৪
তরিকুল ইসলামের বিরাট সমস্যা হয়েছে। হঠাৎ করে কুকুরভীতি তাঁকে কাবু করে ফেলেছে। দোতলা থেকে তিনি নামতে পারছেন না। তাঁর মনে হচ্ছে একতলায় নামলেই তিন দিক থেকে তিন কুকুর এসে তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়েও তিনি স্বস্তি পাচ্ছেন না। কুকুরের খোঁজে এদিক-ওদিক দেখছেন। কালো রঙের কিছু দেখলেই তাঁর বুক ধড়ফড় করছে। কপালে ঘাম হচ্ছে। কেন তিনি এত ভয় পাচ্ছেন নিজেও বুঝতে পারছেন না। ভয়টা সময়ের সঙ্গে বাড়ছে।
সকাল দশটা। তিনি নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে আছেন কারণ এখন তাঁর মনে হচ্ছে তিনটা কুকুরই সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে আসবে। তারা আজ দিনের মধ্যেই একটা ঘটনা ঘটাবে। তরিকুল ইসলামের ইচ্ছা করছে এই অঞ্চল ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে। বড় কোনো শহরে যেখানে কুকুরের উৎপাত নেই।
তরিকুল ইসলামের দরজায় টোকা পড়ছে। কুকুরের দরজায় টোকা দেবার ক্ষমতা নেই তারপরেও তিনি ভীত গলায় বললেন, কে?
আমি মিসির আলি দরজা খুলুন। আমি আপনার কুকুরভীতি সারিয়ে দিচ্ছি।
কীভাবে?
হিপনোটিক সাজেশান বলে একটা পদ্ধতি আছে। ঐ পদ্ধতিতে।
তরিকুল ইসলাম বললেন, কোনো পদ্ধতিতে কিছু হবে না ভাই সাহেব। তাবিজ-কবচ লাগবে।
মিসির আলি বললেন, হিপনোটিক পদ্ধতি কাজ না করলে অবশ্যই তাবিজ-কবচে যাওয়া হবে। আগে দেখি কাজ করে কি না। দরজা খুলুন। সিঁড়ির গোড়ায় আমি মাজেদকে লাঠি হাতে দাঁড়া করিয়ে দিয়েছি। কুকুর সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারবে না। বাড়ি দিয়ে কোমর ভেঙে দেবে।
তরিকুল ইসলাম দরজা খুললেন। কাতর গলায় বললেন, কাল সারা রাত জেগে ছিলাম। এক সেকেন্ডের জন্য চোখের পাতা এক করতে পারি নাই। শেষ রাতে একটু ঝিমুনির মতো এসেছে তখন স্বপ্নে দেখি দু’টা কুকুর আমার দুই পা কামড় দিয়ে ধরে আছে আর বড়টা ছিঁড়ে ছিঁড়ে আমার পেটের নাড়িভুঁড়ি খাচ্ছে।
মিসির আলি বললেন, শান্ত হোন তো ভাই। দেখি সমস্যার সমাধান করা যায় কি না।
.
তরিকুল ইসলাম চিন্তিত ভঙ্গিতে মেঝেতে বসে আছেন। তাঁর তিন ফুট সামনে মিসির আলি। মিসির আলির হাতে পকেট ঘড়ির চেইন। চেইনের মাথায় ঘড়ি। তিনি ঘড়িটা পেন্ডুলামের মতো সামান্য দুলাচ্ছেন। তাদের বাঁ দিকে খাটের উপর আয়না বসে আছে। আয়নার চোখে তীব্র কৌতূহল। আয়নার পাশেই তার মা। ঘোমটা টেনে তিনি নিজেকে আড়াল করেছেন। মহিলা কিছুটা ভয় পাচ্ছেন। তিনি এক হাতে মেয়েকে শক্ত করে ধরে আছেন।
মিসির আলি বললেন, হেডমাস্টার সাহেব!
জি।
আপনি সারা রাত ঘুমান নি এখন আপনার ঘুম পাচ্ছে। ঘুমে চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসছে।
জি।
আপনি কল্পনা করুন নতুন একটা জায়গায় বেড়াতে গেছেন। জায়গাটা ফাঁকা। গাছপালা ছাড়া আর কিছু নেই। জায়গাটা কি কল্পনায় দেখতে পাচ্ছেন? চোখ বন্ধ
করে কল্পনা করুন।
তরিকুল ইসলাম চোখ বন্ধ করে গাঢ় স্বরে বললেন, দেখতে পাচ্ছি।
জায়গাটা কেমন একটু বলুন তো?
সুন্দর। খুব সুন্দর। ফুলের বাগান আছে।
ঠাণ্ডা বাতাস কি বইছে?
জি।
ফুলের মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছেন না?
পাচ্ছি।
একটা পুরোনো কাঠের বাড়ি দেখতে পাচ্ছেন?
হুঁ।
দোতলা বাড়ি না?
জি।
খুঁজে দেখুন দোতলায় উঠার সিঁড়ি আছে। সিঁড়িটা বের করুন।
আচ্ছা।
সিঁড়ি খুঁজে বের করে আমাকে বলুন। সিঁড়ি পেয়েছেন?
পেয়েছি।
এখন সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করুন। এক একটা ধাপ উঠবেন আর আপনার চোখ গাঢ় হতে থাকবে। সপ্তম ধাপে উঠে গভীর ঘুমে আপনি তলিয়ে যাবেন। উঠতে শুরু করুন। প্রথম ধাপ উঠেছেন?
জি উঠেছি।
দ্বিতীয় ধাপ?
হুঁ।
ঘুম পাচ্ছে?
হুঁ।
তৃতীয়।
হুঁ।
আপনার শরীর ভারী হয়ে গেছে। আপনার পা তুলতেও কষ্ট হচ্ছে চতুর্থ ধাপ উঠেছেন?
হুঁ।
চতুর্থ, পঞ্চম এখন সপ্তম ধাপ উঠবেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়বেন। আপনি পা দিয়েছেন সপ্তম ধাপে।
তরিকুল ইসলাম বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। তাঁর মাথা সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে এসেছে। আয়না অপলক তাকিয়ে আছে।
মিসির আলি বললেন, তরিকুল ইসলাম সাহেব।
জি।
ঘুমাচ্ছেন? জি।
আপনার কেমন লাগছে?
ভালো।
আমি দু’বার হাততালি দেব। তালির শব্দে আপনার ঘুম ভাঙবে। ঘুম ভাঙার পর আপনি কুকুর ভয় পাবেন না। কুকুরভীতি আপনার পুরোপুরি দূর হবে।
মিসির আলি দু’বার হাততালি দিলেন। তরিকুল ইসলাম চোখ মেললেন। এদিক- ওদিক তাকাতে লাগলেন। আয়না বলল, বাবা কুকুরের ভয়টা কি গেছে?
তরিকুল ইসলাম বললেন, কুকুরের কীসের ভয়?
আয়না বলল, তুমি স্যারের জন্য মাছ কিনতে যাবে না?
তরিকুল ইসলাম বললেন, এখনই যাচ্ছি।
তিনি উঠে দাঁড়ালেন। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে এক তলায় নামলেন এবং মাছের সন্ধানে বের হয়ে গেলেন। কুকুরভীতি এখন তাঁর আর নেই। *
[* এই বইয়ে লেখা হিপনোটিক সাজেশানের পদ্ধতিটি কেউ ব্যবহার করতে চাইলে সাবধানে ব্যবহার করতে হবে। Trance state-এ চলে যাওয়া কাউকে ভুল সাজেশান কখনোই দেয়া ঠিক না। এতে বড় ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে।—হুমায়ূন আহমেদ]
.
কদম গাছের নিচে বেতের চেয়ার পাতা হয়েছে। আজ কুয়াশা কম। মিসির আলি ছাত্রের ডায়েরি নিয়ে বসেছেন। তাঁকে চা দেয়া হয়েছে। চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন।
মাজেদ অসাধ্য সাধন করেছে। সে মিসির আলির চুল টেনে দিচ্ছে। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার মিসির আলির ভালো লাগছে। ঘুম ঘুম ভাব হচ্ছে। মিসির আলি মাজেদের সঙ্গে গল্প করছেন।
মাজেদ মিয়া!
জি স্যার।
চুল টানা কোথায় শিখেছিস?
মাজেদ বলল, লেখাপড়া শিখা লাগে এইগুলা শিখা লাগে না।
কিছু একটা শেখা তো উচিত। লেখাপড়াটা শিখ।
আপনে বললে শিখব। তয় সমস্যা আছে।
কী সমস্যা?
বেতন দেয়া লাগে। মা একবার আমারে ইস্কুলে দিতে চাইল। বাপজান তারে দিল দাবর।
দাবর কী?
বড় ধমকরে বলে দাবর।
দাবর দিয়ে কী বলল?
বাপজান বলল, এই বান্দি! ইস্কুলে যে দিবি পুলার বেতন কে দিব? তর বাপে দিব?
নিজের স্ত্রীকে বান্দি বলা এটা কেমন কথা।
মাজেদ বলল, আমার বাপজানের মতো যারা গরিব তার পরিবারেরে বান্দি বললে দোষ হয় না।
মিসির আলি বললেন, তোর অনেক বুদ্ধি। তোকে পড়াশোনা করতেই হবে। বেতন আমি দিব। ঠিক আছে?
জে ঠিক আছে। তয় বাপজানের কাছে টেকা দিয়া গেলে বাপজান খরচ কইরা ফেলব। হেডস্যারের কাছে টাকা দিয়া গেলে ভালো হয়।
মিসির আলি বললেন, সবচে ভালো হয় তুই যদি আমার সঙ্গে ঢাকায় যাস। আমি লেখাপড়া দেখিয়ে দিতে পারব। যাবি?
মাজেদ বলল, এক জোড়া স্যান্ডেল কিন্যা দিলে যাব। শহর বন্দরে খালি পায়ে যাওয়া ঠিক না। এই জন্যে স্যান্ডেল।
স্যান্ডেল অবশ্যই কিনে দেব। এখন খেলতে যা। চুল টানতে হবে না।
আমি যে আপনের লগে যাইতেছি মা’রে বলব?
অবশ্যই বলবি। মা’কে বলবি, বাবাকে বলবি। তাদের অনুমতি নিতে হবে না?
মিসির আলি ডায়েরি পড়ায় মন দিলেন। ডায়েরি আজ দিনের মধ্যেই পড়ে শেষ করতে হবে। আগামীকাল ঢাকায় চলে যাবেন। হাতে সময় নেই।
.
“শ্রাবণ মাসের শেষে আমি আয়নাকে নিয়ে এলাম। সে আগ্রহ নিয়ে ঘরবাড়ি দেখল। বিশাল বারান্দা দেখে খুশি হল। দুপুরে নিজেই রান্না করল, ডিম ভাজল। ডাল রাঁধল। কাজের একটা বাচ্চা মেয়ে জোগাড় করে রেখেছিলাম আট নয় বছর বয়স। নাম আঙ্গুর। তার চুল বেঁধে দিল। চুল বাঁধতে বাঁধতে অনেক গল্প করল।
নাম আঙ্গুর। আঙ্গুর কখনো খেয়েছিস?
না।
আচ্ছা তোকে খাওয়াব। তোর স্যারকে বলব নিয়ে আসতে। বারান্দার টবে আঙ্গুরের চাষও করব। তুই গাছে নিয়মিত পানি দিবি। পারবি না?
পারব।
লেখাপড়া জানিস?
না।
লেখাপড়া শিখতে হবে। মূর্খ হয়ে থাকা যাবে না। তোর স্যারকে বলে তোকে স্কুলে ভরতি করিয়ে দেব
আচ্ছা।
গান জানিস।
রূপবান পালার গান জানি।
গেয়ে শুনা।
আঙ্গুর মাথা নিচু করে গান ধরল, ও দাইমা। দাইমা গো।
আনন্দে আমার চোখে পানি এসে গেল। সুখী পরিবার শুরু হতে যাচ্ছে। আমি আত্মীয়-পরিজন ছাড়া একজন মানুষ। সারা জীবন একা থেকেছি। একা থাকতে হবে না। সংসারে শিশু আসবে। সে হাসবে খেলবে। আমি হাঁটু গেড়ে ঘোড়া হব। সে ঘোড়ার পিঠে চড়বে। আয়না তাকে ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে ঘুম পাড়াবে—’খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশে। বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে?”
সন্ধ্যাবেলায় পরিস্থিতি অন্যরকম হয়ে গেল। আয়না ঝিম মেরে গেল। কথা বললে তাকায়, জবাব দেয় না। আমি বললাম, তোমার কি শরীর খারাপ করেছে? সে না সূচক মাথা নাড়ল। রাতে খাবার খেল না। আমি বললাম, শরীর খারাপ লাগলে শুয়ে পড়।
আয়না বলল, আমি আলাদা শোব।
আলাদা শোবে মানে?
আয়না আঙুল উঁচিয়ে গেস্ট রুম দেখিয়ে বলল, ঐ ঘরটায় শোব।
কেন?
আয়না আমার দিকে তাকিয়ে হাসল আর সঙ্গে সঙ্গে আমার কাছে মনে হল সে আলাদা ঘুমাবে এটাই তো স্বাভাবিক। সবার প্রাইভেসি আছে। একা ঘুমালে প্রাইভেসি রক্ষা হয়। স্বামীর সঙ্গে এক বিছানায় ঘুমানো হচ্ছে মধ্যযুগের বর্বরতার মতো। আধুনিক যুগে স্বামী-স্ত্রী আলাদা আলাদা ঘরে বাস করবে। স্বামী তার নিজের মতো তার ঘর সাজাবে। স্ত্রী তার রুচিমতো সাজাবে।
আমি বললাম, অবশ্যই তুমি আলাদা ঘুমাবে। সেটাই উচিত এবং শোভন।
আয়না বলল, থ্যাংক য়্যু।
তখনো আমি বুঝতে পারি নি যে আয়না আমার চিন্তা করার ক্ষমতা কনট্রোল করছে। তার ইচ্ছামতো ভাবতে আমাকে বাধ্য করছে। আমি আলাদা ঘুমুতে গেলাম। ভালো ঘুম হল। কড়া ঘুমের অষুধ খেলে যেমন ঘুম হয় তেমন ঘুম।
সকালবেলা আয়না স্বাভাবিক হয়ে গেল। হাসিখুশি। আঙ্গুর মেয়েটাকে নিয়ে অনেকগুলো ফুলের টব কিনে বারান্দায় সাজাল। শতরঞ্জি কিনে আনল। বারান্দায় বিছিয়ে আসনের মতো করল। আমাকে বলল, এটা হল আমার আসন। যখন আমার
মন খারাপ থাকবে তখন আসনে বসে থাকব।
আমি বললাম, ভালো তো!
সন্ধ্যা হবার পরপর আয়না বারান্দায় বসল। আমার মনে হল এটাই স্বাভাবিক। এখন তার কাছে যাওয়া হবে খুবই অনুচিত। সবারই নিজের আলাদা কিছু সময় থাকা দরকার। সে বারান্দায় বসে নিজের মনে ভাবছে ভাবুক না
আমি একা রাতের খাবার খেয়ে ঘুমুতে গেলাম। মরার মতো ঘুমালাম। ঘুম ভাঙল আয়নার ডাকে। সে চা বানিয়ে এনেছে। আয়না বলল, দশটা বাজে, এখনো ঘুমাচ্ছ? সকালে তোমার ক্লাস নাই?
ক্লাস নিলাম। ছাত্রভর্তি বিষয়ে প্রিন্সিপ্যাল স্যার কিছু দায়িত্ব দিয়েছেন তার পিছনে সময় দিলাম। ছাত্রদের হোস্টেলে দুই দলে মারামারি হয়েছে। আমি হোস্টেলের অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার। দুই দলকে শান্ত করার প্রক্রিয়ায় বেশ সময় গেল। আমি নানান কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত কিন্তু মন পড়ে আছে বাসায়। সারাক্ষণ আয়নাকে নিয়ে ভাবছি। আমি যে তার হাতের পুতুল হয়ে গেছি। এই বিষয়টা পরিষ্কার।
গভীর প্রেম মানুষকে পুতুল বানিয়ে দেয়। প্রেমিক প্রেমিকার হাতের পুতুল হন কিংবা প্রেমিকা হয় প্রেমিকের পুতুল। দু’জন একসঙ্গে কখনো পুতুল হয় না। কে পুতুল হবে আর কে হবে সূত্রধর তা নির্ভর করে মানসিক ক্ষমতার উপর। মানসিক ক্ষমতা যার বশি তার হাতেই পুতুলের সুতা
আমার সুতা আয়নার হাতে। সে আমাকে নিয়ে খেলছে। কিন্তু কেন? আমার জন্য তার কোনো ভালবাসা কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে না। সে আছে সম্পূর্ণ তার নিজের ভুবনে।”
.
মিসির আলি খাতা বন্ধ করলেন। তরিকুল ইসলাম মাছ নিয়ে ফিরছেন। হাসিমুখে বললেন, আপনি বিরাট ভাগ্যবান মানুষ। আপনার কপালের কারণে এত বড় কৈ মাছ পেয়েছি। দেখেন মাছ দেখেন। ছবি তুলে রাখার মতো মাছ।
মিসির আলি চোখে-মুখে আগ্রহ ফুটিয়ে মাছ দেখলেন।
এই সাইজের কৈ কখনো দেখেছেন?
না।
পেটের আঁশে লাল চকচকে ভাব দেখছেন?
জি।
এটা হল রানী কৈয়ের লক্ষণ।
মিসির আলি বললেন, কৈ মাছে রাজা-রানী আছে?
অবশ্যই আছে। আজ হল কৈ দিবস। কৈ মাছের ভাজা খাবেন। মটরশুঁটি দিয়ে ঝোল খাবেন। আরেকটা আইটেম হল কৈ মাছের ভর্তা।
কৈ মাছের ভর্তাও হয়?
তরিকুল ইসলাম আনন্দিত গলায় বললেন, আপনারা যারা শহরবাসী তাদের ধারণা শুধু টাকি মাছের ভর্তা হয়। কৈ মাছেরও ভর্তা হয়। কৈ ভর্তার পাশে অন্য ভর্তা দাঁড়াতেই পারবে না। আজকের প্রতিটা আইটেম আমি রান্না করব।
আপনি রাঁধতেও পারেন?
তরিকুল ইসলাম বললেন, ভালো কোনো মাছ পেয়ে গেলে অন্যের হাতে ছাড়তে ইচ্ছা করে না।
রান্না শিখেছেন কোথায়?
মা’র কাছে শিখেছি। মা রান্না করত আমি পাশে বসে থাকতাম। আজ আমি রান্না করব আপনি পাশে বসে থাকবেন। রান্না দেখার মধ্যেও আনন্দ আছে।
.
মিসির আলি অবাক হয়ে লক্ষ করলেন রান্না দেখে তিনি আনন্দ পাচ্ছেন। রান্না বিষয়টাতে যে এত ধরনের জটিলতা আছে তা তিনি আগে লক্ষ করেন নি। আগুনের আঁচ বাড়ানো হচ্ছে, কমানো হচ্ছে। পাতিলের উপর কখনো ঢাকনা দেয়া হচ্ছে কখনো বা সরিয়ে ফেলা হচ্ছে।
তরিকুল ইসলাম বললেন, আজ খাওয়া শুরু হবে উচ্ছে ভাজি দিয়ে। ভয়ংকর তিতা। তিতা দিয়ে শুরু করলে কি হয় জানেন?
কী হয়?
প্রথমেই শরীরের সিস্টেমে ধাক্কা লাগে। শরীর সেই ধাক্কা খেয়ে অন্য খাবারগুলোর জন্য তৈরি হয়। বাকি খাবারগুলো তখন অসাধারণ লাগে।
রান্না চলেছে আর চলছে তরিকুল ইসলাম সাহেবের মুখ। তিনি কথার রেলগাড়ি চালিয়েছেন। সব কথাই খাদ্য সম্পর্কিত।
মিসির আলি সাহেব! রিঠা মাছ খেয়েছেন?
খেয়েছি মনে হয়। নাম মনে করতে পারছি না।
রিঠা এমন মাছ যে একবার খেলে ভুলবেন না। রিঠা সম্পর্কে কবিতাই আছে—
‘রিঠা
হাড়ে গোশতে মিঠা।’
মিসির আলি বললেন, একবার খেয়ে দেখতে হয়।
তরিকুল ইসলাম বললেন—ঢাকা শহরে এই মাছ পাবেন ঠিকই—সবই মরা। বরফ দেয়া। রিঠা মাছ জীবন্ত অবস্থায় কিনতে হয়। কাটার দশ মিনিটের মাথায় রান্না করতে হয়। দশ মিনিট পরে রান্না করবেন মাছ লাগবে বালির মতো।
তাই নাকি?
অবশ্যই। মহাশোল খেয়েছেন? আমরা বলি মাশুল। পাহাড়ি নদীর মাছ। অনেকটা রুই মাছের মতো তবে মুখটা রুই মাছের চেয়ে লম্বা। হঠাৎ হঠাৎ পাওয়া যায়।
মাশুল মাছ নিয়ে কোনো ছড়া কি আছে?
অবশ্যই আছে—‘মাশুল মাছ আইছে। জমি বেইচা খাইছে।’ এই মাছ রান্না হলে শ্বশুর জামাইকে না দিয়ে নিজে খায়।
খাওয়াদাওয়া মিসির আলির কাছে কখনোই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তরিকুল ইসলামের পাল্লায় পড়ে তাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াল। কৈ মাছ তিনি বেশ আরাম করেই খেলেন।
দিনের বেলা ঘুমানোর অভ্যাসও ছিল না। আজ খাওয়াদাওয়ার পর লেপ গায়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুম ভাঙল সন্ধ্যায়। চোখ মেলেই দেখেন চায়ের কাপ হাতে আয়না দাঁড়িয়ে। আয়না বলল, এই নিয়ে আপনার কাছে তিনবার এসেছি। আপনি ঘুমাচ্ছিলেন দেখে জাগাই নি। বিছানায় বসে চা খাবেন না বারান্দায় বসবেন?
মিসির আলি বললেন, বিছানাতেই বসি। তুমিও চেয়ার টেনে বস। আমার ধারণা তুমি কিছু বলতে চাও। সেটা কী?
হিপনোটিক সাজেশানের বিষয়টা জানতে চাই। এত সহজে একজনকে ঘুম পাড়ানো যায় আমি জানতাম না।
মিসির আলি বললেন, মানুষের ব্রেইন অদ্ভুত কোনো কারণে এমনভাবে তৈরি যে অন্যের কথায় প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়। কারো সামনে চোখ বন্ধ করা মানে তার আয়ত্তে চলে যাওয়া।
কেন এরকম?
মিসির আলি বললেন, আমি পুরোপুরি জানি না। তবে এর Deep rooted কারণ থাকতে পারে। শুরুতে মানবগুষ্ঠি ভয়ংকর বিপদে থাকত। তাদেরকে দলপতির সব কথা শুনতে হতো। দলপতির নির্দেশ না মানার অর্থ হচ্ছে মৃত্যু। বিশেষ করে রাতে, যখন চারদিক অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আমাদের জিন সেই ভাবেই তৈরি। আমরা অতি সুসভ্য প্রাণী কিন্তু আমাদের একটা অংশ প্রাচীন পৃথিবীর।
আয়না বলল, আপনি যখন কাউকে সাজেশান দিচ্ছেন তখন সে আপনাকে লিডার মানছে। যা করতে বলছেন তা-ই সে করছে?
অনেকটা সে রকম।
আমাকে হিপনোটাইজ করতে পারবেন?
চেষ্টা করে দেখতে পারি।
আমি কি আপনাকে হিপনোটাইজ করতে পারব? আপনি যেভাবে করেছেন
সেভাবে।
মিসির আলি বললেন, পারবে। কারণ আমি তোমাকে সাহায্য করব। প্রাণপণে নিজেকে আড়াল রাখার চেষ্টা করব না। তা ছাড়া প্রকৃতি প্রদত্ত এই ক্ষমতা তোমার ভালোভাবেই আছে। তোমার স্বামীকে তুমি তোমার ছবি আয়নায় দেখিয়েছ। হিপনোটাইজ করেই দেখিয়েছ।
কেন বলছেন?
প্রথমে তুমি তোমার স্বামীকে টেলিফোন করলে। অনেকদিন তোমার সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই। সে তোমার কণ্ঠস্বর শুনেই মন্ত্রমুগ্ধ। তখন তাকে বললে আয়না দেখতে। সে সাজেশান পেয়ে গেল। তার প্রবল তৃষ্ণা হল আয়নায় তোমাকে দেখার দেখতে পেল। আয়নায় মানুষ নিজের ছবি দেখে। সে কিন্তু নিজের ছবি দেখে নি। এর অর্থ একটাই আয়নার পুরো ব্যাপারটাই তার কল্পনা।
আয়না বলল, স্যার আরেক কাপ চা কি আপনাকে দেব?
মিসির আলি বললেন, আর চা খাব না।
আয়না বলল, আগামীকাল চলে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ।
আয়না মাথা নিচু করে হাসল। মিসির আলি বললেন, হাসছ কেন?
আয়না বলল, আগামীকাল আপনি যেতে পারবেন না।
কেন যেতে পারব না?
আয়না বলল, ঘুম ভাঙার পর আপনার মনে হবে কী দরকার ঢাকা যাওয়ার? আরো কয়েকটা দিন থাকি। ঢাকায় আমার তেমন জরুরি কাজও তো নেই। এখানে দু’দিন থাকবেন বলে এসেছিলেন। স্যার, সাত দিন পার হয়েছে। এত দিন পার হয়েছে আপনি নিজেও কিন্তু জানেন না।
মিসির আলি অবাক হয়ে বললেন, সাত দিন পার হয়েছে! কী বল তুমি?
আয়না বলল, জি স্যার, সাত দিন। আমি আপনাকে আটকে রেখেছি। আমি যখন আপনাকে যেতে দেব তখন যেতে পারবেন। তার আগে না।
মিসির আলি বললেন, তোমার ধারণা তোমার অনেক ক্ষমতা?
আয়না শান্ত গলায় বলল, স্যার আমার অনেক ক্ষমতা। আমি নিজে না বললে আমার বিষয়ে আপনি কিছুই জানতে পারবেন না। আপনার ছাত্রও কিচ্ছু বুঝতে পারে নি। আপনি শুধু শুধুই তার খাতা পড়ছেন।
পড়া বন্ধ করতে বলছ?
না।
আমাকে যেতে দিচ্ছ না কেন?
আয়না বলল, মনে হয় আমি আপনার প্রেমে পড়েছি।
হতভম্ব মিসির আলি বললেন, কী বলছ তুমি?
আয়না বলল, প্রেমে পড়া অতি তুচ্ছ এবং হাস্যকর একটা জৈবিক বিষয়। এখানে আধ্যাত্মিকতার কিছু নেই। আমি আপনার ছাত্রের স্ত্রী নই। আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। আমার প্রেমে পড়তে সমস্যা কী? আমি আপনার সঙ্গে ঢাকা যাব। মাজেদ একা কেন যাবে?
মিসির আলি তাকিয়ে আছেন। তাঁর বুক ধড়ফড় করছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। কী বলছে এই মেয়ে!
আয়না বলল, স্যার আপনি এত নার্ভাস হয়ে গেছেন কেন? আমি আপনার সঙ্গে ঠাট্টা করছি। আপনি লজিক বুঝেন, কত কিছু বুঝেন। ঠাট্টা বুঝেন না? আশ্চর্য তো।
.
বিড়ালের ম্যাও ম্যাও শব্দ আসছে। মিসির আলি বারান্দায় এসে অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখলেন। মাজেদের কোলে মিশমিশে কালো এক বিড়াল। হেডমাস্টার সাহেব বিড়ালটার পা চেপে ধরে আছেন। বিড়াল উদ্ধার পাবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। মাঝে মাঝে কামড়াতেও যাচ্ছে।
মিসির আলি বললেন, কী ব্যাপার?
তরিকুল ইসলাম বললেন, গলায় কৈ মাছের কাঁটা ফুটেছে। কৈ মাছের কাঁটা বড়শির মতো। একবার ফুটলে ছাড়ন নাই। এই কারণেই বিড়ালের পা ধরে বসে আছি।
বিড়ালের পা ধরলে গলার কাঁটা যাবে?
তরিকুল ইসলাম বললেন, অবশ্যই যাবে। গলার কাঁটা দূর করার এটাই একমাত্র অষুধ। প্রতিটি পা একবার করে ধরতে হয়। তিনটা পা ধরেছি। একটা বাকি আছে। ঐটা ধরা মাত্র কাঁটা চলে যাবে।
তরিকুল ইসলাম চতুর্থ পা ধরলেন। বিড়াল তাঁকে কামড়াতে গেল। তিনি পা ছেড়ে দিয়ে বললেন, কাঁটা নাই। বিদায়।