০৪. দ্য গ্রেটেস্ট ডে-লাইট রবারি

দ্য গ্রেটেস্ট ডে-লাইট রবারি

—গুলি যে শেষ হয়ে আসছে…

—হুঁ, কতক্ষণ টানা যাবে আর?

—খুব বেশি হলে মিনিট পনেরো… ঘিরে ফেলেছে আমাদের, পালানোর পথ নেই আর।

প্রতিক্রিয়ায় ঝাঁঝিয়ে ওঠেন যুবক, আঘাত-প্রত্যাঘাতের রণভূমিতে যিনি অবিসংবাদিত নেতা।

—পালানোর কথা উঠছে কেন? পালানো নয়, সুযোগ থাকলে ট্যাকটিক্যাল রিট্রিট করা যেত হয়তো…

—রিট্রিটের কথাই বলছি… সে সুযোগও তো দেখছি না…

—শেষ অবধি লড়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।

—হ্যাঁ… আরে! সামলে! খেয়াল করো.. ডানদিক থেকে একটা প্ল্যাটুন এগোচ্ছে…

—দেখেছি! ফায়ার!

গুলি এবং পালটা গুলির আওয়াজে নদীতীরবর্তী জঙ্গলের নৈঃশব্দ্য বশ্যতা স্বীকার করেছে তখন।

.

কলেজ স্ট্রিটের নিকটবর্তী মার্কাস স্কোয়ারের পশ্চিম দিকে মাড়োয়ারি হস্টেল। যার একটি অপ্রশস্ত ঘর প্রায় মেক-আপ রুমে পরিণত। চেয়ারে বসে এক যুবক। ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে আরেক যুবক। যিনি, প্রায় ঘণ্টাখানেক হয়ে গেল, মগ্ন হয়ে কাঁচি চালাচ্ছেন চেয়ারে আসীন যুবকের চুলে। যিনি ঠায় বসে থাকতে থাকতে সামান্য অধৈর্য এতক্ষণে।

—আর কত ছোট করবে? এ তো বাটিছাঁট হয়ে যাচ্ছে পুরো…

—চুপ করে বসো তো, বিহারিদের চুল আরও ছোট হয়।

—এর থেকে ভাল, ন্যাড়াই করে দাও।

—দরকার হলে করতাম। আপাতত এই যথেষ্ট।

—বাঁচা গেল, এবার উঠতে পারি?

—হ্যাঁ। খইনির ডিবেটা দেরাজে রাখা আছে, ওটা ভুলো না।

—খইনির বদলে পান চলবে?

—না। খইনিই। খেতে হবে না, ডিবেটা সঙ্গে রাখবে। মাঝে মাঝে খাওয়ার ভান করতে পারো। আর হাতের চেটোয় চুনের দাগটা যেন থাকে।

—বুঝলাম। আর কিছু?

—আর একটা জিনিস শুধু। এই ধুকধুকিটা গলায় ঝুলিয়ে নিয়ো।

—কী এটা?

—বললাম তো… ধুকধুকি… পিতলের জিনিস… ভেরি কমন ইন বিহার।

সাজসজ্জা সম্পূর্ণ হলে আয়নার সামনে দাঁড়ালেন যুবক এবং নিজের চেহারা দেখে চমকিত। দেখে কে বলবে, নিখাদ বঙ্গসন্তান! এ তো পাক্কা বিহারি দেখাচ্ছে!

.

সুঠাম চেহারার যুবককে দৃশ্যতই উত্তেজিত দেখায়। সোজাসাপটা বলে দেয় সঙ্গীদের, এসব আকাশকুসুম কল্পনা।

—মাথা খারাপ হয়েছে তোমাদের? এটা হয় না… জাস্ট ইম্পসিবল!

—এত উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই। কেন হয় না? কীসের ইম্পসিবল?

—এই মিটিংটা লালবাজারের কাছে হচ্ছে মানে তোমরা ধরে নিচ্ছ অ্যাকশনটাও লালবাজারের নাকের ডগায় করা যাবে? অত সোজা?

—ঠিকঠাক প্ল্যান করলে না পারার কিছু নেই।

—একচুল এদিক-ওদিক হলে কী হতে পারে ভেবেছ? পুলিশ হেডকোয়ার্টার একশো মিটারের মধ্যে। টহলদারি ইদানীং বেড়ে গেছে। সাদা পোশাকের পুলিশ চারপাশে ছড়িয়ে থাকে সর্বক্ষণ। ভাবলে অন্য রাস্তা নিশ্চয়ই বেরবে।

—হতে পারে। কিন্তু সময় কোথায় হাতে? যা করার খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। আর এমন সুযোগও বারবার আসবে না। ঝুঁকি নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।

—I disagree. তোমরা যা ভাল বোঝো করো। আমি এর মধ্যে নেই। Hope you can pull this off.

লালবাজার থেকে ঢিলছোড়া দূরত্বের ছাতাওয়ালা গলিতে চলছিল গোপন বৈঠক। মতানৈক্যের জেরে মিটিং ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন দীর্ঘদেহী যুবক। সন্ধ্যা পেরিয়ে তখন রাত। ঘড়ির কাঁটা পা রেখেছে নয়ের ঘরে।

বাকিরা বসে পড়লেন ম্যাপ নিয়ে। এলাকার ভূগোল জানা প্রয়োজন পুঙ্খানুপুঙ্খ। মানচিত্রে লাল দাগ পড়তে লাগল কিছু দিকচিহ্নে। ডালহৌসি স্কোয়ার… লালবাজার…কাস্টমস হাউস… ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্ট্রিট… মলঙ্গা লেন… হিন্দ সিনেমা…

.

থমথম করছে স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের প্রধান চার্লস টেগার্টের চোখমুখ। হাতে ধরা ‘The Statesman’, প্রথম পাতার হেডলাইন, ‘The greatest daylight robbery’।

টেগার্টের বাক্যবাণ বর্ষিত হয় সহকর্মীদের উপর।

—So gentlemen, how has all this happened right under our noses? You think there is anything more embarrassing than this?

ইলিসিয়াম রো (বর্তমানে, লর্ড সিনহা রোড)-র স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের দফতরে বৈঠক চলছে জরুরি। টেগার্টের তিরস্কারে অফিসাররা নতমস্তক। নিশ্চুপ এতটাই, পিন পড়লে মনে হবে বোমাবর্ষণ হচ্ছে বুঝি।

—Officers, I want recovery. At any cost and within the quickest possible time. Do whatever it takes. I won’t take any excuses this time. They just can’t get away with this.

অফিসাররা শুনলেন এবং বুঝলেন, পেশাদারি অহংয়ে আঘাত লেগেছে দোর্দণ্ডপ্রতাপ টেগার্টের। এই মামলায় সামান্যতম ঢিলেমিও বরদাস্ত করবেন না টেগার্ট। ক্ষুরধার বুদ্ধি এবং কর্মনৈপুণ্যের যোগফলে যিনি তখনই ব্রিটিশ প্রশাসনে প্রায় কিংবদন্তিসম।

.

১৯১৪ সালের মধ্যভাগ। অস্থিরতা ক্রমবর্ধমান বিশ্বের রাজনীতিতে। পরিবর্তন ঘটছে বিভিন্ন দেশের পারস্পরিক সম্পর্কের রসায়নে। দ্রুত মেরুকরণে পটভূমি প্রস্তুত হচ্ছে সম্মুখসমরের। ২৮ জুন অস্ট্রিয়ার আর্চডিউকের হত্যার প্রতিক্রিয়ায় সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি।

প্রহর গোনা শুরু হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের। যুযুধান দেশের বন্ধুরাষ্ট্রগুলি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ল একে একে। জার্মানির নেতৃত্বে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি-বুলগেরিয়ার ‘কেন্দ্রীয় শক্তি’ বনাম সার্বিয়া-রাশিয়া-ফ্রান্স-জাপান-ইংল্যান্ডের ‘মিত্রশক্তি’। যুদ্ধের সূচনা হল । যা স্থায়ী হয়েছিল দীর্ঘ চার বছরেরও বেশি। মিত্রশক্তির শিবিরে ক্রমে যোগ দিয়েছিল ইতালি-রোমানিয়া-আমেরিকাও।

