ফারুক হঠাৎ জেগে উঠল ইয়াসিনের কণ্ঠস্বরে! ইয়াসিন তাকে কয়েকবার ডাকল, হুজুর, হুজুর, ঘুম গেলেন নাকি?
কিছুটা সময় লাগল তার সেই ঘোর ভাঙতে। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল, আচ্ছন্ন হয়েছিল। এখন চোখ মেলে তাকাল। ছইয়ের ভেতরটা কী অন্ধকার। পাশ ফিরে তাকাল বাইরে। সেই। যে তারাগুলো দুলছিল এখন তাদের আর দেখা যাচ্ছে না। তার বদলে অনেক নিচে দিগন্তের কিছু ওপরে একটা বিরাট নিঃসঙ্গ তারা ধ্বক ধ্বক করছে। অত্যন্ত সূক্ষ্ম তার একটা রেখা। এসে বুঝি পড়েছে নদীর জলে, নৌকোর কিনার অবধি। আর ফারুক যেন কিছুই শোনেনি। ভাবতে লাগল অতীতের কথা। ইয়াসিন আবার একবার ডাকল। ফারুক এবার বলল, না, ইয়াসিন ঘুমোই নি। ভাবছিলাম। আচ্ছা আর কতক্ষণ লাগবে তোমার পৌঁছুতে?
বেশি না হুজুর। আর ঘণ্টা খানেক।
ও।
আপনি ঘুম যান। নৌকো একেবারে সায়েবের বাংলোর কাছে গিয়ে লাগবে। আপনাকে ডেকে দেব।
আচ্ছা। তুমি বাও।
ফারুক আবার শরীর শিথিল করে এলিয়ে দিল। কেমন ভার হয়ে এলো তার চোখ। স্রোতের টানে বয়ে যাচ্ছে নৌকা। আর এক বিচিত্র শিরশিব অনুভূতি সে স্পষ্ট অনুভব করতে লাগল শিরায় শিরায়। কেমন ঝিমঝিম একটা সুর তরংগের মত। রাতের এই প্রহর পেরিয়ে নদীর দুই পাড় ছাপিয়ে তীরের দীর্ঘ একেকটা গাছের সারের ভেতর দিয়ে সেই সুর যেন অনন্তকাল প্রবাহিত হয়ে গেল।
ইয়াসিন দাঁড় টানছে আস্তে আস্তে। অল্প শব্দ উঠছে।
এবার গুনগুন করে গান ধরল—- “ও আমার গুরুর কথা বলবো
কী,
আমার ভরিয়া গেছে দুই আঁখি।”
সেই গুনগুন এসে কোমল মূচ্ছনা তুলল ফারুকের ভেতরে। সে তন্ময় হয়ে গেল। ইয়াসিন এবার আরো স্পষ্ট করে গেয়ে উঠল,
“ও বোয় যেমন স্বপ্ন দেখে
মনের আগুন মনে রাখে
আমারও ভিতরে তেমনি–”
ক্রমে উদাত্ত হয়ে এলে তার কণ্ঠস্বর। ভারী হয়ে নামলো ফারুকের বুকের ভিতরে। সে নিঃসাড় পড়ে রইল। ডুবে গেল ক্রমে ক্রমে। ইয়াসিনের গলা যেন অনেক অনেক দূরে সরে যাচ্ছে। একসময় বুঝি আর সে শুনতে পাবে না। ধীরে ধীরে চোখের পাতা ভার হয়ে এল তার।