০৪. তরু আজ আবার উপন্যাস নিয়ে বসেছে

তরু আজ আবার উপন্যাস নিয়ে বসেছে। তবে আজকের ম্রায়োজন অন্য রকম। মোমবাতি অফ, টেবিল ল্যাম্প জ্বালানো হয়েছে। ফাউন্টেন পেনের বদলে আজ বলপয়েন্ট। একটি লাল কালির বল পয়েন্ট অন্যটি নীল কালির। লাল কালিতে লেখা অংশ মূল উপন্যাসে থাকবে না। নীল কালিরটা থাকবে। লাল কালির লেখা উপন্যাসের ব্যাখ্যামূলক। বাড়তি আয়োজনের মধ্যে আছে বাটি ভর্তি পানি। সেখানে শুকনো বকুল ফুল ছাড়া হয়েছে। ফুলগুলি পানিতে ড়ুবছে না ভেসে আছে। হালকা গন্ধ ছড়াচ্ছে।

লেখালেখির জন্যে রাতটা ভাল। বৃষ্টি হচ্ছে। তরুদের গ্যারাজের ছাদ টিনের বলে বৃষ্টির শব্দ কানে আসছে। তার বাবা বাসায় নেই। মুনসিগঞ্জে গিয়েছেন। তাদের একটা ট্রাক রিকশার খাদে একসিডেন্ট করেছে। রিকশা যাত্রী মারা গেছে। থানাওয়ালারা ট্রাক আটক করেছে। তরুর বাবা ঝামেলা মিটাতে গিয়েছেন। তাঁর ফিরতে দেরি হবে। তিনি টেলিফোনে তরুকে রাতের খাবার খেয়ে নিতে বলেছেন। তরু ঠিক করেছে যত রাতই হোক বাবা বাড়ি ফিরলে খাবে। বৃষ্টিবাদলার রাত বলেই খাবারের বিশেষ আয়োজন করা হয়েছে। খিচুড়ি এবং ভুনা গরুর মাংস।

তরু বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে লিখছে।

লাল কালির লেখা
(মূল উপন্যাসে যাবে না)

সব উপন্যাসে একটা মূল প্লট থাকে। মূল প্লটকে ঘিরে ছোটখাটো নানান সব প্লট। আমি কোনো মূল প্লট খুঁজে পাচ্ছি না। যেহেতু উত্তম পুরুষে লিখছি—নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া অংশ নিয়ে লিখছি সে কারণেই গল্প খুঁজে পাচ্ছি না। বেশিরভাগ মেয়ের মতো আমার জীবনে তেমন কোনো গল্প নেই। খুবই সাধারণ অবস্থা। আমি বিশাল বড়লোকের মেয়ে হলে আমার জীবনে অনেক গল্প থাকত। বড়লোকের মেয়েদের অনেক গল্প থাকে। আজেবাজে ধরনের গল্প। পাঠকদের তেমন কোনো গল্প দিতে পারলে তারা মজা পেত।

আমার পরামর্শদাতা লেখক বলেছেন সব শিল্প মাধ্যমে বিনোদন একটি প্রধান অংশ। পিকাসো যে ছবি আঁকেন সেখানেও বিনোদন থাকতে হবে। এই লেখকের সঙ্গে আমি কথা বলি মোবাইল টেলিফোনে। মোবাইল টেলিফোনের নাম্বার তিনি আমাকে দিয়েছেন। এবং বলেছেন সকাল সাতটা থেকে এগারোটার মধ্যে কথা বলতে। আমি চিন্তা করে বের করেছি এই সময় লেখক-পত্নী তার মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যান। লেখক সাহেবের ভাবভঙ্গি আমার মোটেই সুবিধার মনে হচ্ছে না। সেদিন আমাকে বললেন—তরু সাহিত্যের প্রতি তোমার আগ্রহ আমাকে মুগ্ধ করছে। আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই। সাহিত্যের অনেক খুঁটিনাটি বিষয় আছে যা টেলিফোনে ব্যাখ্যা করা যাবে না।

আমি বললাম, স্যার বাসায় আসি?

না বাসায় না। অন্য কোথাও নিরিবিলিতে বসতে হবে। লেখালেখির চাপ যখন খুব বাড়ে তখন আমি একটা হোটেলের রুম ভাড়া করি। সেখানে আসতে পারো।

স্যার আপনার তো ডিসটার্ব হবে। অপিনি লেখালেখির জন্যে রুম ভাড়া করছেন সেখানে আমার সঙ্গে বকরবকর করা কি ঠিক হবে!

সমস্যা নেই। একনাগাড়ে লিখতেও তো ভালো লাগে না। সামনের মাসে পনেরো তারিখ থেকে রুম ভাড়া করব। তুমি টেলিফোন করে চলে এসো।

ম্যাডাম রাগ করবেন না তো।

রাগ করবে কেন? তুমি তো কাজে আসছ। অকাজে তো আসছ না।

তাও ঠিক।

টেলিফোনের কথাবার্তার এই পর্যায়ে আমি লেখক স্যারকে পুরোপুরি হকচকিয়ে দেবার জন্যে বললাম, স্যার আলাপ-আলোচনায় রাত যদি বেশি হয়ে যায় তাহলে কি রাতে হোটেলে থেকে যেতে পারি?

লেখক স্যার কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, এই বিষয়ে পরে তোমার সঙ্গে কথা হবে। বলেই টেলিফোন রেখে দিলেন। তারপর থেকে কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে লেখক সাহেবের টেলিফোন আসতে লাগল। আমি টেলিফোন ধরি না। বুঝতে পারছি ভদ্রলোক আমাকে কিছু বলতে চাচ্ছেন। জরুরি কিছু। আমাকে না পেয়ে অস্থির বোধ করছেন।

অস্থিরতা তৈরি করাও একজন লেখকের কাজ। লেখক পাঠকের ভেতর অস্থিরতা তৈরি করবেন। আমি একজন লেখকের ভেতর অস্থিরতা তৈরি করছি এটাই কম কি?

লেখক সাহেব একদিন আমাকে বললেন, মেয়েদের মধ্যে বড় লেখক কেন হয় না জানে?

আমি বললাম, জানি না।

লেখক সাহেব বললেন, তাদের মধ্যে inbuilt কিছু সুচিন্তা কাজ করে। দৈহিক সম্পর্কের মতো অতি পবিত্র একটি বিষয় তারা এড়িয়ে যেতে চায়।

আমি বললাম, স্যার দৈহিক সম্পর্ক কি পবিত্রঃ।

তিনি বললেন, অবশ্যই। এই সম্পর্কের কারণে নতুন একটি প্রাণ সৃষ্টি হয়। যে কারণে একটি প্রাণের সৃষ্টি সেই কারণ অপবিত্র হবে কেন?

আমি বললাম, স্যার সবধরনের দৈহিক সম্পর্কই কি পবিত্র?

তিনি বললেন, আমি সে রকমই মনে করি।

এই কথাটা বলেই লেখক সাহেব কিন্তু ফেঁসে গেলেন। কিংবা বলা যায় তিনি আমার পাতা ফাঁদে পা দিলেন। কারণ আমি অত্যন্ত বিনীত গলায় বললাম, আচ্ছা স্যার মনে করুন আপনার স্ত্রী অন্য কারো সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করে গর্ভবতী হয়ে গেলেন। নতুন একটি প্রাণ সৃষ্টি করলেন। এটা কি পবিত্র?

লেখক স্যার কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, তোমার মাথায় কিছু চিন্তাভাবনায় গিট্টু লেগে গেছে। গিট্টু ছুটাতে হবে।

গিট্টু কে ছুটাবে?

আপনি? চেষ্টা করে দেখব।

লেখক স্যার আমার গিট্টু ছুটানোর অপেক্ষায় আছেন। তিনি এখনো জানেন না আমি কঠিন চিজ। আমি তাঁর মাথায় এমন পিটু লাগিয়ে দেব যা তিনি কোনোদিন ছুটাতে পারবেন না। আমি তার প্রেমে পড়েছি এ রকম একটা লেখা খেলব। সুন্দর সুন্দর চিঠি লিখব। গিফট কিনে পাঠাব। তারপর? তারপরেরটা তারপর।

হয়তো আমাকে খুব খারাপ মেয়ে মনে হচ্ছে। হ্যাঁ আমি সামান্য খারাপ। প্রতিহিংসার ব্যাপারটা আমার মধ্যে আছে। লেখক সাহেব আমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে হোটেলে নিতে যাচ্ছেন—এই ব্যাপারটা আমি নিতেই পারছি না। লেখকরা হবেন অনেক উপরের মানুষ। তাঁরা জাতির আত্মা। তারা কেন এমন হবেন?

আমার বাবা সাধারণ মানুষ। ব্যবসাপাতি নিয়ে থাকেন। একজন বিপত্মীক। তার মধ্যে তো এ রকম ছেকছুকানি নেই। একজন রূপবতী তরুণী কাজের মেয়ে কিছুদিন আমাদের বাসায় ছিল। প্রথম দিনেই বাবা তাকে বললেন, মাগো! আমাকে এক কাপ চা বানিয়ে দাও। কাজের মেয়েটা ধাক্কার মতো খেয়ে অনেকক্ষণ বাবার দিকে তাকিয়ে ছিল। তার দৃষ্টি দেখেই বুঝেছি কোনো গৃহকর্তা এর আগে তাকে মা ডাকেনি। বরং আড়ালেআবডালে অন্য ইঙ্গিত করেছে।

এখন মূল উপন্যাস শুরু করছি।

নীল কালি লেখা

সুতা কৃমি আমার প্রেমে পড়েছে। কি ভাবে বুঝলাম? মেয়েদের তৃতীয় নয়ন থাকে। এই নয়নে সে প্রেমে পড়া বিষয়টা চট করে বুঝে ফেলে। পুরুষের খারাপ দৃষ্টিও বুঝে। মুরুব্বি কোনো মানুষ মা মা বলে পিঠে হাত বুলাচ্ছে সেই স্পর্শ থেকেও সে বুঝে ফেলে মা ডাকের অংশে ভেজাল কতটুকু আছে।

সুতা কৃমির প্রেমে পড়ার ব্যাপারটা তৃতীয় নয়নের সাহায্য ছাড়াই কি ভাবে বুঝলাম সেটা বলি। আমার মোবাইলে একটা SMS পেলাম। রোমান হরফে বাংলায় লেখা—

Apnake na Dekila amar
Boro Kosto hoi.

মোটামুটি বাংলা হবে, আপনাকে না দেখলে আমার বড় কষ্ট হয়।

সে যদি লেখত, তোমাকে না দেখলে আমার বড় কষ্ট হয় তাহলে কিছু রাখঢাক থাকত। আমার মনে হতো অন্য কেউ পাঠিয়েছে। সুতা কৃমি আমাকে আপনি করে বলে। SMS-এ সে এই কাজই করেছে।

আমি তাকে ডেকে পাঠালাম। সে আমার সামনে জড়সড় হয়ে দাঁড়াল। আমি বললাম, খবর কি?

সে বলল, ভালো।

আমি বললাম, তুমি কি আমার কাছে ফোনে এসএমএস পাঠিয়েছ?

সে বলল, না তো। আমার কোনো মোবাইল টেলিফোন নাই।

আমি বললাম, এসএমএস করার জন্যে মোবাইল ফোন থাকতে হয় না। কোনো মোবাইলের দোকানে পাঁচ টাকা দিলেই তারা এই কাজটা করতে দেয়।

সুতা কৃমি বিড়বিড় করে বলল; অল্লাহর কসম এই কাজটা আমি করি নাই।

আমি বললাম, মনে হচ্ছে আমার ভুল হয়েছে। তুমি যাও।

সে প্রায় ছুটে বের হয়ে গেল। যাবার সময় দরজায় বাড়ি খেয়ে মাথা ফুলিয়ে ফেলল। আমি ভালো মেয়ে হলে ব্যাপারটা এখানেই শেষ হয়ে যেত। যেহেতু আমি সামান্য খারাপ মেয়ে, আমি ব্যাপারটা এখানে শেষ হতে দিলাম না। পরদিন তাকে আবার ডেকে পাঠালাম। আমি বললাম, আমার ধারণা তুমি আমার প্রেমে হাবুড়ুবু খাচ্ছ। ধারণাটা কি ঠিক?

সে জবাব দিল না। ভীত চোখে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, প্রেম আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেটা যদি One sided হয় তাহলে তার গুরুত্ব আরো বেশি। তোমার গভীর প্রেমে সাড়া দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব না, তবে তুমি ইচ্ছা করলে একবার আমাকে চুমু খেতে পারো। চাও?

সুতা কৃমি ঘামতে শুরু করল। আমি বললাম, এক মিনিটের জন্যে আমি চোখ বন্ধ করছি। চুমু খেতে চাইলে চুমু খেয়ে বিদায় হও। আমি চোখ বন্ধ করার আগেই সে দৌড়ে পালিয়ে গেল। এবারো সিড়ি ঘরের দরজার সাথে ধাক্কা খেয়ে মাথা ফাটাল।

এই পর্যন্ত লিখে তরু হাই তুলল। আজকের মতো লেখা শেষ। আর লিখতে ইচ্ছা করছে না। লেখার শেষ অংশটা বানানো। সুতা কৃমিকে সে চুমু খেতে বলেনি। অসম্ভব একটা বিষয়। উপন্যাসকে ইন্টারেস্টিং করার জন্যে লেখা। যা করেছে তা হলো—সে বলেছে। তুমি এক মিনিটের জন্যে আমার হাত ধরতে পারো। বলেই সে তার হাত বাড়িয়েছে। হাত বাড়াতে দেখে সুতা কৃমি দৌড়ে পালিয়েছে। দরজায় বাড়ি খেয়ে মাথা ফাটিয়েছে।

আপু খানা খাবেন না?

কাজের মেয়ে সফুরা কখন এসে পেছনে দাঁড়িয়েছে সে জানে না। সফুরা নিঃশব্দে হাঁটে। তারপরেও একজন পেছনে দাঁড়াবে সে টের পাবে না তা হয় না। একজন লেখকের পর্যবেক্ষণ শক্তি যেমন বেশি থাকবে তেমনি অনুভব শক্তিও বেশি থাকতে হবে।

খান লাগাব আপু?

তরু বলল, খানার আবার লাগালাগি কি? সুন্দর করে বলবে টেবিলে খাবার দিব?

সফুরা বলল, টেবিলে খাবার দিব?

রান্না কি?

কই মাছ।

আরো গুছিয়ে বললাকৈ মাছ কিভাবে রান্না হয়েছে?

মটরশুঁটি দিয়ে।

আরো গুছিয়ে বলো। ঝোল ঝোল করে রান্না, না-কি পাতলা করে?

সফুরা হেসে ফেলল। তরু বলল, হাসছ কেন?

সফুরা বলল, আপনার কথাবার্তা শুনলে মাঝে মধ্যে হাসি আসে।

আমার কথাবার্তা শুনে কখনোই তো তোমাকে হাসতে দেখি না। আজ প্রথম দেখলাম। সামনে থেকে যাও, টেবিলে খাবার দাও।

টেলিফোন বাজছে। মোবাইল টেলিফোনের অনেক মজার মজার ব্যাপার আছে। রিং টোনে নিজের পছন্দের মিউজিক ছাড়াও কথাবার্তাও ঢুকানো যায়। তরুর মোবাইল যখন বাজে তখন তরুর গলা শোনা যায়। এই তরু এই। সে নিজেই নিজেকে ডাকে। এই রিং টোন সে শুধু তার বাবার জন্যে রেখেছে। অন্যদের জন্যে সাধারণ রিং টোন। তরু টেলিফোন ধরে বলল, বাবা! বাসায় আসবে না?

দেরি হবে। ঝামেলায় আছি। তুই খেয়ে নে। আমার জন্যে জেগে থাকিস না।

আচ্ছা।

বড় বড় কৈ মাছ এনেছিলাম। ঠিকমত বেঁধেছে কি-না কে জানে। যত্ন করে যে মাছই কিনি ওরা নষ্ট করে ফেলে। ওসমান সাহেবকে দুইটা মাছ পাঠিয়ে দিস।

আচ্ছা।

নিজে নিয়ে যাবি। কাজের মেয়েকে দিয়ে পাঠাৰি না। এটা অভদ্রতা।

সনজুকে দিয়ে পাঠিয়ে দেই?

ঠিক আছে। ভালো কথা মনে করেছিস সনজুকে একটা মাছ পাঠিয়ে দে। বাজার করার সময় সঙ্গে ছিল।

ওদের বাসায় মানুষ তিনজন, একটা মাছ পাঠাব কি ভাবে? ওকে বরং এখানে ডেকে খাইয়ে দেই।

বুদ্ধি খারাপ না। মা, টেলিফোন রাখি?

তরু বলল, বাবা শোনো, যত রাতই হোক আমি জেগে থাকব।

বললাম তো দরকার নাই।

তরু বলল, দরকার না থাকলেও জেগে থাকব।

বাবার সঙ্গে কথা শেষ করে সে সনজুকে খবর পাঠাল। রাতে খেতে বলল। দুটা কৈ মাছ ওসমান সাহেবকে দেয়ার কথা। তার নিজের নিয়ে খওয়ার কথা। সে সফুরাকে পাঠাল। সঙ্গে ছোট্ট চিঠি–

দুটা কৈ মাছ পাঠালাম। এরা স্বামী-স্ত্রী। অর্থাৎ একটি
পুরুষ মাছ একটি মেয়ে মাছ। ইতি তরু।

সনজু খেতে বসেছে। তাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে। সে চোখ তুলে তাকাচ্ছেও না।

সনজু বলল, আমি কৈ মাছ খাই না।

তরু বলল, কেন খাও না?

কাটা বাছতে পারি না। এই জন্যে খাই না।

তরু বলল, আমি কাঁটা বেছে দেই?

সনজু ভীত গলায় বলল, না!

তরু বলল, তুমি বাচ্চা ছেলে না। আমার সামনে কাটা বাছবে এবং খাবে। গলায় কাঁটা লাগলে লাগবে।

আচ্ছা।

সনজু কৈ মাছের কাঁটা বাছছে, তরু তাকিয়ে আছে। তরু লক্ষ করল সনজুর হাত সামান্য কাঁপছে। তরু বলল, তুমি আমার বাবার কৈ মাছ খাওয়া দেখেছ?

না।

দেখার মতো দৃশ্য। বাবা পুরো মাছটা মুখের ভেতর ঢুকিয়ে মাথা ধরে টান দেন। পুরো কাঁটাটা চলে আসে। কাঁটাগুলি তিনি ফেলে দেন না। মাথাসুদ্ধ সব কাঁটা মুখে দিয়ে চিবাতে থাকেন। আমাদের বাসায় কোনো বিড়াল থাকলে এই দৃশ্য দেখে হার্টফেল করত।

সনজু বলল, কেন?

তরু বলল, বিড়ালদের হার্ট খুব দুর্বল থাকে। কাউকে কাঁটা খেতে দেখলে তারা হার্টফেল করে।

এটা জানতাম না। নতুন জিনিস জানলাম।

তরু বলল, বোকার অভিনয় আমার সামনে না করলে ভালো হয়। তুমি ঠিকই বুঝেছ আমি কেন বলেছি, বিড়াল হার্টফেল করত। বুঝনি?

বুঝেছি।

বোকা সাজলে কেন?

দুলাভাইয়ের সামনে সবসময় বোকা সেজে থাকতে থাকতে এ রকম হয়েছে।

বোকা সাজায় লাভ কিছু হচ্ছে?

হচ্ছে।

কি লাভ হচ্ছে?

এখন দুলাভাই আমাকে হিসাবে ধরেন না। আমার সামনেই গোপন টেলিফোনগুলি করেন। তিনি ধরেই নিয়েছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

গোপন টেলিফোন মানে কি?

একটা মেয়েকে তিনি প্রায়ই হোটেলে নিয়ে যান। মেয়েটার নাম নীলু।

তোমার আপা কিছু জানেন না?

না।

তুমি তোমার আপাকে কিছু জানাবে না?

না। আমিই ব্যবস্থা নিব।

কি ব্যবস্থা নিবে ঠিক করেছ?

হ্যাঁ।

আমাকে বলবে?

না।

যা করার একা একাই করবে?

একা করব না। আমার কিছু আজেবাজে বন্ধু-বান্ধব আছে। তারা সাহায্য করবে।

আজেবাজে মানে কি? কি ধরনের আজেবাজে?

খুবই খারাপ ধরনের। ভিডিওর দোকানে কাজ করে। ফেনসিডিল খায়।

তুমি ওদের সঙ্গে জুটলে কি ভাবে?

সনজু জবাব দিল না। সে একমনে খাচ্ছে। তরু বলল, কৈ মাছ খেতে কেমন লাগছে?

ভালো।

তোমাদের বাসায় আজ কি রান্না হয়েছে?

রান্না হয় নি।

কেন?

দুলাভাই আপাকে মারধোর করেছে। এইজন্যে রান্না হয় নি। আমি দুলাভাইয়ের জন্যে তেহেরি কিনে এনেছি। দুলাভাই তাই খেয়েছেন।

তোমার আপা কিছু খান নি?

ভাই খেয়হয় নি। আমি

না।

আপাকে ফেলে একা আরাম করে খাচ্ছ খারাপ লাগছে না?

না।

তোমার দুলাভাইকে শিক্ষা দেবার পরিকল্পনায় আমার সাহায্য লাগলে বলবে।

সাহায্য লাগবে না। খবিসটাকে আমি নেংটা করে রাস্তায় হাঁটাব।

এইটাই শাস্তি?

আরো আছে।

আর কি?

সেটা আপনাকে বলা যাবে না। যখন হবে তখন দেখবেন।

উনি যদি টের পান শাস্তি প্রক্রিয়ায় তুমি যুক্ত তাহলে কি হবে ভেবে দেখেছ?

দুলাভাই টের পাবে না। তার ধারণা আমি মহাগাধা।

তুমি মহাগাধা না?

এক সময় ছিলাম। এখন না।

ফেনসিডিল খেয়ে বুদ্ধি খুলেছে?

আমি ফেনসিডিল খাই আপনাকে কে বলল?

তোমার বন্ধুরা যখন খায় তখন তুমিও খাও।

মাঝে মধ্যে খাই।

আজ খেয়েছ?

হুঁ। সন্ধ্যাবেলা খেয়েছি।

কতটুকু খেয়েছ?

বেশি ছিল না। তিন বোতল চারজন ভাগ করে খেয়েছি।

আমার জন্যে এক বোতল নিয়ে এসো খেয়ে দেখব।

সনজু খাওয়া বন্ধ করে চোখ তুলে তাকাল। তরু বলল, ছেলেরা নেশা করলে মেয়েরাও করতে পারে। পারে না?

না।

না কেন? তোমরা দুনিয়ার হুজ্জত করবে আর চাইবে বাড়ির মেয়ের মাথায় ঘোমটা দিয়ে থাকবে। তসবি টানবে। তা কি ঠিক? অবশ্যই আমাকে এক বোতল ফেনসিডিল এনে দেবে।

আচ্ছা।

তোমার দুলাভাইকে নেংটা করে রাস্তায় কবে হাঁটাবে? আমাকে আগেই জানিও।

সনজু কিছু বলল না। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার চোখ-মুখ কঠিন। তার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে কিছু বলতে চায় কিন্তু বলতে পারছে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *