০৪. নীলা বিছানায় হেলান দিয়ে

নীলা বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে, তার বুক পর্যন্ত একটা সাদা চাঁদর দিয়ে ঢাকা। তার মাথার কাছে কালো টেবিলের উপর একটা কাঁচের ট্রে। সেই ট্রে’র উপরে ক্রিস্টালের গ্লাসে কমলার রস। হাফপ্লেটে রুটির উপর মাখন লাগানো, দুটি আপেল। বিছানায় তার পায়ের কাছে ইশতিয়াক সাহেব বসে আছেন। তিনি একটু এগিয়ে এসে নীলার কপাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে বললেন, “কিছুই তো খেলি না মা!”

“খেতে ইচ্ছে করে না বাবা।”

“ইচ্ছে না করলেও তো খেতে হয়। নাহয় শরীরে জোর পাবি কেমন করে?”

নীলা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমি আর শরীরে জোর পাব না আব্বু। আমি জানি।”

ইশতিয়াক সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “ছি! এভাবে কথা বলে না মা।–”

“কী হয় বললে? এটা তো সত্যি। আমি তো মরে যাব বাবা। আমি জানি, তুমি জান, সবাই জানে।”

“এভাবে কথা বলে না। ছি মা!”

“আমি কবে মারা যাব সেটাও আমি জানি।”

“ছি মা, এভাবে কথা বলে না!”

নীলা হঠাৎ দুই হাত দিয়ে তার বাবার হাত ধরে বলল, “ঠিক আছে আব্বু, বলব না। আর কখনো বলব না।”

কয়েক মুহূর্ত দুজনেই চুপ করে বসে থাকে। ইশতিয়াক সাহেব–মালা গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজের সর্বময় কর্তা, বোর্ড অফ ডিরেক্টরস থেকে শুরু করে দেশ বিদেশের বড় বড় মানুষের সাথে যে-কোন সময় যে-কোন পরিবেশে কথা বলতে পারেন, কিন্তু হঠাৎ করে নিজের বারো বছরের মেয়ের সামনে আর কথা বলার কিছু খুঁজে পেলেন না। নীলা খানিকক্ষণ তার বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “আমার শুধু তোমার জন্যে চিন্তা হয় আব্বু। আমি তো আম্মুর সাথে থাকব। তুমি একা একা কেমন করে থাকবে?”

ইশতিয়াক সাহেবের চোখে হঠাৎ পানি চলে আসতে চায়। অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত রেখে বললেন, “তুই তো আম্মুকে কখনো স্বপ্নে দেখিস মা?”

“রোজ স্বপ্নে দেখি। রোজ।”

“কী দেখিস?”

“আমার সাথে রোজ রাতে কথা বলে আম্মু। আমাকে নিয়ে কোথায় কোথায় যাবে সেইসব বলে। আমার জন্যে আম্মু অপেক্ষা করছে।”

ইশতিয়াক সাহেব একটা নিঃশ্বাস ফেলে কথাটা ঘোরানোর জন্যে বললেন, “তুই কোথাও যেতে চাস মা?”

“না আব্বু, যেতে চাই না।”

“কিছু কিনবি? কোনো বই? ভিডিও-সিডি?”

“না আব্বু। কিছু লাগবে না।”

“কারও সাথে দেখা করবি? কথা বলবি? তোর কোন বন্ধুকে ডাকব?”

“না-না-আব্বু, কাউকে ডেকো না। আমার ভালো লাগে না।”

ইশতিয়াক সাহেব আবার খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “দুপুরবেলা তোর আজমল চাচা আসবে।”

“ঠিক আছে।”

“তোর শরীর কেমন লাগছে তার সবকিছু বলিস আজমল চাচাকে।”

“বলব।”

“অমি একটু অফিসে থেকে ঘুরে আসি, কিছু লাগলেই ফোন করে দিবি।”

“দেব আব্বু।”

ইশতিয়াক সাহেব দরজা খুলে বের হয়ে যাচ্ছিলেন তখন হঠাৎ নীলা বলল, “আব্বু–”

“কী মা?”

“তোমার মনে আছে আমরা একদিন লঞ্চে করে যাচ্ছিলাম?”

“হ্যাঁ মা।”

“একটা মেয়ে–মনে আছে–একটা গাছের উপর থেকে পানিতে ডাইভ দিয়েছিল?”

“হ্যাঁ মা, মনে আছে।”

“মেয়েটা কী সুন্দর ছিল না, আব্বু? কী গ্রেসফুল! কী এনার্জেটিক!”

নীলা আরও কিছু বলবে ভেবে ইশতিয়াক সাহেব চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন, কিন্তু নীলা আরকিছু বলল না। তিনি মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ মা, নিশ্চয়ই সুন্দর ছিল মেয়েটা। আমি তো দেখিনি, কিন্তু তুই তো দেখেছিস। তুই যখন বলছিস নিশ্চয়ই ছিল।”

ইশতিয়াক সাহেব ঘর থেকে বের হয়ে যেতে যেতে কী মনে করে আবার ফিরে এসে বললেন, “তুই মেয়েটার সাথে দেখা করবি মা?”

“আমি? দেখা করব?”

“হ্যাঁ। করবি?”

নীলা হঠাৎ কেমন যেন একটু লজ্জা পেয়ে গেল, বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, “করব? দেখা করে কী বলব তাকে?”

“যেটা ইচ্ছে হয় বলবি!”

“আমাকে দেখে কি হাসবে?”

“কেন? হাসবে কেন?”

“এই যে আমার এত অসুখ। গায়ে জোর নেই।”

“ধুর! সেজন্যে কেউ হাসে নাকি? মানুষের কি অসুখ হয় না? আর ভালো করে একটু খাবি তা হলেই তো জোর হবে।”

“তা হলে তুমি কী বল বাবা? আমরা কি যাব?”

“চল যাই। আমি ফোন করে দিচ্ছি, এখনই রওনা দেব।”

“তোমার অফিস?”

“আরেকদিন যাব অফিসে।”

.

চন্দ্রা নদীর তীরে পলাশপুর গ্রামের বাচ্চাকাচ্চারা হিজল গাছের নিচে লাফ-ঝাঁপ দিচ্ছিল, হঠাৎ তারা দেখতে পেল রাজহাঁসের মতো দেখতে অপূর্ব একটা লঞ্চ প্রায় নিঃশব্দে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। প্রথমে দেখতে পেল সিরাজ, সে অন্যদের দেখতেই সবাই খেলা বন্ধ করে লঞ্চটার দিকে তাকিয়ে রইল। সবাই ভেবেছিল লঞ্চটা কাছাকাছি এসে ঘুরে যাবে, কিন্তু সেটা ঘুরে গেল না, সত্যি সত্যি তাদের দিকে আসতে শুরু করল। লঞ্চের সামনে একজন মানুষ বাঁশ দিয়ে নদীর পানি আন্দাজ করছে। তীরের কাছাকাছি এসে মানুষটা লঞ্চ থেকে নেমে সেটাকে দড়ি দিয়ে একটা গাছের গুঁড়ির সাথে বেঁধে ফেলল, তখন সবাই লক্ষ করল উপরে রেলিঙের কাছে সাহেবদের চেহারার মতো একজন মানুষ এবং তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে একেবারে পুতুলের মতো দেখতে একটা মেয়ে। মানুষটার মাথায় চোখে যেন রোদ না লাগে সেরকম বারান্দাওয়ালা একটা টুপি। মানুষটা ইশতিয়াক সাহেব। তিনি উপর থেকে বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে হাসিহাসি মুখে বললেন, “তোমরা এখানকার?” বাচ্চাদের কারও কথা বলার সাহস হল না। এক-দুইজন ভয়ে মাথা নাড়ল।

ইশতিয়াক সাহেব আবার বললেন, “আমরা এখানে একজনকে খুঁজতে এসেছি। একটা মেয়ে, খুব সাহসী মেয়ে! এই যে গাছটা আছে সেটার একেবারে উপর থেকে নদীতে ডাইভ দিতে পারে।”

সাহেবদের মতো দেখতে ফরসা মানুষটি কার কথা বলছে বুঝতে বাচ্চাদের কারও একটুকু দেরি হল না। তারা প্রায় সমস্বরে চিৎকার করে বলল, “বকুলাপ্পু।”

“কী নাম বললে? ব-ব-”

“বকুলাপ্পু।”

“বকু-লাপ্পু?”

“হ্যাঁ। সিরাজ এবার সাহস করে কথা বলার দায়িত্বটুকু নিয়ে নিল। বলল, “তার নাম হল বকুল। আমরা সবাই বকুল আপু ডাকি।”

“ও!” ইশতিয়াক সাহেব হা হা করে হেসে বললেন, “বকুল আপু থেকে বকুলাপ্পু!”

ব্যাপারটা সাহেবের মতো চেহরার মানুষটাকে বোঝাতে পেরেছে সেই আনন্দে সিরাজ চোখ ছোট ছোট করে হেসে ফেলল। সে শরিফকে টেনে সামনে এনে বলল, “এই যে শরিফ। বকুলাপ্পুর ছোট ভাই।”

“ও! তুমি বকুলাপ্পুর ছোট ভাই!” ইশতিয়াক সাহেব হেসে বললেন, “আমরা তোমার বোনের সাথে দেখা করতে এসেছি।”

শরিফ পাংশুমুখে বলল, “কী করেছে বকুলাপ্পু?”

“কিছু করেনি! আমরা এমনি দেখতে এসেছি। কোথায় আছে বলবে?”

সিরাজ বলল, “ডেকে নিয়ে আসি?”