বিশ্বযুদ্ধের এই অনিশ্চিত প্রেক্ষাপটে রাসবিহারী বসু এবং যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের (বাঘা যতীন) মতো বঙ্গজ বিপ্লবীরা পরিকল্পনা করতে শুরু করলেন সশস্ত্র অভ্যুত্থানের। ব্রিটিশরাজকে লাগাতার আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত করে তোলার এই হল প্রকৃষ্ট সময়, একমত হলেন বাংলার বিপ্লবীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ।

ব্রিটিশ প্রশাসনের অজ্ঞাত ছিল না বিপ্লবীদের এই সক্রিয়তা। যুদ্ধের আবহের সুযোগ নিয়ে গুপ্ত সমিতিগুলি যাতে শাসককে বিব্রত না করতে পারে, তৎপর ছিল রাষ্ট্রযন্ত্র। তল্লাশি এবং অভিযান জারি ছিল নিরন্তর। বিপ্লবীদের আশু প্রয়োজন ছিল পর্যাপ্ত পরিমাণে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের, যা ব্যতিরেকে সশস্ত্র বিপ্লবের স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যাওয়া অবধারিত।

১৮৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত আত্মোন্নতি সমিতির আখড়া ছিল ওয়েলিংটন স্কোয়ারের উত্তর-পূর্ব কোণে। নেতৃত্বে ছিলেন বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী, অনুকূলচন্দ্র মুখার্জী এবং আরও অনেকে। ১৯১৪-র অগস্টের শুরুতে অনুকূল খবর পেলেন, ২৬ অগস্ট ‘Tactician’ নামের জাহাজে রাষ্ট্রের বরাত দেওয়া প্রচুর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র কলকাতায় আসছে। বিখ্যাত অস্ত্র আমদানিকারক কোম্পানি R B Rodda-র ২, ওয়েলেসলি প্লেসের অফিসের পিছন দিকে ভ্যান্সিটার্ট রো-র গুদামে। আমদানির মধ্যে রয়েছে মাউজার পিস্তল আর তার গুলি।

কার্যকারিতার অভিনবত্বে মাউজার ছিল বিপ্লবীদের কাছে উৎকৃষ্ট হাতিয়ার। মাউজার পিস্তলের ‘effective range’ ছিল ৫০০ গজ। একে পিস্তল হিসাবে যেমন ব্যবহার করা যেত, পিস্তল রাখার জন্য কাঠের যে খোল আছে সেটি পিস্তলের সঙ্গে জুড়ে নিলে দূরপাল্লার রাইফেলের মতো কাঁধের উপর রেখে করা যেত গুলি নিক্ষেপ।

বিপ্লবীরা এই সুযোগ হারাতে চাইলেন না। সিদ্ধান্ত হল অস্ত্র লুঠের, সম্মতি মিলল বিপিনবিহারী এবং বাঘা যতীনের। ২৪ অগস্ট লালবাজারের অদূরেই ছাতাওয়ালা গলিতে এক গুপ্তসভায় মিলিত হলেন বিপ্লবীরা। সে সময় ঢাকার হেমচন্দ্র ঘোষের ‘মুক্তিসংঘ’-এর প্রতিনিধি হিসাবে কলকাতায় কাজ করছিলেন শ্রীশ পাল এবং হরিদাস দত্ত। শ্রীশ পালের উপর দায়িত্ব ন্যস্ত হল অভিযানের পরিকল্পনার।

ঠিক কীভাবে অস্ত্র লুঠের চেষ্টা হবে, বুঝিয়ে বললেন শ্রীশ। সব শুনে বেঁকে বসলেন বৈঠকে উপস্থিত নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, যিনি পরবর্তীকালে এম এন রায় হিসাবে বিখ্যাত হবেন। স্পষ্ট জানালেন, এই অভিযান অলীক কল্পনা ব্যতীত কিছু নয়।

—I disagree. তোমরা যা ভাল বোঝো করো। আমি এর মধ্যে নেই। Hope you can pull this off.

