০৪. দেশের উন্নতি হচ্ছে না

দেশের উন্নতি হচ্ছে না কথাটা ঠিক নয়।

নীলগঞ্জ জায়গাটাকে চেনা যাচ্ছেনা। থানার উত্তর দিকের জংলা জায়গায় দশবারটা বড়ো বড়ো বিল্ডিং উঠে গেছে। রাইস মিল, অয়েল মিল, সুরভি লজেন্স ফ্যাক্টরি, আইস ফ্যাক্টরি। জহুরের বিস্ময়ের সীমা রইল না। রেলস্টেশনে যাওয়ার রাস্তাটা পর্যন্ত পাকা হয়ে গেছে। বাজারের সীমানার পরই সাদা রঙের দোতলা একটা দালান–খায়রুন্নেসা খানম ডিগ্রী কলেজ। খায়রুন্নেসা খানমকে জর চিনতে পারল না। কাউকে সঙ্গে আনা দরকার ছিল। চিনিয়েটিনিয়ে দিত। কিন্তু একা-একা হাঁটতেই ভালো লাগছে।

প্রচুর রিকশা চারদিকে। ফাঁকা রাস্তাতেও এরা সারাক্ষণ টুনটুন করে ঘন্টা বাজায়। এত রিকশা কেন? রিকশা করে যাবার জায়গা কোথায়? আগে ছিল ঘোড়া। ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে দূর দূর থেকে মাল আনত। ধনুকের মতো বেঁকে যেত পিঠ। কিন্তু ঘোড়াগুলো গাধার মতোই নিরীহ ছিল, কিছুই বলত না। জহুর বড়বাজারে উঠে এল। বড়োবাজারে দবির মিয়া নতুন একটা ঘর রেখেছে। জহুরের সেখানে যাওয়ার কথা। দবির মিয়া তার জন্যে অপেক্ষা করছে, দুজনে একসঙ্গে বাড়ি ফিরবে।

বড়োবাজারের তেমন কোন পরিবর্তন হয় নি। ছোট-ঘোট ঘুপচি ধরনের টিনের ঘর। ঘর জুড়ে খাট-চৌকি পাতা। এক কোণায় কুৎসিতদর্শন একটা ক্যাশবাক্স। আগরবাতির গন্ধের সঙ্গে আলকাতরার গন্ধ মিশে একটা দম আটকান মিশ্ৰ গন্ধ চারদিকে। মোটামুটি চিত্রটি এই। অবশ্যি দবির স্টোরটি বেশ বড়ো। দেয়ালের র্যাক ভর্তি শাড়ি, লুঙ্গি এবং লংক্ৰথ। দোকানে পা দিলেই মনে হয় দবির মিয়া এই ক বছর প্রচুর পয়সা করেছে। জহরকে ঢুকতে দেখেই সে ক্যাশবাক্স থেকে একটা পাঁচ টাকার নোট বের করল, দুইটা চা আর পান নিয়ে আয়।

যে-লোকটিকে পান আনতে বলা হল সে বেশ বয়স্ক। পরিস্কার কাপড়চোপড় গায়ে। এদেরকে এত সহজে তুই বলা যায় না। কিন্তু দবির অনায়াসে বলছে। লোকটি জহুরের দিকে তাকিয়ে বলল, ভাই সাহেব, শরীরটা ভালো?

জ্বি ভালো। আপনি ভালো?

জ্বি-জ্বি। আমাশা হয়েছিল, এখন আরাম হয়েছে।

দবির মিয়া প্ৰচণ্ড ধমক দিল, চা না আনতে কইলাম?

লোকটি কাঁচুমাচু ভঙ্গি করে চা আনতে গেল। দবির মিয়া বিরক্ত মুখে বলল, যার তার সাথে আপনি-আপনি করাটা ঠিক না। ভদ্রলোকের সাথে ভদ্রলোকের ব্যবহার। ছোটলোকের সাথে ছোটলোকের। এই রামজাদারে যে থাকতে দেই এই তার বাপের ভাগ্য।

লোকটা কে?

কেউ না, পাহারা দেয়। রাত্রে দোকানের ভিতরে ঘুমায়। নীলগঞ্জ কেমন দেখলা?

অনেক জমজমাট। নতুন নতুন দালান-কোঠা।

দালান-কোঠা পর্যন্তই সার–আর কিছু নাই। ব্যবসাপাতি বন্ধ। টাকাপয়সার নাড়াচাড়া নাই। অবস্থা সঙ্গিন।

তাই নাকি?

এতটুক জায়গার মধ্যে দুইটা আইস মেশিন। মাছ যা ঘাটে ওঠে তার সবটাই। বরফ দিয়ে ঢাকা পাঠিয়ে দেয়।

দবির মিয়া থু করে ঘরের মধ্যে একদলা থুথু ফেলল।

আসছ যখন, নিজেই বুঝবে। এক ভাগ পাবদা মাছ দশ টাকা চায়। খাওয়াখাদ্য এখন নাই বললেই হয়।

চা এবং পান এসে পড়ল। লোকটি জহুরের দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে বলল, আপনে যে আইছেন, সবাই জানে। ছোট চৌধুরী খুব ভয় খাইছে।

দবির মিয়া প্রচণ্ড ধমক দিল।

কত বার বলছি, ফালতু কথা বলবি না। চুপ। একদম চুপা লোকটি চুপ মেরে গেল। জহুর দেখল লোকটির গায়ে ফর্সা পায়জামা-পাঞ্জাবি আছে ঠিকই কিন্তু খালি পা। যারা খালি পায়ে চলাফেরা করে তাদের সহজেই তুই সম্বোধন করা যায়।

বাড়ি ফিরবার পথে দবির মিয়া নানা কথা বলতে লাগল।

কি হয়েছে না-হয়েছে, এইসব মনে রাখা ঠিক না। নতুন করে সব কিছু শুরু করা দরকার। ঠিক না জহর?

হুঁ।

বয়স তোমার এমন কিছু হয় নাই। বিয়ে-শাদি করা দরকার। মেয়ের জন্য। চিন্তা করবে না। এই দেশে মেয়ের অভাব আছে এই কথাটা ভুল। হা-হা-হা।

জহুর চুপ করে থাকল।

রুজি-রোজগারের চেষ্টা করা দরকার। সেইটাও আমি ব্যবস্থা করব। একটা লঞ্চ কিনার চেষ্টায় আছি। বিশ্বাসী লোকজন আমার নিজেরই দরকার। বুঝলে নাকি জহুর?

জহুর হঠাৎ অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল। ফস করে জিজ্ঞেস করল, বদি ভাইয়ের বৌ কি এখনন নীলগঞ্জেই থাকে?

কেন?

এমনি জিজ্ঞেস করছি।

থাকে।

শ্বশুরবাড়িতেই থাকে?

হুঁ।

সংসার চলে কীভাবে?

কি জানি কীভাবে। কে খোঁজ রাখে?

দবির মিয়া বিরক্ত হয়ে একদলা থুথু ফেলল। থেমে থেমে বলল, পুরান জিনিস ঘাঁটাঘাঁটি করা ঠিক না।

দবির মিয়ার বাড়ির আলো দেখা যাচ্ছে। বাহাদুর আর বাবলুর তাড়স্বরে পড়া শোনা যাচ্ছে। দবির মিয়া গলা খাঁকারি দিয়ে আবার বলল, পুরান জিনিস ঘাঁটাঘাঁটি করা ঠিক না।

তাকে ঈষৎ চিন্তিত মনে হল।

সেদিনও সে ঈষৎ চিন্তিত হয়েছিল।

 

রাত সোয়ানটার সময় নীলগঞ্জ থানার দারোগা শামসুল কাদের তাকে থানায় ডাকিয়ে নিয়েছিলেন। জহুর আলি সংক্রান্ত কী-একটা গোলমাল। এরকম গোলমাল জহুরকে নিয়ে লেগেই আছে। নিৰ্ঘাত কাউকে ধমকামকি করেছে। দবির মিয়া থানায় যাবার আগে স্ত্রীর সঙ্গে খুব রাগরাগি করল, আর এইসব ঝামেলা নিতে পারব না। যথেষ্ট হয়েছে। মানসম্মান সব গেছে। ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে যদি না দিই তাহলে আমার নাম……

থানায় গিয়ে দবির মিয়া আকাশ থেকে পড়ল। জহুর আলিকে শম্ভুগঞ্জে খুনের দায়ে গ্রেফতার করা হয়েছে। খুন হয়েছে বদি। ব্যাপারটি এমনই অবিশ্বাস্য যে দবির মিয়া ঘটনার উপর তেমন গুরুত্ব দিল না। ভুল হয়েছে বলাই বাহুল্য। কিন্তু সমস্তটাই অল্প সময়ের মধ্যে জট পাকিয়ে গেল। তাজ বোর্ডিংয়ের মালিক বলল, জহরকে সে ৯ নম্বর ঘর থেকে বের হতে দেখেছে, তার শার্ট রক্তমাখা ছিল। এবং সে তাজ বোর্ডংয়ের মালিককে দেখে ঘুট করে সরে পড়ে। কী সর্বনাশের কথা!

দবির মিয়া শম্ভুগঞ্জ থানা হাজতে দেখা করতে গেল। উকিল-টুকিল দিতে হয়, শতেক ঝামেলা। জহুরকে খুব বিচলিত মনে হল না। সে বেশ স্বাভাবিকভাবে বলল, মিথ্যা মামলা দুলাভাই। হোট চৌধুরীর কারবার। কিছু হবে না। বদি ভাইকে আমি খুন করব কেন?

তুই তার হোটলে গেছিলি কি জন্য?

গল্প করবার জন্যে গেছিলাম।

দবির মিয়া কপালের ঘাম মুছে ক্লান্ত স্বরে বলল, এখন আমি করি কি?

কিছু করতে হবে না, বসে থাকেন চুপচাপ। বড়োআপা কেমন আছে?

দবির মিয়া তার জবাব না দিয়ে ভোঁ ভেউ করে কেঁদে ফেলল।

যান, ঘোট চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেন। কাঁদবার তো কিছু হয় নাই।

কাঁদবার কিছু হয় নাই, বলিস কি তুই! আমার কি টাকাপয়সা আছে?

টাকাপয়সার কী দরকার? টাকাপয়সা ছাড়া মামলা-মোকদ্দমা হয়?

দুলাভাই, আপনি চৌধুরী সাহেবের কাছে যান।

ছোট চৌধুরী দবির মিয়ার উপর দারুণ রেগে গেলেন।

খুন হয়েছে বলি, ধরেছে তোমার শালাকে, আমি এর মধ্যে কে? তোমার শালার মাথা আধা-খারাপ আমরা জানি, তোমারটাও যে খারাপ, তা তো জানতাম না।

দবির মিয়া আমতা-আমতা করতে লাগল।

যাও, ভালোমতত উকিল-টুকিল দেও। পয়সাপাতি খরচ কর। অপরাধ একটা করে ফেলেছে, কী আর করা। চেষ্টাটা তোকরাই লাগে।

খুন সে করে নাই চৌধুরী সাহেব।

তুমি আমি বললে তো হবে না–দেখবে কোর্ট।

দবির মিয়া দীর্ঘ সময় চুপচাপ থেকে বলল, জহুরের মাথাটা গরম, আপনার সঙ্গে বেয়াদপি করেছে অনেক বার……

কথার মাঝখানে তাকে থামিয়ে দিয়ে চৌধুরী সাহেব রাগী গলায় বললেন, এই জন্যে আমি তারে খুনের আসামী দিয়ে দিলাম? অন্য কেউ এই কথা বললে আমি তারে জুপিটা করতাম। নেহায়েত দুঃখে-ধান্ধায় তোমার মাথার ঠিক নাই, তাই কিছু বললাম না।

দবির মিয়া বাসায় ফিরে দেখে তার স্ত্রীর এবরশন হয়েছে। এখন-তখন অবস্থা। দুপুররাতে তাকে নিয়ে ময়মনসিংহ সদর হাসপাতালে যাবার জন্যে ট্রেনে উঠতে হল। কপাল খারাপ থাকলে যা হয়। যে ট্রেনের চার ঘন্টার মধ্যে ময়মনসিংহ পৌছার কথা, সেটা পৌছল ন ঘন্টা পর। ময়মনসিংহ স্টেশনে মরা লাশ নিয়ে দবির মিয়া গলা ফাটিয়ে কাঁদতে লাগল। তার চারপাশে লোক জমে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *