দেবদেবীর অজাচার
আগের অধ্যায়ে আমরা দেবালোকের অজাচার ও ব্যভিচার সম্বন্ধে আলোচনা করেছি । দেবতাদের বিশেষ যৌনাচারকে আমরা অজাচার ও ব্যভিচার বলে বর্ণনা করেছি। এই কারণে যে, যে সমাজের প্রতিরূপে দেবীসমাজ কল্পিত হয়েছিল, সে সমাজে আজ এরূপ আচরণ অজাচার ও ব্যভিচার বলে পরিগণিত হয়। কিন্তু নৃতত্ত্ববিদগণ বলেন যে এসব মানুষের মনগড়া। এ সম্বন্ধে Havelock Ellis তাঁর Psychology of Sex বইয়ে বলেছেন–“Freud holds that there is from infancy a strong natural instinct to incest; Mallinowski does not accept the aversion to incest as natural but as introduced by culture, a complex scheme of cultural reactions’. . . . . . .There is a sexual attraction towards persons with whom there is close contact, such persons being often relations, and the attraction being therefore termed incestuous.” Vestermarck তাঁর History of Human Marriage বইয়ের প্রথম সংস্করণে অজাচারকে মানুষের সহজাত প্ৰবৃত্তি বলতে চান নি, কিন্তু পরবর্তী সংস্করণে অজাচার মানুষের স্বভাবজাত প্ৰবৃত্তি বলে মত প্ৰকাশ করেন । এ সম্পর্কে Crawley, Heape প্ৰভৃতি মনীষীগণও ওই মত পোষণ করেছেন । সামাজিক রীতিনীতির প্রতিক্রিয়াতেই মানুষের মনে অজাচার সম্বন্ধে ধারণা গড়ে উঠেছে বলেই এ সম্বন্ধে এক সমাজের রীতিনীতি অপর সমাজের কাছে সম্পূর্ণ দুষ্ট । বর্তমান শতাব্দীর গোড়াতেই একজন বিখ্যাত সমাজতত্ত্ববিদ উইলিয়াম গ্রাহাম সামনার বলেছিলেন যে লোকাচারই স্থির করে দেয় কোনটা দুষ্ট, আর কোনটা দুষ্ট নয় ! আমার নানা লেখার মধ্যে আমি বার বার একথা বলেছি যে আচার ব্যবহার, রীতিনীতি ইত্যাদি সম্বন্ধে সামাজিক স্বীকৃতিই হচ্ছে আসল জিনিষ । এক সমাজ যেটা অনুমোদন করবে, আর এক সমাজ সেটা অনুমোদন না-ও করতে পারে । আবার যে কোন সমাজে এককালে যে আচরণ স্বীকৃত হত, পরবর্তীকালে সেই সমাজ কর্তৃকই সেটা স্বীকৃত না-ও হতে পারে । আমাদের বাঙালী সমাজেই এ-রকম ঘটনা বার বার ঘটেছে । ১৯১৮ খ্ৰীষ্টাব্দে “ম্যান ইন ইণ্ডিয়া’ পত্রিকায় আমি দেখিয়েছিলাম যে এক সময় বাঙালী সমাজে শালীবরণ ও দেবরবরণ এই দুই প্ৰথাই প্ৰচলিত ছিল । বর্তমানকালে কন্যার বিবাহের সময় অনুসৃত জামাইবরণ প্রথা শালীবরণ প্রথার অন্তিম নিদর্শন ।
।। দুই ।।
এবার শুনে চমকে উঠবেন না ষে সহোদরাকে বিবাহ করা যদিও আজকের হিন্দুর কাছে অজাচার বলে গণ্য হয় তা হলেও এরূপ বিবাহ এক সময়ে ভারতীয় সমাজে স্বীকৃত হত। বাঙালী সমাজেও হত । এর প্রমাণ আমরা পাই সিংহল দেশের ‘দীপবংশ’ ও ‘মহাবংশ’ নামে দুই প্ৰাচীন গ্ৰন্থ থেকে । সেখানে বিবৃত হয়েছে যে গৌতম বুদ্ধের অবিভাবের পূর্বে বঙ্গদেশের বঙ্গনগরে এক রাজা ছিলেন। তিনি কলিঙ্গদেশের রাজকন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। তঁদের এক অতি সুন্দরী কন্যা হয় ; কিন্তু সে অত্যন্ত দুষ্টা ছিল । সে একবার পালিয়ে গিয়ে মগধ-যাত্রী এক বণিকের দলে ঢুকে যায়। তারা যখন বাঙলার সীমানায় উপস্থিত হয়, তখন এক সিংহ তাদের আক্রমণ করে। বণিকেরা ভয়ে পালিয়ে যায় । কিন্তু রাজকন্যা সিংহকে তুষ্ট করে তাকে বিবাহ করে । মনে হয় এখানে আক্ষরিক অর্থে ‘সিংহ’ না ধরে, সিংভূম জেলার ‘সিংহ’ উপাধিধারী কোন উপজাতীয়কে ধরে নিলে, এর অর্থ খুব সরল হয়ে যাবে। ওই সিংহের ঔরসে মেয়েটির গর্ভে সিংহবাহু নামে এক পুত্র এবং এক কন্যা জন্মে। সিংহবাহু বড় হয়ে সিংহকে হত্যা করে ও নিজ ভগ্নীকে বিবাহ করে । পরে রাঢ়দেশে সে এক রাজ্য প্ৰতিষ্ঠা করে । সহোদরার গর্ভে ও তার ঔরসে সিংহবাহুর অনেকগুলি পুত্ৰ সন্তান হয়। প্রথম দুটির নাম বিজয় ও সুমিত্র । বিজয় অত্যন্ত দুর্বিনীত ও অত্যাচারী ছিল । তার দুর্ব্যবহারে রাজ্যবাসীগণ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে । বাধ্য হয়ে রাজা সাতশত অনুচরের সঙ্গে বিজয়কে এক নৌকা বরে সমুদ্রে পাঠিয়ে দেন । বিজয় নৌকাযোগে লঙ্কাদ্বীপে এসে, কুবেনী নামে এক যক্ষিণীকে বিবাহ করে ও সিংহল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে । বিজয় যেদিন লঙ্কাদ্বীপে গিয়ে পৌঁছেছিল, সেদিনই কুশীনগরে ভগবান বুদ্ধ মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন । এই কাহিনী থেকে দুটি তথ্য প্ৰকাশ পায়। প্ৰথম, বিজয়ের সময়কাল ভগবান বুদ্ধের সমকালীন ও দ্বিতীয় বিজয়ের পিতা সিংহবাহু নিজ সহোদরাকে বিবাহ করেছিলেন ।
।। তিন ।।
নিজ সহোদরা বা সমগোত্ৰীয়াকে বিবাহ করা প্ৰাচীনকালে প্ৰাচ্য ভারতে প্ৰচলিত ছিল। বৌদ্ধ জাতকগ্ৰন্থ সমূহে আমরা এর ভুরিভুরি প্ৰমাণ পাই । বৌদ্ধ সাহিত্যের এক জায়গায় আমরা পড়ি যে, রাজা ওঙ্ককের ( ইক্ষাকুর ) প্ৰধানা মহিষীর গর্ভে পাঁচ ছেলে ও চার মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। ওই প্ৰধান মহিষীর মৃত্যুর পর রাজা এক যুবতীকে বিবাহ করেন । এই রাণীর যখন এক পুত্র হয়, তখন তিনি রাজাকে বলেন যে তাঁর ছেলেকেই রাজা করতে হবে । রাজা তার প্রথম মহিষীর পাঁচ পুত্র ও চার মেয়েকে হিমালয়ের পাদদেশে নির্বাসিত করেন। সেখানে কপিলমুনির সঙ্গে তাদের দেখা হয়। কপিলমুনি তাদের সেখানে একটি নগর স্থাপন করে বসবাস করতে বলেন । এই নগরের নামই কপিলাবস্তু হয় । ভ্রাতাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ অকৃতদার রইলেন। আর বাকী চার ভাই চার বোনকে বিবাহ করে । ‘মহাবস্তু’ নামে বৌদ্ধগ্রন্থে এই কাহিনীটা আছে ।
বৌদ্ধ সাহিত্যের আর এক কাহিনীতে (অশ্বতথ সুত্ত ১৷১৬ ; কুনাল জাতিক ৫৩৬) শাক্যরা ছিল পাঁচ বােন ও চার ভাই। এই কাহিনী অনুযায়ী জ্যেষ্ঠ ভগিনীকে তারা মাতৃরূপে বরণ করে, আর চার ভাই চার বোনকে বিবাহ করে ।
বৌদ্ধ সাহিত্যের আর এক কাহিনী পড়ুন। বুদ্ধঘোষের ‘পরমথজ্যোতিকা,’ ( ক্ষুদ্দকপথ পৃঃ ১৫৮-৬০ ) কাহিনী অনুযায়ী বারানসীর রাজার প্রধান মহিষী একখণ্ড মাংসপিণ্ড প্রসব করেন । তিনি ওই মাংসপিণ্ডটিকে একটি পেটিকায় করে নদীতে ভাসিয়ে দেন । ওটা যখন ভেসে যাচ্ছিল, তখন একজন মুনি ওটাকে তুলে সংরক্ষণ করেন। পরে ওই মাংসপিণ্ড থেকে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে উৎপন্ন হয়। তাদের নাম লিচ্ছবী দেওয়া হয় । এদের দুজনের মধ্যে বিবাহ হয়, এবং এরা বৈশালী রাজ্য স্থাপন করে ।
আবার দশরথজাতক অনুযায়ী পূর্বকালে বারানসীর রাজা দশরথের প্রধান মহিষীর গর্ভে তিন সন্তান জন্মায়–রামপণ্ডিত, লক্ষণকুমার ও সীতাদেবী। ওই মহিষীর মৃত্যুর পর দশরথ অপর একজনকে প্রধান মহিষী করেন । তার গর্ভে ভরত নামে এক সন্তানের জন্ম হয় । দশরথ একবার ভারতের মাকে একটা বর দিয়েছিলেন । সেই বরের জোরে ভরতের মা ভরতকে রাজা করতে হবে বলে দাবী করেন । তখন দশরথ রাম ও লক্ষণকে দুরান্তরে গিয়ে থাকতে বলেন, এবং বলেন যে বারো বছর পরে তাঁর মৃত্যু ঘটলে রাম যেন ফিরে এসে রাজ্যভার গ্ৰহণ করে । রাজার এই কথায় রাম ও লক্ষণ সীতাকে নিয়ে হিমালয় প্রদেশে চলে যান । এর নয় বৎসর পরে দশরথের মৃত্যু ঘটে । তখন ভরত রামকে ফিরিয়ে আনতে যায় । কিন্তু বারো বৎসর পূর্ণ হবার আগে রাম ফিরতে চাইলেন না । বারো বৎসর উত্তীর্ণ হলে, রাম বারানসীতে ফিরে এসে রাজা হন ও সীতাকে বিবাহ করে তাঁর মহিষী করেন ।
সহোদরাকে বিবাহ করার কাহিনীসমূহ যে মাত্র বৌদ্ধ সাহিত্যে আছে, তা নয়। অন্যান্য সাহিত্যেও আছে। অন্যান্য সাহিত্যে যে সব প্ৰমাণ আছে, তা থেকে মনে হয় যে প্ৰাচ্যভারতে সহোদরার অভাবে অন্য বোনকেও বিবাহ করা যেত । অৰ্দ্ধমাগধী ভাষায় রচিত জৈন্য সাহিত্যে এরূপ বিবাহের উল্লেখ আছে যেমন নন্দিতা বিবাহ করেছিল, তার মাতুলকন্যা রেবতীকে ।
আমি আমার ‘ভারতের বিবাহের ইতিহাস’ গ্রন্থে দেখিয়েছি যে ( দশরথজাতকে বিবৃত ) মাত্র রামই নিজ ভগিনীকে বিবাহ করেন নি, রামের পিতা দশরথও তাই করেছিলেন । দশরথের সঙ্গে কৌশল্যার বিবাহই তার দৃষ্টান্ত । দশরথ কৌশল বংশের নৃপতি ছিলেন । কৌশল্যাও যে সেই বংশেরই মেয়ে ছিলেন, তা তার নাম থেকেই প্ৰকাশ পাচ্ছে । ( তুলনা করুন গান্ধারী, মাদ্রী, কৈকেয়ী, বৈদেহী, কুন্তী, দ্ৰৌপদী ইত্যাদি ) । সুতরাং নিজ বংশেই যে রাজা দশরথ বিবাহ করেছিলেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই । আজকালিকার দৃষ্টিভঙ্গীতে ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহ, অজাচার বলে গণ্য হবে । কিন্তু উত্তর ভারতের পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলে ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহ যে এক সময় প্ৰচলিত প্ৰথা ছিল এবং তার সামাজিক স্বীকৃতিও ছিল, তা উপরের কাহিনীসমূহ থেকে প্ৰকাশ পায় ।
।। চার ।।
এইবার প্রাচীন কাল ছেড়ে দিয়ে, বর্তমান কালে আসুন । বর্তমানে উত্তর ভারতের বিবাহ গোত্ৰ-প্ৰবর ও সপিণ্ড বিধিদ্বারা নিয়ন্ত্রিত । তার মানে বিবাহে নিজ গোত্র-প্ৰবর ও সপিণ্ড পরিহার্য । কিন্তু এর শিথিলতা আমরা দক্ষিণ ভারতে লক্ষ্য করি । সেখানে মামা-ভগ্নীর মধ্যে বা মামাতো বোন কিংবা পিসতুতো বোনের সঙ্গে বিবাহই বাঞ্ছনীয় বিবাহ । তবে যেখানে মামা-ভাগ্নীর মধ্যে বিবাহ ( যেমন তামিলনাড়ুতে ) প্ৰচলিত আছে, সেখানে এরূপ বিবাহ সম্বন্ধে একটা বিশেষ বিধি নিষেধ লক্ষ্য করা যায়। সেখানে বিবাহ মাত্র বড় বোনের মেয়ের সঙ্গেই হয় । ছোট বোনের মেয়ের সঙ্গে হয় না । মারাঠা দেশে এরূপ বিবাহ মাত্র পিতৃকেন্দ্ৰিক জাতিসমূহের মধ্যেই দেখা যায়। মাতৃকেন্দ্ৰিক জাতিসমূহের মধ্যে এটা নিষিদ্ধ। সে যাই হোক, উত্তর ভারতের দৃষ্টিভঙ্গীতে এটা অজাচার, কেননা মাতুল পিতারই সমপর্যায়ের লোক ।
ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহ মাত্র পিসতুতো বোন ও মামাতো বোনের সঙ্গেই হয় । তার মানে এক ক্ষেত্রে বিবাহ হয় মামাতো ভায়ের সঙ্গে, আর অপর ক্ষেত্রে বিবাহ হয় মামাতো বোনের সঙ্গে । মাসতুতো বোনের সঙ্গে বিবাহ যদিও দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতে সাধারণভাবে নিষিদ্ধ, তথাপি এর প্রচলন দেখতে পাওয়া যায় অন্ধ্রপ্রদেশের কোমতি ও কুরুর জাতিদ্বয়ের মধ্যে । তার মানে এদের সমাজে মাসতুতো বোনকেও বিবাহ করা যায়। কর্ণাটকের কোন কোন জাতির মধ্যে এর প্রচলন আছে ; তবে কর্ণাটক দেশে দশস্থ ব্ৰাহ্মণরা ভাগ্নী ও মামাতো বোনকেই বিবাহ করে ।
যদিও উত্তর ভারতে ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহ সাধারণভাবে প্ৰচলিত নেই, তথাপি অনুমান করা যেতে পারে যে, এক সময় এর ব্যাপকতা ছিল । আমরা আগেই বলেছি যে বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যে এর বহু উল্লেখ আছে। বর্তমানে ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহ রাজস্থান, মধ্যপ্ৰদেশ, গুজরাট, কাথিয়াবাড়, মহারাষ্ট্র ও ওড়িষার কোন কোন জাতির মধ্যে প্রচলিত থাকতে দেখা যায়। রাজপুতদের মধ্যে মামাতো বোনের সঙ্গে বিবাহ বাধ্যতামূলক না হলেও, এরূপ বিবাহ প্রায়ই সংঘটিত হতে দেখা যায়। রাজস্থান, কাথিয়াবাড়, ও গুজরাটের রাজন্যবর্গের মধ্যে এরূপ বিবাহের অনেক নিদর্শন আছে । যোধপুরের রাজপরিবারে পিসতুতো বোনের সঙ্গে বিবাহের দৃষ্টান্ত আছে, মামাতো বোনের সঙ্গে নেই । তার মানে, মামাতো বোনের সঙ্গে বিবাহ এক্ষেত্রে অনুমোদিত নয়। কিন্তু কাথি, আহির ও গাধব চারণদের মধ্যে মামাতো বোনের সঙ্গে বিবাহের কোন বাধা নেই । মহারাষ্ট্রের কুন্নবীদের মধ্যে কোন কোন শাখা ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহ অনুমোদন করে, কিন্তু অপর কতিপয় শাখা তা করে না । মধ্য মহারাষ্ট্রের মারাঠাদের মধ্যে কোন কোন সম্প্রদায়ের লোক মাত্র মামাতো বোনের সঙ্গে বিবাহ অনুমোদন করে, কিন্তু ওর দক্ষিণে অবস্থিত লোকেরা মামাতো ও পিসতুতো উভয়শ্রেণীর বোনের সঙ্গেই বিবাহ মঞ্জুর করে । প্রাচীন কালেও যে এর প্রচলন ছিল তার প্রমাণ রুক্মিণীর গর্ভজাত শ্ৰীকৃষ্ণের জ্যেষ্ঠ পুত্ৰ প্ৰদ্যুম্ন তার মাতুলকন্যা কুকুন্দমতীকে বিবাহ করেছিল।
।। পাঁচ ।।
আদিবাসী সমাজেও অনেক রকম বিবাহ প্ৰথা আছে, যা হিন্দু সমাজের দৃষ্টিতে অজাচার বলে গণ্য হবে। দুটি বিশেষ ধরনের বিবাহ প্রথা উত্তর-পূর্ব সীমান্তের আদিবাসী সমাজে প্রচলিত আছে। আসামের গারো জাতির লোকেরা বিধবা শ্বাশুড়ীকে বিবাহ করে, আর লাখের, বাগনী ও ডাফল জাতির লোকেরা বিধবা বিমাতাকে বিবাহ করে । শ্বাশুড়ীকে কিংবা বিমাতাকে বিবাহ করা এদের কাছে অজাচার নয়। আগেই বলেছি যে সমাজই বিধান দেয়, কোনটা অজাচার, আর কোনটা অজাচার নয় । গারোদের কথাই ধরা যাক । গারোরা যখন শ্বাশুড়ীকে বিয়ে করে, তখন সেটা অজাচার নয় । কিন্তু গারোদের উপশাখা সাঙমারা যদি কোন সাঙমা উপশাখার মেয়েকে বিয়ে করে, তাহলে সেটা অজাচার । তখন তাকে মাডোঙ বলা হয় । ‘মাডোঙ’ মানে ‘যে লোক নিজের মাকে বিয়ে করে ।’ তবে শ্বাশুড়ীকে বিয়ে করা, মাত্র গারো সমাজেই প্রচলিত প্রথা নয় । অন্যত্রও এর প্ৰচলন আছে। মধ্য ব্ৰেজিলের টুপি-কোওয়াহিব জাতির লোকেরা একসঙ্গেই শ্বাশুড়ী ও তার মেয়েকে বিয়ে করে ।
আমরা আগেই বলেছি যে লাখের, বাগনী ও ডাফলাজাতির লোকেরা বিমাতাকে বিয়ে করে । এরূপ বিবাহের জন্য বাগনীজাতির বৃদ্ধ পিতারা যখন দ্বিতীয়বার বিবাহ করে তখন বিশেষভাবে অধিক যুবতী মেয়েদের নির্বাচন করে বিবাহ করে, যাতে তার মৃত্যুর পর তার পুত্র যুবতী বিমাতাকেই স্ত্রীরূপে লাভ করতে পারে ।
মা-মাসীকে বিয়ে করাটা যে একেবারে অজাচার এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই । অথচ, এর বিপরীত প্ৰথাটা তো দক্ষিণ ভারতের কিছু সমাজেই প্ৰচলিত আছে। মাতুলের কাছে ভাগ্নী তো কন্যাসম, এবং ভাগ্নীর কাছে মাতুল তো পিতাসম অথচ মামা-ভাগ্নীর মধ্যে বিবাহটািই হচ্ছে সেখানে বাঞ্ছনীয় বিবাহ। তবে একটা কথা এখানে বলা প্রয়োজন । গারোদের মধ্যে পিতার মৃত্যুর পর পুত্র যাতে যুবতী বিমাতাকে স্ত্রীরূপে পায়, তার জন্য গারো পিতার কমবয়সী মেয়েদেরই দ্বিতীয় স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করে। কিন্তু দক্ষিণ ভারতের হিন্দু সমাজে যেখানে বাঞ্ছনীয় বিবাহ প্রচলিত আছে, সেখানে অনেক সময়ই দেখা যায় যে বাঞ্ছনীয় কন্যা বরের মাতার বয়সী । সেজন্য এরূপ বিবাহে বর ও কনের বয়সের মধ্যে যত বছরের তফাৎ, বিবাহের সময় কনেকে ততগুলো নারিকেল কোমরে বেঁধে নিয়ে বিবাহ করতে হয় ।
।। ছয় ।।
পিতা-পুত্রীর বা মাতা-পুত্রের মধ্যে যৌনমিলনের কথা দেশবিদেশের পুরাণেও বিবৃত আছে। আমাদের পুরাণ অনুযায়ী ব্রহ্মা নিজ কন্যা শতরূপাকেই বিবাহ করেছিলেন । এদের সঙ্গমের ফলে মনুর জন্ম হয়। মনু থেকে পৃথিবীতে মানবজাতির সৃষ্টি হয় । সুতরাং মানুষের রক্তের মধ্যেই অজাচারের বীজ গোড়া থেকে আছে ।
মাতা-পুত্রের মধ্যে যৌনমিলনের ক্লাসিক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় গ্ৰীক পুরাণে-জোকাষ্টা ও ইডিপাসের কাহিনীতে । এই কাহিনী অনুযায়ী থিবসের রাজা ইডিপাস। তাঁর নিজ গৰ্ভধারিনী মাতাকেই বিবাহ করেছিল, এদের দুজনের মধ্যে সঙ্গমের ফলে দুই পুত্র পলিওনিসেন ও ইটিওক্লিস ও তুই কন্যা অ্যানটিগনি ও ইসমিন জন্মগ্রহণ করে ।
এরূপ সঙ্গম যে দেবসমাজে অনিন্দনীয় ছিল, তা অর্জুনের প্রতি উর্বশীর উক্তি থেকে প্রকাশ পায় ।
।। সাত ।।
উপরি-উক্ত কাহিনীসমূহ থেকে বোঝা যায় যে মনুষ্যসমাজে অজাচারের অন্ত নেই। এবার আমি অজাচারের একটা সংজ্ঞা দিতে চাই। পাত্র-পাত্রী এই উভয়ের মধ্যে যেখানে রক্তের সম্পর্ক আছে, সেখানে যদি যৌনমিলন ঘটে, তাহলে সেটাই অজাচার । কিন্তু যেখানে রক্তের সম্পর্ক আছে, সেখানে গোপন যৌনমিলন তো আখচারই ঘটে ।
এক কথায়, যেখানে রক্তের সম্পর্ক আছে, সেখানে ওটা অজাচার । আর যেখানে রক্তের সম্পর্ক নেই, সেখানে ওটা ব্যভিচার । কিন্তু এরূপ সম্পর্ক যদি সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত হয়, তাহলে এটা অজাচার নয়। উত্তর ভারতে হিন্দুদের মধ্যে অজাচার পরিহার করবার জন্য যে সকল সামাজিক বিধি নিষেধ আছে, সেগুলো হচ্ছে- গোত্রভেদ, প্রবরভেদ ও সপিণ্ডবিধান। শেষোক্ত বিধান অনুযায়ী পিতৃকুলে ও মাতৃকুলে চার পুরুষ পরিহার করতে হয়। দক্ষিণ ভারতের হিন্দুদের মধ্যেও গোত্ৰ-প্রবর বিধিনিষেধ আছে, কিন্তু সপিণ্ডবিধান যথেষ্ট শিথিল । এ রকম শিথিলতা আমরা আদিবাসী সমাজেও লক্ষ্য করি । যেমন গারোদের মধ্যে আমরা দেখেছি যে বিমাতাকে বিয়ে করা অজাচার নয়, কিন্তু নিজ গভর্ধারিণী মাতা বা একই উপশাখার মধ্যে অন্য মেয়েকে বিয়ে করা অজাচার। অজাচার সম্বন্ধে এসব বিচিত্র রীতি যে মাত্র হিন্দু বা আদিবাসী সমাজেই প্ৰচলিত, তা নয়। প্ৰাচীন মিশর ও ইনকা রাজপরিবারসমূহে এর প্রচলন ছিল । পৃথিবীর অন্যান্য দেশসমূহেও তাই । ইংলেণ্ডের কথাই ধরুন । ইংলেণ্ডে অজাচার বলে কিছু ছিল না, যতক্ষণ না, তা যাজকীয় আদালতসমূহের দৃষ্টির মধ্যে আসত। কিন্তু ১৯০৮ খ্ৰীষ্টাব্দে ‘ইনসেষ্ট অ্যাক্ট ১৯০৮’ প্ৰণীত হবার পর থেকে, অপরাধ হিসাবে অজাচার সাধারণ আদালতের বিচারাধীন হয়েছে । ১৯০৮ খ্ৰীষ্টাব্দের এই আইন অনুযায়ী যদি কোন পুরুষ তার নাতনী, মেয়ে, বোন বা মায়ের সঙ্গে যৌন সংসৰ্গ করে, তবে তা অজাচার বলে গণ্য হয় ও তার জন্য তাকে দণ্ড পেতে হয় । যে মেয়ের সঙ্গে সে যৌন সংসর্গে লিপ্ত হয়েছে তার সম্মতি থাকলেও সেটা অজাচার এবং ওই মেয়েকেও অনুরূপ দণ্ড পেতে হয় । এই আইন অনুযায়ী ভাই-বোন বলতে যে নিজের সহোদর-সহোদরাকে বুঝায় তা নয়। যে কোন রকমের ভাই-বোন হলেই, সেটা অজাচার । এই আইন অনুযায়ী পিতার পূর্ববর্তী স্ত্রীর পুত্র ও কন্যা, বা মাতার পূর্ববর্তী স্বামীর পুত্র ও কন্যাও দণ্ডনীয় অজাচারের অন্তভূক্ত ভাই-বোন । এই আইনের দিক থেকে যেটা লক্ষণীয়, তা হচ্ছে এখানে বিবাহের কথা বলা হয় নি, যৌন সংসর্গের কথাই বলা হয়েছে । এ সম্বন্ধে বিলাতের আইনের মধ্যে এক সূক্ষ্মতা আছে । যেমন শ্যালিকাকে বিবাহ করা যায়, কিন্তু শ্যালিকার সঙ্গে ‘যৌন সংসৰ্গ’ স্থাপন করা অজাচার। স্যার জেমস ফ্রেজারের আমল থেকে আজ পর্যন্ত নৃতত্ত্ববিদ ও সমাজতত্ত্ববিদগণ ‘অজাচার’ সম্বন্ধে ধ্যান-ধারণার নানা কারণ নির্দেশ করেছেন । কিন্তু আজ পর্যন্ত এর কোন সর্ববাদী-সম্মত মতবাদ উদ্ভূত হয় নি। মোট কথা, সমাজ যেটাকে অজাচার মনে করে, সেটাই অজাচার, আর যেটাকে অজাচার বলে গণ্য করে না, সেটা অজাচার নয় ।
।। আট ।।
অজাচারেরই সহােদর ভাই হচ্ছে ব্যভিচার । তবে ব্যভিচারের অর্থ অজাচারের চেয়ে অনেক ব্যাপক। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মধ্যে সমাজের বিধান-বহির্ভুত যৌন-সংসর্গ ঘটলেই সেটাকে অজাচার বলা হয়। এরূপ আত্মীয়ের মধ্যে যৌন মিলন স্থাপনের পক্ষে সমাজের যদি কোন বিধান না থাকে, তা হলে সেটা ব্যভিচারও বটে। নিজ স্বামী বা স্ত্রী ব্যতীত অপরের সঙ্গে যৌন সংসৰ্গ ঘটলেই সাধারণত তাকে ব্যভিচার বলা হয়। সে পুরুষ বা নারী নিজ ঘনিষ্ঠ, আত্মীয়ও হতে পারে, বা অপর কেউও হতে পারে। তবে অপর পুরুষের সঙ্গে যৌন-সংসর্গ সমাজ অনেক সময় ব্যভিচার বলে গণ্য করে না । যেমন প্ৰাচীন কালের নিয়োগ প্ৰথা, অতিথি সৎকারের জন্য স্ত্রীকে সমৰ্পণ করা, ধমীয় সংস্কার ও ধর্মীয় লাম্পট্য, বা বর্তমানকালে ওড়িষ্যায় জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার স্ত্রীকে যৌন-সংসর্গের জন্য গ্ৰহণ করা ।
নিয়োগ প্ৰথা সুবিদিত। তবে নিয়োগ প্ৰথা সম্বন্ধে এখানে দুএকটা কথা বলা প্ৰয়োজন । নিয়োগ প্ৰথায় যে যৌন অধিকার থাকত তা সাধারণ রমণের অধিকার নয় । মাত্র সন্তান উৎপাদনের অধিকার । সন্তান উৎপন্ন হবার পর এ অধিকার আর থাকত না | শাস্ত্র অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির ভ্ৰাতা বা কোন নিকট আত্মীয়, বিশেষ করে সপিণ্ড বা সগোত্রকেই এই উদ্দেশ্যে নিযুক্ত করা হত। নিয়োগ প্ৰথা অনুযায়ী মাত্র এক বা দুটি সন্তান উৎপন্ন করা হোত, তার অধিক নয়। শাস্ত্ৰে বলা হয়েছে যে সন্তান প্রজননের সময় উভয়ে নিজ নিজ চিত্তবৃত্তিকে এমনভাবে উন্নীত করবে যে পরস্পর পরস্পরকে শ্বশুর ও পুত্রবধু বিবেচনা করবে। ( উপমাটা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়) । সমাজের দৃষ্টিতে কোনটা অজাচার, আর কোনটা অজাচার নয়। সে সম্পর্কে এখানে স্মরণ রাখতে হবে যে এই উদ্দেশ্যে কেবলমাত্র কোন আত্মীয়কেই আহবান করা যেত, অপরকে নয়। স্মৃতিযুগের শেষের দিকে কিন্তু নিয়োগ প্রথা পরিত্যক্ত হয়েছিল। বৃহস্পতি বলেছেন কলিযুগে ‘নিয়োগ’ প্ৰথা যুক্তিযুক্ত নয়। মনু যদিও তার ধর্মশাস্ত্রের এক অংশে এর অনুমোদন করেছেন, অপর অংশে তিনি এই প্ৰথাকে সম্পূর্ণভাবে গৰ্হিত ঘোষণা করেছেন ।
।। নয় ।।
পরবর্তীকালের সমাজে পতিব্ৰতা স্ত্রীর যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল, সে সংজ্ঞা অনুযায়ী আগেকার যুগের সমাজের যৌনপ্ৰথাগুলি যে অজাচার বা ব্যভিচার ছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু প্ৰাচীনকালের সমাজে এগুলি অজাচার বা ব্যভিচার বলে গণ্য হত না । সেজন্যই অতিথির সঙ্গে সঙ্গমে রত হওয়া, সে যুগে ব্যভিচার বলে গণ্য হত না। মহাভারতের অনুশাসন পর্বে বর্ণিত সুদৰ্শন ও ওঘাবতী কাহিনী এ সম্বন্ধে বিশেষ আলোকপাত করে। এই কাহিনী অনুযায়ী সুদৰ্শন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ছিলেন। তিনি গৃহস্থাশ্রম পালন করেই মৃত্যুকে জয় করবেন। সংকল্প করেছিলেন । স্ত্রী ওঘাবতীকে অতিথি সৎকার কাজে নিয়োজিত করে তিনি তাকে আদেশ দেন যে প্ৰয়োজন হলে ওঘাবতী যেন নির্বিচারে নিজেকেও অতিথির কাছে সমৰ্পণ করে । কেননা, অতিথি অপেক্ষা শ্ৰেষ্ঠ ব্যক্তি আর কেউ নেই। একদিন তার আদেশের সততা পরীক্ষা করবার জন্য তাঁর অনুপস্থিতকালে যমরাজ স্বয়ং ব্ৰাহ্মণবেশে সেখানে উপস্থিত হয়ে ওঘাবতীর সঙ্গে সঙ্গম প্রার্থনা করেন। ওঘাবতী তার সঙ্গে যৌন মিলনে প্ৰবৃত্ত হয়। এই সময় সুদৰ্শন ঘরে ফিরে এসে। স্ত্রীকে সামনে দেখতে না পেয়ে তাকে বারবার ডাকতে থাকেন । কিন্তু কোন উত্তর পেলেন না । কেননা ওঘাবতী তখন ব্ৰাহ্মণের সঙ্গে যৌনমিলনে নিযুক্ত থাকায় নিজেকে অশুচি জ্ঞান করে স্বামীর আহবানে সাড়া দেন নি । এমন সময় অতিথি ব্ৰাহ্মণ ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে সুদৰ্শনকে বলেন যে ওঘাবতী তার কামনা পূর্ণ করেছে। ওঘাবতীর অতিথিপরায়ণতা দেখে সুদৰ্শন অত্যন্ত প্ৰীত হন । ধর্ম তখন আত্মপ্ৰকাশ করে বলে –‘সুদৰ্শন তুমি তোমার সততার জন্য এখন থেকে মৃত্যুকে জয় করলে ।’
মহাভারতের আদিপর্বে বর্ণিত উদ্দালক-শ্বেতকেতু কাহিনী থেকেও আমরা প্ৰাচীন ভারতে অতিথির সঙ্গে যৌন মিলনের নিদর্শন পাই। ওই কাহিনীর মধ্যে উদ্দালক বলেছিলেন–‘স্ত্রীলোক গাভীদের মত স্বাধীন। সহস্র পুরুষে আসক্ত হলেও তাদের অধৰ্ম হয় না–এটাই সনাতন ধর্ম ।’
।। দশ ।।
স্ত্রীকে অপরের হাতে সমর্পণ করা যে প্রাচীনকালে হিন্দু সমাজেই প্ৰচলিত ছিল, তা নয় । বর্তমানকালে আদিবাসী সমাজেও কোথাও কোথাও এ প্ৰথা প্ৰচলিত আছে । যেমন মধ্যপ্রদেশের সাথিয়া উপজাতির মধ্যে কোনও চুক্তির শর্ত হিসাবে বা ঋণের জামিন স্বরূপ উত্তমর্ণের কাছে নিজের স্ত্রী, কন্যা বা অপর কোন আত্মীয়াকে বন্ধক, রাখা যায়। ঋণ পরিশোধ বা চুক্তির শর্ত প্ৰতিপালন না হওয়া পর্যন্ত ওই স্ত্রী বা কন্যা পাওনাদারের গৃহে থাকে । বন্ধকী অস্থাবর সম্পত্তি ভোগদখল করবার যেমন উত্তমর্ণের অধিকার থাকে, এক্ষেত্রে ওই বন্ধকী স্ত্রী বা কন্যাকে উপভোগ করবার সম্পূর্ণ অধিকারও পাওনাদারের থাকে । এই অবস্থায় ওই পাওনাদারের স্ত্রী বা কন্যাকে উপভোগ করবার সম্পূর্ণ অধিকারও পাওনাদারদের থাকে । এই অবস্থায় ওই পাওনাদারের গৃহে স্ত্রী বা কন্যা যদি সন্তানবতী হয়, তা হলে সে নিজগৃহে পুনরায় ফিরে আসবার সময় ওই সন্তানকে পাওনাদারের গৃহে রেখে আসে। (তুলনা করুন তারা বৃহস্পতির গৃহে ফিরে অন্যাসবার আগে চন্দ্রের ঔরসে জাত সন্তানকে চন্দ্রের গৃহে রেখে এসেছিল ) । সাথিয়ারা স্ত্রী বা কন্যাকে বন্ধক রাখা মোটেই লজ্জাজনক বা নীতিবিগহিত ব্যাপার বলে মনে করে না।
।। এগার ।।
হিন্দুসমাজে ধর্মানুষ্ঠানের অঙ্গস্বরূপ পরস্ত্রীর সঙ্গে যৌন মিলনের অনুমোদন আছে। তান্ত্রিক সাধনার মূলকথা হচ্ছে প্ৰকৃতি ও পুরুষের মিলন । এই প্ৰকৃতি ও পুরুষের মিলনকে তন্ত্রশাস্ত্রে গুহ্যরূপ দেওয়া হয়েছে। তন্ত্রশাস্ত্ৰে পঞ্চ ‘ম’-কার সহকারে চক্ৰপূজার ব্যবস্থা আছে। পঞ্চ ‘ম’-কার হচ্ছে মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন। তন্ত্রপূজার এগুলি হচ্ছে অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ। তন্ত্রে শক্তিসাধনা বা কুলপূজার ওপর বিশেষ করে জোর দেওয়া হয়েছে। কোন স্ত্রীলোককে শক্তির প্রতীক ধরে নিয়ে তার সঙ্গে যৌন মিলনে রত থাকাই তান্ত্রিক সাধনার মূলতত্ত্ব। গুপ্তসংহিতায় বলা হয়েছে যে সে ব্যক্তি পামর যে ব্যক্তি শক্তিসাধনার সময় কোন স্ত্রীলোকের সঙ্গে মৈথুন ক্রিয়ায় নিজেকে না নিযুক্ত রাখে । নিরুক্ততন্ত্র এবং অন্যান্য অনেক তন্ত্রে বলা হয়েছে যে শক্তিসাধক কুলপূজা হতে কোনরূপ পুণ্যফল পায় না, যদি না সে কোন বিবাহিত নারীর সহিত যৌনমিলনে প্ৰবৃত্ত হয় । এ কথাও বলা হয়েছে যে, কুলপূজার জন্য কোন নারী যদি সাময়িকভাবে স্বামীকে পরিহার করে তবে তার কোন পাপ হয় না । সমাজের দৃষ্টিতে যাকে অজাচার বলা হয়, অনেক সময় এটা সে রূপও ধারণ করত। কেননা কুলচুড়মণিতন্ত্রে বলা হয়েছে যে, অন্য রমনী যদি না আসে তা হলো নিজের কন্যা বা কনিষ্ঠ বা জ্যেষ্ঠ ভগিনী, মাতুলানী মাতা বা বিমাতাকে নিয়েও কুলপূজা করবে। ( “অন্যা যদি ন গচ্ছেতু নিজকন্যা নিজানুজা । অগ্রজা মাতুলানী বা মাতা বা তসপত্নীকা। পূর্বাভাবে পরা পূজ্যা মদংশা যোষিতো মতাঃ।। একা চেৎ কুলশাস্ত্ৰজ্ঞ পুজাের্হা তত্র ভৈরব ।।” ) .
অনেক সময় ধর্মের রূপ দিয়ে কামাচারী ব্ৰাহ্মণ পুরোহিতরা বিবাহিতা নারীকে প্ৰলুব্ধ করত, তাদের সতীত্ত্ব বিসর্জন দিত । এরূপভাবে প্ৰলুব্ধ হয়ে সতীত্ব বিসর্জন দেবার এক কাহিনী অষ্টাদশ শতাব্দীর পর্যটক আবে দুবোয়া তার গ্রন্থে বিবৃত করে গেছেন । তিনি বলেছেন যে দক্ষিণ ভারতে এমন কতকগুলি মন্দির আছে যেখানকার পুরোহিতগণ প্রচার করে যে আরাধ্য দেবতার অত্যাশ্চর্য শক্তি আছে স্ত্রীলোকের বন্ধ্যতা দূর করবার। এরূপ মন্দিরের মধ্যে কর্নাটক দেশের তিরুপতির মন্দির বিশেষভাবে প্ৰসিদ্ধ । এখানকার দেবতা ভেন কাটেশ্বরের কাছে অসংখ্য স্ত্রীলোক আসে সন্তান কামনায় । পুরোহিতগণ কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে তারা মন্দিরে রাত্রি যাপন করে। পুরোহিতগণ তাদের বলে যে তাদের ভক্তিদ্বারা গ্ৰীত হয়ে ভেনকাটেশ্বর রাত্রিকালে তাদের কাছে আসবে এবং তাদের গর্ভবতী করে দিয়ে যাবে। তারপর যা ঘটতে, তা না বলাই ভাল। পাঠক তা সহজেই অনুমান করে নিতে পারেন । পরদিন প্ৰভাতে এই সকল জঘন্য চরিত্রের ভণ্ড তপস্বীরা কিছুই জানে না। এরূপ ভান করে ওই সকল স্ত্রীলোকের কাছে এসে দেবতার করুণা লাভ করেছে বলে তাদের পুন্যবতী আখ্যা দিয়ে তাদের কাছ থেকে দান গ্ৰহণ করত । দেবতার সঙ্গে তাদের যৌন মিলন ঘটেছে, এই আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে এই সকল হতভাগিনী নারীরা নিজ নিজ গৃহে ফিরে যেত ।
ধর্মানুষ্ঠানের নামে বিবাহিতা মেয়ের সতীত্ব সর্বপ্রথম নাশ করবার অধিকার কুলগুরুদের বাঙলা দেশেও ছিল । একে ‘গুরুপ্রসাদী’ বলা হত। এ প্রথা ইংলণ্ড ও স্কটল্যাণ্ডেও ছিল । এ প্রথাকে বলা হত – ‘Jus prima noctis,’ উনবিংশ শতাব্দীতে বাঙলাদেশে এই প্রথার কি ভাবে অবলুপ্তি ঘটেছিল, তার একটা সজীব চিত্র হুতোম তাঁর নকশায় দিয়েছেন । তিনি লিখছেন — চক্রবর্তীদের জামাই হরহরি বাবু সেই যে বিয়ের সময় স্ত্রীকে দেখেছিলেন আর দেখেন নি। পাঁচ বৎসর পর তিনি শ্বশুরবাড়ী এসেছেন । এবার হুতোমের ভাষায় বর্ণনাটা শুনুন । এদিকে চক্রবর্তী বাড়ীর গিন্নীরা পরস্পর বলাবলি করতে লাগল যে, ‘তাই তো গা ! জামাই এসেছেন, মেয়েও ষেটের কোলে বছর পনেরো হল, এখন প্ৰভুকে খবর দেওয়া আবশ্যক’। সুতরাং চক্রবর্তী পাঁজি দেখে উত্তম দিন স্থির করে প্রভুর বাড়ি খবর দিলে, প্ৰভু তুরী, খন্তি ও খোল নিয়ে উপস্থিত হলেন। গুরুপ্ৰসাদীর আয়োজন হতে লাগল।…চক্রবর্তীর বাড়ীর ভিতর বড় ধুম । গোস্বামী বরের সজ্জা করে জামাইবাবুর শোবার ঘরে শুলেন । হরহরিবাবুর স্ত্রী নানালঙ্কার পরে ঘরে ঢুকলেন । মেয়েরা ঘরের কপাট ঠেলে দিয়ে ফাঁক থেকে আড়ি পেতে উঁকি মারতে লাগল।…হরহরিবাবু একগাছি রুল নিয়ে গোস্বামীর ঘরে শোবার পূর্বেই খাটের নীচে লুকিয়ে ছিলেন ; এক্ষণে দেখলেন যে স্ত্রী ঘরে ঢুকে গোস্বামীকে একটা প্ৰণাম করে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগল। প্ৰভু খাট থেকে উঠে স্ত্রীর হাত ধরে অনেক বুঝিয়ে শেষে বিছানায় নিয়ে গেলেন । কন্যাটি কি করে । বংশপরম্পরানুগত ধর্মের অন্যথা করলে মহাপাপ–এটি চিত্তগত আছে, সুতরাং আর কোন আপত্তি করল না–সুড়সুড়ি করে প্রভুর বিছানায় গিয়ে শুলে। প্ৰভু কন্যার গায়ে হাত দিয়ে বল্লেন, ‘ব’ল, আমি রাধা তুমি শ্যাম’ । কন্যাটিও অনুমতি মত ‘আমি রাধা, তুমি শ্যাম’, তিনবার বলেছে এমন সময় হরহরিবাবু আর থাকতে পারলেন না, খাটের নীচে থেকে বেরিয়ে এসে এই ‘কাঁধে বাড়ি বলরাম’ বলে গোস্বামীকে রুলসই করতে লাগলেন । এই ঘটনায় প্রভুরা ভীত হলে সমাজে গুরুপ্রসাদী উঠে গেল। খরতাল বাজাবে ; গোস্বামীর রুল সইয়ের চিৎকারে তার হরিধ্বনি ভেবে দেদার খোল বাজাতে লাগল, মেয়ের উলু দিতে লাগল, কাঁসির ঘণ্টা শাকের শব্দে হুলস্থল পড়ে গেল। হরহরিবাবু হঠাৎ দরজা খুলে ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়ে, একেবারে থানার দারোগার কাছে গিয়ে সমস্ত কথা ভেঙ্গে বলল। এদিকে সকলে ঘরে গিয়ে দ্যাখে যে গোস্বামীর দাঁতে কপাটি লেগে গ্যাছে, অজ্ঞান অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছেন, বিছানায় রক্তের নদী বইছে। সেই অবধি গুরুপ্ৰসাদী উঠে গ্যালো, লোকেরও চৈতন্য হলো ; প্রভুরাও ভয় পেলেন।
”আবার দশরথজাতক অনুযায়ী পূর্বকালে বারানসীর রাজা দশরথের প্রধান মহিষীর গর্ভে তিন সন্তান জন্মায়–রামপণ্ডিত, লক্ষণকুমার ও সীতাদেবী। ওই মহিষীর মৃত্যুর পর দশরথ অপর একজনকে প্রধান মহিষী করেন । তার গর্ভে ভরত নামে এক সন্তানের জন্ম হয় “ । আমরাতো জানি মৈথিলির রাজা জনকের কন্যা হ’ল সীতা!