নুরুজ্জামান সকাল ৯ টা থেকে রামপুরা টিভি ভবনের গেটে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে ঢোকার পাশ নেই। নুরুজ্জামানের গায়ে ইস্ত্রী করা পায়জামা-পাঞ্জাবি। পায়ের স্যাণ্ডেল জোড়াও নতুন। স্যাণ্ডেল কেনার তার ইচ্ছা ছিল না। ফুটপাতে সাজানো স্যাণ্ডেল দেখে কৌতূহলী হয়ে দাম করতে গেল। দাম জিজ্ঞেস করে ফিরে আসছিল, দোকানদার বলল, একটা দাম কইয়া তারপরে যান। দাম না কইয়া যান গিয়া এইটা কেমুন ধর্ম? নুরুজ্জামান অস্বাভাবিক কম দাম বলল। দোকানদার নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, লইয়া যান। এই হচ্ছে তার নতুন স্যাণ্ডেলের রহস্য।
নুরুজ্জামানের পাঞ্জাবির পকেটে পাঁচ-ছটা অশ্বত্থ গাছের কচি পাতা। ফজরের নামাজ শেষ করেই সে পাতার সন্ধানে গিয়েছিল। সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে খানিকটা হাঁটতেই পাতা পেয়ে গেল। পাতাগুলি মিইয়ে যাচ্ছে। পাতা বেশিক্ষণ থাকে না। দু ঘণ্টার মধ্যে মিইয়ে যায়। মিয়ানো পাতায় সুর ধরে না। ফেটে ফেটে যায়। সে বুঝতে পারছে না–আবারও কিছু টাটকা পাতা নিয়ে আসবে কি না। কামরুদ্দিন সাহেব এখনো পাশ পাঠাচ্ছেন না কেন তাও বুঝতে পারছে না। ভুলে গেলেন নাকি? ব্যস্ত মানুষ। ভুলে যাওয়া অস্বাভাবিক না। উনাকে খবর পাঠাতে পারলে হত। খবর কিভাবে পাঠানো যায় তাও সে বুঝতে পারছে না।
একটার সময় টিভি ভবনের দারোয়ান বলল, কতক্ষণ আর এইভাবে ঘোরাঘুরি করবেন? যান, ভিতরে চলে যান।
পাশ নাই তো।
পাশ লাগবে না।
অশেষ শোকরিয়া।
নুরুজ্জামান কামরুদ্দিনের ঘর খুঁজে বের করল। ঘর তালাবন্ধ। জানা গেল, তিনি ইউনিট নিয়ে আউটডোর শুটিং-এ গেছেন। শুটিং হচ্ছে সাভারে–বড়খালি নামের এক গ্রামে। সন্ধ্যা পর্যন্ত শুটিং হবে। নুরুজ্জামান বড়খালি চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। সন্ধ্যা সন্ধ্যায় পৌঁছতে পারলেই হল। সমস্যটি হল–বড়খালি জায়গাটা কোথায় কেউ বলতে পারছে না। সাভার চলে গেলে একটা খোঁজ নিশ্চয়ই পাওয়া যায়। উপস্থিত হতে পারলে দুটা লাভ হবে–কামরুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে দেখা হবে। টিভির শুটিং কিভাবে করে তাও দেখা হবে। ব্যাপারটা তার দেখার শখ।
সন্ধ্যার আগে-আগে নুরুজ্জামান বড়খালি গ্রামে উপস্থিত হল। শুটিং ততক্ষণে শেষ হয়েছে। কামরুদ্দিন প্যাক আপ করে দিয়েছেন। ক্যামেরা গাড়িতে উঠছে। নুরুজ্জামান কামরুদ্দিনের কাছে গিয়ে হাসিমুখে বলল, স্নামালিকুম স্যার।
কামরুদ্দিন অন্ধকার মুখে বলল, কে?
স্যার আমি নুরুজ্জামান। আপনি টিভিতে যেতে বলেছিলেন, গিয়েছিলাম, শুনলাম এখানে আছেন। চলে এসেছি।
তাই তো দেখছি।
শুটিং কি শেষ হয়ে গেছে স্যার?
হ্যাঁ।
জিনিসটা দেখার শখ ছিল।
কামরুদ্দিন শুকনো মুখে বলল, বেশি বেশি শখ ভাল না। শখ কম থকা ভাল।
জ্বি, তা ঠিক। স্যার, আমি তাহলে কবে দেখা করব?
কি জন্যে? কি ব্যাপারে?
নুরুজ্জামান বিস্মিত হয়ে বলল, ঐ যে স্যার পাতার বাঁশি।
কিসের পাতার বাঁশি?
স্যার আপনার মনে নেই। ঐ যে আপনি গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলেন, আপনাকে পাতার বাঁশি শুনালাম। আপনি বললেন ঢাকায় এলে দেখা করতে।
ও আচ্ছা। এই বারে কিছু হবে না। আগামী প্রান্তিক পর্যন্ত সব বুক হয়ে আছে। ছয় মাস পরে আসুন, দেখি কি করা যায়।
আষাঢ় মাসে আসব?
আসুন।
টিভির বিরাট বাস এসেছে। বাস খালি পড়ে আছে। কামরুদ্দিন সাহেব ইচ্ছা করলেই নুরুজ্জামানকে সঙ্গে নিয়ে নিতে পারতেন। তা নিলেন না। নুরুজ্জামান হাঁটা ধরল। তাকে হাঁটতে হচ্ছে খালি পায়ে। নতুন স্যাণ্ডেলের ফিতা এর মধ্যেই খুলে গেছে। এখনো চব্বিশ ঘণ্টা পার হয়নি, এর মধ্যেই এই অবস্থা। অথচ কেনার সময় দোকানদার বলল, লাইফ গ্যারান্টি। এরা অশিক্ষিত মূখ। লাইফ গ্যারান্টি শব্দটির মানেই বোধহয় জানে না। জানলে বলত না। অশিক্ষিত লোকজন সাধারণত সৎ হয়।
জাফর সাহেব আজ সকাল সকাল বাসায় ফিরেছেন। এসে দেখেন তিথি নেই। শূন্য বাড়িতে ঢুকতে ভাল লাগে না। শূন্য বাড়িতে ঢুকলে মনে হয়, বাড়িটা চোখ বড় বড় করে দেখছে। তিনি শুনেছেন, বেশির ভাগ মানুষ পাগল হয় যখন সে একা একা থাকে। একজন কেউ সঙ্গি পাশে থাকলে নাকি কেউ পাগল হতে পারে না।
জাফর সাহেবের গা ছম ছম করতে লাগল। তিনি বাথরুমে ঢুকলেন কিন্তু বাথরুমের দরজা লাগালেন না। তাঁর কেবলি মনে হল–বাথরুমের দরজা লাগালেই আর খুলতে পারবেন না। খুলতে গেলেই দেখা যাবে বাইরে থেকে কেউ দরজা চেপে ধরে আছে।
তিনি রান্নাঘরে গিয়ে গরম পানি বসালেন। এককাপ চা খাওয়া দরকার। টিব্যাগ চা, চিনি এসব নিশ্চয়ই হাতের কাছেই পাওয়া যাবে। তিথি হরদম বানাচ্ছে। রাতে ঘুমুতে যাবার আগেও তার চা খেতে হয়। আশ্চর্যের ব্যাপার, চা, দুধ, চিনি কিছুই নেই। একটা পাওয়া না গেলে অন্যটা তো পাওয়া যাবে। চা পাওয়া না গেলে দুধ। দুধ পাওয়া না গেলে চিনি। কিছুই নেই।
তাঁর মাথায় রক্ত চড়ে গেল। জিনিসগুলি ঘরেই আছে অথচ তিনি পাচ্ছেন না, তা কেমন করে হয়! এমন তো না যে জিনিসগুলি অদৃশ্য হয়ে আছে বলে তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। ঘরেই কোথাও আছে। যাবে কোথায়? থাকতেই হবে।
সন্ধ্যাবেলা তিথি বাসায় ফিরে দেখে রান্নাঘরের সমস্ত জিনিস মেঝেতে নামানো। ফ্রীজের পানির বোতল নামাতে গিয়ে দুটা পানির বোতল ভেঙেছে। থৈ-থৈ করছে পানি। ভাঙা কাচে জাফর সাহবের পা কেটেছে।
তিথি হতভম্ব হয়ে বলল, কি হয়েছে বাবা?
জাফর সাহেব অপ্রস্তুত গলায় বললেন, চায়ের দুধ, চিনি, চা এইসব কোথায় রেখেছিস? খুঁজে পাচ্ছি না।
গ্যাসের চুলার পেছনেই তো সব রাখা। এই তো।
ও আচ্ছা।
বাবা, তুমি তো দেখি সব একাকার করে ফেলেছ?
হুঁ।
চা খাবে? তুমি বারান্দায় বোস, আমি চা বানিয়ে আনছি।
না, এখন আর ইচ্ছা করছে না। বাদ দে।
তোমার কি শরীর খারাপ করেছে নাকি? দেখি কাছে আসো তো, গায়ে হাত দিয়ে দেখি। না, শরীর তো ঠাণ্ডা।
জাফর সাহেব হাসতে চেষ্টা করলেন। হাসি স্পষ্ট হল না। তিথি বলল, তোমার জন্য স্যাণ্ডউইচ কিনে এনেছি। নাও, স্যাণ্ডউইচ নাও। বাবা, এখন থেকে এই ব্যবস্থা। আমি বাজার থেকে স্যাণ্ডউইচ কিনে ঘরে রেখে দেব। খিদে লাগলে খাবে।
আচ্ছা।
জাফর সাহেব স্যাণ্ডউইচ খেয়ে অবেলায় বিছানায় গিয়ে শুলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লেন। গাঢ় গভীর ঘুম। তিথি রাত দশটায় অনেক কষ্টে তাঁকে ডেকে তুলল। তিনি জানালেন রাতে কিছু খাবেন না। জ্বর-জ্বর লাগছে।
নুরুজ্জামানও রাতে কিছু খেল না। সে আজও দুটা আনারস কিনে নিয়ে এসেছে। রাতে ভাতের বদলে আনারস খেয়েছে। তিথি ভেবে পাচ্ছে না লোকটা পাগল কি-না।
নুরুজ্জামানের আজ অবশ্যি আনারস কেনার কোন ইচ্ছা ছিল না। সে গিয়েছিল আনারসওয়ালাকে ধন্যবাদ দিতে। ঐদিনের আনারস অসম্ভব মিষ্টি ছিল, খেয়ে তৃপ্তি পেয়েছি–এই কথাগুলি শুধু বলে আসা, লাভের মধ্যে লাভ এই হয়েছে। আনারসওয়ালা আরো দুটা ধরিয়ে দিয়েছে।
টেকা না থাকলে পরে আইস্যা দাম দিয়েন। অসুবিধা কিছু নাই। আর দাম না দিলেও ক্ষতি নাই। দুইটা আনারসের জন্য আমি না খাইয়া মরুম না।
এই কথার পর না কিনে উপায় থাকে না।
তিথি একা একা খেতে বসল। কিছুক্ষণের মধ্যেই নুরুজ্জামান এসে সামনে বসল। অপরিচিত একজন পুরুষ মানুষের সামনে বসে খাওয়া অস্বস্তিকর। তাকে উঠে চলে যেতে বলা আরো অস্বস্তিকর।
নুরুজ্জামান বলল, স্যার খাবেন না?
না, বাবার শরীরটা ভাল না।
কি হয়েছে?
তেমন কিছু না। গা গরম। আপনি রাতে যদি কিছু না খান তাহলে শুধু জেগে আছেন কেন? শুয়ে পড়ুন।
আপনি একা একা খাবেন এই জন্যে বসে আছি।
আমার জন্যে বসে থাকতে হবে না। আমার একা খেতেই ভাল লাগে।
স্পষ্ট ইংগীত। এরচে স্পষ্ট করে বললে বলতে হয় আপনি দয়া করে উঠে যান। তো। আমার সামনে ড্যাব ড্যাব চোখে বসে থাকবেন না। নুরুজ্জামান বসেই আছে। লবনদানী থেকে খানিকটা লবন হাতে নিয়ে আংগুলে করে খাচ্ছে। লবন কি একটা খাবার জিনিস?
নুরুজ্জামান বলল, রাতে ভাত না খাওয়াটা ঠিক না। এতে শরীর থেকে একটা চড়ুই পাখির রক্ত চলে যায়।
তাই না-কি?
গ্রামের কথা। মা চাচীর মুখে শুনেছি।
আপনি যা শুনেন তাই বিশ্বাস করেন?
জ্বি। বিশ্বাস করাই ভাল। শুধু শুধু অবিশ্বাস করব কেন?
আমি যদি বলি, কাল রাতে একটা ভূত এসে আমার খাটের নিচে শুয়েছিল তাহলে বিশ্বাস করবেন?
আপনি বললে অবশ্যই করব। আপনি শুধু শুধু আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলবেন কেন?
কথার পিঠে কথা বলে যেতে তিথির ভাল লাগছে না। তাছাড়া তাকে অর্জি অনেক কথা বাবাকে গুছিয়ে বলতে হবে। মারুফের সঙ্গে তার সম্পর্ক, মারুফের বাইরে যাবার ব্যাপার। অল্প কদিনের জন্যে যে বিয়ের পর্ব শেষ করতে হবে সেটা। তাছাড়া মার সঙ্গেও কথা বলতে হবে। ছোট মামার টেলিফোন নাম্বার আছে। এরিয়া কোড জানা নেই। কোথাও নিশ্চয়ই লেখা আছে।
নুরুজ্জামান হাসি মুখে বলল, পাতা জোগার হয়েছে।
কি জোগার হয়েছে?
পাতা। অশ্বথের পাতা।
অশ্বথের পাতা দিয়ে কি করবেন?
পাতার বাঁশি বাজাব।
ও আচ্ছা আচ্ছা। ভুলে গিয়েছিলাম।
আপনি শুনতে চাইলে খাওয়ার পর খানিকক্ষণ…
আরেকদিন শুনব। আজ আমার বাঁশি শুনতে ইচ্ছা করছে না।
জ্বি আচ্ছা।
আপনি শুয়ে পড়ুন।
আপনার খাওয়া শেষ হলেই শুয়ে পড়ব।
ঢাকার কাজ কর্ম শেষ হয়েছে?
জ্বি না। মন্ত্রী সাহেবের সঙ্গে এখনো দেখা করতে পারিনি।
চেষ্টা করছেন?
জি। উনার পিএ আমাকে টেলিফোন করে সময় দেবেন। মন্ত্রীরা খুব ব্যস্ত থাকেন। বললেই সময় দিতে পারেন না। আমি আপনাদের টেলিফোন নাম্বার দিয়ে এসেছি।
তিথি বলল, আমাদের টেলিফোন নাম্বার লোকজনদের দিয়ে বেড়াবেন না। টেলিফোন নাম্বার হল খুবই ব্যক্তিগত ব্যাপার।
আমি শুধু উনাকেই দিয়েছি। আর কাউকে না।
তিথি খাওয়া শেষ না করেই উঠে পড়ল। খেতে ভাল লাগছে না। সে এখন নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে খানিকক্ষণ শুয়ে থাকবে। ঠাণ্ডা মাথায় ভাববে বাবাকে পুরো ব্যাপারটা কি ভাবে বলা যায়। যখন সমস্ত কথাবার্তা গোছানো শেষ হবে তখন সে বাবার ঘরে যাবে। তিনি জেগে থাকলে তাকে তখনি বলবে। জেগে না থাকলে ভোরবেলা বলবে। সে নিজে ঘুমুবে না। সারারাত ভাববে। দরকার হলে পুরো ব্যাপারটা কাগজে গুছিয়ে লিখবে। ভোরবেলা নিজের মুখে কিছু না বলে কাগজটা ধরিয়ে দেবে। নরম গলায় বলবে–এখানে কিছু জরুরি কথা লেখা আছে। তুমি এখন পড়বে না। অফিসে নিয়ে যাও। অফিসে গিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় পড়বে। তারপর যদি আমাকে কিছু বলতে চাও–বাসায় টেলিফোন করবে আমি বাসাতেই থাকব।
তিথি নিজের ঘরে ঢুকল। ঘরে বাতি জ্বলছিল বাতি নিভিয়ে দিল। প্রচুর কাজ পড়ে আছে রান্নাঘর কিছুই গোছানো হয় নি। ঐ ঘরে এখন ঢুকতেই ইচ্ছা করছে না।
তিথি বিছানায় গড়িয়ে পড়ল। এত ক্লান্তি লাগছে মাথার নিচে বালিশটা পর্যন্ত টেনে দিতে ইচ্ছে করছে না। তিথি চোখ বন্ধ করল আর তখনি জাফর সাহেবের গলা শোনা গেল। ভয় পাওয়া গলায় তিনি ডাকছেন–ও তিথি তিথি। এরকম অদ্ভুত ভঙ্গিতে বাবা তাকে ডাকছেন কেন? তিথি প্রায় ছুটে গেল।
জাফর সাহেবের ঘরে বাতি জ্বলছে। তিনি খাটের মাঝখানে উবু হয়ে বসে আছেন। তার ঘুম ভেঙ্গেছে ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখে। স্বপ্নের ঘোর এখনো রয়ে গেছে। তার বুক ধুক ধুক করছে।
বাবা কি হয়েছে?
কিছু না। পানি খাব। পানি দে।
তিথি পানি এনে দিল। জাফর সাহেব এক চুমুকে পানি শেষ করে গ্লাস মেয়েকে ফেরত দিতে দিতে বললেন, এক কাজ করলে কেমন হয়রে তিথি।
কি কাজ?
চল–কাল দুজনে সিলেট চলে যাই। তোরতো অনেক দিনের ইচ্ছা ছোটমামার চা বাগান দেখবি। বাগান দেখা হল।
চল যাই।
সকালে ট্রেন আছে। ঐ ট্রেনে যাওয়া যাবে না। অফিস থেকে ছুটি নিতে হবে। রাতের ট্রেনে যাই চল।
আমি রাজি। কাল সব গুছিয়ে রাখব।
ঐ গাধাটাকে কি করবি?
কোন গাধা?
নুরুজ্জামান।
ও আচ্ছা। উনাকে বাসা পাহারা দেবার দায়িত্বে রেখে যাব।
সেটা মন্দ না।
তোমার কি শরীর খারাপ ভাবটা একটু কমেছে?
হুঁ।
ভাত খাবে এনে দেই? আজকের তরকারী তত খারাপ হয় নি। মুখে দিতে পারবে।
ভাত খাব নারে মা। ভাত ছাড়া অন্য কিছু থাকলে এনে দে।
স্যাণ্ডউইচ আছে। দেব?
দে।
সঙ্গে এক গ্লাস দুধ দেব?
আচ্ছা দে।
জাফর সাহেব বেশ আরাম করেই স্যাণ্ডউইচ খাচ্ছেন। তিথি সামনে বসে আছে। তিথির খুব মায়া লাগছে। তিথি নরম গলায় ডাকল, বাবা!
কি রে মা।
তিথি খানিকটা অস্বস্থি খানিকটা লজ্জা মেশানো গলায় বললো, বাবা শোন! আমি যদি নিজের পছন্দের একটা ছেলেকে বিয়ে করতে চাই তাহলে তুমি কি খুব রাগ করবে? না জাফর সাহেব খাওয়া বন্ধ করে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তিথি হঠাৎ অসম্ভব লজ্জা পেয়ে গেল। সে জানালার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি এমন করে তাকিয়ে আছ কেন?
জাফর সাহেব বললেন, তোর পছন্দের কোন ছেলে আছে?
হুঁ।
আশ্চর্য কাণ্ড! তুইতো সেদিনের বাচ্চা মেয়ে।
বাবা আমি সেদিনের বাচ্চা মেয়ে না। আমি M.Sc পরীক্ষা দিয়ে বসে আছি। আমার বয়স এখন ২৪ বৎসর তিন মাস।
জাফর সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, বলিস কি তোর চব্বিশ হয়ে গেছে?
হয়েছে।
ছেলেটা কি করে?
এতদিন কিছু করত না। খবরের কাগজে ফ্রীল্যান্স লেখা লিখত দু তিনটা প্রাইভেট টিউশুনি করে। এখন অবশ্যি ph.D করতে ফ্রান্সে যাচ্ছে। তার ইচ্ছা ছিল আমেরিকা যাবার।
ছেলের বাবা কি করেন?
ছেলের বাবা কি করেন আমি জানি না। কখনো জিজ্ঞেস করি নি। ছেলের বাবা কি করেন সেটা কি খুব জরুরি?
জাফর সাহেব চুপ করে রইলেন। তিথি বাবার দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে বলল, একটা মেয়ের যখন একটা ছেলেকে ভাললাগে তখন ছেলের বাবা মেয়েটির সামনে থাকে না।
প্রচ্ছন্ন ভাবে থাকে। ছেলের বাবার ছায়া থাকে ছেলের মধ্যে। আমার খানিকটা ছায়া কি তোর মধ্যে নেই?
জানি না, আছে হয়ত। আচ্ছা বাবা ধর ছেলের বাবা খুবই সামান্য একজন মানুষ। কোন অফিসের পিওন, কিংবা ধর রিকশাওয়ালা। এই অবস্থায় তুমি কি করবে? তুমি কি বলে দেবে–না বিয়ে হবে না।
জাফর সাহেব বললেন, ছেলেটিকে তোর কি খুব পছন্দ?
হ্যাঁ।
আমি দেখেছি তাকে?
একদিন দেখেছ। তবে তোমার নিশ্চয়ই মনে নেই।
ওর কোন ছবি আছে তোর কাছে? নিয়ে আয়তো।
তিথি লজ্জিত গলায় বলল, তুমি ভেবেছ কি আমাকে? আমি বুঝি ওর ছবি বালিশের নিচে রেখে ঘুমাই? ছবি টবি নেই। তিথি এইখানে খানিকটা মিথ্যা কলল। মারুফের ছবি তার কাছে আছে। একটা না বেশ কয়েকটা ছবি।
দেখতে কেমন?
মোটামুটি। তবে এ্যাপোলো না।
বুদ্ধিমান?
অবশ্যই বুদ্ধিমান।
ওর নাম কি?
মারুফ।
জাফর সাহেব খুশি খুশি গলায় বললেন, নামটাতো ভাল–মা দিয়ে শুরু। যে সব ছেলের নাম মা দিয়ে শুরু হয় তাদের হৃদয় নরম থাকে। আমাদের সঙ্গে একটা ছেলে ছিল–মাহফুজ নাম, খুব ভাল ছেলে।
তোমার অদ্ভুত ধরণের কথাবার্তা বন্ধ করতে বাবা। মা দিয়ে নাম শুরু হলে ছেলে হবে হৃদয়বান। দুধটা খেয়ে শেষ কর–গ্লাস হাতে নিয়ে বসে আছ কেন?
জাফর সাহেব এক চুমুকে দুধ শেষ করলেন। তাকে এখন খুব আনন্দিত বলে মনে হচ্ছে। তিথি বলল, তুমি কিন্তু এখনো আমার প্রশ্নের উত্তর দাও নি।
তুই আবার কি প্রশ্ন করেছিস?
এই যে বললাম–আমি যদি আমার পছন্দের একটা ছেলেকে বিয়ে করি তুমি রাগ করবে কি না।
রাগ করব কেন?
বিয়েটা যে খুব তাড়াতাড়ি হওয়া দরকার সেটা কি বুঝতে পারছ?
না–তাড়াতাড়ি হওয়া দরকার কেন?
ও বিয়ে করে তারপর যেতে চায়। যাতে ও চলে যাবার কিছুদিনের মধ্যেই আমি ওর কাছে চলে যেতে পারি। এখন বুঝতে পারছ?
পারছি। ভালই হল কাল সিলেট গিয়ে তোর মাকে নিয়ে আসি। ও ব্যবস্থা ট্যাবস্থা করুক। ছেলের আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গেও আমার কথা বলা দরকার। মামুনকে বললে ও কি তার বাবাকে নিয়ে আসতে পারবে না?
মামুন না বাবা মারুফ।
ও সরি। মারুফ। ওকে বল ও যেন ইমিডিয়েটলি ওর বাবাকে খবর দিয়ে নিয়ে আসে।
ওকে বলতে পারব না বাবা। ও এখন দেশের বাড়িতে গেছে আত্মীয় স্বজন সবার কাছ থেকে বিদায় নিবে।
আসবে কবে?
তাওতো বলতে পারছি না। দু তিন দিন নিশ্চয়ই লাগবে।
জাফর সাহেব উৎসাহের সঙ্গে বললেন–নো প্রবলেম তুই চিঠি লিখে দে। নুরুজ্জামান গাধাটা চিঠি নিয়ে ওর বাড়িতে চলে যাক। ওতে বসেই আছে।
ওর বাড়ির ঠিকানা জানি না বাবা।
তাহলেতো প্রবলেম হয়ে গেল।
কোন প্রবলেম নেই। তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাও।
কাল কি আমরা সিলেট যাচ্ছি?
হ্যাঁ যাচ্ছি।
সকালের ট্রেনে চলে যেতে পারলে হত। তোর মার সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে আলাপ করা দরকার। এখন কি টেলিফোনে কথা বলব?
এখন টেলিফোনে কথা বলার দরকার নেই। অনেক রাত হয়ে গেছে। এত রাতে টেলিফোন করলে মা রাগ করবে। তাছাড়া আমরা হঠাৎ উপস্থিত হয়ে মাকে তো সারপ্রাইজ দেবই। আগে ভাগে কথা বলে সেই সারপ্রাইজ নষ্ট করা ঠিক না। বাবা তুমি শুয়ে পড়।
জাফর সাহেব শুয়ে পড়লেন। তিথি রান্নাঘরে ঢুকে চা বানাল। তার ক্লান্তি হঠাৎ করে কেটে গেছে। এখন কিছুক্ষণ বারান্দায় বসে থেকে চা খাওয়া যায়। আজ আকাশে চাদের অবস্থাটা কি কে জানে?
চা-টা চমৎকার হয়েছে। কাপ শেষ হবার পর মনে হল–বিরাট মগভর্তি এক মগ চা বানালে ভাল হত। অনেকক্ষণ ধরে খাওয়া যেত। টেলিফোন বাজছে। এত রাতে কে টেলিফোন করবে? আজে বাজে কল না তো? ইদানিং গভীর রাতে দুষ্ট প্রকৃতির কিছু লোকজন টেলিফোন করে বিরক্ত করে।
তিথি ভয়ে ভয়ে বললো, হ্যালো।
ও পাশ থেকে মারুফ বলল, তিথি জেগে আছ?
সেকি তুমি দেশে যাও নি?
না।
কেন?
যাবার জন্যে ব্যাগ গুছিয়ে ঘর থেকে বের হয়েই দেখি–পিতাজী। রিকশা থেকে নামছেন?
কে নামছেন।
আমার বাবা।
ও আচ্ছা। উনি কি এখন ঢাকায়?
হ্যাঁ ঢাকায়।
কোথায়? তোমার এখানে?
হ্যাঁ আমার এখানেই।
ক দিন থাকবেন বলতো?
কয়েকদিন নিশ্চয়ই থাকবেন। কেন বলতো?
তিথি আনন্দিত ভঙ্গিতে বলল, আমি বাবাকে সব কথা বললাম। বাবা উনার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছেন। ভালই হয়েছে উনি এখন ঢাকায়। তুমি কি কাল ভোরে। তাকে আমাদের এখানে নিয়ে আসবে? আমরা এক সঙ্গে সকালে নাশতা খাব।
মারুফ চিন্তায় পড়ে গেল। বাবাকে নিয়ে হঠাৎ এই সমস্যা হবে সে বুঝতে পারে নি। একটা মিথ্যা ঢাকতে এখন পরপর অনেকগুলি মিথ্যা বলতে হবে। প্রতিটি মিথ্যাই খুব গুছিয়ে বলতে হবে। যেন যুক্তিতে কোন খুঁত না থাকে।
হ্যালো কথা বলছ না কেন? নিয়ে আসতে পারবে সকালে?
পারারতো কথা। তবে আমি নিশ্চিত না।
নিশ্চিত না কেন?
বাবা এসেই অকারণে আমার সঙ্গে ঝগড়া করলেন। নিতান্ত ফালতু বিষয় নিয়ে হৈ চৈ। রাগারাগি। আমি নাকি ছমাস ধরে তার চিঠির কোন জবাব দিচ্ছি না। শেষ পর্যন্ত চিন্তিত হয়ে তাকে চলে আসতে হয়েছে।
চিন্তিত হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। তুমি হু মাস চিঠি দেবে না আর উনি চিন্তিত হতে পারবেন না?
অবশ্যই চিন্তিত হতে পারবেন তবে তার মানে এই না যে তিনি রিকশাওয়ালার সামনে আমাকে গাধা বলবেন।
তিথি হাসতে হাসতে বলল, উনার স্বভাবও দেখি আমার বাবার মত। আমার বাবাও রেগে গেলে এমন গালাগালি করেন। তবে তার রাগ অবশ্যি বেশিক্ষণ থাকে না। বাবার রাগ ভাদ্র মাসের বৃষ্টির মত ক্ষণ স্থায়ী।
আমার বাবারটা স্থায়ী। আমার উপর রাগ করেই রাতে ভাতটাত না খেয়ে ঘুমুতে গেছেন। ঘুম আসছে না। পেটে প্রচণ্ড ক্ষিধে ঘুম আসার কথা না। এপাশ ওপাশ করছেন। তিনি তাঁর ব্যাগ গুছিয়ে মাথার কাছে রেখে দিয়েছেন। এটা হচ্ছে বিশেষ এক লক্ষণ–বাবা ফজরের নামাজ পড়েই বাসা ছেড়ে চলে যাবেন।
বল কি?
আমি প্রাণপন চেষ্টা করব উনাকে আটকে রাখতে। যদি পারি তাহলে অবশ্যই সকাল আটটার মধ্যে তোমাদের বাসায় এনে উপস্থিত করব। যদি না পারি তাহলে আমি নিজেই আসব। তাতে কাজ হবে?
হ্যাঁ হবে।
তোমাকে যে জন্যে টেলিফোন করেছিলাম সেটাইতো বলা হয় নি।
কি জন্যে টেলিফোন করেছ?
চার লাইনের কবিতা শুনাতে চেয়েছিলাম—
শোনাও।
থাক এখন না। কাল সকালে যখন আসব তখন শোনাব।
না এক্ষণী শুনাও।
নিঝুম রাতের জ্যেৎত্মা এসে স্মৃতির ভাড়ার লোটে
ফাগুন হাওয়ায় সিদকাঠিটা বুকের মধ্যে ফোটে
হৃদয় ফেটে কাব্য ঝরে ব্যথার শোনিত পারা
রূপকথা নয়, রূপকথা নয়, এই জীবনের ধারা।