॥ ৪ ॥
‘নাঃ—এ মশাই ভাবা যায় না।’
গভীর সম্ভ্রমের সঙ্গে ফিসফিসিয়ে কথাটা বললেন জটায়ু। উনি বললে হয়ত আমি বলতাম, কারণ এরকম দৃশ্য আমি এর আগে কখনো দেখিনি। প্রায় এক বর্গ মাইল জায়গা জুড়ে ছোট বড় মাঝারি সাইজের পাথর কাত হয়ে পড়ে আছে না হয় খাড়া দাঁড়িয়ে আছে, তার মধ্যে যেগুলোর হাইট সত্যিই উঁচু সেগুলো প্রায় তিন তলা বাড়ির সমান। একেকটা বিশাল দাঁড়ানো পাথর আবার মাঝখান থেকে চিরে দু’ভাগ হয়ে গেছে—হয়ত সুদূর অতীতের কোনো ভূমিকম্পের চিহ্ন। দৃশ্যটার মধ্যে এমন একটা প্রাগৈতিহাসিক ছাপ রয়েছে যে একটা পাথরের পাশ দিয়ে যদি একটা ডাইনোসর বেরিয়ে আসে তাহলেও অবাক হব না।
এইখানেই একটা বিশেষ জোড়া পাথরকে বলা হয় মামা-ভাগ্নে, আর তার থেকে পুরো জায়গাটারই নাম হয়ে গেছে মামা-ভাগ্নে।
গণেশ ঢানঢানিয়ার কাছে বিদায় নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেই ফেলুদা প্রস্তাব করল দুবরাজপুরেই যখন আসা হয়েছে তখন মামা-ভাগ্নে না দেখে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। চৌবেও প্রস্তাব সমর্থন করলেন। সাহেবরা এটার কথা আগে শোনেনি, এসে তাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে। পিটার খালি খালি বলছে ‘ফ্যানট্যাস্টিক… ফ্যানট্যাস্টিক, আর টমের মুখে এই প্রথম হাসি দেখা দিয়েছে। সে একটা ছবি তোলার বিষয়ও পেয়ে গেছে—একটা উঁচু পাথরের মাথায় বসে একটা সাধু চিরুনি দিয়ে দাড়ি আঁচড়াচ্ছে। তিনি কী করে ওই টঙে চড়েছেন তা মা গঙ্গাই জানেন।
পিটার বলল, ‘আচ্ছা, চারিদিকে ত্রিসীমানায় কোনো পাথর দেখছি না, অথচ এইখানে এত পাথর—এ নিয়ে কোনো কিংবদন্তী নেই?’
‘ডু ইউ নো গড হনুমান?’
প্রশ্নটা অপ্রত্যাশিতভাবে করলেন জটায়ু। উত্তরে পিটার মৃদু হেসে বলল, ‘আই হ্যাভ হার্ড অফ হিম।’
এর পরে লালমোহনবাবু যা বললেন, একসঙ্গে এতটা নির্ভুল ইংরিজি বলতে তাঁকে এর আগে কখনো শুনিনি।
‘ওয়েল, হোয়েন গড হনুমান ওয়জ ফ্লাইং থ্রু দ্য এয়ার উইথ মাউন্ট গন্ধমাদন অন হিজ হেড, সাম রকস্ ফ্রম দি মাউনটেন ফেল হিয়ার ইন দুবরাজপুর।’
‘ভেরি ইন্টারেস্টিং,’ বলল পিটার রবার্টসন।
সাহেব থাকা সত্ত্বেও ফেলুদা জটায়ুকে উদ্দেশ করে বাংলায় বলল, ‘হনুমানের কিংবদন্তীটা বোধহয় আপনার কল্পনাপ্রসূত?’
‘নো স্যার!’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন জটায়ু। ‘লজের ম্যানেজার নিজে আমায় এটা বলেছেন। এখানে সবাই এটাই বিশ্বাস করে।’
‘“বাংলায় ভ্রমণ” তা বলেনি।’
‘কী বলেছে?’
‘বলেছে রামচন্দ্র যখন সেতুবন্ধনের জন্য পাথর আনাইলেন, তখন কিছু পাথর পুষ্পক রথ থেকে এখানে পড়ে যায়।’
‘ভালোই, তবে নট অ্যাজ গুড অ্যাজ মাই হনুমান।’
ম্যাক্সওয়েলের মনে হল পাথরের ছবি তুলতে বিশেষ ভালো লাগছে না, যদিও আমার মনে হচ্ছিল পাথরগুলো দারুণ ফোটোজেনিক। ওর সুযোগ এল মামা-ভাগ্নের এক প্রান্তে পাহাড়েশ্বর শিব আর শ্মশানকালীর মন্দিরে এসে।
মন্দিরে পুজো দেওয়া ও বোধহয় এই প্রথম দেখল, কারণ দেখলাম ওর ক্যামেরার খচ খচ শব্দ আর থামছে না। এই শ্মশানকালীকেই নাকি রঘু ডাকাত পুজো দিত।
চৌবে দেখলাম ম্যাক্সওয়েলের কান্ড দেখে একটু বিচলিত হয়ে পড়েছেন। বললেন, ‘এখানে অনেকেই কিন্তু বিদেশীরা যে সব কিছুর ছবি তুলে নিয়ে যায় সেটা পছন্দ করে না। এই ব্যাপারে তোমাকে একটু সাবধান হতে হবে।’
‘কেন?’ ফোঁস করে বলে উঠল ম্যাক্সওয়েল। ‘এখানে চোখের সামনে যা ঘটছে তারই ত ছবি তুলছি আমি, জোচ্চুরি ত করছি না।’
‘তাও বলছি—কখন, কী নিয়ে কে আপত্তি করে বসে তা বলা যায় না। ভারতীয়রা এ ব্যাপারে একটু সেনসিটিভ। আমাদের কিছু আচার ব্যবহার বিদেশীদের চোখে দৃষ্টিকটু লাগা অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু সেগুলোর ছবি তুলে বাইরে প্রচার করাটা অনেকের কাছেই আপত্তিকর মনে হতে পারে।’
ম্যাক্সওয়েল তেড়েমেড়ে কী যেন বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু পিটার তাকে একটা মৃদু ধমকে নিরস্ত করল।
আমরা মামা-ভাগ্নে দেখে তেষ্টা মেটানোর জন্য কিছুদূরে রাস্তার ধারে একটা চায়ের দোকানে গিয়ে রাস্তার উপরেই রাখা বেঞ্চিগুলোতে বসে চা আর নানখাটাই অর্ডার দিলাম। হরিপদবাবু বললেন উনি এই ফাঁকে একবার চা খেয়ে নিয়েছেন তাই আর খাবেন না।
ইন্সপেক্টর চৌবে ফেলুদার পাশে বসেছিলেন, তাঁর পাশে আমি। তাই চৌবে যে কথাটা বললেন সেটা আমার কানে এল।
‘আপনার নাম শুনেই আমি আপনাকে চিনেছি, কিন্তু সেটা আর প্রকাশ করিনি, কারণ মনে হল যত্রতত্র আপনার আসল পরিচয়টা প্রকাশ পেয়ে যায় সেটা হয়ত আপনি চাইবেন না।’
‘আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন,’ বলল ফেলুদা।
‘এখানে কি বেড়াতে?’
‘পুরোপুরি।’
‘আই সী।’
‘আপনি ত বিহারের লোক বোধহয়।’
‘হ্যাঁ, কিন্তু পাঁচপুরুষ ধরে আমরা বীরভূমেই রয়েছি। ভালো কথা, ম্যাক্সওয়েল ছেলেটির সঙ্গে ভারতবর্ষের কোনো যোগসূত্র আছে কি?’
‘ম্যাক্সওয়েলের ঠাকুরদার ঠাকুরদাদা এই বীরভূমেই একটা নীলকুঠির মালিক ছিলেন। নাম বোধহয় রেজিন্যাল্ড ম্যাক্সওয়েল।’
‘তাই হবে। আমি ছেলেবেলায় বাপ-ঠাকুরদাদার মুখে এক ম্যাক্সওয়েল সাহেবের নাম শুনেছি, তিনিও নীলকুঠির মালিক ছিলেন। লাভপুরের কাছে ছিল তাঁর কুঠি। গাঁয়ের লোকে বলত ম্যাকশেয়াল সাহেব। তারপর ক্রমে সেটা খ্যাঁকশেয়ালে পরিণত হয়।’
‘কেন?’
‘কারণ লোকটা ছিল ঘোর অত্যাচারী এবং অহংকারী। এর মধ্যেও দেখছি সেই পূর্বপুরুষের রক্ত কিছুটা বইছে। অথচ রবার্টসন সাহেব কিন্তু একবারেই সেরকম নন, সত্যি করেই ভারতবর্ষ ও ভারতীয়দের ভালোবাসেন।’
চা পর্ব সেরে দুবরাজপুরের দু’মাইলের মধ্যে হেতমপুরে কয়েকটা সুন্দর টেরা কোটা মন্দির দেখে আমরা লাঞ্চের আগেই টুরিস্ট লজে ফিরে এলাম। হেতমপুরের মন্দিরের গায়ে দুশো বছরের পুরোনো থামে মেমসাহেবের মূর্তি দেখে রবার্টসন মুগ্ধ। ম্যাক্সওয়েলের দেখলাম মন্দির সম্বন্ধে কোনো কৌতূহল নেই। সে রাস্তার ধারে টিউবওয়েলে এক মা তার বাচ্চাকে স্নান করিয়ে দিচ্ছিল, তারই কয়েকটা ছবি তুলে ফেলল।
হেতমপুর থেকে চৌবে বিদায় নেবার আগে ফেলুদা তাকে একটা প্রশ্ন করল।
‘আপনার সঙ্গে ত ঢানঢানিয়ার যথেষ্ট পরিচয় আছে দেখলাম। লোকটা কেমন?’
চৌবে বলল, ‘পরিচয় মানে ও আমাকে হাতে রাখতে চায়। ওর নানারকম সব ধোঁয়াটে কারবার আছে, তাই পুলিশের সঙ্গে ওর দোস্তি রাখাটা দরকার। আমি অবশ্য ওর খাতিরের মানে বুঝি এবং সব সময়ই চোখ কান খোলা রাখি। গোলমাল দেখলে আমি ওকে রেহাই দেব না। তবে লোকটা ধনী। ওই রুবির জন্য দশ লাখ দিতে ওর গায়ে লাগবে না।’
‘ওঁর ছেলে কি ওর বাপের ব্যবসা দেখে?’
‘কিশোরীলালের নিজের ইচ্ছা নেই বাপের ব্যবসায় থাকার। সে নিজে একটা কিছু করতে চায়, এবং সেই নিয়ে তার বাপের সঙ্গে কথাও হয়েছে। গণেশ তার ছেলেকে খুব ভালোবাসে, তাই শেষ পর্যন্ত সে রাজিও হয়ে যেতে পারে।’
‘আই সী।’
‘ভালো কথা—আপনাদের কালকের প্ল্যান কী?’
‘কাল ভাবছি সকালে একবার কেন্দুলীর মেলাটা দেখে আসব।’
‘আপনারা সবাই যাবেন? ইনক্লুডিং এই দুই সাহেব?’
‘সেরকমই ত মনে হয়।’
‘তাহলে আপনাকে বলে দিই—আপনি এই ম্যাক্সওয়েল ছোকরাটির উপর একটু দৃষ্টি রাখবেন। ওর ব্যবহার আমার মাথায় দুশ্চিন্তা ঢুকিয়ে দিয়েছে।’
‘নিশ্চয়ই রাখব।’
লজে ফিরে এসে আরো দুজনের সঙ্গে আলাপ হল—তাদের কথা এই বেলা লিখে রাখি।
এক—মিস্টার নস্কর। ইনি কলকাতার একজন নাম-করা ধনী ব্যবসায়ী। ইনি আগেই দুটোর সময় নিজের গাড়ীতে এসে পৌঁছেছেন।
দুই—জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়। ইনি বোলপুরেই থাকেন। স্টেটসম্যানে পিটারের লেখাটা পড়ে সোজা আমাদের সঙ্গে এসে দেখা করে বললেন উনি বীরভূম সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ। এখানকার প্রত্যেকটি টেরা কোটা মন্দির ওঁর দেখা এবং সে ব্যাপারে উনি সাহেবদের খুব সাহায্য করতে পারেন। পিটার তাঁকে বলে দিল ওর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে।
মিঃ নস্কর—পরে জেনেছিলাম পুরো নাম অর্ধেন্দু নস্কর—টুরিস্ট লজে এসে লাউঞ্জে আমাদের দেখা পেলেন। আমরা সবাই তখন লাঞ্চের ডাক কখন পড়বে তার অপেক্ষায় বসে আছি। ভদ্রলোক এসে ঢুকতে আমাদের সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন, কারণ চেহারাটা বেশ চোখে পড়ার মতো। টকটকে গায়ের রঙ, ফ্রেঞ্চ কাট কালো দাড়ি, চোখে রিমলেস চশমা, পরনে গাঢ় নীল সুটের সঙ্গে জামার উপর কালো নকশা করা স্কার্ফ।
ভদ্রলোক দুজন সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে ‘মিঃ ররার্টসন?’ বলতেই পিটার উঠে দাঁড়িয়ে তার হাতটা বাড়িয়ে দিল। ভদ্রলোক করমর্দন করে বললেন, ‘মাই নেম ইজ ন্যাস্কার। আমি স্টেটসম্যানে তোমার লেখাটা পড়ে খোঁজখবর করে তোমার সঙ্গে দেখা করব বলে সোজা এখানে চলে আসছি আমার গাড়িতে।’
‘হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ?’
নস্কর একটা চেয়ার টেনে নিয়ে পিটারের মুখোমুখি বসে বলল, ‘আগে তোমার মুখ থেকে আমি একটা কথা শুনতে চাই…’
‘কী?’
‘দেড়শো বছর আগে তোমার পূর্বপুরুষ তাঁর ডায়রিতে যে বাসনার কথা লিখেছেন, তুমি কি সত্যিই সেটা পূরণ করতে এদেশে এসেছ?’
‘অ্যাবসোলিউটলি,’ বলল পিটার।
‘তুমি কি অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস কর? তোমার কি সত্যিই ধারণা যে রুবিটা ভারতবর্ষে ফেরত দিলে তোমার পূর্বপুরুষের আত্মা শান্তি পাবে?’
পিটার শুক্নো গলায় উত্তরটা দিল।
‘আমি কী বিশ্বাস করি বা না করি সেটা জানার কী দরকার? যতদূর বুঝছি আপনি রুবিটা কেনার প্রস্তাব করছেন। আমার উত্তর হল আমি ওটা বেচব না।’
‘তুমি তোমার দেশের জহুরীকে এটা দেখিয়েছ?’
‘দেখিয়েছি।’
‘রুবির দাম তার মতে কত হতে পারে?’
‘টোয়েন্টি থাউজ্যান্ড পাউন্ডস।’
‘পাথরটা কি হাতের কাছে আছে? সেটা একবার দেখতে পারি কি?’
পাথরটা টমের কাছেই ছিল; সে ব্যাগ থেকে কৌটোটা বার করে নস্করকে দিল। মিঃ নস্কর কৌটোটা খুলে পাথরটা বার করে বেশ কিছুক্ষণ ধরে সেটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে তারপর পিটারের দিকে ফিরে বলল, ‘তোমাদের দুজনের কাউকেই ত তেমন ধনী বলে মনে হচ্ছে না।’
‘তার কারণ’, বলল পিটার, ‘আমরা ধনী নই। কিন্তু এও বলতে পারি যে আমরা লোভীও নই।’
‘আমরা দুজনে কিন্তু এক ছাঁচে ঢালা নই’, টম ম্যাক্সওয়েল হঠাৎ বলে উঠল।
‘তার মানে?’ নস্কর শুধোলেন।
পিটার বলল, ‘আমার বন্ধু বলতে চাইছে যে এ ব্যাপারে আমাদের দুজনের মধ্যে মতের সম্পূর্ণ মিল নেই। অর্থাৎ রুবিটা বিক্রি করে দু’ পয়সা রোজগারের ব্যাপারে তার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু রুবিটা ত ওর প্রপার্টি নয়, আমার প্রপার্টি; কাজেই ওর কথায় তেমন আমল না দিলেও চলবে।’
টম দেখি গম্ভীর হয়ে গেছে, তার কপালে গভীর খাঁজ।
‘এনিওয়ে’, বললেন নস্কর, ‘আমি এখানে আরো তিনদিন আছি। শান্তিনিকেতনে আমার বাড়ি রয়েছে। আমি আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখব। অত সহজে আমাকে ঝেড়ে ফেলতে পারবেন না মিস্টার রবার্টসন। আমি আপনাকে বারো লাখ টাকা দিতে রাজি আছি। আমার মূল্যবান পাথরের সংগ্রহ সারা ভারতবর্ষে পরিচিত। এত বড় একটা রোজগারের সুযোগকে আপনারা কেন হেলাফেলা করছেন জানি না। আশা করি ক্রমে আপনাদের মত পরিবর্তন হবে।’
পিটার বলল, ‘এখানে একটা কথা কিন্তু বলা দরকার। আপনার আগে আরেকজন আমাদের অফার দিয়েছেন।’
‘কে?’
‘দুবরাজপুরের একজন ব্যবসায়ী।’
‘ঢানঢানিয়া?’
‘হ্যাঁ।’
‘ও কত দেবে বলেছে?’
‘দশ লাখ। সেটা আরো বাড়বে না এমন কোনো কথা নেই।’
‘ঠিক আছে। ঢানঢানিয়াকে আমি খুব চিনি। ওকে আমি ম্যানেজ করে নেব।’
মিঃ নস্কর আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন, আর ওদিকে ডাইনিং রুম থেকে খবর এলো যে পাত পড়েছে।