ফুলবাড়ি নামের জায়গাটিকে শহর না বলে গঞ্জই বলা ভালো। নদীর ধারে হাটখোলা, আশেপাশের কয়েকখানি গাঁয়ের মানুষ আসে সওদা করতে। সপ্তাহে দু’দিন এখানে স্টিমার আসে, সেই জন্যই জায়গাটার যা কিছু গুরুত্ব। কার অ্যান্ড টেগোর কোম্পানির আমল থেকেই এখানে স্টিমারঘাটা স্থাপিত হয়েছে। সেই উপলক্ষে গোটা তিনেক পাইস হোটেলও আছে। সকাল ন’টায় স্টিমার থামে, তার মধ্যেই গরম গরম ডাল-ভাত ও মাছের ঝোল তৈরি হয়ে যায় হোটেলগুলোতে। পূর্ববঙ্গে মাছ সস্তা, তবু তিন পয়সা পিস রান্না মাছ খাবার লোক যাত্রীদের মধ্যে বেশি থাকে না। শুধু ডাল-ভাত খেলেও ‘ছয় পয়সার কম খাওয়া নাই’–এই নোটিস বাইরে ঝোলানো।
হাটখোলার পেছনে মাটির বাড়িতে তিন ঘর বেবুশ্যের বাস। হাটবারেই তাদের পশার জমে, অন্য অন্য দিন তারা নদীর ধারে চুল মেলে, পা ছড়িয়ে বসে চাটাই বোনে কিংবা ধামা কুলো বানায়। অনেক হাটুরের সঙ্গেই তাদের দিদি কিংবা মাসির সম্পর্ক। রেট আট আনা।
এ ছাড়া ফুলবাড়িতে আছে একটি পোস্ট অফিস, তিনটি পাঠশালা, একটি বোর্ড। স্কুল–সেখানে ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়ানো হয়, একটি হাই স্কুলও সদ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পাশেই গ্রাম হাসানবাড়ির হাইস্কুলটি সুপ্রাচীন। কোর্টকাছারির জন্য এলাকার মানুষকে যেতে হয় ফরিদপুর জেলা সদরে। ফুলবাড়িতে পাকা রাস্তা একটিও নেই–একটি সুরকির রাস্তা তিন-চার মাইল গিয়ে বড়খালে ডুব দিয়ে আবার ও-পারে উঠেছে। খালে কোনও সেতু নেই। এশহরে পাকাবাড়ির সংখ্যা দশ-বারোখানার বেশি নয়। ব্রাহ্মণ আছে পাঁচ ঘর, কায়স্থ ও বৈদ্য বেশ কিছু, নমোশুদ্রের সংখ্যা অনেক। পাশের গ্রামটি মুসলমান প্রধান। ফুলবাড়ির প্রধান মাতব্বর জয়নাল আবেদিন–তার ছিট কাপড় ও বেনেতি মশলার বিরাট ব্যবসা। যেখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে বাঁশবন, তার মধ্যে ডাউক। বা ডাহুক আর কুবোপাখির ডাক শোনা যায় সব সময়। সন্ধ্যার পরই প্রান্তর ভরিয়ে ভেসে ওঠে শেয়ালের ডাক, দিনেরবেলা কিন্তু তাদের টিকিটিও দেখতে পাওয়া যায় না। সুন্দরবন থেকে দু-একটা কেঁদো বাঘ কচিৎ কখনও ছটকে এ-দিকে আসে। একবার একটা বুনো হাতিও এসেছিল, কোথা থেকে এসেছিল কে জানে। লোকে বলে আসামের বন্যায় ভাসতে ভাসতে এসে ঠেকেছিল হাসানবাড়িতে। সাপ আছে প্রচুর। এবং ভূত, প্রেত ও ব্রহ্মদৈত্যর তখনও অপ্রতিহত রাজত্ব চলেছে। ইলেকট্রিক আলো কেউ চোখে দেখেনি। হ্যাঁজাক বাতি জ্বালানো হয় শুধু উৎসবের সময়। ডিগবয়ে পেট্রোল ও। কেরোসিন আবিষ্কারের পর থেকেই মাত্র হ্যারিকেনের যুগ শুরু হয়েছে, তার আগে পর্যন্ত তেলের সেজবাতি।
সারদারঞ্জনের বাড়ি বলতে এতদিন পর্যন্ত ছিল দুখানি টিনের চালা দেওয়া মাটির দেওয়ালের ঘর ও একটি খড়ের চালার রান্নাঘর। সম্প্রতি তিনি একটা একতলা পাকা দালান তুলেছেন। তার সামনের দিকে বৈঠকখানা, পেছনে ছোট ছোট ঘরে ছেলেদের পড়াশুনো ও শোবার জায়গা। কাঠের সিন্দুকটাও দালানে স্থানান্তরিত করা হয়েছে, কিন্তু সারদারঞ্জন দুই স্ত্রীকে নিয়ে এখনও মাটির ঘরেই থাকেন।
ছেলেরা ধাঁ ধাঁ করে বড় হয়ে যাচ্ছে। প্রিয়রঞ্জন ম্যাট্রিক পাশ করেই সরকারি কালেকটারিতে চাকরি পেয়ে গেল, থাকতে হয় বরিশালে মাসে একবার করে বাড়িতে আসে। ঝালেকাঠির এক বর্ধিষ্ণু গৃহস্থের মেয়ের সঙ্গে তার বিয়েও দেওয়া হল। পূর্ণিমা বিধবা হয়ে ফিরে এসে বাপের সেবা করে। চিররঞ্জন ম্যাট্রিক পাশ করে পড়তে চলে গেল কলকাতার কলেজে। খবরের কাগজ দেখে নিজেই চিঠিপত্র লিখে চিররঞ্জন কলকাতার একটি বাড়িতে ছেলেমেয়ে পড়াবার বিনিময়ে থাকা-খাওয়া জোগাড় করে নিয়েছে। নিখিলরঞ্জনের মনের গতি টের পাওয়া যায় না, চুপচাপ গম্ভীর ভাবে থাকে ও স্বামী বিবেকানন্দের বই পড়ে। একবার ম্যাট্রিকে সে ফেল করেছে। ছোটছেলে বিশ্বরঞ্জনের পড়াশুনোয় বেশ মাথা আছে, কিন্তু একদম মন নেই। এক দণ্ড তাকে ঘরের মধ্যে চুপ করে বসিয়ে রাখার উপায় নেই। গ্রামের ইস্কুলে মারামারি করার পর তাকে হাসানবাড়ির হাইস্কুলে ভরতি করে দেওয়া হল। গোঁয়ারের মতন রোজ চার মাইল হেঁটে সে সেই স্কুলে যায়, কোনও দিন এক বারও আপত্তি তোলেনি। কিন্তু ইস্কুল থেকে ফেরে অনেক দেরি করে সে। দাদারা কখনও এ রকম সাহস পেত না।
সারদারঞ্জনের বাড়ির পাশেই একটা বড় পুকুর-দিঘি বলা হত তাকে–তার ও-পাশে রায়চৌধুরীদের বাড়ি। বাড়িতে দুর্গাপুজো কালীপুজো হত খুব ধূমধাম করে। মস্ত বড় বাড়ি, উঠোনে বিরাট ধানের গোলা, রায়চৌধুরীদের বন্দুকও ছিল। বাড়ির কর্তারা অবশ্য প্রায় কেউই থাকতেন না কলকাতায় ব্যবসা করতেন–উৎসবের সময়। আসতেন দলবল নিয়ে। রায়চৌধুরীদের বাড়ির দু’খানা ঘরে থাকত আট-দশটি ছেলে অনাথ, দরিদ্র বা বাড়ি-পালানো ছেলেরা দরখাস্ত করে এখানে জায়গা পেত–তাদের খাওয়া, থাকা ও পড়ার খরচ লাগত না। ঘরদুটো জুড়ে তক্তপোশ পাতা, তার ওপর। ঢালাও বিছানা-সে বিছানা গোটানো হত না কখনও। সকালে মুড়ি ও গুড় দু’বেলা পেটভরা ভাত, মাসে দু’টাকা হাতখরচ এবং দুর্গাপুজোর সময় দু’খানা করে ধুতি ও জামা–এই ছিল বরাদ্দ। রায়চৌধুরীদের বাড়িতে ওই সব আশ্রিত ছেলেদের মধ্যে একজন পরবর্তীকালে অবিভক্ত বাংলার মন্ত্রী হয়েছিলেন, একজন হয়েছিলেন কলকাতায় বত্রিশ টাকা ভিজিটের ডাক্তার ও একজন চলচ্চিত্র পরিচালক।
ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাশ করার পর ওই সব ছেলেরা চলে যেত, আসত নতুন ছেলেরা। কিন্তু পুরনো ছেলেদের মধ্যে অনেকেই বাড়ির মায়া কাটাতে পারত না–ফিরে ফিরে আসত বার বার এবং বাড়ির ছেলের মতনই তাদের জন্য ছিল অবারিত দ্বার। তারা ওই শহরে নিয়ে আসত বাইরের জগতের হাওয়া–তারা ফুটবল ক্লাব, যাত্রাপার্টি গঠন করত, তারা একটা ছোটখাটো পাবলিক লাইব্রেরিও তৈরি করেছিল। ওই রকম একজন প্রাক্তন ছাত্র ছিল অমরনাথ ভাদুড়ি। বরিশাল বি এম কলেজে বি এ পড়তে পড়তেও প্রায়ই ছুটিছাটায় সে আসত ফুলবাড়িতে। স্থানীয় ছেলেদের মধ্যে তার খুব প্রভাব–যাত্রা থিয়েটার সংগঠনে অমরনাথ খুব ওস্তাদ–অমরনাথের গানের গলাও ছিল খুব সুরেলা। অমরনাথের পূর্ব পরিচয় কেউ জানত না। কোনও দিন সে কারোকে নিজের বাবা-মায়ের কথা ঘুণাক্ষরেও বলেনি। সারদারঞ্জনের ছেলেরা রায়চৌধুরীবাড়ির ওই ছাত্রাবাসে আড্ডা দিতে যেত নিয়মিত। কয়েক বছর পর পুলিশ এসে ওই ছাত্রাবাসটি ভেঙে দেয়–কারণ আস্তে আস্তে সেটি সন্ত্রাসবাদী গুপ্ত বিপ্লবীদের ঘাঁটি হয়ে দাঁড়াচ্ছিল।
অমরনাথ এসে পূর্ণিমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেবার পর সারদারঞ্জন যখন তাকে মারতে উঠেছিলেন, তখন সারদারঞ্জনের ছোটছেলে বিশ্বরঞ্জন মাঝখানে লাফিয়ে পড়ে বাপের হাত থেকে লাঠি কেড়ে নেয়। বিশ্বরঞ্জনের বয়স তখন সবে চোদ্দো, কিন্তু সবল চেহারা। লাঠিখানা কেড়ে নিয়ে হাঁটুর জোর দিয়ে মট করে ভেঙে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বাবার মুখোমুখি চোখ রাঙিয়ে দাঁড়ায়। তার সেই অদ্ভুত ধরনের ঘৃণা আর ক্রোধ। সেই দিনই সবাই বুঝেছিল, এই ছেলে বিপজ্জনক। এই গোঁয়ারগোবিন্দ ছেলেকে ঘাঁটানো সহজ হবে না। ‘ পড়াশুনোয় মন ছিল না বিশ্বরঞ্জনের–কিন্তু ম্যাট্রিক পরীক্ষায় সে সবাইকে তাজ্জব বানিয়ে ফাস্ট ডিভিশনে পাশ করল। এবং তারপরই ঘোষণা করল, সে আর পড়াশুনো করবে না। বই পড়তে তার ভালো লাগে না।
ছেলের সাফল্যে সারদারঞ্জন যেমন গর্বিত হয়েছিলেন, তেমনই নিরাশ হলেন এই ঘোষণায়। কত সাধ ছিল, এই ছেলেকে তিনি ডাক্তারি পড়াবেন। এখন তার সেই সামর্থ্যও হয়েছে। ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, পড়াশুনো করবি না, তা হলে তুই কী করতে চাস!
গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বিশ্বরঞ্জন উত্তর দিল, কিচ্ছু না!
কিচ্ছু না মানে? এ কথার মানে কী?
বিশ্বরঞ্জন নীরবে সোজা চোখ তুলে বাবার দিকে তাকাল। চোখের পলক পড়ে না। অর্থাৎ সব কথার মানে সে সবাইকে বুঝিয়ে বলতে প্রস্তুত নয়। নিজের বাবাকেও নয়।
ক্রমশ আবিষ্কৃত হল, বিশ্বরঞ্জন একজন শিল্পী। বাড়ির পেছনের আমবাগানে বহুকালের পরিত্যক্ত একটা গোয়ালঘর ছিল। সেখানে বিশ্বরঞ্জন মাটি দিয়ে নানা রকম মূর্তি তৈরি করে। সরস্বতী, মহাদেব, লাঙলকাঁধে কৃষক, সম্রাট শাহজাহান, গাছের নীচে গৌতম বুদ্ধ। একটি মূর্তি খুব বিরাট, বাঙালি চেহারার সিন্ধুবাদ নাবিকের কাঁধের ওপর ব্রিটিশরূপী দৈত্য। সেই গোয়ালঘরে সাপখোপের বাসা–কিন্তু বিশ্বরঞ্জন ও-সব কিছু গ্রাহ্য করে না। তার সেই শিল্পকলা চর্চার স্থানটি বিশ্বরঞ্জন বহুদিন গোপন রেখেছিল, আস্তে আস্তে সেটি পাড়া-প্রতিবেশীর গোচরে আসে।
শিল্পী বলতে যে রকম মানুষের কথা মনে হয়, বিশ্বরঞ্জন মোটেই সে রকম ছিল না। তার গুন্ডার মতন চেহারা, লোকের সঙ্গে মারধর করে, শাসায়–আবার কখনও কখনও সে আমবাগানের গোয়ালঘরে একা একা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে মাটি দিয়ে মূর্তি বানায়। তখন নাওয়া-খাওয়ার কথাও মনে থাকে না তার। অথচ তার চরিত্রে একটা নিষ্ঠুরতা ছিল সব সময়েই। তার কোনও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল না, প্রায় কৈশোর থেকেই তাকে কেউ কাঁদতে দেখেনি–হালকা রসিকতা বা আমোদপ্রমোদে তার কখনও রুচি দেখা যায়নি। পাশের গ্রামের শেয়ালমারা পার্টিতে বিশ্বরঞ্জন অগ্রণীর ভূমিকা নেয়। শেয়ালের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে হাসানবাড়ির লোকেরা একদিন দল বেঁধে শেয়াল মারতে বেরোয়। তাদের সঙ্গে সঙ্গে বল্লম হাতে বিশ্বরঞ্জন। দিনেরবেলা শেয়ালগুলো লুকিয়ে থাকে মাটির তলায়–ওপরে অনেকগুলো গর্ত। একটা দিয়ে খোঁচাখুঁচি করলে আর একটা দিয়ে পালায়। খুঁজে খুঁজে সব ক’টা গর্তের মুখ বন্ধ করে, শেষ গর্তটায় আগুন লাগিয়ে দেওয়া। হয়, ধোঁয়ায় আর আগুনের আঁচে শেষ পর্যন্ত শেয়াল বেরোবেই। দূরে লোকজন লাঠি হাতে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে–বেরোলেই লাঠিপেটা করে মারা। কিন্তু অসীমসাহসী বিশ্বরঞ্জন একটা শেয়ালকে বল্লম দিয়ে গেঁথে সেই গগনভেদী চিৎকাররত প্রাণীটিকে পুনর্বার আগুনে নিক্ষেপ করল। দগ্ধ শরীরে শেয়ালটা যত বার ছুটে আসছে, বিশ্বরঞ্জন সেটাকে আবার আগুনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত সেই শিয়াল বিশ্বরঞ্জনের ঊরু কামড়ে ধরেছিল–ইফতিকার নামে একটি ছেলে কোনওক্রমে ছাড়িয়ে না দিলে বিশ্বরঞ্জনের প্রাণ বাঁচানো শক্ত হত। এই বিশ্বরঞ্জনই আবার তন্ময় হয়ে বসে বসে নিজে-গড়া মূর্তির চোখের পাতা আঁকে।
একদিন সারদারঞ্জন এসে হাজির হলেন সেই আমবাগানের স্টুডিয়োতে। বহুক্ষণ ধরে বিশ্বরঞ্জনকে খেতে ডাকা হচ্ছিল, তার কোনও সাড়া নেই, সারদারঞ্জন নিজেই চলে গেলেন সেই গোয়ালঘরে। সেই সব মূর্তিটুর্তি দেখে জিজ্ঞেস করলেন, এসব কী?
বিশ্বরঞ্জন কোনও উত্তর দিল না। দু হাতেই কাদা মাখা, কী যেন একটা অতিকায় প্রাণী তৈরি করছিল সে।
সারদারঞ্জন আবার জিজ্ঞেস করলেন, এসব কী হচ্ছে কী? শেষ পর্যন্ত কি তুই কুমোর হবি নাকি? না পটো হবি? এইসব লক্ষ্মী, সরস্বতী–এসব বানিয়েছিস কেন? বিক্রি করবি?
না।
তা হলে? জানিস না, এসব ঠাকুর দেবতার মূর্তি বানালে পুজো করতে হয়? এমনি এমনি কেউ রাখে? পড়াশুনো ছেড়ে দিয়ে এইসব? ছি ছি ছি!
আমি মেজদাকে চিঠি লিখেছি। আমি কলকাতায় গিয়ে আর্ট স্কুলে ভরতি হব।
আর্ট ইস্কুল? সে আবার কী? কোনও ভদ্রবংশের ছেলে সেখানে যায়? আর্টের আবার ইস্কুল! ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে তুই কি আবার ইস্কুলে ভরতি হবি?
আপনি সব খবর রাখেন না…
পারিবারিক প্রথা অনুসারে বিশ্বরঞ্জন বাবাকে আপনি সম্বোধন করে কথা বলত বটে, কিন্তু কথাবার্তায় বিনয় বা শ্রদ্ধা দেখানোর ভাব তার ধাতে ছিল না। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পরই সারদারঞ্জন হঠাৎ রাগে দপ করে জ্বলে উঠলেন। ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য হুংকার দিয়ে বললেন, এসব চলবে না! এসব চলবে না বলে দিলাম!
বিশ্বরঞ্জন একটুও ভয় পায় না। ক্রোধে অন্ধ হয়ে সারদারঞ্জন হাতের লাঠি দিয়ে সিন্ধুবাদ মূর্তির ওপর জোরে আঘাত করলেন। মূর্তিটার অনেকখানি ভেঙে গিয়ে বেরিয়ে পড়ল ভেতরের অন্ধকার।
এতটা বাড়াবাড়ি করে সারদারঞ্জন বোধহয় একটু লজ্জিত হয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু বিশ্বরঞ্জনের প্রতিক্রিয়া হল অন্য রকম। নিজেই সে লাথি মেরে মেরে অন্য মূর্তিগুলো ভাঙতে লাগল। সরস্বতী, শিবমূর্তি তার সবল পদাঘাতে ছিটকে পড়তে লাগল চতুর্দিকে।
সারদারঞ্জন স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। এ-ছেলেকে তিনি চেনেন না। বাবা-মায়ের মনে সবচেয়ে বেশি আঘাত লাগে যখন কোনও সন্তানের আচরণ তাদের কাছে দুর্বোধ্য মনে হয়। যে-সন্তানকে চোখের সামনে এইটুকু থেকে বড় হতে দেখলেন, সেই-ই যখন একদিন স্নেহ-মমতায় ঘেরা বোধের সীমানা ভেঙে দিয়ে বাইরে দাঁড়ায় তখন এই পৃথিবী রসশূন্য হয়ে যায়।
পূর্ণিমার বিয়ের পর ফুলবাড়িতে আর একটি আলোড়ন ঘটালেন গঙ্গাধর দত্ত। লোকের মুখে মুখে এঁর নাম হয়ে গিয়েছিল, মরা-গোরু কি ঘাস খায় দত্ত! এ রকম নামের উৎস এই, গঙ্গাধর তার বাবা মারা যাবার পর শ্রাদ্ধ করেননি, মাথা ন্যাড়া করেননি। স্থানীয় হিন্দু সমাজকে চমকে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, মরা মানুষের আত্মা আবার পিন্ডি। খাবে কী? মরা গোর কি ঘাস খায়? এর উত্তরে দত্তবংশের কুলপুরোহিত মন্তব্য করেছিলেন, বৎস গঙ্গাধর, তোমার ব্যবহারটা কিয়ৎ পরিমাণে গোবৎসের মতন, কিন্তু তোমার বাপও যে গোরু ছিলেন, তা তো আমরা জানতাম না!
গঙ্গাধর বেশ কিছুকাল দেশ-ছাড়া ছিলেন। তাঁর বিধবা দিদি ও বুড়োবুড়ি বাবা-মা থাকতেন শহরের একটেরে বাড়িতে। বুড়ি আগেই মরলেন সিঁথির সিঁদুর অক্ষয় রেখে সতীলক্ষ্মীর মতন। কিন্তু বুড়ো মরার কিছু দিন আগে ফিরে এলেন গঙ্গাধর। মুখে একমুখ দাড়ি ও অনর্গল হিন্দি ও ইংরিজি বুলি! লম্বা-চওড়া চেহারা, ব্যবহারে একটা বেপরোয়া ভাব। মফসল শহরের নিস্তরঙ্গ জীবনে এইসব মানুষ এক একটা ঝড়ের মতন। গঙ্গাধর তার বাবার শ্রাদ্ধ করতে অস্বীকার করায় সকলের মনে হল, এ রকম কাণ্ড ইতিহাসে কোনও দিন ঘটেনি। শুধু পারলৌকিক কাজ করতে অস্বীকারই নয়, ‘মরা গোরু কি ঘাস খায়’ কিংবা ‘বামুন নেবে টাকা সিকি আর স্বগ্যে আমার বাপ বগল বাজাবে, ফুঃ ফুঃ—’ এই ধরনের অশ্রদ্ধেয় উক্তি। যদিও এর বহু আগেই প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের ছেলে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, যাঁর ডাক নাম ছিল মহর্ষি, তিনিও যে পিতৃশ্রাদ্ধ করতে অস্বীকার করেছিলেন, সে-খবর ওখানে কেউ রাখে না।
গঙ্গাধর দত্তকে শাস্তি দেবার জন্য স্থানীয় হিন্দুসমাজ রে রে করে উঠল। কিন্তু শেষ। পর্যন্ত দেখা গেল, শাস্ত্র বহির্ভূত নিছক লোকাঁচার-নির্ভর হিন্দু সমাজের নিয়মকানুন খুব কড়া হলেও ভেতরে ফক্কা, শাস্তি দেবার বিশেষ কোনও অস্ত্র তাদের হাতে নেই। বিশেষত গঙ্গাধরের মতন শক্ত সবল গোঁয়ার মানুষকে। যত জারিজুরি মেয়েদের ওপর। সামাজিক অনুশাসন অসহায় বিধবাদের একাদশীর দিন জলও খেতে না দিয়ে মাটি চাটিয়েছে, কিন্তু পুরুষের রাশ আলগাতে পারেনি। গঙ্গাধর দত্ত চণ্ডীমণ্ডপের বৃদ্ধমণ্ডলীর প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন। গঙ্গাধরের ধোপা-নাপিত বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হল। গঙ্গাধরের মুখ-ভরতি দাড়ি আর মাথায় লম্বা লম্বা চুল–তার নাপিতের দরকার নেই। বাড়িতে বিধবা বোনটা রয়েছে, জামাকাপড় সে-ই কেচে দেয়। গঙ্গাধর হা-হা করে হেসে বলল, আউর কেয়া হ্যাঁয়, বোলো! আউর ক্যা? সামাজিক ক্রিয়াকলাপে তার নেমন্তন্ন বন্ধ–তাতেও কিছু যায় আসে না, কারণ ইতিমধ্যেই আশেপাশের কয়েকখানা গাঁয়ের ছেলেছোকরারা গঙ্গাধরের অনুরক্ত হয়ে পড়েছিল।
তখন চারদিকে রটে গেল যে, গঙ্গাধর দত্তের বাবার অতৃপ্ত প্রেতাত্মা রোজ রাত্তিরে এসে শ্মশানতলার পাশে বাঁশবাগানের মধ্যে কাঁদে। অনেকেই সেই কান্না শুনেছে। এক রাত্তিরে দলবল নিয়ে গঙ্গাধর নিজে গেলেন শ্মশানতলায়। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর সত্যিই শুনতে পেলেন সেই কান্না। একটা প্রকান্ড কাঁপা কাঁপা অতিপ্রাকৃত আওয়াজ সাইরেনের মতো উঁচুতে উঠে আস্তে আস্তে নেমে যাচ্ছে। কোনও মানুষ বা জীবজন্তুর গলা থেকে এ রকম শব্দ বেরোতে পারে না। এরপর একটা মজার ব্যাপার হয়েছিল। অত সাহসী ও প্রচণ্ড নাস্তিক গঙ্গাধর দত্তের ভূতের ভয় ছিল খুব। রাত্তিরবেলা তার ভূতের ভয়ের কাছে কোনও যুক্তিতর্ক টিকত না। ভয় পেয়ে পাশের সঙ্গীকে জড়িয়ে ধরে গঙ্গাধর কাতর ভাবে বলতে লাগলেন, টু অর ফলস? টু অর ফলস? ভোলা, শিগগির বল, আমি একাই শুনতে পাচ্ছি, না তোরাও শুনেছিস?
সে রাত্তিরে ভয় পেয়ে তারা সদলবলে পালিয়ে আসে। তারপর গঙ্গাধর তিন-চার দিন জ্বরে ভুগলেন। কিন্তু হার মানলেন না। সেরে উঠে আবার একদিন গেলেন শ্মশানে। সে দিনও শোনা গেল, সেই দুর্বোধ্য আর্তনাদ। গঙ্গাধর চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, বাবা, আপনি কিছু বললেন? শব্দটা একবার হয়েই থেমে যায়। তারপরই প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা ও বাঁশবনে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। ওদের সঙ্গে একটা টর্চ পর্যন্ত নেই–দুটি হ্যারিকেন। সে দিন ওই দলে আর একজন যুবক ছিল। একটি হ্যারিকেন নিয়ে সে একা এগিয়ে গেল বাঁশবনের দিকে। বলাই বাহুল্য, সেই যুবকটি বিশ্বরঞ্জন।
কিন্তু তারপরই আর একটা কাণ্ড হল। হঠাৎ হাওয়ায় নিভে গেল গঙ্গাধরদের সঙ্গের হ্যারিকেনটা। তখন অলৌকিক বিশ্বাসের হাওয়া বইছে চার দিকে। হ্যারিকেন নিভে যাওয়া তো ভয়ের ব্যাপারই। সবাই সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, রঞ্জ, রঞ্জু ফিরে আয়! শিগগির!
বাঁশবনের সেই শব্দ কিছু দিন পর আপনা-আপনি থেমে যায়। কিন্তু রহস্যের মীমাংসা হল না। গঙ্গাধরের বাবার প্রেতাত্মার কান্নার গল্প স্থায়ী হয়ে গেল ফুলবাড়িতে।
একদিন জয়নাল আবেদিন সারদারঞ্জনকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, পণ্ডিতমশাই আপনার ছেলেকে সামলান।
ছোটছেলের সম্পর্কে নিত্যনতুন অভিযোগ শোনা গা-সহা হয়ে গিয়েছিল সারদারঞ্জনের। কিন্তু জয়নাল আবেদিনের মতন গণ্যমান্য বক্তির সঙ্গে তার ছেলে কী করতে পারে?
বিবর্ণ মুখে সারদারঞ্জন জিজ্ঞেস করলেন, কেন, সে কী করেছে? আপনার কোনও ক্ষতি করেছে সে হারামজাদা?
জয়নাল আবেদিন অবজ্ঞার সঙ্গে বললেন, ওরা দল বেঁধে গুন্ডামি করতে আসে। আমার দোকানের সামনে। কিন্তু সেটুকু সামাল দেবার ক্ষমতা আমার আছে। সে-সব আমি পরোয়া করি না। তবে, আপনি মানী লোক, আপনাকে সাবধান করে দেওয়া আমার কর্তব্য। আপনার ছেলে অস্থানে কুস্থানে যায়! ছেলের এবার তাড়াতাড়ি বিয়ে শাদি দিন!
কোথায় যায়? কোথায় যায় বললে?
স্টিমারঘাটায় কসবিদের ঘরের সামনে রোজ সন্ধ্যাবেলা সে ঘোরাঘুরি করে। আমার লোক দেখেছে।
সারদারঞ্জনের অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতন অবস্থা। তার ভাগ্যে এমন ছিল, এ রকম কথাও শুনতে হল তাঁকে? তার ছেলে বেশ্যাপল্লিতে যায়!
তক্ষুনি ছেলের খোঁজে ছুটলেন সারদারঞ্জন। কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে তাকে? সে তো বেশির ভাগ সময় বাড়িতেই থাকে না। আমবাগানের গোয়ালঘরেও আজকাল যায় না। পাড়া-প্রতিবেশীদের বাড়িতেও নেই। শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যাবেলা সারদারঞ্জন নিজেই। গেলেন স্টিমারঘাটায়।
সেদিন হাটবার, বেশ ভিড়। সবে একটু একটু শীত পড়তে শুরু করেছে। নদীর ওপর পাতলা আস্তরণের মতন জমে আছে কুয়াশা। টাটকা সতেজ তরিতরকারি এসেছে দোকানে। চাষিদের হাতে আউসধান বিক্রির কাঁচা টাকা। বেশ্যাদের ঘরগুলোর সামনে আট-দশ জন মানুষ হাতে হাত ধরাধরি করে শিকল বানিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে গঙ্গাধর এবং বিশ্বরঞ্জন। তারা কোনও খদ্দেরকে ঢুকতে দেবে না। আর ঘরের ভেতর থেকে মেয়েগুলো ওদের উদ্দেশে বর্ষণ করছে পৃথিবীর কুৎসিততম গালাগাল। গঙ্গাধরের দলবল একটু আগে জয়নাল আবেদিনের দোকানের সামনে বিলিতি বস্ত্র বর্জনের আবেদন জানিয়ে পিকেটিং করে এসেছে।
ভিড় ঠেলে সারদারঞ্জন সামনে এসে দাঁড়ালেন। অপমানে তার মাথা কাটা যাচ্ছে। চিৎকার করে বললেন, রঞ্জু, এক্ষুনি চলে আয়।
বিশ্বরঞ্জন শুনেও শুনতে পেল না। অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে রইল। গঙ্গাধর এগিয়ে এসে হাতজোড় করে বললেন, মুখুজ্যে কাকা, আপনি বাধা দেবেন না। আমরা এদের ভালোর জন্যই…
সারদারঞ্জন কুঁকড়ে উঠে বললেন, ছুঁয়ো না, তুমি এত কাছে এসো না–নিজে কুলাঙ্গার, এখন আমার ছেলেকেও—
টেলিগ্রাম পাঠিয়ে সারদারঞ্জন বড় দুই ছেলেকে বাড়িতে আনালেন। তিনি তাদের বললেন, ফুলবাড়িতে থেকে বিশ্বরঞ্জন যদি এসব কীর্তি করে বেড়ায়, তা হলে তিনি পাগল হয়ে যাবেন। একটা কিছু ব্যবস্থা করতেই হবে।
দাদারা অনেক করে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বিশ্বরঞ্জনকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে কলেজে ভরতি করে দিল। বাবার ইচ্ছে মতন তাকে ডাক্তারি পড়াবার পরিকল্পনাই বহাল রইল।
ঢাকায় যাবার পর বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক প্রায় চুকেই গেল বিশ্বরঞ্জনের। মেজদা চিত্তরঞ্জনের বিয়ের সময় একবার মাত্র বাড়িতে এসেছিল, তারপর আর এক বছরের মধ্যে ছুটিছাটাতেও তার দেখা পাওয়া যায় না। কদাচিৎ মাসে দু-এক লাইন চিঠি লেখে।
এক বছর পরেও বিশ্বরঞ্জন বাড়ি ফিরল না, কিন্তু তার খোঁজে এল পুলিশ।
ফুলবাড়ির মানুষ জলজ্যান্ত সাহেব বেশি চোখে দেখেনি। কদাচিৎ স্টিমারের রেলিং ধরে ঝুঁকে দাঁড়ানো সাহেব-মেমদের দেখা গেছে দূর থেকে। কচিৎ কখনও জেলার কালেক্টর সাহেব কয়েক ঘন্টার জন্য থেকেছেন ফুলবাড়িতে। তাঁকেও সকলের চোখে দেখবার সৌভাগ্য হয় না। কর্মোপলক্ষে যেসব গ্রাম্য মানুষ কখনও বরিশাল বা ঢাকায় যায়, তারাই বাড়ি ফিরে এসে স্বচক্ষে সাহেব দেখার গল্প বলে। সাহেবরা তখনও রূপকথার মানুষ। এদের গায়ের রং দেবতাদের মতন। এই টুপিওয়ালারা অসাধ্যসাধন করতে পারে, ভয়ডর বলে কোনও বস্তু এদের শরীরে নেই। সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার থেকে এসে এরা এত বড় দেশটাকে হাতের মুঠোয় পুরে রেখেছে।
ফুলবাড়ির রাস্তা দিয়ে প্রথম একজন সাহেব, স্থানীয় দারোগা আর তিনজন সিপাইকে সঙ্গে নিয়ে প্রকাশ্যে হেঁটে এসে সারদারঞ্জনের বাড়ির সামনে দাঁড়াল। সারদারঞ্জনের নাকের সামনে ব্যাটন তুলে বলল, হোয়ার ইজ ইয়োর সান? টুম ব্রাহমিন, ঝুট বাত মাৎ বোলো! হোয়ার ইজ হি হাইডিং?
সারদারঞ্জন এক বর্ণ ইংরেজি জানেন না। দারোগা তর্জনগর্জন করে অনুবাদ করে দিল। তোমার ছেলে বিশ্বরঞ্জন কোথায় লুকিয়ে আছে, বলো! মিথ্যে কথা বলে লাভ নেই। ব্রিটিশ শাসনের লম্বা হাত তাকে ঠিক খুঁজে বার করবে!
অত ছোঁয়াছানির বাতিক সারদারঞ্জনের, কিন্তু সেই ম্লেচ্ছ সাহেব ও যবন সেপাইরা জুতো পরেই ঢুকে গেল ঘরে ঘরে। সমস্ত জিনিসপত্র উলটেপালটে তছনছ করে দেখল।
বড় শহরের খবর এখানে তিন-চার দিনের আগে পৌঁছোয় না। তবু পুলিশপক্ষ ধারণা করতেই পারেনি যে, সারদারঞ্জন কিছুই জানেন না। দুদিন আগে সারদারঞ্জনের ছেলে। বিশ্বরঞ্জন ঢাকায় পুরনো পলটনে সাহেব পুলিশকমিশনারকে গুলি করে মেরে ফেলে পালিয়েছে। হিউবার্ট সাহেব তখন যুব সমাজের ত্রাস। বিশ্বরঞ্জন তিনটি গুলিতে তার মস্তক ভেদ করে দেয়। সারা দেশে তাই নিয়ে হইচই, শুধু জানে না আসামির বাবা-মা।
বিশ্বরঞ্জন আর ধরা পড়েনি। সে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। এরপর পঁচিশ বছরের মধ্যেও তার কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি। লোকের ধারণা সে সাধু হয়ে হিমালয়ে আছে কিংবা জাভা-সুমাত্রার দিকে পালিয়ে গেছে।
প্রথম পুলিশ আসার দিন দশেক বাদে আবার পুলিশ এসে সারদারঞ্জনকে ঢাকা শহরে নিয়ে যায়। মর্গে তিনটে পচা-গলা শব দেখিয়ে তার ছেলেকে শনাক্ত করতে বলে। কয়েক দিন আগে নদীর ওপর পলাতক অবস্থায় এই তিন জনকে পুলিশ গুলি করে মারে। সারদারঞ্জন দু’ দিকে মাথা নেড়ে জানিয়েছিলেন, এর মধ্যে তার ছেলে নেই।
বাড়ি ফিরে আসার কয়েক ঘণ্টা বাদেই সারদারঞ্জনের পক্ষাঘাত হয়। সেই অবস্থায় বেঁচে ছিলেন দেড় মাস। বাকশক্তিও রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। হাঁ করে মাঝে মাঝে কিছু বলতে চাইতেন, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেন শুধু, চোখ দিয়ে অনবরত জল পড়ত। মৃত্যুর কয়েক মুহূর্ত আগে হঠাৎ যেন অপ্রাকৃত শক্তিতে তিনি বিছানার ওপর ওঠে বসলেন, গলা দিয়ে অদ্ভুত কাতর শব্দ বার করতে লাগলেন। উপস্থিত আত্মীয়স্বজনদের ধারণা, বিশ্বরঞ্জনের নাম ধরে ডাকতে ডাকতেই তিনি মারা গেছেন।
পঁচিশ-তিরিশ বছর ধরে বিশ্বরঞ্জনের নিরুদ্দেশ থাকাটা সম্ভবত গুজব। নানাসাহেব কিংবা সুভাষ বসু সম্পর্কে যে রকম গুজব প্রচলিত আছে, ও রকম সাধারণত হয় না। এমনও হতে পারে, মর্গের মৃতদেহগুলির মধ্যে সারদারঞ্জন তাঁর ছেলেকে চিনতে পেরেছিলেন, কিন্তু প্রকাশ করেননি সে কথা। নইলে তার পরেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন কেন? বিশ্বরঞ্জনের পক্ষে কোথাও অপঘাতে এবং অজ্ঞাতনামা হিসেবে মৃত্যুবরণ করাই সম্ভব। কিন্তু বিশ্বরঞ্জনের আত্মা মরেনি।
এই পরিবারে প্রথম বিশ্বরঞ্জন মারা যায় অতি অল্প বয়সে তাকে বাঁচানোর কত চেষ্টা হয়েছিল। তোক বিশ্বাস অনুসারে সে-ই আবার ফিরে এসেছিল দ্বিতীয় বিশ্বরঞ্জনের মধ্যে। সেই বিশ্বরঞ্জনও পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় পূর্ণ যৌবনের আগে। বহু বছর বাদে বিশ্বরঞ্জনের আত্মা আর একবার ফিরে এসেছিল এই পরিবারে সম্পূর্ণ অন্য চেহারায়, অন্য চরিত্রে।
বইয়ের কথা গুলো অনেক সুন্দর ভালো লেগেছে।