্বদীপ।
ইদানীং শুচুকে আরও শীর্ণ মনে হয়। উচ্চারণেও সামান্য জড়তা এসেছে। জিভ, যেন আড়ষ্ট। নড়তে চায় না। শুভদীপ দুটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কথা শুনেছে। হৃদযন্ত্রের অস্ত্রোপচারের জন্য যারা দুঃস্থদের অর্থ সাহায্য করে। সে যাবে। ভেবেছে। কিন্তু ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না তারা দুঃস্থ কি না। দুঃস্থ বলতে যে দৃশ্য আসে, তাদের তেমন নয়। তাদের দরিদ্র জীবনযাপনের গায়ে মধ্যবিত্ততার মায়া বুলানো আছে।
অতএব সে ভাবছে। সাহায্য পেলে শুচুকে নিয়ে সে চলে যেত দক্ষিণে। ভোের শহরে। আর সারিয়ে আনত। ভেলোরে যারা যায়, সবাই সেরে ফিরে আসে। এমনকী এ শহরের প্রধান প্রধান চিকিৎসকরা যাদের জবাব দিয়ে দেন—তারাও। এমনই এক কিংবদন্তি এখন। অতএব সে ভাবছে। ভাবে। যাবে। বলবে তার সাহায্য চাই। ভাবো কিন্তু যেতে পারে না।
বেশ বড়সড় চেহারার বাবা ও সাধারণ মাপের মায়ের সঙ্গে বড় ঘরের বড় বিছানায় বেশ এঁটে যায় শুচু। এই বড় ঘর তার নিজস্ব পরিমাপের চেয়েও, এ সংসারে আরও অনেক বড় হয়ো দেখা দিয়েছে আসলে। এ ঘরেই তাদের সমস্ত। সব বসবাস। টিভি, খাট, আলনা, আলমারি, সাজার টেবিল, জলছাঁকনির বাক্স, টেপরেকর্ডার, ক্যাসেট, কাঁসা-পেতলের বাসন, বসার চেয়ার, বই, ছবি। বস্তুসামগ্রী ঢোকাতে ঢোকাতে এত ঠাসাঠাসি–কোনও কিছুকেই আর নাড়ানো যাবে না। ঘরে ইদুরের ইন্তেকাল হলে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।
একটি অমোঘ প্রশ্নের জন্য অপেক্ষাকরছিল শুভদীপ। এ প্রশ্ন আর মা মুখে ঝুলিয়ে পথ ছেয়ে দাঁড়াবে না। উচ্চারণ করবে। সে কী জবাব দেবে জানে না। স্পষ্ট কোনও জবাব না দিলেও চলে। সে বলবে, কাজে লেগেছে। কাল ওষুধ এনে দেবে। পর্যটন সংস্থায় যাবে আর টাকা পাবে। সে টাকা থেকে ওষুধ কিনবে। মাসের শেষ হলেই… সেই আবর্তন। সেই দুষ্টচক্র। শেষ পর্যন্ত আবার সংসারের ভাঁড়ারে টানাটানি। আর ঘ্যানঘ্যানানি বাড়বে। বিরক্তি বাড়বে। গোটা জীবনযাপন নির্বোধ চাহনিতে, হাঁ-মুখে তাকিয়ে থাকবে তার দিকে। তাকিয়েই আছে সারাক্ষণ। এই যে মৃত্যুকেই সে ভেবে বসে আছে পরমু মোক্ষ, চিরনারীর কোলে সে আশ্রয় নেবে–এমনই ভেবে চলেছে নিরন্তর, আর তা বাস্তবায়িত করতে পারছে না, তার কারণ হতে পারে এই হাঁ-মুখ সংসার। যেখানে সে প্রায় অপরিহার্য এখন। দশচক্রে ভগবান।