পাল্কি ও ল্যাণ্ডোর যুগ
সেকালের কলকাতা শহরে অটোমোবিল ছিল না। কলকাতা শহরে কেন, পৃথিবীর কোনো শহরেই তখন ‘অটো’ বা মোটরগাড়ি ছিল না। উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়েই দেশ-বিদেশে মানুষ ঘুরে বেড়িয়েছে। ঘোড়ার পিঠে মানুষ তার সংস্কৃতিকেও দেশ-বিদেশে বহন করে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশের গোটা নবজাগরণের যুগটাকে ‘অশ্বযুগ’ বলা যায়। জাগরণের অগ্রদূত ছিলেন যাঁরা, তাঁরা প্রায় সকলেই ছিলেন শহরবাসী। কলকাতা শহরই তাঁদের জীবনের প্রধান কর্মকেন্দ্র ছিল। কিন্তু কলকাতায় তখন ‘অটো’র চলাচল আরম্ভ হয়নি, এবং অটোযুগের যান্ত্রিক পরিবেশও সৃষ্টি হয়নি শহরে। নানারকমের অশ্বচালিত যানবাহনে তখন লোকজন কলকাতার পথে চলে বেড়াত। বিচিত্র সব নাম ছিল সেই সব যানবাহনের। ল্যাণ্ডো ফিটন বগি পালকিগাড়ি ও আরও কত কি। তখনকার সমাজ ও মানুষের জীবনের নতুন ছন্দের সঙ্গে এই সব ঘোড়ার গাড়ির চলার ছন্দের একটা মিলও ছিল বোঝা যায়। জীবনে ও সমাজে যেমন নবযুগে নতুন বেগ সঞ্চারিত হয়েছিল, তেমনি শহরের মানুষের চলাফেরার সেই বেগ ফুটিয়ে তুলেছিল ঘোড়ার গাড়ি। আগেকার যুগে ঘোড়া রাজারাজড়াদের রথ টানত, যোদ্ধাদের পিঠে বহন করে নিয়ে যেত, কিন্তু সাধারণ মানুষের চলাফেরার জন্য গাড়ি টানত না। আমাদের দেশে গরু-মহিষের গাড়িতে মানুষ চলে বেড়াত। যে-দেশে গরুই ছিল মানুষের প্রধান পালিত পশু, সে দেশে সাধারণ অশ্বযান বলে কিছু ছিল না। অশ্বযানের স্বচ্ছন্দ গতির জন্য শুধু শহর-নগর নয়, বড় বড় প্রশস্ত পাকা রাজপথও প্রয়োজন ছিল। মধ্যযুগের শহরের সংকীর্ণ অলিগলিতে বেগবান যানবাহনের চলাচল সম্ভব ছিল না। আধুনিক শহরের বড় বড় পাকা পথঘাটের উপরেই তার দ্রুত বাধাবন্ধনহীন চলাচল আরম্ভ হয়েছিল। সুতরাং নবজাগরণের যুগকে নতুন শহরে অশ্বযানের যুগ বললে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
বাংলার নবজাগরণের যুগকে তাই আমরা স্বচ্ছন্দে ‘ঘোড়ার গাড়ির যুগ’ বলতে পারি। তাও শুধু ল্যান্ডো-বগি-ফিটনের যুগ বললেই সম্পূর্ণ বলা হয় না, তাকে ছ্যাকরা-গাড়ির যুগও বলতে হয়, অর্থাৎ হুতোমী ভাষায় বলতে হয় ‘ছক্কোড়-যুগ’। তার সঙ্গে দীর্ঘদিন অবশ্য পুরাতনের উদ্বৃত্ত হিসেবে ‘পাল্কিও’ ছিল। রামমোহন, দ্বারকানাথ, ডিরোজিও, কৃষ্ণমোহন, তাঁরাচাঁদ, রাধানাথ, রসিককৃষ্ণ, দক্ষিণারঞ্জন, রামগোপাল, বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র, বিবেকানন্দ, সকলেই ছ্যাকরা-গাড়ি ও পাল্কিতে চড়ে চলাফেরা করেছিলেন, কিন্তু সেই চলার শক্তিতেই তাঁরা আমাদের দেশের অচল সমাজকে কিছুটা সচল করে তুলেছিলেন। ছ্যাকরা ও পাল্কিতে চড়ে তাঁরা যে সামাজিক সচলতা এনেছিলেন, তা আজকের দিনে ষ্ট্রিমলাইণ্ড অটোমোবিলে চড়েও আমরা আনতে পারছি কি না সন্দেহ। বাংলার অচল স্থিতিশীল সমাজে তাঁরা যে একটা প্রচণ্ড বেগের অবেগ এনেছিলেন, যে ‘মোবিলিট’ এনেছিলেন, আজও অনেকটা তারই ‘মোমেণ্টামে’ আমরা এগিয়ে চলেছি। ক্যাডিলাক-পণ্টিয়াক-প্লিমাউথ-ব্যুইক-কমাণ্ডারের যুগের নধরকান্তি বাঙালিবাবুরা সেই সচলতার কথা বোধ হয় কল্পনাই করতে পারবেন না। জুড়ি বগি চৌঘুড়ি ছঘুড়ি আটঘুড়ি ফিটন ব্রাউনবেরী ব্রুহাম ল্যাণ্ডো ল্যাণ্ডোলেট ঠিকাগাড়ি কেরাঞ্চিপালকিগাড়ি প্রভৃতি নানারকমের ঘোড়ার গাড়ি চড়ে, রামমোহন-বিদ্যাসাগর-বিবেকানন্দ-যুগের সমাজকর্মীরা নবজাগরণের বাণী প্রচার করেছেন এবং সামাজিক দুর্নীতি, জড়তা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বলিষ্টচিত্তে আপসহীন অভিযান করেছেন। যেমন সব তেজি ও দুর্ধর্ষ ঘোড়া ছিল তখন, তেমনি ছিল সেই ঘোড়ার যুগের মানুষগুলোও তেজীয়ান। ঘোড়া ও মানুষের ব্যক্তিগত চরিত্রের মধ্যে কোথায় যেন একটা সাদৃশ্য ছিল, পেট্রল-মোবিল-চালিত অটোমোবিলের যান্ত্রিকতার সঙ্গে একালের মানুষের চরিত্রের যেমন সাদৃশ্য আছে তেমনি। তখন ছিল যেমন সব ওয়েলার ঘোড়া, আরবি ও টাট্টু ঘোড়া, তেমনি সব ওয়েলারের মতন মানুষ, আরবি ও টাট্টু ঘোড়ার মতন মানুষ। ঘাড় ও মাথা উঁচু করে, দৃপ্তভঙ্গিতে, আপন মেজাজে জোরকদমে তাঁরা জীবনের পথে চলতেন। রামমোহন বিদ্যাসাগরের মতন মানুষের চলার ভঙ্গি দেখে একথা কে না স্বীকার করবেন।
ওয়েলেসলি, কর্নওয়ালিসের যুগে কলকাতা শহরের রাস্তায় কেবল ঘোড়া নয়, হাতিও মন্থরগতিতে আমেরি চালে চলে বেড়াত! তা দেখে বড় বড় ল্যাণ্ডোর তেজী ঘোড়ারা হয়ত বিচলিত হত না, কিন্তু জীর্ণ ছক্কোড়ের অস্থিচর্মসার দুর্বল ঘোটকেরা ভয়ানক ঘাবড়ে যেত। ১৬ এপ্রিল ১৮০৫ ‘বেঙ্গল হরকরা’ পত্রে এরকম এক ঘাবড়ানো ঘোটকষানের দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়। খবরটি এই :
A few evenings ago, Mr. and Mrs. Hutteman, with 3 of their children, were returning home in a carriage. They met an elephant on Esplanade Row, opposite the Tank; upon which the horses got wild and ran the carriage in the drain close to Brady’s house and upset it.
শ্রী ও শ্রীমতি হুটেম্যানের তাল ল্যাণ্ডো বা তেজী ঘোড়া ছিল বলে মনে হয় না। তা যদি থাকত, তা হলে রাজপথে হস্তী দর্শনে সে-ঘোড়া একটা ঘাবড়ে যেত না, এবং ব্যাডি সাহেবের সামনের পচা ড্রেনের মধ্যে গাড়িখানাকে উল্টে ফেলে দিয়ে সাহেব-মেমদের বিপদ ঘটাত না। মধ্যযুগের বাদশাহি আমলের প্রতিনিধি হাতি, সেকালের ফিউডাল লর্ডের মতন তার চালচলন। উনিশ শতকের গোড়ায় কলকাতা শহরে তার চলাফেরা দেখে বোঝা যায় যে, নতুন শহরে বাদশাহি আমলের আমেজ তখনও পুরোপুরি কাটেনি। বাদশাহি চালে, নবাবি মেজাজ নিয়ে নবযুগের বিদেশি দূত ইংরেজরাই তখন নতুন শহুরে সমাজে চলাফেরা করতেন। আর নতুন বাঙালি বড়লোকেরা নবাবের বংশধরদের মতন তখন জীবনযাপন করতে ভালবাসতেন। সুতরাং তখনও যে অস্তগামী নবাবি আমলের শেষ স্মৃতিচিহ্নের মতন দু-চারটে হাতি মহানগরে রাজপথে চলেফিরে বেড়াবে, তাতে অবাক হবার কি আছে।
১৮১৪-১৫ সাল থেকে রামমোহন রায় কলকাতা শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে আরম্ভ করেন। এই সময় থেকে বাংলাদেশে সামাজিক নবজাগণের আন্দোলন প্রত্যক্ষভাবে আরম্ভ হয় বলা চলে। ১৮১০ সালে দেখা যায়, ২৩ মার্চ তারিখের The Morning Post পত্রিকায়, কলকাতার Williams and Hohler Co. নিলামের যে-সব পদার্থের তালিকা দিয়াছেন তার মধ্যে একটি হল, ‘A beautiful female elephant measuring 7 ft. 6 inch. high’ কলকাতা শহরে রামমোহনের স্থায়ী বসবাসের আগেও সাড়ে-সাত ফুট উঁচু সুন্দরী হস্তিনী শহরে নিলামে কিনতে পাওয়া যেত। রামমোহনের ‘আত্মীয় সভা’ স্থাপন ও ‘বেদান্ত গ্রন্থ’ প্রকাশের পরেও নতুন শহরে পুরাতন হাতি যে একেবারে দেখতে পাওয়া যেত না, তা নয়। কিন্তু হাতির উপদ্রব তার পর থেকে কলকাতা শহরে নিশ্চিত কমে আসছিল।
আঠার শতকের চতুর্থ পর্ব থেকেই কলকাতা শহরে গাড়ি-ঘোড়ার, অর্থাৎ ঘোড়ার গাড়ির চলাচল বাড়তে থাকে। তার আগে সেকালের ‘স্কন্ধযান’ পালকিই ছিল প্রধান বাহন, কারণ ‘অশ্বযান’ চলার মতন উপযুক্ত পথঘাট তখনও তৈরি হয়নি কলকাতায়। বিদেশ থেকে ইংরেজ কোচমেকাররা এই এই সময় কলকাতা শহরে আসতে আরম্ভ করেন। বড় বড় কোচ তৈরির কারখানা, আড়গড়া ও ঘোড়ার আস্তাবল কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়, প্রধানত মধ্য-কলকাতায় ওল্ডকোর্ট হাউস থেকে ধর্মতলা-চাঁদনির মধ্যে। অধিকাংশ সাহেব কোচমেকারের কারখানা ছিল এই অঞ্চলে। পরবর্তীকালে দু-চারজন বাঙালিও এইখানে কোচ-নির্মাণের কারখানা ও ঘোড়ার আড়গড়া-আস্তবল স্থাপন করেন। ১৭৯০ সালের ‘ইস্ট ইণ্ডিয়া রেজিস্টারে’ বাংলাদেশে ইয়োরোপীয় বাসিন্দাদের নামের তালিকায় এই ক-জন কোচমেকারের নাম পাওয়া যায় :
এডওয়ার্ড চ্যাণ্ডলার : ১৭৭৬
জন বুল্টন : ১৭৭৫
রবার্ট গ্রেঞ্জ : ১৭৭৯
উইলিয়াম গ্রেঞ্জ : ১৭৮৩
রিচার্ড হেগ : ১৭৮০
জেমস ম্যাকনিকল : ১৭৮৩
জেমস স্টুয়ার্ট : ১৭৮৩
রবার্ট স্টুয়ার্ট : ১৭৮৪
টমাস ওয়াটসন : ১৭৮৫
জেম্স ওয়াটসন : ১৭৮১
কোচমেকাররা নানারকমের ঘোড়ার গাড়ি বিদেশ থেকে আমদানি করতেন, এদেশের কারিগরদের দিয়ে তৈরি করাতেন, সেগুলি বিক্রি করতেন এবং ভাড়া খাটাতেন। কেবল গাড়ি নয়, তার সঙ্গে ভাল ঘোড়াও রাখতেন আস্তাবলে, ঘোড়া ও গাড়ি দুয়েরই সাজসরজ্জাম থাকত। ২ মার্চ ১৮১০ ‘মর্নিং পোস্ট’ পত্রিকায় জনৈক কোচমেকার ক্রিস্টেফার ডেক্সটার বিজ্ঞাপন দিয়ে তাঁর এই ব্যবসায়ের কথা এইভাবে শহরবাসীদের জানান :
christopher Dexter
Return his most grateful thanks to his friends and the public at large for the support he has experienced from them for the three years past–in order to enlarge his business–taken a house in Bowbazar that has got upwards of eight bighas of ground–erecting stables for 600 horses to stand at livery. Horses and carriages bought and sold on commission. Also he lets out horses and carriages, by day, month or year. Horse shoes and nails on Sale.
C. D. likewise attends on sick horses as his house or abroad.
৬০০ ঘোড়া রাখবার মতন আড়গড়া তৈরি করেছে ডেক্সটার সাহেব, আটবিঘে জমি নিয়ে বৌবাজারে। ডেক্সটারের দক্ষতা প্রশংসনীয়। গাড়ি ও ঘোড়া কেনাবেচার তিনি দালালি করেন, ভাড়া খাটান এবং তার নিজের আড়গড়ায় বা মালিকের বাড়ি গিয়ে অসুস্থ ঘোড়ার চিকিৎসাও করেন। অর্থাৎ ডেক্সটার সাহেব কেবল ঘোড়ার দালাল নন, ঘোড়ার ডাক্তারও।
ডেক্সটারের মতন আরও অনেক সাহেব কোচমেকার, ঘোড়ার দালাল ও ডাক্তার ছিলেন কলকাতায়। সবচেয়ে নামজাদা কোচমেকার ছিলেন কলকাতার স্টুয়ার্টরা। কলকাতার প্রাচীনতম ও দীর্ঘস্থায়ী ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্টুয়ার্ট কোম্পানি অন্যতম। ওল্ডকোর্ট হাউসের কোণে তাঁরা কারখানা স্থাপন করেছিলেন আঠার শতকের শেষ পর্বে, এবং সেকালের ল্যাণ্ডো-পাল্কির যুগ থেকে একালের অটোমোবিলের যুগ পর্যন্ত প্রায় অব্যাহত ধারায় তাঁরা ব্যবসা করে এসেছেন। ১৭৮৫ সালের মধ্যেই তাঁরা যে পূর্ণোদ্যমে গাড়িঘোড়ার ব্যবসা আরম্ভ করেছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় তখনকার পত্রিকার বিজ্ঞাপন থেকে। ‘ইণ্ডিয়া গেজেট’ পত্রিকায় ১৭৮৫ সালে স্টুয়ার্ট কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেখা যায় এই মর্মে :
January 3, 1785-To be sold a Handsome Europe…haise, new lined and painted with elegant medallions on the doors. Price 2000 S. R. (Sicca Rupees). Also a very handsome new Buggy and harness with a remarkable quick Trotting Horse. Price 1000 S. R.
January 31, 1785-To be sold a Phaeton in perfect repair with a set of Horses perfectly broke.
১৭৮৫ সালের ‘ক্যালকাটা গেজেট’ পত্রিকাতে স্টুয়ার্টদের একাধিক বিজ্ঞাপন দেখা যায়। যেমন :
Thrursday, March 17, 1785
For Sale at Messrs, Stewarts, Coachmakers
A new elegant europe Gigg; to save troble; Price Sicca Rupees… By applying as above gentlemen in the country building Chariots, Phoetons or Buggies may be supplied with the best Europe articles for that purpose on reasonable terms.
Thrursday, December 8, 1785
To be Raffled for at Messrs. Stewarts, Coachmakers
A new elegant and fashionable Europe Coach, with a set of Plated Harness for four Horses, with Postilion Saddles, and long spare Traces. The Coach and Harness cost 600 Rupees. Thirty Subscribers at Rs. 20 each.
বিজ্ঞাপন দেখে মনে হয়, তখন প্রতি বৃহস্পতিবারে স্টুয়ার্ট কোম্পানিতে ‘সেল’ ও ‘অকশন’ হত, এবং তাতে ভাল ভাল সব বিদেশি গাড়ি ঘোড়া বিক্রি হত। বগি-ফিটন, গিগ-চ্যারিয়ট প্রভৃতি দামের বহর দেখে বোঝা যায়, শহরের অভিজাত ধনিক বাসিন্দারা ছাড়া অন্য কোনো শ্রেণির লোক ক্রেতা ছিলেন না। অন্যদের জন্য পালকি ছিল। সাধারণ মধ্যবিত্তের বাহনই ছিল তখন পালকি। অবশ্য তারা পালকির মালিক ছিলেন না, কারণ পালকির অথবা যে কোন ঘোড়ার মালিকানার মধ্যে ব্যয়ের দিক থেকে বিশেষ কোনো পার্থক্য ছিল না। পালকির মতন পালকি হলে, এবং সেরকম পরিচ্ছদধারী বেয়ারাদল থাকলে, আভিজাত্যের দিক থেকে অনেক সময় তা ল্যাণ্ডোবগিকেও হার মানিয়ে দিত।
দুএক রকমের নয়, হরেকরকমের ঘোড়াগাড়ি ছিল কলকাতায়। তার বিচিত্র সব নাম ছিল। সব নাম সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি, তবে যতটুকু জানা গেছে তা প্রায় কৃষ্ণের শতনামের মতন। ঘোড়ার গাড়ির এরকম নামবৈচিত্র্যের কথা আজকের দিনে কল্পনা করা যায় না। যেমন :
জুড়ি ল্যান্ডো ব্রাউনবেরি পালকিগাড়ি
চৌঘুড়ি ল্যাণ্ডোলেট ব্রুহ্যাম জাউনগাড়ি
দুঘুড়ি ফিটন দশফুকার ডাকগাড়ি
আটঘুড়ি বগি সারাব্যাঙ্ক এক্কাগাড়ি ইত্যাদি
সবরকমের গাড়ির বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় না। স্টুয়ার্ট কোম্পানির নতুন কোনো সম্ভ্রান্ত কোচমেকারের সেকালের কোনো Descriptive Illustrated Catalogue থাকলে হয়ত পাওয়া যেত। স্টুয়ার্টদের ক্যাটালগ নিশ্চয় ছিল, এবং এখন যদি তার কোনো পুরনো ‘কপি’ পাওয়া যেত তা হলে সামাজিক ইতিহাসের অনুসন্ধিৎসু স্কলাররা সেটাকে একখানা প্রাথমিক আকরগ্রন্থ হিসেবে তথ্য-সংগ্রহের কাজে ব্যবহার করতে পারতেন। দুঃখের বিষয় এখনও তা পাওয়া যায়নি, অন্তত আমি পাইনি। পুরোনো কোচমেকার, ফার্ণিচার প্রভৃতি ব্যবসায়ীর ক্যাটালগও যে সেকালের সামাজিক ইতিহাসের উপর কতখানি আলোকসম্পাত করতে পারে, তা আমাদের দেশে অ্যাকাডেমিক ঐতিহাসিকরা ঠিক উপলব্ধি করতে পারেননি। তাই ইতিহাসের এই জাতীয় উপকরণ আজও আমাদের দেশের স্কলারদের কাছে উপেক্ষিত হয়ে রয়েছে।
বিনা ক্যাটালগেই আমরা বর্ণনা দিচ্ছি। জুড়ি চৌঘুড়ি ছঘুড়ি আটঘুড়ি দশফুকার ইত্যাদি নাম দেখেই বোঝা যায়, ঘোড়ার সংখ্যানুপাতে গাড়ির নামকরণ করা হয়েছে। একজোড়া ঘোড়া জুতলে জুড়ি, দুজোড়ায় চৌঘুড়ি, তিনজোড়ায় ছঘুড়ি, চারজোড়ায় আটঘুড়ি, পাঁচ-জোড়ায় দশফুকার (?) ইত্যাদি। দশের বেলায় ‘ফুকার’ কেন, ‘ঘুড়ি’ নয় কেন, বোঝা যায় না। ক্ষিতিন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন :
তখন ঠিকাগাড়ী ও পাল্কির সংখ্যাও নিতান্ত অল্প ছিল না। তখন বড়লোকদের অর্থাৎ ধনীদের ধনবত্তা দেখাইবার অন্যতম প্রধান উপায় ছিল সকালে সুদৃশ্য জুড়ি অথবা চৌঘুড়ি বা ছয়ঘুড়ি আটঘুড়ি পর্য্যন্ত সুদৃশ্য ল্যাণ্ডোতে যুতিয়া শহরের দেশীয় পল্লীর মধ্যে নিজে হাঁকাইয়া বেড়ানো ও দুর্গন্ধ বায়ুসেবন এবং একটা সুদৃশ্য ‘পাল্কিগাড়ী’ বা ‘আফিস ব্রাউনবেরি’ গাড়ীতে চড়িয়া স্কুলে বা অফিসে যাতায়াত। বৈকালে ধনী বাবুরা আবার সুদৃশ্য ওয়েলার জুড়ি যুতিয়া ল্যাণ্ডো, ফিটন বা অন্য কোনো প্রকার মাথা খোলা গাড়ীতে গঙ্গার ধারের রাস্তায় ‘হাওয়া খাইয়া’ পরে বিলাতী ব্যাণ্ড বুঝুন না নাই বুঝুন, ইডেন গার্ডেনের ধারে গাড়ী রাখিয়া তাহাতেই বাজনা শেষ হওয়া পর্য্যন্ত বসিয়া থাকিতেন….বাবুদের দৌলতে সেকালে কত রকমেই গাড়ী যে বিলাত হইতে আমদানী হইত, তাহার ইয়ত্তা ছিল না-ল্যাণ্ডো, ফিটন, বগি, ল্যাণ্ডোলেট, দশফুকার, ব্রাউনবেরি, ব্যারুষ ইত্যাদি। উচ্চদরের ডাক্তার বা জজ প্রভৃতি, যাঁহারা আপনাদের গাম্ভীর্য-গৌরব বাহিরে বজায় রাখিতে প্রচলিত রীতি অনুসারে বাধ্য হইতেন-ভিতরে তাঁহারা যতই কেন মনমাতাল বা হল্লাবাজ হৌন না-তাঁহারাই সাধারণতঃ ব্রুহ্যাম গাড়ী ব্যবহার করিতেন। ব্রুহ্যাম গাড়ীর আরোহীদিগকে দেখিলে সকলের মনে একটা মহা ‘সমীহ’ ভাব জাগিয়া উঠিত-মনে হইত, না জানি, আরোহী হাইকোর্টের কোনো জজ বা মেডিকেল কলেজের কোনো বড় ডাক্তার।
গাড়ির চেহারার সঙ্গে যাত্রীর পদমর্যাদার সম্পর্ক ছিল, form-এর সঙ্গে content-এর যেমন সম্পর্ক থাকে তেমনি। একালেও কি নেই? অবশ্যই আছে। কালের যাত্রার গাড়ি বদলায়, আরোহী যাত্রী বদলায়, কিন্তু গাড়ির সঙ্গে যাত্রীর পরস্পর-সম্পর্কের যে sociological law তা কখনও বদলায় না। অতএব গাড়ি-যাত্রীর সম্পর্ক সেকালেও যেমন ছিল, একালেও তেমনি আছে। ভাঙা বেবি অষ্টিন বা উটের মতন উঁচু ঝরঝরে ফোর্ড গাড়ি দেখলেই বোঝা যায়, ভিতরের আরোহীর অটোতে চড়ার বাসনা আছে, আর্থিক সামর্থ্য নেই। কম্যাণ্ডার বা প্রেসিডেণ্টের মতন ষ্ট্রীমলাইণ্ড অটোমোবিল দেখলে বোঝা যায়, ভিতরের আরোহীর ‘লিকুইড’ টাকার কোনো অন্ত নেই এবং হয় তিনি চলচ্চিত্রের কোনো উজ্জ্বল তারকা, না হয় ফাটকা বাজারের কোনো কীর্তিমান দালাল, অথবা লাটে-ওঠা কোনো লিমিটেড কোম্পানির ম্যানেজিং-ডিরেক্টর। তাঁর মন-প্রাণ, চিত্ত-ফুসফুস, পাঁজরে-হাড়গোড় অর্থাৎ গোটা ফিজিওলজিক্যাল গড়নটাও ঠিক অটোমোবিলের মতন চাঁছাছোলা। চরিত্রের দিক থেকেও তিনি ঠিক যেন একটি নিখুঁত পালিশ করা যন্ত্র। সমাজের মধ্যেও তিনি অবিকল তাঁর অটোমোবিলের মতন সরীসৃপ-গতিতে নিঃশব্দে চলে বেড়ান। তাঁর চলার যান্ত্রিক বেগ আছে যথেষ্ট, কিন্তু হৃদয়ের আবেগ নেই একটুও। একালের অটোর মতন সেকালের ল্যাণ্ডোর যুগেও যাত্রীদের বোঝা যেত গাড়ি দেখে। গাড়ির সঙ্গে ঘোড়াটাকেও অবশ্য দেখতে হত, কারণ কেবল ‘কোচ’ দেখে তার ভিতরে বাবুটিকে বোঝা যেত না। ভাল ল্যাণ্ডোতে বা ব্রুহ্যামে কেউ যদি হাড়গিলে ঘোড়া যুতে রাস্তায় বেরুতেন তা হলে বুঝতে হত, বাবুর দফা রফা হয়ে গেছে, মামলা-মোকদ্দমায় হোক বা বাবুগিরিতেই হোক তাঁর বংশের আভিজাত্যের সলতেটি পুড়ে প্রায় ছাই হয়ে এসেছে। ঘোড়ার দানা জুটছে না, ভাল সহিস তো নয়ই। অথচ পিতামহ-প্রপিতামহের আমলের ব্রুহ্যামের পরিত্যক্ত কোচটি আছে। বাবু তাই সেই পুরনো অভিজাত ব্রুহ্যামে দানাভাবে শীর্ণ হাড়গিলে ঘোড়া যুতেই রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছেন।
সুতরাং কেবল গাড়ি নয়, গাড়ির সঙ্গে ঘোড়াও দেখতে হত। গাড়ির সঙ্গে ঘোড়ার গোঁজামিল, অথবা ঘোড়ার সঙ্গে গাড়ির গোঁজামিল, তখনকার লোকের কাছে নিশ্চয় দৃষ্টিকটু লাগত। সাধারণত অবশ্য ব্রুহ্যাম, বা ভাল জুড়ি-ল্যাণ্ডোতে চড়ে শহরের ধনিক অভিজাতরা চলাফেরা করতেন। মধ্যবিত্ত বা স্বল্পবিত্ত লোকের সাধ্য ছিল না ল্যাণ্ডো হাঁকিয়ে বেড়ানোর। আজকালকার মধবিত্তের পক্ষে কোনোরকমে একটা ছোটখাট সেকেণ্ডহ্যাণ্ড মোটর কিনে নিজে চালিয়ে বেড়ান সম্ভব। সেকালের ল্যাণ্ডোর যুগে তা সম্ভব ছিল না। অবশ্য তখনকার সমাজে মধ্যবিত্তের আয়তন বা সংখ্যাও এত বিপুল ছিল না। উপরে মহাবিত্তবান এবং নীচে স্বল্পবিত্ত দরিদ্র, প্রধানত সমাজে এই দুইশ্রেণির লোকই ছিল। ল্যাণ্ডো কালচার স্বল্পবিত্তদের স্পর্শও করতে পারত না। একালে ভাল ভাল মোটর ‘ট্যাক্সি’ হিসেবে ভাতা পাওয়া যায়। স্বল্পবিত্ত লোকও এক-আধদিন তাতে চড়ে বেড়াতে পারেন। সেকালের লাণ্ডো-ব্রুহ্যামে বড়লোকদের একান্ত মোসাহেব না হলে কারও সাধ্য ছিল না চড়ে বেড়ানোর। কারণ ল্যাণ্ডো বা ব্রুহ্যাম ভাড়া খাটত না। কেরাঞ্চি, পালকিগাড়ি, ছক্কোড়, ব্রাউনবেরি ইত্যাদি ভাড়া পাওয়া যেত। এইসব গাড়ির ও ঘোড়ার চেহারার সঙ্গে ল্যাণ্ডো-ব্রুহ্যামের কোনো তুলনাই হত না। আমাদের দেশের পালকিতে চার চাকা লাগিয়ে ঘোড়া জুতে দিলে যা হয়, তাই ছিল পালকিগাড়ি। একঘোড়ার ও দুঘোড়ার, দুরকমেরই পালকিগাড়ি ছিল। প্রথমদিকের পালকিগাড়িতে দুদিকেই দণ্ড থাকত। অর্থাৎ পালকিটাকেই চার চাকার উপর বসানো হত। কখনও তা মানুষে ঠেলত, কখন ঠেলত ঘোড়া। আবার যখন দরকার হত, চাকার উপর থেকে তুলে নিয়ে মানুষের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে পালকি করে নেওয়া হত। স্কন্ধযান অশ্বযানে পরিণত হবার আগে তার এই তিনরকমের transitional রূপ হয়েছিল দেখা যায়।
প্রথমটি মানুষ টানা চারচাকার পাল্কিগাড়ি।
দ্বিতীয়টি ঘোড়া-টানা চারচাকার পাল্কিগাড়ি।
তৃতীয়টি আদি অকৃত্রিম পাল্কি।
ব্রাউনবেরি ছিল পালকিগাড়িরই দ্বিতীয় সংস্করণ। জনৈক ব্রাউনলো সাহেব, পালকি বেয়ারাদের ধর্মঘটের সময়, একবার নাকি অফিস যাতায়াতের সুবিধার জন্য পালকিতে ঘোড়া যুতে এই গাড়ি চালু করেছিলেন। সেইজন্য তার নাম হয়েছিল ব্রাউনবেরি।
কেরাঞ্চি গাড়ির খুব প্রচলন ছিল কলকাতায়, সাধারণ লোক দল বেঁধে শেয়ারে তাতে যাতায়াত করত। বিলেতের পুরনো ভাড়াটে গাড়ির অনুকরণে তৈরি কেরাঞ্চি দুই ঘোড়ায় টানত। তৃতীয়শ্রেণির অপদার্থ ঘোড়াই বেশি। ১৮৪৩ সালে ‘গ্রিফিন’ তাঁর Sketches of Calcutta পুস্তকে জনৈক কলকাতার কেরাঞ্চি গাড়ি সম্বন্ধে লিখেছেন :
There are many objects which attract our attention solely on account of their negative qualities, and the kranchie is one of them… The body of a kranchie is rather smaller than a home noddy, and it is lower and unpainted… The ponies that draw this sorry vehicle are mere skin and bone…in this narrow and much frequented street (কসাইতলা বা বেণ্টিক ষ্ট্রীট) aspiring natives are often seen in kranchies and showing their bare breasts and arms to advantage… Four, five and six of these vahicles are frequently seen running in company.
সাহেব বলেছেন যে, ‘নেগিটিভ’ গুণের জন্য উল্লেখযোগ্য বস্তু হল কলকাতার কেরাঞ্চি গাড়ি। ছোট ও নিচু খাঁচার মতন দেখতে কেরাঞ্চির গায়ে কোনো রঙচঙের বিশেষ চিহ্ন থাকত না অস্থিচর্মসার ঘোড়ায় কেরাঞ্চি টানত। সাহেব উচ্চাভিলাষী নোটবাদকের প্রসঙ্গে বলেছেন যে তাঁরা কেরাঞ্চিতে চড়ে, প্রায় সারা গা আলগা করে, কলাইতলার সরু রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করতেন। ‘aspiring natives’ বলতে সাহেব কাদের কথা বলতে চেয়েছেন বোঝা যায় না। চাঁদনি বা চীনবাজারের দেশি ব্যবসায়ীরা হয়ত এইভাবে মধ্যে মধ্যে দল বেঁধে কেরাঞ্চিতে চড়ে শহরে বেড়াতে বেরুতেন। অথবা কালীঘাটের তীর্থযাত্রীরাও সারবন্ধী কেরাঞ্চিতে যেতে পারেন। কালীঘাট ছিল তখন কলকাতার অন্যতম আকর্ষণ। পুণ্যলোভাতুররা বহুদূর থেকে কলকাতার কালিঘাট তীর্থে আসতেন। চিৎপুর-কলাইতলা-চৌরঙ্গি দিয়ে দক্ষিণে কালীঘাট পর্যন্ত রাস্তা ছিল তখন। কালীঘাটের তীর্থযাত্রীদের এটি অতি প্রাচীন রাস্তা। সাহেব হয়ত সারবন্দী কেরাঞ্চি-বোঝাই তীর্থযাত্রীদের দেখেছেন। তা ছাড়া ‘bare breasts and arms’ তিনি কোথা থেকে দেখবেন? অবশ্য তা নাও হতেপারে। এদেশের সাধারণ লোকেরা গ্রীষ্মকালে গায়ে বিশেষ জামা-জোব্বা চাপাবার প্রয়োজন বোধ করতেন না তখন। দল বেঁধে তাঁরাও কেরাঞ্চি ভাড়া করে সান্ধ্য-ভ্রমণে বেরুতে পারেন।
শ্রীমতী ফ্যানি পার্কস (fanny parks) ১৮৮২ সালে একবারে চৈত্র-সংক্রান্তির দিনে চড়কের গাজন দেখতে কালীঘাটে গিয়েছিলেন। তিনি তাঁর Wanderings of a pillgrim etc. (১ম খণ্ড, লণ্ডন ১৮৫০) গ্রন্থে লিখেছেন :
I drove down in the evening to kalee Ghaut. Thousands of people were on the road, dressed in all their gayest attire, to do honour to the festival of the Churuk Pooja, the swinging by hooks…kharanchies full of nach girls were their in all their gally coloured dreases and ornaments, as well as a number of respectable men of good caste…
কেরাঞ্চিতে নর্তকীরা গাজনের মেলায় গিয়েছিল কালীঘাটে। সম্ভ্রান্ত বলতে মধ্যবিত্ত গৃহস্থদের কথাই ফ্যানি বলেছেন। কেরাঞ্চিতে চড়ে তাঁরা উৎসব পার্বণের দিন ঘুরে বেড়াতেন। কেরাঞ্চিই ছিল তখন কলকাতার পপুলার গাড়ি।
উত্তরভারতের জনপ্রিয় এক্কাগাড়ি বাংলাদেশের কলকাতা শহরে বিশেষ পপুলার হতে পারেনি। এক্কা প্রসঙ্গে ‘পঞ্চানন্দের’ বিখ্যাত বর্ণনার কথা মনে হয় :
বিঘোরে বিহারে চড়িনু এক্কা
লাগে-ধুবধাব তাই বিষম ধাক্কা।
কিবা-বাঁকা দুটি বাঁশ শোভে দুই পাশ
মাঝখানে তার সকলি ফক্কা :
দেয়-পাতালতা দিয়ে আসন গড়িয়ে
ছেঁড়ে যদি পথে অমনি অক্কা।
পঞ্চানন্দের এই ‘এক্কাকাব্য’, পড়ে খানিকটা অনুমান করা যায়, বাংলাদেশে কেন এক্কার ‘ইনফিলট্রেশন’ সম্ভব হয়নি। দুদিকে বাঁকা দুটি বাঁশ, ‘মাঝখানে তার সকলি ফক্কা’ এবং ‘ছেঁড়ে যদি পথে অমনি অক্কা’-এরকম যে এক্কার গড়ন, তার চলন বাংলাদেশে হওয়া মুশকিল। উত্তরভারতের এক্কা-কৃষ্টির ‘diffusion’ তাই উনিশ শতকে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও, বাংলাদেশের কলকাতা শহরে সম্ভব হয়নি। অশ্বযানের মধ্যে পালকিগাড়ি কেরাঞ্চি ও ল্যাণ্ডো-ব্রুহ্যামই বাংলার রেনেসাঁসের যুগে আধিপত্য বিস্তার করেছে।
বগি গাড়ির বেশ প্রতিপত্তি ছিল বাংলাদেশে। বগির উপরে একটা ঢাকনা থাকত, রোদ আড়াল দেবার জন্য। স্টুয়ার্ট কোম্পানির বগিগাড়িকে অনেকটা জনপ্রিয় করে তোলেন। বগি বলতে উনিশ শতকে ‘স্টুয়ার্ট-বগি’ বা ‘বগি-স্টুয়ার্ট’ বোঝাত। ‘বগি’ আর ‘স্টুয়ার্ট’ কথা দুটি প্রায় একার্থক হয়ে গিয়েছিল। ‘Calcutta in 1811’ কবিতায় জনৈক কবি এই স্টুয়ার্ট-বগিকে অমর করে রেখে গেছেন :
Sedate they quit the ruminating chair,
And breathe abroad the evening dust and air;
As dips the Sun, of dazzling splendour shorn,
When the wide Fort resounds the evening horn,
Full many a saddened from, in jacket white,
Wings on the througing course his airy flight,
Borne on the steed, or perched with whip and reins,
In a dear specimen of Stewart’s pains.
সঙ্গতিপন্ন মধ্যবিত্তরা বগি-ফিটন বেশি ব্যবহার করতেন। নতুন সব উকিল মোক্তার ডাক্তার, স্কুল কলেজের শিক্ষক-অধ্যাপক, মাঝারি গ্রেডের ব্যবসায়ী, এঁরা কেউ ফিটন বা বগি-স্টুয়ার্টের উপরের স্তরের চৌঘুড়ি-আটঘুড়ি-ল্যাণ্ডো-ব্রুহ্যাম ইত্যাদির কথা কল্পনাও করতে পারতেন না। এদেশি কেরানী ও অন্যান্য সাধারণ চাকরি-জীবীদের প্রধান বাহন ছিল কেরাঞ্চি ও ছক্কোড়। ল্যাণ্ডোব্রুহ্যামে চড়তেন ধনিক-দালাল-বেনিয়ন মুচ্ছুদিরা, শহরের নবাগত জমিদাররা আর সাহেবরা।
গাড়ি ও ঘোড়া দুইই অবশ্য দৈনিক ও মাসিক হার ভাড়া পাওয়া যেত। ১৮৪০-৪১ সালে মেসার্স হাণ্টার অ্যাণ্ড কোং ও মেসার্স কুক অ্যাণ্ড কোম্পানির বিজ্ঞাপিত ভাড়ার হার ছিল এই :
একজোড়া ঘোড়া : দৈনিক ১০্ টাকা
ঐ : মাসিক ১৫০্ টাকা
একজনের গাড়ি ও : দৈনিক ১৬্ টাকা
একজোড়া ঘোড়া
ঐ : মাসিক ২৫০্ টাকা
দুজনের ‘চ্যারিয়ট’ : দৈনিক ২০্ টাকা
ঐ : মাসিক ৩০০্ টাকা
একজনের গাড়ি : দৈনিক ৪্ টাকা
ঐ : মাসিক ১২০্ টাকা
দুজনের গাড়ি : দৈনিক ১০্ টাকা
ঐ : মাসিক ১৫০্ টাকা
বগি ও ঘোড়া : দৈনিক ৮্ টাকা
ঐ : মাসিক ১৫০্ টাকা
একটি ঘোড়া : দৈনিক ৫্ টাকা
ঐ : মাসিক ১৫০্ টাকা
[The Bengal and Agra Guide and Gazetteer for 1841, Vol I, Part II, PP. 72-73]
তদানীন্তর সুপ্রিমকোর্টের অ্যাডভোকেট জর্জ জনসন ১৮৪৩ সালে লিখেছেন যে একখানা বগি গাড়ির দাম ছিল তখন ৮০০ টাকা থেকে ১১০০ টাকা, পালকিগাড়ির দাম ছিল ৯০০ টাকা থেকে ১৮০০ টাকা এবং ব্রিচ কার দাম ছিল ২০০০ টাকা থেকে ৪০০০ টাকা। অ্যাডভোকেট সাহেব জানিয়েছেন : These are the prices charged by the markers for new carriages : but by private sale or auction, they may always be met with, as good as new, for about half that cost. ‘পালকিগাড়ি’ সম্বন্ধে তিনি বলেছেন যে চারচাকার উপর বসানো পালকির মতন হলেও, ‘it is a very comfortable carriage for travelling in at night or in bad weather; but it is too close and hot for the purpose of evening exercise.’
গাড়ির দাম সংগ্রহ করা যদিও বা কারও সাধ্যে কুলাত, ঘোড়ার দামের কথা ভাবলে তাকে গাড়ি চড়ার বাসনা বর্জন করতে হত। বিলেত থেকে এক-একটা ঘোড়া নিয়ে আসার খরচই পড়ত প্রায় ৪০ পাউণ্ড করে। সুতরাং বিলেতি ঘোড়ার দাম ছিল অত্যধিক। আরবি স্ট্যালিয়ন, যা সাধারণত সাহেবরা চড়ে বেড়াতেন, ১০০০ টাকা থেকে ১৮০০ টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি হত। জনসন লিখেছেন, ভদ্রলোকে কোনোরকমে পিঠে চড়ে বেড়াতে পারে, এরকম একটি চালু ঘোড়া ৫০০ টাকা করে পাওয়া যেত না। আর খুব কম করেও একটা ঘোড়া পুষতে মাসে তখন ১৫ টাকা আন্দাজ খরচ হত। তা ছাড়া, ঘোড়া হলেই সহিসের দরকার হত। ঘোড়ার অন্যান্য সাজসরঞ্জামের দামও নেহাৎ অল্প ছিল না। দুঘোড়ার গাড়ির একসেট লাগাম-বগলস ইত্যাদি বিলেতি চামড়ার হলে (অর্থাৎ সাহেব মুচির তৈরি হলে) ২০০ টাকার কম পাওয়া যেত না। কিন্তু এদেশি মুচির হাতে চামড়ার তৈরি হলে তা ৬০ টাকাতেই পাওয়া যেত। জনসন এদেশি জিনিসই ব্যবহার করতেন। তিনি লিখেছেন, ‘I always had the latter; they look quite as well as thouse made by English saddlers’। জনসন ব্যবহার করলেও এদেশি অভিজাত জনার্দনরা নিশ্চয় বিলেতী ‘হার্নেস’ ব্যবহার করতেন, দেশি মুচির চামড়ার লাগামে তাঁদের মন উঠত না। সুতরাং সাহেব-নবাবদের কথা বাদ দিলেও, এদেশি বাবুদের ঘোড়ার চেয়ে চাবুকের খরচ পড়ত বেশি, এবং গোটা দুই ঘোড়ার গাড়ি রাখতে তাঁরা যে কি পরিমাণ অর্থ অপব্যয় করতেন তা কল্পনা করা যায় না। সাধারণ মানুষ এই ব্যয়ের কথা কল্পনাই করতে পারত না, ঘোড়া ও গাড়ি দুই-ই তাদের কাছে নিছক বিলাসিতা বলে মনে হত। তা ছাড়া, আগে যে ঘোড়া ও গাড়ির দৈনিক ও মাসিক ভাড়ার হারের কথা উল্লেখ করেছি তা দেখেই বোঝা যায়, ল্যাণ্ডো-বগি-কালচার তো বহুদূরের কথা, সামান্য কেরাঞ্চি-ছক্কোড়-কালচারও কলকাতা শহরে বর্ধিষ্ণু মধ্যবিত্ত-শ্রেণির বেশি দূর স্তর পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। অতএব নবযুগের নতুন মহানগরে পালকি কালচারেরই দীর্ঘদিন পর্যন্ত প্রতিপত্তি ছিল।
মানুষের স্কন্ধযান পালকি প্রাচীন ও মধ্যযুগের সংস্কৃতির বাস্তব নিদর্শন। তার উদবর্তন আধুনিক যুগেও সম্ভব হয়েছিল নতুন অশ্বাযানের ব্যয়-বাহুল্যের জন্য। উনিশ শতকের তৃতীয় পর্ব পর্যন্ত তো বটেই তার পরেও অনেকদিন পর্যন্ত পালকির প্রতিপত্তি কমেনি। বাংলার কথিত নবজাগরণ আন্দোলন যখন তরঙ্গশীর্ষে পৌঁছেছে, তখনও কলকাতার রাজপথে পালকি-বেয়ারাদের পথচলার ধ্বনি শোনা গেছে। যখন থেকে ঘোড়াটানা ট্রামগাড়ি চলতে আরম্ভ করেছে কলকাতায়, তখন থেকে সাধারণ মানুষের পালকি নির্ভরতা কমতে আরম্ভ করেছে। তার আগে একজোড়া পা ছিল সাধারণ মানুষের চলার পথে প্রধান সম্বল, অথবা ওড়িয়া বেয়ারাদের পদনির্ভর পালকি। কিন্তু প্রশ্ন হল, বাংলাদেশের ‘কাহার’ ‘ডোম’ ও অন্যান্য জাতের লোক যারা পালকি বইত, তারা কেউ গ্রাম ছেড়ে নতুন শহরে সাগ্রহে তেমন এল না কেন? বাংলার নতুন শহরে পালকিবেয়ারা হল ওড়িয়ারা। বাঙালি পালকিবেয়ারারা