০৪. দুপুরে ঘুমুচ্ছিলাম

দুপুরে ঘুমুচ্ছিলাম। ঘুমের মধ্যেই মনে হলো দারুণ একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। খুব : আনন্দময় কিছু। আমার এরকম প্রায়ই হয়। আমরা একবার নানিজনদের বাড়িতে বেড়াতে গেছি। মা নানিজান দুজনে মিলে এমন গল্প শুরু করলেন, সাড়ে এগারটা বেজে গেল। নানিজান বললেন, এতরাতে বাসায় ফিরে কী করবি? থেকে যা। আমরা থেকে গেলাম। নানিজানদের বাড়িতে বিছানার খুব অভাব। আমি, নানিজান আর মা আমরা তিনজন এক বিছানায় শুয়েছি। বালিশে মাথা ছোঁয়াবার সঙ্গে সঙ্গে আমার ঘুম চলে এলো। ঘুমের মধ্যে মনে হলো, আমাদের খুব খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। ভয়ঙ্কর কোনো সংবাদ নিয়ে কেউ একজন আসছে। আমার ঘুম ভেঙে গেল। জেগে দেখি, মা আর নানিজান তখনো মজা করে গল্প করছেন। খুব হাসাহাসি হচ্ছে। নানিজান বাচ্চামেয়েদের মতো মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হাসছেন। আমাকে জেগে উঠতে দেখে নানিজান হাসিমুখে বললেন, কী রে নাতু, ছোট ঘর যাবি? নানিজান আমাকে ‘নাতু’ ডাকেন। নাতাশা নামটা নাকি তার কাছে অনেক লম্বা লাগে। ডাকতে গিয়ে দম ফুরিয়ে যায়।

আমি বললাম, ছোট ঘরে যাব না, পানি খাব নানিজান।

নানিজান পানি আনার জন্যে উঠতে যাচ্ছেন, মা বললেন, তুমি বসো তো মা, আমি পানি এনে দিচ্ছি। আর ঠিক তখন কলিংবেল বেজে উঠল। আমি নিশ্চিত বুঝলাম খারাপ খবরটা এসে গেছে। আমার হাত-পা কাঁপতে লাগল। এত রাতে মা দরজা খুলতে গেলেন না। নানাভাই জেগে ছিলেন, তিনি উঠে দরজা খুললেন। মা গেলেন নানাভাইয়ের পিছু পিছু। মা’র সঙ্গে আমিও গেলাম।

বুড়ো মতো ভিখিরী ধরনের এক জ্বলোক দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বিড়বিড় করে কী যেন বললেন। এত নিচু গলায় বললেন যে, কেউ কিছু বুঝতে পারল না। নানাভাই বিরক্ত গলায় বললেন, কী বলছেন জোরে বলুন। কিছু বুঝতে পারছি না। আপনার গলায় জোর নাই।

বুড়ো দ্রলোক তখন আমার ছোট মামার মৃত্যুসংবাদ দিলেন।

কতদিন আগের কথা, এখনো আমার স্পষ্ট মনে আছে। কথা বলার সময় বুড়ো ভদ্রলোকের মুখ থেকে থুথু ছিটকে আসছিল। সেই থুথুর খানিকটা এসে তাঁর দাড়িতে লাগল। দাড়ির মাথায় শিশিরের মতো থুথুর বিন্দু চিকচিক করতে লাগল। সেই থুথু আমি এখনো চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই। যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন দেখতে পাব।

বেশিদিন অবশ্যি আমি বেঁচে থাকব না। আর খুব অল্পদিনই বাঁচব। এটা মা জানে না। আমি জানি। এবং খুব সম্ভব আমার ডাক্তার সাহেব জানেন। মা পুরোপুরি নিশ্চিত চিকিৎসা-টিকিৎসা করে আমাকে সুস্থ করে ফেলবে। তখন আমি আবার আগের মতো হয়ে ছোটাছুটি শুরু করব। আমার অপারেশনের ব্যবস্থা সব হয়ে গেছে। এখন শুধু টিকিট কেটে প্লেনে ওঠা। ও না, ভিসা এখনো হয় নি। ভিসা নিয়ে মা খুব চিন্তা করছে। আমেরিকান অ্যাম্বেসি নাকি কাউকে ভিসা দিচ্ছে না। ভিসার চিন্তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে টাকার চিন্তা। টাকা জোগাড় করার জন্যে মা প্রায় পাগলের মতো হয়ে গেছে। তার মাথা এলোমেলো। সেদিন সন্ধ্যাবেলা শুনি গুন গুন করে আপন মনে গান গাইছেন– ‘খোল খোল দ্বার রাখিও না আর বাহিরে আমায় দাঁড়ায়ে।

আমি অবাক হয়ে মাকে দেখছি। কারণ তাঁকে আমি এভাবে কখনো গান গাইতে শুনি নি। মা আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ খুব লজ্জা পেয়ে গেলেন। আমি বললাম, মা, তুমি সুন্দর গান গাও তো। মা আরো লজ্জা পেলেন। বিড়বিড় করে কী যেন বললেন। এতটা লজ্জা পাওয়ার মার কিছু ছিল না। ভয়ঙ্কর দুঃসময়ে আমরা সবাই অস্বাভাবিক আচরণ করি। ছোট মামার মৃত্যুসংবাদ নিয়ে বুড়ো ন্দ্রলোক যখন এলেন তখন আমার নানাভাইও খুব অস্বাভাবিক আচরণ করেছিলেন। বুড়ো ভদ্রলোককে বললেন, শুধু-মুখে যাবেন না। পান খেয়ে যান।

বাড়িতে তখন ভয়ঙ্কর কান্নাকাটি চলছে। নানাভাই এর মধ্যে ব্যস্ত হয়ে পান খোঁজাখুজি করছেন। আমি অবাক হয়ে নানাভাইয়ের কাণ্ড দেখছি। আমার ধারণা, সেদিন থেকেই নানাভাইয়ের মাথা কিছু কিছু খারাপ হতে শুরু করেছে। কেউ বুঝতে পারে নি। আমি কিন্তু বুঝেছি।

আমি অনেক কিছুই বুঝতে পারি। এই যে ঘুমের মধ্যে মনে হলো আজ খুব ভালো কিছু ঘটতে যাচ্ছে। আমি নিশ্চিত, আসলেই তা ঘটবে। কেউ বাজি ধরতে চাইলে আমি বাজি ধরতাম, এবং নির্ঘাৎ বাজিতে জিততাম।

আমি বিছানায় উঠে বসলাম। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দরজার কলিংবেল বাজতে লাগল। সেই ভালো কিছুটা কি এক্ষুনি ঘটবে? বাবা কি এসেছেন? কিংবা বাবার কোনো চিঠি? আমার শরীর যেন কেমন কেমন করছে। মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে আমি পড়ে যাব। বুয়া দরজা খুলতে এত দেরি করছে কেন?

আমাদের বুয়া সব কাজ ঝটপট করে, শুধু কলিংবেল বাজলে দরজা খুলতে দেরি করে। মনে হয় কলিংবেলের শব্দ অনেক পরে তার কানে যায়। শব্দের গতিবেগ যেন কত? স্কুলে পড়েছিলাম। এখন আর মনে পড়ছে না। আলোর গতিবেগ মনে আছে সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল। ও হ্যাঁ মনে পড়েছে- শব্দের গতিবেগ হলো প্রতি সেকেন্ডে তিনশ বত্রিশ মিটার। এক ফুট সমান ৩০.৪৮ সেন্টিমিটার।

আবার কলিংবেল বাজছে। বুয়া এখন যাচ্ছে। এত আস্তে আস্তে পা ফেলছে, মনে হচ্ছে পায়ের তলায় কোনো ফোড়া-টোড়া হয়েছে। পা ফেলতে খুব কষ্ট।

দরজা খুলল। কার সঙ্গে যেন কথা হচ্ছে। কিছু বোঝা যাচ্ছে না। আবার দরজা বন্ধ হলো। আমি বললাম, কে এসেছিল? বুয়া বলল, কেউ না।

এটা কোনো জবাব হলো? কেউ না আবার কী? কেউ একজন তো নিশ্চয়ই এসেছে।

তুমি কার সঙ্গে কথা বললে?

উকিল সাবের বাড়ির ঠিকানা খুঁজে। আমি বলছি জানি না।

জানি না বললে কেন? উকিল সাহেবের বাড়ির ঠিকানা তো তুমি জানো। আমাদের ফ্ল্যাটের সামনের বকুল গাছওয়ালা বাড়িটা উকিল সাহেবের বাড়ি।

যার দরকার হে খুঁইজা বাইর করুক।

খোঁজ করে তো সে পাচ্ছে না। তুমিও তাকে বলছ না।

আমার অত ঠেকা নাই। কিছু খাইবেন আফা। শীতল পানি।

আমাদের বুয়া মাঝে মাঝে কঠিন শব্দ ব্যবহার করে। ঠাণ্ডা পানি বলে না, বলে শীতল পানি। দৈ বলে না, বলে দধি। রুই মাছকে বলে রুহিত মাছ।

আফা, শীতল পানি আনমু?

আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ালাম। আমার আসলেই পানির পিপাসা হচ্ছে। বুয়া উৎসাহের সঙ্গে শীতল পানি আনতে চলে গেল। এখন আর তার পায়ের তলায় ফোড়া নেই। সে প্রায় দৌড়ে যাচ্ছে।

মা আমার পানি খাওয়ার জন্যে একটা ফ্রিজ কিনেছেন। সেই ফ্রিজ জন্মদিন উপলক্ষে আমাকে দেয়া হয়েছে। ছোট্ট লাল টুকটুকে একটা ফ্রিজ। মা’র টাকা পয়সার এত টানাটানি, এর মধ্যে ফ্রিজ কিনল কেন? আমাকে অনেকখানি খুশি করে দেওয়ার জন্যে? যাই হোক, আমাকে সেই ফ্রিজের পানি খাওয়ানোর ব্যাপারে বুয়ার খুব উৎসাহ।

বালিশের নিচ থেকে আমি আমার অ্যালার্ম ঘড়ি বের করলাম। সময় দেখলাম। তিনটা পঁচিশ। ঘড়িটাও আমি জন্মদিনে পেয়েছি। বড়খালা দিয়েছেন। ঢাকনা দেওয়া একটা ঘড়ি। ঘড়িটার ঢাকনার রঙও লাল টুকটুকে। আশ্চর্যের ব্যাপার, এবারের জন্মদিনে আমি সব লাল রঙের জিনিস পেয়েছি। নিজান। আমাকে কামিজ কিনে দিয়েছেন। সেটার রঙও লাল। আমার স্কুলের মেয়েরা আমাকে একটি চকলেট আর বড় রঙ পেন্সিলের বাক্স দিয়েছে। পেনসিল বক্সে দুটা লাল রঙের ঘোড়া আঁকা।

আমার জন্ম ৩রা বৈশাখ। আমার জন্মের পর পর দাদাজানের কাঁঠাল গাছ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়া পাখি উড়ে গিয়েছিল। এই দৃশ্য আমি দেখি নি, কিন্তু আমার কল্পনা করতে খুব ভালো লাগে। প্রতি জন্মদিনের ভোরবেলায় আমার মনে হয়- আজ কোনো একটা গাছ থেকে একঝাক টিয়া পাখি আকাশে উড়বে।

এ বছর আমার জন্মদিন করার কথা ছিল না। মা বললেন, অসুখ-বিসুখের মধ্যে জন্মদিন ভালো লাগবে না। রোগ সারুক, তারপর আমরা দারুণ হৈচৈ করে জন্মদিন করব। বিরাট একটা পার্টি দেব। ঠিক আছে মা? আমি বললাম, আচ্ছা।

মানুষ যেরকম ভাবে সেরকম হয় না। জন্মদিনের দিন সকাল থেকে এত মানুষ আসা শুরু করল। উপহারে ঘর ভর্তি হয়ে গেল। মার মুখ থমথমে হয়ে গেল। মা চাপা গলায় নানিজানকে বললেন, তোমরা কি ভেবেছ এটা আমার মেয়ের শেষ জন্মদিন? তোমাদের কাউকে আমি আসতে বলি নি। কেন তোমরা এত কিছু নিয়ে এসেছ? তোমরা যা ভাবছ তা হবে না। আমি আমার মেয়ের একশ বছরের জন্মদিন করব। নানিজান হাসিমুখে বললেন, একশ বছরের জন্মদিন তুই করতে পারবি না। তুই এতদিন বাঁচবি না। অন্যরা করবে।

মা কাঁদতে শুরু করলেন। নানিজান মা’র পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, নাতুকে নিয়ে তুই অনেকদিনের জন্যে বিদেশে চলে যাবি, কতদিন তাকে দেখব না। কাজেই একটা উপলক্ষ ধরে আমরা এসেছি। তুই এত রাগ করছিস কেন? নাতুর মাথার টিউমারের চেয়ে বড় টিউমার তো তোর মাথায় হয়েছে রে। আমেরিকা থেকে তুইও একটা অপারেশন করিয়ে আসিস। নানিজান মাথা দুলিয়ে খুব হাসতে লাগলেন। মা হেসে ফেললেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেল।

আমার নানিজান অসাধারণ একজন মহিলা। যখনি তাকে দেখি তখনি তিনি হাসছেন এবং এত মিষ্টি করে হাসছেন। যার অন্তর যত সুন্দর সে নাকি তত সুন্দর করে হাসে। যদি তাই হয় তাহলে নানিজানের মতো সুন্দর অন্তর আর কারো নেই।

তিনি এসেই বললেন, এই নাতু, শুয়ে থাকবি না তো। উঠে বোস। রোগী শুয়ে থাকলে রোগ বসে থাকে। আর রোগী উঠে বসলে রোগ শুয়ে পড়ে।

আমি উঠে বসলাম। নানিজান আমার পেছনে বালিশ দিয়ে দিলেন। তারপর শুরু করলেন হাসির এক গল্প। গল্প বলবেন কী, নিজেই হাসতে হাসতে বাঁচেন না। এক লাইন বলেন, বলেই হাসেন। আরো এক লাইন বলেন, আবারো হাসি। এমন হাসাহাসি শুরু হলো যে, কে বলবে এ বাড়িতে কোনো অসুখ-বিসুখ আছে! আমি অনেকদিন পর মাকে প্রাণ খুলে হাসতে দেখলাম। আর একটা জিনিস লক্ষ করলাম, একটু পর পর মা এসে নিজানকে ছুঁয়ে যাচ্ছেন। কখনো হাত ধরে বসে থাকেন, কখনো গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে বসেন। একসময় নানিজান ধমকের মতো করে বললেন, তুই তো বড় যন্ত্রণা করছিস! শুধু গায়ের সঙ্গে গা ঘসাচ্ছিস। এমনিতেই গরমে মরে যাচ্ছি।

সামান্য কথা। এতেও আবার সবাই হাসতে শুরু করল। নিজান একটা হাসির বড় ঝাড়বাতি জ্বেলে চলে গেলেন। তিনি আরো কিছুক্ষণ থাকতেন, কিন্তু তাকে যেতেই হবে, কারণ নানাভাই বাসায়। তিনি না গেলে নানাভাই ভাত খাবেন না। রাগ করে বসে থাকবেন। নানাভাই আবার নানিজান পাশে না থাকলে ভাত খেতে পারেন না।

বিকেলে আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার ক্লাসের মেয়েরা এলো। তাদের নিয়ে এলেন আমাদের অঙ্ক-মিস-শাহেদা আপা। স্কুলে আমাদের এই অঙ্ক-মিসের নাম হলো শুকনা বাঘিনী’। আমাদের স্কুলে দুজন বাঘিনী আছেন। একজন হলেন থলথলা বাঘিনী, অন্যজন শুকনা বাঘিনী। আমরা সবচে’ বেশি ভয় পাই শুকনা বাঘিনীকে। স্কুলের বারান্দা দিয়ে তাকে হেঁটে যেতে দেখলে আমাদের পানির পিপাসা পেয়ে যায়। তিনি যে আমার জন্মদিনে চলে আসবেন আমি চিন্তাও করি নি। তাকে দেখে আগের অভ্যাস মতো ভয়ে আমার পানির পিপাসা পেয়ে গেল। তিনি আমার মাথার কাছে এসে দাঁড়িয়ে অবাক গলায় বললেন, মা রে, তোর এই অবস্থা কেন হলো? বলেই কাঁদতে শুরু করলেন। বাচ্চা ছেলেমেয়েরা যেরকম শব্দ করে কাঁদে সেরকম শব্দ করে কান্না। তারপর তিনি ছুটে বারান্দায় চলে গেলেন। বারান্দা থেকে তার কান্নার শব্দ শোনা যেতে লাগল।

বাইরে থেকে দেখে একটা মানুষ কেমন তা বোঝা আসলে খুব কঠিন। আমাদের শুকনা বাঘিনী আপা আসলেই বাঘিনী। দয়া-মায়ার ছিটেফোঁটাও তার মধ্যে নেই। আদর করে কাউকে তিনি কোনো কথা বলেছেন বলে কেউ শুনে নি। পরীক্ষার হলে নকল করে কোনো মেয়ে ধরা পড়লে অবশ্যই তিনি তাকে এক্সপেল করে দেবেন। কেঁদে চোখ গালিয়ে ফেললেও কোনো লাভ হবে না। তবে কারো অসুখ-বিসুখ হলে অন্যকথা। আমি যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন মনিকা একদিন ক্লাসে এলো জ্বর নিয়ে। বাঘিনী আপা অঙ্ক পড়াতে এসে টের পেলেন। কঠিন গলায় বললেন, কী রে, তোর চোখ লাল কেন? জ্বর-জারি নাকি?

মনিকা ভয়ে নীল হয়ে বলল, জি-না আপা।

দেখি কাছে আয়।

মনিকা কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে গেল। আপা কপালে হাত দিয়ে হুঙ্কার দিয়ে। উঠলেন, গায়ে তো ভালো জ্বর। জ্বর নিয়ে এসেছিস কেন? বিদ্যা ধুয়ে খাবি? যা, টিচার্স কমনরুমে বেঞ্চ আছে, ওখানে গিয়ে শুয়ে থাক। আমি ক্লাস শেষ করে আসছি।

টিফিন পিরিয়ডে আমরা অবাক হয়ে দেখলাম মনিকা বেঞ্চে শুয়ে আছে আর বাঘিনী আপা তার মাথা টিপে দিচ্ছেন। কত বিচিত্র ধরনের মানুষ যে পৃথিবীতে আছে! আশ্চর্য! একজন মানুষ অন্য একজন মানুষের চেয়ে এত আলাদ সব মানুষ একরকম হলে কেমন হতো কে জানে। যখন কারো জ্বর হবে, সবার একসঙ্গে হবে। কারো আনন্দের কিছু ঘটলে সবারই ঘটবে। এইসব বিচিত্র কথা আজকাল আমার প্রায়ই মনে হয়। আমি বাবাকে দেখাবার জন্যে মোটা একটা খাতায় লিখে রাখি। আমি জানি বাবা সেই খাতা দেখে খুব হাসাহাসি করবে। তবে হাসাহাসি করলেও বাবার কাছে খুব ভালো লাগবে। তবে মা ভুরু কুঁচকে বলবে– পাগলের মতো এইসব কী লিখেছিস? খাতাটা আমি কাউকে দেখাব কি-না তা এখনো ঠিক করি নি। মনে হয় শেষপর্যন্ত দেখাব না। খাতাটাতে এমন অনেক কিছু লেখা আছে যা পড়লে মা মন খারাপ করবে। আমি বেঁচে থাকলে অবশ্যি মন খারাপ করবে না। আমি বেচে থাকব না এইজন্যেই মন খারাপ করবে। যেমন আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি। সে যদি বেঁচে থাকত তাহলে কি তার ডায়েরির এত নাম-ধাম হতো? আমার মনে হয় না। বেচারি নাজিদের হাতে শেষপর্যন্ত মারা গেছে বলেই তার ডায়েরি পড়ার সময় আমাদের এত খারাপ লাগে।

ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবার পর উপহার হিসেবে আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরিটা আমি পেয়েছিলাম। মেজোখালা দিয়েছিলেন। আমার বৃত্তি পাওয়া উপলক্ষে আমাদের বাসায় ছোটখাটো একটা পার্টির মতো হলো। সবাই আমার জন্যে নানান উপহার-টুপহার নিয়ে এলেন। ছোটখালা আনলেন আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি। র‍্যাপিং পেপারে খুব সুন্দর করে মুড়ে, মোড়কের উপর কাগজের ফুল লাগিয়ে উপহারটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, আমি আর তোর মেজোখালু তোর উপহার কেনার জন্যে নিউমার্কেট চষে ফেলেছি। কিছুই পছন্দ হয় না। শেষে এই বইটা পেলাম। মনে হচ্ছে তোর ভালো লাগবে। অসাধারণ একটা মেয়ের অসাধারণ কাহিনী।

আমার মেজোখালা এবং খালু দুজনই খুব কৃপণ ধরনের মানুষ। নিজেদের জন্যে তারা প্রচুর খরচ করবেন। ঐ তো কিছুদিন আগে আরেকটা গাড়ি কিনলেন। কিন্তু অন্যের জন্যে একটা পয়সাও তাঁরা খরচ করবেন না। সেই মেজোখালা উপহার এনেছেন? আমার খুব ভালো লাগল।

মোড়ক খুলে বই বের করে আমি খুব খুশি। হঠাৎ দেখি বইয়ের ভেতরের পাতার এক কোনায় লেখা- পাপিয়া রহমান, ক্লাস নাইন, সেকশান বি। পাপিয়া মেজোখালার মেয়ে। এখন শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করছে। আমি তখন বোকার মতো একটা কাজ করে ফেললাম। আমি বললাম, খালা, এটা তো পাপিয়া আপার বই। তার নাম লেখা। তখন একটা বিশ্রী অবস্থা হলো। মেজোখালা চোখ-মুখ লাল করে বলতে লাগলেন, বইটা তিনি আমার জন্যেই কিনেছেন। পাপিয়া এক ফাঁকে নিজের নাম লিখে ফেলেছে।

আমার বড়খালু মানুষকে লজ্জা দিয়ে খুব আনন্দ পান। তিনি আমার হাত থেকে বইটা নিয়ে পাতা উল্টাতে উল্টাতে বললেন, পাপিয়া আম্মুর তো খুব বুদ্ধি। শুধু যে নিজের নামই লিখেছে তা না, আবার ব্যাক ডেট দিয়েছে। তিন মাস আগের তারিখ লেখা। হা হা হা।

মেজোখালা বললেন, দুলাভাই, আপনার কি ধারণা নাতাশার জন্যে নতুন একটা বই কেনার সামর্থ্যও আমার নেই?

বড়খালু বললেন, আমি কি বলেছি বই কেনার সামর্থ্য তোমার নেই? অবশ্যই আছে। আমি শুধু ব্যাকডেটের কথা বললাম। তোমার মেয়ের বুদ্ধির তারিফ করলাম। আমার ধারণা, পাপিয়া বড় হলে তোমার চেয়েও ইন্টেলিজেন্ট হবে। অবশ্যই সে তোমাকে ছাড়িয়ে যাবে।

মেজোখালা কাঁদতে শুরু করলেন। কিছু না খেয়েই আমাদের বাসা থেকে চলে গেলেন। আমার কী যে খারাপ লাগল। আমি নিজেও বাথরুমে ঢুকে অনেকক্ষণ কাঁদলাম। আমি কেন বোকার মতো এই কাজটা করলাম? কেন খালাকে এমন লজ্জা দিলাম? আমাদের বাংলা মিস, মিস রোকেয়া একদিন ক্লাসে বলেছিলেন, গুরু নানকের একটা কথা আছে— তোমরা সবাই কথাটা খাতায় লিখে ফেল। কথাটা হচ্ছে– ‘দু গুণা দত্তার চৌগুণা জুজার।’ কথাটার মানে হচ্ছে দু গুণ দিলে চার গুণ ফেরত পাওয়া যায়। তুমি যদি কাউকে দু গুণ আনন্দ দাও তাহলে চার গুণ আনন্দ ফেরত পাবে। আবার কাউকে দু গুণ কষ্ট দিলে চার গুণ কষ্ট ফেরত পাবে। আমি পরীক্ষা করে দেখেছি কথাটা সত্যি। তোমরাও পরীক্ষা করে দেখো।

আমাদের ক্লাসের মলিনা গোমেজ খুব বোকা। আমার ধারণা, খৃস্টানরা বুদ্ধিমান হয়। মলিনা খৃস্টান হলেও দারুণ বোকা। সব ক্লাসেই সে বোকার মতো একটা প্রশ্ন করবে। মলিনা রোকেয়া আপাকে বলল, মিস, আপনি যদি আমাকে মারেন তাহলে কেউ কি আপনাকে ডাবল করে মারবে?

রোকেয়া আপা কখনো কারো কথায় রাগ করেন না। মলিনার কথা শুনে তার ভুরু কুঁচকে গেল, তবে তিনি রাগ করলেন না। শুধু বললেন, হ্যাঁ।

মলিনা বলল, এইজন্যেই কি আপনি আমাদের মারেন না?

ক্লাসের সবাই হাসতে লাগল। মিস রোকেয়া ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। আমি স্পষ্ট বুঝলাম আপার মন খারাপ হয়েছে। গুরু নানকের চমৎকার একটা কথা তিনি বলেছেন। অথচ কথাটার গুরুত্ব কেউ বুঝতে পারছে না। সবাই হাসাহাসি করছে।

সেই দিনই গুরু নানকের কথাগুলি আমি আমার ডায়েরিতে লিখে ফেললাম এবং ঠিক করলাম কথাগুলি সত্যি কি-না আমি পরীক্ষা করে দেখব। কারো মনে কষ্ট দিলে সঙ্গে সঙ্গে ডায়েরিতে দিন-তারিখ দিয়ে লিখে ফেলব। তারপর মিলিয়ে দেখব আমি ডাবল কষ্ট পাই কি-না।

মেজোখালাকে লজ্জা দেয়ার ব্যাপারটা আমি খুব গুছিয়ে লিখলাম। কতদিন পরে আমি ডাবল লজ্জা পাই সেটা দেখার জন্যে। লেখার ছদিনের দিন আমি লজ্জা পেলাম। সে যে কী ভয়ঙ্কর লজ্জা! কাউকে সে লজ্জার কথা কোনোদিন বলা যাবে না। ডায়েরিতেও লিখে রাখা যাবে না। গুরু নানকের কথা এত সত্যি! আমি এখন থেকে ঠিক করেছি কাউকে কখনো কষ্ট দেব না, লজ্জা দেব না। এমন কিছু করব যাতে মানুষ খুশি হয়। তারা খুশি হলে কোনো না কোনো ভাবে আমি ডবল খুশি হব।

আমার জন্যে মানুষকে খুশি করা বেশ কঠিন। কারো সঙ্গে আমার দেখাই হয় না। আমার বন্ধুবান্ধব নেই। স্কুল থেকে ফিরে সারাদিন আমি ঘরেই বসে থাকি। বই পড়ি কিংবা ডায়েরি লিখি। গল্পগুজব যা করার ফুলির মা’র সঙ্গে করি। সে কিছুতেই খুশি হয় না। তাকে খুশি করার একমাত্র উপায় হচ্ছে তার গল্প শোনা। ফুলির মা সাধারণ কোনো গল্প জানে না। তার সব গল্পই ভয়ঙ্কর। শুনলে হাত-পা কাঁপে। অথচ সে এমন নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে যেন ঠাকুমার ঝুলি থেকে লালকমল নীলকমলের গল্প বলছে।

বুঝছেন আফা, আমি তখন নয়া বাসার কামে ঢুকছি। আমার গেরাম সম্পর্কে চাচা আমারে নারায়ণগঞ্জের এক ফেলেটে কামে ভর্তি করছে। বাসার সাব ব্যাংকের অবিছার। পাঁচটা ডাংগর পুলাপান। পরথম দিন কাম করতে করতে জেবন শেষ। তিন বালতি কাপড় ধুইছি। ঘর মুছছি, দুনিয়ার বেবাক পাতিল মাজছি। রাইত একটার সময় চুলা বন কইরা ঘুমাইতে গেছি। ঘুমানির জইন্যে একটা পাতলা চাঁদর দিছে, আর দিছে একটা বালিশ। কী যে গরম ছিল আফা! গরমে শইল সিদ্ধ হইতাছে। গরমের সাথে সামিল হইছে মশা। হায় রে আষা কী কমু, ভোমরার লাহান বড় বড় মশা। আমার চউক্ষে নাই নিদ্রা। এই গোন দেই, হেই গড়ান দেই– মশা খেদাই। শেষ রাইতে চউখ একটু বন হইছে, হঠাৎ মনে হইল শাড়ি ধইরা কে জানি টানে। ইয়া মাবুদ! ধড়ফর কইরা উইঠা দেখি বাড়ির সাব। চিক্কর দিতে গেছি, ধরছে মুখ চাইপ্যা। এর মইধ্যে শাড়ি খুইল্যা লেংটা বানাইয়া ফেলছে…।

চুপ কর ফুলির মা। আমি আর শুনব না।

না শুননই ভালো। তুমি পুলাপান মানুষ। এই গুলান পুলাপানের গফ না।

পুলাপানের গল্প না হলেও ফুলির মা’র সব গল্পই আমাকে শুনতে হয়েছে। হয়তো গল্পের বই পড়ছি মা অফিসে, বাবা গেছেন কাজে। ফুলির মা তার কাজ শেষ করে এসে বসবে আমার কাছে। তার হাতের মুঠোয় লুকানো জ্বলন্ত সিগারেট। ফুলির মা আমার সামনে সিগারেট খেলেও খুব সমীহ করে খায়। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে টান দেয়।

কী করেন গো আফা?

কিছু করি না।

মজার একটা ইতিহাস স্মরণে পাইছি। বড়ই ইন্টারেস্টের ইতিহাস। ভাত রানতে রানতে স্মরণ হইছে। একলা একলা হাসছি। ভাবলাম আফারে বলি। হইছে কী আফা– এক বড়লোকের বাড়িত কাম পাইছি। বাড়ির বেগম সাব পরীর লাহান সুন্দর। বেগম সাবের কাছে গাইয়ের দুধ আনলে দুধরে কালা লাগে। এমন শইলের রঙ। আর আমারে দেহেন আফা গাছের পেত্নি। তয় শইলটা ভালো। তা আফা খাটাখাটনির শইল ভালো তো হইবই! আমরার সম্বল হইল শইল,..।

এই গল্প শুনব না।

আচ্ছা থাউক, শুননের দরকার নাই। এইটা পুলাপানের গফ না।

তারপরেও ফুলির মা বুয়ার অনেক গল্প আমি শুনেছি। তার কয়েকটা আমি ডায়েরিতে লিখে রেখেছি। মা পড়লে ফুলির মা’র উপর রাগ করবে। খুব রাগ করবে। তবে আমি নিজে থেকে পড়তে না দিলে মা আমার ডায়েরি পড়বে না। এইসব ব্যাপারে মা খুব সাবধান। অবশ্যি আমার মৃত্যুর পর মা সব পড়বে। পড়বে আর কাদবে। সবচে বেশি কাঁদবেন বাবা। কারণ মেয়েরা অনেক শক্ত ধরনের হয়। ছেলেরা তা হয় না। বাইরে থেকে তাদের শক্ত মনে হলেও আসলে তারা তা না। ছোট মামার মৃত্যুর শোক নানিজান সামলে উঠেছেন। নানাভাই সামলাতে পারেন নি। বাবার বেলাতেও তাই হবে। কাজেই আমাকে এমন একটা ব্যবস্থা করতে হবে যেন আমার মৃত্যুর পর কেউ আমার ডায়েরি পড়তে না পারে। ঘরে যেন আমার কোনো ছবিও না থাকে। ছবি থাকলেই আমার কথা সবার মনে পড়বে। ছবি দেখে দেখে কাদবে। হয়তো আমার আরেকটা ভাই হবে। কিংবা বোন হবে। ঈদের দিন ওরা কত আনন্দ করতে চাইবে। তখন মার মনে পড়ে যাবে আমার কথা। মা সব ফেলে দিয়ে দরজা বন্ধ করে কাঁদতে বসবে। আমার বেচারা ভাইবোনরা মন খারাপ করে ঘুরবে।

বোনটা হয়তো দুই ধরনের হবে। পড়াশোনা করতে চাইবে না, শুধু খেলতে। চাইবে। তখন মা বলবেন, তুমি এত দুষ্ট হয়েছ কেন? তোমার যে আপা ছিল নাতাশা, সে তত দুষ্ট ছিল না। সে তো দিন-রাত পড়াশোনা করত। অসম্ভব লক্ষ্মী ছিল সে। আমার বোনটা তখন কত মন খারাপ করবে! হয়তো মনে মনে রাগ করবে আমার উপর। আমি চাই না সে আমার উপর রাগ করুক। আমি চাই না কেউ আমার উপর রাগ করুক। কেউ আমার কথা মনে করে কাঁদুক।

আমি চাই আমার মৃত্যুর পর বাবা-মা একসঙ্গে থাকবে। তারা কোনোদিন কোনো ঝগড়া-টগড়া করবে না। বাবা রাত-বিরেতে নেশা করে বাসায় ফিরবে না। বাবা আবার আগের মতো লাল টুকটুক একটা গাড়ি কিনবে। মাকে পাশে বসিয়ে শাঁ শাঁ করে সেই গাড়ি নিয়ে চলে যাবে চিটাগাং, রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার। পেছনের সিটে আমার ছোট দুই ভাইবোন বসবে, তারা খুব হৈচৈ করবে। চিষ্কার করবে। গান করবে। তারা যতই হৈচৈ করবে বাবা ততই হাসবেন। মা বিরক্ত হয়ে বলবেন, আহ্, চুপ কর তো। তখন বাবা মাকে খ্যাপাবার জন্যে তার বিখ্যাত চাইনিজ গান ধরবেন।

টিং টিং টিটিং টিং
রেবা রেবা লিং লিং

আমার এইসব গোপন ইচ্ছার কথাও আমি আমার ডায়েরিতে লিখি। আগে খুব হেলাফেলা করে ডায়েরি লিখতাম। আসলে জানতাম না তো কী করে ডায়েরি লিখতে হয়। একদিন লিখলাম–

আজ লবণের বাটিতে একটা মরা তেলাপোকা পাওয়া গেল। মা ফুলির মাকে খুব বকা দিলেন। ফুলির মা বলল, আমি কি তেল্যাচুরারে কইছিলাম লবণের বাটিত গিয়া মরতে? আমারে বকেন ক্যান? ফুলির মা’র কথা শুনে মা খুব রেগে গেল। মা বললেন, তোমাকে দিয়ে আমার পুষাবে না। তুমি অন্য কোথাও কাজ দেখ। ফুলির মা বলল, জে আইচ্ছা। যে কাম জানে তার কামের অভাব হয় না। ফুলির মাকে চলে যেতে বললে সে সবসময় বলবে– জে আচ্ছা। কিন্তু কখনো যাবে না।

আরেকদিন লিখলাম–

আজ পটল দিয়ে মাছ রান্না করা হয়েছে। বোয়াল মাছ আর পটল। বাবা বললেন, বোয়াল নিম্নশ্রেণীর মাছ। পটল উচ্চ শ্রেণীর তরকারি। পটল দিয়ে বোয়াল মাছ রান্না ঠিক হয় নি। ভুল হয়েছে। এতে তরকারি হিসেবে পটলকে অপমান করা হয়েছে। এই নিয়ে মা এবং বাবার মধ্যে ছোটখাটো ঝগড়া বেঁধে গেল।

এইসব আজেবাজে কথা লিখে শুধু শুধু পাতা ভরানো। কোনো মানে হয় না। আসলে আমাদের জীবনটা এরকম যে লেখার মতো কিছু ঘটে না। স্কুলে যাওয়া, স্কুল থেকে এসে ভাত খাওয়া, রাতে পড়াশোনা করে ঘুমুতে যাওয়া- ব্যস, এইটুকুতেই সব।

আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি পড়ে মেয়েটার উপর আমার খুব ঈর্ষা হলো। কত ভাগ্যবতী মেয়ে! তার ছোট্ট জীবনে কত কিছু ঘটেছে। আর কী সুন্দর করে গুছিয়েই

সে সবকিছু লিখে গেছে। আমার যদি এরকম ঘটনার জীবন হতো আমিও সুন্দর করে সব লিখে রাখতাম। আনা ফ্রাঙ্কের মতো চিঠির আকারে ডায়েরি। সে তার কল্পনার বান্ধবীকে উদ্দেশ করে চিঠির মতো লিখেছে। আমি লিখতাম বাবাকে উদ্দেশ করে। মাকে উদ্দেশ করেও লেখা যায়। তবে মাকে লিখতে ইচ্ছে করে না। মাকে সবসময় আমার নিজেরই একটা অংশ বলে মনে হয়। তাঁর কাছে চিঠি লিখতে ইচ্ছে করে না।

আনার মতো ডায়েরি আমি লেখার চেষ্টা করছি অসুখের পর থেকে। প্রথম দিনই বেশ বড় করে লিখলাম। এখন খুব ছোট ছোট করে লিখছি। কারণ হচ্ছে আমি চোখে ঝাঁপসা দেখছি। মাকে চোখের এই ব্যাপারটা বলা হয় নি। এমনিতেই তিনি চিন্তায় চিন্তায় অস্থির। সেই চিন্তা বাড়িয়ে কী হবে! আমি যদি এখন বলি– মা, আমি চোখে ঝাঁপসা দেখতে শুরু করেছি, তাহলে মা কী করবে? তার কিছুই করার নেই। শুধু শুধু অস্থির হবে আর ভয়ঙ্কর কষ্ট পাবে। এমনিতেই বেচারি কষ্টে মরে যাচ্ছে। সেই কষ্ট বাড়িয়ে লাভ কী?

বাবাকে উদ্দেশ করে লেখা প্রথম ডায়েরির লেখাটা এরকম (খুব চেষ্টা করেছি আনা ফ্রাঙ্কের মতো হাসি-খুশিভাবে লিখতে। হয় নি।)

বাবা,

আজ আমার একটা অসুখ ধরা পড়েছে। অসুখটার নাম মেনিনজিওমা। এরকম অদ্ভুত নাম তুমি নিশ্চয়ই এর আগে শুন নি। কেউই বোধহয় শুনে নি। যাকেই এই নাম বলা হবে সে-ই ভুরু কুঁচকে বলবে, অসুখটা কী?

অসুখটা ভয়াবহ। কতটা যে ভয়াবহ তা আমি মাকে দেখে বুঝতে পারি। আমার অসুখ ধরা পড়ার পর থেকে মাকে দেখাচ্ছে অবিকল মরা মানুষের মতো। তোমার মনে আছে, দাদিজানের মৃত্যুর খবর পেয়ে তাকে আমরা দেখতে গেলাম। গিয়ে দেখি পুরনো কালো খাটটায় তাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। তার মুখ হলুদ রঙের একটা চাঁদরে ঢাকা। সাধারণত মৃতদেহ সাদা চাঁদরে ঢাকা থাকে। দাদিজানকে হলুদ চাঁদরে কেন ঢাকল কে জানে! বোধহয় ঘরে কোনো সাদা চাঁদর ছিল না। আমরা দাদিজানের খাটের পাশে দাঁড়ালাম। কে একজন তার মুখ থেকে চাঁদর সরিয়ে দিল। আমি আঁৎকে উঠলাম। প্রাণহীন মানুষের মুখ এত ভয়ঙ্কর!

মায়ের মুখও প্রাণহীন মানুষদের মুখের মতো ভয়ঙ্কর হয়ে গেছে। তিনি অবশ্যি খুব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছেন, যেন আমি কিছু বুঝতে না পারি। যেদিন আমার অসুখটা মা প্রথম জানলেন সেদিন বাসায় ফিরেই ফুলির মাকে বললেন, বুয়া, চা কর। নাতাশাকেও এক কাপ দিও।

ফুলির মা হতভম্ব গলায় বলল, আফনের হইছে কী?

কিছু হয় নি। হবে আবার কী? টায়ার্ড।

সন্ধ্যার পর অতিরিক্ত আগ্রহের সঙ্গে বললেন, অনেকদিন টিভি দেখা হয় না। আজ টিভি দেখব। ইন্টারেস্টিং কিছু কি আজ টিভিতে আছে?

সে-রাতে অতি কুৎসিত একটা নাটক হলো। একটা ছেলে একটা মেয়েকে ভালোবাসে। তাকে না পেলে সে পাগল হয়ে যাবে। কিন্তু তাকে সে বিয়ে করবে না, কারণ বিয়ে করলে তার ভালোবাসা নষ্ট হয়ে যাবে। কী যে জগাখিচুড়ি! বড় বড় সব কথা। একটু পর পর কবিতা আবৃত্তি। নায়ক এক একবার কাঁপা কাঁপা গলায় কবিতা শুরু করে আর আমার ইচ্ছা করে দেই কষে একটা চড়।

মা সেই নাটকও চোখ বড় বড় করে দেখল এবং নাটক শেষ হলে বলল, মন্দ না তো। রাতে মা আমার সঙ্গে ঘুমুতে এলো। সে-রাতে খুব গরম পড়েছিল। তার উপর ছিল না ইলেকট্রিসিটি। কিছুতেই আমার ঘুম আসছে না। মা বোধহয় মানসিকভাবে খুব ক্লান্ত ছিল। শোয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়ল। আমি জেগে আছি। এপাশ-ওপাশ করছি। তখন হঠাৎ মনে হলো– মানুষের যেমন ‘অসুখ’ হয় সেরকম ‘সুখ’ হবার নিয়ম থাকলে খুব ভালো হতো। পৃথিবীতে নানান ধরনের অসুখের মতো নানান ধরনের সুখ থাকত। ছোট সুখ, বড় সুখ। একেক সুখের একেক নাম। কোনো মা’র মেয়ের বড় ধরনের সুখ হলে সেই মা আনন্দে অস্থির হয়ে চারদিকে টেলিফোন করে খবর দিত– আমার মেয়ের না এই সুখ হয়েছে।

সত্যি?

হ্যাঁ সত্যি। পরীক্ষায় ধরা পড়েছে। কী যে আনন্দ হচ্ছে ভাই!

আনন্দ হবারই কথা। আমি সবসময় দেখেছি আপনি ভাগ্যবতী।

মেয়েটার জন্যে দোয়া করবেন আপা।

ডায়েরি এইখানেই শেষ।

আচ্ছা, আমার কি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে? কী দিয়ে শুরু করেছিলাম আর কী বলছি। শুরু করেছিলাম কী দিয়ে? ঐ যে দুপুরে ঘুম ভাঙার পর মনে হলো আজ খুব আনন্দের কিছু ঘটবে। সারাদিন কিছু ঘটল না।

খুব আশা ছিল বাবার কাছ থেকে একটা চিঠি নিশ্চয়ই আসবে। অনেকদিন বাবা চিঠি লিখেন না। কে জানে হয়তো তাঁর অসুখ-বিসুখ হয়েছে। অসুখ হলে সেখানে তাঁকে দেখার কেউ নেই। তিনি থাকেন একা, নিজেই বেঁধে খান। শেষ চিঠিতে বাবা তার রান্না করার কথা লিখেছেন। কী সুন্দর করেই না লিখলেন–

ও আমার টিয়া পাখি,

আজ দুপুরে রান্না করার সময় তোর কথা মনে পড়ল। কেন বল তো? কারণ আজ একটা দারুণ জিনিস রান্না করেছি। পাহাড়ি একটা মাছ– ওরা বলে দুই মাছ কিংবা চই মাছ। দেখতে এত সুন্দর যেন রূপার একটা পাত। অনেকটা চাঁদা মাছের মতো– চ্যাপ্টা। মুখটা লাল টুকটুক। প্রথমে ভাবলাম ভেজে ফেলি। দেখি, ঘরে মাছ ভাজার মতো তেল নেই। কাজেই তরকারি করা হলো। তরকারি চড়িয়ে দিয়ে মনে হলো– টিয়া পাখি থাকলে এই মাছ আমাকে রান্না করতে দিত না। সে বলত, এত সুন্দর মাছ তুমি কেটেকুটে খেয়ে ফেলবে। পানিতে ছেড়ে দিয়ে আস বাবা।

যাই হোক, মাছটা দেখতে যত সুন্দর খেতে ততই অসুন্দর। বিশ্রি গন্ধ। পচা নাড়িভুড়ি থেকে যে-রকম গন্ধ আসে সেরকম গন্ধ। প্রচণ্ড সর্দিতে নাক বন্ধ থাকলেই শুধু এই মাছ খাওয়া চলে নয়তো না।

আমি অল্প একটু খেয়ে বমি করে সব ফেলে দিয়েছি। সারাদিনই শরীরটা কেমন কেমন করেছে। মনে হয় ‘ছই’ কোনো বিষাক্ত মাছ। এই কারণে বোধহয় বাজারে বিক্রি হয় না। আমি নিজে জাল ফেলে ধরেছি। ভালো কথা– আমার একটা জাল আছে। সেই জাল ফেলে আমি নিজেই শঙ্খ নদীতে মাছ ধরি। একবার একটা সাপ ধরেছিলাম। বিশাল সাপ। মুরং এক ছেলে খুব আগ্রহ করে সাপটা আমার কাছ থেকে নিয়ে গেল। মুরংরা সাপ খায়। মুরং ছেলেটার নাম ‘উলাপ্রু’। সে মাঝে মাঝে এসে আমার কাজকর্ম করে দেয়। একবার তাকে কিছু কাপড় ধুতে দিলাম। সে সঙ্গে সঙ্গে নিজের

লুঙ্গি খুলে নেংটো হয়ে কাপড় ধুতে শুরু করল। নিজের লুঙ্গিটা খুলে নিল কারণ কাপড় ধোয়ার সময় লুঙ্গি ভিজে যাবে। এদের লজ্জা-শরম একটু কম। আজ এই পর্যন্তই মা।

পরে তোকে লম্বা চিঠি দেব।

ইতি–

তোর বাবা

পুনশ্চ : উলা বলেছে সাপটা নাকি খেতে দারুণ ছিল। পেট ভর্তি ছিল ডিম।

 অফিস থেকে ফিরলেন অনেক দেরি করে। ফিরেই আবার বের হয়ে পড়লেন। আমার ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট। বুয়া রান্নাঘরে রান্না করছে। আমি একটা বই হাতে শুয়ে আছি। ঘরে আলো আছে কিন্তু পড়তে পারছি না। লেখাগুলি সব ঝাঁপসা। কেউ যদি পড়ে পড়ে শোনাত ভালো লাগত।

দরজার কলিংবেল বাজছে।

কে এসেছে?

বাবা?

মনে মনে যা আশা করা হয় তা ঘটে না। উল্টোটা হয়। কাজেই আমি ভাবতে লাগলাম- বাবা আসেন নি। বড় খালু এসেছেন। বড় খালুকে আমার অসহ্য লাগে। কাজেই বড় খালুর কথা ভাবলে হয়তো দেখা যাবে বাবা এসেছেন। ফুলির মা দরজা খুলেছে। তার কোনো কথা শুনা যাচ্ছে না। তাহলে বাবা আসেন নি। বাবা এলে ফুলির মা ‘চাচাজান’ বলে বিকট একটা চিৎকার দিত।

আমার টিয়া পাখি কই রে?

আমি কি ভুল শুনছি? কে টিয়া পাখির খোঁজ করছে? আরে এই তো। এই তো বাবা।

বাবা ঘরের মাঝখানে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমার দিকে।

আকাশ-পাতাল বিস্ময় নিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, মা, তোর কী হয়েছে?

আমি হাসার চেষ্টা করলাম। হাসতে পারলাম না।

বাবা আমাকে দেখে কষ্ট পাচ্ছেন। খুব কষ্ট পাচ্ছেন। বাবাকে আমি খুব কষ্ট দিলাম এই দুঃখে আমার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়তে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *