নীলু বলল সে রাতে খাবে না।
কোন খাবি না রে?
বললাম না। জ্বর।
রমজান ভাই কাউকে না খাইয়ে ছাড়ে না। সে ক্রমাগত ঘ্যানঘ্যান করতে লাগল, রাইতে ভাত না খাইলে এক চড়ুইয়ের রক্ত পানি হয়।
নীলু শব্দ করল না। তার ঘরের দরজাও খুলল না। সেতারার মনে ক্ষীণ আশা ছিল হয়তো শেষপর্যন্ত নীলু। তাকে ডেকে নেবে। সে সব কিছুই হল না। রাত নটা বাজতেই নীলু। তার ঘরের বাতি নিভিয়ে দিল।
খুব বৃষ্টি হল সে রাতে–ঝমঝম করে বৃষ্টি। আকবরের মা বলল, আশ্বিন মাসে বিষ্টি, লক্ষণ খুব বালা।
আমি অনেক রাত পর্যন্ত বাবার জন্যে অপেক্ষ করতে লাগলাম। বাবাকে কী সব খুলে বলা উচিত? বাবা খুব দেরি করতে লাগলেন। ঝড়বৃষ্টিতে এদিকে সব ভাসিয়ে নিচ্ছে।
বাবা ফিরলেন গভীর রাতে। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। রমজান ভাই আমাকে ডেকে তুলে ফিসফিস করে বলল, ছোট আফা, লক্ষণ বেশি বালা না।
কেন কী হয়েছে?
মদ খাইয়া আইছে।
সমস্ত রাত আমার ঘুম হল না।
সেতারা এক কাণ্ড করেছে। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেছে। দুটি পত্রিকার (দৈনিক বাংলা, অবজার্ভার) প্রথম পাতায় তার ছবি ছাপা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হাত থেকে শিশুসংগীত সম্মেলনের গ শাখায় স্বর্ণপদক নিচ্ছে।
অথচ বাবা সেতারাকে ঢাকায় যেতেই দিতে চাননি। গানের স্যারের কত ধরাধরি কত সুপারিশ। বাবার এক কথা, না, এইসবের দরকার নেই।
শেষপর্যন্ত নজমুল চাচা যখন সঙ্গে যেতে রাজি হলেন তখনই শুধু গম্ভীর মুখে বাবা রাজি হলেন।
ঢাকায় গিয়ে সে যে এই কাণ্ড করেছে তাও আমরা জানি না। রমজান ভাই পত্রিকা পড়ে। প্রথম জানল এবং এমন চোঁচামেচি শুরু করল–।
সেতারা যে ভেতরে ভেতরে এমন ওস্তাদ হয়ে উঠেছে তা আমরা বুঝতেই পারিনি। সকাল বেলা ঘুম ভেঙেই অবশ্যি শুনতাম—
কোয়েলিয়া বলেরে মাই
অঙ্গনা মোরে বারে বারে
পিয়া পরদেশ গাওন কিন্নু
সদরঙ্গ পিয়ারাবা তোমাবিনা নয়নানা দরশন বারে বারে।
একই জিনিস সকালে একবার বিকেলে একবার। মাথা ধরে যাওয়ার মত অবস্থা। বাবা পর্যন্ত গানের স্যারকে একদিন বললেন, ছয় সাত মাস ধরে একই জিনিস গাচ্ছে শুনতে খুবই বিরক্ত লাগে।
গানের স্যার একগাল হেসে বললেন, সময় হলে দেখবেন। হা হা হা। সময় হোক না।
ফিরে আসবার পর সেতারার একটা সংবর্ধনাও হল। আমি সেতারাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলাম। বাবা কোথাও যানটান না। নীলুও যাবে না।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ঐ ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তিনি হাসিমুখে এগিয়ে এলেন, আরে নীলু, এই মেয়ে তোমার বোন? তুমি তো বলনি তোমার এমন গুণী বোন আছে। আস তুমি, তোমার সঙ্গে কথা আছে।
একবার ভাবলাম বলি, আমি বিলু। কিন্তু কিছুই বললাম না।
আমি দিন দশোকের মধ্যে চলে যাব। ইউনিভার্সিটি খুলে যাচ্ছে।
ও।
পরশুদিন আসতে বলেছিলাম আসিনি তো?
আমি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম।
আমি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলাম। একবার ভাবলাম যাই তোমাদের বাসায়।
আমি বিলু। নীলু আসেনি।
ভদ্রলোক চশমা খুলে কাঁচ পরিষ্কার করতে লাগলেন।
এত পরে বলছ কেন? প্রথমে বললেই হত।
ভদ্রলোক রাগী চোখে তাকালেন। আমার দিকে। আমি এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে। একবার পেছন ফিরে দেখলাম তিনি কেমন যেন খড়গ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমার কেন জানি খুব কষ্ট হতে লাগল।
আমাকে কেউ তেমন পছন্দ করে না। কেন করে না। আমি জানি না। নীলু অন্য ঘরে চলে যাবার পর সেতারাও চলে গিয়েছে তার সঙ্গে। আকবরের মা আগে আমার ঘরের সামনে পাটি পেতে ঘুমাত, এখন ঘুমোচ্ছে ওদের ঘরের সামনে। নজমুল চাচা সব ঈদে আমাদের উপহার দেন। আমি লক্ষ্য করেছি নীলুর উপহারটা হয় অনেক সুন্দর অনেক দামি।
ক্লাসের মেয়েরাও আমাকে পছন্দ করে না। টগরেব বোনের বিয়েতে টগর ক্লাসের পাঁচটি মেয়ে ছাড়া সবাইকে দাওয়াত করল। আমি ঐ চার-পাঁচজন মেয়েদের মধ্যে একজন। সবাই এরকম করে কেন আমার সঙ্গে?
নীলু ইদানীং আমার সঙ্গে কথা বলা ছেড়েই দিয়েছে। নিজের থেকে কিছু জিজ্ঞেস কবলে তবেই জবাব। সেদিন দেখলাম খুব সাজগোজ করছে। আমি বললাম, কোথায় যাচ্ছিস রে?
যাচিছ এক জায়গায়।
কোথায়? কোনো বন্ধু?
নীলু চুপ করে রইল।
ঐ ভদ্রলোকের কাছে যাচ্ছিস বুঝি?
গেলে কী হয়?
প্রায়ই যাস নাকি?
মাঝে মাঝে যাই।
এরকম যাওয়া ঠিক না। লোকজন খারাপ বলবে।
খারাপ বললে বলুক না। আমি কী পায়ে ধরে সোধছি–আমাকে খারাপ না বলার জন্যে।
আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম, ঐ ভদ্রলোকের নাম কী?
রকিব ভাই, অংক পড়ায়। খুব শিগগির আমেরিকা চলে যাবে।
উনিই বলেছেন বুঝি?
মুন্নি বলেছে। উনি মুন্নির খালাতো ভাই হন।
কোন মুন্নি? কালো মুন্নি?
হুঁ।
নীলু কপালে একটা টিপ পরে অনেকক্ষণ আয়নার দিকে তাকিয়ে আবার টিপটি তুলে ফেলল। হালকা গলায় বলল, মুন্নির ধারণা রকিব ভাই ওকে বিয়ে করবে।
করবে নাকি?
কী জানি করতেও পারে। আমার কিছু যায় আসে না। করতে চাইলে করবে।
যায় আসে না, তাহলে যাস কেন?
নীলু থেমে থেমে বলল, আমি ওদের বাড়ি গেলেই মুন্নি রাগ করে। দারুণ রাগ করে। কিন্তু কিছু বলতে পারে না। আমার খুব মজা লাগে। সেই জন্যে যাই।
ছিঃ, নীলু। এইসব কী?
শুধু মুনি না। ওর মাও রাগ করেন। সেদিন কি বলছিলেন শুনবি?
কি বলছিলেন?
বলছিলেন, মুন্নির সঙ্গে রকিব ভাইয়ের বিয়ের কথা সব পাকাপাকি হয়ে আছে, শ্রাবণ মাসে। বিয়ে? ডাহা মিথ্যা। কোনো কথাই হয়নি।
তুই জানালি কী করে কোনো কথা হয়নি?
আমি জিজ্ঞেস করলাম।
কাকে জিজ্ঞেস করলি?
রকিব ভাইকে। আবার কাকে?
খুব খারাপ হচ্ছে নীলু।
খারাপ হলে আমার হচ্ছে, তোর তো হচ্ছে না। তুই আমার সঙ্গে বকবক করিস না। যা ভাগ।
নীলু আজকাল স্কুলেও নিয়মিত যাচ্ছে না। সকালবেলা স্কুলে যাবার জন্যে তৈরি টৈরি হয়ে হঠাৎ বলবে, আজকে আর যাব না। পেট ব্যথা করছে।
সেদিন সেলিনা আপা (আমাদের হেড মিসট্রেস) আমাকে তার ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন। রাগী গলায় বললেন, তুমি কী গত শুক্রবার কালোমত রোগা একটা ছেলের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছিলে? বিউটি লন্ড্রির সামনে?
কই না তো আপা।
আমিও তাই ভাবছিলাম। ঐটা নীলু। আজেবাজে ছেলের সঙ্গে আজকাল খুব মিশছে মনে হয়। তোমার বাবাকে বলবে। ঐ সব লোফার টাইপের ছেলে। পানের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট খায়, মেয়ে দেখলে শিস দেয়। বলবে তুমি তোমার বাবাকে।
জি বলব।
ঠিক আছে তোমার বলার দরকার নেই। তাকে বলবে। আমার সঙ্গে দেখা করতে।
জি আচ্ছা।
তাছাড়া ও তো রেগুলার ক্লাসেও আসে না। বাড়িতে শাসন না থাকলে যা হয়।
নীলু। এসব শুনে গা দুলিয়ে হাসতে লাগল, দূর ঐ ছেলের সঙ্গে আমি ঘষাঘষি করব কেন? আমাকে জিজ্ঞেস করল কটা বাজে। আমি বললাম। তারপর আমি বললাম।–আপনার হাতে তো ঘড়ি আছে আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন? সে ব্যাটা একদম ঘাবড়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল আমার ঘড়ি নষ্ট। আমি বললাম— মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে খুব ভাল লাগে, না? ছেলেটার যে কী অবস্থা। দূর থেকে অন্য বন্ধুগুলি তাকে দেখছে। হি-হি-হি। ঐ পাঁজিগুলি আগে আমাকে দেখলেই শিস দিত। এখন আর দেয় না।
আর কথা হয়নি। ঐ ছেলের সাথে?
আর কথা হবে কেন?
সেলিনা আপা বাবার সঙ্গে কথা বলবেন।
বলুক।
বাবা খুব রাগ করবেন।
করলে করবে।
বাবা সত্যি সত্যি রাগ করলেন। বেশ রাগ। চিৎকার চেঁচামেচি। শুধু তাই না, এক পর্যায়ে প্রচণ্ড একটা চড় কষিয়ে দিলেন। নজমুল চাচা ছুটে এলেন, ছিঃ ছিঃ এসব কী কাণ্ড! মেয়ে বড় হয়েছে না?
বাবা ঝাঁঝাল স্বরে বললেন, ওর স্কুল এখন বন্ধ। তুমি একটা ছেলে দেখ তো, ওর বিয়ে দিয়ে দেব।
আচ্ছা সেটা দেখা যাবে। বিয়ে দিতে চাইলে বিয়ে দেবে। বিলু, মা, তুমি আমাদের দুকাপ চা দাও তো। লেবু দিয়ে।
নীলু যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে বলল, আমাকেও এক কাপ চা দিস তো।
পরদিন নীলু স্কুলে গেল না। সন্ধ্যাবেলা বাবার সামনেই তার সমস্ত বই-খাতা বারান্দায় জমা করতে লাগল। বাবা ইজিচেয়ারে বসে অবাক হয়ে দেখতে লাগল।
কী করছিস নীলু?
বইপত্রগুলি সব ফেলে দিচ্ছি বাবা। পড়াশোনা তো আর করছি না। বই দিয়ে কী হবে?
পড়াশোনা করবি না আর?
না। তুমি নিষেধ করলে। তাছাড়া আমারও ভাল লাগে না।
কী করবি ঠিক করেছিস?
এখনো কিছু ঠিক করিনি।
বাবা আর কিছু বললেন না। রাতে ভাত খাবার সময় হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবে বললেন, রাগে মাথায় অনেকে অনেক কিছু বলে, সে সব মনের মধ্যে পুষে রাখা ঠিক না।
নীলু মুখ না তুলেই বলল, আমি মনের মধ্যে কিছু পুষে রাখিনি।
আর কোনো কথাবার্তা হল না।
সে রাতে বাবা বাইরে গেলেন না। গম্ভীর হয়ে সেতারার পড়া দেখিয়ে দিতে বসলেন। সেতারা ক্লাস সিক্সে উঠেছে। নতুন ক্লাসে উঠেছে বলেই পড়াশোনায় খুব আগ্রহ। সে হাসিমুখে তার বইপত্র দেখাতে লাগল। বাবা এক সময় আমার পড়াশোনারও খোঁজ নিলেন, পড়াশোনা ঠিকমত হচ্ছে তো?
জি হচ্ছে।
প্রি-টেস্ট কবে?
এখনো দেরি আছে।
কোন কলেজে পড়বি কিছু ভোবিছিস? ঢাকায় যেতে চাস নাকি?
নাহ।
ঢাকা না যাওয়াই ভাল, যা গোলমাল। এই স্ট্রাইক ওই স্ট্রাইক।
তা ঠিক।
নীলু আমাদের কাছেই কি-একটা গল্পের বই নিয়ে উবু হয়ে আছে, যেন কোনো কিছুই তার কানে যাচ্ছে না।
নীলু এত মন দিয়ে কী পড়ছিস?
ভূতের গল্প।
নাম কী?
ডাকবাংলা রহস্য।
খুব ভয়ের নাকি?
খুব না। কিছু ভয়ের।
বাবা হঠাৎ বললেন, তোরা সবাই মিলে মামার বাড়ি থেকে ঘুরে আয় না। একটা চেঞ্জ হবে। সেতারার তো বোধহয় মনেই নেই।
মনে আছে বাবা, পুকুর পাড়ে দুটো তাল গাছ আছে। আর পুকুরের ঘাটে বসে থাকলে এক রকম মাছ আসে। চোখগুলো বড় বড়। ঠিক না নীলু আপা?
হুঁ। চ্যালা মাছ।
বাবা আবার বললেন, কী রে যাবি তোরা? যাস যদি তোর মামাকে লিখি। এসে নিয়ে যাবে।
তুমি যাবে না?
নাহ। আমার ব্যবসাট্যবসা খুব খারাপ। তোরা তো জানিস না। অবশ্যি আমি নিজেই বলি না। কিছু। প্রেসটা আমি খুব সম্ভব বিক্রি করে দেব। বয়স হয়ে গেছে, এইসব ঝামেলা এখন আর ভাল লাগে না।
নীলু বাবার কথা শুনল, কিন্তু কিছু বলল না।
যাবি মামার বাড়ি?
যাওয়া যায়।
আচ্ছা ঠিক আছে, লিখে দেব তোর মামাকে। পৌষ মাসের দিকে গেলে ধান কাটা দেখবি।
সে রাতে ঘুমাতে গেলাম দশটার দিকে। সেতারা তার বালিশ নিয়ে এসে হাজির। আপা, আজ তোমার সঙ্গে ঘুমাব।
আয়। হঠাৎ আমার সঙ্গে যে।
নীলু আপা বলেছে আজ সে একা একা ঘুমোতে চায়।
বাতি নেভাতে সেতারা ফিসফিস করে বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করি আপা, রাগ করবে না তো?
না রাগ করব কেন?
আগে গা ছুঁয়ে বল রাগ করবে না।
রাগ করব না, বল।
সেতারা বেশ খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, মেয়েদের যখন শরীর খারাপ থাকে তখন কোনো ছেলেকে চুমু খেলে নাকি পেটে বাচ্চা হয়?
বলেছে কে এসব?
বলছে কে এসব?
না হয় না। এই সব জিনিস নিয়ে না ভাবাই ভাল।
তাহলে বাচ্চা কিভাবে হয়?
জানি না কিভাবে হয়, ঘুমা তো।
সেতারা ঘুমিয়ে পড়ল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। সেতারাও অনেকটা আমার মত, এ বাড়িতে তার কথা বলার কেউ নেই। স্কুলে তেমন বন্ধুবান্ধব নেই। সেদিন দেখলাম টিফিনের সময় ওদের ক্লাসের সব মেয়ে মিলে চুলটান। বিবিয়ানা সাহেববাবুর বৈঠকখানা খেলা খেলছে। সেতারা দূরে দাঁড়িয়ে তৃষিত নয়নে দেখছে।
আমি সেতারার গায়ে হাত রাখতেই সেতারা বলল, মাকে কাল রাতে আমি স্বপ্নে দেখেছি আপা। খুব লম্বা লম্বা চুল।
আমি অবাক হয়ে বললাম, তুই ঘুমাসনি?
উঁহু।
আয় দুজনে মিলে এক কাজ করি, নীলুকে ভয় দেখিয়ে আসি।
সেতারা উত্তেজনায় উঠে বসল। কিভাবে ভয় দেখাবে? জানালার কাছে গিয়ে ‘হুঁম’ করবে?
তা করা যায়। যাবি?
চল।
আমরা দরজা খুলে পা টিপে টিপে বাইরে এসে দেখি বাবা ইজিচেয়ারে শুয়ে আছেন। তার পাশের মোড়ায় গুটিশুটি মেরে নীলু বসে আছে। বাবা নীলুর মাথায় হাত বুলাচ্ছেন। নীলু। সম্ভবত কাদছে। বাবা আমাদের দেখে হালকা গলায় বললেন, কিরে সেতারা–বাথরুমে যাবি নাকি?
না বাবা, আমরা নীলু আপাকে ভয় দেখাবার জন্যে এসেছি।
বাবা হেসে উঠেলেন। দীর্ঘদিন পর বাবা এমন উঁচু গলায় হাসলেন।
নীলু, চোখ মুছে বলল, আমাকে ভয় দেখানো এত সস্তা না!
আমাদের বাড়িটির একটি নাম আছে ‘উত্তর দীঘি’। বাড়ির কত সুন্দর সুন্দর নাম থাকে। কিন্তু এ বাড়িটি দেখতে যেমন অদ্ভুত, নামটিও তেমনি। মায়ের খুব সখ ছিল শ্বেত পাথরের একটা নতুন নেম প্লেট লাগাবেন, মাধবী ভিলা লেখা থাকবে সেখানে।
বাড়িটি কিনেছিলেন আমার দাদা। তিনি ধুরন্ধর প্রকৃতির লোক ছিলেন। দাঙ্গার সময় যখন ময়মনসিংহ শহরের বেশির ভাগ ধনী হিন্দু জলের দামে বাড়ি বিক্রি করে কলকাতায় চলে গেল, আমার দাদা। তখন উত্তর দীঘি ও শ্ৰীকালী প্রেস কিনে ফেললেন। টাকা যা দেয়ার কথা তার অর্ধেকও নাকি দেননি। এই সব আমার মায়ের কাছ থেকে শোনা। মা নাকি বিয়ের পর অনেকদিন দেখছেন বাড়ির মালিক বাকি টাকার জন্যে এসে বসে আছে এবং দাদা নানান রকম টালবাহানা করছেন। তার কিছু দিন পর দাদা মারা যান। আমার ধারণা লোকটিকে টাকা-পয়সা না দেয়ার জন্যেই নিদারুণ যন্ত্রণায় দাদার মৃত্যু হয়েছে। তাঁর পেটে ক্যান্সার হয়েছিল।
আমাদের উত্তর দীঘি বাড়িটি প্রকাণ্ড। দোতলা বাড়ি। তবে ছাদে ওঠার কোনো সিঁড়ি নেই। মার খুব সখ ছিল ছাদে ওঠার সিঁড়ি করবেন। জোছনা রাতে ছাদে হাঁটাহাঁটি করা যাবে। হাঁটাহাটি করার জায়গার অভাব এ বাড়িতে নেই। অনেকখানি জায়গা জুড়ে বাড়ি। কাঁঠাল পেয়ারা আম এবং তেঁতুল গাছ দিয়ে বাড়িটা ঘেরা। বাড়ির সামনে ফুলের গাছ আছে বেশ কয়েকটা এবং জায়গায় জায়গায় সিমেন্ট দিয়ে উঁচু বেদীর মত করে বাধানো। সেখানে বসে খুব আরাম করে গল্পের বই পড়া যায়। আমার যখন কিছু ভাল লাগে না তখন আমি লাল বেদীগুলোর কোনো-একটিতে বসে থাকি। নীলুর মতে ওগুলো আমার গোসাঘর।
আজ আমার মন খুব ভাল ছিল। মন ভাল হওয়ার কোনো কারণ ঘটেনি। কিন্তু ভালো লাগছিল। তবু আমি গোসাঘরে এসে চুপচাপ বসে রইলাম। সেতারা দোতলার বারান্দায় বসে গলা সাধছিল। বেশ লাগছিল শুনতে। এমন সময় একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল। নীলুর সেই রকিব ভাই হঠাৎ করেই যেন আমার সামনে এসে উপস্থিত হলেন। এখানে আসতে হলে গেট খুলে অনেকখানি হাঁটতে হয়। কখন গেট খুললেন এবং কখনই-বা এলেন।
ভাল আছ?
আপনি ভাল আছেন?
আমি অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছিলাম, তুমি পাথরের মূর্তির মত বসে আছ। তোমার বাবা বাসায় আছেন?
জি না। সন্ধ্যা নাগাদ আসবেন।
আমি তার সঙ্গে দেখা করব আজকে, কী বল?
ঠিক আছে।
আমি পরশুদিন সকালে ঢাকা চলে যাব। ভাবলাম যাবার আগে দেখা করে যাই। আর আসা হবে কিনা জানি না।
আর আসবেন না বুঝি?
ভদ্রলোক গম্ভীর হয়ে বললেন, তুমি কী আসতে বল?
আমি চুপ করে রইলাম।
কি, কথা বলছি না যে?
আমি কিন্তু বিলু, আপনি আমাকে নীলু ভাবছিলেন।
ভদ্রলোক চশমা খুলে কাঁচ পরিষ্কার করতে লাগলেন।
নীলু কি বাসায় আছে?
জি আছে। আপনি ভেতরে এসে বসুন, আমি ডেকে দিচ্ছি।
না ঠিক আছে ডাকতে হবে না।
ডাকতে হবে না কেন? আপনি তো ওর সঙ্গেই কথা বলতে এসেছেন?
ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন।
ঠিক তা না। আমি নদীর ধার দিয়ে অনেকখানি হাঁটি। আজও তাই করছিলাম। হঠাৎ তোমাকে দেখলাম। ভাবলাম নীলু।
ও।
নীলু অনেকদিন মুন্নিদের বাড়িতে যায় না। মনে হয় ওর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে। তুমি জানো কিছু?
জি না। ওর সঙ্গে আমার কথা বন্ধ।
ভদ্রলোক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, তোমরা যে বাচ্চা মেয়ে এটাও মনে থাকে না।
আমি বুঝি বাচ্চা মেয়ে?
হুঁ! তোমরা আড়ি দাও এবং ভাব দাও। ঠিক না?
আমি দেই না, নীলু দিতে পারে। আসুন, ভেতরে এসে বসুন। নজমুল চাচা আছেন, দোতলায় তার ঘরে ও বসতে পারেন।
নজমুল চাচা কে?
আমাদের একজন ভাড়াটে দোতলায় একটা ঘর নিয়ে থাকেন।
নীলু শোন, আমি এখন আর ঘরে ঢুকব না।
আমি কিন্তু বিলু।
ও হ্যাঁ বিলু। তুমি এক কাজ কর, আমি নীলুব জন্যে একটা গল্পের বই এনেছিলাম, ‘ঘনাদার গল্প’ ওটা ওকে দিয়ে দিও।
আমি অল্প হাসলাম। ভদ্রলোক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন, হাসছ কেন?
আপনি একটু আগে বলেছিলেন নীলুর সঙ্গে দেখা করবার জন্যে আসেননি, এখন বলছেন বই নিয়ে এসেছেন তাই হাসছি।
ঠিক তখন দোতলার বারান্দা থেকে নজমুল চাচা ডাকলেন, এই–এই বিলু উনি কে?
নজমুল চাচার গলা ভয় ধরানো, যেন হঠাৎ ভূত দেখেছেন। অনেকক্ষণ থেকেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন হয়ত।
পরিচয় করিয়ে দেবার পর নজমুল চাচা অতিরিক্ত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
আরে আপনি জমির আহমেদ সাহেবের ছেলে? আপনাকে চিনিব না বলেন কি? আপনার বাবা ছিলেন কালিনারায়ণ স্কলার।
আমি বাবার মত হইনি অবশ্যি।
আরে আপনিই কম কি। অংকের প্রফেসর! কি সর্বনাশ।
প্রফেসর না। লেকচারার
আমার কাছে লেকচারারও যা প্রেফেসরও তা। কী আশ্চৰ্য কাণ্ড বলেন দেখি! নীলুর সঙ্গে আলাপ হল কিভাবে?
ও আমাকে একটা অংক জিজ্ঞেস করেছিল, আমি করতে পারিনি।
বলেন কি! কী অংক?
ও জিজ্ঞেস করল–পাঁচের সঙ্গে দুই যোগ করলে কখন ছয় হয়?
কখন হয়?
যখন ভুল হয় তখন হয়। অংকটা আসলে সহজ।
নজমুল চাচা ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন। আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, যা নীলুকে আসতে বল। বলবি প্রফেসর সাহেব এসেছেন। চা-টার ব্যবস্থা করতে হবে।
আমি ঘর থেকে বেরোবার সময় শুনলাম ভদ্রলোক বলছেন, আপনি কি বুঝতে পারেন কে বিলু কে নীলু?
পারি। নীলুটা খুব হাত নেড়ে কথা বলে।
রকিব সাহেব দোতলায় বসে আছেন শুনে নীলু দারুণ অবাক হল। সে কি, আমি তো বলেছি এ বাড়িতে যেন কখনো না আসেন।
কি জন্যে বলেছিস?
দূর ভাল্লাগে না।
ভাল্লাগে না কেন?
এমনভাবে কথা বলে যেন আমি বাচ্চা মেয়ে।
যাবি না তাহলে?
উঁহু।
নীলু যদিও বলল উঁহু, কিন্তু আমি দেখলাম সে কামিজ বদলে শাড়ি পরছে।
শাড়ি পরছিস কেন?
ইচ্ছা হয়েছে পরছি। তোকে জিজ্ঞেস করে কাপড় পরতে হবে?
নীলু অনেক সময় নিয়ে মুখে পাউডার দিল। এবং এক সময় চিরুনী হাতে এসে বলল, চুল বেঁধে দিবি?
আমি চুল বেঁধে দিয়ে বললাম, আজ আর তোকে কেউ বাচ্চা মেয়ে বলবে না।
নীলু রাগী স্বরে বলল, তুই কি ভাবছিস আমি তোতলায় যাচ্ছি? মোটেই না, আমি বাগানে হাঁটতে যাচ্ছি। সেতারার গলা সাধা শেষ হলেই যাব।
আমি দেখলাম নীলু। সত্যি সত্যি সেতারাকে নিয়ে বাগানে বেড়াচ্ছে। অপূর্ব লাগছে তাকে। আমার মনে হল এমন রূপবতী মেয়ে আমি আর কখনো দেখেনি।
বড় মামার চিঠি এসেছে।
সুদীর্ঘ চিঠি। যার বক্তব্য হচ্ছে–এ সময় গ্রামের বাড়িতে নীলু-বিলুদের বেড়াতে আসা ঠিক হবে না। কি কারণে ঠিক হবে না তা স্পষ্ট করে বলা নেই। শুধু লেখা–গাঁয়ের লোকজন এদের
দেখতে এসে নানান কথা বলবে, এটা ওদের ভাল লাগবে না। মনের ওপর চাপ পড়বে। এইসব। আমার কাছে একটা ব্যাপার খুব অবাক লাগল। চিঠির শেষে পুনশ্চতে লেখা–যা হবার হইয়াছে, এখন দুলাভাই আপনি যদি হৃদয়ের মহত্ত্ব দেখাইয়া সব ভুলিয়া যান তাহা হইলে বড়ই আনন্দের বিষয় হয়। ভুল মানুষ মাত্রই করে। ইহাই মানব ধর্ম।
এর মানে কি? নতুন করে এইসব কথা তোলা হচ্ছে কেন?
নীলুকে জিজ্ঞেস করতেই সে হেসে বলল, বুঝতে পারছিস না? মা এখন মামার বাড়িতে।
তার মানে?
মানেটানে জানি না। মা এখন মামার ঘাড়ে চেপে বসে আছে। মামা ঘাড় থেকে নামাতে চাইছে।
বুঝলি কি করে?
এখানে না বোঝারী কিছু আছে নাকি?
নীলু। তরল গলায় হাসল।
শেষ পর্যন্ত দেখবি বাবা বলবেন, ঠিক আছে চলে আসুক। আর মা তার ছেলে কোলে নিয়ে এ বাড়িতে উঠে আসবেন। খুব কান্নাকাটি হবে কিছুদিন। তারপর সব ঠিকঠাক। মাঝখান থেকে আমরা একটা ভাই পেয়ে যাব।
তোর কথার কোনো ঠিকাঠিকানা নেই নীলু।
না থাকলে কি আর করা। তবে এ রকম হলে মন্দ হয় না। কি বলিস? বাড়ির অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যাচেছ। যাচ্ছে না?
হুঁ।
বাবা যে হারে মদ-টদ খাচ্ছে। একেবারে দেবদাসের মতো–
নীলু। হেসে উঠল।
এর মধ্যে হাসির কি আছে?
কান্নারও কিছু নেই।
নীলু গম্ভীর মুখে বই নিয়ে পড়তে বসল। ইদানীং তার পড়াশোনায় খুব মনোযোগ হয়েছে। এই নিয়ে কিছু বললে সে গম্ভীর হয়ে বলে, তোরা সব স্টার-ফার পেয়ে পাস করবি আর আমি বুঝি ফেল করব? সেটা হচ্ছে না।
এখন আমাদের স্কুলটুল নেই। পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে জোরেসোরে। সপ্তাহে তিনদিন কোচিং ক্লাস হয়। সেখানে মেয়েরা সবাই ভান করে যে কিছু পড়াশোনা হচ্ছে না। কে কোন কলেজে পড়বে। সে নিয়েও ক্ষীণ আলোচনা হয়। হলিক্রস কলেজ ভাল না। ইডেন ভাল সব মেয়েরাই সেটা জানে।
এমন সিরিয়াস পড়াশোনার সময়টাতেও আমাদের ক্লাসের রুবিনার বিয়ে হয়ে গেল। সেলিনা আপা খুব রাগ করলেন–বাবা-মাদের কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই নাকি? সেলিনা আপা খুব কাটা কাটা কথা বলে অপমান করলেন রুবিনার বাবাকে। ঝাঁঝাল গলায় বললেন, আপনাদের মত শিক্ষিত মূর্থের জন্যে দেশের এমন খারাপ অবস্থা।
রুবিনা খুবই কান্নাকাটি করতে লাগল। গায়ে হলুদের দিন দেখি কেঁদে মুখটুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। রুবিনার এক মোটাসোটা খালা পানিভর্তি মুখ নিয়ে বলে বেড়াচ্ছেন, মেট্রিক ক্লাসটা হচ্ছে মেয়েদের বিয়ের বয়স। এরপর আর রসকষ থাকে না। নীলুটা ফস করে বলে বসল, কেন, তখন রস কি হয়?
রুবিনার খালা চোখ বড় বড় করে বললেন, এই ফাজিল মেয়েটা কে?
নীলু হাসিমুখে বলল, ফাজিল বলছেন কেন?
খুব হাসোহাসি শুরু হয়ে গেল চারদিকে। রুবিনার খালা রেগেমেগে অস্থির। কয়েকবার বললেন, আজিকালিকার মেয়েগুলি এমন কেন?
অনেকদিন পর রুবিনার গায়ে হলুদ উপলক্ষে আমরা খুব হৈচৈ করলাম। বিয়েটিয়ে এই জাতীয় অনুষ্ঠান আমার ভাল লাগে না। গাদাগাদি ভিড়। মেয়েদের লোক দেখান আহাদীপনা। খাবার টেবিলে তাড়াহুড়ো করে বসতে গিয়ে শাড়িতে রেজালার ঝোল ফেলে দেয়া। অসহ্য! কিন্তু রুবিনার গায়ে হলুদ আমার কেন যে এত ভাল লাগল। বরের বাড়ি থেকে এলা নামের একটি মেয়ে এসেছিল, সে ঢাকায় ও লেভেলে পড়ে। ওর সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল। জন্মের বন্ধুত্ব। এর আগে আর কোনো মেয়ের সঙ্গে এত বন্ধুত্ব হয়নি। আমরা দু’জন এক ফাঁকে ছাদে চলে গেলাম। মেয়েটি নানান কথা বলতে লাগল। একটি ছেলের সঙ্গে তার ভাব হয়েছে। ছেলেটি মেডিক্যালে পড়ে। এক বিয়ে বাড়িতে আলাপ হয়েছিল। খুব নাকি লাজুক ছেলে। আর দারুণ ভদ্র। এলা নিচু স্বরে বলল, জানো ভাই, ও একবার যা অসভ্য কথা লিখেছিল আমাকে। আমি খুব রাগ করলাম। ওর সঙ্গে দেখা করাই বন্ধ করে দিলাম। টেলিফোন করলে টেলিফোন নামিয়ে রাখতাম। শেষে কি করল সে জান?
কি করল?
বলল সে বিষ খাবে। আমি তো জানি তাকে। খাবে বলেছে। যখন তখন খাবেই। ছেলেরা দারুণ সেন্টিমেন্টাল হয় ভাই।
তখন তুমি কি করলে?
কি আর করব, দেখা করলাম।
আমি ইতস্তত করে বললাম, অসভ্য কথাটা কি লিখেছিল?
এলা তরল গলায় হেসে উঠল, দূর তা বলা যায় নাকি? বিয়ের দিন তুমি আসবে তো? ঐ দিন তোমাকে ওর ঐ চিঠিটাই পড়াব। দেখবে ছেলেরা কি রকম অসভ্য হয়।