ডা. ভারমান চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছেন। লিলিয়ানের মনে হলো তিনি হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করছেন। যে-কোনো মুহূর্তে হেসে ফেলবেন। হাসবেন তাহেরের মতো শব্দ করে। লিলিয়ান খুব লজ্জায় পড়বে। সে-রকম কিছু হলো না। ডা. ভারমান হাসলেন না। চোখ থেকে চশমা খুলে ফেলে। কচি পরিষ্কার করতে করতে বললেন, তুমি আবার দুঃস্বপ্ন দেখেছি?
হ্যাঁ।
মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন দেখা তো খুব স্বাভাবিক লিলিয়ান। আমরা সুন্দর স্বপ্ন যেমন দেখি দুঃস্বপ্নও দেখি।
ডা. ভারমান, আমি তা জানি। কিন্তু আমার স্বপ্ন অন্য রকম।
অন্য রকম বলতে কী বোঝাচ্ছ?
আপনাকে ব্যাখ্যা করতে পারব না। তবে আমার মনে হয় স্বপ্নে কেউ আমাকে কিছু বলার চেষ্টা করছে।
তুমি ঠিকই ধরেছি। স্বপ্নে কেউ তোমাকে কিছু বলার চেষ্টা করছে–এটা ঠিক। অবশ্যই বলার চেষ্টা করছে। সেই কেউটা হচ্ছে–তুমি নিজে। তোমার নিজের সাবকনশাস। মাইন্ড তোমার কনশাস। মাইন্ডকে তথ্য দিতে চাইছে।
ডক্টর! তা কিন্তু না। তাহেরের মহাবিপদ সম্পর্কে আমাকে কেউ একজন সাবধান করছে।
ডা. ভারমান এবার হাসলেন, তবে শব্দ করে না। নিঃশব্দে। শিশুদের প্রবোধ দেয়ার জন্য বড়রা যেমন হাসে তেমন হাসি।
শোন লিলিয়ান, ছেলেটা সম্পর্কে তোমার নিজের মধ্যেই এক ধরনের ভয় আছে। সেই ভয় হচ্ছে ছেলেটিকে হারানোর ভয়। এই ভয়ের উৎপত্তি হলো ভালোবাসায়। কাউকে গভীরভাবে ভালোবাসলেই এই ভয় তৈরি হয়। মনে হয়–এক সময় ভালোবাসার মানুষ আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। তখন আমব কী হবে? অবচেতন মনে ধীরে ধীরে ভয় জমা হতে থাকে… তোমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।
আপনাকে আমি বোঝাতে পারছি না–আমি স্বপ্নে তাহেরদের প্রাচীন বসতবাড়ি স্পষ্ট দেখেছি। আমি সে বাড়ির লোহার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিলাম।
তুমি তোমার কল্পনার একটি বাড়ির লোহার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিলে।
ডা. ভারমান, আমি কিন্তু নিশ্চিত জানি একদিন ঐ বাড়িতে আমরা যাব–তাহের ভয়ঙ্কর বিপদে পড়বে।
যদি জানো তাহলে ঐ বাড়িতে যেও না।
আমাদের যেতেই হবে। এটা হচ্ছে নিয়তি। যা ঘটবার তা ঘটবেই।
লিলিয়ান তুমি তোমার নিজের যুক্তিতে আটকা পড়ে যাচ্ছ — যা ঘটবার তা যদি ঘটে তাহলে তোমাকে স্বপ্লে সাবধান করার প্রয়োজন কী?
লিলিয়ান চুপ করে রইল। ডা. ভারমান শান্ত গলায় বললেন, তুচ্ছ জিনিস নিয়ে এত ভেবো না। তুচ্ছ জিনিসকে তুচ্ছ করতে শেখ।
লিলিয়ান উঠে দাঁড়াল। ক্লান্ত গলায় বলল, আমি ওদের বাড়ি স্বপ্নে সত্যি দেখেছি। দেখামাত্ৰ চিনতে পারব। লোহার প্যাচানো সিঁড়ি.
লিলিয়ান আমি তোমাকে ঘুমের ওষুধ দিচ্ছি। রাতে ঘুমুতে যাবার এক ঘণ্টা আগে দুটা ট্যাবলেট খাবে। মনে থাকবে?
থাকবে।
ডক্টর ভারমান নিশ্চয় খুব কড়া ঘুমের ওষুধ দিয়েছেন। ওষুধ খাবার পরপর লিলিয়ানের মনে হলো সে তলিয়ে যেতে শুরু করেছে। কোনো গভীর খাদে পড়ে গেছে–নিচে নেমে যাচ্ছে। অতি দ্রুত নেমে যাচ্ছে। খাদটা অন্ধকার এবং শীতল। লিলিয়ানের ভয় ভয় করতে লাগল। মনে হয়। এই ঘুম তার আর ভাঙবে না। কেউ ভাঙতে পারবে না। সে বিরাট এই বাড়িতে মরে পড়ে থাকবে। কেউ জানবেও না।
ক্রিং ক্রিং ক্রিং!
কীসের শব্দ? টেলিফোন, না কেউ এসে কলিং বেল টিপছে? না-কি গীর্জার ঘণ্টার শব্দ? তাদের বাড়ির কাছেই ক্যাথোলি ক চার্চ। ওরা মাঝে মাঝে ঘণ্টা বাজায়! কেউ মারা গেলে ঘণ্টা বাজায়। কে মারা গেছে? তাহের? তাহেরেব কি কিছু হয়েছে? প্লেন দুর্ঘটনার খবর টিভি খুব ফলাও করে প্রচার করে। ট্রেন বা বাস দুর্ঘটনার খবর কোনো পাত্তা পায় না। এর কারণ কী?
ক্রিং ক্রিং ক্রিং।
লিলিয়ান টেলিফোন তুলে ক্লান্ত গলায় বলল, হ্যালো!
ওপাশ থেকে তাহেরের গলা পাওয়া গেল।
হ্যালো লিলিয়ান–আমি। তুমি কেমন আছ?
ভালো।
গলা শুনে তো ভালো মনে হচ্ছে না। অসুখ-বিসুখ করেছে না-কি?
না, ঘুম পাচ্ছে।
এখনই ঘুম পাচ্ছে কেন? রাত তো বেশি হয় নি। কটা বাজে তোমাদের ওখানে?
দশটা।
দশটা তো তেমন বাত না। তুমি ঘুমে কথা বলতে পারছি না। ব্যাপার কী?
আমি ঘুমের ওষুধ খেয়েছি।
কেন?
কয়েক রাত ধবে আমার ঘুম হচ্ছে না। আমি দুঃস্বপ্ন দেখছি।
ও আচ্ছা।
লিলিয়ান জড়ানো স্বরে বলল, তোমাকে একটা জরুরি কথা জিজ্ঞেস করি। খুব জরুরি। আচ্ছা, তোমাদের গ্রামের বাড়িটা বিশাল না?
হ্যাঁ বিশাল। হঠাৎ এই প্রসঙ্গ কেন?
কারণ আছে। এখন বলে তোমাদের বাড়ির বাইরেব দিকে ছাদ পর্যন্ত লোহার প্যাচানো সিঁড়ি আছে না?
না নেই।
আগে এক সময় ছিল। এখন নেই।
কখনো ছিল না। কোনো কালেও ছিল না। সিড়ির কথা এলো কেন?
এখন কথা বলতে পাবিব না–খুব ঘুম পাচ্ছে।
হ্যালো লিলিয়ান–হ্যালো।
লিলিয়ান টেলিফোন নামিযে রেখে সোফাব ওপর ঘুমিয়ে পড়ল। আবার ঘুম ভাঙল টেলিফোনেব শব্দে। লিলিয়ান জড়ানো গলায় বলল, হ্যালো।
মিসেস লিলিয়ান।
ইয়েস।
ইউনাইটেড ট্রাভেল এজেন্সি থেকে বলছি–আপনি ভিয়েনার বুকিং চেয়েছিলেন। আগামীকাল বুকিং পাওয়া গেছে। লন্ডন ফ্রাংকফোর্ট হয়ে ভিয়েনা। লন্ডনে একরাত থাকতে হবে।
কোথায় থাকব?
এয়ারপোর্ট হোটেল। এয়ারপোর্টের কাছেই।
আচ্ছা, এই হোটেলে কি প্যাচানো লোহার সিঁড়ি আছে?
ম্যাডাম আপনি কী বলছেন বুঝতে পারছি না। লিলিয়ান টেলিফোন রেখে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের মধ্যে সেই প্যাচানো সিঁড়ি আবার দেখল। সে সিড়ি দিয়ে নামছে। অতি দ্রুত নামছে। সিঁড়ি কাঁপছে–মনে হচ্ছে পড়ে যাবে। লিলিয়ান ঘুমের মধ্যেই ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।