॥ ৪ ॥
‘আপনি তো দিব্যি মশাই একটি বাঘছাল বাগাবেন বলে মনে হচ্ছে। আর আমি?’
একটু যেন মনমরা হয়েই কথাটা বললেন লালমোহনবাবু। আমাদের খাওয়াদাওয়া হয়েছে প্রায় ঘণ্টাখানেক হল। তারপর নীচে বৈঠকখানায় বসে মহীতোষবাবুর কাছে নানারকম লোমহর্ষক শিকারের গল্প শুনে এই কিছুক্ষণ হল নিজেদের ঘরে এসেছি। লালমোহনবাবুর কথায় ফেলুদা বলল, ‘কেন? যে-ই সংকেতটার সমাধান করবে সে-ই বাঘছাল পাবে। অন্তত পাওয়া উচিত। কাজেই আপনিও তাল ঠুকে লেগে পড়তে পারেন। আপনি তো সাহিত্যিক মানুষ, ভাষার উপর বেশ দখল আছে।’
‘আরে মশাই, ভাষার উপর দখল মানে কী আর সংকেতের উপর দখল? মহীতোষবাবুও তো সাহিত্যিক। উনি হাল ছেড়ে দিলেন কেন? না মশাই, ও সব মুড়ো বুড়ো গাছ মাছ, তাল ফাঁক ভুঁই ফাঁক—ওসব আমার দ্বারা হবে না। আপনার ভাগ্যেই ঝুলছে বাঘছাল। এই এইটে দেবে নাকি?’
লালমোহনবাবু মেঝেয় রাখা বাঘছালটির দিকে আঙুল দেখালেন। ফেলুদা বলল, ‘ভদ্রলোক বড় বাঘের কথা বললেন শুনলেন না? ওসব চিতা-টিতায় আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই।’
ফেলুদা এর মধ্যেই ছড়াটা খাতায় লিখে নিয়েছে, আর খাটে বসে সেটার দিকে একদৃষ্টে দেখছে।’
‘কিছু এগোলেন?’ লালমোহনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
ফেলুদা খাতার পাতা থেকে চোখ না তুলেই বলল, ‘গুপ্তধনের সংকেত সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।’
‘কী করে বুঝলেন? ওই মুড়ো-বুড়োর ব্যাপারটা কী?’
‘সেটা এখনও জানি না, তবে একটা গাছের কথা যেন বলা হচ্ছে তাতে তো কোনও সন্দেহ নেই। মুড়ো হয় বুড়ো গাছ। তারপর বলছে হাত গোন ভাত পাঁচ। এখানে হাতটা ইম্পর্ট্যান্ট। সাধারণত এসব সংকেত প্রথমে একটা বিশেষ জায়গার কথা বলে, তারপর সেখান থেকে কোনদিকে কতদূরে গেলে গুপ্তধন পাওয়া যাবে সেটা বলে। রবীন্দ্রনাথের ‘গুপ্তধন’ পড়েননি? তেঁতুল বটের কোলে দক্ষিণে যাও চলে, ঈশান কোণে ঈশানি বলে দিলাম নিশানি? তেমনই এখানেও হাত কথাটা পাচ্ছি, দিক কথাটা পাচ্ছি। এই জন্যেই বলছি—’
ফেলুদার কথাটা শেষ হল না, কারণ ঘরে আরেকজন লোক ঢুকে পড়েছে।
দেবতোষ সিংহরায়।
সকালের সেই বেগুনি ড্রেসিং গাউনটা এখনও পরা, আর চোখে সেই অদ্ভুত চাহনি, যেন মনে হয় সকলকেই সন্দেহ করছেন। দেবতোষবাবু সোজা লালমোহনবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমরা কি ভোটরাজার লোক?’
লালমোহনবাবু ফ্যাকাশে হয়ে ঢোক গিলে বললেন, ‘ভ্-ভোট মানে কি আপনি ভ্-ভোটিং—মানে, ই-ইলেকশনের—?’
‘না, উনি বোধহয় ভূটান রাজের কথা বলছেন।’
ফেলুদা কথাটা বলায় দেবতোষবাবুর দৃষ্টি ফেলুদার দিকে ঘুরে গেল, আর তার ফলে লালমোহনবাবু একটা বিশ্রী অবস্থা থেকে উদ্ধার পেয়ে গেলেন।
‘শুনেছিলাম ভোটেরা নাকি আবার আসছে?’ দেবতোষবাবু প্রশ্নটা ফেলুদাকেই করলেন। ফেলুদা খুব স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিল, ‘সেরকম তো শুনিনি। তবে আজকাল ইচ্ছে করলে ভূটান যাওয়া যায়।’
‘ও, তাই বুঝি।’
মনে হল দেবতোষবাবু এই প্রথম খবরটা শুনলেন।
‘তা বেশ। উপেন্দ্রকে ভোটরাজ অনেক হেল্প করেছিল। ওরা ছিল বলেই নবাবের সেনা কিছু করতে পারেনি। ওরা যুদ্ধটা জানে। সবাই জানে কি?’ দেবতোষবাবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, ‘হাতিয়ার কি আর সবার হাতে বাগ মানে? সবাই কি আর আদিত্যনারায়ণ হয়?’
কথাটা বলে দেবতোষবাবু দরজার দিকে ঘুরে দু’ পা এগিয়ে গিয়ে থেমে গেলেন। তারপর মুখ ঘুরিয়ে মেঝের বাঘটার দিকে চেয়ে একটা অদ্ভুত কথা বললেন।
‘যুধিষ্ঠিরের রথের চাকা মাটি ছুঁত না। তাও শেষটায় ছুঁল।’
ভদ্রলোক চলে যাবার পর আমরা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। তারপর ফেলুদা বিড়বিড় করে বলল, ‘খড়ম পরেছে। তাতে রবারের সাইলেন্সার লাগানো।’
এরপর রাত্তিরে পর পর অনেকগুলো ঘটনা ঘটল। সেগুলো ঠিক মতো লেখার চেষ্টা করছি। বাইরে বারান্দায় সিঁড়ির দরজার পাশে একটা গ্র্যান্ডফাদার ক্লক থাকার দরুন ঘটনার সময়গুলো আন্দাজ করতে অসুবিধা হয়নি।
প্রথমেই বলে রাখি যে গদি বালিশ তোষকের দিক থেকে শোবার ব্যবস্থা ভাল হলেও, একটা ব্যাপারে গণ্ডগোল হয়ে যাওয়াতে প্রথম রাত্তিরে ঘুমটা একদম মাটি হয়ে গিয়েছিল। তার কারণ আমাদের তিনজনের মশারিতেই ছিল ফুটো। মশারি ফেলার দশ মিনিটের মধ্যে ভেতরে মশা ঢুকে কামড় আর বিনবিনুনির জ্বালায় আমাদের ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিল। ফেলুদার সঙ্গে ওডোমস থাকে, শেষটায় তাই মেখে কিছুটা আরাম পাওয়া গেল। বাইরের ঘড়িতে তখন ঢং ঢং করে এগারোটা বেজেছে। দিনের বেলা মেঘলা থাকলেও এখন জানালা দিয়ে চাঁদের আলো আসছিল। সবেমাত্র চোখের পাতাটা বুজে এসেছে এমন সময় একটা চেনা গলায় ধমকের সুরে কথা এল।
‘আমি শেষবারের মতো বলছি— এর ফল ভাল হবে না।’
গলাটা মহীতোষবাবুর। উত্তরে কে যে কী বলল তা বোঝা গেল না। তার পরে সব চুপচাপ। আমার বাঁদিকে লালমোহনবাবুর মশারির ভিতর থেকে নাক ডাকার শব্দ শুরু হয়েছে। আমি ডান পাশে ফেলুদার খাটের দিকে ফিরে চাপা গলায় বললাম, ‘শুনলে?’
গম্ভীর ফিসফিসে গলায় উত্তর এল, ‘শুনেছি। ঘুমো।’
আমি চুপ করে গেলাম।
তার কিছুক্ষণের মধ্যেই বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুমটা যখন ভাঙল তখনও ঘরে চাঁদের আলো রয়েছে, কিন্তু সেই সঙ্গে মেঘের গর্জনও শোনা যাচ্ছে মাঝে মাঝে। একটা লম্বা গুড়গুড়ানি থামলে পর আরেকটা শব্দ কানে এল। ঘুট ঘুট…ঘুট ঘুট…ঘুট ঘুট…। তালে তালে একটানা শব্দ নয়। মাঝে মাঝে হচ্ছে, মাঝে মাঝে থেমে যাচ্ছে, আর মাঝে মাঝে মেঘের গর্জনে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। শব্দটা হচ্ছে বেশ কাছ থেকেই। আমাদের ঘরের ভিতরেই। ফেলুদার খাটের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে কান পাততেই ওর জোরে জোরে নিশ্বাস পড়ার শব্দ পেলাম। ও ঘুমোচ্ছে।
কিন্তু লালমোহনবাবুর নাক ডাকা বন্ধ কেন? ওঁর খাটের দিকে চেয়ে ডবল মশারির ভিতর দিয়ে কিছুই দেখতে পেলাম না। কিন্তু একটা ক্ষীণ শব্দ যেন আসছে খাটের দিক থেকে। এটা আমার চেনা শব্দ। বাক্স-রহস্যের ব্যাপারে সিমলার বরফের মধ্যে একটা পিস্তলের গুলি লালমোহনবাবুর পায়ের কাছে এসে পড়ায় তার দাঁতে দাঁত লেগে ঠিক এই শব্দটাই হয়েছিল।
সেই সঙ্গে আবার সেই শব্দটা কানে এল। ঘুট ঘুট…ঘুট ঘুট…ঘুট ঘুট…
আমি ঘাড় কাত করে মেঝের দিকে চাইলাম। ফলে মশারিটা একটু নড়ে ওঠাতে বোধহয় লালমোহনবাবু বুঝলেন আমার ঘুম ভেঙে গেছে। একটা বিকট চাপা ঘড়ঘড় স্বরে তিনি বলে উঠলেন, ‘ত-তপেশ—বা বাঘ!’
বাঘ শুনেই আমার চোখ মেঝের বাঘছালটার দিকে চলে গেল, আর যেতেই যা দেখলাম তাতে আমার রক্ত জল হয়ে গেল।
জ্যোৎস্নার আলো বাঘের মাথাটার উপর পড়েছে, আর স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি মাথাটা মাঝে মাঝে এদিক-ওদিক নড়ে উঠছে, আর তার ফলেই ঘুট ঘুট শব্দ হচ্ছে।
আর থাকতে না পেরে যা থাকে কপালে ভেবে ফেলুদার নাম ধরে একটা চাপা চিৎকার দিয়ে উঠলাম। ফেলুদার ঘুম যতই গাঢ় হোক না কেন, ও সব সময় এক ডাকে উঠে পড়ে, আর ওঠামাত্র ওর মধ্যে আর ঘুমের লেশমাত্র থাকে না।
‘কী ব্যাপার? চ্যাঁচাচ্ছিস কেন?’
আমারও প্রায় লালমোহনবাবুর দশা। কোনওরকমে ঢোক গিলে বলে ফেললাম, ‘মেঝে…বাঘ।’
ফেলুদা মশারির ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে বাঘটার নড়ন্ত মাথাটার দিকে একদৃষ্টে খানিকক্ষণ দেখে নিল। তারপর দিব্যি নিশ্চিন্তভাবে এগিয়ে গিয়ে বাঘের থুতনিটা ধরে উপরে তুলতেই তার নীচ থেকে একটা গুবরে পোকা বেরিয়ে পড়ল। ফেলুদা অম্লানবদনে সেটাকে দু’ আঙুলের চাপে তুলে নিয়ে বলল, ‘গুবরের আসুরিক শক্তির কথাটা কি তোদের জানা নেই? একটা কাঁসার জামবাটি চাপা দিয়ে রাখলে সেটাকে সুষ্ঠু টেনে নিয়ে সারা বাড়ি চক্কর দিতে পারে।’
ভয়ের কারণটা এত সামান্য জানলে অবিশ্যি ঘামটাম আপনা থেকেই শুকিয়ে যায়। আমার আর লালমোহনবাবুরও তাই হল। এদিকে ফেলুদা গুবরেটাকে নিয়ে জানালার বাইরে ফেলে দিয়ে দেখি সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। এই গভীর রাত্তিরে ফেলুদা কী দেখছে সেটা ভাবছি, এমন সময় ও ডাক দিল, ‘তোপসে, দেখে যা।’
আমি আর লালমোহনবাবু ফেলুদার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
আগেই বলেছি পশ্চিমদিকটা বাড়ির পিছন দিক, আর এদিক দিয়েই কালবুনির জঙ্গল দেখা যায়। এই ক’ মিনিটের মধ্যেই কালো মেঘে চাঁদ ঢেকে ফেলেছে৷ মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল বটে, কিন্তু তা ছাড়াও আর একটা আলো দেখে অবাক লাগল। আলোটা মনে হল জঙ্গলের ভিতর ঘোরাফেরা করছে। টর্চের আলো।
‘হাইলি সাসপিশাস’, ফিসফিস করে বললেন লালমোহনবাবু।
আলোটা এবার নিবে গেল।
এবার একটা চোখ ধাঁধানো বিদ্যুতের সঙ্গে সঙ্গে একটা কানফাটা বাজের আওয়াজ, আর তার পরমুহূর্তেই বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা শুরু হয়ে গেল। পশ্চিমদিক থেকেই ছাঁট, তাই দুটো জানালারই শার্সি বন্ধ করে দিতে হল। ফেলুদা বলল, ‘একটা বেজে গেছে, শুয়ে পড়। কাল সকালে আবার জল্পেশ্বরের মন্দির দেখতে যাবার কথা আছে।’
আমরা তিনজনেই আবার মশারির ভিতর ঢুকলাম।
জানালায় রঙিন কাচ থাকার ফলে বিদ্যুৎ চমকালেই ঘরে রামধনুর রং খেলছিল। সেই রং দেখতে দেখতেই আবার কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম তা টেরই পাইনি।