দশরথ : পক্ষপাতদোষে দুষ্ট, বিষয়াসক্ত, কামার্ত, স্ত্রৈণ রাজা
বিভিন্ন গ্রন্থ ঘেঁটে দশরথকে পাওয়া যায় ইক্ষ্বাকু বা সূর্যবংশীয় রাজা অজের পুত্র হিসাবে। ইনি অযোধ্যার রাজা এবং রাম লক্ষ্মণাদির পিতা হিসাবে সর্বজনবিদিত। কৌশল্যা, কৈকেয়ী ও সুমিত্রা নামে এঁর তিনজন প্রধান মহিষী ছিলেন। মুনিবর বাল্মীকি বলেছেন এছাড়াও প্রায় ৩৫০ টি স্ত্রী ছিল দশরথের–
“অর্ধসপ্তশস্তত্র প্রমদাস্তাম্রলোচনাঃ”।
মহাকবি কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর লেখা রামায়ণে দশরথের সাতশো স্ত্রীর কথা উল্লেখ করেছেন। অনেক প্রকৃত ঘটনার মতো ‘অর্ধ’ শব্দটি কৃত্তিবাস নজরের বাইরেই রেখে দিলেন। দশরথের প্রধান স্ত্রী তিনজনই–জ্যেষ্ঠা কৌশল্যা, দ্বিতীয়া কৈকেয়ী এবং কনিষ্ঠা সুমিত্রা। মূল বাল্মীকির রামায়ণে কৈকেয়ীকে ছোটো রানি হিসাবে উল্লেখ করা হলেও কৃত্তিবাস বলেছেন মেজো রানি। কৈকেয়ী কেকয়দেশের পাঞ্জাবি মেয়ে। কেকয় দেশ শতদ্রু ও বিপাশার মধ্যবর্তী অঞ্চলকে বোঝায়, যা বর্তমান পাঞ্জাব। বাল্মীকির রামায়ণে সুমিত্রার কোনো পিতৃপরিচয় জানা যায় না। তবে কৃত্তিবাস সুমিত্রাকে সিংহলের মেয়ে বললেও, মহাকবি কালিদাস তাঁর “রঘুবংশম’-এ মগধের মেয়ে বলে উল্লেখ করেছেন। কৃত্তিবাস এসব অসমর্থিত তথ্য কোথায় পেলেন তাঁর কোনো সূত্র তিনি দেননি। তিনশো স্ত্রীর বিষয়ে রামায়ণে মাত্র একবারই উল্লেখ হয়েছে, তা শ্রীরামচন্দ্রের বনবাসের বিদায় দেওয়ার সময়। এদের নাম-পরিচয় কিছুই জানা যায়নি।
বাল্মীকির রামায়ণ ছাড়া অন্য প্রাদেশিক কিছু রামায়ণে কৌশল্যাকে কোশল রাজার কন্যা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ পরিচয় কোথায় পেয়েছেন সেটা তাঁরাই বলতে পারেন। বাল্মীকি তাঁর গোটা রামায়ণের কোথাও এ পরিচয় দেননি। কোশলরাজের যে উল্লেখ বাল্মীকি করেছেন, সেখানে কোথাও কৌশল্যার পিতা বা দশরথের শ্বশুর এমন উল্লেখ নেই। কৌশল্যা কোশলরাজের কন্যা না-হলেও কোশল দেশের মেয়ে হয়তো ছিলেন। সেই কারণেই তিনি কৌশল্যা। বাল্মীকির রামায়ণে মাত্র একবারই কোশলরাজকে পাই, যখন দশরথ অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন।তিনি এ যজ্ঞে নিমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে ছিলেন। বাল্মীকি কৌশল্যার পিতৃ-পরিচয় উল্লেখ না-করলেও, দশরথের দ্বিতীয় স্ত্রী কৈকেয়ীর পিতৃ-পরিচয় সযত্নে দিয়েছেন। কৈকেয়ী ছিলেন কেকয়রাজ অশ্বপতির কন্যা, অতএব তিনি রাজকন্যা। কৈকেয়ীর ভাই যুধাজিৎ। এই অশ্বপতি ও যুধাজিতের প্রসঙ্গ বাল্মীকির রামায়ণে বহুবার আছে। দশরথের কনিষ্ঠা স্ত্রী সুমিত্রা অভিজাত বংশের কন্যা ছিলেন, এমন পরিচয় বাল্মীকির রামায়ণে পাওয়া যায় না। তাহলে কি নিন্মবর্গীয়া ছিলেন? এর প্রমাণ পেতে গেলে শ্রীরামচন্দ্রের সম্ভাষণ অনুসরণ করতে হবে। শ্রীরামচন্দ্র বিমাতা কৈকেয়ীকে ‘আর্যা কৈকেয়ী’, ‘দেবী কৈকেয়ী’, ‘কৃষ্ণলোচনা কৈকেয়ী’ ‘জননী কৈকেয়ী’ বা ‘দেবী কৈকেয়ী’ প্রভৃতি সম্মানসূচক বিশেষণে সম্ভাষণ করতেন। অপরদিকে সুমিত্রাকে সম্মানসূচক বিশেষণ ছাড়াই নাম ধরে ডাকতেন। ন্যূনতম মা বলে ডাকতেন না। অতএব সুমিত্রা নিম্নবর্গীয় এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকছে না। প্রমাণ চান? শ্রীরামচন্দ্র তাঁর মা কৌশল্যাকে বলছেন–“দেখুন আপনি, আমি, জানকী, লক্ষ্মণ ও সুমিত্রা … পিতা যাহা বলিবেন তাহাই করিব।”
দশরথ অযযাদ্ধা বা অযোধ্যার রাজা ছিলেন। অযোধ্যা একটি অতি ক্ষুদ্র রাজ্য বা দেশ ছিল, যার আয়তন ৭৪৩ বর্গমাইল। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ ছিল আরও কম, মাত্র ৪৯৫ বর্গমাইল। যদিও প্রাদেশিক কিছু রামায়ণে বলা হয়েছে, বসুন্ধরায় যতদূর সূর্যকিরণ পৌঁছোয় ততদূর পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্য। বাল্মীকি কিন্তু দশরথকে অত বড়ো সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হিসাবে দেখাননি। তাঁকে বরং অতি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের নরপতি হিসাবে দেখিয়েছেন। দশরথের সাম্রাজ্যকে ‘নগররাষ্ট্র’ বলা হত। দশরথ আটজন মন্ত্রী এবং ঋত্বিক, বামদেব, বশিষ্ঠের সাহায্যে তাঁর স্বাধীন রাজ্য চালাতেন। সে যুগে এমন রাষ্ট্র অসংখ্য ছিল। রামায়ণের যুগে তো বটেই, মহাভারতের যুগেও এমন ‘নগররাষ্ট্রের সংখ্যা প্রচুর পাওয়া যায়।
দশরথ যখন কৈকেয়ীকে বিয়ে করছেন, তখন পর্যন্ত অপুত্রক ছিলেন। একে অপুত্রক মায় ক্ষুদ্র নরপতি, তায় আবার দোজবর। কেকয়রাজ অশ্বপতি এমন বিয়েতে রাজি হলেন কেন? রাজি হলেন এই কারণে যে ভবিষ্যতে কৈকেয়ীর সন্তানই হবে অযোধ্যার রাজা। হিসাবমতো (প্রথা) প্রথমা মহিষীর পুত্রই রাজত্বলাভ করে থাকে। যদিও তখনও পর্যন্ত দশরথ অপুত্রক, তা সত্ত্বেও কেকয়রাজ অশ্বপতি কোনো ঝুঁকি নিতে চাননি। তাই তিনি বিয়ের আগেই প্রতিজ্ঞা বা চুক্তি করিয়ে নিলেন দশরথকে দিয়ে। বলা হল পরিস্থিতি যেমনই থাক, কৈকেয়ীর পুত্রকেই দশরথ সমস্ত রাজ্য লিখে দেবেন।
যদিও কৌশল্যাকে দশরথ পুত্রসন্তান দিতে পারেননি, কৈকেয়ীকেও পুত্রসন্তান দিতে পারেননি। সুমিত্রাকেও নয়। অতএব এটা বুঝতে হবে, দশরথ সন্তান জন্মদানে অক্ষম ছিলেন। তবে যৌনতায় অক্ষম ছিলেন একথা বলা যায় না। যৌনতা না-থাকলে তিনি এতগুলি বিয়ে করতেন না, ‘কচি’ বউ কৈকয়ীর কাছে সর্বক্ষণ লেপটে থাকতেন না। নারীই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। নারীই তাঁর সর্বনাশ।
তিন-তিনটে প্রধানা থাকা সত্ত্বেও দশরথ সন্তানের পিতা হতে পারেননি। বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত তিনি নিঃসন্তান বা অপুত্রক ছিলেন। সে যুগে রাজা নিঃসন্তান হলে সেই রাজার মুখ দেখাও অমঙ্গল ছিল। তা ছাড়া পরবর্তী রাজা কে হবেন, সেই চিন্তায় অপুত্রক রাজার বিনিদ্র রজনি কাটত। তার উপর চারিদিক কানাঘুষোও চলত। রাজা দশরথকে লাঞ্ছিতও হতে হয়েছিল। সেকালে পুত্র-সন্তানের আশায় রাজারা যেমন একাধিক বিয়ে করতেন, তেমনই একই কারণে সাধারণ পুরুষরাও একাধিক বিয়ে করতেন–“পুত্ৰৰ্থে ক্রিয়তে ভাৰ্য্যা”। সন্তান বা পুত্র সন্তান জন্ম দিতে না-পারার সমস্ত দায় মাথায় নিয়ে মেয়েদেরকে অসংখ্য সতীনদের সঙ্গে সংসার করতে হত।
এত সংখ্যক রমণীকে বিয়ে করেও রাজা দশরথ পুত্র-সন্তানের স্বাদ পাননি। তাহলে কি দশরথে নিজেই পুত্র সন্তান উৎপাদনে অসমর্থ ছিলেন। শান্তার জন্মের ব্যাপারটাও তো রহস্যাবৃত। শান্তাই দশরথের একমাত্র কন্যা সন্তান। সন্তান বা পুত্র-সন্তান জন্ম দিতে না-পারার জন্য পুরুষ বা স্বামীদের কোনো দায় নিত না–সেকালেও নয়, একালেও নয়। শুধু দশরথই নয়–রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণগুলিতে অসংখ্য সন্তান জন্মদানে অক্ষম ক্ষত্রিয় রাজাদের পরিচয় আমরা পাই। এরা কেন সন্তান জন্মদানে অক্ষম ছিলেন তার ব্যাখ্যা সবক্ষেত্রেই পাওয়া যায়নি।
দশরথ, দিলীপ, ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু–এঁরা এরকমই অক্ষম পুরুষ ছিলেন। তবে দশরথ মোটেই ধ্বজভঙ্গ বা লিঙ্গ উত্থানরহিত (Improtent) ছিলেন না। স্মর্তব্য, এইসব অক্ষম পুরুষরা ক্ষত্রিয় রাজা ছিলেন। অথচ ব্রাক্ষণকুল এবং দেবতাকুল এরা বলে বলে পুত্র-সন্তানের জন্ম দিতেন, এই প্রক্রিয়ায় তাঁরা কোনো কন্যা-সন্তান জন্ম দিয়েছেন বলে শুনিনি৷ অক্ষম ক্ষত্রিয় রাজাদের স্ত্রীগণ হয় দেবতাদের দ্বারা, নয় ব্রাহ্মণ-ঋষিদের দ্বারা গর্ভবতী হয়েছেন। মহাকবি কালিদাসের ‘রঘুবংশম’-এ দিলীপ-ভার্যা সুদক্ষিণা বশিষ্ঠমুনি কর্তৃক গর্ভবতী হয়েছিলেন বলেই অনুমান করা যায়। দশরথ-ভার্যা তিন রানিই ঋষ্যশৃঙ্গ ঋষি কর্তৃক গর্ভবতী হয়েছিলেন বলে অনেক গবেষক বলেন। পাণ্ডু-ভার্যা কুন্তি ও মাদ্রির গভরক্ষা হয় যথাক্রমে সূর্য (পুত্র কর্ণ), ধর্ম (পুত্র যুধিষ্ঠির), পবন। (পুত্র ভীম), ইন্দ্র (পুত্র অর্জুন), অশ্বিনীদ্বয় (পুত্র নকুল ও সহদেব) কর্তৃক। এরকম অসংখ্য উদাহরণ উল্লেখ করা যায়। অলৌকিকের মোড়কে এই সমস্ত জন্মকে বর্ণনা করা হয়েছে প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে।
শিবের গলগল করে ঝরে-পড়া বীর্যে মনসা, কার্তিক ইত্যাদি শিশুদের জন্ম এবং অবশেষে পরিত্যক্তও হতে হয় সেইসব অসহায় সন্তানদের। ব্রাহ্মণ মুনিঋষিরা তো রানিদের গর্ভবতী করার মহান দায়িত্ব নিতেন, বেশ্যাদেরও গর্ভবতী করতে তাঁরা ছাড়েননি। অনভিপ্রেত যৌনসম্ভোগ করে বিশ্বামিত্র স্বৰ্গবেশ্যা মেনকাকেও গর্ভবতী করেছেন এবং সন্তান শকুন্তলাকে পরিত্যক্তা করেছেন। গবেষক-প্রাবন্ধিক মাহবুব লীলেন তাঁর সহজিয়া রামায়ণ রচনায় বলেছেন–
“দশরথ সাড়ে তিনশোখান বিবাহ করছে কি খালি শালা-শ্বশুরের প্রদর্শনী দিবার লাইগা? মোটেও তা না। এক বাপের এক পুতের অতখান বিবাহের মূল উদ্দেশ্য হইল পোলা জন্মাইয়া নিজের ঘরেই একখান সেনাবাহিনী গইড়া তোলার পাশাপাশি আশপাশের রাজ্যগুলায় পোলা-মাইয়া বিবাহ দিয়া বন্ধুত্ব কিংবা নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা। তয় একলা এক মানুষের পক্ষে অতগুলা বৌর ঘরে পোলাপান জন্ম দিতে খাটনিও লাগে, সময়ও লাগে। তার থাইকা পুত্রেষ্টী যজ্ঞে রাজার বৌদের একলগে গর্ভবতী কইরা একলগে একগাদা পোলাপানের বাপ হইয়া যাওয়া শাস্ত্রসম্মত সহজ উপায়। পুত্রেষ্টী যজ্ঞে রাজার বৌরা আমন্ত্রিত বামুন দ্বারা গর্ভবতী হইয়া রাজার ঘরে পোলাপানের জন্ম দেন, শাস্ত্রমতে রাজার পোলাপান হিসাবেই গণ্য হয়।”
এ কাহিনিগুলি যদি ইতিহাস হয়, যদি সমসাময়িক বর্ণনা হয়–তাহলে বলতেই হয় সে যুগে এ ধরনের যৌনমিলন এবং জন্ম দেওয়া স্বীকৃত ছিল। এ নিয়মকে বলা হত নিয়োগ প্রথা। প্রাচীন হিন্দুসমাজে প্রচলিত ছিল নিয়োগ বিধি, এটি একটি সংস্কার। বিধবা মহিলা অর্থাৎ যেসব মহিলার স্বামী মারা গেছেন, অথচ তার কোনো সন্তানসন্ততি নেই এবং যেসব মহিলার স্বামী আছেন কিন্তু তিনি সন্তান জন্মদানে অক্ষম সেই মহিলা তার স্বামী ও বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির অনুমতিক্রমে একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে সন্তান জন্মদানের উদ্দেশ্যে আহ্বান জানানোকেই ‘নিয়োগ প্রথা’ বলে।
এখানে উল্লেখ্য যে–(১) বিষয়টির সঙ্গে স্বামী ও অন্যান্য বয়োজ্যষ্ঠ ব্যক্তির অনুমতির ব্যাপার আছে এবং (২) এই প্রথাটি যৌন পরিতৃপ্তির সঙ্গে মোটেই সম্পর্কযুক্ত নয়। বরং এটা সমাজ ও পরিবারের একান্ত প্রয়োজন অনুসারেই শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনের জন্যই এই প্রথা অনুশীলন করা হয়। নারী-শরীরের সুস্থ বীর্য-স্থাপনাই এই প্রথার উদ্দেশ্য। তৎকালীন সময়ে নিয়োগ প্রথায় কিছু শর্ত শক্তভাবে পালিত হত। এটা সাধারণত কেন এবং কোন্ অবস্থায় করা হত, সেটা জেনে নেওয়া যেতে পারে–
নরক থেকে পূর্বপুরুষদের উদ্ধার করার জন্য পুত্র উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তার উপর স্মৃতিকাররা বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই যুগে যুগে ‘পুত্রেষ্টি যজ্ঞ চলছেই, পাশাপাশি চলছে কন্যাভ্রণ হত্যা। এই কারণে বিবাহিত জীবনে যদি সন্তান উৎপন্ন না-হয়, কী নিঃসন্তান অবস্থায় যদি কেহ মারা যায়, তা হলে তার স্ত্রী বা বিধবার ক্ষেত্রে’ অপরের দ্বারা সন্তান উৎপাদনের বিধান স্মৃতিকাররা দিয়েছিলেন। প্রধানত রাজপরিবারগুলিতে এবং অধিক ভূসম্পত্তির অধিকারী পরিবারগুলিতে বংশপরম্পরা রক্ষা এবং উত্তরাধিকারীর জন্যই এ প্রথা পালন করা হত। সাধারণত হিন্দুসমাজ পিতৃতান্ত্রিক এবং পিতার দিক থেকেই বংশ পরিচয় এবং উত্তরাধিকার নির্ধারিত হয়। এই অবস্থায় ধনাঢ্য পরিবারগুলির স্ত্রীদেরকে অন্যত্র বিয়ে দেওয়া হলে সেই স্ত্রীলোকের গর্ভে জন্ম নেওয়া সন্তানেরা পরবর্তীতে ওই (দ্বিতীয়বার বিবাহিত) নারীর দ্বিতীয় স্বামীর উত্তরাধিকারীরূপে পরিচিতি লাভ করবে। এ অবস্থায় ওই নারীর প্রথম স্বামীর পরিবার বিনাশের পথে যেতে পারে। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্যই এহেন বিধি পালন করা হত।
কারা নিয়োগ প্রথার অধিকারী ছিলেন?
(১) একজন নারী এই প্রথা অনুসরণ করবে শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনের জন্য, যৌন আনন্দ লাভের জন্য নয়।
(২) নিয়োগকৃত পুরুষ এই কাজটি করবেন ধর্মের জন্য, নারীকে সন্তান উৎপাদনে সাহায্যের জন্য–যৌন আনন্দ উপভোগের জন্য নয়।
(৩) এই উপায়ে জন্মগ্রহণকৃত সন্তান স্বামী-স্ত্রীর সন্তানরূপে বিবেচিত হবে, নিয়োগকৃত পুরুষ সেই সন্তানকে নিজের সন্তানরূপে দাবি করতে পারবে না।
(৪) ভবিষ্যতে নিয়োগকৃত পুরুষ সন্তানের পিতৃত্ব দাবিও করতে পারবে না।
(৫) অপব্যবহার রোধের জন্য একজন পুরুষ তার সারাজীবনে মাত্র তিনবার নিয়োগকৃত হয়ে যৌনমিলন করে গর্ভবতী করতে পারবে।
(৬) এই কাজকে ধর্ম হিসাবে দেখা হবে, যাতে নারীর মনে বা পুরুষের মনে এই ব্যাপারে কোনো আকাঙ্ক্ষা বা লোভ জন্ম না নেয়–একজন পুরুষ এই কাজটি নারীকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে করবে, আর নারী এই কাজটি করবে তার ও তার স্বামীর জন্য সন্তান লাভের উদ্দেশ্যে।
(৭) এই প্রথায় কোনো শৃঙ্গার হবে না, কোনোরূপ যৌনক্রিয়া হবে না, শুধুমাত্র যোনিতে লিঙ্গ প্রবেশ ছাড়া।
(৮) সেখানে একটা অর্ধস্বচ্ছ আচ্ছাদন থাকবে, যা দিয়ে নারীর উর্ধাঙ্গ ঢেকে দেওয়া হবে এবং নিয়োগকৃত পুরুষ শুধুমাত্র নারীর যৌনাঙ্গ দেখার অনুমতি লাভ করবে, যাতে সে শুধুমাত্র নিয়োগ-কর্ম সমাধা করতে পারে।
মহাভারতের একস্থানে ভীষ্ম বলেছেন–“দেবতারা পাঁচ প্রকারে সন্তান উৎপাদন করেন–বাসনা দ্বারা, বাক্য দ্বারা, দর্শন দ্বারা, স্পৰ্শন দ্বারা ও যৌনসঙ্গম দ্বারা”। বেদ, মনুসংহিতায় নিয়োগ প্রথার স্পষ্ট উল্লেখ আছে। কিন্তু রামায়ণ ও মহাভারত যখন লেখা হল তখন নিশ্চয় এ ধরনের প্রথা এবং জন্মদান নিশ্চয় বৈধতা হারায়। আর সেই কারণেই বোধহয় এহেন যৌনমিলন অলৌকিকতার মোড়কে মুড়ে দেওয়া হয়। না-হলে কেন ‘আপস্তম্ভ ধর্মসূত্র’-এ বলা হয়েছে–
“সন্তান প্রজননের জন্য স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে অপরের হস্তে সমর্পণ করা কলিযুগে নিষিদ্ধ হয়েছে। কলিযুগে এরূপ যৌনমিলন ব্যভিচাররূপে গণ্য হয় এবং এরজন্য স্বামী ও স্ত্রী উভয়েরই নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।”
এই উক্তি থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, পূর্ববর্তীকালের সমাজে ‘নিয়োগ’ প্রথা অনুমোদিত হলেও, পরবর্তীকালের সমাজে এ প্রথা নিষিদ্ধ হয়েছিল। প্রাচীনকালে দেবতা ও ঋষিদের পক্ষে যা বৈধ এবং প্রশস্ত ছিল, পরবর্তীকালের মানুষের পক্ষে তা গর্হিত ও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। আপস্তম্ভ বললেন যে, ব্যভিচার অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তির লিঙ্গ ও অণ্ডকোশ কর্তন করে শাস্তি দেওয়া হবে এবং যদি সে কোনো অনুঢ়া কন্যার সঙ্গে ব্যভিচার করে থাকে, তাহলে তার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে এবং তাঁকে দেশ থেকে বহিস্কৃত করা হবে। বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট নারী বা কুমারীকে রাজা সমস্ত কলঙ্ক থেকে মুক্ত করবেন এবং তাঁর অভিভাবকদের হাতে তাঁকে প্রত্যর্পণ করবেন, যদি অভিভাবক তাঁর দ্বারা যথোচিত প্রায়শ্চিত্ত সম্পাদনের ব্যবস্থা করেন। ব্যভিচারীর শাস্তিস্বরূপ নারদ যে দণ্ড বিধান করেছেন তা হচ্ছে–১০০ পণ অর্থদণ্ড, সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ, লিঙ্গ কর্তন ও মৃত্যু। বৃহস্পতিও বলেছেন যে, কলিযুগে ‘নিয়োগ’ প্রথা যথাযথ নয়। নিয়োগ’ প্রথানুযায়ী অপর পুরুষের দ্বারা গর্ভসঞ্চারণ করানোর রীতি যখন বিলুপ্ত হল, তখন নারীর সতীত্ব সম্পর্কে হিন্দুসমাজে এক নতুন ধারণা কল্পিত হল। সে আর-এক অধ্যায়।
মহাভারতে নিয়োগ প্রথার অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়। যেমন দীর্ঘতমা মুনি বঙ্গদেশের রাজা বলির রানি সুদেষ্ণার গর্ভে এই পদ্ধতিতেই কয়েকটি পুত্র উৎপাদন করেছিলেন। ঋষি পরাশর সত্যবতীর গর্ভে ব্যাসদেবকে উৎপাদন করেছিলেন। আবার ব্যাসদেব কুরুরাজ বিচিত্রবীর্যের দুই বিধবা পত্নী অম্বিকা এবং অম্বালিকার গর্ভে যথাক্রমে ধৃতরাষ্ট্র এবং পাণ্ডুকে জন্ম দিয়েছিলেন। এছাড়া তাঁর দ্বারাই অম্বিকার অনাম্মী দাসীর গর্ভে বিদুরের জন্ম হয়। পাণ্ডুরাজার দুই স্ত্রী কুন্তী ও মাদ্রীর গর্ভে পঞ্চপাণ্ডবের জন্ম হয় নিয়োগ পদ্ধতিতেই। অগ্নিপুরাণে ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু এবং পঞ্চপাণ্ডবের নিয়োগ প্রথা অনুসরণে জন্মগ্রহণের কথা বলা হয়েছে। রাজা সুদাসের পুত্র সৌদাসের রানি দময়ন্তীর গর্ভে ঋষি বশিষ্ট অশ্যককে জন্ম দেন।
গরুড়পুরাণে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জাত সন্তানকে বৈধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ঋকবেদে ১০/৪০/২ নম্বর শ্লোকটি বৈদিক যুগে নিয়োগ প্রথা চালু থাকার কথা বলেছে। গৌতম বশিষ্ট, বৌধায়ন, নারদ এবং মনু নিয়োগ সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। বৃহন্নারদীয় পুরাণের মতে নিয়োগ পদ্ধতি কলিযুগে কার্যকরী নয়। আদি পুরাণ এই নির্দেশিকা সমর্থন করেছে।
যাই হোক, রাজা দশরথকে কলঙ্কমুক্ত করতে এবং তাঁর মৃত্যুর পর পিতৃপুরুষের উদ্ধারের জন্যই উৎপাদন করা হয়েছে জন্ম বিষয়ক এই অলৌকিক কাহিনি। বাস্তবে যখন স্বাভাবিক উপায়ে রাজাকে পুত্রের স্বাদ দেওয়া সম্ভব নয়, তখনই অলৌকিকতার আশ্রয় এসেছে। প্রাদেশিক কবিরা ফল বা চরু বা পায়েস খাইয়ে স্ত্রীদের গর্ভবতী করানোর গল্প বলেছেন। বাল্মীকি কিন্তু বালকাণ্ডে (প্রক্ষিপ্ত?) সোজাসাপটাই বলেছেন দশরথের স্ত্রীদের গর্ভবতী হওয়ার প্রকৃত কাহিনি। রাজা দশরথ পুত্র সন্তানের জন্য ‘পুত্রেষ্টি যজ্ঞ’ করেন। পুত্রের জন্য শেষপর্যন্ত ঋষ্যশৃঙ্গকে দশরথ আহ্বান করেন–
“ততঃ প্রণম্য শিরসা তং বিপ্রং দেববর্ণিনম্।/যজ্ঞায় বরয়ামাস সন্তানার্থং কুলস্য চ৷৷”
যজ্ঞের মুনি ঋষ্যশৃঙ্গ যজ্ঞ থেকে একটা ফল পান এবং সেই ফল রাজাকে দিয়ে তাঁর পত্নীদের খাওয়াতে বলেন। সেই মোতাবেক দশরথ ফল নিয়ে দুই ভাগ করে তাঁর প্রধান দুই রানী কৌশল্যা আর কৈকেয়ীকে খেতে দেন। এমন সময় তৃতীয় রানী সুমিত্রা এসে কান্নাকাটি করল পুত্রলাভের ফলের জন্য। তখন কৌশল্যা দয়াবতী হয়ে তার ভাগের আর্ধেকটা ফল আরও দু-ভাগ করে একভাগ সুমিত্রাকে দেন। যথাসময়ে কৌশল্যার ঘরে রাম জন্ম নিলেন। কয়েকদিন পর কৈকেয়ীর ঘরে ভরত জন্ম নেন আর সুমিত্রার ঘরে যমজ পুত্র লক্ষ্মণ আর শত্ৰুগ্ন জন্ম নেন। অন্য এক কাহিনি থেকে জানা যায়–ভারতবর্ষের সরযু নদীর কাছে অযোধ্যা নামের এক নগরে দশরথ নামের এক রাজা ছিলেন। তাঁর কোনো সন্তান ছিল না। মনের দুঃখে একদা মন্ত্রীদের বললেন–আমি দেবতাদের তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে যজ্ঞ করব। যজ্ঞের আয়োজন সম্পন্ন করা হল। প্রথমেই করা হল ‘অশ্বমেধ যজ্ঞ’। ঘোড়ার মাংস দিয়ে এই যজ্ঞ করা হয়। জটিল এক প্রক্রিয়া, প্রথমে ঘোড়াটা ছেড়ে দেওয়া হয়। এই ঘোড়া এক বছর যেখানে খুশি সেখানে ঘুরে বেড়ায়, তারপর এটাকে ফিরিয়ে আনা হয়৷ ‘অশ্বমেধ যজ্ঞ’-তে যে ঘোড়াটা ছেড়ে দেওয়া হত সেটাকে নিজ রাজ্যে না-ফেরা পর্যন্ত কোথাও বাধা দেওয়া হত না। এই সময়টায় ওই ঘোড়ার পিছন পিছন খুব শক্তিশালী একটা সৈন্যদল থাকত। ঘোড়াটা ঘুরতে ঘুরতে অনেকগুলি রাজ্যে ঢুকে পরত এবং নিয়মটা ছিল ঘোড়াটা যেসব রাজ্যে ঢুকে পরত সেসব রাজাকে যজ্ঞকারী রাজার ‘জয়’ বলে মেনে নিতে হত৷ না-মানলে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হত।
যাই হোক, অশ্বমেধ যজ্ঞের পর ঋষ্যশৃঙ্গ বললেন–
“এরপর পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করিলে মহারাজের ছেলে হইবে”।
যজ্ঞের ফলে অলৌকিক ‘পায়েস’ এল। সেই পায়েস রানিদের খেতে দেওয়া হল। দশরথের তিন রানি কৌশল্যা, কৈকেয়ী, সুমিত্রা। কিছুদিন পর তাঁদের ছেলে হল। কৌশল্যার পুত্র রাম। কৈকয়ীর পুত্র ভরত। সুমিত্রার দুই পুত্র–লক্ষ্মণ এবং শত্রুঘ্ন। দশরথ নয়, দশরথের কোনো ভূমিকাতেও নয়–সন্তানের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব রানি-ত্রয়ী এবং অবশ্যই ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি৷ যুক্তিবাদী প্রাবন্ধিক প্রবীর ঘোষ স্পষ্টত বলেছেন–
“ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির সঙ্গে মিলনের ফলে জন্ম হয় দশরথের চার পুত্রের”।
অতএব রাম, লক্ষ্মণ, ভরত ও শত্রুঘ্নের ‘বায়োলজিক্যাল ফাদার’ দশরথ নন, মুনি ঋষ্যশৃঙ্গ। ‘ছাল’, ‘পায়েস’ খেয়ে কৌশলা রামের জন্ম দিয়েছেন–এটা যদি বিশ্বাস করতে বলেন, তাহলে রাম এবং রামায়ণ কিছুতেই ঐতিহাসিক হতে পারে না। অতএব অলৌকিক নয়, লৌকিক উপায়েই রাম ও অন্যান্য পুত্রদের জন্ম হয়েছিল। মুনিবর বাল্মীকি রামের জন্মতিথিও বলে দিয়েছেন–
“ততো যজ্ঞে সমাপ্তে তু ঋতুনাং ষট্ সমতায়ুঃ।
ততশ্চ দ্বাদশে মাসে চৈত্রে নাবমিকে তিথৌ৷৷
নক্ষত্রেদিতিদৈবততা স্বোচ্চসংস্থে্যু পঞ্চসু।
গ্রহেষু কর্কটে লগ্নে বাকপবিন্দুনা সহ৷৷”
এবং “পুষ্যে জাতন্তু ভরতো মীনলগ্নে প্রসন্নধীঃ।
সার্পে জাতৌ তু সৌমিস্ত্রী কুলীরে অ্যুদিতে রবো৷”
অসংখ্য বিয়ে করলেও, ৩৫০ টি স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও একটি স্ত্রীকেও তিনি সন্তান উপহার দিতে সক্ষম হননি। বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত তাঁর কোনো পুত্রসন্তান হয়নি।
তবে রাম ও ভ্রাতৃসকল ঋষ্যশৃঙ্গের ক্ষেত্রজ সন্তান একথা আমি মানছি না। দশরথ বৃদ্ধ বয়সেই পুত্র-সন্তান লাভ করেন এবং বৃদ্ধ বয়সেও সন্তানের পিতা হওয়া সম্ভব। এমন উদাহরণ ঝুড়ি ঝুড়ি আছে। দশরথ বৃদ্ধ হলেও তাঁর স্ত্রীরা বৃদ্ধা ছিলেন না। তাঁরা বয়সে দশরথের চেয়ে অনেক নবীন ছিলেন। অতএব রানিদের সন্তানধারণে কোনো অসুবিধা নেই। রানিরা সন্তানের মা হলেন, তবে তা স্বামীর দ্বারা নয়, অন্য পুরুষ দ্বারা। কৌশল্যার জ্যেষ্ঠ সন্তান শান্তা রোমপাদ মুনির দ্বারা। শান্তার স্বামী রোমপাদের ছেলে ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি। রোমপাদের স্ত্রী বর্ষিণী হলেন কৌশল্যার বোন। রোমপাদের দ্বারা ক্ষেত্রজ সন্তান শান্তাকে লাভ করেন কৌশল্যা। সেই হিসাবে ঋষ্যশৃঙ্গ যেমন রোমপাদের নিজের ঔরসজাত সন্তান, অপরদিকে শান্তা ক্ষেত্রজ হলেও নিজের ঔরসজাত সন্তান।
রাজা দশরথের এই স্ত্রীরা সকলেই ক্ষত্রিয় ছিলেন, তা কিন্তু নয়। ছিলেন প্রচুর বৈশ্যা ও শূদ্রা স্ত্রীও। প্রধানা মহিষী কৌশল্যাকে অশ্বমেধের ফিরে আসা ঘোড়ার সঙ্গে রাত কাটাতে হয়েছিল, তেমনি যজ্ঞের পুরোহিতরা দশরথের অন্যান্য সকল (ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্রা) রানিদেরও ঘোড়ার সঙ্গে রাত কাটানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তবে জাতপাতের মূল্যায়নে এইসব স্ত্রীদের ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ও ছিল, তাতেই বোঝা যেত কোন্ রানি ক্ষত্রিয়া কোন্ রানি শূদ্রা। যেমন ক্ষত্রিয়া রানিদেরকে বলা হত মহিষী’, বৈশ্যা রানিদের বলা হত ‘বাবা’ এবং শূদ্রা রানিদের বলা হত ‘পরিবৃত্তি’। দশরথের যে বৈশ্যা-শূদ্রা স্ত্রী ছিল সে কথা বাল্মীকি তাঁর রামায়ণে অকপটে উল্লেখ করলেও কৃত্তিবাস, তুলসীদাস, কম্ব, রঙ্গনাথনের মতো স্বনামধন্য কবিরা ভুলেও উল্লেখ করেননি। কারণ ইতিমধ্যে সমাজে ব্রাহ্মণ্যবাদ জাঁকিয়ে বসেছিল। সমাজের ঘৃণার জিনিস ক্ষত্রিয়রাজার স্ত্রী শূদ্র হলে তো সত্যনাশ হয়ে যাবে যে!
যাই হোক, রামের বনবাসে বিদায় দেওয়ার সময় রাজা দশরথ সুমন্ত্রকে তাঁর সমগ্র স্ত্রীদের ডেকে আনতে বললেন এবং তিনি জানান সমগ্র স্ত্রীপরিবৃত হয়ে রামকে দর্শন করতে চান–“দারৈঃ পরিবৃতঃ সর্বৈঃ দ্রষ্টুমিচ্ছামি রাঘবম”। রাম বনে যাওয়ার সময় কৌশল্যা সহ আরও ৩৫০ মাতাকে প্রণাম করেছিলেন। দশরথের কিন্তু রামের বনবাসের ব্যাপারে একদম রাজি ছিলেন না। “বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা’ বলে কৈকেয়ীর প্রতি দশরথের যারপরনাই দুর্বলতা ছিল। কৈকেয়ী সরাসরি বর চেয়ে বসলে দশরথও সরাসরি ‘না’ বলতে পারেননি। এই দুর্বলতার কথা কৈকেয়ী যে জানতেন না, তা কিন্তু নয়। এমন প্রাণঘাতী বর চেয়ে বসলে যে বৃদ্ধ স্বামী মর্মাহত হবেন, সেকথা কৈকেয়ী জানতেন। সেই কারণেই কৈকেয়ী বরদুটো চাইতে গিয়ে দোনোমনো করছিলেন। কিন্তু মন্থরার জব্বর ব্রেনওয়াশে শেষপর্যন্ত বরদুটি চাইলেন কৈকেয়ী। দশরথের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। দশরথ বললেন–
“বালিশো বত কামাত্মা রাজা দশরথো ভৃশ৷
স্ত্রীকৃতে যঃ প্রিয়ং পুত্রং বনং প্রস্থাপয়িষ্যতি।”
কামুক রাজা, স্ত্রীর কথায় ছেলেকে বনে পাঠাল? রাস্তাঘাটের লোকেরা পর্যন্ত যার সম্বন্ধে বলেছে ‘কামাত্মা’, ‘কামবেগবশানুগ’। লক্ষ্মণ যেমন পিতাকে ‘কামুক’ বলে তিরস্কার করেছিলেন, রামও অনুরূপ ভাষায় তিরস্কার করেছিলেন। দশরথ নিজেও বেশ স্পষ্ট করেই জানতেন যে তিনি কামুক। লোকে যে বলে লোকে যে বলবে সে বিষয়ে দশরথ বিলক্ষণ অবগত। কৈকেয়ী-কামুকত্বেই দশরথ শেষ হয়েছে। রামের বনবাসও সেই কামুকতারই ফল। কামজৰ্জর রাজা তথা পিতা কৈকেয়ীর বিরুদ্ধে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে পারেননি। তবে প্রিয়পুত্র রামের জন্য দশরথ গর্জে উঠেননি, তা নয়–
“ন নাম তে কেন মুখাৎ পতত্যধো বিশীমানা দশনা সহস্রধাঃ।”
এইখানেই শেষ হয় না ক্রোধ, দশরথ বলেন–
“মা স্বাক্ষীঃ পাপনিশ্চয়ে…ন হি ত্বাং দ্রষ্টুমিচ্ছামি ন ভার্যা ন চ বান্ধবী…সকামা ভব কৈকেয়ী বিধবা রাজ্যমাবস।”
এটা রাজার মনের কথা, কঠিন বাস্তব। কৈকেয়ীর প্রেমে রাজা এতটাই ডগমগ ছিলেন যে, কৌশল্যা-সুমিত্রাদের এক্কেবারেই পাত্তা দিতেন না। কিন্তু অবস্থাকালে দশরথ স্বমূর্তি ধারণ করলেও কেকেয়ীর কাছে হারই মানতে হয় শেষপর্যন্ত।
কৈকেয়ীকে সবসময় তুষ্ট করে চলতেন স্বামী দশরথ। স্বামী দশরথ সেই কারণেই বড়ো রানি কৌশল্যাকে চরম অবহেলা করতেন, সেকথা কৌশল্যার আত্মকথনেই জানা যায়–
“ত্বয়ি সন্নিহিতে প্যেমহমাসং নিরাকৃতা। কিং পুনঃ প্রোষিতে তাত ধ্রুব মরণমেব মো… অত্যন্তং নিগৃহীতাস্মি ভর্তুর্নিত্যমসম্মতা… পরিবারেণ কৈকেয়্যাঃসমা বাপ্যথবাবরা.. তদক্ষয়ং মহ দুঃখং নোৎসহে সহিতুং চিরম্। বিপ্রকারং সপত্নীনামেবং জীর্ণাপি রাঘব”
অর্থাৎ “বাবা, তুই কাছে কাছে থাকতেই তোর বাবা আমার এই দশা করলেন, সেখানে তুই বনে গেলে আমার কপালে মরণ লেখা আছে।… তুই জানিসনে, বাবা, আমি সহ্য করেছি, কত অত্যাচার মাথা পেতে নিয়েছি, আসলে তোর বাবা আমায় দেখতেই পারে না।… এই যে ছোটোবৌ কৈকেয়ী, তার দাসীর চেয়েও অধম করে আমাকে রেখেছে।… এখন বুড়ি হয়ে গেছি, এই বয়সে আর সতীনের মুখ-ঝামটা সহ্য করতে পারব না, আমাকে তুই সঙ্গে নিয়ে চল বাবা।”
দশরথ জানতেন তাঁর প্রতিজ্ঞার কথা রামকে জানালে রাম বিনা কৈফিয়তে তা মেনে নেবেন, সে তাঁর বাধ্য সন্তান। রামের এই আত্মত্যাগ দশরথ সহ্য করতে পারবেন না, সেই কারণে দশরথও নিজের মুখে রামকে সেকথা বলতে পারেননি–সেকথা বলেছেন স্বয়ং কৈকেয়ী। রামও বিনা বাক্যব্যয়ে বনের পথে বাড়ালেন। এ কেমন পিতৃসত্য পালন! যেকথা ভেবে পিতা দশরথ বলতে পারলেন না, সেকথা পালন করার আগে একবারও পিতার কথা ভাবলেন না রাম! কার কথা রাখলেন রাম–পিতা দশরথের কথা, না বিমাতা কৈকেয়ীর? রামের (লক্ষ্মণ ও সীতা সহ) বনবাস যে পিতা হজম করতে পারবেন না, সেকথা কী একবারও রামচন্দ্রের মনে হয়নি? পিতৃসত্য পালন করতে গিয়ে তিনিই পিতার মৃত্যুর কারণ হলেন? নিজের মায়ের দুরবস্থার কী একবারও কানে ঢোকেনি রামচন্দ্রের? কেমন পুত্র তিনি? সেদিক থেকে লক্ষ্মণকে অবশ্যই ‘হ্যাটস অফ” জানাতে হয়। স্পষ্টবাদী লক্ষ্মণ সোজাসাপটা কথা বলেন। বাবা বলে দশরথকেও রেয়াত দেননি পুত্র লক্ষ্মণ। বলেছেন–
“এই নাকি আমার বাবা, বুড়ো বয়সে খোকা সেজেছেন।… ওঁর ভীমরতি ধরেছে।… মেনিমুখো পুরুষ, যিনি মেয়েছেলের কথায় ছেলেকে বনে পাঠান। এই বয়েসে এত কামুক হলে তিনি কিই-না বলতে পারেনা.. কৈকেয়ীর ওপরে গদগদ হয়ে তিনি যদি আমাদের সঙ্গেও শত্রুতা করেন, তবে মেরে ফেলাই উচিত।”
কী পাঠকবন্ধু আহত হলেন? পড়ন, মহাকবি বাল্মীকির ভাষায়–
“পুনর্বাল্যমুপেয়ুষঃ… বিপরীতশ্চ বৃদ্ধশ্চ স্ক্রিয়ো বাক্যবশং গতঃ .. নৃপঃ কিমিব ন ক্ৰয়াচ্চোদ্যমানঃ সমন্মথঃ।… বধ্যতাং বধ্যতামপি।”
লক্ষ্মণ এখানেই থেমে থাকেননি। ক্রোধ আরও ঊর্ধ্বগামী হয় তাঁর–
“হনিষ্যে পিতরং বৃদ্ধং কৈকয্যাসক্তমানসম্। কৃপণঞ্চ স্থিতং বাল্যে বৃদ্ধভাবেন গর্হিতম”।
অর্থাৎ “আমি মেরেই ফেলব; আমাদের উপর যার একটুও মায়া নেই আর কৈকেয়ীর উপর যাঁর এত মোহ, সেই কুচুটে কুৎসিত বুড়ো বয়সের রামখোকাটিকে আমি মেরেই ফেলব।”
লক্ষ্মণের এই প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক, কিন্তু রাম কীভাবে সব মুখ বুজে বেমালুম হজম করে গেলেন সেটা বোধের বাইরে। তা সত্ত্বেও লক্ষ্মণকে কোনোরূপ শাস্তি দেননি দশরথ। শাস্তি দিয়েছেন ভরতকে, ত্যাজ্যপুত্র করে বসলেন ভরতকে–
“সন্ত্যজামি স্বজঞ্চৈব তব পুত্ৰং ত্বয়া সহ।”
অযোধ্যায় বসে রামচন্দ্র তাঁর পিতা দশরথকে কটু কথা না-বললেও, চিত্রকুটে অবস্থানকালে গায়ের ঝাল মিটিয়ে লক্ষ্মণকে বলেছেন–
“কিং করিষ্যতি কামাত্মা কৈকেয্যা বশমাগতঃ”।
অর্থাৎ পিতাকে রামও ‘কামুক’ বললেন। কেবল পিতাই নয়, বিমাতা কৈকেয়ী উদ্দেশেও বললেন–
“অপি ন চ্যায়েৎ প্রাণান্ দৃষ্ট, ভরতমাগতম্”। এখানে বিমাতাকেও ‘খুনি’ বললেন রাম।
দশরথ পক্ষপাতদোষে দুষ্ট ছিলেন। পিতা হিসাবে রামের প্রতিই তাঁর একমাত্র দুর্বলতা। রামের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত স্নেহশীলতাই অন্যান্য পুত্রদের প্রতি উদাসীনতা দেখিয়েছেন চরমভাবে। শর্তানুযায়ী রাজ্যের অধিকার ভরতকে ছেড়ে দিতে হবে জেনেও তিনি অত্যন্ত গোপনে রাজ্যাভিষেকের জন্য রামকে প্রস্তুত করেছেন। এই প্রস্তুতি নিচ্ছিদ্র করার জন্য ভরতকে বছরের পর বছর মাতুলালয়ে ফেলে রেখেছিলেন। রামের বনবাসের আগে শেষ বারো বছর তো ভরতকে অযোধ্যা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলেন। ভরতের সঙ্গে সামান্য যোগাযোগ পর্যন্ত করেননি তিনি। রামকে বনবাসে পাঠিয়ে দশরথ যতটা ব্যথিত হয়েছিলেন, ভরতকে বনবাসে পাঠালে বিন্দুমাত্র ব্যথিত হতেন না, এ সিদ্ধান্তে আসাই যায়। লক্ষ্মণ, শত্রুঘ্ন তো অনেক দূরের কথা। রাম দশরথের কাছে এত প্রিয় ছিলেন যে, রামের অভিষেকের কথা পরম প্রিয়তমা কৈকেয়ীর কাছেও গোপন রেখেছিলেন। কৈকেয়ী, রাজ্যপাট ছেড়ে তিনি যাঁর ঘরেই সারাক্ষণ পড়ে থাকতেন। এর পরেই শেষরক্ষা করতে পারেননি দশরথ। “এই ক্রোধাগারে হয় প্রাণত্যাগ করিব, না-হয় ভরতকে রাজ্য দিব।”–প্রিয়তমা কৈকেয়ীর এমন কঠিন কথায় দশরথ টু ফাঁ পর্যন্ত করতে পারলেন না। কৈকেয়ী রণমূর্তি ধারণ করলেন, বললেন–
“তুমি এখন রামকে এই স্থানে আনাও এবং তাহাকে বনবাস দিয়া ভরতকে রাজা করো। তুমি আমার শত্রু দূর না-করিরা এ-স্থান হইতে এক পদও যাইতে পারিবে না।”
দশরথ বন্দি হলেন কৈকেয়ীর ক্রোধাগারে, অন্তরীণ হলেন। নিঃস্ব, অসহায় রাজা। যদিও একবার শেষবারের মতো গর্জে উঠে কৈকেয়ীকে ইতরভাষায় বলেছিলেন–
“এক্ষণে তোকে ও আমার ঔরসজাত পুত্র তোর ভরতকে পরিত্যাগ করিলাম। … আমি কিছুতেই তোর কথা শুনিব না৷ তোকে অবমাননা করিব এবং রামকে রাজ্য দিব।”
ওই পর্যন্তই। তারপর বুঝলেন রাজঅন্তঃপুর তাঁর জন্য প্রতিকূল। শেষপর্যন্ত একেবারে চুপসে গেলেন। গলার স্বর মিইয়ে গেল। শুধু পুত্রদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব ছিল না, পক্ষপাতিত্ব ছিল কমবয়সি স্ত্রী কৈকেয়ীর প্রতিও। কৈকেয়ীর প্রতি বেশি প্রেমপিরিতির কারণে কৌশল্যাকে তো অবজ্ঞা করেছেই, সুমিত্রার কোনো খোঁজখবর নিতেন বলে তো শুনিনি। কৈকেয়ীর সঙ্গে দশরথের বেশি ‘ঢলাঢলি’ তাঁর পুত্রদেরও চোখও এড়ায়নি।
রাম চোদ্দো বছরের বনবাসে গেলে দশরথ চরম আহত হন। সারথি সুমন্ত্র কৈকেয়ীর কাছ থেকে দশরথকে মুক্ত করে আনতে সমর্থ হন। রামের বনবাসের ষষ্ঠ দিন তাঁর মৃত্যু হয়। প্রাদেশিক রামায়ণে বলা হয়েছে পুত্রশোকেই নাকি পিতা দশরথের মৃত্যু হয়েছে। শোক কীসের? রাম তো মারা যাননি! তবে শ্বাপদশঙ্কুল দণ্ডকারণ্যে রামের নিশ্চিত মৃত্যু হবে, সেই আশঙ্কাতেইও শোক হতে পারে। শোক নয়, বলা যেতে পারে বিরহ। দশরথের অতি প্রিয় পুত্র ছিলেন রাম। রামকে যতটা স্নেহ করতেন দশরথ, তার ছিটেফোঁটা স্নেহও করতেন না অন্য পুত্রদের ক্ষেত্রে। বিরহ তো ছিলই, কিন্তু বিরহে মৃত্যু! বাল্মীকির রামায়ণে ঘটনার পারিপার্শ্বিক বিচার বলছে কিন্তু দশরথের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। চলে যাই বাল্মীকির রামায়ণে অযোধ্যা কাণ্ডে–
কৈকেয়ীর কবল থেকে মুক্ত দশরথ কৌশল্যার ভবনে অবস্থান করছেন। ভরতকে তিনি যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করতে একবিন্দুও রাজি নন। রাম বনবাসে চলে গেছেন। কিন্তু রামকে ফিরিয়ে আনা যায়, ফিরিয়ে এনে তাঁকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করবেন বলে দশরথ সিদ্ধান্তও নিলেন। অন্যদিকে কৈকেয়ীর অনুগামীরা রাজাদেশ ব্যতীত ভরতকে মাতুলালয় থেকে অযোধ্যায় ফিরিয়ে আনাও সম্ভব নয়৷ রাম ইতোমধ্যে বনবাসে চলে গেলেও দশরথ কিন্তু এখনও ভরতকে রাজ্যানুশাসনের দায়িত্ব সঁপে দেননি। কৈকেয়ীর অনুগামীদের এটাও বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, দশরথ যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন পর্যন্ত ভরতের পক্ষে অযোধ্যার রাজা হওয়া সম্ভব নয়। অতএব ভরতকে অযোধ্যার রাজা হতে হলে দশরথে মৃত্যু অনিবার্যই। রামের সন্দেহ অমূলক নয়। বনবাসের পথে রাম লক্ষ্মণকে সেই আশঙ্কাও প্রকাশ করে ফেললেন–
“কৈকেয়ীর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইয়াছে। ভরত উপস্থিত হইলে তিনি তাহাকে রাজ্যে অভিষেক করিবার নিমিত্ত রাজাকে আর প্রাণে বাঁচিতে দিবেন না।…ভরতকে রাজ্যে নিয়োজিত, আমাকে নির্বাসিত ও পিতার প্রাণান্ত করিবার নিমিত্তই কৈকেয়ী আসিয়াছেন।”
ষড়যন্ত্রের আঁধারে রাজান্তঃপুর থমথমে। দশরথ কৈকেয়ীর ঘরে ঢুকতে সাহস পাচ্ছেন না। কৌশল্যার ভবনে অবস্থান করেই তিনি রাজ্য চালাচ্ছেন। কেন? মৃত্যুভয়ে? বনবাসে এই মুহূর্তে রামের অবস্থান দশরথ উদগ্রীব হয়ে আছেন। সারথি সুমন্ত্র ফিরে এলেই জানবেন সব সংবাদ। বনবাসের ষষ্ঠদিনে সুমন্ত্র ফিরে এলেন অযোধ্যায়, দশরথের কক্ষে। সুমন্ত্রকে দশরথ বললেন–
“এক্ষণে তুমি আমাকে শীঘ্র রামের নিকট লইয়া চলো, তাহাকে না-দেখিয়া আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত হইয়াছে। আমি আজ্ঞা দান করিতেছি, তুমি রামকে প্রত্যায়ন করো।”
যে সাহস কৈকেয়ীর গৃহবন্দি থাকাকালীন অর্জন করতে পারেননি, সেই সাহস কৌশল্যার ঘরে বসে দেখিয়ে দিলেন দশরথ।
রাজাজ্ঞা মোতাবেক সুমন্ত্র রামকে অযোধ্যায় প্রত্যানয়ন করবেন এমনই কথা হয়ে রইল। রাত্রি নেমে আসায় তক্ষুনি যাওয়া সম্ভব হল না। অতএব পরদিন সকালে যাত্রা শুরু হবে। অতএব বিরহক্লান্ত দশরথ ঘুমিয়ে পড়লেন। সেই রাতেই দশরথের মৃত্যু হল, ষষ্ঠ রজনীর অধ্যামে। রামকে ফিরিয়ে আনা হবে এই আশ্বাসে যখন দশরথ ঘুমোতে গেলেন, তখন পুত্রশোকে কেন মরতে যাবেন! পুত্রশোকে মৃত্যু হয়েছে এমন পিতা এ পৃথিবীতে খুবই বিরল। এ মৃত্যু স্বাভাবিক হতে পারে না। ভরতের যে রাজা হওয়ার সম্ভাবনা নেই একথা কৈকেয়ী এবং কৈকেয়ীর অনুগামীরা নিশ্চয়ই ওয়াকিবহাল। কিন্তু দশরথ যে রামকে ফিরিয়ে এনে অযোধ্যার যৌবরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করার সংকল্প করেছেন সেকথা জানবে কী করে! এ সংকল্প তো কৈকেয়ীর ঘরে বসে হয়নি, এ ব্লুপ্রিন্ট তৈরি হয়েছে কৌশল্যার ঘরে বসেই–যেখানে সুমিত্রা, কৌশল্যা আর সুমন্ত্র ছাড়া কেউই। ছিলেন না। কেউ ছিলেন না মানে যে কেউ বুঝবেন না তা তো হয় না। সারা রাজবাড়ি যেখানে দশরথের প্রতিকূল, যেখানে ষড়যন্ত্র ছড়িয়ে আছে ইটপাথরের কোনায় কোনায়–তখন এ খবর চাপা থাকে কীভাবে! দশরথ যে শেষপর্যন্ত ভরত নয় রামকেই পছন্দ করেন, সেকথা কৈকেয়ীরা বিলক্ষণ জেনে গেছেন।
রাত্রি গভীর হয়েছে। দশরথ রানিদের অন্ধমুনির কাহিনি শুনিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। ঘুমিয়ে পড়েছেন কৌশল্যা, সুমিত্রাও। এত ঘুম! ঘুম এত গম্ভীর হল কেন যে, পরদিন ভোরের পরেও ঘুম ভাঙল না! বাল্মীকি বলছেন–“প্রাতঃকালে সুশিক্ষিত সুত, কুলপরিচয় দক্ষ মাগধ, তন্ত্ৰীনাদ নির্ণায়ক গায়ক ও স্মৃতিপাঠকগণ রাজভবনে আগমন করিল এবং স্ব স্ব প্রণালী অনুসারে উচ্চৈঃস্বরে রাজা দশরথকে আশীর্বাদ ও স্তুতিবাদ করিয়া প্রাসাদ প্রতিধ্বনিত করিতে লাগিল।” রাজার না-হয় মৃত্যু হয়েছে, তিনি আর উঠবেন না। কিন্তু এত কোলাহল আর হৈ হুল্লোড়ে কৌশল্যা, সুমিত্রার ঘুম ভাঙবে না! তাহলে কি গভীর রাতে কেউ এ ঘরে ঢুকে ঘুমের কিছু প্রয়োগ করে দিয়েছিলেন? দশরথের মৃত্যু কি তবে ঘুমের মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ প্রয়োগে মৃত্যু হয়েছে? রাম তো এরকমই সন্দেহ করেছিলেন–“অপি ন চ্যায়েৎ প্রাণান্ দৃষ্টা ভরতমাগতম্”–“ভরত অযোধ্যায় এসে গেছে। তাকে দেখে জোর পেয়ে কৈকেয়ী আবার দশরথকে প্রাণে মেরে না-ফেলেন।” না, ভরতের অযোধ্যায় ফিরে আসা পর্যন্ত কৈকেয়ী অপেক্ষা করেননি। তার আগেই অযোধ্যাকে কাঁটামুক্ত করে রেখেছেন ভরতমাতা। রাজবাড়ির সেই অস্বাভাবিক ঘটনার পোস্টমর্টেম হয়নি, ফরেনসিক রিপোর্ট নেই, সিবিআই তদন্ত হয়নি। উত্তর খোঁজাও আজ তাই বৃথা। যাই-ই হোক, দশরথের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই প্রাসাদ-বিপ্লবের পরিসমাপ্তি ঘটে। মনে হতে প্রাসাদ-বিপ্লবের শেষ হয়ে গেছে। প্রাসাদ-বিপ্লব এত সহজেই শেষ হয়ে যায় না। বনবাস উতরে রাবণের সঙ্গে যুদ্ধশেষে অযোধ্যায় ফিরে এসে পুনরায় প্রাসাদ-বিপ্লব হয়ে গেল। সে কথা অন্য অধ্যায়ে আলোচনা করা যাবে।