নরেন্দ্রনাথ বেরিয়ে গেলেন। বাকিরা বসলেন ম্যাপ নিয়ে। শ্রীশ বুঝিয়ে দিলেন ভৌগোলিক খুঁটিনাটি।

—ম্যাপটা মন দিয়ে দেখো সবাই… এইখানে লালবাজার… আর এই হল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্ট্রিট…

.

২৬ অগস্ট, ১৯১৪। সকাল সোয়া এগারোটা। ডালহৌসির অফিসপাড়ায় প্রাত্যহিক তাড়াহুড়োর পরিচিত দৃশ্যপট। গাড়িঘোড়া অবিরাম, নিত্যযাত্রীদের ওঠানামা, বাতাসে ব্যস্ততার গন্ধ।

রডা কোম্পানির বিশ্বস্ত কর্মচারী শ্রীশ চন্দ্র (হাবু) মিত্র যাবতীয় নথিপত্র নিয়ে হাজির কাস্টমস হাউসের সামনে (বর্তমানে নেতাজি সুভাষ রোডের যেখানে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অফিস, তার অদূরেই)। হাবুর আদবকায়দা ছিল সাহেবি। ট্রাউজার, ধোপদুরস্ত হাফ শার্ট, পায়ে চকচকে বুটজুতো। বাহারি গোঁফ একটা ভারিক্কি ভাব এনেছিল বলিষ্ঠ চেহারায়। প্রথম দর্শনে সমীহের উদ্রেক হওয়া সঙ্গত।

সাতটি গোরুর গাড়ি আনা হয়েছে মালপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য। সপ্তম গাড়িটি মিনিটপাঁচেক দেরি করেছে আসতে। বিরক্ত হাবু বাজখাঁই ধমক দিয়েছেন গাড়োয়ানকে, ‘উল্লু কে পাটঠে, জলদি কিউঁ আয়ে নেহি!’ গাড়োয়ান কাঁচুমাচু মুখে অধোবদন।

২০২টি কাঠের পেটি খালাস হল মালসমেত। ১৯২টি পেটি বোঝাই হল প্রথম ছ’টি গাড়িতে। দেরিতে আসা সপ্তম গাড়িতে বাকি ১০টি। সব কয়টি পেটিতেই কোম্পানির আদ্যক্ষর ‘RBR’।

লালবাজার থেকে বড়জোর একশো-দেড়শো মিটার দূরত্বের কাস্টমস হাউস থেকে সাতটি গাড়ির সারি রওনা দিল ভ্যান্সিটার্ট রো-র গুদামের উদ্দেশে। পঞ্চম এবং ষষ্ঠ গাড়ির মাঝামাঝি পায়ে হেঁটে তদারকিতে হাবু। মূল সড়ক থেকে ডানদিকে গুদামের রাস্তা ধরল প্রথম ছ’টি গাড়ি। সপ্তম গাড়ি সবার অলক্ষ্যে সোজা চলল পুবদিকে। ম্যাঙ্গো লেন, ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্ট্রিট, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট পেরিয়ে চাঁদনি চকের পাশ দিয়ে ওয়েলিংটনের নিকটস্থ মলঙ্গা লেনের পথে। মিশন রো অথবা গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউয়ের অস্তিত্ব ছিল না তখন।

গোরুর লেজ মুড়িয়ে দ্রুত চালাচ্ছিলেন সপ্তম গাড়ির গাড়োয়ান। ছোট ছোট করে ছাঁটা চুল। পকেটে খইনির ডিবে। হাতের চেটোয় চুনের দাগ। গলায় ধুকধুকি। সাজটা জব্বর হয়েছে। গত রাতের কথা ভেবে নিজের মনেই হেসে ফেলেন।

—আর কত ছোট করবে? এ তো বাটিছাঁট হয়ে যাচ্ছে পুরো।

—চুপ করে বসো তো। বিহারিদের চুল আরও ছোটও হয়।

.

গুদামে পৌঁছে হিসাব মিলাতে গিয়ে মাথায় হাত হাবুর। সাত নম্বর গাড়িটা কোথায়? ওটাতেই তো আসল জিনিস ছিল। রওনা হওয়ার আগে চালান দেখে মিলিয়ে নিয়েছিলেন। দশটা পেটি ছিল। আটটায় নম্বর ছিল ৩৯৬ থেকে ৪০৩। প্রতিটিতে ৫০০০ করে মাউজারের গুলি। ৪০৪ নম্বর পেটিতে ছিল ৬০০০ গুলি। বাকি একটি পেটির নম্বর ছিল ৮২৮, যার মধ্যে ছিল .৩০০ বোরের ৫০টি মাউজার পিস্তল। সব মিলিয়ে ৪৬,০০০ গুলি আর পঞ্চাশটা মাউজার লোপাট? সর্বনাশ!

সপ্তম গাড়ির খোঁজে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে গেলেন হাবু। এবং সেই যে গেলেন, গেলেন তো গেলেন, আর ফিরলেন না। ফেরার কথাও ছিল না।

তিনিই তো লুঠের প্রধান কুশীলব!

শ্রীশ চন্দ্র (হাবু) মিত্রের জন্ম ১৮৯০ সালে হাওড়ার রসপুর গ্রামে। শৈশব-কৈশোর অতিবাহিত মধ্য কলকাতার মলঙ্গা অঞ্চলের ১৪, দাস লেনের মাতুলালয়ে। লেখাপড়ার সঙ্গে সংস্রব ছিল না বিশেষ। ছোটবেলা থেকেই ‘বাপরে কী ডানপিটে ছেলে!’ ভয়ডরহীন দস্যিপনার জন্য এলাকায় নামডাক ছিল হাবুর।

আত্মোন্নতি সমিতির অনুকূলচন্দ্র মুখার্জী থাকতেন ৩৯, মলঙ্গা লেনে। দেশপ্রেমের মন্ত্রে সদ্য যুবকদের দীক্ষিত করা ছিল তাঁর অন্যতম কাজ। পাড়ার ডানপিটে ছেলে হাবুর উপর নজর পড়ল অনুকূলের। নিয়ে গেলেন সমিতির আখড়াতে। প্রশিক্ষণ চলল মুষ্টিযুদ্ধ-লাঠিখেলা-শারীরিক কসরতের। বছরদুয়েক পরে হাবু যখন শক্তসমর্থ, J F Madan কোম্পানির স্টোরকিপারের পদে বহাল হতে সহায়তা করলেন অনুকূল।

বিপিনবিহারী গাঙ্গুলীর এক সুহৃদ রডা কোম্পানির কর্মী ছিলেন। যাঁর মধ্যস্থতায় ১৯১৩ সালের অগস্ট মাসে রডা কোম্পানিতে চাকরি হল হাবুর। মাসিক বেতন সাকুল্যে তিরিশ টাকা। কর্মনিষ্ঠায় অল্পদিনেই কোম্পানির কর্ণধার Mr. Prike-এর অত্যন্ত বিশ্বস্ত হয়ে উঠলেন হাবু। Jetty clerk-এর পদে উন্নতি হল দ্রুত, দায়িত্ব পেলেন আমদানি হওয়া মাল খালাসের। ১৯১৪ সালের অগস্ট পর্যন্ত অন্তত ৪০বার মাল খালাস করেছিলেন নিখাদ পেশাদারিত্বে। মালিকের বিশ্বাস আর আস্থা অর্জন করেছিলেন অনায়াসে।

জাহাজে মাউজার পিস্তল আর গুলি আমদানির খবর হাবুই জানালেন অনুকূলচন্দ্রকে। অস্ত্র লুঠের নিখুঁত ছক কষলেন বিপ্লবীরা। ছাতাওয়ালা গলির গোপন সভায় হাবুও ছিলেন। সভা শেষের কিছু পরে, সেই রাতেই আবার বৈঠক বসল হাবু মিত্রের বাড়িতে। সিদ্ধান্ত হল, অনুকূল একটি গোরুর গাড়ির ব্যবস্থা করবেন। বিহারি গাড়োয়ানের বেশে সেই গাড়ি চালাবেন হরিদাস দত্ত। গাড়ির অদূরে কোমরে গোঁজা রিভলভার সমেত দু’পাশে হাঁটবেন শ্রীশ পাল এবং খগেন দাস। চার বিপ্লবী— সুরেশ চক্রবর্তী, বিমান ঘোষ, আশুতোষ রায় এবং জগৎ ঘোষের উপর দায়িত্ব পড়ল ডালহৌসি স্কোয়ারের আশেপাশে সাদা পোশাকের গোয়েন্দাদের উপর নজর রাখার। কোনওরকম বিপদের আভাস পেলেই যাঁরা চিৎকার করে গান ধরবেন হরিদাস দত্ত-শ্রীশ পালদের সতর্ক করে দিতে।

ঘটনার আগের রাতে হরিদাস দত্তকে পরম যত্নে গাড়োয়ানের সাজে সাজিয়েছিলেন আদতে দুমকার বাসিন্দা প্রভুদয়াল হিম্মতসিংকা। যিনি ছিলেন আদ্যন্ত দেশপ্রেমিক, নানাবিধ সমাজসেবামূলক ক্রিয়াকর্মে নিবেদিত। প্রখ্যাত সলিসিটর হয়েছিলেন পরবর্তী কালে।

এতটাই চাতুর্যের সঙ্গে সম্পন্ন হয়েছিল লুণ্ঠনপর্ব, কোম্পানির মালিক Mr. Prike ওয়াটারলু স্ট্রিট থানায় (তখনও হেয়ার স্ট্রিট থানার পত্তন হয়নি) দিনতিনেক পরে অভিযোগ জানানোর আগে পর্যন্ত ঘুণাক্ষরেও কিছু টের পায়নি লালবাজার। গাফিলতির অভিযোগে কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেই সরকার, জানতেন Prike সাহেব। তিনদিন হন্যে হয়ে খোঁজখবর করেও যখন হদিশ মিলল না খোয়া যাওয়া অস্ত্রের, পুলিশে অভিযোগ দায়ের করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না।

নগরপাল Fredrick Loch Halliday সহ লালবাজারের কর্তাব্যক্তিদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল খবর জানাজানি হওয়ার পর। বিশ্বযুদ্ধের বাজারে এত অস্ত্র বিপ্লবীদের হাতে চলে গেল দিনেদুপুরে, কলকাতা পুলিশের সদর দফতরের নাকের ডগা দিয়ে, বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে? লালবাজার সর্বশক্তি প্রয়োগ করল অস্ত্র উদ্ধারে। গোয়েন্দাদের রাতের ঘুম অন্তর্হিত হল টেগার্টের হুংকারে।

—Officers.. I want recovery. At any cost and within the quickest possible time. Do whatever it takes. I won’t take any excuses this time. They just can’t get away with this.

২৭ সেপ্টেম্বর ৩৪, শিবঠাকুর লেন থেকে গ্রেফতার হলেন হরিদাস দত্ত। উদ্ধার হল গুলিভর্তি ট্রাঙ্ক। বিপ্লবী হরিদাস দত্তের স্মৃতিচারণে লিপিবদ্ধ আছে গ্রেফতারির পর তাঁকে থানায় নিয়ে আসার পরের দৃশ্য। খবর পেয়েই টেগার্ট সহ কর্তারা চলে এলেন থানায়। হরিদাসকে দেখেই টেগার্টের মন্তব্য সহাস্য, ‘Hello Royal Bengal Tiger! Now you are bagged!’

উদ্ধার হওয়া ট্রাঙ্ক খোলার পর উচ্ছ্বাস অবশ্য ক্ষণস্থায়ী হল টেগার্টের। গুলি গোনার পর দেখা গেল, সব মিলিয়ে ২১,২০০ রাউন্ড। পরের দিন ৬১/১/১ কানুলাল লেনে বিপ্লবীদের গোপন ডেরা থেকে উদ্ধার হল আরো ১,০৪০ রাউন্ড। বছরের বাকি কয়েক মাসে দুটি পিস্তল এবং আরও ৯৬০ রাউন্ড গুলি বিভিন্ন জায়গায় খানাতল্লাশির পর। সব মিলিয়ে ২৩,২০০। বাকি গুলি? পিস্তল? কোথায় গেল?

পুলিশের বার্ষিক প্রশাসনিক প্রতিবেদনে ঘটনার বিবরণ ছিল বিস্তারে।

On the 26th August 50 Mauser pistols and 46,000 rounds of ammunition were stolen by Srish Chunder Mittra, the Customs House sirkar of Messrs. R B Rodda & Co. This sirkar was entrusted by the firm with the necessary documents and papers for clearing a consignment of arms and ammunition from the Custom House and took delivery of the goods. One cart containing the abovementioned Mauser pistols and ammunition was diverted from a string of seven carts on the way from Custom House and was eventually traced to an iron yard off Wellington Street where it was found that the arms ammunition had been removed from the carts and stolen. Srish Chundra Mittra disappeared and has not since been found. These weapon and ammunition passed into the hands of anarchists and have been used in dacoity and theft cases. Two pistols and 23,200 rounds of ammunition have since been recovered. Ten persons were prosecuted in connection with this theft and conspiracy to steal, of whom six were discharged and four convicted and sentenced to two year’s rigorous imprisonment each during the current year. The question as to what action was to be taken against the firm responsible for this large loss of arms and ammunition was still under the consideration of the Government at the close of the year.

.

বাকি অস্ত্র এবং গুলি পাচার হয়ে গিয়েছিল লুঠের দিনই। পরিকল্পনামাফিক হরিদাস দত্ত গোরুর গাড়ি নিয়ে পৌঁছেছিলেন মলঙ্গা লেনের কাছে কান্তি মুখার্জীর লোহার গুদামের কাছে একটি মাঠে। বিপিনবিহারীর নির্দেশমতো তিন বিপ্লবী, সতীশ দে, বসন্ত দাস এবং জগৎ গুপ্ত কুলির বেশে পৌঁছলেন মাঠে। যুদ্ধকালীন ক্ষিপ্রতায় কয়েকটি ঠিকাগাড়িতে সমস্ত পেটি বোঝাই করে নিয়ে গেলেন ৩, জেলেপাড়া লেনে ভুজঙ্গভূষণ ধরের বাড়িতে। মাঝরাত পর্যন্ত চলেছিল পিস্তল আর গুলি নতুন কেনা বেশ কয়েকটি স্টিলের ট্রাঙ্কে ভরার কাজ। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল কাঠের পেটিগুলি।

বিপিনবিহারীর তত্ত্বাবধানে বাংলার বিভিন্ন বিপ্লবী দলের কাছে পরের কয়েকদিনে পৌঁছে গেল অত্যাধুনিক মাউজার এবং পর্যাপ্ত গুলি। যার কিয়দংশ পৌঁছেছিল বাঘা যতীনের কাছেও, যিনি তখন আক্ষরিক অর্থেই ব্রিটিশ সরকারের ত্রাস হয়ে উঠেছেন। বুড়িবালামের তীরে ১৯১৫-র ৯ সেপ্টেম্বর বিশাল ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে বাঘা যতীন এবং তাঁর চার সঙ্গীর বহুশ্রুত লড়াইয়ে ব্যবহৃত হয়েছিল লুঠ হওয়া কয়েকটি মাউজার এবং গুলি। অসম যুদ্ধে মরণপণ লড়েছিলেন বাঘা যতীন, চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী, জ্যোতিষ পাল, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত এবং নীরেন দাশগুপ্ত। নতিস্বীকার অনিবার্য ছিল গুলি ফুরিয়ে আসার পর।

—গুলি শেষ হয়ে আসছে..

—হুঁ, কতক্ষণ টানা যাবে আর?

বহুপঠিত তথ্য, ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান চিত্তপ্রিয়। পরের দিন হাসপাতালে গুরুতর আহত বাঘা যতীনের প্রয়াণ। জ্যোতিষের ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়, নীরেন আর মনোরঞ্জনের ফাঁসি।

১৯১৭-র সেপ্টেম্বরের মধ্যে বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পুলিশ ৩১টি মাউজার পিস্তল এবং প্রায় সাতাশ হাজার গুলি উদ্ধার করেছিল। তবে তার আগে বিস্তর ক্ষতি যে হয়ে গিয়েছিল ইংরেজদের, তা নিহিত রয়েছে পরিসংখ্যানে। লুঠের মাউজার পিস্তল আর গুলি দিয়ে সারা বাংলায় ৪৪টি রাজনৈতিক ঘটনায় বিপ্লবীদের হাতে নিহতের সংখ্যা ছিল ২৭, আহত ৪৪।

রাজদ্রোহের বারুদ মজুতই ছিল, অগ্নিসংযোগের জরুরি কাজটি করেছিল অস্ত্র লুঠের সফল অভিযান। যার নেপথ্য নায়ক ছিলেন হাবু মিত্র। শত চেষ্টাতেও যাঁকে ধরতে পারেনি পুলিশ। শ্রীশ পাল, অনুকূলচন্দ্র মুখার্জী সহ অনেকে গ্রেফতার হয়েছিলেন। বিচারের পর ঘটেছিল সাজাপ্রাপ্তি। হাবু ছিলেন অধরাই। কোথায় পালিয়েছিলেন? কী হয়েছিল পরিণতি?

লুঠের ঘটনার রাতেই দার্জিলিং মেল ধরেছিলেন হাবু। রংপুরের কুড়িগ্রামের বিপ্লবী ডাক্তার সুরেন্দ্র বর্ধনের বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন কিছুকাল। পুলিশি নজর এড়াতে ডাক্তার বর্ধন এরপর হাবুকে পাঠিয়ে দেন আসামের গোয়ালপাড়ায় রাভা উপজাতিদের হেফাজতে। কিছুদিন পরে জানতে পারেন, হাবু মণিপুরের দিকে রওনা দিয়েছেন। পরবর্তী ঘটনাবলি নিয়ে প্রামাণ্য তথ্য নেই। সুরেন্দ্র বর্ধনের লেখনীতে, ‘আমার মনে হয়, হাবুর যেরূপ দুঃসাহস, ভারতবর্ষ পেরিয়ে যাইতে চেষ্টা করা অসম্ভব নয়। ঐ সময়ে কোন দুর্ঘটনা হওয়াও অসম্ভব নয়।’

দুর্ভাগ্যের, হাবু মিত্রের কোনও ছবির সন্ধান পাওয়া যায় না।

.

বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে বন্দিত নায়কের তালিকা দীর্ঘ। ক্ষুদিরাম-প্রফুল্ল চাকী-বাঘা যতীন-বিনয়-বাদল-দীনেশের মতো বরণীয়দের জন্য ইতিহাস বরাদ্দ রেখেছে প্রাপ্য সমাদর। কলকাতা পুলিশের সংগ্রহে থাকা ইতিহাসযাপনে তবু মনে হয়, ওঁরা তো চিরপ্রণম্যই, তবে ভাবীকালের কৃপাদৃষ্টি প্রাপ্তির মানদণ্ডে হয়তো কিঞ্চিৎ ভাগ্যবানও বটে।

হাবু মিত্রের মতো কত অনামী-অজানা-অচেনা বিপ্লবী ছিলেন এই বাংলায়। অপরিমেয় অবদান ছিল অগ্নিযুগের উথালপাথালে, অথচ বিস্মৃত ‘কত প্রাণ হল বলিদান’-এর বহুবচনে, ‘কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা’র সমষ্টিতে। নেপথ্যচারী পার্শ্বনায়করা কাব্যে উপেক্ষিত থেকে গেছেন। ইতিহাসেও। আবক্ষ মূর্তি নেই এঁদের। নেই জন্ম বা মৃত্যুজয়ন্তী পালনের সাদর সমারোহ।

তবু মনে রেখো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *