হীরুকে ঘণ্টাখানিক ধরে একতলা একটা টিনের ঘরের আশপাশে ঘুরঘুর করতে দেখা যাচ্ছে। এই এক ঘণ্টায় বাড়ির কাছাকাছি এসে কয়েকবার তীক্ষ্ণ শিস দিয়েছে। দুবার ইটের টুকরা টিনের চালে ফেলেছে। এসব হচ্ছে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা। চেষ্টায় কোনো ফল হচ্ছে না। কেউ বেরুচ্ছে না বা জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে না।
বাড়িটা ইসমাইল সাহেবের।
ইসমাইল সাহেব মীরপুর কৃষি ব্যাংকের ক্যাশিয়ার। তাঁর ছয় মেয়ে। এই ছ’মেয়ের তৃতীয়জনের নাম এ্যানা। এ্যান্য এই বছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। রেজাল্ট হয়নি। এখন রেজাল্টের জন্যে অপেক্ষার কাল চলছে। হীরুর শিস এবং চালে ঢিল সবই এ্যানার উদ্দেশ্যে। তৃতীয় দফায় ঢিল এবং শিস দেবার সঙ্গে সঙ্গে বসার ঘরের একমাত্র খোলা জানালাটাও বন্ধ হয়ে গেল। হীরু চাপা গলায় বলল, হারামজাদী। রাগে তার গা জ্বলে যাচ্ছে। এ্যানার কাণ্ডকারখানা সে ঠিক বুঝতে পারছে না। হারামজাদী আজ বেরুচ্ছে না কেন? বাবা বাসায় আছে নাকি?
হীরু রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পরপর তিনটা স্টার সিগারেট খেয়ে ফেলল। বুক পকেটে একটা বিদেশী ফাইভ ফাইভ আছে। সে ঠিক করে রেখেছিল–এ্যানা বের হলে এটা ধরানো হবে। এখন মনে হচ্ছে হারামজাদী বেরুবে না। অবশ্যি তার হয়ত দোষ নেই। ছোটলোক বাপ হয়ত ঘরে বসে। আছে। এই ছোটলোকটা প্রায়ই অফিস কামাই করে। ঘরে বসে বসে ঝিমায়। যার ছটা মেয়ে এবং সাত নম্বর মেয়ে স্ত্রীর পেটে বড় হচ্ছে তার বিমানো ছাড়া গতি কি? হীরু কয়েকবার দেখেছে এ্যানার মাকে। রোগা কাঠি। শ্যাওড়া গাছের ডালে এলোচুলে বসে থাকলেই এ মহিলাকে বেশি। মানাতো। তা না করে তিনি কল্যাণপুরের একটা টিনের ঘরে বাস করেন এবং ভাঙা গলায় সারাক্ষণ ছয় কন্যাকে বকাঝকা করেন। হীরু নিজেও একবার বিকা খেয়েছে।
এ্যানাদের বসার ঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সে একবার ছোট্ট করে শিস দিতেই এই মহিলা জানালা দিয়ে মুখ বের করে বললেন, এই ছেলে তুই কি চাস?
হীরু হতভম্ব!
এই যুগে তার বয়েসী কোনো ছেলেকে কোনো মেয়ের বা যে তুই করে বলতে পারে তা সে কল্পনাও করেনি। সে এতই অবাক হল যে মুখ দিয়ে কথা বেরুল না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। ভদ্রমহিলা তার ভাঙা গলায় তিনবার বললেন, চাস কি তুই? রোজ জানালার সামনে শিস! জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলব।
হীরু থেতমত খেয়ে বলল, কিছু চাই না ম্যাডাম। একটা অ্যাডড্রেস খুঁজছি। সতের বাই তিন। ইকবাল সাহেবের বাসা। এটা কি ইকবাল সাহেবের বাসা?
মহিলা খট করে জানালা বন্ধ করে দিলেন। হীরুর প্রায় ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার মত অবস্থা। একি যন্ত্রণা!
এই বাড়ির মেয়েগুলিও হয়েছে মায়ের মত। সব কটা মেয়ে পুরুষদের মত গলায় কথা বলে। চেহারাও পুরুষদের মত। হাবভাবও সে রকম। হীরু যে এদের একজনের জন্যে রোজ এতটা সময় নষ্ট করে এতেই এদের কৃতাৰ্থ থাকা উচিত। হীরুর ধারণা নরম্যাল পদ্ধতিতে এদের একটারও বিয়ে হবে না। প্ৰেম-টেমা করে যদি দু’একটা পার পায়। অথচ বাপ-মা এই জিনিসটাই বুঝে না।
এ্যানার বাবা ইসমাইল সাহেবের কাজকর্ম একজন জেলের সুপারিনটেনডেন্টের মত। যতক্ষণ বাসায় থাকবেন কোনো মেয়ে ঘর থেকে বেরুতে পারবে না। উকি-কুঁকি দিতে পারবে না। ঘরের জানালা থাকবে বন্ধ। আজকের লক্ষণও সে রকম। হীরু ঠিক করল। মীরপুর গিয়ে দেখে আসবে। ভদ্রলোক অফিসে গেছেন না। ছুটি নিয়ে বাসায় বসে আছে। যদি অফিসে না গিয়ে থাকেন তাহলে তো কিছুই করার নেই। আর যদি দেখা যায়। ভদ্রলোক অফিসেই আছেন তাহলে আরেকটা এটেম্পট নেয়া যায়। এত সহজে হাল ছেড়ে দেয়া ঠিক না।
ভদ্রলোক অফিসেই আছে। বিশাল চেহারা। ব্যাঙের চোখের মত বড় বড় চোখ। কচকচ করে পান খাচ্ছে। হীরু মনে মনে বলল, খাঁ ব্যাটা পান খা। আর প্রতি বছর একটা করে মেয়ে পয়দা করা। বলেই হীরুর মনে হল–বলাটা ঠিক হল না। তার শ্বশুর হবার একটা ভীষণ সম্ভাবনা এই কোলা ব্যাঙের আছে। হবু শ্বশুর সম্পর্কে এরকম মন্তব্য করা ঠিক না। শ্বশুরদের সম্পর্কে ভক্তিশ্রদ্ধা থাকা দরকার। তবে এই লোক তার শ্বশুর হলেও বিপদ আছে। ঈদের দিন কোলাকুলি করতে হবে।
হীরু একটা রিকশা নিয়ে নিল। মীরপুর থেকে কল্যাণপুর ফেরার এই সময়টায় বাসে গাদাগাদি ভিড় থাকে। এ্যানার সঙ্গে দেখা হবে ভেবে ইস্ত্রী করা শার্ট পরে এসেছে। চাপাচাপিতে শার্ট ভর্তা হয়ে যাবে। রিকশা ভাড়ায় বাড়তি টাকা চলে যাচ্ছে। উপায় আর কি?
এ্যানার সঙ্গে তার পরিচয় দীর্ঘদিনের নয়। আড়াই মাসের মত। পরিচয় পর্বটা খারাপ না। এসএসসি পরীক্ষায় দ্বিতীয় দিন। হীরু মীরপুর রোডে এসে দাঁড়িয়েছে কি করবে। ঠিক বুঝতে পারছে না। বছর তিন চারেক আগে এই সময়ে মেয়েদের স্কুলে নকল সাপ্লাই করত। বয়সের কারণে এটা এখন মানায় না। তবু পরীক্ষার সময় গম্ভীর মুখে একবার ঘুরে আসে। অনেক দিনের অভ্যাস। চট করে ছাড়া মুশকিল।
হীরু ভাবছিল কোন স্কুলে যাবে। আশপাশের সব কটা সেন্টার ঘুরে দেখা দরকার। রোজ রোজ একই সেন্টারে যাবার কোনো মানে হয় না। এই রকম যখন তার মনের অবস্থা তখনি এ্যানাকে তার চোখে পড়ল। বেচারী রিকশা পাচ্ছে না। কোনো রিকশা নেই। যাও আছে যাত্রী বোঝাই। মেয়েটা ছোটাছুটি করছে রিকশার জন্যে। ব্যাপারটা দেখতেই হীরুর বেশ মজা লাগছে। মেয়েটা দারুণ ভয় পেয়েছে। তার হাত থেকে এক সময় জ্যামিতি বাক্স পড়ে গেল। চাদা, কম্পাস এসব ছড়িয়ে পড়ল। চারদিকে। সে বসে বসে এইসব তুলছে এবং চোখ মুছছে।
একটা রিকশাওয়ালাকে পাওয়া গেল–সে দশ টাকা ভাড়া চায়। মেয়েটার সঙ্গে বোধ হয় দশ টাকা নেই। সে অনুনয়-বিনয় করছে সাত টাকায় যাবার জন্যে।
হীরুর এতক্ষণ বেশ মজাই লাগিছিল এখন খানিকটা খারাপ লাগল–সব এসএসসি পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে কয়েকজন করে আত্মীয়-স্বজন থাকে। ও যাচ্ছে একা এবং সঙ্গে দশ টাকাও নেই।
হীরু তখন এগিয়ে গেল। গলার স্বর যথাসম্ভব গভীর করে বলল, খুকী আমার কাছ থেকে দশটা টাকা নিয়ে নাও। এক সময় দিয়ে দিলেই হবে। আমি এই দিকেই থাকি।
মেয়েটি শীতল চোখে খানিক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, আমার কাছে টাকা আছে। আর যদি নাও থাকে। আপনার কাছ থেকে নেব কেন?
হীরু হতভম্ব। নিজেকে সামলে নিতে সময় লাগল। মেয়েটি বলল, পাঁচ টাকা ভাড়া হয় আমি শুধু শুধু তাকে দশ টাকা দেব কেন?
তা তো বটেই। তবে দেরি হয়ে যাচ্ছে না?
হোক দেরি।
তোমার কোন স্কুলে সিট পড়েছে?
মেয়েটি জবাব না দিয়ে বিদ্যুৎবেগে এগিয়ে গেল। একটা বাস এসে থেমেছে। বাসে যথেষ্ট ভিড়। বাস স্ট্যান্ডেও অপেক্ষমাণ ছোটখাটো জনতা। মেয়েটি সেই ভিড় কাটিয়ে বাসে উঠে পড়ল।
দূর থেকে হীরু মনে মনে বলল–সাবাস। বলেই তার খেয়াল হল যে তার পকেট ফাঁকা একটা টাকাও নেই। মেয়েটা যদি তখন বলত–দিন দশটা টাকা, তাহলে উপায়টা কি হত?
মেয়েটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হতে বেশি সময় লাগল না। দেখা হলে সে কথা বলে। হীরু ঘুরিয়েফিরিয়ে দু’একটা রোমান্টিক কথাও বলেছে তেমন কোনো রি-অ্যাকশান অবশ্যি তাতে বোঝা যায়নি। এর মধ্যে একটা ডায়ালগ ছিল এ রকম আজ তো তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।
মেয়েটি হেসে ফেলল বলেছে–শুধু শুধু মিথ্যা কথা বলেন কেন? যে সুন্দর না তাকে সুন্দর বললে তার খুব খারাপ লাগে . এটা আপনি জানেন?
মেয়েটার এইটাই হচ্ছে একটা সমস্যা। ফটফট করে কথা বলে। বেশি চালাক। মেয়েছেলের বেশি চালাক হওয়া ঠিক না।
হীরু এ্যানাদের বাসার ঠিক সামনের রিকশা থেকে নামল। রিকশায় আসতে আসতে সে ঠিক করে। রেখেছে–এ্যানাদের বসার ঘরের জানালার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে কয়েকবার কাশবে। যক্ষ্মারুগীর কাশি না–ভদ্র কাশি। যাতে এ্যানা ভেতর থেকে শুনতে পেয়ে বের হয়ে আসে।
হীরুকে কাশতে হল না। সে দেখল এ্যানা বাসার সামনের দোকান থেকে কি যেন কিনছে। এদের বাড়িতে কোনো কাজের লোক নেই বলে দোকানের টুকটাক বাজার মেয়েদেরই করতে হয়। হীরু এগিয়ে গেল।
এ্যানা আধ কেজি চিনি কিনছে। হীরু গম্ভীর মুখে দোকানদারকে বলল, পাল্লাটা ঠিকমত ধরেন ভাইজান। পাল্লায় ফের আছে? নগদ পয়সায় পারলিক জিনিস কিনবে আর আপনি পারলিককে ঠকাবেন তা তো হয় না।
এ্যানা বলল, নগদ পয়সায় কিনছি না; বাকিতে কিনছি।
বলেই হীরুকে দ্বিতীয় কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সে চিনির ঠোঙা হাতে নিয়ে রাস্তা পার হয়ে গেল। যেন হীরুকে সে চেনে না। যেন হীরু রাস্তার একটা ছেলে। হীরু মনে মনে বলল, হারামজাদী।
তার মন খারাপ হয়ে গেল। আজ দিনটাই তার জন্যে খারাপ। হোতও পুরোপুরি খালি। যে সামান্য কিছু টাকা ছিল তার সবটাই রিকশা ভাড়ায় চলে গেছে। শখানেক টাকা সঙ্গে না থাকলে কেমন অস্থির লাগে। কোথায় পাওয়া যায় টাকা? হীরু দ্রুত চিন্তা করতে লাগল–ঢাকায় ধার চাওয়ার মত আত্মীয়স্বজন কে কে আছে যাদের কাছ থেকে এখনো ধার চাওয়া হয়নি। তেমন কারোর নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। উত্তর শাহজাহানপুরে দূর-সম্পর্কের এক মামা আছেন। তার কাছে যাওয়া যায়। তবে ঐ ভদ্রলোকের নিজেরই দিনে আনি দিনে খাই অবস্থা। ধার চাইতে গিয়ে কোনো বিপদে পড়তে হয় কে জানে।
হীরু জমা করে রাখা বিদেশী সিগারেটটা বের করল। জমা করে রাখার কোন অর্থ হয় না।
সে সিগারেট ধরিয়ে দু’টা টান দিয়েছে তখন দেখা গেল এ্যানা আবার আসছে। এবং তার কাছেই যে আসছে এটাও নিশ্চিত। হীরু ঠিক করে রাখল কোনো কথা বলবে না। যে মেয়ে তাকে অপমান করে, দেখতে পেয়েও না দেখার ভান করে চলে যায় তার সঙ্গে কথা বলার কোনো মানে হয় না।
এ্যানা এসে হীরুর সামনে দাঁড়িয়েছে। মেয়েটাকে হীরুর সত্যি সত্যি সুন্দর লাগছে। যত দিন যাচ্ছে মেয়েটা কি ততই সুন্দর হচ্ছে? তা কেমন করে হয়?
এ্যানা বলল, এরকম বিশ্ৰী করে শিল দিচ্ছিলেন কেন? কতবার না বললাম। এ রকম করবেন। না। আর ছাদে ঢিল মারলেন কেন? এইসব কি?
কথা না বলার প্রতিজ্ঞা টিকল না। হীরু বলল, মন-মেজাজ খুব খারাপ মাথার ঠিক নাই। কি করতে কি করি।
মাথার ঠিক নাই কেন?
আর বলে না, ছোট ভাই মিসিং হয়ে গেছে। দৌড়াদৌড়ি ছোটাছুটি সব তো আমার ঘাড়ে। বড় ছেলে হবার বিরাট যন্ত্রণা।
আপনার ছোট ভাই হারিয়ে গেছে নাকি?
হুঁ, পালিয়ে গেছে। যাকে বলে….
হীরু থেমে গেল। সে পালিয়ে গেছের একটা ইংরেজি বলতে চেয়েছিল–বলতে পারছে না। কারণ পালিয়ে গেছের ইংরেজি তার জানা নেই।
এ্যানা বলল, পুলিশকে খবর দিয়েছেন?
না, পুলিশ-ফুলিশে হবে না। পীর সাহেবের কাছে যেতে হবে। কলতা বাজারের পীর। জ্বীন সাধনা আছে। আমার সঙ্গে খুবই খাতির। অত্যন্ত স্নেহ করেন।
এ্যানা বলল, আপনাকে স্নেহ করেন? আপনাকে স্নেহ করার কি আছে?
হীরুর বিস্ময়ের সীমা রইল না। এই মেয়ে বলে কি? কষে একটা চড় দিতে ইচ্ছা করছে। যে সব চমৎকার কথা বলবে বলে হীরু এসেছিল তার সবই এলোমেলো হয়ে গেল। হীরু বলল, যাই তাহলে?
আচ্ছা।
দিন পনের দেখা হবে না। ঢাকার বাইরে যাচ্ছি। বিজনেসের ব্যাপার।
যান, বিজনেস করে আসুন।
তোমার ঠিকানাটা লিখে দাও তো, সময় যদি পাই একটা চিঠি-ফিটি ছেড়ে দেব।
চিঠি দিতে হবে না। বাবা জানলে আমাকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে।
হীরুর মনটাই খারাপ হয়ে গেল।
মন খুব বেশি খারাপ হলে সে সাধারণত পীর সাহেবের কাছে যায়। আজ তাও যাওয়া যাবে না, হাত একদম খালি। পীর সাহেব টাকা-পয়সা কিছুই নেন না। তবে বিদেশী সিগারেট দিলে খুশি হন। এক প্যাকেট বেনসনের দাম কম হলেও পাঁচ পঞ্চাশ টাকা … এই টাকাটা সে পাবে কোথায়?
হীরু ভেবে পেল না তার এবং এ্যানার ব্যাপারটা সে পীর সাহেবকে বলবে কি বলবে না। লজ্জা লজ্জা করে তবে একবার বলে ফেললে চির জীবনের জন্যে নিশ্চিন্ত।
তাছাড়া টুকুর জন্যেও যাওয়া দরকার। হারানো মানুষ বাড়ি ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে এই পীর হচ্ছে এক নাম্বার। পীর সাহেবের এগারটা জ্বীন আছে। জ্বীনের মারফত খবর পান।
হীরু খালি হাতেই পীর সাহেবের সন্ধানে রওনা হল।