কোথায় গেল? বোঝা যায়, তারা গ্রাম ছেড়ে শহরে আসেনি। নতুন শহর-নগরের যানবাহন দীর্ঘকাল পর্যন্ত গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত হয়নি। আজই বা গ্রামের কতদূর পর্যন্ত প্রচলিত হয়েছে? উনিশ শতকের প্রথমার্ধে তো হয়ইনি, দ্বিতীয়ার্ধেও রেলপথে ট্রেন চলাচলের পর, ট্রেন ছাড়া আর কোনো আধুনিক যান গ্রাম অভিমুখে যাত্রা করেনি। কিন্তু রেলগাড়ি গেলেও, তাতে গ্রাম্যজীবনের ভিতরের চলাচলের চাহিদা মেটেনি। সেকালের গ্রাম্যসমাজের অচলতা ও বিচ্ছিন্নতা রেলগাড়ি দূর করে দিয়েছিল বটে, কিন্তু তার ভিতরের যুগসঞ্চিত জড়তার লৌহপ্রাচীর ধূলিসাৎ করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। নতুন শহুরে সমাজে যে গতিশীলতা সঞ্চারিত হয়েছিল, তার শতাংশের একাংশও গ্রাম্যসমাজে দীর্ঘকাল পর্যন্ত হয়নি। নতুন অশ্বযানের পথ তৈরি হয়নি গ্রামে। সনাতন পায়ে-হাঁটা পথে মানুষ চলত, এবং মানুষের কাঁধে ডুলি ও পালকি চলত। ব্রিটিশ আমলেও এই অবস্থার বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি। সুতরাং গ্রাম্যসমাজে নানাজাতের ও নানাশ্রেণির লোক ইংরেজ আমলে তাদের বংশগত পেশা থেকে উৎখাত হলেও, বাংলায় পালকিবেয়ারারা বেকার হয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসতে বাধ্য হয়নি। ওড়িয়া বেয়ারারা হয়ত আর্থিক কারণেই নতুন কলকাতা শহরে আসতে প্রলুব্ধ হয়েছিল, কিন্তু বাঙালি বেয়ারারা হয়নি। নতুন শহর অথবা অর্থলোভ গ্রাম্য পরিবেশ থেকে তাদের ছিনিয়ে আনতে পারেনি। দরিদ্র ও পরিশ্রমী ওড়িয়ারা অভাবের তাড়নায় ও উপার্জনের লোভে সহজেই তাদের গ্রাম ছেড়ে বাংলার নতুন মহানগরে দলে দলে চলে এসেছিল।
নতুন কলকাতায় পুরাতন পালকির বাহক ছিল ওড়িয়ারা। ১৮৪০-৪১ সালে পালকি ও তার বেয়ারাদের ভাড়া ও মজুরির হার ছিল এই :
পাল্কিভাড়ার হার
সারাদিনের জন্য, ১৪ ঘণ্টা : চার আনা
আধাদিনের জন্য, ১ ঘণ্টা থেকে
৫ ঘণ্টা : দুই আনা
বেয়ারাদের মজুরি
সারাদিনের জন্য, ১৪ ঘণ্টা : চার আনা
আধাদিনের জন্য : দুই আনা
একঘণ্টা বা আরও
অল্প সময়ের জন্য : এক আনা
পাল্কি ও পালকিবেয়ারাদের সঙ্গে ঘোড়াগাড়ি ও ঘোড়ার ভাড়া-মজুরির হারের তুলনা করলে একটা আশ্চর্য বিষয় লক্ষ্য করা যায়। নতুন অর্থসর্বস্ব শহরে অর্থের মর্যাদা মানুষের চেয়ে বড় তো হয়ে উঠলই, মানুষের মেহনতের আর্থিক মূল্য ঘোড়ার চেয়েও কমে গেল। ১৮৪০-৪১ সালে সারাদিনের জন্য একটি ঘোড়া ভাড়া করতে গেলে ৫ টাকা মজুরি দিতে হত। ঘোড়ার কাজ ছিল প্রভুকে পিঠে চড়িয়ে ঘুরে বেড়ানো। ঘোড়ার সারাদিনের মেহনতের মজুরি যখন ৫ টাকা ছিল তখন একজন পালকিবেয়ারার সারাদিনের মেহনতের মজুরি ছিল চার আনা। অর্থাৎ মানুষের মেহনতের মজুরির হারের চেয়ে ঘোড়ার মেহনতের মজুরির হার ছিল বিশগুণ বেশি। অথচ পালকিবেয়ারারাও, ঘোড়ার মতন মানুষকে পিঠে না বইলেও, কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যেত। উভয়ের মেহনতের মধ্যে গুণগত, এমন কি বাইরের রূপগতও, কোনো পার্থক্য ছিল না। সুতরাং তাদের মেহনতের মূল্যে এত তফাৎ হওয়া উচিত হয়নি। কিন্তু নতুন শহরে একশ্রেণির মানুষের আত্মমর্যাদা যেমন বাড়ছিল, তেমনি একশ্রেণির মেহনতসর্বস্ব মানুষ পশুর চেয়েও নিম্নস্তরে নেমে যাচ্ছিল।
যানবাহনের দিক থেকে সাধারণ মানুষের একমাত্র সহায় ও সম্বল ছিল সনাতন পালকি। পালকির চেয়ে বগি কেরাঞ্চি, এমন কি ছ্যাকরার ভাড়ার হারেও ছিল অনেক বেশি। তাই থাকাই স্বাভাবিক, কারণ ঘোড়ার মেহনতের দাম মানুষের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। আজও স্টীমলাইণ্ড অটোমোবিলের যুগে বড় বড় শহরে তো মানুষ টানা রিক্সা চলে। বিংশ শতাব্দীর মধ্যাহ্নেও তো জন্তু ও যন্ত্রের চেয়ে মানুষের মেহনতের মূল্য বাড়ল না! সুতরাং উনিশ শতকে পালকি ও তার বাহকদের ভাড়ার হার বগি ও তার ঘোড়ার চেয়ে যে অনেক কম হবে, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।
পালকি ও তার বাহকদের এই ট্র্যাজিডি সত্ত্বেও একথা স্বীকার করতেই হবে যে বাংলার নবজাগরণের যুগে অগ্রগতির প্রতীক ছিল ল্যাণ্ডো-ব্রুহ্যাম-বগি, এমন কি, কেরাঞ্চি ও ছক্কোড়ও। ল্যাণ্ডো-বগির কদম-চালে নবজাগরণের জাগ্রত সমাজচেতনার অগ্রগতির বেগ প্রতিফলিত হত। কেবল ল্যাণ্ডো নয়, তার ঘোড়াগুলোও ছিল নবযুগের মানুষের চরিত্রের প্রতীক। কিন্তু তার সঙ্গে কলকাতায় পালকিরও প্রাধান্য ছিল যথেষ্ট। পালকির এই প্রাধান্য দেখে বোঝা যায়, বাংলাদেশে নবজাগরণের আদর্শ সম্পূর্ণরূপে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়নি, তার মধ্যে আত্মবিরোধ ছিল অনেক। সামন্ত যুগের সংস্কৃতিতে বেশ সমারোহেই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টা হয়েছিল। চেষ্টা একেবারে ব্যর্থ হয়নি। বিদেশি সাহেব কোচমেকাররা পর্যন্ত এদেশি পালকি নির্মাণে মনোযোগ দিয়েছিলেন।
পালকি বেচে তাঁরা ল্যাণ্ডো-বগির চেয়ে বেশি ছাড়া কম অর্থ রোজগার করেননি। মনে হয় পালকি বেচেই তাঁরা সবচেয়ে বেশি পয়সা পেয়েছিলেন। বিখ্যাত ইয়োরোপীয় চিত্রকররা কলকাতা শহরে এসে, কোচমেকারদের কারখানায় পালকি চিত্রণের কাজ করে, প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন। উইলিয়ম বেইলি (যাঁর আঁকা প্রাচীন কলকাতার চিত্রাবলী ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলে আছে) ১৭৯৫ সালে তাঁর একজন শিল্পীবন্ধুকে লেখেন :
সলভিন্স নামে একজন ফ্লেমিশ শিল্পী ব্রুশেলস থেকে বছর চারেক আগে কলকাতা শহরে এসেছেন। অল্পদিনের মধ্যে তিনি প্রচুর অর্থ উপাজর্ন করেছেন। কোচমেকার স্টুয়ার্টদের কারখানায় তিনি পাল্কি চিত্রিত করেই অর্থ পেয়েছেন বেশি। অবশ্য সেসব সাধারণ পাল্কি নয়, রাজরাজড়াদের পাল্কি। তার মধ্যে দু’টি আমি জানি লর্ড কর্নওয়ালিস, মহীশূর-রাজের জন্য তৈরি করেছিলেন, ছ’সাত হাজার টাকা করে দাম হবে। সলভিন্স সেই পাল্কি চিত্রিত করেছিলেন, সোনার রঙের উপর অন্য একটি রঙ দিয়ে। তাতে তাঁর সুনাম হয়েছিল খুব। এইসব রাজকীয় পাল্কির অদ্ভুত কারিগরি দেখলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। যেখানে যে-ধাতু দিয়ে তৈরি, তার উপর রূপো দিয়ে বাঁধানো, কোথাও বা নীরেট রূপো দিয়েই সবটা তৈরি। ভিতরে ভেলভেটের লাইনিং দেওয়া, তার উপর সোনারুপোর কাজ করা ঝালর লাগানো। তাঞ্জোরের মহারাজকুমারদের জন্য সম্প্রতি স্টুয়ার্টরা দুই একরকমের পাল্কি তৈরি করেছেন, প্রত্যেকটির দাম দশ হাজার টাকা হবে। এগুলিকে ‘মহনা’ বা ‘মিয়ানা’ পাল্কি বলা হয়। পাল্কির ভিতরে বিছানা-বালিশ সবই থাকে, শুয়ে শুয়ে পরম আরামে যাওয়া যায়।
মিয়ানা পালকি বাংলারই বৈশিষ্ট্য ছিল। কলকাতার বিদেশি কোচমেকাররা ভারতের রাজামহারাজাদের জন্য এই পালকি তৈরি করে পাঠাতেন। লম্বায় ও চওড়ায় বেশ বড় পালকি, ভিতরে আরোহীরা হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে-বসে, যেভাবে খুশি যেতে পারতেন। বিলাসিতার দিক থেকে মিয়ানা পালকির কোনো জুড়ি ছিল না।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের কথা। নবযুগের ল্যাণ্ডো-বগির সঙ্গে মধ্যযুগের রাজকীয় পালকি তখনও কলকাতার রাস্তায় পাল্লা দিয়ে চলেছে। শহরের পথে-ঘাটে ঘোড়াকে ভয় দেখিয়ে দুচারটে হাতীও তখন চলে বেড়িয়েছে। কথিত নবজাগরণের সূচনা হয়নি তখনও। উনিশ শতক থেকে ক্রমে রাজকীয় পালকির প্রভাব কমেছে এবং ল্যাণ্ডো-বগির প্রতিপত্তি বেড়েছে। ধনিক-বণিক যুগের অগ্রগতির ধ্বনি ল্যাণ্ডো ও ওয়েলারের চলার ছন্দে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। কিন্তু সাধারণ জনসমাজে মধ্যযুগের প্রভাব যে বিশেষ কমেনি, ল্যাণ্ডো বগির পাশে ওড়িয়া বেয়ারাদের পালকি দেখে তা বোঝা যেত।
তবু একটা পুরনো যুগ যে অস্ত যাচ্ছে এবং নতুন যুগের জন্ম হচ্ছে কলকাতা শহরে, উদ্ধত অশ্বারোহীর ও অশ্বযানের পদধ্বনিতে তা বোঝা যাচ্ছিল। নবনির্মিত বড় বড় লম্বা-চওড়া রাজপথের মধ্য দিয়ে কলকাতা শহরের আধুনিক যুগোপযোগী রূপ ফুটে উঠেছিল। মধ্যযুগের নগরের সংঙ্কীর্ণ অলিগলির বাঁকে মধ্যে মধ্যে তবু অশ্বারোহী অভিজাতদের সঙ্গে সাধারণ দীনদরিদ্র প্রজাদের হঠাৎ দেখা-সাক্ষাৎ হত, এবং তাঁরা তাদের পথ ছেড়ে দেবার জন্য হয়ত দুদণ্ড অশ্বপৃষ্ঠে অপেক্ষাও করতেন। কিন্তু নবযুগের নতুন শহরে সুদীর্ঘ প্রশস্ত রাজপথ তৈরি হল যখন, তখন ধনীদরিদ্রের মানবিক বিভেদ-বিচ্ছেদও সেই অনুপাতে প্রশস্ত হয়ে গেল। সেইজন্য সমাজবিজ্ঞানী মামফোর্ড (Lewis Mumford) বলেছেন :
Now, with the development of the wide avenue, the dissociation of the upper and the lower classes achieves form in the City itself. The rich drive, the poor walk. They roll alone the axis of the grand avenue : the poor are off-centre, in the gutter. [The Culture of Cities, P. 97]
কলকাতা শহরেও ধনী-দরিদ্রের এই ব্যবধান ক্রমেই বাড়তে থাকল। সতেরশতকে প্যারিস ও লণ্ডন শহরে স্টেজকোচ চাপা পড়ে যত লোকের মৃত্যু হয়েছিল, পরবর্তীকালে রেলগাড়ির যুগেও বোধহয় তা হয়নি। আঠার ও উনিশ শতকের কলকাতা শহরেও ঠিক তাই হয়েছিল। নবযুগের নতুন সামাজিক গতি ও চলার ছন্দের সঙ্গে সাধারণ মানুষ ঠিক তাল রেখে চলতে পারছিল না। মামফোর্ড বলেছেন : ‘If the fowls no longer cackled at dawn, the restless stomp of a highbread horse might be heard at night from rear windows; the man on horseback had taken possession of the city.’
উনিশ শতকের কলকাতা শহরেও মোরগের ডাকে ভোরবেলা মানুষের আর ঘুম ভাঙছিল না। গ্রাম ভেঙে যখন নতুন শহর গড়ে উঠেছিল, এবং গ্রামের মানুষ শহর থেকে দূরে বহুদূরে সরে যাচ্ছিল, তখন তাদের সঙ্গে ভোরের মুরগির ডাকও ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল। টমটম ও ল্যাণ্ডো-বগির চাকার ঘর্ঘর শব্দে এবং তেজোদ্দীপ্ত অশ্বের পদধ্বনিতে নতুন শহরে নতুন ভোর হচ্ছিল, এবং নতুন করে জেগে উঠছিল মানুষ। শহর নতুন, ভোর নতুন, মানুষও নতুন। ভোরের ঘুমভাঙা মানুষ বুঝতে পারছিল, ‘the man on horseback had taken possession of the city’-নতুন যুগের অশ্বারোহীরাই শহরটাকে দখল করেছে, এবং নতুন শহরের উপর দিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে দুরন্ত বেগে তারা এগিয়ে চলেছে। কিন্তু চলেছে কোথায়?