৪
মিসির আলির দিন শুরু হয়েছে রুটিন মতোই। সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখেছেন— মশারির ভেতর দিয়ে খবরের কাগজটা ঢুকিয়ে দেওয়া। একসময় বাসিমুখে খবরের কাগজ পড়তে তিনি আনন্দ পেতেন, এখন পান না, কিন্তু অভ্যাসটা রয়ে গেছে। অভ্যাস সহজে যায় না। খবরের কাগজ পড়তে পড়তেই ইয়াসিন চা নিয়ে আসে। মশারির ভেতরে ঢুকিয়ে গলা খাঁকারি দেয়। সেই চা, চা-না অতিরিক্ত চিনির কারণে সিরাপ জাতীয় ঘন তরল পদার্থ। ইয়াসিনকে অনেক বলেও চিনি কমানোর ব্যবস্থা মিসির আলি করতে পারেন নি। এখন মিসির আলির গরম সিরাপ খাওয়া অভ্যাস হয়ে গেছে। প্রায়ই তাঁকে বলতে শোনা যায়—ইয়াসিন আরেক চামচ চিনি দে। ইংরেজি প্রবচনটা এতই সঠিক — Old habit die hard. পুরোনো অভ্যাস সহজে মরে না।
মিসির আলির হাতে খবরের কাগজ। তিনি খবরের কাগজে চোখ বুলাচ্ছেন- -হঠাৎ এমন কোনো খবর চোখে পড়ে কি না যা মনে গেঁথে যায়। এমন কিছু চোখে পড়ছে না। হত্যা, ধর্ষণ ছাড়া তেমন কিছু নেই। মিসির আলির মনে হল সব পত্রিকার উচিত এই দুটি বিষয়ে আলাদা পাতা করা। খেলার পাতা, সাহিত্য পাতার মতো ধর্ষণ পাতা, হত্যা পাতা। যারা ঐ সব বিষয় পড়তে ভালবাসে তারা ঐ পাতাগুলি পড়বে। যারা পড়তে চায় না তারা পাতা আলাদা করে রাখবে। বিশেষ দিনে হত্যা এবং ধর্ষণ বিষয়ে সচিত্র ক্রোড়পত্র বের হবে।
পত্রিকায় নতুন একটি বিষয় চালু হয়েছে—জন্মদিনের শুভেচ্ছা। মামণির এক বছর বয়সপূর্তি উপলক্ষে পিতা-মাতার শুভেচ্ছা। মিসির আলি বেশ আগ্রহ নিয়েই পড়ছেন।
অনিক
পৃথিবীতে আজ যত গোলাপ ফুটেছে সবই তোমার জন্যে
তোমার বাবা ও মা
অনিকের ছবি। দুই হাতে ভর দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত গোলাপের মালিক হাঁ করে বসে আছে। তার জিব দেখা যাচ্ছে।
শিপ্রা,
আজ আমাদের শিপ্রার শুভ জন্মদিন
পৃথিবীর সব দুঃখ করবে সে বিলীন
শিপ্রার
নানা নানু ছোট মামা, ছোট মামি ও রনি।
পৃথিবীর সমস্ত দুঃখ যে বিলীন করবে সেই শিপ্রার ক্রন্দনরতা একটা ছবি। শিপ্রার হাতে চকবার।
মিসির আলি ছবিটির দিকে তাকিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলেন। মেয়েটি কাঁদছে কেন? চোখে মুখে কি চকবারের কাঠির খোঁচা লেগেছে?
জন্মদিনের শুভেচ্ছায় শুধু ছোট মামা, ছোট মামি আছেন। যেহেতু ছোট মামার উল্লেখ করা আছে অবশ্যই ধরে নিতে হবে বড় মামাও আছেন। বড় মামা-মামি কি আলাদা বাণী দেবেন? তিনি কি পরিবারের সঙ্গে থাকেন না? নাকি বড় মামা মারা গেছেন। শুভেচ্ছা বাণীতে বড় মামা নেই কেন? আরেকটা নাম আছে রনি। এই রনিটা কে? কাজিন? মামাতো ভাই। শিপ্রা মেয়েটির কি কোনো খালা নেই।
ইয়াসিন চায়ের কাপ মশারির ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে। যথারীতি গরম সিরাপ মিসির আলি চুমুক দিলেন—তাঁর কাছে মনে হল মিষ্টি সামান্য বেশি তবে খেতে খারাপ না। চায়ে চুমুক দিতে দিতে মিসির আলি শিক্ষার্থীর পাতা উল্টালেন। শিক্ষার্থীর পাতা বলে আরেকটা জিনিস খবরের কাগজে চালু হয়েছে। আজ আছে ক্লাস সিক্সের বৃত্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি বিষয়ে আলোচনা। অগ্রণী গার্লস হাই স্কুলের ফার্স্ট গার্লের ইন্টারভ্যু। ভিকারুননিসা নূন স্কুলের একজন শিক্ষিকার বৃত্তি পরীক্ষার ওপর কিছু ‘—টিপস’। মিসির আলি প্রথম পড়তে শুরু করলেন ফার্স্ট গার্ল নাজনিন বেগমের ইন্টারভ্যু—
‘তুমি দৈনিক কত ঘণ্টা পড়াশোনা কর?’
আমি দৈনিক পাঁচ থেকে ছ’ঘণ্টা পড়াশোনা করি।
‘তুমি অবসর সময়ে কী কর?’
আমি অবসর সময়ে গল্পের বই পড়ি। টিভি দেখি।
‘তোমার পড়াশোনার পেছনে কার অনুপ্রেরণা সবচেয়ে বেশি কাজ করে?’
আমার পিতা-মাতা এবং শিক্ষক-শিক্ষিকা।
‘তোমার কি কোনো গৃহশিক্ষক আছে?’
দু জন গৃহশিক্ষক আছে।
‘তুমি কি কোনো কোচিং সেন্টারে যাও?’
আমি একটি কোচিং সেন্টারে সপ্তাহে তিনদিন যাই।
‘তোমার সাফল্যের রহস্য কী?’
আমি দিনের পড়া দিনে তৈরি করে রাখি।
‘তোমার বয়সী ছাত্রছাত্রীদের প্রতি তোমার কী উপদেশ?’
‘তোমরা নিয়মিত পড়াশোনা কর।’
ফার্স্ট গার্ল নাজনিন বেগমের ইন্টারভ্যু শেষ করে মিসির আলি ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শিক্ষিকার কঠিন উপদেশগুলি পড়তে শুরু করলেন। তাঁর খানিকটা মন খারাপ হতে শুরু করেছে—তাঁর কাছে মনে হচ্ছে সবাই বাচ্চাগুলির পেছনে লেগেছে। শিশুর স্বপ্ন, শিশুর আনন্দ কেড়ে নেবার খেলা শুরু করেছে। শিশুদের শিশুর মতো থাকতে দিলে কেমন হয়। বৃত্তি পরীক্ষা উঠিয়ে দিলে কেমন হয়? পরীক্ষার ব্যাপারটা কি উঠিয়ে দেওয়া যায় না। পরীক্ষা নামের ব্যাপারগুলি রেখে অতি অল্পবয়সেই শিশুদের মাথায় একটা জিনিস আমরা ঢুকিয়ে দিচ্ছি—তোমাদের মধ্যে কেউ ভালো, কেউ খারাপ। তোমাদের মধ্যে একদল বৃত্তি পায়, একদল পায় না। তোমাদের মধ্যে একজন হয় ফার্স্ট গার্ল নাজনিন। আরেকজন খুব চেষ্টা করেও দশের ভেতর থাকতে পারে না। যেদিন স্কুলে রেজাল্ট দেয় সেদিন সে কান্না কান্না মুখে বাড়ি ফেরে। এবং তার মা মেয়ের ওপর প্রচণ্ড রাগ করেন। এই মা-ই আবার মেয়েকে গান শেখান—আমরা সবাই রাজা, আমাদের এই রাজার রাজত্বে।
আমরা যে সবাই রাজা না, কেউ কেউ রাজা কেউ কেউ প্রজা, পরীক্ষা নামক ব্যবস্থাটা তা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়।
মিসির আলি পত্রিকা ভাঁজ করে রাখলেন। মশারির ভেতর থেকে বের হলেন না। সকালে মশারির ভেতর থেকে তিনি বেশ আয়োজন করে বের হন। যেন তিনি জেলখানা থেকে মুক্তি পাচ্ছেন, সারা দিন কাজকর্ম করবেন আবার রাত এগারোটা বারোটায় জেলখানায় ঢুকবেন।
কলিংবেল বাজছে।
মিসির আলি মশারির ভেতর থেকে দেয়ালঘড়ির দিকে তাকালেন। কাঁটায় কাঁটায় ন’টা বাজে। প্রতিমা এসে পড়েছে। সে ন’টায় আসবে বলেছিল—ঠিক ন’টায় এসেছে। পাঁচ-ছ’মিনিট আগেই হয়তো এসেছে। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ন’টা বাজার অপেক্ষা করেছে। এ ধরনের মানুষ খুব যন্ত্রণাদায়ক হয়। মিসির আলি ছোট্ট নিশ্বাস ফেললেন। মানুষের সঙ্গ তাঁর কাছে খুব আনন্দদায়ক কোনো ব্যাপার না। তিনি একা থেকে থেকে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। অন্যরা ব্যাপারটা বুঝতে পারে না।
মিসির আলির ধারণা যেসব মানুষ দীর্ঘদিন একা থাকে এবং বই পড়ে সময় কাটায় তারা অন্য রকম। মানুষকেও তারা বই মনে করে। যে বই তার পছন্দ সে লাইব্রেরি থেকে সেই বই টেনে নেয়। ঠিক একইভাবে যে মানুষটি তার পছন্দ সেই মানুষকে সে ডেকে নিয়ে আসে। কোনো মানুষ নিজে তাদের কাছে উপস্থিত হবে এটা তাদের পছন্দ না।
মিসির আলি অপ্রসন্ন মুখে মশারির ভেতর থেকে বের হলেন। বসার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখেন প্রতিমা আসে নি। বেতের চেয়ারে ফতে মিয়া বসে আছে।
‘স্যার কেমন আছেন?’
মিসির আলি বললেন, ভালো আছি।
ফতে বলল, চলে যাচ্ছি তো স্যার, এইজন্যে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। একটু দোয়া রাখবেন।
‘কোথায় যাচ্ছ?’
‘গতকাল আপনাকে বললাম না আমি একটা দরজির দোকান দিচ্ছি। এখন থেকে দোকানেই থাকব।’
‘ও আচ্ছা।’
‘আপনাকে একদিন আমার দোকানে নিয়ে যাব।’
মিসির আলি ফতের সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, ঠিক আছে।
‘আমার একটা আবদার আছে স্যার। যদি রাখেন খুব খুশি হব।’
‘কী আবদার?’
‘আমার দোকানের প্রথম দরজির কাজটা আপনাকে দিয়ে করাব। আপনার জন্যে একটা পাঞ্জাবি বা ফতুয়া দিয়ে দোকানের শুরু। আপনাকে কখনো ফতুয়া পরতে দেখি নাই। আপনি কি ফতুয়া পরেন?’
‘পোশাক নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। পোশাক নিয়ে আমি তেমন ভাবি না।’
‘স্যার আপনি কি নাশতা করেছেন?’
‘না।’
‘আমিও নাশতা করি নাই। ইয়াসিনকে বলেছি আমাদের দুজনের নাশতা দিতে। শুধু পরোটা ভাজতে বলেছি। আমি বিরিয়ানি হাউস থেকে মুরগির লটপটি নিয়ে এসেছি। মুরগির লটপটি জিনিসটা কখনো খেয়েছেন?’
‘না।’
হোটেলে অনেক মুরগি রান্না হয় তো। সেই সব মুরগির গিলা, কলিজা, পাখনা, এইগুলো কী করবে? ফেলে তো দিতে পারে না—হোটেলওয়ালারা এইগুলো দিয়ে একটা ঝোলের মতো বানায়। এটাকে বলে লটপটি। পরোটা দিয়ে লটপটি খেতে খুবই সুস্বাদু।
‘ও আচ্ছা।
ফতে মিয়া হাসতে হাসতে বলল, সকালবেলা এসে আপনার সঙ্গে বকবক শুরু করেছি, আপনার খুব বিরক্ত লাগছে তাই না স্যার?
মিসির আলি বললেন, খুব বিরক্তি লাগছে না, তবে কিছুটা যে বিরক্ত হচ্ছি না—তা না। অকারণ কথাবার্তা বলতে আমার ভালো লাগে না।
ফতে বলল, আমি তো চলেই যাচ্ছি স্যার। এরপর আর রোজ রোজ এসে আপনাকে বিরক্ত করব না। যান হাত-মুখ ধুয়ে আসুন, একসঙ্গে নাশতা খাই। আমি স্যার গজফিতা নিয়ে এসেছি—আপনার ফতুয়ার মাপ নিব। আমি মাপ নেওয়া শিখেছি। আপনাকে দিয়ে বিসমিল্লাহ করব।
মিসির আলি অপ্রসন্ন মুখে বাথরুমের দিকে রওনা হলেন। ফতে মিয়া ঘণ্টাখানেক সময় নষ্ট করবে এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। এর মধ্যে নিশ্চয়ই প্রতিমা চলে আসবে। সে তো আর সহজে যাবে না। বাজারটাজার নিয়ে আসবে। মহাউৎসাহে মাছ ভাজতে শুরু করবে। ঘর ধোয়া মোছা করবে। প্রতিমার কর্মকাণ্ড এখানেই শেষ হবে না। সে অবশ্যই চেষ্টা করবে তাঁকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে। বাড়াবাড়ি এই মেয়ে করবেই। মানুষের জিনের মধ্যে এমন কিছু কি আছে যা তাকে দিয়ে ‘বাড়াবাড়ি’ করায়। ডিএনএ অণুতে প্রোটিনের এমন কোনো বিশেষ অবস্থান যা বাড়াবাড়ি করতে বিশেষ বিশেষ মানুষকে প্রেরণা দেয়। সেই মানুষ যখন ঘৃণা করে বাড়াবাড়ি ধরনের ঘৃণা করে। যখন ভালবাসে বাড়াবাড়ি ভালবাসে। অনেক অসুখের মতো এটাও যে একটা অসুখ তা কি মানুষ জানে? এখন না জানলেও একদিন জানবে। কোনো ওষুধ কোম্পানি ওষুধ বের করে ফেলবে। যেসব মানুষের বাড়াবাড়ি করার রোগ আছে তারা ট্যাবলেট খেয়ে রোগ সারাবে। একসময় হুপিংকফ, পোলিওর মতো ‘বাড়াবাড়ি’ রোগেরও টিকা বের হবে। শিশুদের বয়স ছয় মাস হবার আগেই তাদের ‘বাড়াবাড়ি প্রবণতা’ রোগের টিকা দেওয়া হবে। রাস্তায় রাস্তায় পোস্টার দেখা যাবে আপনার শিশুকে কি ‘বাড়াবাড়ি প্রবণতা’র টিকা দিয়েছেন?
বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মিসির আলি বিরক্ত মুখে নিজের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর দূরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছা করছে। তাঁর যদি প্রচুর টাকা থাকত তিনি সমুদ্রের কোনো জনমানবশূন্য দ্বীপে একটা ঘর বানাতেন। আলেকজান্ডিয়ার লাইব্রেরির মতো—সেখানে তাঁর বিশাল লাইব্রেরি থাকত। তিনি দ্বীপে ঘুরে ঘুরে বই পড়তেন। ঘুম পেলে বালির ওপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। রবিনসন ক্রুশোর আনন্দময় জীবন।
মিসির আলির চোখ-মুখ জ্বালা করছে। তিনি মুখে ঠাণ্ডা পানির ছিটা দিচ্ছেন তাতেও জ্বলুনি কমছে না। হঠাৎ তাঁর খুব মেজাজ খারাপ লাগছে। এতটা মেজাজ খারাপ হবার মতো কোনো ঘটনা ঘটে নি। তিনি সমাজে বাস করছেন। সমাজের আর দশটা মানুষের মতোই তাকে থাকতে হবে। সামাজিকতা করতে হবে। কেউ তাঁর সঙ্গে গল্প করতে চাইলে গল্প করতে হবে। কেউ লটপটি নামক বস্তু নিয়ে এসে তার সঙ্গে নাশতা খেতে চাইলে নাশতা খেতে হবে। কোনো উপায় নেই। তিনি সমাজে বাস করছেন—বাস করার মূল্য তাঁকে দিতেই হবে।
মিসির আলি বাথরুম থেকে বের হয়ে ইয়াসিনকে গরম পানি দিতে বললেন। গোসল করবেন। সকালে গোসল করার অভ্যাস তার নেই। এখন গোসলে যাওয়ার অর্থ কিছুটা সময় নিজের করে পাওয়া। ফতে তার গজফিতা নিয়ে থাকুক একা একা। একা থাকার অভ্যাস করাটাও জরুরি।
.
ফতে সিগারেট ধরিয়েছে। পা নাচাচ্ছে। সে আনন্দেই আছে। তার মুখ হাসি হাসি। সে ঠিক করেই এসেছে আজ মিসির আলি সাহেবকে সে চমকে দেবে। ছোটখাটো চমক না, বড় ধরনের চমক। ছোটখাটো চমকে এই লোকের কিছু হবে না। ছোটখাটো চমক সে দিয়ে দেখেছে। ঘড়ি না দেখে ঘড়ির সময় বলেছে। আজ তার চেয়ে বেশি কিছু করবে। সকালবেলা মিসির আলি সাহেব যখন তার সামনে এসে বসেছিলেন তখন ফতে পরিষ্কার বুঝতে পারছিল উনার মাথায় ঘুরছে রনি নামের একজনের নাম। রনিটা কে তিনি বুঝতে পারছিলেন না। রনির সঙ্গে শিপ্রার সম্পর্ক কী তা নিয়ে তিনি চিন্তিত। ফতে ইচ্ছা করলে এই কথাটা বলেও তাকে চমক দিতে পারত। কিংবা সে সকাল ন’টায় যখন এসেছে তখন বলতে পারত—ন’টার সময় অন্য একজনের আসার কথা। সে আসে নি আমি এসেছি। যার আসার কথা তার নাম প্রতিমা।
ফতে জানে সে ক্ষমতাধর একজন মানুষ। অন্যের মাথার ভেতর সে ঢুকে পড়তে পারে। ছোটবেলা থেকেই পারে। তার ধারণা ছিল সব মানুষই এটা পারে। ব্যাপারটা যে অন্যরা পারে না শুধু সে একা পারে এটা ধরতে তার অনেক সময় লেগেছে। ক্লাস ফাইভে যখন পড়ে তখন তার হঠাৎ চিন্তা হল—সে কী ভাবছে অন্যরা তা বুঝতে পারছে না কেন? অন্যদের তো বুঝতে পারা উচিত।
ক্লাসের স্যার যখন তাকে প্রশ্ন করলেন, ফতে বল তিব্বতের রাজধানী কী?
ফতে খুবই অবাক হল। প্রশ্ন করার দরকার কী? স্যার কেন তার মাথার ভেতর ঢুকে পড়ছেন না। মাথার ভেতর ঢুকলেই তো স্যার জানতে পারতেন। তিব্বতের রাজধানীর নাম ফতে জানে না। তবে এই মুহূর্তে জানে—কারণ স্যারের মাথায় নামটা ঘুরছে। তিব্বতের রাজধানী—লাসা। এই প্রশ্নের পরে স্যার কী প্রশ্ন করতেন এটাও সে জানে। স্যারের পরের প্রশ্ন—ভুটানের রাজধানীর নাম কী। উত্তরও স্যারের মাথায় আছে— থিম্পু।
মানুষের মাথার ভেতর ঢুকতে পারার অস্বাভাবিক ক্ষমতা দিয়ে ফতের কোনো লাভ হয় নি। সে কিছুই করতে পারে নি। এই ক্ষমতার কারণে স্কুল জীবনটা তার মোটামুটি ভালো কেটেছে—স্যারদের মার খেতে হয় নি। প্রশংসা শুনেছে—। ইতিহাসের স্যার তো গর্ব করে বলতেন—ইতিহাসের সন তারিখ সব ফতের মুখস্থ। তার সমস্যা একটা পরীক্ষার খাতায় কিছু লিখতে পারে না।
ক্ষমতা পাওয়ায় ফতের লাভের চেয়ে ক্ষতিই হয়েছে। তাকে সারাক্ষণ চিন্তার ভিতর থাকতে হয়—‘অন্য কেউ কি আমার মাথার ভিতর ঢুকে পড়ছে। ঢুকে পড়লে ভয়ঙ্কর হবে। কারণ আমার মাথার ভেতর ভয়ঙ্কর সব জিনিস আছে।’ ফতে তার জীবনটাই কাটাল আতঙ্ক নিয়ে। কেউ অন্য রকমভাবে তার দিকে তাকালেই তার বুক ছ্যাৎ করে ওঠে। সর্বনাশ কি হয়ে গেল?
কেউ তার মাথার ভিতর ঢুকতে পেরেছে এ রকম কোনো প্রমাণ তার হাতে নেই— তবে মাঝে মাঝেই সে লক্ষ করেছে তার দিকে তাকানোর সময় কেমন করে যেন তাকাচ্ছে। তার কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছে। শিশুদের ব্যাপারে এই ঘটনাটা বেশি ঘটে। বেশিরভাগ শিশুই তাকে দেখলে কাঁদতে শুরু করে। সাধারণ কান্না না। চেঁচিয়ে বাড়ি মাত করে ফেলার মতো কান্না। তখন ফতের ভয়ঙ্কর রাগ লাগে। ইচ্ছা করে আছাড় দিয়ে মাথাটা ফাটিয়ে ফেলতে।
আরো একজনের সঙ্গে ফতের দেখা হয়েছিল যাকে দেখে সে নিজে আতঙ্কে অস্থির হয়েছিল। ঘটনাটা এ রকম—ফতের মামা ফতেকে দোকানে পাঠিয়েছিলেন—টুথপেস্ট আনতে। ফতে টুথপেস্ট কিনল। স্টেশনারি দোকানের পাশের সিগারেটের দোকান থেকে সিগারেট কেনার সময় হঠাৎ পাশ থেকে এক ভদ্রলোক বললেন, কিছু মনে করবেন না। আপনার নাম কী?
অপরিচিত কোনো মানুষ হঠাৎ এ ধরনের কথা বলে না। ফতে হকচকিয়ে গেল। তার বুকে ধাক্কার মতো লাগল। ঘটনা কী? লোকটা কি সব বুঝে ফেলেছে। ফতে বলল, আমার নাম ফতে।
‘আপনি কোথায় থাকেন?’
ফতে ক্ষীণ স্বরে বলল, কেন?
‘আপনার বিষয়ে আমার কৌতূহল হচ্ছে এই জন্যেই জানতে চাচ্ছি।’
ফতে খুব নার্ভাস হয়ে গেল। তার বুক ধড়ফড় করা শুরু হয়ে গেল। সে ইচ্ছা করলে লোকটার মাথার ভিতর ঢুকতে পারে। লোকটা কেন এ রকম প্রশ্ন করছে তা জানতে পারে—সমস্যা হচ্ছে ফতে যখন ভয় পেয়ে যায় তখন তার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। তখনো হল। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা একটা লোক। রোগা। থুতনিতে সামান্য দাড়ি আছে। শান্ত ভদ্র চেহারা। লোকটা তাকিয়ে আছে তীক্ষ্ণ চোখে। ফতে নিজেকে শান্ত করার জন্যে সিগারেট ধরাল। লোকটা বলল, আপনি কী করেন জানতে পারি?
ফতে নিজেকে সামলে নিয়ে কঠিন গলায় বলল, আমি কী করি তা দিয়ে আপনার প্রয়োজন কী?
লোকটা বলল, প্রয়োজন নেই। শুধুই কৌতূহল।
ফতে বলল, এত কৌতূহল ভালো না।
এই বলেই সে আর দাঁড়াল না। হাঁটতে শুরু করল। কিছুদূর যাবার পর পেছন ফিরে দেখে লোকটা তার পেছনে পেছনে আসছে। ফতের বুক আবার ধড়ফড় করতে শুরু করল। সে দৌড়াতে শুরু করল। তখন ঐ লোকটা দাঁড়িয়ে পড়ল, তবে তাকিয়ে রইল ফতের দিকে। দৃশ্যটা মনে পড়লেই ফতের বুক কাঁপে।
মিসির আলির ব্যাপারটা ফতে ঠিক ধরতে পারছে না। ফতের যে ক্ষমতা এই মানুষটার কি সেই ক্ষমতা আছে? মাঝে মাঝে মনে হয় আছে—আবার মাঝে মাঝে মনে হয় নেই। মিসির আলির মাথায় বেশিরভাগ সময়ই ফতে ঢুকতে পারে না। সন্দেহটা সেই কারণেই হয়। যতবার ফতে মিসির আলির মাথার ভিতর ঢুকেছে ততবারই সে ধাক্কার মতো খেয়েছে। লোকটা একসঙ্গে অনেক কিছু চিন্তা করছে। তিনটা-চারটা চিন্তা কোনো মানুষ একসঙ্গে করছে—এমন কারোর সঙ্গেই ফতের এর আগে দেখা হয় নি। ফতে মিসির আলির ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হতে চায়। পুরোপুরি জানতে চায় এই মানুষটারও কি তার মতো ক্ষমতা আছে?
ফতের মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে তার ক্ষমতার ব্যাপারটা মিসির আলিকে খোলাখুলি বলে। কিন্তু তার মন সায় দেয় না। লোকটাকে এটা বলে তার লাভ কী। এমন তো না যে এটা কোনো অসুখ সে অসুখ থেকে মুক্তি চায়। আগবাড়িয়ে বললে—একজন তার গোপন ব্যাপারটা জেনে ফেলবে। একজন জানা মানেই অনেকের জানা। কী দরকার।
মিসির আলির গোসল শেষ হয়েছে। তিনি এসে ফতের সমনের চেয়ারে বসেছেন। ফতে খুবই হতাশা বোধ করছে। মিসির আলির মাথার ভেতর সে ঢুকতে পারছে না। ইয়াসিন এসে পরোটা এবং বাটিতে করে মুরগির লটপটি দিয়ে গেল। ফতে বলল, স্যার খান এর নাম মুরগির লটপটি।
মিসির আলি কোনো কথা না বলে খেতে শুরু করলেন। ফতে বলল, খেতে কেমন স্যার?
মিসির আলি বললেন, ভালো।
‘আপনার কি শরীর খারাপ?’
‘না শরীর খারাপ না। মেজাজ সামান্য খারাপ। কোনো কারণ ছাড়াই খারাপ।’
‘আমি বেশিক্ষণ থাকব না স্যার। নাশতা খেয়ে আপনার ফতুয়ার মাপটা নিয়ে কাপড় কিনতে যাব। কী রঙের কাপড় আপনার পছন্দ?’
মিসির আলি বললেন, কাপড়ের রঙ নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। শুধু কটকট না করলেই হল।
‘হালকা নীল রঙ কিনব স্যার?’
‘কিনতে পার।’
‘কাপড়ের দামটা স্যার আমি দিব। আপনি যদি কিছু মনে না করেন। শুধু দরজির খরচটা আপনি দিবেন। প্রথম ব্যবসা—বিনা টাকায় করা ঠিক না।’
মিসির আলি বললেন, আমি দরজির খরচ দেব। কোনো অসুবিধা নেই।
‘আজ সন্ধ্যার মধ্যে ফতুয়া দোকানে গিয়ে ডেলিভারি নেবেন। কষ্টটা আপনাকে করতে হবে।’
‘আচ্ছা করব। ঠিকানা রেখে যাও, আমি সন্ধ্যার পরপর যাব।’
মিসির আলির নাশতা খাওয়া শেষ হয়েছে। তিনি চা খাচ্ছেন। ফতে কয়েকবার চেষ্টা করেও মিসির আলির মাথার ভেতর ঢুকতে পারল না। সে পরিকল্পনা বদলাল। লোকটাকে চমকে দেবার কোনো দরকার নেই। পরে হয়তো দেখা যাবে চমকে দিতে গিয়ে এমন কিছু ঘটল যে উল্টো সে নিজেই চমকাল। লোকটির বিষয়ে আগে সে পুরোপুরি জানবে। তারপর অন্য ব্যবস্থা।
ফতে মাপ নেবার জন্যে ফিতা বের করল। দরজিদের মতোই উঁচু গলায় মাপ বলতে বলতে কাগজে লিখে নিল।
লম্বা ২৯
বুক ৩৪
পুট ৬
হাত ১২
মুহরি ১৬
গলা ১৩.৫
ফতে বলল, একটু দোয়া রাখবেন স্যার দরজির কাজটা যেন তাড়াতাড়ি শিখতে পারি। খবরের কাগজে নকশা করে, খবরের কাগজ কেটে কেটে কয়েকদিন চেষ্টা করেছি আউলা লেগে যায়।
মিসির আলি বললেন, সব কাজ সবার জন্যে না।
ফতে সামান্য চমকাল মিসির আলি এই কথাটা কেন বললেন। তিনি কি কিছু বুঝতে পারছেন? না এটা শুধুই কথার কথা। ফতে বলল, স্যার আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব। যদি কিছু মনে না নেন।
‘জিজ্ঞেস কর।’
ফতে মিনমিনে গলায় বলল, আমার বিষয়ে আপনার কী ধারণা?
তোমার প্রশ্নটা বুঝতে পারছি না। আরো পরিষ্কার করে বল।
‘আমাকে দেখলে আপনার কী মনে হয়?’
‘মনে হয় তুমি সব সময় আতঙ্কে আছ। সবাইকে ভয় পাচ্ছ।’
ফতে মুখ শুকনা করে ফেলল। ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে উঠে পড়ল। তার মাথা ঝিমঝিম করছে। এই লোক কী করে বুঝল সে সবাইকে ভয় পায়। তার ভয় তো সে প্রকাশ করে না। নিজের ভিতর লুকিয়ে রাখে। লুকানো জিনিস সে জানল কীভাবে?
স্যার আমি যাই?
ফতুয়ার লেখা কাগজটা ফেলে গেছ। মাপটা নিয়ে যাও। লম্বার মাপে ভুল আছে—লম্বা বাইশ। তুমি মাপ নিয়েছ বাইশের বলেছ ঊনত্রিশ, লিখেছও ঊনত্রিশ।
.
মিসির আলি সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘরেই থাকলেন। প্রতিমা এল না। এতে তার টেনশন কমল না—যে কোনো সময় চলে আসবে এই টেনশন থেকেই গেল।
সন্ধ্যায় ফতুয়া আনতে গেলেন। দরজির দোকান ফতে সুন্দর সাজিয়েছে। ঝলমলে বাতি জ্বলছে। টাকা দিয়ে মিসির আলি ফতুয়া নিলেন। দোকানের মালিক ফতে ছিল না। মিসির আলি কেমন যেন স্বস্তিবোধ করলেন। স্বস্তিবোধ করার কারণটা তাঁর কাছে স্পষ্ট না।
মিসির আলি মাথা নিচু করে হাঁটছেন। বাসায় ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে না। তার মনে ক্ষীণ সন্দেহ–বাসায় ফিরে দেখবেন প্রতিমা এসেছে। দেড়টনি একটা ট্রাক নিয়ে এসেছে। সে ট্রাকে মিসির আলির জিনিসপত্র তুলে অপেক্ষা করছে কখন মিসির আলি আসবেন।
এতটা এই মেয়ে নিশ্চয়ই করবে না, আবার করতেও পারে। অস্বাভাবিক মানুষ পারে না এমন কাজ নেই। কাউকে চট করে অস্বাভাবিক বলা ঠিক না। মানুষ স্বাভাবিক এবং অস্বাভাবিকের সীমারেখায় বাস করে। একজন স্বাভাবিক মানুষ মাঝে মধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ করে, আবার খুবই অস্বাভাবিক মানুষ হঠাৎ স্বাভাবিক আচরণ করে। এখানেও কথা আছে—কোন আচরণগুলিকে আমরা স্বাভাবিক আচরণ বলব। স্বাভাবিকের মানদণ্ড কে ঠিক করে দেবে? মিসির আলি যে আচরণকে স্বাভাবিক ভাবছেন—ফতে মিয়া কি তাকে স্বাভাবিক ভাববে?
ভ্রূ কুঁচকে মিসির আলি ফতের কথা ভাবতে শুরু করলেন। ফতেকে কি খুব স্বাভাবিক মানুষ বলা যায়?
মিসির আলি মাথা নেড়ে নিজের মনে বললেন, হ্যাঁ বলা যায়।
মিসির আলি আবারো নিজেকে প্রশ্ন করলেন, ফতেকে কি অস্বাভাবিক বলতে চাইলে বলতে পারে?
প্রশ্ন এবং উত্তরের খেলা চলতে লাগল। কিছু দাবা খেলোয়াড় আছে সঙ্গী না পেলে নিজেই নিজের সঙ্গে দাবা খেলে—মিসির আলিও ইদানীং তাই করেন। নিজেই প্ৰশ্ন করেন। নিজেই উত্তর দেন। কাজটা বেশিরভাগ সময় করেন পথে যখন হাঁটেন। এটাও বয়স বাড়ার কোনো লক্ষণ কি না তিনি জানেন না। একটা বয়সের পর সবাই কি এ রকম করে? করার কথা।
মিসির আলির নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলার নমুনা এ রকম—
প্রশ্ন : ফতের কোন আচরণটা সবচেয়ে অস্বাভাবিক?
উত্তর : সে ভীতু প্রকৃতির মানুষ। ভয়ে সে অস্থির হয়ে থাকে। ভীতু মানুষরা কারো চোখের দিকে সরাসরি তাকায় না। আর তাকালেও খুব অল্প সময়ের জন্যে তাকায়। এ ধরনের মানুষ বেশিরভাগ সময় মেজের দিকে তাকিয়ে কথা বলবে। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ফতে সব সময় চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
প্ৰশ্ন : সে কেন চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে?
উত্তর : হয়তোবা চোখের ভাষা পড়তে চায়। হয়তো সে চোখের ভাষা সহজে বুঝতে পারে।
প্ৰশ্ন : তোমার এই হাইপোথিসিস কীভাবে প্রমাণ করা যাবে?
উত্তর : খুব সহজেই প্রমাণ করা যায়। চোখে সানগ্লাস পরে তার সামনে বসতে হবে। সানগ্লাসের কারণে তার চোখ দেখা যাবে না। কাজেই ফতে আর চোখের দিকে তাকাবে না।
প্ৰশ্ন : আর কোনো পদ্ধতি আছে?
উত্তর : একজন জন্মান্ধের সঙ্গে তাকে কথা বলতে দিয়ে দেখা যেতে পারে।
প্ৰশ্ন : তার অস্বাভাবিকতার আর কোনো উদাহরণ কি আছে?
উত্তর : হ্যাঁ আছে। বড় একটা উদাহরণ আছে।
প্রশ্ন : বল শুনি।
উত্তর : না এখন বলব না। আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে নিই।
প্ৰশ্ন : কী আশ্চর্য তুমি যা বলার আমাকেই তো বলছ। আমি তো বাইরের কেউ না।
উত্তর : যে প্রশ্ন করছে এবং যে উত্তর দিচ্ছে তারা একই ব্যক্তি হলেও আলাদা সত্তা। একটি সত্তা অন্য সত্তার থেকে নিজেকে আলাদা রাখতে চাইতেই পারে।
মিসির আলি ঘড়ি দেখলেন সাড়ে সাতটা বাজে। প্রায় দেড় ঘণ্টা তিনি হেঁটেছেন—কোনো এক চিপা গলির ভেতর ঢুকে পড়েছেন। জায়গাটা চিনতে পারছেন না। একজনকে জিজ্ঞেস করলেন-’ভাই এই জায়গাটার নাম কী?’ সে এমনভাবে তাকাল যেন খুব গর্হিত কোনো প্রশ্ন তিনি করে ফেলেছেন। জবাব না দিয়ে সে চলে গেল। আরেকজনকে একই প্রশ্ন করলেন, সে নিতান্তই বিরক্ত গলায় বলল, জানি না।
অদ্ভুত এক গলি, তার চোখের সামনে দিয়ে কালো রঙের প্রকাণ্ড এক শূকর কয়েকটা বাচ্চা নিয়ে চলে গেল। মেথরপট্টিতে শূকর পোষা হয় এই জায়গাটা নিশ্চয় মেথরপট্টি না। তিনি কোথায় এসে পড়েছেন?
.
রাত ন’টা।
ফতে মিয়াকে নিউমার্কেটের কাঁচাবাজারে ঘোরাফেরা করতে দেখা যাচ্ছে। সে এসেছে মুরগি কিনতে। সে চারটা রোস্টের মুরগি কিনবে। ফতের মামির কিছু বান্ধবী কাল দুপুরে খাবে। মামি রাতেই রোস্ট রেঁধে ফেলতে চান।
ফতে দাঁড়িয়ে আছে—বড় মাছের দোকানের সামনে। বিশাল চকচকে বঁটি দিয়ে মাছ কাটা হয়—বঁটির গা বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ে। কী অসাধারণ দৃশ্য! ফতের দেখতে ভালো লাগে। দৃশ্যটা দেখার সময় মেরুদণ্ড দিয়ে শিরশির করে কী যেন বয়। শরীর ঝনঝন করতে থাকে। ফতের বড় ভালো লাগে। মাছটা যদি জীবিত হয় তখন তার আরো ভালো লাগে। আজ একটা কাতল মাছ কাটা হচ্ছে। মাছটা জীবিত ছটফট করছে। আহা কী দৃশ্য!
মাছ কাটা দেখে ফতে গেল মুরগি কিনতে। ফতে মনের ভেতর চাপা আনন্দ অনুভব করছে। জীবিত মুরগিগুলিকে জবেহ করা হবে। জবেহ করার ঠিক আগে মুরগিগুলি আতঙ্কে অস্থির হয়ে ছটফট করতে থাকে—তখনো ফতের ভালো লাগে। ফতে ঠিক করেছে মুরগি জবেহ করার সময় সে বলবে মাথাগুলি যেন পুরোপুরি শরীর থেকে আলাদা করা হয়। খুব ছোটবেলায় একবার সে এই দৃশ্য দেখেছিল। বাড়িতে মেহমান এসেছে— মুরগি জবেহ হচ্ছে। ধারালো বঁটি দিয়ে টান দিতেই মুরগির মাথাটা শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেল। যে মুরগি ধরে ছিল সে হাত ছেড়ে দিল। কী আশ্চর্য মাথা ছাড়া মুরগিটা তিন-চার পা এগিয়ে গিয়ে ধপ করে পড়ে গেল। এই দৃশ্য এর পরে ফতে আর দেখে নি। যতবারই মুরগি কাটা হয়—ফতে আগ্রহ নিয়ে এই দৃশ্য দেখার জন্যে বসে থাকে। সে নিশ্চিত একসময় না একসময় সে দৃশ্যটা দেখবে। কে জানে কপাল ভালো হলে হয়তো আজই দেখবে। আজ তার জন্যে শুভদিন। নিজের দোকান চালু হয়েছে।
ফতে মুরগি কাটতে দিয়ে নিচুগলায় বলল, মুরগির মাথা পুরাটা আলগা করে ফেলেন।
মুরগি কাটার লোক বলল, বুঝলাম না কী কন।
ফতে বলল, এক পোচ দিয়ে মাথা আলাদা করে ফেলেন।
লোকটা আপত্তি করল না। যা বলা হল তাই সে করল। ছোটবেলার ঘটনাটা ঘটল না। মাথাবিহীন কোনো মুরগি দৌড় দিল না। ফতে আফসোসের ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল। এ ধরনের মজাদার ঘটনা রোজ রোজ ঘটে না। হঠাৎ হঠাৎ ঘটে।
মুরগির কাটা মাথাগুলি ফতে আলাদা করে পলিথিনের ব্যাগে নিয়ে নিল। কাটা মাথাগুলি নিয়ে একটা মজা করা যাবে। যে বেবিট্যাক্সিতে করে সে বাড়িতে ফিরবে মুরগির কাটা মাথাগুলি সেই বেবিট্যাক্সির সিটে রেখে দেবে। সিটের উপর রক্তমাখা মাথা রেখে ফতে নেমে যাবে। পরে যে যাত্রী উঠবে সে বসতে গিয়ে ভয়ে ভিরমি খাবে। চিৎকার-চেঁচামেচি করবে। ফতের ভাবতেই ভালো লাগছে। এই সময় সে কাছে থাকবে না এটাই একটা আফসোস।
ফতে বেবিট্যাক্সি বাড়ি পর্যন্ত নিল না, বাড়ির কাছাকাছি এসে ছেড়ে দিল। বেবিট্যাক্সিওয়ালাকে বাড়ি চেনানো মোটেই ঠিক হবে না। কেন সে মুরগির মাথা সিটে রেখেছে তা নিয়ে দরবার করতে পারে। এই সব সূক্ষ্ম কাজ খুব ঠাণ্ডা মাথায় করতে হয়। সামান্য উনিশ-বিশও করা যায় না। ফতে এই কাজগুলি ঠাণ্ডা মাথায় করে বলেই এখনো টিকে আছে। কেউ তাকে ধরতে পারে নি। কোনোদিন পারবেও না।
চারটা মুরগি নিয়ে ফতে রওনা হয়েছে। তার বেশ মজা লাগছে। সে কল্পনায় দেখতে পাচ্ছে তার পরে বেবিট্যাক্সিতে যে উঠবে তার দশাটা কী হবে। ধরা যাক স্বামী- স্ত্রী উঠেছে। প্রথমে উঠল স্ত্রী। সে বসতে গিয়ে বলল, কিসের ওপর বসলাম গো? স্বামী বলল, তুমি সব সময় যন্ত্রণা কর। স্ত্রী বলল, হাতে যেন রসের মতো কী লাগল। এর মধ্যে স্বামী এসে উঠেছে। দেয়াশলাই জ্বালিয়ে আঁতকে উঠেছে—হতভম্ব গলায় বলছে সর্বনাশ শত শত মুরগির মাথা। কোত্থেকে আসল?
চারটা মুরগির মাথাই তখন তাদের কাছে শত শত মুরগির মাথা বলে মনে হবে। ভয় পেলে এ রকম হয়।
ফতে ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে ভাবল মুরগির মাথা না হয়ে যদি মানুষের মাথা হত তখন কেমন হত। চারটা মাথার তখন প্রয়োজন নেই। একটা কাটা মাথাই যথেষ্ট। সিটের এক কোনায় কাটা মাথাটা পড়ে আছে। অন্ধকার বলে সবকিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। যাত্রী উঠল। বেবিট্যাক্সি চলা শুরু করেছে। যাত্রী বলল, কে যেন ব্যাগ নাকি ফেলে গেছে। বলেই সে হাত দিয়ে জিনিসটা তুলল। এরপর যে নাটক হবে তার কোনো তুলনা নেই। এই নাটক কল্পনায় দেখলে হবে না। এই নাটক দেখতে হবে বাস্তবে। বেবিট্যাক্সি নিয়ে ফতেকেই বের হতে হবে। যাত্রী যখন কাটা মাথাটা হাত দিয়ে তুলে ধরে হতভম্ব গলায় বলবে—’এটা কী?’ তখন ফতে খুব স্বাভাবিক গলায় বলবে, ‘এটা একটা ছোট বাচ্চার কাটা মাথা। সাইডে রেখে দেন।’
ভাবতেই গা যেন কেমন করছে। মেরুদণ্ড দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে। শরীর ঝলমল করছে।
কাজটা করতে হবে। একটা কাটা মাথা নিয়ে বের হতে পারলে অনেক মজা করা যাবে। হয়তো আত্মভোলা টাইপ কোনো যাত্রী উঠেছে। সিটের কোনায় কী পড়ে আছে সে তাকিয়েও দেখছে না। তাকে সে বলল, স্যার সিটের কোনায় ছোট বাচ্চার একটা কাটা মাথা আছে। একটু খেয়াল রাখবেন মাথাটা যেন পড়ে না যায়।
কিংবা ধরা যাক খুব সাহসী কোনো যাত্রী এসেছে। সে প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বলল, এই বেবি থামাও। গাড়ির ভেতর মানুষের মাথা কেন? কোথেকে এসেছে। চল থানায় চল।
সে তখন খুবই বিনীত গলায় বলবে, মাথাটা স্যার আমি এনেছি। শুক্রাবাদ থেকে আরেকটা মাথা তুলে ডেলিভারি দিতে হবে। মাল দুটা ডেলিভারি দিয়ে আপনার সঙ্গে থানায় যাব। কোনো সমস্যা নেই।
ফতের চোখ চকচক করছে। কল্পনা করতেই এত আনন্দ। আসল ঘটনার সময় না- জানি কত আনন্দ হবে।
আসল ঘটনার খুব দেরিও নেই। নকল ঘটনা ঘটতে ঘটতে আসল ঘটনা ঘটে। তার জীবনে সব সময় এ রকমই হয়েছে। অতীতে যেহেতু হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। কোনো এক বর্ষার রাতে দেখা যাবে মাফলার দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে সে বেবিট্যাক্সি নিয়ে বের হয়েছে। সেই বেবিট্যাক্সির ‘প্রাইভেট’ লেখা সাইনবোর্ড সে খুলে ফেলেছে। এখন তারটা সাধারণ ভাড়ার বেবিট্যাক্সি। ফার্মগেট থেকে যাত্রী তুলেছে, যাবে উত্তরায়। মোটামুটি ফাঁকা রাস্তা। স্বামী-স্ত্রী এবং ছোট একটা বাচ্চা। বাচ্চাটাই প্রথম দেখল। সহজ গলায় মাকে বলল—মা এটা কী?
ফতের মামি তসলিমা খানম ফতেকে দেখেই রেগে উঠলেন। ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, চারটা মুরগি কিনতে এতক্ষণ লাগে? তুমি কি ডিমে তা দিয়ে মুরগি ফুটিয়ে এনেছ?
ফতে কিছু বলল না। বলার কিছু নেই। সে যদি পাঁচ মিনিটের মধ্যে চলে আসত— তা হলেও তসলিমা খানম চেঁচামেচি করতেন। অন্য কোনো প্রসঙ্গ নিয়ে চেঁচামেচি। তখন হয়তো বলতেন—বুড়া মোরগ কোত্থেকে এনেছ? এটা কি রোস্টের মুরগির সাইজ। রোস্টের মুরগির যে মিডিয়াম সাইজ হয় তুমি জান না। নাকি জীবনে কখনো রোস্ট খাও নি। তোমাকে কি রোস্ট কোনোদিন দেওয়া হয় না। আবার বেয়াদবের মতো চোখে চোখে তাকিয়ে আছ কেন?
মামির চেঁচামেচিকে ফতে গ্রাহ্য করে না। কিন্তু ভাব করে যেন খুব গ্রাহ্য করছে। ভয়ে বুক কাঁপছে। এই অভিনয় সে ভালোই করে শুধু একটাই সমস্যা তাকে তাকিয়ে থাকতে হয়। চোখের দিকে না তাকালে সে মাথার ভেতর ঢুকতে পারে না। সমস্যা হচ্ছে চোখের দিকে তাকালেই লোকজন মনে করে সে বেয়াদবি করছে।
তসলিমা খানমের মাথার ভেতর ঢোকা ফতের জন্যে খুব সহজ। হুট করে ঢুকে যাওয়া যায়। তবে খুব সাধারণ একটা মাথা। ঢুকে কোনো আনন্দ নেই। এই মহিলার সমস্ত চিন্তাভাবনা সংসার নিয়ে। আজ কী রান্না হবে। ঘর কোথায় নোংরা। ধোপাখানা থেকে কাপড় আনতে হবে। সবুজ রঙের বিছানার চাদরটা কি শেষ পর্যন্ত হারিয়ে গেল। কাজের বুয়া চুরি করে নি তো। এই মহিলার চিন্তাভাবনার মধ্যে শুধু একটাই মজার ব্যাপার আছে—খায়রুল কবির নামের একজন আধবুড়ো মানুষ। এই আধবুড়ো লোকটাকে এই মহিলা ডাকেন—বড়দা। আধবুড়োটা তাকে ডাকে পুটুরানী। আধবুড়ো শয়তানটা বিয়ে করে নি। সে বাসাবোর একটা দোতলা বাড়িতে থাকে। ফতে কোনোদিন সে বাড়িতে যায় নি তবে বাড়িটা কোথায়, কেমন সব জানে। কোন ঘরে কী ফার্নিচার তাও সে বলতে পারবে। কারণ ঐ বাড়িটা তসলিমা খানমের মাথায় খুব পরিষ্কারভাবে আছে। তসলিমা খানম স্কুলে পড়ার সময় থেকে ঐ বাড়িতে যেতেন। বিয়ের পরেও যান। আধবুড়ো শয়তানটা তখন তাকে পুটুরাণী, পুটুরানী করে খুবই নোংরাভাবে আদর করা শুরু করে। একসময় পুটুরানী বলে, বড়দা এ রকম করলে আমি কিন্তু আর আসব না। তুমি একা একা থাক বলে মাঝে মাঝে তোমাকে দেখতে আসি, তুমি এসব কী কর। বুড়োটা বলে—আচ্ছা যা আর আসতে হবে না। পুটুরানী তখন বলে, দরজাটা বন্ধ কর। দরজা তো খোলা। বুড়োটা বলে, তোর বন্ধ করতে ইচ্ছা হলে তুই কর। পুটুরানী বলে, কে না কে দেখবে।’ বুড়ো বলে, দেখুক যার ইচ্ছা।
ফতের মাঝে মাঝে ইচ্ছা করেছে বুড়োর কথা বলে হঠাৎ সে তার মামিকে চমকে দেয়। যেমন সে খুব সহজ গলায় বলল, মামি বুধবার যে আপনার বড়দার কাছে যাওয়ার কথা, আপনি যাবেন না?
এটা করা ঠিক হবে না। তখন তার আশ্রয় নষ্ট হয়ে যাবে। মামি তৎক্ষণাৎ তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন। তবে এখন যদি সে চায় তা হলে এই কাজটা করতে পারে। এখন বাড়ি থেকে বের করে দিলেও তার থাকার জায়গা আছে। সাজঘরে বিছানা পেতে শুয়ে থাকবে। এখন ‘পুটুরানীর’ বিষয়টা নিয়ে মজা করা যায়। মজাটা এমনভাবে করা যেন কেউ ধরতে না পারে মজার পেছনে সে আছে।
ফতেকে আবার বাজারে যেতে হচ্ছে। গরম মশলা এনে বাসায় ঢোকা মাত্র মামি বললেন, টক দই আন নি কেন? তিনটা মাত্র জিনিস আনতে পাঠালাম এর মধ্যে একটা ভুলে গেলে। তখন ফতে যদি বলে, টক দইয়ের কথা আপনি বলেন নি তা হলে মামি খুবই রেগে যাবেন। আবার ফতে যদি নিজ থেকে টক দই নিয়ে আসে তা হলেও মামি রাগ করবেন। গলার রগ ফুলিয়ে বলবেন, আগবাড়িয়ে তোমাকে কে দই আনতে বলেছে? সব সময় মাতব্বরি কর কেন? আলগা মাতব্বরি করবে না।
বাজারে যাবার সময় ফতে দেখল—সিঁড়ির গোড়ায় লুনা বসে আছে। একা একা খেলছে। হাতের আঙুল একবার খুলছে একবার বন্ধ করছে। এটা লুনার বিশেষ ধরনের খেলা এবং খুবই পছন্দের খেলাটা সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খেলতে পারে।
ফতে তার কাছে এগিয়ে বলল—পুটুরানী পুটুরানী।
লুনা চোখ তুলে তাকাল। মিষ্টি করে হাসল। ফতে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল—পুটুরানী, পুটুরানী, পুটুরানী।
এইবার লুনা ফিসফিস করে বলল, পুটুরানী।
ফতে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। কাজ হয়েছে। এখন লুনা নিজের মনেই পুটুরানী পুটুরানী করতে থাকবে। ফতের মামি ব্যাপারটা খুব সহজভাবে নিতে পারবেন না। লুনার কপালে আজ দুঃখ আছে। চড়থাপ্পড় অবশ্যই খাবে। ভাবতেই ফতের মজা লাগছে। লুনার চড়থাপ্পড়ের চেয়ে মজার দৃশ্য হবে পুটুরানী পুটুরানী শুনে তসলিমা খানম কী করেন সেটা। এই মজার দৃশ্য ফতে দেখতে পাবে না। কী আফসোস!
প্রচুর বানান ভুলরে ভাই