০৪. বাসায় ফিরলাম একটার দিকে

বাসায় ফিরলাম একটার দিকে। বন্ধুরা কেউ আসে নি তখনো। গণি সাহেব এসে একটি রেজিস্ট্রি চিঠি দিয়ে গেলেন। বাবুল ভাইয়ের চিঠি। ইংরেজিতে লেখা। যার অর্থ অনেকটা এরকম–বাবার অনেকগুলি চিঠি পেয়েছি। বুঝতে পারছি তোমাদের অবস্থা শোচনীয়। কিছু করতে পারছিলাম না। আমার নিজের অবস্থাও তাই। এখন অবস্থার সামান্য পরিবর্তন হয়েছে। ড্রাফট একটা পাঠালাম। বেশ কিছু টাকা এতে হবার কথা। পরবর্তী সময়ে আরো পাঠাব। ধীরে ধীরে দোতলা একটা বাড়ি বানিও। যার একতলাটি ভাড়া দিয়ে বাবা যেন নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আমার নিজের আর দেশে ফেরা হবে না। তবে বাচ্চাদের এক বার বাংলাদেশ দেখাতে নিয়ে আসব। ড্রাফটটি তাড়াতাড়ি ভাঙাবার চেষ্টা করবে। ডলারের দাম পড়ে যাবে, এ রকম একটি গুজব এখানে আছে।

তিন হাজার পাঁচ শ ইউ এস ডলারের একটি ড্রাফট। গণি সাহেব বললেন ঠিকমত ভাঙাতে পারলে লাখখানিক টাকা হবার কথা।

আমি চুপ করে রইলাম। যে কোনো চিঠি মানুষ দু-তিন বার করে পড়ে। এই চিঠি দ্বিতীয় বার পড়তে ইচ্ছা হচ্ছে না। এবং চিঠি খুব অবহেলার সঙ্গেই রাখলাম

টেবিলে। যেন টাকাটার আমার কোন প্রয়োজন নেই।

গণি সাহেব অবাক হয়ে তাকালেন আমার দিকে। তিনি হয়ত আশা করেছিলেন, আমি খানিকটা উচ্ছ্বাস দেখাব। দেখানই তো স্বাভাবিক।

কেউ কি এসেছিল আমার কাছে?

আপনার ভগ্নিপতি এসেছিলেন। খানিকক্ষণ বসে চলে গেছেন।

কিছু বলে গেছেন?

জ্বি-না।

কিছুই বলে যান নি?

না। শুধু বললেন–উনি আপনার ভগ্নিপতি।

দায়িত্ব পালনের দেখা। এর বেশি কিছু নয়। মুখ কালো করে বসে ছিলেন এবং প্রতি মুহূর্তেই হয়তো বিরক্তি বাড়ছিল-বাড়ি ফিরে হয়তো অনুর সঙ্গে বড়ো রকমের একটা ঝগড়া বাধিয়েছেন। তিনি হয়তো বলেছেন, তোমার ভাইয়ের খোঁজে গিয়ে সারাটা দিন নষ্ট হল। অনু তার উত্তরে বলল, গিয়েছিলে কেন? তোমাকে যেতে বলেছি? অনু খুব শান্ত মুখে কাটা-কাটা কথা বলতে পারে। এবং এত সহজে পুরনো সব কথাবার্তা তোলে যে মনে হয় রাত-দিন সে এসব নিয়েই ভাবে। এমন তিক্ততার মধ্যে দু জন মানুষ বাস করে কীভাবে?

অনুর সঙ্গে দেখা করতে গেলেই মন ভার করে ফিরে আসতে হয়। মনে হয় বেঁচে থাকার মতো শাস্তি আর নেই। অনু শান্ত মুখে সহজ গলায় বলে, আমি এভাবে বেশি দিন থাকব না। এ কথায় সে কী বোঝাতে চায়, আমি জানি না। জানতে চেষ্টা করি না।

একদিন-না-একদিন চলে যাব।

কোথায় চলে যাবি?

তাও তো ঠিক। আমার যাবার জায়গা নেই।

অনুকে বাড়িতেই থাকতে হবে। তার কোথাও যাবার জায়গা নেই, এই চিন্তাটিই কি তাকে সব সময় পীড়িত করছে?

 

হাত পা কুটকুট করছিল। গা ধোয়ার জন্যে বাথরুমে গিয়ে দেখি, মাকড়শাটা বেরিয়ে এসেছে। শেষ দেখা দিতে এসেছে নাকি? আমি বেশ শব্দ করে বললাম, কিরে ব্যাটা, কেমন আছিল? বলাটা ঠিক হল না, কারণ এটা মেয়ে মাকড়শা, এর পেটের নিচে ডিমের থলি। একে বলা উচিত, কিরে মা, কেমন আছিল? কিন্তু এমন কুৎসিত জিনিসকে মা ডাকা যায় না। আমি ওর গায়ে পানি ছিটিয়ে দিলাম। সে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে তার কোনো গোপন জায়গায় লুকিয়ে পড়ল। আমাদের দু জনের বিদায়ের দৃশ্যটি ঠিক সুখকর হল না। পানি না দিলেই হত।

শরীর এখন বেশ ভালোই লাগছে। বাথরুমের আয়নাটাভালোনয়। কেমন ঢেউখেলান ছবি আসে, তবু নিজেকে খারাপ লাগছে না। এ মুখ ভরসা-হারান লক্ষ লক্ষ মানুষের মুখের একটি নয়। ঠিক বললাম কি? নাকি নিজেকে এই মুহূর্তে বিশেষ কিছু ভাবছি যেন আমি সবার চেয়ে আলাদা।

আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে বাবুল ভাই-ই ছিল একটু অন্য রকম। তার এক ফোঁটা সাহস ছিল না, তবু সে মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব সাহসী কাণ্ডকারখানা করত। মোজাম্মেল স্যারের সঙ্গে যে-কাণ্ডটা করল! স্যার ক্লাসে অঙ্ক করাচ্ছেন। সে উঠে বলল, স্যার, মনিরকে আপনি হাফ-ইয়ারলির অঙ্ক প্ৰশ্ন আউট করে দিয়েছেন কেন? মোজাম্মেল স্যার রাগের চোটে তোতলা হয়ে গেলেন। চোখ-মুখ লাল করে বললেন, আ-আ-আমি কোশ্চেন আউট করেছি? বলেছে কে?

মনির বলেছে স্যার।

কথাটা খুবই সত্যি। মনির সব সাবজেক্টে গোল্লার কাছাকাছি পেয়েছে, শুধু অক্কে বিরানই। তবু মোজাম্মেল স্যার বাবুল ভাইকে মেরে তক্তা বানিয়ে ফেললেন। দু-তিন জনে মিলে তাকে বাসায় দিয়ে গেল। বাসায় বাবা দ্বিতীয় দফায় তার উপর চড়াও হলেন। শিক্ষককে অপমান! তোর বাপের নাম আজ ভুলিয়ে ছাড়ব। বাপের নাম তিনি ভোলাতে পারলেন না, তবে দিন সাতেকের জন্যে বিছানায় ফেলে দিলেন।

গাটা ফুলে প্রচণ্ড জ্বর। বাবুল ভাই রাত-দিন শুয়ে থাকে। এক রাতে বিড়বিড় করে কী সব বলতে লাগল। বাবা গিয়েছেন পাশের বাড়ি তাস খেলতে। বড়োভাই তাঁকে ডাকতে গিয়ে ধমক খেয়ে ফিরে এলেন। আমার কেন জানি ধারণা হল, বাবুল ভাই বাঁচবে না। এবং আশ্চর্য, এই ভেবে সূক্ষ্ম একটা আনন্দ বোধ করলাম। সে মরে গেলেই ভালো হয়। বাবার একটা উচিত শিক্ষা হয়।

বাবাকে উচিত শিক্ষা দেওয়া গেল না। বাবুল ভাই সেরে উঠল। বাবা তাকে মোজাম্মেল স্যারের বাসায় নিয়ে গেলেন। বাবুল ভাই স্যারের পা ধরে বলল, স্যার, আর কোনো দিন করব না। মাফ করে দেন স্যার। রীতিমতো নাটক। বাবা সেরাতে ভাত খেতেখেতে বললেন, শিক্ষকদের অমর্যাদা করলে বড় হতে পারবি না। শিক্ষক বড় মারাত্মক জিনিস। বাবা-মাকে এক বার সালাম দিলে হয়, কিন্তু শিক্ষককে সালাম দিতে হয় দশ বার। বুঝলি?

আমরা কেউ কোনো জবাব দিলাম না। বাবুল ভাই জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকার দেখতে লাগল। বাবা হৃষ্টচিত্তে বলতে লাগলেন, কোশ্চেন আউট করে সে খুব খারাপ কাজ করেছে, কিন্তু তোরা তো অঙ্ক শিখছিস তার কাছে। শিখছি না? সেটাই বড়ো।

তার দিন কয়েক পর মোজাম্মেল স্যার বাবুল ভাইকে ডেকে নিয়ে বললেন, তুই এক কাজ করিস–সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় আমার বাসায় আসিস। অঙ্কটা দেখিয়ে দেব। টাকাপয়সা কিছু দিতে হবে না। বলিস তোর বাবাকে।

বাবুল ভাই রাজি ছিল না। কিন্তু বাবা বিনাপয়সার এই সুযোগ হারাবার লোক নন। তিনি কড়া ধমক দিয়ে বাবুল ভাইকে পাঠাতে লাগলেন।

মোজাম্মেল স্যার অঙ্ক খুবই ভালো জানতেন। স্কুলে তাঁর নাম ছিল মুসলমান যাদব। বাবুল ভাই তাঁর কাছ থেকে ভালো অঙ্ক শিখলেন। ভালো বললে কম বলা হবে। খুবই ভালো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *