০৪. প্রতিমা উপাসনা, বিবিক্তবাদ ও পাপ
যে মুহূর্ত থেকে পিতৃত্বের আসল কারণটি উদ্ভাবিত হলো তখন থেকে ধর্ম যৌনতা প্রতি অতিমাত্রায় সচেতন হয়ে পড়ে। এর অন্তরালে আরেকটি সত্য আছে, যা কিছু রহস্যময় গুরুত্বপূর্ণ তার প্রতি ধর্মের আকর্ষণ বড় প্রবল। কৃষিভিত্তিক ও গ্রাম্য অবস্থায় সমাপ্তিমূলক সফলতা ছিল পুরুষের একমাত্র কাম্য। অকৃষিজ ফসল, গৃহপালিত পশু-পাখি অথবা নর-নারী যে ক্ষেত্রেই হোক না কেন, সর্বদা ভালো ফসল পাওয়া যেত না এবং প্রতিটি কার্যে সৃষ্টি করতো না গর্ভাবস্থা। কাঙ্ক্ষিত ফলোভের জন্য ধর্ম ও যাদুবিদ্যার সংমিশ্রণ শুরু হয়। সহানুভূতিসম্পন্ন যাদুবিদ্যায় সাধারণ মতবাদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চিন্তা করা হলো যে, মানুষের উর্বরতা বৃদ্ধি করলে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পাবে। মানুষের উর্বরতা বৃদ্ধি করার আকাঙ্খা সুপ্ত ছিল আদিম গোষ্ঠীর মধ্যে। তারা বিশ্বাস করত বিভিন্ন ধার্মিক ও যাদুবিদ্যা সংক্রান্ত উৎসবে।
প্রথম যুগের চার্চে সেইন্ট পলের চিন্তাধারাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হলো। সৌন্দর্যকে পবিত্র হিসেবে মনে করা হতো এবং শয়তানের পাশবিক শক্তিকে কামনার্ত দৃশ্যকল্প দ্বারা আঘাত করার জন্য পুরুষকে আত্মনিয়োগ করার জন্য অনুপ্রেরণা দেওয়া হতো।
যা কিছু সমস্যা হতো তা বিচার করলে পাপ কর্মে প্ররোচিত করে, এই কথা ভেবে চার্চ স্নান করার অভ্যাসকে আক্রমণ করে। অশুচিতাকে প্রশংসনীয় হিসেবে চিহ্নিত করা হলো এবং পবিত্রতার সুগন্ধ ক্রমে ক্রমে চতুর্দিক ভরিয়ে তোলে। সেইন্ট পাইলা মন্তব্য করেছেন, শরীর এবং আচ্ছাদনের পবিত্রতার অর্থ হলো আত্মার অপবিত্রতা। লিসে একে বলেছেন–ঈশ্বরের মুক্তি এবং পবিত্র মানুষের অপরিহার্য চিহ্ন হলো তাকে উন্মোচিত করা।
সেইন্ট আব্রাহাম নামে এক সন্ন্যাসী ছিলেন। যিনি সন্ন্যাস গ্রহণের পর পঞ্চাশ বছর অতিবাহিত করেন। সন্ন্যাস লাভের পরমুহূর্ত থেকে তিনি তাঁর মুখ অথবা পাদুকা দুটি ধৌত করতেন না। একথা কথিত আছে, তিনি ছিলেন একক সৌন্দর্যের মূর্ত প্রতীক এবং তাঁর জীবনীকার কিছুটা অবাক হয়ে মন্তব্য করেছে যে, তাঁর মুখমন্ডলে প্রতিফলিত হতো আত্মার পবিত্রতা।
সেইন্ট আমন কখনো তাকে উলঙ্গ অবস্থায় দেখেননি। অলিভিয়া নামে এক সুপ্রসিদ্ধা কুমারী সন্ন্যাসিনী বললেন, যদিও তাঁর বয়স হয়েছিল আশি এবং নিজের কার্যকারণে তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন, তা সত্ত্বেও ধার্মিক তথ্যে বিশ্বাসী হয়ে তিন আঙুল ব্যতীত দেহের অন্য কোনো অংশ ধৌত করতে অনুমতি দিতেন না।
সেইন্ট ইউফ্যারাকসিস (Euphxaxis) একশ ত্রিশ জন সন্ন্যাসিনীর সমাবেশে যোগদান করেন, যারা কখনও তাদের পদযুগল পরিস্কার করতেন না এবং স্নানের কথা উঠলে শিউরে উঠতেন।
এক ব্যক্তি একদা ভেবেছিল যে, শয়তানের প্রতিমূর্তি তাকে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে ভয় দেখাচ্ছে। কেননা সে দেখেছে, মরুভূমির মধ্য দিয়ে উড়ে আসছে এক নগ্ন ছায়ামূর্তি যার গায়ে নোংরা আস্তরণ এবং দীর্ঘ সময় অনাবৃত থাকায় সে হয়েছে কুৎসিৎ, বাতাসে ভাসছে তার সাদা চুল। একদা ইনিই ছিলেন ইজিপ্টের রূপসী মহিলা সেইন্ট মেরি, যিনি সাতচল্লিশ বছর ধরে তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে চলেছেন।
সন্ন্যাসিনীগণের তাৎক্ষণিক অবলুপ্তিকে নিন্দার বিষয় বলে ভাবা হতো। বিশিষ্ট সন্ন্যাসী আলেকজান্ডার শোকাহত চিত্তে অতীতের দিকে অবলোকন করে মন্তব্য করেছেন, আমাদের পিতৃপুরুষরা কখনো তাদের মুখমণ্ডল পরিস্কার করতেন না, কিন্তু আমরা প্রায়ই স্নানে অংশগ্রহণ করি। এর কারণ ছিল, মরুভূমির মধ্যে অবস্থিত মঠের সন্ন্যাসীরা পান করার মতো জলের অভাবে যথেষ্ট কষ্ট পেতেন। কিন্তু সন্ন্যাসী থিওডোসিয়াসের প্রার্থনায় অনন্ত জলের উৎস ধারা সৃষ্টি হয়। শীঘ্রই কয়েকজন সন্ন্যাসী অনন্ত জলস্রোত দ্বারা আবর্তিত হয়ে তাদের সুপ্রাচীন পবিত্রতা থেকে বিচ্যুত হন এবং স্নান করার জন্যে ঐ জলকে ব্যবহার করার অভিপ্রায়ে অধ্যক্ষের অনুমতি আনতে যান।
তারপর সেই স্নান সমাধান হল। কিন্তু শুধুমাত্র একবার সন্ন্যাসীগণ এই স্বাধীনতা ভোগ করেন, তারপর স্রোতধারা বন্ধ হয়ে গেল। প্রার্থনা, অশ্রু ও উপবাস বিফল হলো। কেটে গেল পুরো একটি বছর। অবশেষে মঠাধ্যক্ষ স্নান করাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন। এটিকে স্বর্গীয় নিরানন্দ বস্তুরূপে চিহ্নিত করলেন এবং পুনরায় জলধারা প্রবাহিত হলো।
এর থেকে প্রমাণিত হয় যে, যৌনতা সম্পর্কেও একই ধরনের মনোভাব প্রচলিত ছিল। যৌন সম্পর্কে আরোপিত হতো নিষ্ঠুর বর্বরতা। যেমন ভাবে নিষেধের দ্বারা তৃষ্ণা নিবারনকে কাক্ষিত করা হয়। ভালোবাসার লীলাখেলা হলো বিস্তৃত এবং বিবাহকে রুক্ষ কাঠিন্যে নিষ্করুণ করা হলো।
স্বর্গীয় নৈতিকতার মতাদর্শ মানুষের হৃদয়ে যে ভাবের সৃষ্টি করেছে তা মহান এবং শারীরিক পবিত্রতার গুরুত্বকে স্বীকার করার পক্ষে যথেষ্ট বরণীয়। তার বিরাটত্ব সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সন্দেহ প্রকাশ না করে বরা যায় যে, সেই মনোবৃত্তিকে বিসম করেছিল বিবাহ সম্পর্কিত কঠিন চিন্তা। শুস্ক করুণ লেখনীমালার মধ্যে আবদ্ধ ঐ মতাদর্শের দুটি–তিনটি সৌজন্যমণ্ডিত বর্ণনারাজি তাকে কারুণিক করতে পারে নি। কিন্তু সাধারণভাবে বলা যায় যে, ঐ ব্যবস্থাগুলি যেভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল তা অনেক বন্য ও বিকর্ষণকারী।
মৃত্যু দ্বারা আহুত শোকের প্রতিষেধক হিসেবে প্রকৃতি যে মহান সম্পর্ক স্থাপন করেছে এবং লিনিয়াস প্রদর্শিত পথে যে সম্পর্ক পুনরায় পৃথিবীতে বিস্তৃত, তাকে আদমের পতন দ্বারা উদ্ভূত বলে নিম্নতম যৌক্তিকতায় চিহ্নিত করেছে বিবাহের বিকৃত চিন্তা। সুক্ষ্ম ভালোবাসার বিচিত্র সুন্দর অনুভূতি, ধীরে ধীরে উদ্ভাসিত গার্হস্থ্য গুণাবলির পবিত্র সুন্দরতাময় উপস্থিতি ইত্যাদিকে চিন্তাধারার মধ্যে আনা হয়নি। স্বর্গীয় পবিত্রতায় উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে অনন্ত কৌমার্যের প্রতি আকর্ষিত করা এবং এই মতবাদের অবশ্যম্ভাবী ফলরূপে বিবাহকে নিকৃষ্ট মানসিকতার পরিচায়ক প্রতীকস্বরূপ ভাবা হলো। বিবাহকে অপরিহার্য বলে ধরা হলো এবং সেই কারণে এটি ছিল অবশ্যম্ভাবী। যেমন বংশবিস্তারের জন্য ও স্বাধীন মানুষকে বৃহত্তর পাপের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে বিবাহের সবিশেষ ধামার সোনার বাংলা প্রয়োজনীয়তার কথা সকলে মেনে নিলেন। তা সত্ত্বেও চরম পবিত্রতার পথ হয়ত চ্যুতিস্বরূপ বিকৃতরূপে বিবাহকে চিহ্নিত করা হলো। সেইন্ট জেরোমে দৃপ্তব্যঞ্জক ভাষায় ঘোষণা করেন, কৌমার্যের কুঠার দ্বারা বিবাহের অরণ্য প্রকৃতিকে কর্তন করা হলো। তিনি ছিলেন সর্বশেষ সন্ন্যাসী এবং যদি তিনি বিবাহ ব্যবস্থাকে প্রশংসা করে শান্তি পেতে চান, তাহলে ভাবা যেতে পারে যে, কুমারী সৃষ্টি করার ক্ষমতার জন্যে তা করা হয়েছে। যখন নিবিড় বন্ধন দ্বারা পুরুষ ও স্ত্রী গ্রন্থিত হত, স্বর্গীয় কামনা করারুদ্ধ হত। আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি যে, এই ঘটনা কিভাবে গার্হস্থ্য জীবনের অন্যান্য সম্পর্ককে প্রভাবিত করেছে। এর মধ্যে পবিত্রতম ছিল দশ দফা তিক্ততার বিবৃতি।
যখনই শক্তিশালী ধার্মিক নীতিবোধ এসে স্বামী অথবা স্ত্রীকে উদ্বুদ্ধ করত, তার প্রথম প্রভাব পড়তো পবিত্র মিলনকে অবাস্তব করার মধ্যে। ধার্মিকতাবোধ আলোকিত অংশীদার তৎক্ষনাৎ নিঃসঙ্গ স্বর্গীয় পবিত্রময় জীবন যাপনের দুর্মর বাসানায় প্রলুদ্ধ হত। অথবা যদি কোনো দৃশ্য বিচ্ছেদ না ঘটত তাহলে বিচ্ছিন্নতাবাদী জীবনধারা দেখা যেত। পূর্বপুরুষদের বিক্ষিপ্ত রচনাবলিতে এই ব্যাপারগুলির উল্লেখ আছে। সন্তাদের উপকথায় এর অস্তিত্ব দেখা যায়। সাহিত্যের এই বিভাগে যাদের সামান্য জ্ঞান আছে, তাঁরা সবাই বিষয়টি সম্যক অনুধাবন করতে পারতেন।
এখানে কয়েকটি উদাহরণ প্রযুক্ত হলো। সেইন্ট লিনিয়াস দুটি সন্তানের জনক হবার পর স্বর্গীয় একাকীত্বের প্রতি আকৃষ্ট হন। অনেক অশ্রুপাতের পরে তার স্ত্রী অন্য ব্যবস্থায় সম্মত হলেন। বিবাহ রাত্রে সেইন্ট আমন তাঁর নবপরিণীতা বধূকে বিবাহিত অবস্থায় ক্ষতির কথা বিবৃত করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তারা বিচ্ছিন্ন হতে চান। সেইন্ট মেলানিয়া দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় তাঁর স্বামীকে বোঝাতে সমর্থ হন যে, তিনি শয্যা ছেড়ে যাবেন।
বিবাহের রাতে সেইন্ট আব্রাহাম তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে ছুটে পালিয়ে যান। সেইন্ট গ্যালোসিস, যার কথা বিবৃত আছে শেষোক্ত কালের উপকথায়, তিনিও একই কার্যে প্রবৃত্ত হন। কিন্তু অনেক বছর বাদে জেরুজালেম থেকে তাঁর পিতার গৃহে প্রত্যাগমন করেন। সেখানে তখনো তার স্ত্রী নিজের দুর্ভাগ্যের জন্যে অনুশোচনা করছে এবং ঈশ্বরের করুণা লাভের আশায় প্রার্থনা করছে। সেইন্ট আলেকসিস সেখানে মৃত্যু অবধি সম্পূর্ণ অবজ্ঞাত হয়ে দিনাতিপাত করেন।
সেবাইতের সন্ন্যাসীবৃন্দ এবং সেইন্ট পলের মতো ক্যাথলিক চার্চ কিন্তু এতখানি অজৈবিক ছিল না। সেইন্ট পলের উপদেশবলি পাঠ করে একজন ভাবতে পারে যে, বিবাহকে শুধুমাত্র কামের নীতিপূর্ণ প্রকাশপথ বলে মনে করা হয়। তাঁর নির্দেশ থেকে এই চিন্তার উদয় হবে না যে, তিনি জন্ম নিয়ন্ত্রণের ওপর নিষেধ আরোপ করেছেন। পক্ষান্তরে মনে হতে পারে যে, তিনি গর্ভাবস্থা এবং শিশু জন্মের মুহূর্তকে বিপজ্জনকরূপে বর্ণনা করেছেন।
চার্চ থেকে উদ্ভূত হলো অন্য মতপদ। গোঁড়া খ্রিস্টান ভাবাদর্শ অনুসারে বিবাহের দুটি প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। এক, সেইন্ট পল দ্বারা স্বীকৃত উদ্দেশ্য এবং অন্যটি, সন্তান লাভের আকাঙ্খ। এর ফলে সেইন্ট পলের যুগে যৌন নৈতিকতা যতখানি জটিল ছিল, তার চেয়েও বেশি জটিলতা আরোপিত হলো। বিবাহ ব্যতিরেকে যেকোনো যৌনতাকে পাপ বলে গণ্য করা হত। শুধু তাই নয়, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে সহবাস গর্ভাবস্থায় সৃষ্টি করে না, তাও সমাজের চোখে সমান নিন্দনীয় ছিল।
ক্যাথলিক চার্চ মনে করত যৌন সঙ্গমের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো আকাঙ্খিত সন্তান লাভ করা। এই একটি মাত্র উদ্দেশ্য সাধিত হলে আরোপিত নিষ্ঠুরতাকে অগ্রাহ্য করা যেতে পারে। যদি স্ত্রী যৌন সহবাসকে ঘৃণা করে, যদি শিশুসন্তানটি রুগ্ন অথবা উন্মাদ হয়, যদি দারিদ্রতার চরম অবস্থাকে প্রতিরোধ করার মতো যথেষ্ট অর্থ না থাকে, তা সত্ত্বেও পুরুষ তার স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠিত দাম্পত্য অধিকারকে স্থাপন করবে, যদি সে সন্তান উৎপাদনের আকাঙ্খ বহন করে।
এ সম্পর্কে ক্যাথলিক শিক্ষকের মধ্যে দুটি উপাদান আছে। একদিকে এটি সেন্ট পল প্রবর্তিত স্বর্গীয় পবিত্রতাকে স্থাপন করেছে এবং অপরদিকে এই মতবাদ পৃথিবীর বুকে যত বেশি সম্ভব আত্মা আনয়নের চেষ্টা করেছে, কেননা প্রতিটি আত্মা মোক্ষ লাভ করতে পারে।
কয়েকটি কারণ আমি অনুধাবন করতে অসমর্থ, যে সকল আত্মা নিন্দাবাদ লাভ করতে ইচ্ছুক, তাদের কেন কর্তব্যের মধ্যে আনা হবে না। সেই কারণে ক্যাথলিকরা তাদের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে প্রোটেস্ট্যান্ট দ্বারা অনুসৃত জন্মনিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করেছে। কেননা তারা চিন্তা করেছেন যে প্রোটেসট্যান্ট শিশুদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে রাজনৈতিক কার্যধারায় সাহায্যে বিনষ্ট করতে না পারলে পরবর্তী পৃথিবীকে তারা চিরন্তর বিবাদের স্থানে পরিণত করবে। এই মতবাদ তাদের কার্যবলিকে কিয়দংশে নিষ্ঠুর করেছে। কিন্তু নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, এই সকল রহস্যকে যথাযথভাবে বিশ্লেষিত করা হয়নি।
বিবাহের অন্যতম উদ্দেশ্যরূপে সন্তানের স্বীকৃতিকে ক্যাথলিক মতবাদ আংশিকভাবে স্বীকার করেছে। এ তত্ত্ব এই সিদ্ধান্তে বিশ্বাস করে, যে সহবাস সন্তান লাভে কাঙ্খিত নয় তা নিন্দনীয়। প্রজনন ক্ষমতার বিচারে বিবাহকে বৈধ ঘোষণা করার অনুমতি দেবার মতো সাহস তার ছিল না। যাই হোক একজন পুরুষ সর্বতোভাবে সন্তান কামনা করতে পারে কিন্তু যদি দেখা যায় তার স্ত্রী বন্ধ্যা সেই পুরুষ খ্রিস্টান নৈতিকতা থেকে কোনো সাহায্য পাবে না। আসল কথা হলো, বিবাহের আশাব্যঞ্জক লক্ষ্য, সন্তান উৎপাদন সামান্য অংশ লাভ করেছে এবং সেইন্ট পলের মন্তব্য অনুসারে, পাপ রোধ করার প্রয়াসকে প্রধান উদ্দেশ্যরূপে বিবেচিত করা হয়েছে। ব্যভিচারিতা এখনো কেন্দ্রস্থলে আসীন এবং বিবাহকে কম নিন্দনীয় বিকল্প হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছে।
বিবাহ সংক্রান্ত এই নিকৃষ্ট মনোভাবকে পাকা করার জন্যে ক্যাথলিক চার্চ ঘোষণা করেছে যে, বিবাহের তথ্য অতি পবিত্র। এই মতবাদের ব্যবহারিক কার্যময়তা স্বীকার করে বিবাহ হলো অচ্ছেদ্য বন্ধন। দুপক্ষের কোনো পক্ষ সেই বন্ধনকে স্বীকার করল কি করলো না। এক পক্ষ উন্মাদ, অথবা যৌনরোগী অথবা মাতাল কিংবা প্রকাশ্যে অন্য আরেক জাতের সঙ্গে অবৈধ জীবন স্থাপন করল, তা সত্ত্বেও দুজনের সম্পর্কের পবিত্রতায় ফাটল ধরল না। কিন্তু এ সকল ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। তবে পূর্ণ বিবাহের অনুমতি কখনই দেওয়া হবে না।
এই মতবাদ অনেক ক্ষেত্রে নিদারুণ দুঃখ কষ্টের অবতারণা করেছে। কিন্তু যেহেতু সেই গ্লানি ঈশ্বরের অভিপ্রায় দ্বারা লব্ধ, তাই তাকে ভোগ করতেই হবে।
সম্পূর্ণ সুদৃঢ় এই মতবাদটির পাশাপাশি ক্যাথলিকরা সদাসর্বদা পাপের সমালোচনায় কিছুটা উদার মনোভাবের পরিচয় দিয়েছে। চার্চ স্বীকার করেছে যে, সাধারণ মানব প্রকৃতি তার ওপর আরোপিত সীমাবদ্ধতার মধ্যে বাস করতে পারে না এবং ব্যভিচারে আসক্ত পাপীকে ক্ষমা করা হবে যদি সে তার পুরোহিত গোষ্ঠীর অধিকার বৃদ্ধির চেষ্টা করা হয়। কেননা একমাত্র তারাই স্বীকারোক্তি সংগ্রহ করতে পারতেন এবং স্বীকারোক্তি ভিন্ন ব্যভিচারের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া যেত না।
তথ্যগতভাবে প্রোটেসট্যান্ট ধর্মাবলম্বীদের মতবাদ কিছুটা অন্যরকম ছিল। কিন্তু ব্যবহারিক প্রয়োগে তা ছিল এরই সমার্থক। লুথার যে ধর্মীয় উক্তি দ্বারা উজ্জীবিত হন, সেটি হলো প্রজ্বলন অপেক্ষা বিবাহ শ্রেয়। তিনি এক সন্ন্যাসিনীকে ভালোবাসতেন এবং তার সিদ্ধান্ত ছিল যে, কৌমার্যের স্থলন সত্ত্বেও তিনি ও ঐ সন্ন্যাসিনী পরস্পরকে বিবাহ করতে পারেন। কেননা তা না হলে তিনি স্বীয় কামনা দ্বারা আকর্ষিত হয়ে নৈতিক পাপে প্রলুদ্ধ হবেন। সেই কারণে প্রোটেসট্যান্ট মতবাদ কৌমার্যের প্রশংসা থেকে নিজেকে বিরত করে। এ ব্যাপারে ক্যাথলিক চার্চের সঙ্গে তাদের মতপার্থক্য দেখা যায়।
তারা বিবাহ তত্ত্বকে পবিত্র অঙ্গীকার হিসেবে স্বীকার করল এবং কয়েকটি ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদকে স্বীকৃতি দিল। কিন্তু ব্যভিচারিতার প্রশ্নে তারা ক্যাথলিক অপেক্ষা অধিক মাত্রায় মর্মাহত হয়। এ ব্যাপারে তাদের নৈতিক নিন্দা ছিল অনেক বেশি সুদৃঢ়। ক্যাথলিক চার্চ পাপ স্থলন করত স্বীকারোক্তির দ্বারা। পক্ষান্তরে প্রোটেস্ট্যান্টরা এ ব্যাপারে ক্যাথলিকদের নিন্দা করত। এবং তারা স্বীকারোক্তি ও পবিত্রকরণের পদ্ধতিগুলি বাতিল করে পাপীকে আশাহীন অবস্থায় ঠেলে দেয়। ক্যাথলিক চার্চে তার কিছু কিছু প্রতিষ্ঠা ছিল। আধুনিক আমেরিকায় এই দুটি মতবাদের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। সেখানে বিবাহ বিচ্ছেদ অত্যন্ত সহজ ব্যাপার। কিন্তু ব্যভিচারিতাকে ক্যাথলিকদের সমূহ অপেক্ষা আরো বেশি কাঠিন্য সহকারে বিবেচনা করা হয়। এর থেকে মনে হয় খ্রিস্টান নৈতিকতার সমস্ত মতবাদকে, ক্যাথলিক অথবা প্রোটেসট্যান্ট ধারাকে পুনরায় উজ্জীবিত করা উচিত। অবশ্য সেই বিশ্লেষণ যেন খ্রিস্টান শিক্ষা পদ্ধতিকে আঘাত না করে।
শৈশব অবস্থা থেকে আমাদের মনের মধ্যে যে ধ্যানধারাণা অনুপ্রবিষ্ঠ হয় তা অধিকাংশ মানুষের মনে অবচেতন স্তরে বজায় থাকে এবং ধর্মের যুক্তিহীন বসবাসে আমরা নিজেদের নিয়োজিত করি। প্রকৃতপক্ষে এ হলো অবচেতনভাবে ধার্মিক শিক্ষা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সত্য। আমরা সাহসের সঙ্গে প্রশ্ন করতে পারি, কেন চার্চ সকল ব্যভিচারিতাকে নিন্দা করেছে? আমরা কি মনে করি যে, এর অন্তরালে কোনো স্বীকৃত কারণ আছে? যদি আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, চার্চ কর্তৃক প্রযুক্ত কারণ ভিন্ন অন্য কোনো কারণ নেই, তাহলে আমরা কেন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হব? প্রাথমিক যুগে চার্চ চিন্তা করতো যৌন সম্পর্কে অপবিত্রতার অপরিহার্য অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এমন কি কয়েকটি প্রাথমিক শর্ত পূরণ করার পরেও এই কাজ নিন্দনীয় বলা যেতে পারে।
এইরূপ মতবাদকে কুসংস্কার বলে অভিহিত করা যায়। যেসকল কারণে এই মতবাদের উৎপত্তি সেগুলি সর্বশেষ অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে। মনে হয় যৌন বিরোধী মনোভাবই সৃষ্টির প্রয়োসে এই মতবাদের উৎপত্তি। এর উদ্দেশ্য হলো শরীর অথবা উভয়ের রোগজীর্ণ অবস্থা স্থাপন করা।
এই মতবাদকে আমরা কি সম্পূর্ণভাবে অবাস্তব বলে অভিহিত করতে পারি না? যদিও মনুষ্য সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠের অবিনাশ্যকারিতায় এটি সর্বজনস্বীকৃত তথ্যরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তবু তাকে যুক্তিগ্রাহ্য অপেক্ষা আবেগবহুল বলা উচিত।
পেলেউ দ্বীপপুঞ্জবাসীরা বিশ্বাস করে যে, উন্নত নাসিকার অবস্থিতি হলো অনন্ত আশীর্বাদ অর্জন করার জন্যে। ইউরোপীয়ানরা মনে করে যে, মাথা নত করে কয়েকটি শব্দের পুন:পুন: উচ্চারণ দ্বারা সেই আশীর্বাদ পাওয়া যায়। পেলেউ দ্বীপপুঞ্জবাসীদের বিশ্বাসটি হলো কুসংস্কার কিন্তু ইউরোপীয়ানদের বিশ্বাসকে আমাদের পবিত্র ধর্মের অন্যতম সত্যরূপে চিহ্নিত করা যায়।
জেরিমি তেনযাম কার্যধারার উৎস সংক্রান্ত সারণি প্রস্তুত করেছেন, সেখানে মানবিক আকাঙ্ক্ষাকে তিনটি সমান্তরাল সারিতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, যার একটিতে আছে মানুষের প্রশংসা, একটিতে তিরস্কার, এবং অপরটিতে নির্দলীয়তা। এইভাবে আমরা দেখতে পাই প্রথম সারি মোহময় এবং এর বিপরীত শব্দটি, দ্বিতীয় সারিতে সামাজিক প্রতিষ্ঠার আনন্দ লাভের বাসনা। একইভাবে আমরা দেখি প্রশংসিত নাম যা সার্বজনীন সত্তা বোধের উন্মোচন করে এবং এর বিপরীত শব্দ, পরবর্তী সারিতে আমরা স্পাইট শব্দটি পাই। কোনো ব্যক্তি যদি বেনথামের অনুসরণে নৈতিকতা বিষয় সম্পর্কে স্বচ্ছ ভাবে চিন্তা করতে ইচ্ছুক হন তাহলে তিনি নির্ভর করতে পারেন এবং যখন তার হৃদয়ে সত্য প্রতিষ্ঠিত হবে যে, প্রায় প্রতিটি প্রশংসা বহনকারী শব্দের নিন্দা বহনকারী অর্থ আছে, তখন তিনি এমন শব্দ ব্যবহারে উৎসাহিত হবেন যার মধ্যে প্রশংসা অথবা নিন্দা নেই।
চরিত্রহীনতা ও ব্যভিচারিতা এই দুটি শব্দ একইভাবে সুদূঢ় নৈতিক বিচ্যুতির কথা ঘোষণা করে এবং বিভিন্নভাবে প্রযুক্ত হয়েও স্বচ্ছ চিন্তার উদ্রেকে সাহায্য করে, নাকি বিভিন্ন লেখকগণ যে সকল শব্দ ব্যবহার করেছেন, তার দ্বারা তারা আমাদের মানসিকতাকে দুর্নীতিগ্রস্ত করতে চান? এইসব লেখকরা অসম সাহসিকতার উল্লেখ করেছেন এবং আইনের শীতল বন্ধন দ্বারা অপ্রাপ্তব্য ভালোবাসার মহিমা প্রকাশ করেছেন। এই দুটি শব্দরাজি কুসংস্কার স্থাপন করেছে। যদি আমরা কামনাবিহীনভাবে চিন্তা করি, তাহলে আমরা অনুধাবন করব যে, এ দুটি হলো পরস্পরের সমর্থক বিষয়।
দুর্ভাগ্যক্রমে এই জাতীয় বিষয়সমূহ আমাদের সাহিত্যিক মাপের অবমূল্যায়ণ ঘটিয়েছে। প্রশংসা আবার নিন্দা উদ্রেককারী শব্দ নিয়ে একাধারে বর্ণময় ও আকর্ষক, যা পাঠকচিত্তকে স্তুতি অথবা প্রশংসা দ্বারা প্রভাবিত করতে পারে এবং সামান্য প্রয়াসে তার আবেগকে লেখক কর্তৃক ঈপ্সিত পথে পরিচালিত করা সম্ভব হয়।
যা হোক, আমরা কার্যকারণের কাছে আবেদন করতে চাই এবং সেই কারণে আমরা নিষ্প্রভ, নির্দল শব্দপঞ্জি ব্যবহার করব। যেমন বহির্বিহিক যৌনবিধি যে সকল বিষয়ের প্রতি মানবিক আবেদনে দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত তার আলোচনায় সযত্নপ্রয়াস প্রয়োজন। যদি আমরা আমাদের সৃষ্টি থেকে আবেগকে সম্পূর্ণভাবে বিতাড়িত করি তা হলে অভীষ্ট বিষয়ের আলোচনার যে ব্যাপারটি অনুধাবন করতে হবে, তা হলো অংশগ্রহণকারীদের প্রতি নিয়োজিত আকর্ষণ ক্ষমতা অথবা ঈর্ষান্বিত বহিরাগত দ্বারা অপ্রশস্ত ক্ষমতা।
আমাদের কাছে যা সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ অন্যের কাছে তা কৌমার ব্যভিচারিতা সেই কারণে আমরা আবেগপ্রবণ বর্ণময় শব্দপুঞ্জকে স্মরণে রাখবো এবং ঘটনাচক্রে তা ব্যবহার করব। কিন্তু সেই প্রয়োগ হবে ইচ্ছা নির্ভর। প্রধান বিষয় অবতারণায় আমরা নির্দল ও বিজ্ঞানসম্মত নিখুঁত ভাষাতাত্ত্বিক মনোভঙ্গির পরিচয় প্রদান করব।
খ্রিস্টান নৈতিকতা অনিবার্যভাবে পুণ্যের ওপর যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করেছে। তা সত্ত্বেও নারীজাতির অবস্থানকে নিম্নগামী করা হলো। যেহেতু নৈতিকতাবাদীরা ছিলেন পুরুষ, তাই নারীকে চিহ্নিত করা হয়েছে কামনাময়ী রূপে। যদি রমণিরা ঐ আসনে থাকতেন তাহলে পুরুষকে এই ভুমিকা দেওয়া হত। যেহেতু রমণিকে কামনাময়ী করা হলো, তাই পুরুষকে আকর্ষণ করার প্রয়াসকে সীমাবদ্ধ রাখা হলো। সম্মানিত বংশের মহিলাদের ওপর প্রযুক্ত বিধিনিষেধ সাধারণ মেয়েদের তুলনায় বেশি। আভিজাত্য বিহীন বংশের রমণিদের অশ্রদ্ধা সহকারে বিশ্লেষণ করা হত।
রোমান যুগে রমণিরা যে পরিমাণ স্বধীনতা লাভ করেছিলেন তাকে পুনরুদ্ধার করা হলো আধুনিক কালে। আমরা দেখেছি, পিতৃতান্ত্রিক পদ্ধতি নারীজাতিকে বন্দিনী করেছে কিন্তু এর অধিকাংশই ঘটে গেছে খ্রিস্টান ধর্মের উত্থানের পূর্বে। বাইবেলের পর নারীজাতির স্বাধীনতাকে আবার হরণ করা হলো পাপের হাত থেকে তাদের উদ্ধার করার অভিপ্রায়ে। আধুনিক যুগে পাপ সম্পর্কিত মূল্যবোধের পরিবর্তনে রমণি জাতি তাদের জাতি স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারে সফল হয়।
ধর্মযাজকদের রচনাবলিতে নারীজাতির সম্পর্কে বিদ্বেষী মনের পরিচয় পাওয়া যায়।
নারীজাতিকে নরকের প্রবেশদ্বার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, তারা ছিল যাবতীয় মানবিক পাপের জননী। সে যে নারী, এই কথা ভেবে তার লজ্জা পাওয়া উচিত। পৃথিবী সে যে অভিশাপ বয়ে আনছে তার জন্যে তাকে ধারাবাহিক শাস্তি পেতে হবে। নিজের আবরণ সম্পর্কে সে লজ্জা পাবে কেননা এ হলো তার পতনের স্মারক। নিজের সৌন্দর্যের জন্যে সে বিশেষভাবে লজ্জা পাবে কেননা এটি হলো শয়তানের শক্তিশালী অস্ত্র।
শারীরিক সৌন্দর্যের সাহায্যে সে ঐশ্বরিক অবিনাশ্যতাকে অগ্রাহ্য করেছে, এর বিরুদ্ধে এটি মাত্র ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয়। মধ্যযুগে বিশপদের ব্যক্তিগত সৌন্দর্যকে স্বীকার করা হয়েছিল। প্রভেনসিয়াল কার্বনসিল। ষষ্ঠ শতাব্দীতে অপবিত্রতা হেতু নারীজাতিকে নগ্নহস্তে পবিত্র অগ্নি গ্রহন করা থেকে নিষিদ্ধ করলেন। তাদের অপরিহার্য নিম্ন অবস্থিতিকে ধারাবাহিকভাবে বজায় রাখা হলো।
একই কথা বিবেচনা করে সম্পত্তি ও উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আইনের অনুশাসন পরিবর্তিত হলো। ফরাসি বিপ্লবের মুক্তচিন্তাকর্মীদের সাহায্যে কন্যারা বংশগত অধিকার অর্জন করে।