সিরাজের কথা শেষ হবার আগে শরিফ এবং আরও আট-দশজন বকুলকে ডাকার জন্যে গুলির মতো ছুটে গেল। তাদের গ্রামে এত বড় ব্যাপার এর আগে কবে ঘটেছে কেউ মনে করতে পারে না।

বাড়িতে তখন বকুলকে বকাবকি করা হচ্ছিল। রহমত চাচার পাগলি গাইটি কীভাবে জানি ছুটে গেছে, গ্রামের দুর্ধর্ষ মানুষেরা এই গাইয়ের ধারেকাছে যায় না, বকুল সেটাকে ধরার চেষ্টা করে পিছুপিছু ছুটে গিয়েছিল। গাইটি পথেঘাটে যত অনর্থ করেছে এখন তার সব দোষ এসে পড়েছে বকুলের ঘাড়ে। বকুলকে জন্ম। দিতে গিয়ে মা কেন মরে গেলেন না সেটা চতুর্থবারের মতো বলে মা পঞ্চমবারের মতো বলতে শুরু করেছিলেন তখন ছুটতে ছুটতে শরিফ এবং বাচ্চাকাচ্চার দল এসে হাজির। শরিফ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “বকুলাপ্পু-সাংঘাতিক জিনিস হয়েছে।”

“কী?”

“একটা সাহেবের মতো লোক–ঐ যে সাদা লঞ্চে করে যায় সে তোমাকে খুঁজছে।”

“আমাকে?” বকুল মনে করার চেষ্টা করতে থাকে কীভাবে সে সাদা লঞ্চের মানুষের সাথে একটা গোলমালে জড়িয়ে পড়ল।

বড়চাচি কাছে দাঁড়িয়েছিলেন, এবারে চোখ কপালে তুলে বললেন, “ও মা গো! কী ডাকাতে মেয়ে! লঞ্চওয়ালার সাথে গোলমাল করে এসেছে!”

বকুল তেজি ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “আমি কিছুই করি নাই।”

“তা হলে কেন তোকে ডাকছে?”

“আমি কেমন করে বলব?”

শরিফ এবং অন্যেরা বকুলের হাত ধরে টানতে টানতে বলল, “চলো বকুলাপ্পু। চলো। তাড়াতাড়ি চলো!”

মা এবং বড়চাচি দুশ্চিন্তায় মুখ কালো করে বসে রইলেন এবং তার মাঝে বকুল বাচ্চাদের নিয়ে নদীর ঘাটের দিকে চলল। বকুল দূর থেকে দেখতে পেল লঞ্চের উপর পুতুলের মতো দেখতে মেয়েটা বসে আছে, তাঁকে দেখে মেয়েটা উঠে দাঁড়াল। মেয়েটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সাহেবদের মতো দেখতে একজন মানুষ, সেই মানুষটা বকুলকে দেখে লঞ্চ থেকে নেমে এসে বললেন, “তুমি হচ্ছ বিখ্যাত বকুলাপ্পু?”

বকুল হঠাৎ করে একটু লজ্জা পেয়ে যায়। মানুষটি বকুলের পিঠে হাত দিয়ে বললেন, “তুমি একদিন ঐ গাছ থেকে নদীর পানিতে ডাইভ দিয়েছিলে, সেটা দেখে আমার মেয়ে এত মুগ্ধ হয়েছে যে সে তোমার সাথে পরিচয় করতে এসেছে।”

বকুল অবাক হয়ে মানুষটির দিকে তাকাল, যে-কাজটিকে প্রত্যেকটি মানুষ একটা বড় ধরনের দুষ্টুমি হিসেবে ধরে নেয়, তার জন্যে বকুনি থেকে শুরু করে বড় ধরনের পিটুনি পর্যন্ত খেতে হয়, সেই কাজটি করেছে বলে তাকে দেখতে এসেছে একটি মেয়ে! আর মেয়েটি হ্যাঁনো তেনো কোন মেয়ে নয়–একেবারে সেই স্বপ্নজগতের একটা মেয়ে।

সাহেবদের মতো লম্বা-চওড়া ফরসা মানুষটা বকুলের দিকে খানিকটা ঝুঁকে পড়ে বললেন, “আমার মেয়েটি নিজেই নেমে আসত, কিন্তু আসলে তার শরীরটি ভালো নয়।”

বকুল ভুরু কুঁচকে বলল, “কী হয়েছে?”

ফরসা মানুষটি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “তার একটা অসুখ করেছে। একটা কঠিন অসুখ। খুব দুর্বল সেজন্যে।”

বকুল অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে একবার মানুষটির দিকে আরেকবার পুতুলের মতো মেয়েটিরে দিকে তাকাল। এরকম ফুলের মতো সুন্দর একটা মেয়ের কখনো কি অসুখ করতে পারে?

“তুমি আসবে একটু আমার সাথে? আমার মেয়ে তোমার সাথে পরিচয় করার জন্যে বসে আছে।”

বকুল মাথা নাড়ল। তারপর মানুষটার পিছুপিছু লঞ্চের উপর উঠল। অনেকদিন আগে একবার সে লঞ্চে করে সদরঘাট গিয়েছিল, কী ভয়ানক ভিড় ছিল সেই লঞ্চে, কী ঘিঞ্জি নোংরা একটা লঞ্চ! আর তার তুলনায় এটা একেবারে একটা ছবির মতো, সাদা ধবধবে করছে, দেখে মনে হয় এটি বুঝি সত্যিকারের লঞ্চ নয়, বুঝি একটা খেলনা।

সাহেবদের মতো লম্বা-চওড়া ফরসা মানুষটি বকুলের হাতে ধরে সাবধানে উপরে নিতে নিতে বলল, “আমার নাম ইশতিয়াক আহমেদ, আর আমার মেয়ের নাম হচ্ছে নীলা।”

বকুল ভাবল সে একবার জিজ্ঞেস করবে নীলার কী অসুখ করেছে কিন্তু ততক্ষণে উপরে চলে এসেছে তাই আর জিজ্ঞেস করতে পারল না। ইশতিয়াক সাহেব নীলার কাছাকাছি গিয়ে বললেন, “নীলা, এই হচ্ছে বকুল, আর বকুল, এই হচ্ছে নীলা।”

বকুল কী বলবে বুঝতে পারল না, সে ছোট ছোট দুষ্টু ছেলেমেয়েদের নিয়ে যে-কোনরকম দুরন্তপনা করতে পারে, গলা ফাটিয়ে ঝগড়া করতে পারে, পাজি ছেলেদের ল্যাং মেরে ফেলে দিতে পারে–কিন্তু এরকম একটা ছবির মতে, সুন্দর লঞ্চের দোতলায় পুতুলের মতো একটা মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে কী কথা বলতে হবে সে বুঝতে পারল না। দুজন দুজনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তখন নীলা বলল, “আমি যে এরকম করে এসেছি তুমি কি রাগ হয়েছ?”

বকুল অবাক হয়ে বলল, “কেন রাগ হব কেন?”

“না, আমি ভাবলাম কোনোরকম খবর না দিয়ে অচেনা একজন মানুষ হঠাৎ করে—”

“আমি তোমাকে চিনি।”

নীলা অবাক হয়ে বলল, “তুমি আমাকে চেন?”

“হ্যাঁ। আমি তোমাকে অনেকবার দেখেছি তুমি এই লঞ্চে করে যাচ্ছ।”

“আমিও তোমাকে দেখেছি ঐ গাছের উপর থেকে তুমি ডাইভ দিচ্ছ। ইশ! তোমার ভয় করে না?”

বকুল ফিক করে হেসে বলল, “একটু একটু করে।”

নদীর ঘাটে ততক্ষণে অনেক বাচ্চার ভিড় জমে গেছে, সবাই লঞ্চে ওঠার জন্যে উসখুস করছে কিন্তু সাহস পাচ্ছে না। ইশতিয়াক সাহেব রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি তাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কি আসতে চাও?”

তার কথা শেষ হবার আগেই ডজনখানেক বাচ্চা হুড়মুড় করে লঞ্চের দিকে ছুটে যেতে থাকে, ধাক্কাধাক্কি করে কে কার আগে যাবে সেটা নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়, উপর থেকে কোন-একজন নিচে পড়ে যাবে সেই ভয়ে ইশতিয়াক সাহেব চোখ বন্ধ করে ফেললেন। কয়েক সেকেন্ড পরে চোখ খুলে দেখলেন বকুল আর নীলাকে ঘিরে সব বাচ্চা দাঁড়িয়ে আছে–কেউ পড়ে যায়নি! বকুল আর নীলা কী নিয়ে কথা বলে সেটা শোনার জন্যে তারা একটা নিঃশব্দ কৌতূহল নিয়ে তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।

বকুল জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাকি অসুখ করেছে?”

নীলা মাথা নাড়ল।

বকুল মাথা নেড়ে সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গি করে বলল, “কোন চিন্তা কোরো না। সবারই কোন-না-কোন অসুখ হয়।”

বকুল এবং নীলাকে ঘিরে যে বিশাল দর্শকমণ্ডলী দাঁড়িয়েছিল তারা সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, আজিজ বলল, “আমার গত সপ্তাহে জ্বর হয়েছিল।”

কালাম বুক ফুলিয়ে বলল, “আমার গত বছর জন্ডিস হয়েছিল।”

জাহানারা ফিসফিস করে বলল, “আমার ম্যালেরিয়া।”

সিরাজ রতনকে দেখিয়ে হিহি করে হেসে বলল, “আর রতনের সারা বছর অসুখ থাকে। পেটের অসুখ নাহলে জ্বর নাহলে পাঁচড়া।

নীলা মাথা নেড়ে বলল, “আমার অসুখটা সেরকম অসুখ না।”

“তা হলে কীরকম অসুখ?”

“এটা আসলে–এটা-”নীলা ইতস্তত করে বলল, “এটা কোনদিন ভালো হবে না।”

সবাই কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। আজিজ বলল, “ডাক্তার দেখালেই তো অসুখ ভালো হয়।”

নীলা একটু হেসে বলল, “পৃথিবীর সব ডাক্তার দেখানো হয়েছে। এই অসুখটার কোন চিকিৎসা নেই।”

বাচ্চাদের দলটার মাঝে রতনকে সবচেয়ে বোকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সে নিজের সুনামটা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্যেই মনে হয় বলল, “তা হলে কি এখন তুমি মরে যাবে?”

বকুল সাথে সাথে রতনের কান ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “গাধার মতো কথা বলিস কেন?”

রতন নিজের কান বাঁচানোর চেষ্টা করতে করতে বলল, “চিকিৎসা না হলে মানুষ মরে যায় না? মনে নাই জব্বার চাচা–”

ইশতিয়াক সাহেব অসহায়ভাবে বাচ্চাদের আলোচনাটি শুনে যাচ্ছিলেন–এত খোলামেলাভাবে এরকম একটা বিষয় নিয়ে মনে হয় শুধু বাচ্চারাই আলোচনা করতে পারে। তিনি বিষয়টা পালটানোর চেষ্টা করতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই নীলা বলল, “আসলে ঠিকই বলেছে ও। আমি কয়েকদিনের মাঝে মরে যাব।”

সাজ্জাদ এই দলটার মাঝে সবচেয়ে ধার্মিক মানুষ, গত রোজায় সে ত্রিশটা রোজা রেখেছে, এর মাঝেই নিজে নিজে দশ পারা কোরান শরিফ পড়ে ফেলেছে। সে এগিয়ে এসে গম্ভীর গলায় বলল, “হায়াত-মউত আল্লাহর হাতে। কে কখন মারা যাবে কেউ বলতে পারে না।”

নীলা হাসিহাসি মুখে বলল, “আমি পারি।”

সাজ্জাদ মাথা নেড়ে বলল, “এইরকম করে কথা বলা ঠিক না। আল্লাহ নারাজ হবে। আল্লাহ্ চাইলে সব অসুখ ভালো হয়ে যায়।”

বকুল এবং অন্য সবাই জোরে জেরে মাথা নাড়তে থাকে। সাজ্জাদ উৎসাহ পেয়ে বলল, “যখন কঠিন অসুখ হয় তখন সদকা দিতে হয়।”

“সদকা?”

“হ্যাঁ, জানের সদকা দিতে হয় জান দিয়ে। মনে করো আল্লাহ্ ঠিক করেছে এই অসুখটা দিয়ে তোমার জান নেবে। তখন একটা মুরগি কিনে সেটাকে সদকা দিতে হয়। বলতে হয় আল্লাহ্ তুমি আমার জান না নিয়ে এই মুরগির জানটা নাও। আল্লাহ্ তখন মুরগির জান নিয়ে তোমার অসুখ ভালো করে দেবে।”

আজিজ জিজ্ঞেস করল, “মুরগি সদকা কি দেওয়া হয়েছে?”

নীলা মনে হল মুখের হাসি গোপন করে বলল, “না, দেওয়া হয়নি।”

“দেওয়া উচিত ছিল।”

বকুল বলল, “তুমি চিন্তা কোরো না, আমরা আজকেই তোমার জন্যে একটা মুরগি সদকা দেব।”

উপস্থিত অন্য সবাই মাথা নাড়ল এবং ঠিক তখন নদীর তীর থেকে কে–একজন চিৎকার কর উঠল, “শুশুক, শুশুক–”

সবাই লঞ্চের রেলিং ধরে নিচে তাকাল এবং অবাক হয়ে দেখল একটা বিশাল শুশুক লঞ্চটার কাছে ভেসে ভেসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তীর থেকে একজন চিৎকার করে বলল, “মার, মার শালাকে!”

কেন শুশুককে মারতে হবে কেউ পরিষ্কার করে বুঝতে পারল না, কিন্তু সাথে সাথে লোকজন চিল পাথর হাতে নিতে শুরু করে, কে-একজন একটা কোচ নিয়ে আসার জন্যে ছুটতে থাকে।

বকুল নিচে তাকাল এবং সাথে সাথে শুশুকটাকে চিনতে পারল, লঞ্চের উপর থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে পিঠের আঘাতের চিহ্ন। সে চিৎকার করে বলল, “না–না–না, কেউ মেরো না।”

তার কথা শেষ হবার আগেই দুটি ঢিল ছুটে আসতে থাকে এবং কেউ কিছু বোঝার আগেই বুকল রেলিঙের উপরে উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। নদীর পানিতে ঝপাং করে সে ডুবে যায়, কয়েক মুহূর্ত পরে সে যখন ভেসে উঠল সবাই অবাক হয়ে দেখল শুশুকটার গলা জড়িয়ে ধরে রেখেছে এবং শুশুকটা প্রাণের বন্ধুকে যেভাবে আদর করে সেভাবে বকুলকে তার মুখ দিয়ে আদর করে যাচ্ছে।

লঞ্চের উপর ইশতিয়াক সাহেব, নীলা, ডজনখানেক বাচ্চা, নদীর তীরে জনা দশেক মানুষ সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। সবার আগে কথা বলল নীলা, জিজ্ঞেস করল, “তু-তুমি এটাকে চেন?”

বকুল মুখের উপর থেকে ভিজে চুল সরিয়ে বলল, “হ্যাঁ, এটা আমার বন্ধু।”

“বন্ধু? বন্ধু! কী নাম?”

“টুশকি।”

“টুশকি! ইশ কী সুন্দর নাম! আমি টুশকিকে ছুঁতে পারি?”

রতন মাথা নেড়ে বলল, “কামড় দেবে। কামড় দিয়ে কপ করে মাথাটা খেয়ে ফেলবে।”

“ধুর গাধা! আজিজ ধমক দিয়ে বলল, “শুশুক তো মাছ, মাছ কি কামড় দেয়? বকুলাপ্পুকে কি কামড় দিচ্ছে?”

জাহানারা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “বকুলাপ্পুকে বাঘও কামড় দেবে না। আমরা গেলে কপ করে খেয়ে ফেলবে।”

নীলা উপর থেকে আবার চিৎকার করে বলল, “আমি টুশকিকে ছোব।”

বকুল টুশকির গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “নিচে পানিতে আসতে হবে।”

নীলা জ্বলজ্বলে চোখে ইশতিয়াক সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, “বাবা আমি যাই নিচে? পানিতে?”

ইশতিয়াক সাহেব অবাক হয়ে নীলার দিকে তাকিয়ে রইলেন। শাহনাজ মারা যাবার পর মেয়েটি একেবারে সবকিছুতে আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছিল, কত চেষ্টা করেও কোনকিছুতেই একটুকু আগ্রহ বা কৌতূহল জাগাতে পারেননি। দুই বছর পর এই প্রথমবার সে কিছু একটা করতে চাইছে। শুধু যে করতে চাইছে তাই নয়, সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে দিচ্ছে। তিনি নরম গলায় বললেন, “যেতে চাইলে যা মা। আমি আসব?”

“আসতে হবে না বাবা, আমি নিজেই পারব।”

ইশতিয়াক সাহেব অবাক হয়ে দেখলেন দুর্বল শরীরে নীলা লঞ্চের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে, তার সামনে পিছনে ছোট ছোট বাচ্চারা তাকে ধরে রেখেছে যেন পড়ে না যায়। নিচে কাদামাটি, তার কাছে ঘোলা পানি, সেখানে হাঁটতে হাঁটতে প্যারিস থেকে কেনা তার সাদা জুতো কাদায় মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে, নিউইয়র্কের ম্যাসিতে এই ফ্রকটা কিনেছিলেন আড়াইশো ডলার দিয়ে, নদীর ঘোলা পানিতে ভিজে একাকার হবে এক্ষুনি! কিন্তু ইশতিয়াক সাহেব সেদিকে দেখছিলেন না, তিনি তাকিয়ে ছিলেন নীলার মুখের দিকে, কী অপূর্ব প্রাণশক্তিতে হঠাৎ করে সেটা জ্বলজ্বল করছে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তিনি নিচু গলায় ডাকলেন, “শমসের–”

সাথে সাথে সারেঙের ঘর থেকে মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ বের হয়ে এল, বলল, “স্যার, আমাকে ডেকেছেন?”

“হ্যাঁ। তুমি যাও, ডক্টর আজমলকে নিয়ে এসো। যেভাবে হোক। কতক্ষণ সময় লাগবে?”

“এক ঘণ্টা লেগে যাবে স্যার।”

“এক ঘণ্টার পারবে নিয়ে আসতে?”

“যদি ডাক্তার সাহেবকে খুঁজে আনতে না হয় তা হলে পারব স্যার।”

“ভেরি গুড! যাও। বলবে খুব জরুরি। খুব খুব জরুরি।”

বকুল পানিতে শুশুকটার গলা জড়িয়ে ভেসে আছে, তাকে ঘিরে আরও কিছু বাচ্চা হুটোপুটি করছে। ইশতিয়াক সাহেব লঞ্চের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন। বেশ কয়েকজন মিলে নীলার হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ইশতিয়াক সাহেব বুকের মাঝে একধরনের কাঁপুনি অনুভব করতে থাকেন। ফুলের মতো কোমল তাঁর এই মেয়েটার যদি কিছু-একটা হয়? শুশুকের শক্তিশালী লেজের ঝাঁপটায় যদি সে আছড়ে পড়ে ডুবে যায় পানিতে, নদীর স্রোতে যদি ভেসে যায় খড়কুটোর মতো?

.

নীলা শীতে কাঁপছে ঠকঠক করে, কাঁপতে কাঁপতে সে মাছের টুকরোটা উঁচু করে ধরে রাখল আর শুশুকটা হঠাৎ পানির নিচ থেকে লাফিয়ে উঠে ওর হাত থেকে মাছটা নিয়ে আবার পানির নিচে অদৃশ্য হয়ে গেল। ডজনখানেক নানা বয়সের বাচ্চা হাততালি দিয়ে চিৎকার করে ওঠে, আর নীলা কাঁপতে কাঁপতেই খিলখিল করে হেসে উঠল আনন্দে।

লঞ্চের রেলিংটা শক্ত করে ধরে রেখে ইশতিয়াক সাহেব কাঁপা গলায় বললেন, “কী মনে হয় তোর আজমল? নীলা কি ডিপ্রেশান থেকে বের হয়ে আসছে?”

ডক্টর আজমল নিচু গলায় বললেন, “দেখ, ইশতিয়াক আমি চাই না তোর পরে আশাভঙ্গ হোক–তা-ই কিছু বলতে চাচ্ছি না। কিন্তু যদি নীলার মাঝে এই ভাবটা ধরে রাখা যায়–তা হলে মনে হয় একটা-কিছু হয়ে যাবে!”

“কতক্ষণ ধরে রাখতে হবে? কতক্ষণ?”

“বলা মুশকিল–যত বেশি সময় হয় ততই ভালো।”

“কিন্তু দেখছিস না শীতে কাঁপছে?”

“হ্যাঁ। এখন খানিকক্ষণের জন্যে উপরে নিয়ে আয়–শরীর মুছে আবার খানিকক্ষণ পরে না হয় খেলতে দিস! পানিতে ভিজেই যে খেলাতে হবে তা নয়–অন্য কোনোভাবে।”

“এই যে বকুল মেয়েটাকে দেখছিস নিশ্চয়ই জাদু জানে–নিশ্চয়ই জানে। কী বলিস তুই?’

ডক্টর আজমল হাসলেন, “হ্যাঁ, মাঝে মাঝে এরকম পাওয়া যায়। এক দুজন মানুষ–তাদের হাতের ছোঁয়ায় জাদু থাকে, চোখের দৃষ্টিতে জাদু–”

.

ইশতিয়াক সাহেব হঠাৎ আজমলের হাতটা চেপে ধরে প্রায় আর্তনাদ করে বললেন, “কী মনে হয় তোর? বাঁচবে আমার মেয়েটা? বাঁচবে?”

ডক্টর আজমল ইশতিয়াক সাহেবের কাঁধ স্পর্শ করে বললেন, “এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? একটু ধৈর্য ধর। মনে হয় খোদা আমাদের কথা শুনেছেন।”

ইশতিকথাটি যেন তার জন্যে

নীলা শরীর মুছতে মুছতে বলল, “আব্বু, এমন খিদে লেগেছে যে মনে হচ্ছে আস্ত একটা ঘোড়া খেয়ে ফেলতে পারব।”

তুচ্ছ একটা কথা শুনে ইশতিয়াক সাহেবের চোখে পানি এসে গেল, শেষবার কবে মেয়েটি শখ করে কিছু খেতে চেয়েছে? সাবধানে চোখের পানি গোপন করে বললেন, “এখন তোর জন্যে ঘোড়া রান্না করবে কে?”

কথাটি যেন সাংঘাতিক হাসির কথা নীলা সেরকমভাবে হাসতে শুরু করল। ইশতিয়াক সাহেব মনে করতে পারলেন না শেষবার কবে তাকে হাসতে শুনেছেন। হাত দিয়ে মেয়েকে নিজের কাছে টেনে এনে বললেন”কী খাবি মা?”

“ইলিশ মাছের ভাজা দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছে করছে আব্বু। ঝাল করে কাঁচা মরিচ দিয়ে ভাজবে। কিন্তু–”

“কিন্তু কী?”

“লঞ্চের কিচেনে তো কোনো ইলিশ মাছ নেই।”

“কী হয়েছে ইলিশ মাছের?

“দেখলে না পুরো ইলিশ মাছটা খাইয়ে দিলাম টুশকিকে! যা পেটুক, তুমি বিশ্বাস করবে না! ইলিশ মাছ শেষ করে গলদা চিংড়ি রুইমাছ–”

ইশতিয়াক সাহেব যখন নীলাকে নিয়ে লঞ্চে করে বেড়াতে আসেন তখন সাথে নানারকম খাবারের আয়োজন থাকে। লঞ্চের নিচে রান্না করার ব্যবস্থা রয়েছে, কখনো খাওয়ার সমস্যা হয় না। আজ অবিশ্যি ভিন্ন ব্যাপার, কিচেনের যাবতীয় খাবার টুশকি নামের শুশুকটিকে খাইয়ে দেওয়া হয়েছে। ইশতিয়াক সাহেব দরজা দিয়ে গলা বের করে ডাকলেন, “শমসের–”

শমসের প্রায় সাথে সাথেই নিঃশব্দে হাজির হয়ে বলল, “আমাকে ডেকেছেন স্যার?”

“কিচেনের সব ইলিশ নাকি টুশকিকে খাইয়ে দেওয়া হয়েছে।”

“জি স্যার।”

“কতক্ষণে তুমি কিছু ইলিশ মাছ আনতে পারবে?”

শমসের খানিকক্ষণ তার নখের দিকে তাকিয়ে রইল যেন সেখানে কিছু একটা তথ্য লেখা রয়েছে, তারপর মুখ তুলে বলল, “বিশ মিনিট স্যার।”

“তোমাকে পুরো তিরিশ মিনিট সময় দিচ্ছি। যাও।”

“ঠিক আছে স্যার।”

শমসের ঠিক যেরকম নিঃশব্দে হাজির হয়েছিল ঠিক সেরকম নিঃশব্দে বের হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড পরেই শক্তিশালী স্পিডবোটের গর্জন শোনা গেল, শহর থেকে ডক্টর আজমলকে এক ঘণ্টার মাঝে নিয়ে আসার রহস্যটা ইশতিয়াক সাহেবের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল হঠাৎ।

আধা ঘন্টার মাঝে সত্যি সত্যি ইলিশ মাছ হাজির হল, সেটা কেটেকুটে রান্না করতে করতে আরও আধাঘণ্টা, খাওয়া শেষ হতে হতে আরও আধাঘণ্টা। ইশতিয়াক সাহেব সবাইকে নিয়ে খেতে চাইছিলেন, কিন্তু বকুল এবং অন্য বাচ্চাগুলো কিছুতেই রাজি হল না।

ডক্টর আজমল নীলাকে পরীক্ষা করে খানিকক্ষণ শুয়ে বিশ্রাম নিতে বললেন, সে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না, কিন্তু এরকম জোর করে শুইয়ে দেবার পর প্রায় সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়ল। তার দুর্বল শরীর কি পরিমাণ ক্লান্ত হয়েছিল সে নিজেও জানত না।

বিকেলবেলা বকুল এল একটা ছোট মোরগের বাচ্চা হাতে-নীলার জন্যে এই মোরগের বাচ্চাটি সদকা দেওয়া হবে। ইশতিয়াক সাহেব মোরগের বাচ্চাটির দাম দেওয়ার চেষ্টা করলেন কিন্তু বকুল সজোরে মাথা নেড়ে বলল সাজ্জাদ জানিয়েছে যে নিজেদের মানুষেরা এর দাম দিয়ে দিলে সদকার কার্যক্ষমতা কমে যায়। ইশতিয়াক সাহেব সেটা শুনে আর দাম দেওয়ার চেষ্টা করলেন না, নীলাকে ডেকে দিয়ে একটু আড়ালে সরে গেলেন, দেখলেন অত্যন্ত গম্ভীরমুখে বকুল কিছু একটা বলছে, নীলা খুব মনোযোগ দিয়ে সেটা শুনছে।

খানিকক্ষণ পর নীলা এসে ইশতিয়াক সাহেবকে বলল, “আব্বু–আমি বকুলের সাথে যাই?”

“কোথায় যাবি?”

“এই তো গ্রামে।“

যে-মেয়েটি আজ সকালেও রুগ্ন হয়ে বিছানায় শুয়েছিল সেই মেয়েটি যদি এখন আরেকজনকে নিয়ে গ্রামে ঘুরে বেড়াতে চায় সেটি খুব সহজভাবে নেওয়া সম্ভব নয়। ডক্টর আজমল থাকলে তাকে জিজ্ঞেস করা যেত, কিন্তু তার হাসপাতালে ডিউটি ছিল বলে ঘণ্টাখানেক আগে চলে গিয়েছেন। নীলা আবার জিজ্ঞেস করল, “যাই বাবা?”

“ঠিক আছে, যা।”

সাথে সাথে নীলা গায়ে হালকা একটা সোয়েটার চাপিয়ে বকুলের সাথে রওনা দিল। দুজনে একটু দূরে সরে যেতেই ইশতিয়াক সাহেব চাপা গলায় ডাকলেন,

“শমসের—”

শমসের নিঃশব্দে এসে বলল, “জি স্যার?”

“ঐ যে দেখছ নীলা আর বকুল? তাদের দুজনকে চোখে-চোখে রাখবে। কিন্তু খুব সাবধান, তারা যেন বুঝতে না পারে।”

“ঠিক আছে স্যার।”

শমসের সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছিল তখন ইশতিয়াক সাহেব আবার ডাকলেন, “শমসের

“জি স্যার।”

“থাক দরকার নেই। আমার মেয়েটি কি বেঁচে যাবে কি না সেটা এখন নির্ভর করছে এই বাচ্চা মেয়েটার উপর।”

শমসের নিচু গলায় বলল, “আল্লাহ মেহেরবান।”

“ঐ মেয়েটাকে আমার বিশ্বাস করা উচিত। কী বল?”

“জি স্যার।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *